পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৬২ আনন্দমত্ততা অনুভব করিতেছিলেন ; কিন্তু অনাদির শেষ কথায় তিনি একটা চাপ। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হতাশার স্বরে কহিলেন, “আমাদের ব্যবহার্য্য সমস্ত জিনিষ যে দিন দেশ থেকেই পাওয়া যাবে—সে দিন সত্যট সত্যযুগ ফিরে আসবে। আসবে, সে দিন আসবে ভাই—এ অাশা আমিও করি—কিন্তু এখনো বিলম্ব আছে। সেজন্য প্রস্তুত হ’তে এখনো অামাদের অনেকটা সময় লাগবে ।” অনাদি কছিলেন, “অর্জনে বিলম্ব থাকিলেও বর্জনে ত আমি কোন বাধা দেখিনে । এক র্কাচের চুড়িগুলো থেকেই কোটি কোটি টাকা বিলাতে চলে যাচ্ছে। এমন কত সপের জিনিষ,—ফিতা, পাউডার, সেণ্ট—“ পণ্ডিত মহাশয় অনাদিকে বাধা দিয়া কহিলেন, “বাবাজি,—সখের জিনিষকে তোমরা যতটা হেয়ঞ্জান কর, সহজ-ত্যজ্য ভাব, আসলে তা মোটেই নয়। এই যে বিশ্বব্ৰহ্মাওরূপ মহাস্থষ্টি, এটা বিধাতার সন্থ ছাড়া আর কি বল ত হে বাপু ? এই স্বষ্টির মূলে প্রয়োজনটা যে কি ছিল, আজও পর্য্যস্ত কোন মুনি ঋষি তার সন্ধ্যান পান নি ।” জ্যোতিৰ্ম্ময়ী কহিলেন, “তা সত্যি, সংসারে প্রয়োজনীয় খরচের চেয়ে সখের খরচই বেশী, তাতে সন্দেহ নেই।” এই অনুমোদন বাক্যে পণ্ডিত মহাশয়ের আনন্দ, তাহায় দাউীর টানকে দ্বিগুণিত করিয়া তুলিল। তিনি কহিলেন, "দেখেছ ত মা, হাড়ি ডোমের মেয়েদের অঙ্গে কাসার গহনার চাপ ! সেই সখের ভারকে তারা পালকের মতই লঘু জ্ঞান করে!” অনাদি বলিয়া উঠিল, “ফিনক্ষিনে বিলিতি কাচের চুড়ির চেয়ে কাসার চাপও ঢের ভাল মশায়, সে যে আমাদের মাতৃভূমির দান!” “আমিও বলি সে ঢের ভাল ।” পণ্ডিত মহাশয় উত্তেজিত স্বরে কহিলেন, “কিন্তু জননী যার প্রতি বিমুখ, তার দান যে হতভাগ্য পায় নি, তারও ত প্রাণে সখ আছে, তখন তার সখ মেটাবার সহজ উপায়—স্বল্পমূল্য বিলিতি জিনিষ ব্যবহার কর।” —জান ত বাৰাজি, সন্ন্যাসী ফকীরদেরও সথের হাত থেকে অব্যাহতি নেই। লাল বাবুর গল্প শুনেছ বোধ হয় ? তিনি সংসারের মায়া ত্যাগ ক’রেও ভোগমুখ একেবারে ত্যাগ করতে পারেন নি। গাছতলায় গুয়েও ইটের উপর মাখা রেখে নিদ্রা দিচ্ছিলেন, তার পর পথিক স্ত্রীলোক ছুইজনের ব্যঙ্গোক্তিতেই নাকি এ ঘুম তার ভেঙ্গে ৰায়।” স্বর্ণকুমারী দেবীর গ্রন্থাবলী অনাদি কছিল, “আপনিও এ সম্বন্ধে টোলের পণ্ডিতের নাম রাখতে পারবেন। দেখেছ দিদি, পণ্ডিত মহাশয়ের দাড়ীটা দিকে দিন কি রকম চকৃচকে হচ্ছে ? বিলিতি ব্রসের টানটা এর উপর যে ভাল ক’রেই পড়ছে, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই।” পণ্ডিত মহাশয় দেয়ালেয় আরণীর দিকে সচকিত দৃষ্টিপাত করিলেন, কিন্তু তাহার মাথার অৰ্দ্ধেকখান ছাড়া আকাঙ্ক্ষিত প্রতিবিম্ব তাছাতে দেখিতে পাইলেন না । তিনি একটু অপ্রস্তুত ভাবেই উত্তর করিলেন, বাবাজি, আমরা লঘু খড়, তোমাদের ইঙ্গিতেই আমরা চলি ফিরি, দৃষ্টান্ত দেখাও, গতি আপন হ’তেই ফিরবে ।” অনাদি বলিয়া উঠিল, “সেই কথাই ত এতক্ষণ ধ’রে রাণীদিদিকে বলছি " রাজকুমারী ভাই, দোকানদায়দের ভাল ক’রে জানিয়ে দাও যে, বিলিতি জিনিষ রাখলে তাদের বিপদে পড়তে হবে ।” রাজকুমারী উত্তর করিলেন, “ন। অনাদি, বিলিতি জিনিষ একেবারে বর্জন করার সময় এখনো আসে নি। সেইজন্য কিছু দিন ধ’রে এখনো আমাদের প্রস্তুত হ’তে হবে। ভেবে দেখ ছ বেলা স্থ’ মুষ্টি অল্প যে সব লোকের মেলে না, তাতের দামী কাপড় কিনে পর কি তাদের সাধ্য ? তাত-শিল্পকে উদ্ধার করবার সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানারও বিস্তৃত আয়োজন চাই, নইলে বিলিতি সস্তা জিনিষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অমরাই হেরে যাব।” অনাদি দমিবার পাত্র নয় ; এই কথার উত্তরে সমান উৎসাহে কহিল, “তা বুঝি হচ্ছে না ভাবছ ? বঙ্গলক্ষ্মী মিলের বিজ্ঞাপনটা প’ড়ে দেখ, তা ছাড়া সাবান, দেশলাই, কাচের বাসন প্রভৃতি প্রস্তুতেরও আয়োজন হচ্ছে।” আশানন্দে জ্যোতিৰ্ম্মীর হৃদয় ভরিয়া গেল । তাহার সেই অকাল-আনন্দ স্নান করিয়া দিয়া পণ্ডিত মহাশয় কছিলেন, “আরে অৰ্ব্বাচন, একটা বঙ্গলক্ষ্মী মিল দেশের কত কাপড় যোগান দেবে বল দেখি ? অনাদি রাগিয়া কছিল, “দেশের কোনো খবর জানেন না আপনি, অথচ একটা কথা ব’লে বসেন ? কেন, বোম্বাই অঞ্চলের কাপড়ের মিলগুলো কি ধৰ্ত্তব্যের মধ্যে নয় না কি ?” কৃষ্ণশক্রিরাজির মধ্য হইতে পণ্ডিত মহাশয়ের শ্বেত দস্তরজি প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গে বিকশিত হইয়া উঠিল,— তিনি হাসিয়া কছিলেন, "ভারতের কোটি কোটি