নাটক

নাটক লিখেচি একটি।
বিষয়টা কী বলি।
অর্জ্জুন গিয়েচেন স্বর্গে,
ইন্দ্রের অতিথি তিনি নন্দন বনে।
ঊর্ধ্বশী গেলেন মন্দারের মালা হাতে
তাঁকে বরণ করবেন বলে।
অৰ্জ্জুন বলেন, দেবী, তুমি দেবলোকবাসিনী,
অতি সম্পূর্ণ তোমার মহিমা,
অনিন্দিত তোমার মাধুরী
প্রণতি করি আমি তোমাকে।
তোমার মালা দেবতার সেবার জন্যে।


ঊর্ধ্বশী বললেন, কোনো অভাব নেই দেবলোকের,
নেই তার পিপাসা।
সে জানেই না চাইতে,
তবে কেন আমি হলেম সুন্দর।
তার মধ্যে মন্দ নেই,
তবে ভালো হওয়া কার জন্যে।
আমার মালার মূল্য নেই তার গলায়।
মর্ত্ত্যকে প্রয়োজন আমার,
আমাকে প্রয়োজন মর্ত্ত্যের।

তাই এসেচি তোমার কাছে,
তোমার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে করো আমাকে বরণ,
দেবলোকের দুর্লভ সেই আকাঙ্ক্ষা,
মর্ত্ত্যের সেই অমৃত-অশ্রুর ধারা॥

ভালো হয়েচে আমার লেখা।
ভালো হয়েচে, কথাটা কেটে দেব কি চিঠি থেকে।
কেন, দোষ হয়েচে কী।
সত্য কথাই বেরিয়েচে কলমের মুখে।
আশ্চর্য্য হয়েচ আমার অবিনয়ে,
বল্‌চ, ভালো যে হয়েইচে জান্‌লে কী করে।
আমার উত্তর এই, নিশ্চিত নাই বা জানলেন।
এককালের ভালোটা
হয়তো হবেনা অন্য কালের ভালো।
তাই তো এক নিঃশ্বাসে বলতে পারি
ভালো হয়েচে।
চিরকালের সত্য নিয়ে কথা হোত যদি
চুপ করে থাকতেম ভয়ে।
কত লিখেচি কত দিন,
মনে মনে বলেচি, খুব ভালো।
আজ পরম শত্রুর নামে
পারতেম যদি সেগুলো চালাতে
খুসি হতেম তবে।
এ লেখারও একদিন হয়তো হবে সেই দশা,
সেই জন্যেই, দোহাই তোমার,
অসঙ্কোচে বলতে দাও আজকের মতো
এ লেখা হয়েছে ভালো।

এইখানটায় একটুখানি তন্দ্রা এলো।
হঠাৎ বর্ষণে চারদিক থেকে ঘোলা জলের ধারা
যেমন নেমে আসে, সেই রকমটা।
তবু ঝেঁকে ঝেঁকে উঠে টলমল করে কলম চল্‌চে,
যেমনটা হয় মদ খেয়ে নাচতে গেলে।
তবু শেষ করব এ চিঠি,
কুয়াষার ভিতর দিয়েও জাহাজ যেমন চলে,
কল বন্ধ করে না।
বিষয়টা হচ্চে আমার নাটক।
বন্ধুদের ফরমাস, ভাষা হওয়া চাই অমিত্রাক্ষর।
আমি লিখেচি গদ্যে।
পড়া হোলো সমুদ্র,
সাহিত্যের আদি যুগের সৃষ্টি।
তার বৈচিত্র্য ছন্দতরঙ্গে,
কলকল্লোলে।
গদ্য এলো অনেক পরে।
বাঁধা ছন্দের বাইরে জমালো আসর।
সুশ্রী কুশ্রী ভালোমন্দ তার আঙিনায় এলো
ঠেলাঠেলি করে।
ছোঁড়া কাঁথা আর শাল দোশালা
এলো জড়িয়ে মিশিয়ে,
সুরে বেসুরে ঝনাঝন্ ঝঙ্কার লাগিয়ে দিল।
গৰ্জ্জনে ও গানে, তাণ্ডবে ও তরল তালে
আকাশে উঠে পড়ল গদ্যবাণীর মহাদেশ।
কখনো ছাড়লে অগ্নিনিঃশ্বাস,
কখনো ঝরালে জলপ্রপাত।

কোথাও তার সমতল, কোথাও অসমতল;
কোথাও দুর্গম অরণ্য, কোথাও মরুভূমি।
এ’কে অধিকার যে করবে তার চাই রাজপ্রতাপ;
পতন বাঁচিয়ে শিখতে হবে
এর নানারকম গতি অবগতি।
বাইরে থেকে এ ভাসিয়ে দেয় না স্রোতের বেগে,
অন্তরে জাগাতে হয় ছন্দ
গুরু লঘু নানা ভঙ্গীতে।
সেই গদ্যে লিখেচি আমার নাটক,
এতে চিরকালের স্তব্ধতা আছে,
আর চল্‌তিকালের চাঞ্চল্য।

৯ ভাদ্র, ১৩৩৯