ক্ষণিকা

খোলো, খোলো হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা,
খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।
কবে সে যে এসেছিলো আমার হৃদয়ে যুগান্তরে,
গোধূলি-বেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে,
ল’য়ে তা’র ভীরু দীপশিখা।
দিগন্তের কোন্‌ পারে চ’লে গেলো আমার ক্ষণিকা


ভেবেছিনু গেছি ভুলে; ভেবেছিনু পদচিহ্নগুলি
পদে পদে মুছে নিলো সর্ব্বনাশী অবিশ্বাসী ধূলি।
আজ দেখি সেদিনের সেই ক্ষীণ পদধ্বনি তা’র
আমার গানের ছন্দ গোপনে ক’রেছে অধিকার;
দেখি তা’রি অদৃশ্য অঙ্গুলি
স্বপ্নে অশ্রু-সরোবরে ক্ষণে ক্ষণে দেয় ঢেউ তুলি’॥

বিরহের দূতী এসে তা’র সে স্তিমিত দীপখানি
চিত্তের অজানা কক্ষে কখন রাখিয়া দিল’ আনি’।
সেখানে যে বীণা আছে অকস্মাৎ একটি আঘাতে
মুহূর্ত্ত বাজিয়াছিল; তা’র পরে শব্দহীন রাতে
বেদনা-পদ্মের বীণাপাণি
সন্ধান করিছে সেই অন্ধকারে-থেমে-যাওয়া বাণী॥


সেদিন ঢেকেছে তা’রে কি এক ছায়ার সঙ্কোচন,
নিজের অধৈর্য্য দিয়ে পারেনি তা করিতে মোচন।
তা’র সেই ত্রস্ত আঁখি, সুনিবিড় তিমিরের তলে
যে-রহস্য নিয়ে চ’লে গেলো, নিত্য তাই পলে পলে
মনে মনে করি যে লুণ্ঠন।
চিরকাল স্বপ্নে মোর খুলি তা’র সে অবগুণ্ঠন॥


হে আত্মবিস্মৃত, যদি দ্রুত তুমি না যেতে চমকি’,
বারেক ফিরায়ে মুখ পথ-মাঝে দাঁড়াতে থমকি’,
তা হ’লে পড়িত ধরা রোমাঞ্চিত নিঃশব্দ নিশায়
দুজনের জীবনের ছিল যা চরম অভিপ্রায়।
তা হ’লে পরম লগ্নে, সখি,
সে ক্ষণকালের দীপে চিরকাল উঠিত আলোকি’॥

হে পান্থ, সে পথে তব ধূলি আজ করি যে সন্ধান;—
বঞ্চিত মূহুর্ত্তখানি প’ড়ে আছে, সেই তব দান।
অপূর্ণের লেখাগুলি তুলে দেখি, বুঝিতে না পারি,
চিহ্ন কোনো রেখে যাবে, মনে তাই ছিল কি তোমারি?
ছিন্ন ফুল, এ কি মিছে ভাণ?
কথা ছিল শুধাবার, সময় হ’লো যে অবসান॥


গেলো না ছায়ার বাধা; না-বোঝার প্রদোষ-আলোকে,
স্বপ্নের চঞ্চল মূর্ত্তি জাগায় আমার দীপ্ত চোখে
সংশয়-মোহের নেশা;—সে মূর্ত্তি ফিরিছে কাছে কাছে
আলোতে আঁধারে মেশা,—তবু সে অনন্ত দূরে আছে
মায়াচ্ছন্ন লোকে।
অচেনার মরীচিকা আকুলিছে ক্ষণিকার শোকে॥


খোলো, খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা।
খুঁজিব তারার মাঝে চঞ্চলের মালার মণিকা।
খুঁজিব সেথায় আমি যেথা হ’তে আসে ক্ষণতরে
আশ্বিনে গোধূলি আলো, যেথা হ’তে নামে পৃথ্বী পরে
শ্রাবণের সায়াহ্ন-যূথিকা;
যেথা হ’তে পরে ঝড় বিদ্যুতের ক্ষণদীপ্ত টীকা॥


হারুনা মারু জাহাজ, ৬ অক্টোবর, ১৯২৪।