পূরবী/পথিক/সমুদ্র
সমুদ্র
১
হে সমুদ্র, স্তব্ধচিত্তে শুনেছিনু গর্জ্জন তোমার
রাত্রিবেলা; মনে হ’লো গাঢ় নীল নিঃসীম নিদ্রার
স্বপ্ন ওঠে কেঁদে কেঁদে। নাই, নাই তোমার সান্ত্বনা;
যুগ-যুগান্তর ধরি’ নিরন্তর সৃষ্টির যন্ত্রণা
তোমার রহস্য-গর্ভে ছিন্ন করি’ কৃষ্ণ আবরণ
প্রকাশ সন্ধান করে। কত মহা-দ্বীপ কত মহা-বন
এ তরল রঙ্গশালে রূপে প্রাণে কত নৃত্যে গানে
দেখা দিয়ে কিছুকাল, ডুবে গেছে নেপথ্যের পানে
নিঃশব্দ গভীরে। হারানো সে চিহ্ন-হারা যুগগুলি
মূর্ত্তিহীন ব্যর্থতায় নিত্য অন্ধ আন্দোলন তুলি’
হানিছে তরঙ্গ তব। সব রূপ সব নৃত্য তা’র
ফেনিল তোমার নীলে বিলীন দুলিছে একাকার।
স্থলে তুমি নানা গান উৎক্ষেপে করেছো আবর্জ্জন,
জলে তব এক গান, অব্যক্তের অস্থির গর্জ্জন॥
২
হে সমুদ্র, একা আমি মধ্যরাতে নিদ্রাহীন চোখে
কল্লোল-মরুর মধ্যে দাঁড়াইয়া, স্তব্ধ ঊৰ্দ্ধলোকে
চাহিলাম; শুনিলাম নক্ষত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে
আকাশের বিপুল ক্রন্দন; দেখিলাম শূন্য-মাঝে
আঁধারের আলোক-ব্যগ্রতা। কত শত মন্বন্তরে
কত জ্যোতির্লোক গূঢ় বহ্ণিময় বেদনার ভরে
অস্ফুটের আচ্ছাদন দীর্ণ করি’ তীক্ষ রশ্মিঘাতে
কালের বক্ষের মাঝে পেলো স্থান প্রোজ্জ্বল প্রভাতে
প্রকাশ-উৎসব দিনে। যুগ-সন্ধ্যা কবে এলো তা’র,
ডুবে গেলে অলক্ষ্যে অতলে। রূপ-নিস্ব হাহাকার
অদৃশ্য বুভুক্ষু ভিক্ষু ফিরিছে বিশ্বের তীরে তীরে,
ধূলায় ধূলায় তা’র আঘাত লাগিছে ফিরে ফিরে।
ছিল যা প্রদীপ্তরূপে নানা ছন্দে বিচিত্র চঞ্চল
আজ অন্ধ তরঙ্গের কম্পনে হানিছে শূন্যতল॥
৩
হে সমুদ্র, চাহিলাম আপন গহন চিত্তপানে;
কোথায় সঞ্চয় তা’র, অন্ত তা’র কোথায় কে জানে।
ওই শোনো সংখ্যা-হীন সংজ্ঞাহীন অজানা ক্রন্দন
অমূর্ত্ত আঁধারে ফিরে, অকারণে জাগায় স্পন্দন
বক্ষতলে। এক কালে ছিল’ রূপ, ছিল’ বুঝি ভাষা;
বিশ্বগীতি-নির্ঝরের তীরে তীরে বুঝি কত বাসা
বেঁধেছিলো কোন্ জন্মে;—দুঃখে সুখে নানা বর্ণে রাঙা
তাহাদের রঙ্গমঞ্চ হঠাৎ পড়িল কবে ভাঙা
অতৃপ্ত আশার ধূলিস্তূপে। আকার হারালো তা’রা,
আবাস তা’দের নাহি। খ্যাতি-হারা সেই স্মৃতি-হারা
সৃষ্টি-ছাড়া ব্যর্থ ব্যথা প্রাণের নিভৃত লীলা ঘরে
কোণে কোণে ঘোরে শুধু মূর্ত্তি তরে, আশ্রয়ের তরে।
রাগে অনুরাগে যারা বিচিত্র আছিল’ কত রূপে,
আজ শূন্য দীর্ঘশ্বাস আঁধারে ফিরিছে চুপে চুপে॥