পাতা:স্মৃতির রেখা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তখনও এই রকম কালবৈশাখী নামবে, এই রকম মেঘান্ধকার আকাশ নিয়ে, ভিজে মাটির গন্ধ নিয়ে, ঝড় নিয়ে, বৃষ্টির শীকরসিক্ত ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া নিয়ে, তীক্ষ্মী বিদ্যুৎ চমক নিয়ে-তিন হাজার বছর পরের বৈশাখ-অপরাহ্নের উপর । তখন কি কেউ ভাববে তিন হাজার বৎসর পূর্বের প্রাচীন যুগের এক বিস্মৃতি কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় এক বিস্মৃত গ্ৰাম্য বালকের ক্ষুদ্র জগৎটি এই রকম বৃষ্টির গন্ধে, ঝোড়ো হাওয়ায় কি অপূৰ্ব আনন্দে দুলে উঠতো ? এই মেঘান্ধকার আকাশের বিদ্যুৎ চমক-সকলের চেয়ে এই বৃষ্টির ভিজে সোদা সোদা গন্ধটা কি আশা উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা দূর দেশের, দূরের উত্তাল মহাসমুদ্রের, ঘটনাবহুল অস্থির জীবনযাত্রার কি মায়া-ছবি তার শৈশব-মনে ফুটিয়ে তুলতো ? কোথায় লেখা থাকবে তার তিন হাজার বৎসর পুর্বের (এক বিস্মৃত অতীতের সে সব আনন্দভরা জীবনযাত্রা, বহুদিন পরে বাড়ী ফিরে মায়ের হাতে বেলের পান খাওয়ার মধুময় চৈত্র অপরাহ্নট, বাশবনের ছায়ায় অপরাহ্নের নিদ্রা ভেঙে পাপিয়ার যে মন মাতানো ডাক-গ্ৰাম্য নদীটির ধারে শ্যাম তৃণদলের উপর ব’সে ব’সে কত গান গাওয়া, কত আনন্দ-কল্পনা, এক বৈশাখের রাত্রিতে প্ৰথম বর্ষণসিক্ত ধরণীর সেই মুদু সুগন্ধ যা তার নববিবাহিতা তরুণী পত্নীর সঙ্গে সে উপভোগ করেছিল ? কোথায় লেখা থাকবে বর্ষাদিনের বৃষ্টিসিক্ত রাত্রিগুলোর সে সব আনন্দকাহিনী ? দূর ভবিষ্যতের ষে সব তরুণ বালক-বালিকার মনে এই কালবৈশাখী নব আনন্দের বার্তা আনবে, কোন পথে তারা অসেবে ? এই সন্ধ্যায় ব’সে গভীর- ভাবে একথাগুলো ভাবতে ভাবতে কোন গভীরের মধ্যে ডুবে গেলাম ! মেঘভরা নিৰ্জন সন্ধ্যা-বিদ্যুৎ চমক-ঝড়ের শব্দ-হঠাৎ এই জলের গন্ধে এক অপূর্ব বার্তার আনন্দে মন শিউরে উঠলো । এই ঘন মেঘের পরপারে কোথায় যেন আছে অনন্ত প্ৰাণ ধারার উৎস, দিকে দিকে যুগে যুগে প্রবাহমান জীবনের উৎসব, নিত্য শাশ্বত আনন্দলীলা ও অনন্তের গভীর রহস্য, বিশালতা • • • আর যা আছে তাদের বর্ণনা মানুষের ভাষায় নেই।-কোনো ভাষার ব্যাকরণে তার প্রতিশব্দ “গ”ড়তে পারেনি। ‘অনন্ত’ ‘শাশ্বত’ ‘নিত্য’ ‘বিরাট’ প্ৰভৃতি মামুলি একঘেয়ে কথায় তার বর্ণনা শেষ হ’য়ে যায় না, বোঝানো যায় না প্রকৃতরূপ—যে শুধু এই কালবৈশাখীর বৃষ্টির গন্ধ মিশানো দূর হাওয়ায়, ঘন মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকে, ঘনান্ধকার আকাশের রহস্যে মনে আসে-অনন্তের সে বেণগীত । o R