বংশগৌরবকে পায়ে দলে মিশে গিয়েছেন লড়াকু জনতার মাঝে, তাদেরই একজন হয়ে। জনগণের কাছ থেকে শিখেছেন আবার তাদেরই বিলিয়ে দিয়েছেন। মানুষের ভালোবাসা বীর বিরসা মুণ্ডাকে যেমন ‘ভগবান’-এর আসনে বসিয়েছিলেন তেমনই বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় হয়ে গিয়েছিলেন ‘ঠাকুর’।
দীর্ঘ জেলজীবন তাঁর শরীরকে ভেঙ্গে দিয়েছিল, গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় জেল থেকে মুক্তি পান। এরপর বিজ্ঞানসম্মত চাষের কৌশল, বিভিন্ন ফসল কিভাবে আরো উন্নত আকারে উৎপন্ন করা যায় সে নিয়ে গবেষণা করেছেন। শিখেছিলেন গাছে কলম বাঁধার বহু উপায়, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছচাষ, পশুচিকিৎসা। ভেষজ গাছগাছড়া, কুটিরশিল্প ইত্যাদি নিয়েছিল গভীর আগ্রহ। একজন অভিজ্ঞ চাষীর মতোই জানতেন মাটির প্রকৃতি, সারের ব্যবহার, ফসলের গুণাগুণ! বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিষ্টু ঠাকুর পারদর্শী ছিলেন এস্রাজ বাজানোতে, ‘মেহনতি মানুষ' নাম দিয়ে তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়। কৃষক আন্দোলনের পটভূমিকায় কিছু ছোটো গল্প লিখেছেন। যাদের জন্য সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই গরীব কৃষকদের জন্য স্কুল, বয়স্কদের নৈশ বিদ্যালয়, বিশ্বভারতীর লোকশিক্ষা সংসদের পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন তিনি।
এই সর্বস্ব ত্যাগী মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবীর শেষজীবন বড়ই মর্মান্তিক! বেদনার। দেশভাগের পর একে একে তাঁর অনেক সাথীই দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন ভারতবর্ষের নিরাপদ আশ্রয়ে, আসেননি তিনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে শুরু করে দেশি শাসকদের বিরুদ্ধে সাহসী যোদ্ধা, আজীবন বিপ্লবী স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে চুপ করে থাকেননি। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১-এর ১১ই এপ্রিল, নির্জন দুপুরে ইয়াহিয়া খানের প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকবাহিনী চে গেভারা সদৃশ এই মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে! অবিভক্ত বাংলার লাখো লাখো শ্রমজীবী জনতার প্রিয় বিষ্ণু ঠাকুরের জীবন দীপ নিভে গেল এভাবেই! “Entire section of the world history have no other existence than what the oppressor permitted us to know of them.”-ঐতিহাসিক জ্যাঁ শ্যেনোস (Jean Chesnequx)