পাতা:স্মৃতির রেখা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সুন্দর বিদগ্ধ চৈত্র-ছাপুরে কচিপাতা ওঠা বন-ঝোপের পাশ কাটিয়ে বাশবনের ছায়ায় কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে ফিরে আসা । বালি বড় তেন্তে গরম হ’য়েছে-পা পুড়ে যাচ্ছে। রাখালবাবু মারা গিয়েছেন শুনে বৈকালে ঘোড়া নিয়ে তার বাড়ী তিনটাঙাতে দেখতে গেলাম। জয়পাল সাধুর বাড়ীর কাছে গিয়ে একজন স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা করলাম-ডাক্তারবাবুর বাড়ী কোথায় ? সে কথা বললে না । তারপর একটা লোককে জিজ্ঞাসা করাতে সে রাস্তা বলে দিলে । এর ওর বাড়ীর সামনে দিয়ে একটা বাড়ীর কাছে এলে, একটা ফােসােমত ছেলে বললে, ডাক্তারবাবুর বাড়ীতে কেউ নেই। সেখানে দেখি, মটুকনাথ পণ্ডিত কি করছে। সেই মটুকনাথ-যে তৌজিরদিন কাছারী গিয়ে কানের পোকা বার করবার যোগাড় করেছিল। ফিরলাম যখন বেলা প’ড়ে গিয়েছে। বহুদিন দ্বিারায় থাকবার সময় চোখে যখন হঠাৎ এই বড় বড় বট অশ্বখগাছ দেখি তখন একঘেয়ে কাশ-কাউবনের দৃশ্যের সঙ্গে তুলনায় মনে হয়, যেন কোন অঙ্গরযুগের পৃথিবী থেকে হঠাৎ উচ্চ বিবর্তনের জগতে এসে পৌছেছি। স্নিগ্ধ বৈকাল। ঝোপে ঝোপে পাখী কিচ কিচ করছে, আলোকলতা স্কুলছে । আস্তে আস্তে ঘোড়া চালিয়ে এসে পথের ধারে একটা রোদ পোড়া ঘাসে ভরা মাঠ পেলাম-বড় ভাল লাগল। মাঠের একটা বড় অশ্বখ গাছে নতুন কচ্চি রক্তাভ পাতা গজিয়েছে। অনেক শকুনির বাসা-মাঠে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে দাড়িয়ে দেখলাম। এই স্নিগ্ধ বৈকালে আমাদের ইছামতীর ঘাটের পথ বেয়ে গ্রামের মেয়েরা সব গা ধুয়ে আসছে। যারা ছিল বিশ বছর পূৰ্ব্বে নব-বধু তারা আজ প্ৰৌঢ়া, জীবনের কত সুখ-দুঃখের ওলট-পালট হ’য়ে গিয়েছে । সেই কুলগাছ দেখে এসে বঁাশতলায় বসা—পিসিমার সেই কঞ্চিকাটা বঁাশবন, মার হাতের হাড়ী কলসী পোড়ো ভিটায় পড়া-মা'র হাতের পোতা সজনেগাছ-এই স্নিগ্ধ বৈকালে কচিপাতা ওঠা অদ্ভুত ধরনের আঁকাবঁকা গাছটার সীমারেখার দিকে চেয়ে মন-মাতানো কোকিল, পাপিয়ার উদাস ডাক শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল জীবনটা কি অপূৰ্ব্ব করুণ সঙ্গীত। সন্ধ্যায় পূরবী গৌরী রাগিণীর মত নির্লিপ্ত নিৰ্ব্বিকার, অথচ চারু-শিল্পের চরম দান। বিহারের এই ধুধু উদাস মাঠ প্ৰান্তর, দূরপ্রসারী দিক্‌চক্রবাল, দু’একটি পুরোনো শিমুলগাছ-রক্ত সূৰ্য্যাস্ত বড় ভাল লাগে। দূরের নীল পাহাড়রাটা-যেন এক মায়া, রাজ্যের সীমা একেছে৷ সন্ধ্যাধুসর পূর্ব আকাশপটে। সারাদিনের খররৌদ্রদগ্ধ মাটীর সোদা সোদা মোঙ্গপাড়া গন্ধ, তারপরেই কলািবলিয়ার ঠাণ্ড জলের গন্ধ-বড় আনন্দ পেলাম আজ।