সময় ওদেশে মেয়েদের লেখাপড়া বড় নিন্দনীয় ছিল। আমি একদিন রাত্রে হঠাৎ জেগে উঠে মাথা তুলে দেখি যে আমার মা কি লিখছেন না পড়ছেন, আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি সেগুলো সব ঢেকে ফেল্লেন, পাছে আমি ছেলেমানুষ কাউকে বলে ফেলি। আমাদের এক প্রতিবেশিনী বয়স্কা আত্মীয়া লেখাপড়া জানতেন, লোকনিন্দার ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে হিসেব-কিতেব চিঠিপত্র লিখতেন। তবু কিরকম করে’ টের পেয়ে লেখাপড়া করেন বলে পাড়ার লোকে তাঁর নিন্দা করত। পাঠশালা সম্বন্ধে আমার যা-কিছু জ্ঞান, তা এই পাঠশালা থেকেই হয়েছিল; যদিও তখন আমার চার পাঁচ বছরের বেশি বয়স হবে না। বাবামশায় যখন আমাকে এই পাঠশালায় নিয়ে গেলেন, তখন আমি লজ্জায় ভয়ে জড়সড় হয়ে মুখ হেঁট করে বসে রইলুম। মনে আছে মনে হল চারিদিকে অপরিচিত মস্ত মস্ত পুরুষ মানুষ (অবশ্য আমার তুলনায়)—তাদের দিকে তাকাতেও পারলুম না। প্রথমে তালপাতায়, যতটা চওড়া পাতা তত বড় অক্ষর আমাকে লিখতে দিলে। তারপর সে লেখা অভ্যাস হলে কিছু কম চওড়া আট ভাঁজের কাগজে লিখতে দিলে। আর হাত পাকলে শেষে ষোলো ভাঁজের কাগজে লেখালে, সেই হল চূড়ান্ত। মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে নেই বলে আমাকে কেউ কিছু বলত না। কিন্তু ছেলেদের উপর মারধোর হত, সেটা বুঝতে পারতুম। যে ছেলে লেখাপড়ার দিকে চোখ না রেখে এদিক ওদিক তাকাত, তাকে কিরকম শাস্তি দেওয়া হত আমার একটু একটু মনে আছে। সে যত বড় হাঁ করতে পারে সেই হাঁয়ের মাপে একটা ছোট কঞ্চি কেটে তার নীচের ও উপরের দাঁতের মাঝে বসিয়ে দেওয়া হত, কিছুক্ষণ সেইভাবে থাকতে হত। কোন পোড়ো গরহাজির হলে তাকে ধরে আনবার জন্যে গুরুমশায় জনকতক পোড়োকে পাঠাতেন। তারা যখন তাকে ধরে আনত, তখন কি একটা ছড়া বলতে বলতে আসত, তার এক লাইন মনে আছে—“গুরুমশায়, গুরুমশায়, তোমার পোড়ো হাজির।” হাজির হলে পর তার শাস্তি হত। দুরকম
পাতা:স্মৃতিকথা (জ্ঞানদানন্দিনী দেবী).djvu/১০
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৯
পুরাতনী