পাতা:স্মৃতির রেখা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ট্রেন সব আসছে, লোক ঝুলতে ঝুলতে আসছে বাইরে। একটা ঘোড়া কেমন নাচতে নাচতে এল। টমটম-ওয়ালারা চীৎকার করছে-“ধাক্কা বঁাচাও ।” একটি মেয়ে কঁাদছে, তার স্বামী কোথায় গিয়েছে-পাত্ত পাচ্ছে না । সাবণ জেলার ম্যাজিষ্ট্রেটের তাবু পড়েছে। । ‘সন্ধ্যা ৬টা, ৭ই নভেম্বর, ১৯২৭, রেলওয়ে কম্পার্টমেণ্ট, সোনপুর ॥ জ্যোৎস্নাভিরা রাতে পুটুলি হাতে এইমাত্র এসে পাটনায় পৌছান গেল । বৈকুণ্ঠবাবুর সাজানো অফিস ঘরে টেবিলটাতে বসে লিখছি। গঙ্গায় খুব বড় একটা ষ্টীমার, নাম মুজঃফরপুর—তাতেই পার হওয়া গেল। এপারে ওপারে কি ভয়ানক ভীড় । গঙ্গার ধারে দীঘ৷ ঘাটে ও পালেজ ঘাটেই এক এক মেলা বসে গিয়েছে। জ্যোৎস্নালোকিত গঙ্গাবক্ষে হু হু হাওয়ার মধ্যে যখন জাহাজ ছাড়ল তখন কল্পনা করলাম ইজিপ্ট থেকে যেন জাহাজ যাচ্ছে-ওপারে সুন্দরী ইটালীতে। মাঝের ভূমধ্যসাগরের চলোৰ্ম্মি-চঞ্চল নীল বারিরাশিকে কতকাল আগেকার কত নীলনয়ন কণাক-কেশিনী সুন্দরীর ছবি যেন দেখলাম, কত ক্লিওপেট্ৰী, কত হাস্যমুখী তরুণী, ইটালীর মেয়ে, গ্রীসের মেয়ে, রোমের মেয়ে । লোকের ভিড়ে ষ্টীমারের ঘাটে নাম যায় না, মালগাড়ীর মধ্যে ওয়েটিং-রুম, টিকেট দেওয়ার ঘর-যেন যুদ্ধের সময়ের বন্দোবস্ত । আসবার সময় কেবলই মনে হতে লাগলএই বিদেহ-মিথিলু । এটা ছাপরা জেলা হলেও কালকাসুন্দে গাছের একটা ছায়াভিরা ঝোপ দেখে বাংলাদেশের কথা একবার একটু মনে হ’ল-অবশ্য ঐ পৰ্য্যন্তই মিল । এদেশের শ্যামলতাশূন্য ভূমিশ্ৰীর মধ্যে কি আর মরকতশ্যাম-শ্রীর তুলনা হয় ? সেই মাকালিলন্ত দোলা বৈকালের ছায়াপাড়া ঝোপঝাপ, নদীতীর, পাখীর ডাক, ঘন বন, লতাপাতার কটুতিক্ত সুগন্ধ, বনফুলের সৌরভ । দীঘাঘাট থেকে গাড়ী ছেড়ে আসবার সময় মনে পড়ল-গিরীনন্দদার মুখে শুনতাম দীঘঘাটের ওপারে প্যালেজ ঘাট । কখন দেখিনি । এত কাল পরে সে সাধ মিটলো । আরও মনে পড়ল, গিরীনদাদা তার পরিবারবর্গ নিয়ে বহুকাল আগে -আজি একুশ বছর আগে---এই পথে প্রথম বারাকপুর গিরি বাড়ী তৈরী করেন। তারপর আমাদের যে মুগ্ধ শৈশব কেটেছে, কৈশোর কেটেছে—প্ৰথম যৌবন, বনগ্রামের বোডিং, গর্দভ উপাধি, বেচু চাটুয্যের স্ট্রীট, মনে মোহন সেনের লেন, পানিতর, কত কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। এখন তিনি কি করছেন ? গঙ্গায় আসতে আসতে ষ্টীমারে চা খেতে খেতে ভাবছিলাম বহুদূরে চাপাপুকুরের ঘাটটার কথা ।