পুনশ্চ/ফাঁক
ফাঁক
আমার বয়সে
মনকে বলবার সময় এলো,
কাজ নিয়ে কোরো না বাড়াবাড়ি,
ধীরে সুস্থে চলো,
যথোচিত পরিমাণে ভুলতে করো শুরু
যাতে ফাঁক পড়ে সময়ের মাঝে মাঝে।
বয়স যখন অল্প ছিল
কর্ত্তব্যের বেড়ায় ফাঁক ছিল যেখানে সেখানে।
তখন যেমন-খুসির ব্রজধামে
ছিল বাল-গোপালের লীলা।
মথুরার পালা এল মাঝে,
কর্ত্তব্যের রাজাসনে।
আজ আমার মন ফিরেচে
সেই কাজ-ভোলার অসাবধানে।
কী কী আছে দিনের দাবী
পাছে সেটা যাই এড়িয়ে
বন্ধু তার ফর্দ্দ রেখে যায় টেবিলে।
ফর্দ্দটাও দেখতে ভুলি,
টেবিলে এসেও বসা হয় না—
এমনিতরো ঢিলে অবস্থা।
গরম পড়েচে ফর্দ্দে এটা না ধরলেও
মনে আনতে বাধে না।
পাখা কোথায়,
কোথায় দার্জিলিঙের টাইমটেবিলটা,
এমনতরো হাঁপিয়ে ওঠবার ইসারা ছিল
থার্ম্মোমিটারে।
তবু ছিলেম স্থির হয়ে।
বেলা দুপুর
আকাশ ঝাঁ ঝাঁ করচে,
ধু ধু করচে মাঠ,
তপ্ত বালু উড়ে যায় হুহু করে,
খেয়াল হয় না।
বনমালী ভাবে দরজা বন্ধ করাটা
ভদ্রঘরের কায়দা,—
দিই তাকে এক ধমক।
পশ্চিমের সাসির ভিতর দিয়ে
রোদ ছড়িয়ে পড়ে পায়ের কাছে।
বেলা যখন চারটে
বেহারা এসে খবর নেয়, চিটঠি!
হাত উল্টিয়ে বলি, নাঃ।
ক্ষণকালের জন্যে খটকা লাগে
চিঠি লেখা উচিত ছিল,—
ক্ষণকালটা যায় পেরিয়ে,
ডাকের সময় যায় তার পিছন পিছন!
এদিকে বাগানে পথের ধারে
টগর গন্ধরাজের পুঁজি ফুরোয় না,
এরা ঘাটে-জটলা-করা বউদের মতো,
পরস্পর হাসাহাসি ঠেলাঠেলিতে
মাতিয়ে তুলেচে কুঞ্জ আমার।
কোকিল ডেকে ডেকে সারা,
ইচ্ছে করে তাকে বুঝিয়ে বলি
অত একান্ত জেদ কোরো না
বনান্তরের উদাসীনকে মনে রাখবার জন্যে।
মাঝে মাঝে ভোলো, মাঝে মাঝে ফাঁক,—
মনে রাখার মান-হানি কোরো না
তাকে দুঃসহ করে।
মনে আনবার অনেক দিন ক্ষণ আমারো আছে,
অনেক কথা, অনেক দুঃখ।
তার ফাঁকের ভিতর দিয়েই
নতুন বসন্তের হাওয়া আসে
রজনীগন্ধার গন্ধে বিষণ্ণ হয়ে;
তারি ফাঁকের মধ্যে দিয়ে
কাঁঠালতলার ঘন ছায়া
তপ্ত মাঠের ধারে
দূরের বাঁশি বাজায়
অশ্রুত মূলতানে।
তারি ফাঁকে ফাঁকে দেখি,
ছেলেটা ইস্কুল পালিয়ে খেলা করচে
হাঁসের বাচ্ছা বুকে চেপে ধরে,
পুকুরের ধারে,
ঘাটের উপর একলা বসে,
সমস্ত বিকেল বেলাটা।
তারি ফাঁকের ভিতর দিয়ে দেখতে পাই
লিখচে চিঠি নূতন বধু
ফেলচে ছিঁড়ে, লিখচে আবার।
একটুখানি হাসি দেখা দেয় আমার মুখে,
আবার একটুখানি নিঃশ্বাসও পড়ে।৷
১১ ভাদ্র, ১৩৩৯