পাতা:স্বর্ণকুমারী দেবীর নূতন গ্রন্থাবলী.djvu/২০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্বপ্নবাণী ঠাকুর-মা ছবিখানি হাতে লইয়া পুনঃ পুনঃ প্রণাম করিয়া আহলাদ সহকারে কহিলেন, “ঠিক সময়েই এনেছিস্ রাণি,—এখনি মন্দিরে গিয়ে টাঙ্গিয়ে দেব। কালী-মূৰ্ত্তি সেখানে একথানিও নেই । তাই বুঝি দেবী আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন । স্বপ্ন দেখার পরই পটখানি কালীঘাট থেকে অগনিয়েছি।” 参

  • আচ্ছা দাg ঠাকুর-মা—আমি নিয়ে যাচ্ছি।” বলিয়া জ্যোতিৰ্ম্ময়ী ছবিখানি তাহার হাত হইতে স্বহস্তে পুনগ্রহণ করিলেন । ঠাকুর-মা তখন তাহার দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিয়া কহিলেন, "দিন দিন যে শুকিয়ে যাচ্ছিস নাতনি ! বিরহজালা পুষছিল যে বুকে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সবাই যা বোঝে, তোর বাপ ত তা বোঝে না । বীপের তোর ধনুৰ্ভঙ্গ পণ যে অর্জুন জামাই করযে। আরে ঐ ত সেই !---যুদ্ধ জিতলে, মালা নিলে,— ছদ্মবেশী অৰ্জ্জুনই ত সে,—তোর বাপকে কে তা বোঝায় বল দেখি ?"

জ্যোতিৰ্ম্মীর মনের বেদন মুখে রক্তরাগে বাপাইয়া উঠিল—পাছে ঠাকুরমা তাহা লক্ষ্য করেন –তাই তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “ন। ঠাকুর-মা, আমি বিয়ে করব না ।” "কেন লো ?” “সবাই যে বিয়ে করে।” দিদিমা খুব হাসিয়া উঠিলেন,—নাতনির পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন, “ও সেই জন্তে ? যেমন বাপ ঠিক তেমনি মেয়ে ! সবাই যা করে তা কবৃতে নেই—কেমন ? সেই জন্তে তোর বীপও ত বিয়ে করলে না ।” মেয়ে বলিল –“আচ্ছা ঠাকুর-মা, বাবা বিয়ে করেন নি ব’লে তোমার এত দুঃখ, আমি সে দুঃখ নিবারণ করতে প্রাণপণে চেষ্টা করব । আমারও অনেক সময় মনে হয়—বাবার বিয়ে হ’লে ভাল হোত । তুমি একটি ভাল মেয়ে দেখ—তার পর এবার আমরা দুজনে মিলে বাবাকে ধ’রে পড়ব ।” ঈর্ষ্যার পরিবর্তে নিজেই যে জ্যোতিৰ্ম্ময়ী পিতার বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছে, ইহাতে ঠাকুর-ম অত্যন্ত আহলাদিত হইলেন। মনে মনে বলিলেন, —"র্হ্যা, অসাধারণ মেয়ে বটে।” মুখে বলিলেন, “বেশ কথা! আগে ত তোর হাতে বাধন পড়,ক—তখন বীপের চাদরেও গিরে দিস।” রক্ষন-চৌকীর পুত্রবীরাগ সহসা মন্দিরের আহবানঘণ্টাধ্বনির মধ্যে থামিয়া পড়িল। রাজমাতা ২০৫ বলিলেন, "চল রাণি চল, আরতির সময় হোল, ফিরে এসে এ পরামর্শ করা যাবে।” মন্দির-অঙ্গনে পৌঁছিয়া প্রথমেই রাজমাতা কালী মূৰ্ত্তিখানি এক জন সেবকের হস্তে দিয়া, কোথায় ইহা টাঙ্গান হইবে, তাহা ৰলিয়া দিলেন। পুরোহিত এবং অন্যান্ত রাজআত্মীয়গণ এতক্ষণ রাজমাতার আগমনঅপেক্ষীয় ছিলেন । তাহারা মন্দিরে আসিবামাত্র স্তোত্রপাঠ এবং আরতি আরম্ভ হইল। রাজকুমারীর সহিত মহারাণী সপ্তবার দেব-প্রদক্ষিণ করিয়া দেবসম্মুখে প্রণত হইলেন। প্রণামান্তে জ্যোতিৰ্ম্ময়ী নতজানু হইয়া করযোড়ে মূৰ্ত্তিষুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন । প্রকৃতিপুরুষের মিলনভাব—এই যুগলমূৰ্ত্তিতে আজ তিনি সৰ্ব্বপ্রথমে মৰ্ম্মে-মৰ্ম্মে উপলব্ধি করিলেন । এই মিলনরূপ—কি সুমধুর,—কি মনোমোহন । জ্যোতিৰ্ম্ময়ী মনে করিয়া আসিয়াছিলেন, গ্ৰামমুনারের চরণতলে তাহার উন্মেষিত প্রেমকে আজ অঞ্জলিদান করিয়া—চির-কৌমাৰ্য্যব্রতে শপথবদ্ধ হইবেন । পারিলেন না—তাহা পারিলেন না। ভগবানের প্রেমমিলনরূপে তন্ময় হইয়া মোহাচ্ছন্ন ভাবে করযোড়েই তিনি বসিয়া রহিলেন। আরতি শেষ হইয়া গেল, স্তোত্রপাঠ বন্ধ হইল—ঠাকুর-ম তখনও রাজকন্যাকে সেই ভাবে বসিতে দেখিয়া একটু যেন ভীতভাবে ডাকিলেন, “রাণি?” রাণী চমকিয়া উঠিয়া দাড়াইলেন। রাজা তখন গীতগুহে ঢালা বিছানায় বসিয়া তানপুরার স্বরে গান করিতেছিলেন । জ্যোতিৰ্ম্মী মন্দির হইতে ফিরিয়া গৃহপ্ৰবেশকালে দূর হইতেই গীত-বাদ্যধ্বনি শুনিয়া এমন নিঃশবো পিতার পশ্চাতে আসিয়া দাড়াইলেন যে, তিনি তাহা জানিতেও পারিলেন না ; আত্মহারাভাবে মুদ্রিতনয়নে তিনি গাইতে লাগিলেন— বড় একেলা গো বড় একেলা ! দুপুর সন্ধ্যা সকলো— তার অমৃত-কিরণ মাখা আকাশ-ভরা চোখের দেখা ধরার পানে ফিরলো না ত হায়রে – একটি বারও একটি বেলা ! মুলতলি রাগিণীতে র্তাহার ভাববিহবল-কষ্ঠোখিত পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত এই কয়েকটি ছত্র গৃহে একটি মধুর বিষাদতান বর্ষণ করিতে লাগিল,—শুনিতে শুনিতে জ্যোতিৰ্ম্মন্ধীর নেত্র অশ্রীতে ভরিয়া উঠিল, নিজেকে অপরাধী বলিয়া মনে হুইল। তিনি যে