পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/পরীবানুর হাঁহলা

পরীবানুর হাঁহলা

 এই পরীবানুর পালা-সম্বন্ধে ইহার সংগ্রাহক শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী মহাশয় বিগত ২৪শে জুলাই চট্টগ্রাম হইতে আমাকে যাহা লিখিয়া পঠাইয়াছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি:—

 “পরীবানুর পালাটি ‘সুজাতনয়ার বিলাপেরই’ অনুরূপ; কিন্তু ইহার মধ্যে অন্য বৈশিষ্ট্যও আছে। বহু পূর্ব্ব হইতেই আমি আপনাকে ‘হাল্‌দা-ফাটা’ নামক পল্লীগীতির কথা লিখিয়া আসিতেছি। এই পালাটিও সেই জাতীয় গান। সাধারণতঃ সমুদ্রোপকূলবর্ত্তী স্থানগুলিতেই ‘হাল্‌দা-ফাটা’ গানের প্রচলন দেখা যায়। এই পালাগায়ক সারেঙ্গ, তানপুরা, খঞ্জরি কি অন্য প্রকারের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না। প্রকৃতির সাধারণ সুর ও সমুদ্রের সোঁ সোঁ শব্দসংযোগে তাহারা যেন এই গানের তালমান রক্ষা করিয়া থাকে। গায়ক পদপূরণ করিবার সময় অতি সুন্দর ও স্বাভাবিক নিয়মে ‘রে’ শব্দটির দ্বারা সুর যোজনা করিয়া লয়। ইহার কৌশলও অভিনব এবং মৌলিক। বঙ্গদেশে সঙ্গীতশাস্ত্রের যদি কোন মৌলিক গবেষণা হয়, তবে হাল্‌দা-ফাটা গান হইতে অনেক সুরের উপকরণ সংগৃহীত হইবে। গান করিবার সময় তাল যন্ত্র ছাড়া সুরের সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে হয় বলিয়া এই পালারচকেরা শব্দবিন্যাস ও ছন্দের প্রতি সর্ব্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া থাকে। অধিকাংশ হাল্‌দা-ফাটা গানে উপান্ত্য স্বরের মিল আছে।

 এই পরীবানুর পালার ঐতিহাসিকত্ব প্রমাণ করিতে কোন বেগ পাইতে হয় না। সুজাতনয়ার বিলাপের ভূমিকাখানি ইহার সহিত জুড়িয়া দেওয়া যায়। মােটের উপর এই পালাগানটিকে মোগল ইতিহাসের কয়েক পৃষ্ঠা বলা যাইতে পারে। চারিবৎসর পূর্ব্ব হইতে আমি আপনাকে এই পালার বিবরণ জানাইয়াছি। আপনিও অনেক জায়গায় তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। ‘ডবলমুরিং’ থানার অন্তর্গত ‘আনরাবাদ’ গ্রামনিবাসী খলিলুর রহমান নামক এক গায়ক এই পালাটির সামান্য কতকটুক তখন আবৃত্তি করিয়াছিল। মোটের উপর বলিতে কি এই পালা যে সংগৃহীত হইবে এমন ভরসা আমার ছিল না। গত কয়েক মাস এই পালাটি উদ্ধারের জন্য আমি প্রাণান্ত পরিশ্রম করিয়াছি।

 গত ফেব্রুয়ারী মাসে মহিষখালী দ্বীপে শ্রীধনঞ্জয় বড়ুয়া নামে একজন জরীপের ডেপুটির সঙ্গে আমি এ পালার বিষয় আলোচনা করিয়াছিলাম। তিনি আমাকে সাতকানিয়া থানার অন্তঃপাতী ‘গোরস্তান’ নামক গ্রামে যাইতে বলিয়াছিলেন, কেননা অল্পদিন পূর্ব্বে তিনি জরীপের কাজে যাইয়া সেখানে এই পরীবানুর পালা শুনিয়াছিলেন। কিন্তু আমি গোরস্থানে অনেক খোঁজ করিয়াও সেই পালাগায়কের সন্ধান পাই নাই। আরাকানের অন্তৰ্গত মংভু সাবডিভিশনের মৌলবী আবুল হালিম নামক একজন সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তি আমাকে এ পালার কিছু বিবরণ জানাইয়াছিলেন। আরাকানের সেই সুধর্ম্ম নরপতির যে রাজধানী ছিল তাহার বর্ত্তমান নাম মেয়ং (Myohong), সেখানে এখনও সুজার মসজীদ এবং সুজার দীঘি আছে। এই পালা সংগ্রহের ব্যপদেশে আমি ছোট-বড় অনেকের নিকট গমন করিয়াছি; কেহ হয়ত আমায় কিছু সাহায্য করিয়াছেন, আবার হয়ত কাহারও নিকট হইতে হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। সেই হিন্দুবৰ্জিত মুসলমান পল্লীগুলিতে কখনও ভাত জুটিয়াছে কখনো বা উপবাসী ফিরিয়া আসিয়াছি।

 তাহার পর আমি অনেক সন্ধান করিয়া পেরুয়া দ্বীপে উপস্থিত হই। সিরাজ মিঞা সেইখানের জমিদার। তিনি বড়ই রসগ্রাহী এবং সৌখীন লোক। আমি তাহার নিকট যখন পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকার ৩য় খণ্ড হইতে কাফন চােরার পালাটি আবৃত্তি করিয়াছিলাম তখন তিনি আমাকে আনন্দে জড়াইয়া ধরিয়াছিলেন। আমি পেরুয়া দ্বীপে সাত দিন তাঁহার বাড়ীতেই ছিলাম। তিনি ১৫৷১৬ মাইল দূরবর্ত্তী স্থান হইতেও আমার নিকট গায়কদের উপস্থিত করাইয়াছিলেন। তন্মধ্যে উজান টেঁইয়া গ্রামনিবাসী মনসুর আলীর নিকট হইতে এই পালার অধিকাংশ সংগৃহীত হইয়াছে। সেই অঞ্চলে এই গানটি ‘পরীবানুর হাঁহলা’ নামে পরিচিত।

 আমরা এক বৎসর পূর্ব্বেই পরীবানুর একটা গান প্রকাশিত করিয়াছি; সেই গানের সঙ্গে এই পালাটি পাঠক মিলাইয়া পড়িবেন। এই গানে দৃষ্ট হয়, সুজা ও তাঁহার পত্নী আরাকান রাজ-কর্তৃক সমুদ্র-গর্ভে নিক্ষিপ্ত হইয়া প্রাণ ত্যাগ করেন নাই। যখন সুজা বুঝিলেন, আরাকান-রাজ তাঁহার পত্নীকে ছলে-বলে লইয়া যাইবেন এবং এ বিষয়ে তাঁহার বাধা দেওয়ার কোন সামর্থ্য নাই, তখন রাত্রিকালে কন্যা দুটিকে রাখিয়া রাজদম্পতী সমুদ্রের তীরাভিমুখে ছুটিলেন। সম্মুখে আকূল অতল জলরাশি, একখানি মাছের নৌকা সংগ্রহ করিয়া রাজা তাঁহার প্রাণপ্রিয়া পত্নীর সঙ্গে সমুদ্র বাহিয়া চলিলেন। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গ-মালা, সুজা বাদসা নিজে কাণ্ডারী,—কি ভয়ানক কষ্ট সহিয়া যে সুজা পত্নীসহ সারারাত্রি কাটাইলেন, তাহা অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। ক্রমে ক্রমে হস্ত শিথিল হইল, সমুদ্রপথ অনেকটা বাহিয়া আসিয়াছেন—আর তো শক্তি নাই। এদিকে কালাপানির ভীষণ আবর্ত্তে নৌকা চক্রাকারে ঘুরিয়া পাতালের দিকে চলিল। বাদসাহ ও বেগম দুইজনে প্রেমালিঙ্গনে বদ্ধ হইয়া মৃত্যুর আলয়ে চলিলেন, এক সঙ্গে জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া আরাকানরাজের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলেন।

 এই পালাগানটিতে অতি সংক্ষেপে করুণরসের ধারা অব্যাহত রাখিয়া সুজা বাদাসাহের শেষ কয়েকটা দিনের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে; ঘটনাগুলি সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক কিনা বলা যায় না—কিন্তু পরীবানুর অনুপম সৌন্দর্য্যই যে সুজার জীবনের এই বিসদৃশ পরিণতি ঘটাইয়া ছিল, তাহাতে সংশয় নাই।

 এই গানটিতে “বারবাঙ্গালা” শব্দটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। “বারবাঙ্গালা” এক প্রকার গৃহের নাম, বাঙ্গালা দেশেই এইরূপ গৃহের সর্বপ্রথম পরিকল্পনা হইয়াছিল। ফার্গুসন সাহেব বলেন, দোচালা ঘরের মত ইহার ছাদ ছিল, এবং এইরূপ গৃহ বাঙ্গালা দেশের আদর্শে পৃথিবীর বহু স্থানে নির্ম্মিত হইয়াছিল। অনেকে মনে করেন বাঙ্গালা দেশের রাজধানীর নাম পূর্বকালে “বাঙ্গলা” ছিল—এই বাঙ্গলা নগরের নাম বিদেশী পর্য্যটকদের প্রাচীন গ্রন্থে দৃষ্ট হয়। এখন ইহার অস্তিত্ব নাই, কিন্তু সম্ভবতঃ ঢাকা নগরই এই প্রাচীন রাজধানী; ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ “বাঙ্গলাবাজার” এই নগরের পূর্ব্বতন নামের স্মৃতি বহন করিতেছে। এখনও যে “বাঙ্গালো” বা “বাঙ্গলা” ঘর আমরা এদেশে সর্ব্বত্র দেখিতে পাই, তাহারও উৎপত্তি স্থান সেই প্রাচীন রাজধানীতে।

 কিন্তু এখানে “বারবাঙ্গালা” বলিতে ঘর বোঝায় নাই। বাঙ্গালাদেশ দ্বাদশ খণ্ডে বিভক্ত ছিল এবং এক সময়ে এই “দ্বাদশ” স্থানের অধিপতি দ্বাদশটি ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন, ইঁহাদের উপাধি ছিল “বারভুঞা”—এইরূপ দ্বাদশ ভাগে একটা প্রধান দেশকে বিভক্ত করার রীতি প্রাচীন কালে আর্য্যগণঅধুষিত বহু প্রদেশে প্রচলিত ছিল। গ্রীক্‌দিগের “ডডনপ্‌লাস” বারভুঞারই নামান্তর। রাজপুতনার কোন কোন স্থানে এখনও রাজার অধীনে দ্বাদশ মণ্ডল বা দ্বাদশ প্রধান নায়ক থাকার রীতি বিদ্যমান। ত্রিপুরার রাজা স্বীয় অভিষেকের সময় দ্বাদশটি সামন্ত রাজা নিযুক্ত করিতেন। এই রীতি আর্য্যগণশাসিত রাজ্যসমূহের একটি অতি পুরাতন প্রথা। ‘বারভূঞা’র উল্লেখ আমরা ধর্ম্মমঙ্গল এবং বহুবিধ বাঙ্গালা প্রাচীন কাব্যে পাই। ধর্ম্মমঙ্গলে লিখিত আছে যে কোন রাজচক্রবর্ত্তীর অভিষেকের সময় বারভুঞা বা বার জন “ভুঞা রাজা” তাঁহার মস্তকে অভিষেকের বারি বর্ষণ করিতেন। সুতরাং ইহা মনে করিতে হইবে না যে প্রতাপাদিত্য-ইশা খাঁ-প্রমুখ বারভুঞারাই মাত্র বাঙ্গালার ‘বারভুঞা’-পদবাচ্য। ইঁহাদের পূর্ব্ববর্ত্তী বহু “বারভুঞা” এ দেশ শাসন করিয়া গিয়াছেন। “ভূঞা” শব্দ ভৌমিক শব্দের অপভ্রংশ, সুতরাং ইহা খাঁটি হিন্দুরাজ্যের সময়কার নিদর্শন, মুসলমান-অধিকারে এই উপাধির সৃষ্টি হয় নাই।

 এখানে “বারবাঙ্গালা” বলিতে দ্বাদশ ভৌমিক-শাসিত সমস্ত রাজ্যটি বুঝাইতেছে। কিন্তু এই পালাগানটিতে কথাটির কোন ঐতিহাসিক সার্থকতা, নাই। সুজার সময় এই প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখযােগ্যভাবে আর বাঙ্গালায় বিদ্যমান ছিল না। কথাটা বহু প্রাচীন সংস্কারাগত এবং এক সময়ে বঙ্গদেশে যে দ্বাদশ জন পরাক্রান্ত দেশনায়ক ছিলেন—তাহারই ক্ষীণ স্মৃতির পরিচায়ক।

 ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৩১

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

পরীবানুর হাঁহলা

পরীবানুর হাঁহলা

(১)

ধুয়া—সাইগরে ডুপালি[] পরীরে 
হায়! হায়! দুখ্‌খে মরি রে।
কি ভাবে গাহিব ওই দুখ্‌খের বিবরণ।
যে হালে হইল সেই পরীর মরণ॥
কেমনে দুখের কথা বয়ান করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

ভোজের বাজি দুনিয়া যে কেবল বেড়া জাল।
কাডাকাডি[] মারামারি আর যত জঞ্জাল॥
মিছা রাজ্য মিছা ধন মিছা টাকা কড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

বার বাঙ্গলার[] বাদ্‌সা সুজা রাজ্যর ওর নাই।
বাপর দিন্যা[] তক্তর লাগি করিল লড়াই॥
মার পেডর[] ভাই যে হৈল কাল পরাণ বৈরীরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

ভাইয়ে চাইলো ভাইয়ের লোউ[] মিছা রাজ্যের লাগি।
গরীব গুইন্যা বেশী ভাল্যা যারা খায় মাগি[]
কিসের রাজ্য কিসের ধন কিসের টাকা কড়িরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—


লড়াইতে হটিয়া সুজা হইল পেরেসানি।
পরিবার লইয়া সঙ্গে করিলা মেলানি॥
ধন দৌলত কিছু কিছু নিলা সঙ্গে করিরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—


সুজা বাদসার আওরাত পরীবানু নাম।
চাডিগাঁতে আসি তারা বদরের[] মোকাম॥
বহুত খরাত দিলা সোণা ভরী ভরী রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—


পাইক পহল[] ভাল থাকে গাছৎ[১০] বাসা বাঁধি।
বাদসার পোলা দেশে দেশে ঘুরে কাঁদি কাঁদি।
সুগ[১১] নাই কন কাইত[১২] পদে পদে অরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—(১—৩০)

(২)

নসীবের লেখা কভু না যায় খণ্ডন।
চাডিগাঁ ছাড়িতে বাদসা করিল মনন॥
দহিন মিক্যা[১৩] আইল তারা হাতীর উয়র[১৪] চড়িরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

মধ্যে বইস্যে সুজা বাদসা বামে পরীজান।
জেনে[১৫] বইস্যে দোন কইন্যা পুন্নমাসীর চান॥
ধীরে ধীরে যায় তারা মুড়ায় পন্থ ধরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

মুড়ায় পন্থ ধরি তারা দহিন মিক্যা যায়।
পিন্ পিন্ পিন্ সাড়ী পরীর বয়ারে[১৬] উড়ায়॥
চুনকি বাদলা কত পড়ে ঝরি ঝরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—


পরীর হাতৎ লাল বাখরি[১৭] মাঝে মাঝে লেখা।
ঝুম্‌কামালা কানৎ[১৮] পরীর চান বোলাকটা[১৯] বেঁকা॥
পাড়াল্যা মা ভৈনে আসি চাইলো নয়ন ভরি রে[২০]
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

হাতীর উয়র হাওদা যে সোণাতে তৈয়ার।
পরীর ছুরত চোগে ধাঁধা লাগাই যার॥
কোন হুরিপরী[২১] এই পন্থে গড়াগড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

কোন্ দিগদি কণ্ডে[২২] যাইব নাইরে ঠিকানা।
কেহ দিল পন্থ দেখাই কেহ করে মানা॥
ধীরে ধীরে যায় তারা মুড়ায় পন্থ ধরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

কেহ বলে আমার বাড়ীৎ আইস পরীজান।
তুলসীমালার[২৩] ভাত দিয়ম ছালৈন[২৪] নানান॥
সাঁচি বরর পান আর দিয়ম বাট্টা ভরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

কেহ বলে দহিন মিক্যা না যাইও আর।
চালার[২৫] মুয়ৎ[২৬] চাইন্য বাইঘ্যা[২৭] লেজরি ঘুরার॥
সেই পন্থে গেলে বাইঘ্যা খাইব ধরি ধরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

বড় বড় দইরন্যা[২৮] পাইবা গেলে তার পর।
ডাঙ্গর[২৯] ডাঙ্গর আছে কুম্ভীর হাঙ্গর॥
কনে দিব তোমরারে দইরন্যা পার করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

পেরাবন[৩০] আছে সেথায় নানান সাপর বাসা।
একবার ডংশিলে আর প্রাণের নাই আশা॥
ফায়দা[৩১] কি পাইবা তোমরা হুদাহুদি[৩২] মরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

ন যাইও ন যাইও পরী রোসাঙ্গ্যার[৩৩] দেশে।
ধন দৌলত হারাইবা জান দিবা শেষে॥
সে মিক্যা[৩৪] না যাইও পরী মুড়ার পন্থ ধরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

ন যাইও ন যাইও পরী মুরঙ্গ্যার[৩৫] ঠাঁই।
মাইন্‌সর গোস্ত খায় তারা হিঁজাই[৩৬] হিঁজাই
এক পাও যাইতে আর আমি মানা করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

পছিম মিক্যা ন যাইও সাইগরের পারে।
আমার কথা মনত রাইখ্যো কই বারে বারে॥
হার্ম্মাদ্যারা লৈয়া যাইব গলাৎ বাঁধি দড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—(১—৫২)

(৩)

ন শুনিল কথা বাদসা ন মানিল মানা।
নাহি চিনে পন্থ তারা বেগর ঠিকানা॥
ধীরে ধীরে যারগই[৩৭] তবু হাতীর উপর চড়িরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

তের দিন তের রাইত ভরমণা করিয়া।
ছাম্নে পাইল সুজা বাদসা বেমান[৩৮] দরিয়া॥
কুলেতে পড়িয়া ঢেউ করে গড়াগড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

আকাশ পাতাল বাদসা ভাবে বারে বার।
এমন দরিয়া আমায় কে করিবে পার॥
সঙ্কটে পড়িলাম এখন উপায় কি করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

এইরূপে তিন দিন গুজারিয়া[৩৯] যায়।
চারিদিনে রোসাঙ্গ্যা এক আসিল তথায়॥
বাদসার আবস্থা সেই জাইন্‌ল ভালা করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

এর সঙ্গে বাদসাজাদা কি কাম করিল।
রোসাং সহরে আসি দাখিল হইল॥
সংবাদ পাইয়া রাজা কহে তড়াতড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

বার বাঙ্গলার বাদসা সুজা আইলো আমার ঠাঁই।
তান সঙ্গে হইব এখন বিষম লড়াই॥
চট্ করি সাজি লও রোসাং নগরী রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

পরেতে জানিলা রাজা সুজা বাদসার হাল।
দেশ ছাড়ি রাজ্য ছাড়ি পন্থের কাঙ্গাল॥
নছিবের দোষে তান ভাই হৈয়ে বৈরী রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

রাজার সঙ্গেতে তান দুস্তি[৪০] তৈল শেষে।
ঘর বাড়ী ছাড়ি সুজা রৈল রোসাং দেশে॥
তারপরে কি হইল কেম্নে বয়ান করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—(১—৩২)

(8)

দুনিয়াতে জাইন্য ভাইরে লালছে[৪১] পড়িয়া।
মানুষে মানুষর বুকে বিঁধে ছুরি দিয়া॥
দুদিন্যা[৪২] দুনিয়া খোদা দিয়ে দুখ্যে ভরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

একদিন পরীবানু দোমাহালার ঘরে।
খসমের কাছে বসি রং তামাসা করে॥
শত দুখ্‌খ বাদসা তখন গেলা যে পাসরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

রোসঙ্গ্যার রাজা তখন সেই পন্থ দিয়া।
হাবা[৪৩] খাইত যাইত আছিল হাতীতে চড়িয়া॥
আতাইক্যা[৪৪] দেখিল এই অপরূপ সোন্দরীরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

সোন্দরী পরীর তখন দোলে নাগর[৪৫] নথ।
মন মনুরা[৪৬] দিল উড়া দেখিয়া ছুরত॥
হাতীর উপরে রাজা যায় গড়াগড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

ভোগালুয়ে[৪৭] ভাত চায় তিয়াসীয়ে[৪৮] পানি।
পানিরে পাইলে নন্দী[৪৯] বুকে লয় টানি॥
আসকে ভাবে যে কেম্নে বাঞ্ছা পুর্ণ করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

আসকের মন জাইন্য বারিষার ঢল[৫০]
পরীর লাগিয়া রাজা হইল পাকল[৫১]
নছিবের দোষে সুজার দোস্ত হইল অরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—(১—২৪)


(৫)

আদিগুড়ি[৫২] কথা সুজা যখনে শুনিল।
কাঁদিয়া পরীর কাছে কহিতে লাগিল॥
দোন চোখে পানি তান পড়ে ঝরি ঝরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

দেশ নাই রাজ্য নাই না আছিল দুখ।
ভরা রাইখ্য তুমি আমার এই যে খাইল্যা[৫৩] বুক॥
তোমারে ছাড়িয়া আমি কেম্নে পরাণ ধরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

সুজার কাঁদনে পরীর বুগ ফাড়ি যায়।
দুখ্‌খের উপরে দুখ্‌খ দিল যে আল্লায়॥
রোসাঙ্গ্যার রাজা হইল কাল পরাণর বৈরী রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

কাঁদিয়া কাটিয়া পরে মন করি থির।
পোঁহাইত্যা[৫৪] রাতুয়া তারা হইল বাহির॥
পিছে ফিরি নাহি চায় চলে তড়াতড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

সাইগরের পারে আইলো বাদসা পরীজান।
দোন[৫৫] কন্যার লাগি তারার ঝরিল নয়ান॥
দুনিয়ার দুখ্‌খ আর ন সৈল[৫৬] শরীরে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

মাছ ধরে রোসাঙ্গ্যা ভাই ছোড একখান নাও।
বাদসা বলে তোমার নুকা মোরে আজি দাও॥
সঙ্গে লইয়া যাইয়ম[৫৭] আমি তোমার এই তরী রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

রোসাঙ্গ্যার হাতে পরী দিল সোণার হার।
লুজা বাদসা মাঝি হৈয়া সে নৌকা বাহার[৫৮]
পরথম জোয়ারের পানি আইয়ের[৫৯] হু হু করি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

বেমান দরিয়ার মাঝে নয়া এক মাঝি।
আওরতে[৬০] লইয়া সঙ্গে পাড়ি দিয়ে আজি॥
ঢেউএ যেন ডাকে তানে গুজরি গুজরি[৬১] রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

বাদসার মুখের পানে পরী রইলো চাহি।
মাঝ দরিয়ায় চলে সুজা নৌকা বাহি বাহি॥
হাত নাহি চলে অঙ্গ কাঁপে থরথরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

পোহাইয়া গেল রাইত হইল বেয়ান[৬২]
কণ্ডে যারগই[৬৩] নয়া মাঝি নাইরে গেয়ান[৬৪]
প্রাণ উড়িছে তান শিহরি শিহরি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

মনে মনে পড়ি লৈল ফজরের[৬৫] নমাজ।
বাদসা বলে শুন পরী শেষ দেখা আজ॥
ঢেউএর বাড়ি খাই লৈল গড়াগড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

আছমানে উডিল সুরুজ—বরণ তার লাল।
পরীর মুখ চাহি সুজা দিল এক ফাল[৬৬]
ওরে দেখা নাইসে গেল আর সেই ছোট তরী রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—

ডুপিল ডুপিল নুকা—সুজা পরীজান।
দরিয়ার মাঝে হায় দিল রে পরাণ॥
মরণেও রৈল তারা বুক জড়াজড়ি রে।
সাইগরে ডুপালি পরীরে—
হায় হায় দুখ্‌খে মরি রে!(১—৫৩)


  1. ডুপালি=ডুবাইলি।
  2. কাডাকাডি=কাটাকাটি।
  3. বার বাঙ্গলা=পূর্ব্ববঙ্গদেশ বারটি সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত ছিল বলিয়া মনে হয়। এই “বার বাঙ্গলা” কথাটিতে একটা চিরাগত সংস্কারের আভাস আছে। “বার ভূঞা” কথাটাও একই অর্থবাচক। অনেকে ভ্রমবশতঃ এই বার ভূঞাকে কোন বিশেষ শতাব্দীর বারটি জমিদার বলিয়া মনে করিয়া থাকেন।
  4. বাপর দিন্যা=পৈতৃক, পিতার দেওয়া।
  5. পেডর=পেটের।
  6. লোউ=রক্ত।
  7. গরীব.....মাগি=যাহারা ভিক্ষা করিয়া (মাগিয়া) খায়, সেই সকল গরীবদিগকেও ইহাদের অপেক্ষা অনেক ভাল বলিয়া গণ্য করি।
  8. বদর=পীর বদর। চট্টগ্রাম সহরে পীর বদরের সমাধি আছে।
  9. পাইক পহল=পক্ষী ইত্যাদি।
  10. গাছৎ=গাছে।
  11. সুগ=সুখ।
  12. কন কাইত=কোন দিকে।
  13. দহিন মিক্যা=দক্ষিণ দিকে। মিক্যা=মুখী।
  14. উয়র=উপরে।
  15. জেনে=দক্ষিণ দিকে।
  16. বয়ারে=বাতাসে।
  17. বাখরি=এক প্রকার অলঙ্কার।
  18. ঝুম্‌কামালা কানৎ=কর্ণে ঝুম্‌কার মালা।
  19. চান বোলাক=চন্দ্রের মত বেসর (?)
  20. পাড়াল্যা······ভরি রে=পাড়ার মা-বহিনেরা আসিয়া চক্ষু ভরিয়া তাহাদিগকে দেখিতে লাগিল।
  21. হুরিপরী=হুরি, অপ্সরা।
  22. কোন্ দিগদি কণ্ডে=কোন্ দিক্ দিয়া কোন্ খানে।
  23. তুলসীমালা=এক রকমের সুগন্ধ সরু চাল।
  24. ছালৈন=ব্যঞ্জন।
  25. চালা=গিরিবর্ত্ম।
  26. মুয়ৎ=মুখে।
  27. বাইঘ্যা=বাঘ।
  28. দইরন্যা=দরিয়া।
  29. ডাঙ্গর=বড়।
  30. পেরাবন=সমুদ্রের তীরবর্তী জল-জঙ্গলময় স্থান।
  31. ফায়দা=উপকার।
  32. হুদাহুদি=শুধু শুধু!
  33. রোসাঙ্গ্যা=আরাকানবাসী। আরাকানদের আর এক নাম রোসাঙ্গ।
  34. মিক্যা=দিকে।
  35. মুরঙ্গ্যা=অসভ্য পার্ব্বত্য জাতি
  36. হিঁজাই=সিদ্ধ করিয়া।
  37. যারগই=যাইতেছে।
  38. বেমান=সুবিশাল, সীমাহীন।
  39. গুজারিয়া=কাটিয়া।
  40. দুস্তি=বন্ধুত্ব।
  41. লালছে=লালসায়।
  42. দুদিন্যা=দুই দিনের।
  43. হাবা=হাওয়া।
  44. আতাইক্যা=অকস্মাৎ
  45. নাগর=নাকের।
  46. মন মনুরা=মন, চিত্ত; হৃদয় অর্থে “মন মনুরায়” অনেক প্রাচীন পুঁথিতে ব্যবহৃত দেখা যায়।
  47. ভোগালুয়ে=ক্ষুধার্ত্ত।
  48. তিয়াসীয়ে=তৃষ্ণার্ত্ত।
  49. নন্দী=নদী।
  50. বারিষার ঢল=বর্ষার প্লাবন।
  51. পাকল=পাগল।
  52. আদিগুড়ি=গোড়াকার।
  53. খাইল্যা=খালি।
  54. পোঁহাইত্যা=শেষ রাত্রিতে।
  55. দোন=দুই।
  56. সৈল=সহিল।
  57. যাইয়ম=যাইব।
  58. বাহার=বাহে, বাহিতে লাগিল।
  59. আইয়ের=আসে।
  60. আওয়তে=স্ত্রীকে।
  61. গুজরি, গুজরি=গর্জ্জন করিতে করিতে। এই শব্দ ‘হাতী খেদার’ গানে এবং অন্যত্র অনেক বার পাওয়া গিয়াছে।
  62. বেয়ান=সকাল।
  63. কণ্ডে যারগই=কোথায় যাইতেছে।
  64. গেয়ান=জ্ঞান।
  65. ফজরের=সকালের।
  66. ফাল=লম্ফ।