পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্রা তাহাকে চপেটাঘাতপুৰ্ব্বক গৃহে গিয়া বালকের দ্যায় রোদন করিয়াছিলেন । মদ্যপানে মামুঘ যে কিরূপ পশুর অধম হইয় পড়ে, এই দৃষ্টান্তে তাহ তিনি শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন । তিনি মদ স্পশ করিতেন না । কৰ্ম্মেশ্বর পারতপক্ষে ইংরাজদের সহিত মিশিতেন ন–কিন্তু দেখা হইলে নত হইয়া সেলাম করিতে বা “মন-যোগান’ কথা কহিতে ক্রটি করিতেন না। জমীদারের পক্ষে কাৰ্য্য-উদ্ধারের ইহাই অব্যর্থ ‘পলিসি’ বলিয়া সেকালে জ্ঞান ছিল । কিন্তু কলেজের শিক্ষাদীক্ষণর ফলে অতুলেশ্বরের ভিন্নরূপ মেজাজ হইয়া উঠিল, কোন ম্যাজিষ্ট্রেট দেখা করিতে আসিলে বা তিনি কাহারও নিকট গমন করিলে কখনও সেলাম করিতেন না । কিন্তু যেখানে কৰ্ম্মেশ্বর সেলাম করেন—সেখানে তাহার ভ্রাতুপুত্র কেবল সেকহাণ্ড করিবার জন্ত হাত বাড়াইয়া দিলে দেখায় নিতান্ত অদ্ভুত, সেই জন্ত কৰ্ম্মেশ্বরের নিকটে কোন ইংরাজ আসিলে, তিনি সেখানে অনুপস্থিত থাকিতেন । তাহাতে কৰ্ম্মেশ্বর অসন্তুষ্ট হইতেন। এক দিন কিন্তু অতুলেশ্বর ধরা পড়িলেন। কলিকাতা হইতে ফিরিয়া বৈঠকখানায় পদার্পণ করিয়াই দেখিলেন--কৰ্ম্মেশ্বর দুই এক জন ইংল্লাজের সহিত বসিয়া গল্পগুজব করিতেছেন। কুমার আসিতেই তিনি পরস্পরের সহিত পরিচয় করিয়া দিলেন । কিন্তু অতুল ত কই কাহ:কেও সেলাম করিল না । হাস্তমুখে সকলকে হাত বাড়াইয়া দিল । কৰ্ম্মেশ্বর মনে মনে প্রমাদ গণিলেন,—এক দিন যে এ শিক্ষার ফলভোগ করিতে হইবে, তাহাতে র্তাহার মনে সন্দেহ রছিল না । অতুলেশ্বর যে-কয়দিন বাড়ী রছিলেন, পুনঃপুনঃ নিজের কাছে ডাকিয়া ত্যানিয়া তাহাকে হিতোপদেশ দিতে লাগিলেন । সে-কয়দিন ভাবনাম-চিন্তায় মদের গ্লাস পর্য্যন্ত র্তাহার মুখে উঠিল না—সভা নিস্তব্ধভাব ধারণ করিল,--মোসাহেবগণ মুখে নিদ্রা দিয়া বাচিল । কিন্তু কৰ্ম্মেশ্বরের উপদেশের ফল যে নিতান্তই বিফলে পরিণত হইয়াছে,—অচিরাৎ রাজা এক দিন বুঝিতে পারিলেন। ইলবার্টবিলের সময় বালক অতুলেশ্বর প্রসাদপুরে এক প্রতিবাদসভা আহবান করিয়া স্বয়ং হইলেন তাহার প্রেসিডেণ্ট । ইহার পর ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আসিয়া কৰ্ম্মেশ্বরের সহিত কে জানে, কি কথাবার্তা কহিয়া গেলেন, রাজ্যে ঘোষিত হইল—অতুলেশ্বর এখন নাবালক— তাহার কোন কাৰ্য্যকলাপ রাজার অমুমোদিত নহে। কুমার অতুলেশ্বরের কোন কাৰ্য্যে প্রজাগণ যেন ుని যোগদান না করে। ইহার অব্যবহিত পুৰ্ব্বে অতুলেশ্বর ব্যায়াম-সমিতি প্রভৃতি দেশহিতকর নানা সভা-সমিতি স্থাপন করিয়াছেন ; রাজার আদেশে —অকালে সে সমস্তই নষ্ট হইয়া গেল। কুমার মৰ্ম্মপীড়িত হইয়া কলিকাতায় চলিয় গেলেন । সেখানে তিনি নানারূপ দেশহিতকর অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন –কিন্তু নিজের রাজ্যে তিনি নগণ্য পুরুষ হইয়া রছিলেন । কাৰ্য্যতঃ কিছু করিতে না পারিলেও গানে কবিতায় তাহার দেশানুরাগ প্রকাশিত হইতে লাগিল । কৰ্ম্মেশ্বরের মৃত্যু হইল—জ্যোতিৰ্ম্মী জন্মিবার দুই একমাস মাত্র পুৰ্ব্বে । অতুলেশ্বর যখন রাজা হইলেন, তখন তাহার বয়স চবিবশের অধিক নহে । তাহার পর রাজার জীবনে যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছে এবং তাছার ফলে তাহার জীবনের গতি কোন দিকে ফিরিয়াছে, তাহ পাঠক অবগত আছেন । .* প্রাসাদসংলগ্ন নবনিৰ্ম্মিত গৃহে বসিয়া রাজা অতুলেশ্বর লেখাপড়া করেন । গৃহে জানালা-দরজা অনেকগুলি ; দক্ষিণের জানালা হইতে শীতকালে যে নদী রজত-পাতের মত নয়নে প্রতিভাত হয়,--বর্ষাকালে ইহাই বিশাল অণকার ধারণ করিয়া তেজস্বিনী, স্রোতস্বিনী মূৰ্ত্তিতে রাজবাটীর অনতিদূরে বহিয়া যায়। গৃহের সম্মুখেই মুক্তছাদ-সকালে সন্ধ্যায় রাজা এইখানে বসিয়া প্রকৃতির শোভা সন্দর্শন করেন—জ্যোতিৰ্ম্ময়ী সময় পাইলেই পিতার কাছে আসিয়া দাড়ায় । আসিবার সময় বাগান হইতে র্তাহার জন্ত কতকগুলি ফুল তুলিয়া আনে । রাজা প্রভাতে অরুণরাগ-রঞ্জিত আকাশে নবেদিত সুর্য্যের শোভা দেখিয়া তন্ময়ভাবে স্বরচিত গানে ঈশ্বরবন্দন করেন— বালিকা মুগ্ধভাবে তাহা শুনিয়া—তাহীর সঙ্গে সঙ্গে তান ধরে । বৈকালিক বায়ু-সেবনের পরও প্রশাস্ত রজনীতে পিতাপুত্রীতে এইখানে আসিয়া বসে । রাত্রি জ্যোৎস্নময়ী হইলে রাজা কন্যাকে সেতার বাজাইতে বলেন ; কখনও কখনও তাহার হাত হইতে সেতারাটা টানিয়া লইয়া নিজেই বাজাইতে থাকেন। জ্যোতিৰ্ম্ময়ীর সেতারশিক্ষা হইয়াছে তাহার পিতারই নিকটে । মাঝে মাঝে রাজা যখন কস্তার সংস্কৃত বিদ্যার পরীক্ষা গ্ৰহণ করেন, তখনই জ্যোতিৰ্ম্ময়ী মনে মনে বিপদ গণে । বিদ্যাশিক্ষায় সে যে আশানুরূপ মনোযোগ দিতে পারিতেছে না, ইহা সে নিজে বেশ বোঝে। রাজা কিন্তু পরীক্ষায় অসন্তুষ্টির কোন কারণ পান