তৃতীয়া

কাছের থেকে দেয় না ধরা, দূরের থেকে ডাকে
তিন বছরের প্রিয়া আমার, দুঃখ জানাই কাকে।
কণ্ঠেতে ওর দিয়ে গেছে দখিন হাওয়ার দান
তিন বসন্তে দোয়েল শ্যামার তিন বছরের গান।
তবু কেন আমারে ওর এতই কৃপণতা,
বারেক ডেকে দৌড়ে পালায়, কইতে না চায় কথা।
তবু ভাবি, যাই কেন হোক অদৃষ্ট মোর ভালো,
অমন সুরে ডাকে আমার মাণিক আমার আলো।
কপাল মন্দ হ’লে টানে আরো নীচের তলায়,
হৃদয়টি ওর হোক না কঠোর, মিষ্টি তো ওর গলায়

আলো যেমন চম্‌কে বেড়ায় আম্‌লকির ঐ গাছে
তিন বছরের প্রিয়া আমার দুরের থেকে নাচে।
লুকিয়ে কখন বিলিয়ে গেছে বনের হিল্লোল
অঙ্গে উহার বেণু-শাখার তিন ফাগুনের দোল।
তবু ক্ষণিক হেলাভরে হৃদয় করি’ লুট
শেষ না হ’তেই নাচের পালা কোন্‌খানে দেয় ছুট।

আমি ভাবি এই কি কম, প্রাণে তো ঢেউ তোলে,
ওর মনেতে যা হয় তা হোক আমার তো মন দোলে।
হৃদয় না হয় নাই বা পেলাম মাধুরী পাই নাচে,
ভাবের অভাব রইলো না হয়, ছন্দটা তো আছে॥


বন্দী হ’তে চাই যে কোমল ঐ বাহু বন্ধনে,
তিন বছরের প্রিয়ার আমার নাই সে খেয়াল মনে।
সোনার প্রভাত দিয়েছে ওর সর্ব্বদেহ ছুঁয়ে
শিউলি ফুলের তিন শরতের পরশ দিয়ে ধুয়ে।
বুঝ্‌তে নারি আমার বেলায় কেন টানাটানি।
ক্ষয় নাহি যার সেই সুধা নয় দিতো একটুখানি।
তবু ভাবি বিধি আমায় নিতান্ত নয় বাম,
মাঝে মাঝে দেয় সে দেখা তা’রি কি কম দাম?
পরশ না পাই, হরষ পাবো চোখের চাওয়া চেয়ে,
রূপের ঝোরা বইবে আমার বুকের পাহাড় বেয়ে॥


কবি ব’লে লোক-সমাজে আছে তো মোর ঠাঁই,
তিন বছরের প্রিয়ার কাছে কবির আদর নাই।
জানে না যে ছন্দে আমার পাতি নাচের ফাঁদ,
দোলার টানে বাঁধন মানে দূর আকাশের চাঁদ।

পলাতকার দল যত সব দখিন হাওয়ার চেলা
আপনি তা’রা বশ মেনে যায় আমার গানের বেলা।
ছোট্টো ওরি হৃদয়খানি দেয় না শুধু ধরা,
ঝগ্‌ড়ু বোকার বরণ-মালা গাঁথে স্বয়ম্বরা।
যখন দেখি এমন বুদ্ধি, এমন তাহার রুচি,
আমারে ওর পছন্দ নয়, যায় সে লজ্জা ঘুচি’॥


এমন দিনও আস্‌বে আমার, আছি সে-পথ চেয়ে,
তিন বছরের প্রিয়া হবেন বিশ বছরের মেয়ে।
স্বর্গ-ভোলা পারিজাতের গন্ধখানি এসে
ক্ষ্যাপা হাওয়ায় বুকের ভিতর ফির্‌বে ভেসে ভেসে।
কথায় যারে যায় না ধরা এমন আভাস যত
মর্ম্মরিবে বাদল-রাতের রিমিঝিমির মতো।
সৃষ্টিছাড়া ব্যথা যত, নাই যাহাদের বাসা,
ঘুরে ঘুরে গানের সুরে খুঁজ্‌বে আপন ভাষা।
দেখ্‌বে তখন ঝগ্‌ড়ু বোকা কী ক’র্‌তে বা পারে,
শেষকালে সেই আসতে হবেই এই কবিটির দ্বারে॥


বুয়েনোস এয়ারিস্‌, ৪ ডিসেম্বর, ১৯২৪।