পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/ভারইয়া রাজার কাহিনী
ভারাইয়া রাজার কাহিনী
এই গানটিতে ভারাইয়া রাজার সঙ্গে ক্ষত্রিয় বীরসিংহ রাজার যুদ্ধের বিবরণ আছে। বীরসিংহের রাজ্যের প্রান্তে একটা নিবিড় জঙ্গলিয়া দেশ ছিল; ভারাইয়া রাজা সেই বন কাটাইয়া অনেক চাষা নিযুক্ত করিয়া উহা আবাদ করিয়া ফেলিলেন; বড় বড় তাল, তমাল, শাল ও দারাক বৃক্ষ কর্ত্তিত হইল এবং সেই আরণ্য প্রদেশ সুশোভন সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হইয়া কৃষকের লাঙ্গলের অনুগত হইল। এই সংবাদ যখন ক্ষত্ত্রিয় রাজা বীরসিংহ শুনিলেন, তখন তিনি রণডঙ্কা বাজাইয়া যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক প্রকার অপরিচিত অস্ত্র ও অজ্ঞাতনামা রণবাদ্যের নাম পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু এ যুদ্ধ মূলতঃ শেল, শূল, মুদ্গর বা আগ্নেয়াস্ত্রের যুদ্ধ নহে:―মন্ত্র-তন্ত্র ও যাদুবিদ্যাই হইল এ যুদ্ধের সর্ব্ব প্রধান অস্ত্র-শস্ত্র। ক্ষত্ত্রিয় রাজা ও তাঁহার পুত্রের অসামান্য বীরত্ব পাহাড়িয়া রাজার মন্ত্রপূত ধূলিমুষ্টির নিকট হা’র মানিল। পিতাপুত্র বন্দী হইলেন। অবশেষে কুমারের সহিত ভারাইয়া রাজার রূপসী কন্যার বিবাহে স্বীকৃত হইয়া বীরসিংহ মুক্তি লাভ করিলেন। অসংখ্য মূল্যবান্ উপঢৌকন পাইয়া বন্দী রাজা স্বরাজে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। কিন্তু ভারাইয়া রাজার সঙ্গে তাঁহার আত্মীয়তা হইবে; একথা যতবার তাঁহার মনে হইল, ততবার তাঁহার ক্রোধবহ্নি জ্বলিয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজেকে ধিক্কার দিয়া তাঁহার অতি পবিত্র প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করিয়া তিনি দ্বিতীয়বার তাঁহার পুত্রকে রণক্ষেত্রে প্রেরণ করিলেন। কুমারের বলবীর্য্যের অভাব ছিল না,―তাঁহার সুশিক্ষিত সৈন্য শীঘ্রই পাহাড়িয়া সৈন্যদিগকে বিপর্যস্ত করিল; কিন্তু আবার সেই ধূলিমুষ্টি, সেই যাদুবিদ্যার অমোঘ শক্তিতে আকাশবাতাস অন্ধকারে পূর্ণ হইয়া গেল। কুমার পুনর্ব্বার বন্দী হইলেন এবং তাঁহার মৃত্যুদণ্ড আসন্ন হইল।
এই সময়ে ভারাইয়া রাজার কন্যা কুমারকে চাক্ষুষ না দেখিলেও পিতৃদত্ত প্রতিশ্রুতি শিরোধার্য করিয়া লইয়াছিলেন। “স্বামী” এই কথাটির মাধুরীতে তাঁহার হৃদয় জ্যোৎস্নাময় হইয়া উঠিয়াছিল। রাজকুমারের বিপদের কথা শুনিয়া কুমারী অস্থির হইয়া উঠিলেন; তিনি স্বীয় অঙ্গ হইতে হীরকের বলয় ও মণিময় কঙ্কণ প্রভৃতি যাবতীয় অলঙ্কার উৎকোচ দিয়া কারারক্ষকের নিকট কারাগারে প্রবেশাধিকার লাভ করিলেন।
এই পালাগানটির চিত্রে নানাপ্রকার বিভীষিকাপূর্ণ তান্ত্রিক অনুষ্ঠান ইহার ভীষণতা আরও বাড়াইয়া দিয়াছে। কিন্তু অন্ধকার রাতে একবারটি যদি বিদ্যুৎ চম্কাইয়া জগতের প্রসন্ন রূপ উদঘাটন করিয়া দেখায়, তবে তাহা যেরূপ স্মরণীয় হইয়া থাকে―এই বিপদসঙ্কুল জটিল অবস্থাচক্রে বিঘূর্ণিত প্রণয়-কাহিনীতে কুমার ও রাজকন্যার মিলনের দৃশ্যটা তেমনি উজ্জ্বল, তেমনি মনোহর। রাজকুমারী শৃঙ্খলিত রাজকুমারের শৃঙ্খল মোচন করিয়া যেরূপ স্নেহমধুর করুণ রসের উৎস-স্বরূপ অশ্রুপাত করিয়াছিলেন, রাজকুমারও সাগ্রহে সেইরূপ আন্তরিকতার সহিত সেই প্রণয়ের প্রতিদান দিয়াছিলেন। কুমার রাজকন্যাকে একটিবারও জিজ্ঞাসা করিলেন না, এই ভাবে তাঁহাকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টার মধ্যে কুমারীর কোন ভাবী বিপদ্ প্রচ্ছন্ন ছিল কিনা? কুমারী কারাতোরণ খুলিয়া দিলেন, যুবরাজ কৃতজ্ঞচিত্তে ঘোড়ায় আরোহণ করিয়া স্বদেশে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এবং চন্দ্রসূর্য্যকে শুনাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়া গেলেন যে কুমারীই তাঁহার ধর্মপত্নী, জীবন-মরণে তাঁহার অর্দ্ধাঙ্গিনী থাকিবেন।
ভাগ্যচক্রের আবর্তনে ভারাইয়া রাজার অবস্থা প্রতিকূল হইল। বীরসিংহ কামাখ্যায় যাইয়া মন্ত্রতন্ত্র শিখিয়া আসিলেন এবং বন্য রাজাকে এবার আবদ্ধ করিয়া বন্য পশুর ন্যায় বন্দী করিলেন। তারপর তিনি মন্ত্রপূত ধূলিমুষ্টি তাহার উপর নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, ‘তুমি চিরকাল পাষাণ হইয়া থাক।’ সেই অমোঘ সন্ধানে রাজার রক্তমাংসের শরীর প্রস্তরে পরিণত হইল।
ভারাইয়া রাজার ঐশ্বর্য ও রাজতক্ত সমস্তই বীরসিংহের করতলগত হইল! এই সময়ে ঐশ্বর্য্যচ্যুতা ভারাইয়া রাজপত্নী কাঙ্গালিনীর মত যাইয়া বীরসিংহের দরবারে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার সেই দীনহীন বেশ ও শোচনীয় অবস্থা দর্শনে প্রজামণ্ডলীর নয়নে অশ্রুর বাণ ছুটিল। কিন্তু বীরসিংহ অতি কঠোর ভাবে তাঁহার সমস্ত আবেদন প্রত্যাখ্যান করিলেন। রাজমহিষী নিজের জন্য কোন প্রার্থনাই করেন নাই। তিনি ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া রাজাকে তাঁহার কন্যার সহিত কুমারের বিবাহের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন; এই কাতর নিবেদন উচ্চারণ করিতে যাইয়া তাঁহার কণ্ঠস্বর কতবার গদ্গদ হইয়াছিল,―তাঁহার ভাষা কতবার কাঁপিয়া গিয়াছিল এবং তিনি কত না মর্ম্মন্তুদ বেদনা অনুভব করিতেছিলেন! কিন্তু ক্ষত্রিয়পুঙ্গব বীরসিংহ সেই রাণীকে যে কদর্য্য ভাষায় গালাগালি দিয়াছিলেন, তাহাতে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা নিম্ন শ্রেণীর লোকের উপর কিরূপ বিদ্বিষ্ট ও ঘৃণার ভাব পোষণ করেন, তাহা জাজ্বল্যমান। রাণী বিষ খাইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। রাজকন্যাও উদ্দেশে স্বামীর পদে শত শত মিনতি জানাইয়া ও ভালবাসার কতকগুলি চূড়ান্ত কথা বলিয়া মাতার অনুগামিনী হইলেন। পালা রচয়িতা লিখিয়াছেন কুমারীর এই অবস্থা দর্শনে তাঁহার প্রস্তরীভূত পিতার চক্ষু দিয়া দুই ফোঁটা জল পড়িয়াছিল; পাষাণ যে দুঃখে গলিয়া গিয়াছিল, রক্তমাংসের শরীরে তাহার কোন প্রভাব দেখা গেল না।
ভারাইয়া-রাজকন্যা অপরাপর পালাগানগুলির প্রথিতকীর্ত্তি মহীয়সী মহিলা চরিত্র-সমূহের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইবার যোগ্যা, তিনি সর্ব্ববিধ গুণমণ্ডিতা। কিন্তু নায়কের চরিত্র অতি হীন। ধোপার পাটের কাঞ্চনমালার প্রণয়ী রাজপুত্রের মতই তাহার চরিত্র।
এই গানটিতে নানা তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব দেখিয়া মনে হয় ইহা দশমএকাদশ শতাব্দীর প্রভাবান্বিত, কিন্তু গানটি ঠিক কবে রচিত হইয়াছিল তাহা বলা যায় না।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বিজয়নারায়ণ আচার্য্য মহাশয়ের সাহায্যে চন্দ্রকুমার দে এই পালাটি সংগ্রহ করেন। নাজির নামক এক ফকির এই গানের প্রথমাংশ আবৃত্তি করিয়াছিল, পরে ঐ জেলার ফুলপুর নামক গ্রামনিবাসী আর একজন ফকির বাকী অংশের অনেকটা দিয়াছিল। শিমুলকান্দা-নিবাসী ঈশান নামক একব্যক্তির সাহায্য লইয়া চন্দ্রকুমারবাবু পালাটি সম্পূর্ণ করেন। একটা বন্য রাজার সঙ্গে ক্ষত্ত্রিয় রাজার বিবাহের প্রস্তাবটাও বোধ হয় শেষকালে হিন্দু সমাজে খুব সঙ্গত ব্যাপার বলিয়া পরিগৃহীত হয় নাই, বিশেষ বিবাহের পূর্ব্বে এতটা প্রেমের বাড়াবাড়ি ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বিরোধী হইয়াছিল; সুতরাং পালাটি হিন্দুদের সম্বন্ধে হইলেও মুসলমান গায়কদের কৃপায় ইহা বহুকাল যাবৎ রক্ষা পাইয়া আসিয়াছিল।
আমরা বহু রূপকথায় কামাখ্যাকে সর্ব্বপ্রকার তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রভূমি-স্বরূপ বর্ণিত দেখিতে পাই। একাদশ শতাব্দীতে ভারতীয়, বিশেষতঃ বঙ্গদেশের তন্ত্রমন্ত্র ও সিদ্ধাদের অলৌকিক শক্তি-সম্বন্ধে নানা গল্পগুজব য়ুরোপে প্রবেশ করিয়াছিল। তৎসম্বন্ধে আমার Folk Literature of Bengal নামক পুস্তকে সবিশেষ আলোচনা করিয়াছি। গ্যালিক কাহিনীগুলিতে ড্রুইড পুরোহিতগণের অলৌকিক শক্তিমত্তা-সম্বন্ধে যে সকল বর্ণিত আছে, তাহা ভারতীয় সিদ্ধাদের বৃত্তান্তের অনুরূপ;―গ্যালিক প্রবাদ ও গল্পে এই ভাবের বহু কথা প্রচলিত আছে―হেস্পারিডেসের রাজকুমারীদের টুইরেনের তিন রাজপুত্রের অনুসরণকাহিনী অনেকটা আমাদের ময়নামতীর গল্পে গোদা যম ও রাণীর লড়াইএর কথা স্মরণ করাইয়া দেয়।
এই তান্ত্রিক প্রভাব দশম-একাদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশকে একেবারে গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছিল। তাহারও পূর্ব্বে বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ সিংহাসনের গল্পগুলি তান্ত্রিক সিদ্ধির আদিম প্রভাব সূচনা করিতেছে। ভারাইয়া রাজার কাহিনী এই প্রভাবের নিদর্শন, কিন্তু সম্ভবতঃ পালাটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে বা চতুর্দ্দশ শতাব্দীর আদিভাগে রচিত হইয়া থাকিবে। ভাষা ও গল্প বলিবার ভঙ্গী দেখিয়া আমাদের এই ধারণা হইয়াছে।
ভারইয়া রাজার কাহিনী
ভারইয়া রাজার কাহিনী
(১)
আম গোসাইলার ভারইয়া রাজা রে
কথা শুন দিয়া মন।
এমুন ক্ষেমতাবান রাজা নাই সে ত্রিভুবন॥৩
মুল্লুকগিরী করে রাজা সুন্দাসেতীর[১] পাড়;
আরে ভালা সুন্দাসেতীর পাড়॥৫
লোক লস্কর যত, তাহান বা কহিবাম কত,
সে আচানৌকা[২] সমাচার॥৭
সভা কইরা বইছ[৩] ভাইরে হিন্দু মুসলমান!
তোমরায় জনাবে আগে জানাইরে সেলাম॥৯
আজিকার গান গাইম ভারইয়ার কাহিনী।
কি গান গাহিবাম আমি ভাল মন্দ নাহি জানি॥১১
আরে ভাই এক পাল হাতী আছে রাজার
আর পাল ঘোড়া।১৩
ময়াল মহিষ কত গুণিয়া বড়ায় না তত
শত শত কোটাল পাহারা॥১৫
বাথানে দুধের গাই তার গুণাবাছা[৪] নাই
মুল্লুকের রাজা।
ভাটি মুল্লুকে নাই ভাইরে তানির মতন রাজা॥১৮
(২)
আর ভাইরে এক ত দিনের কথা শুন দিয়া মন।
চলিলাইন কুচ রাজা ভূমিত দরশন[৫]॥২০
সুন্দাসেতী নদীর পাড় কতক জঙ্গলা।
লোকজন কহে রাজা আন ত কামেলা[৬]॥২২
কামেলা আনিয়া রাজা কাটাও ত বন।
ভেউর জঙ্গলার মাঝে কোন্ বা প্রয়োজন॥২৪
তবে রাজা যুক্তি না কইরা কামেলা আনিল।
বার শত কোচ আইসা হাজির হইল॥২৬
রাজার না পাইক আইস্যা ডঙ্কায় মাইল বাড়ি।
বার শত কামেলা দেখ, কতক পুরুষ নারী॥২৮
কেহু কাটে ঘোর জঙ্গলায় বড় বড় গাছ।
কোদালিয়া কাটিয়া মাটি চলেক যত পাছ॥৩০
আগুন লাগাইল কেউ জঙ্গলার মাঝে।
বনের যতেক বাঘ ভাল্লুক পড়িল বিপাকে॥৩২
আর ভাইরে তরাসে ছুটিয়া না যায়
নাহি পায় রে দিশা।
পশুপক্ষী উইড়া যায় রে না কইরা বাসার আশা॥৩৪
ছাও ত রাখিয়া মাও ডরেতে উড়িল।
আগুনের লাল জিব্বা আসমানে ঠেকিল॥৩৬
বনেলা[৭] না পশুপক্ষী করে হাহাকার।
সুখের না ঘরবাড়ী, আরে ভালা,
কোন্ দুষ্মনে করলো ছারখার॥৩৮
চৈতের রোইদ খরতর, ভালা, বৈশাখ মাস আসে।
হাল বাইতে কোচের রাজা যুক্তি সল্লা[৮] করে॥৪০
বড় বড় হালুয়া[৯] যতে দিল নিমন্ত্রণ।
নিমন্ত্রণ পাইয়া তারা আইল কোচ রাজার বাড়ী॥৪২
ঠাসা লাঙ্গল ভাসা হাল গরু মইষে টানে।
খবরিয়ায় কহে ত খবর রাজার বির্দ্দমানে॥৪৪
(৩)
শুন শুন বীরসিংহ রাজা কহি যে তোমারে।
তোমার জমিদারী দখল কইরা লয় ভাড়াইয়া ধাঙ্গরে॥৪৬
লাঠিয়ালে মাইল ফাল[১০], ভালা, এতেক কথা শুনিয়া।
রাজ্য যুড়িয়া লোক জনে, ভালা, হইল মুনিয়া॥৪৮
কেউবা লইল বাঁশের লাঠিরে কেউবা লইল তীর।
ঝলুঙ্গা[১১] লইয়া নাচে, ভালা, বড় বড় বীর॥৫০
টেডা[১২] লৈল আর লইল রে, শল্কী[১৩] চোখা মাখা।
হাতে লৈল ধনুক ফলা মাথে লৈল ঝুকা[১৪]॥৫২
কুঁদিয়া[১৫] চলিল লস্কর, আরে ভালা, সুন্দাসেতীর পাড়ে।
কামেলা পলাইয়া যায় ভালা বীর সিংহের ডরে॥৫৪
আরে ভালা, তবেত-কামেলাগণ কোন্ কাম করে।
দাখিল[১৬] হইল তারা গিয়া ভারইয়ার পুরে॥৫৬
শুন শুন ভারইয়া রাজা কহি যে তোমারে।
আইল রাজা বীর সিংহ খেদাইল আমরারে॥৫৮
এইকথা শুইন্যা ভারইয়া রাজার গুস্সা[১৭] যে হইল।
বারুদের আগুন যেমুন জ্বলিয়া উঠিল॥৬০
কে আছ রে লোকজন সাজরে জল্তি[১৮]।
কত বল ধরে বেটা সেই সিঙ্গির পুতি[১৯]॥৬২
নগর কাটিয়া ভালা সাওরে[২০] ভাসাও।
বীরসিঙ্গি’র মস্তক আইন্যা, ভালা, আমারে দেখাও॥৬৪
লম্ফ দিয়া ভারইয়া রাজা ঘোড়াকে চলিল।
কুঁদিয়া ঘোড়ার পিষ্ঠে সোয়ার না হইল॥৬৬
তবে যত লোকজন কহিতে অপার।
তাহান পিছনে চলে, সবে কইরা মার মার॥৬৮
দুই রাজার লোক-লস্কর, ভালা, একত্র হইল—
হায় ভালা একত্র হইল।
সায়রের বুকে যেমুন তোফান ছুটিল॥৭০
কারও বুকে তীরের ঘা, লৌ উঠে মুখে।
ধনুক তীর বাজে গিয়া মালেমস্ত[২১] বুকে॥৭২
সবার মস্ত পালোয়ান, ‘বীর’—শিরে পাগ্ড়ী বানা[২২]।
আগে আগে যায় বীর নাহি মানে মানা॥৭৪
হাতে লোহার মুগুর যারে মারে বাড়ী।
মাও বাপের ছাড়ে আশা জমিনেতে পড়ি॥৭৬
কার কাটে শির গলা রে, কারও হাত পাও।
কেউ কান্দে ডাক ছাড়ে কোথা রইল মাও॥৭৮
সুন্দাসেতী নদীর জল, ভালা, রক্তে রাঙা হইল।
ভারইয়া দলের লোক হারি যে মানিল॥৮০
হাতে ধনু বীরসিংহ রাজা সন্ধান যে জানে।
পালোয়ান বীরের বুকে এক তীর হানে॥৮২
লোহার কাল তীর গোটা বাতাসে উড়িল।
বুকে ত বিন্ধিয়া তার পৃষ্ঠে বাহির হইল॥৮৪
তবে ত বীরসিংহের দল করে মার মার।
ভারইয়া রাজার লস্কর ভালা করে হাহাকার॥৮৬
তন্তর মন্তর জানে ভারইয়া রাজা রে—
কোন্ কাম করিল।
এক মুইট্[২৩] থলার ধূলা হাতে ত লইল॥৮৮
হাতে লইয়া থলার ধূলা, ভালা, কোন্ কাম না করে।
মন্ত্র পড়িয়া রাজা ওস্তাদের নাম শুরে[২৪]॥৯০
তবে ত ভারইয়া রাজা কোন্ কাম করিল।
হাতের ধুলা লইয়া রাজা ফুঁয়ে উড়াইল॥৯২
আন্ধ্যা লাগ্যা বন্দী হইল রে, সিঙ্গের লস্কর।
পথ নাই সে পায় তারা খুঁজিয়া বিস্তর॥৯৪
ঘোড়ার পিষ্ঠে সিঙ্গিরাজ পরমাদ গুণিল।
ভারইয়া রাজা তবে রাজারে বান্ধিল॥৯৬
হাতে দিল হাতের বেড়ী পায়েত বান্ল দড়ি।
হাতীর উপর লৈয়া চলে, ভালা, ভারইয়ার বাড়ী॥৯৮
(8)
লোকজন খবর কয়’ গিয়া রাজার ছাওয়ালে।
তোমার বাপ বন্দী হইল ভালা ভারই রাজার পুরে॥১০০
বাপের দুগ্গতির কথা, আরে ভালা, যখনি শুনিল রে,
রাজার বেটা দুধরাজ, পরিল রণের সাজ
লাল ঘোড়ায় সওয়ার হইল রে।১০২
আগে পাছে লস্কর যত,
বীর বড়, রে বড়—
সকলি চলিল তবে ধেইয়া।
কেউ মারে উল্কা ফাল,[২৫]
কেউ কান্ধে লোহার ফাল,[২৬]
আম-গোসাইলের পথ আগুলিয়া রে॥১০৮
তবে ত ভারইয়া রাজা কোন কাম করে।
আনিল ডাকিয়া রাজা যতেক লস্করে॥১১০
কাড়া না নাগেরা বাজে ডঙ্কায় মাইল রে বাড়ি।
যত যতেক বীর পল্লোয়ান হইল আগুসারি॥১১২
আরে ভালা, আলে বেড়া, তালে বেড়া,
হুঙ্কারি মারিল।
বজ্র হুঙ্কারে দেখ তালি যে লাগিল॥১১৪
বায়ে ত তউরালে কাট্যা[২৭], ডাইন সিরগালে[২৮] পুছে।
ভারইয়ার লস্কর যত খাড়া আগে পাছে॥১১৬
শমন সমান রাজার বেটা ঘোড়া গুটি চালাইল।
রণের ঘোড়ার পিষ্ঠে দেখ চাবুক মারিল॥১১৮
হাতে লইয়া তীর তরোয়াল, ভালা,
তারা হেন ছুটে।
ডাইনে বাঁয়ে যত লোকে কলা গাছ কাটে॥১২০
তবে ত ভারইয়ার লোক প্রমাদ গুণিল।
কাত্যানির কলা গাছ ভালা জমিনে ঢলিল॥১২২
খবরিয়ায়[২৯] খবর কয়, কি কর ভারই রাজা
গিরেতে[৩০] বসিয়া?
তোমার লস্কর যত মৈল রণথলাতে গিয়া॥১২৪
কি কাম করিল কুমার আরে কি কাম করিল।
বড় বড় বীর লইয়া সঙ্গেত ভারইয়া রাজা
পন্থে মেলা দিল॥১২৬
এক মুঠা পন্থের ধূলা হাতে ত লইয়া
ভারই রাজা, ভালা, মন্ত্র যে পড়িল।
মন্ত্র পড়িয়া রাজা ধূলা উড়াইল॥১২৯
কি কব ওস্তাদের গুণ গো
কামাখ্যার দেবীর কিরপায়।
যাহার প্রসাদে মরা বাঁচে
ঘরে ফিরি আয়॥১৩৩
যে জন হইলে রুষ্ট মূল কাটে তার নালে।
বাঁচিতে নাই সে পারে লোক লুকাইয়া সায়রের জলে॥১৩৫
যখনি ভারইয়া রাজা আরে ভালা ধূলি উড়াইল।
দুধরাজের লস্করা যত সবে পরমাদ গণিল॥১৩৭
কেহুর ভাঙ্গে ঠেঙ্গের নালা কেহুর ভাঙ্গে হাত।
বজ্জর ভাঙ্গিয়া শিরে যেন পড়ল অকর্সাৎ॥১৩৯
ঘোড়ার ভাঙ্গ্ল পাও, ভালা,
কুমার হায়, দেখ না দেখ নয়ানে।
কোন্ দিকে যাইতে গেলে ভারইয়ার টানে॥১৪২
ওলা মন্তর কোলা মন্তর রে
মন্তরের গুণে।
দুধরাজে বান্ধিয়া লৈল, হায় ভালা,
বাপের বির্দ্দমানে॥১৪৪
(৫)
বন্দিখানা বাপ বেটা হায় ভালা মরে ত কান্দিয়া।
বাহিশ মুণী[৩১] পাত্থর দেছে ত ভালা বুকের উপুর
তুলিয়া॥১৪৬
বাপ বেটার কান্দনেতে দেখ পাত্থর গল্যা পানি।
এহি মতে যায় দিন ভালা পোষায় রজনী॥১৪৮
তবে ত ভারইয়া রাজা কোন্ কাম করিল।
পাত্র মিত্র লৈয়া রাজা যুক্তি যে করিল॥১৫০
এক পাত্র দিগম্বর রাজার পিয়ার[৩২] বড়
রাজা কোন্ কাম করে।
তাহারে পাঠাইল রাজা বন্দিখানা ঘরে॥১৫২
“শুন শুন সিঙ্গ রাজা, রাজা আরে,
কহি যে তোমারে।
যে কারণ আইলাম আমি রাজা তোমার গোচারে॥১৫৪
কোচের রাজা ভারই হাজরা সদয় হইল।
(তোমারেরে রাজা সদয় হইল)
তে কারণে আমারে পাঠাইল॥১৫৬
“এক কন্যা আছে রাজার যুবাবতী ঘরে।
চাম্পাবতী নাম তার জানা সকল স’রে॥১৫৮
“তাহান রূপের কথা কইতে না জোয়ায়।
পরদীম পসর[৩৩] দেখ আন্ধারে লুকায়॥১৬০
চন্দ্র ছুরৎ রাজার বেটী যে দেখে না ভোলে।
মেঘেত বান্ধিয়া রাখে কন্যা আপনার চুলে॥১৬২
মুয়েত[৩৪] বান্ধিয়া রাখে কন্যা পুন্নিমার চান্দে।
দুই না আঁখিতে কন্যা দুই তারা বান্ধে॥১৬৪
বুকে ত বান্ধিয়া রাখে কন্যা যোড় কুসুমের কলি।
রাঙ্গা ঠোঁটে ছাইন্দা রাখে কন্যা উজ্জ্ব্যালা বিজুলী॥১৬৬
সাড়িতে বান্ধিয়া রাখে কন্যা আর যত তারা।
একবার দেখিলে রূপ না যায় পাশুরা[৩৫]॥১৬৮
“শুন শুন সিঙ্গ রাজা কহি যে তোমারে॥
এহি কন্যা বিভা করাও তুমি দুধরাজ কুমারে॥১৭০
অর্দ্ধেক রাজত্বি দিব রাজা আরে মালে মাল।
হস্তী ঘোড়া যতেক দিবে মইষের বাথান॥১৭২
গাই দিব রাজা পঞ্চশত সঙ্গেত বাছুরী।
পঞ্চশত দাসী দিব রাজা রূপে বিদ্যাধুরী॥১৭৪
ধেয়ান গেয়ান মন্তর রে রাজা দিব শিখাইয়া।
হালে ঘরে ত যাহ রাজা এ সব লইয়া॥”১৭৬
তবে রাজা বীরসিংহ কোন্ কাম করিল।
দিগম্বরের কথা শুনি রাজা বেন্নামুখী॥[৩৬] হইল।১৭৮
অনেয়াই[৩৭] কথা রাজা আরে ভালা
বহুত ক্ষণ চিন্তা যে করিল।
দিগম্বরের কথা রাজা শেষে স্বীকার হইয়া গেল॥১৮০
আপ্তকুল বিচার কইরা রে রাজা ছলনা পাতিল।
বেটার বিভা দিবেক বইল্যা ভালা স্বীকার হইল॥১৮২
ডাম্বা ঢোল বাজে রাজার ঘরে ভালা
বহুত উঠ্ল রুল[৩৮]।
ঘর-যুয়ানী[৩৯] কন্যার আইজ বুঝি ফুটল বিয়ার ফুল॥১৮৪
দুই বিয়াইয়ে কোলাকুলি দেখ রঙ্গসহাল[৪০] করে।
তবে ত ভারই রাজা কোন্ কাম করে॥১৮৬
যত যত উছা বাছা চিজ বস্তু নগরে আছিল।
মৈষের পিষ্ঠে বোঝাই দিয়া রাজা বীরসিংহে দিল॥১৮৮
খুশী হালে সিঙ্গ রাজা পুত লইয়া নিজ গিরে ফিরিল।
দেশে ত ফিরিয়া রাজা কোন্ কাম করিল॥১৯০
অপমান বহুত পাইয়া ভুলিত না পারে।
আরবার বীরসিঙ্গরাজ রণসাজ ধরে॥১৯২
(৬)
ঘার নুয়াইয়া তবে দুধরাজ সামনে হইল খাড়া রে।
“আমি যাইবাম আইজের রণে ত মোরে
দেহ উনমতি[৪১] রে॥১৯৪
হায় ভালা শুন শুন বাপ ওগো কহি যে তোমারে।
ভারইয়ায় হস্তে গলে বাইন্ধা না আইন্যা আজি
দিবাম তোমারে॥১৯৬
যদি না আনিতে পারি শেষে যাইরে কইয়া।
আগুণে পুড়িয়া মরিম আমি ইহার লাগিয়া॥১৯৮
এ মুখ না দেখাইম বাপ গো নেহুলার সহরে।
পরতিজ্ঞা কইরা চলিলাম বাপ তোমার গোচারে॥”২০০
হাতে লৈয়া ঢাল খাড়া লস্কর চলিল ধাইয়া।
লাল গোটা ঘোড়াত কুমার সওয়ার হইল যাইয়া॥২০৪
জিব্বা গোটা দেখি ঘোড়ার জ্বলন্ত আঙ্গেরা।
পবনার গতি ঘোড়া শূন্যে মারে উড়া॥২০৪
তবে ত রাজার বেটা ভালা কোন্ কাম করিল।
ভারইয়ার রাজ্যে গিয়া তিন ডাক মারিল॥২০৬
“কি কররে দুষ্মন রাজা গিরেতে বসিয়া।
যম ত খাড়া হইল তোমার শিয়রে আসিয়া॥”২০৮
তবে ত ভারইয়া রাজা গোস্সায় জ্বলিল।
কুঁদিয়া ভারইয়া রাজা ঘরের বাহির হইল॥২১০
দুই ত লস্করে রণ রণথলার মাঝে।
বড় বড় বীর পাল্লোয়ান সাজে॥২১২
আটকাইতে না পারে দুধরাজে তারা যেমুন ছুটে।
কাত্যালির কলা গাছ সাম্নে পাইলে কাটে॥২১৪
তবে ত আউল রাজা কোন্ কাম করে।
মন্তর পড়িয়া রাজা ধূলা মুইটা ছাড়ে॥২১৬
মন্তের ধূলায় দেখ দুনিয়া আন্ধার।
দুধরাজের লস্করেরা করে হাহাকার॥২১৮
শিরে গলে বান্ধিয়া ভারইয়া রাজা লইল কুমারে।
কুমারে বান্ধিয়া রাখে বন্দিখানা ঘরে॥২২০
বাইশ মুণী পাথর দিল রাজা বুকে ত তুলিয়া।
লোক লস্করা গেল তার রাজ্যে ত পলাইয়া॥২২২
(৭)
(হায় ভালা) শীতল মন্দির ঘরে থাক্যা তাহা চাম্পাপুতি শুনে।
আপনি বহিল লোর কন্যার দুই নয়ানে॥২২৪
ভেউরা জঙ্গলার মাঝে বিরক্ক সারি সারি।
এক বুণ্টায়[৪২] ফুট্ল ফুল রে পুরুষ আর নারী॥২২৬
যার উবুরা[৪৩] মাটিরে দিয়া ভালা বিধাতা গড়িল।
সেই ত করম পুরুষ রে আইসা দেখা দিল॥২২৮
বাপে দিলা বাক্যি দান রে প্রভু হইলা তুমি।
জীবনে মরণে বন্ধু প্রাণকান্ত তুমি॥২৩০
বাপে দিলা বাক্যি দান আমি হইলাম দাসী।
আইজের না ফুটা ফুল রে কাইল যে হইব বাসি॥২৩২
আইজে গাইথাছি মালা শীতল মন্দিরে।
বহুত না কইরা আশা বন্ধু পরাইবাম তোমার গলে॥২৩৪
সুগন্ধি চন্দন চুয়া রাখ্যাছি যতনে।
যৌবন ঢালিয়া দিবাম বন্ধু তোমার চরণে॥২৩৬
কেশেত মুছাইয়া চরণ পালঙ্কে বসাইম।
সাজাইয়া বাঙ্গালা পান রে মুখে তুল্যা দিম॥২৩৮
তোমারে পাইব বল্যারে, বন্ধু, কতই না আশায়।
বড় দুঃখে দিন গেল রজনী না যায়॥২৪০
চাম্পা ফুলের মালা গলে বন্ধু আইবা মন্দিরে।
আইজ কেন আইলা শুনি দুম্মনের বেশে।
আইজ কেন আইলা শুনি লড়াইকের সাজে॥২৪৩
ঢোলের বদলে বন্ধু বাজাইলা কাড়া।
বাঁশীর বদলে বন্ধু বাজাইলা নাকারা॥২৪৫
মঙ্গল জোকার নাইরে বন্ধু দেশে হাহাকার।
এহি মতে হবে বুঝি বন্ধু বিয়া সে আমার॥২৪৭
বিষ খাইয়া মরিম আমি গলে দিবাম কাতি।
জীবনে মরণে তুমি হইও পরাণ পতি॥২৪৯
না দেখ্যাছি চান্দমুখ দেখ্যাছি স্বপনে।
না দেখা না শুন্যা বন্ধু সপ্যাছি পরাণে॥২৫১
আশা পিয়াসা লইয়া জীবন ফুরায়।
পবনায় ধূলা যেমুন শূন্যেতে মিশায়॥২৫৩
(৮)
কি কর সুন্দর কন্যা গিরেতে বসিয়া কিবান কর।
তোমার বন্ধু বন্দী হইল বন্দী খানার ঘর॥২৫৫
হাতে গলায় বাইন্ধা রাজা লইল কুমারে।
বাইশমুণী পাথর তুইল্যা দিছে বুকের পরে॥২৫৭
আছে বা না আছে পরাণ কে জানিতে পারে।
দুষ্মন হইয়া রাজা মারিল কুমারে॥২৫৯
এহি কথা চম্পাপুতি কন্যা যইখনে শুনিল।
বিরক্ক ছাড়া কাউলীর লতা বিছাইয়া পড়িল॥২৬১
শুন শুন পরাণের ধাই গো কহি যে তোমারে।
আমারে লইয়া চল গো বন্দিখানা ঘরে॥২৬৩
দুষ্মন বিধাতা মোর কপালে লিখিল।
আবিয়াত[৪৪] কালে মোরে বিধুবা করিল॥২৬৫
দুষ্মন হইয়া বাপ এতেক করিল।
হস্তের না কাঞ্চন মোর জোরে কাইড়া নিল॥২৬৭
মাও দুষ্মন বাপ রে দুষ্মন কারে কিবান[৪৫] বলি।
আবিয়াতে রাণ্ডী বইল্যা মোরে কে দিল রে গালি॥২৬৯
ফুল না ফুটিতে মোর বুণ্টা যে কাটিল।
না আইতে জোয়ারের পানি নদী শুকাইল॥২৭১
না আইতে মুখের নিশি খসিল চন্দমা।
না মিটি যৈবনের সাধ টুটিল গরিমা॥২৭৩
পরাণের ধাই ওগো কহি যে তোমারে।
শীঘ্র কইরা লইয়া যাহ মোরে বন্দিখানা ঘরে২৭৫
কান্ধে ভর কইরা কন্যা চলিল সত্বরে।
আষাঢ়িয়ার পাগেলা নদীরে যেমুন ছুট্লো অন্ধকারে॥২৭৭
(৯)
শুন রে উপাক্যা[৪৬] জহ্লাদ, জহ্লাদ আরে,
কহি যে তোমারে।
সকুলে ছাড়িয়া দেও ত আমার পরাণ বন্ধুরে॥২৮০
সোণার কপালী কন্যা শির থাক্যা খুলিল।
জহ্লাদের হস্তে কন্যা তুলিয়া না দিল॥২৮২
হস্ত হইতে খুল্যা কন্যা হীরার কঙ্কণ।
জহ্লাদের হস্তে দিয়া জুড়িল ক্রন্দন॥২৮৪
একে একে খুলে কন্যা হায় ভালা বাজু না বন্ধ তার।
একে একে খুলে কন্যা হীরা মতির হার॥২৮৬
গুঞ্জরী পঞ্চম কন্যা খুলিয়! লইল।
ধর লও বাপের জহ্লাদ হাতে তুল্যা নাই সে দিল॥২৮৮
কাণের না কন্নফুল দেখ্তে চমৎকার।
পিন্ধনে আছিল সাড়ী বসন্ত বাহার॥২৯০
সকল খুলিয়া লইল সাজিল ফতুরী[৪৭]।
পিন্ধনে কসিয়া পড়ে ছিঁড়া একখান সাড়ী॥২৯২
সর্ব্ব অলঙ্কার কন্যা ভালা জহ্লাদেরে দিল,
হায় ভালা, জহ্লাদেরে দিল।
জহ্লাদের হস্তে না ধইরা কন্যা কান্দন জুড়িল॥২৯৫
ছাইড়া দেরে প্রাণবন্ধে জহ্লাদ
তোরে দিব কি।
এতেক দুস্কু যে মোর কপালে ছিল হইয়া না রাজার ঝি॥২৯৭
আমারে বান্ধিয়া রাখরে জহ্লাদ
বন্দিখানার ঘরে।
কাল বিয়ানে আমার বাপ শূলে দিউক আমারে॥২৯৯
আমারে বাঁন্ধিয়া রাখ রে জহ্লাদ বন্ধেরে ছাড়িয়া।
বাইশমুনি পাত্থর দে রে বুকেত তুলিয়া॥৩০১
আমার কঠিন বুক রে শিল পাত্থরের সমান।
আমার বুকেত সইবে এহি অপমান॥৩০৩
শুন শুন জহ্লাদ আরে খাওরে মোর মাথা।
বন্ধু কি সহিতে পারে এমন পাষাণের ব্যথা?৩০৫
সহিলে আমার বুক রে সহিতে যে পারে।
অবুলা কঠিন হিয়া বিধি গইড়াছে পাত্থরে॥৩০৭
এহি মতে সুন্দর কন্যা গো করিল কান্দন।
জহ্লাদের গলিল তবে শানে বান্ধা মন॥৩০৯
লোহা লক্করের ভালা দেখ যমের দুয়ার।
সেই দুয়ার খুলিয়া দেখ সকল অন্ধকার॥৩১১
রুসানাই[৪৮] পরদীম জ্বালি কন্যা কোন্ কাম করিল।
কুমারের হাতের পায়ের বন্ধন খুলিল॥৩১৩
“উঠ উঠ পরাণপতি কইয়া বুঝাই তোরে।
বাপ ত দুষ্মন হইয়া রাখে বন্দিখানা ঘরে॥৩১৫
সোণার পালং পরে রে বন্ধু, হায় বন্ধু, ফুলের বিছানী।
কঠিন মাটির শেষে গোঁয়াও রে রজনী॥৩১৭
সোণার পালং পরে রে বন্ধু, হায় বন্ধু, ফুলের বিছানী।
সেও ফুলে পাইলে দুঃখ বুকে তুলতাম আমি॥৩১৯
শীতল মন্দিরে বন্ধুরে আরে বন্ধু নিদ্রায় কাতর।
আইজ বন্ধু কত কষ্টে বন্দিখানা ঘর॥৩২১
সুগন্ধী শীতল বারি, আবের[৪৯] পাঙ্খা লইয়া।
ধুয়াইতাম যোগল চরণ কেশে ত মুছিয়া॥৩২৩
সোণার বাটায় পানের খিলি রে বন্ধু তুল্যা দিতাম মুখে।
পালংএতে পাইলে ব্যথা তুল্যা লইতাম বুকে॥৩২৫
শুন শুন রাজার ঝি আরে না কান্দিও আর।
নিদয়া নিঠুর হইল বাপ সে তোমার॥৩২৭
না দেখি না শুনি লো কন্যা তোর সোণার বরণ।
আইজ যদি যায় পরাণ সফল জনম॥৩২৯
কাইল ত বিয়ানে তোর বাপ কন্যালো মোরে দিব শুলে।
এক রাত্রির দেখা সুখ ঘটিল কপালে॥৩৩১
শুন শুন রাজার কন্যালো বইস মোর উরে।
চান্দ মুখ দেখি তোমার দুই চক্ষু ভইরে॥৩৩৩
তোমার বাপ বাক্যিদান লো কন্যা দিয়াছে তোমায়।
তোমারে ছাড়িয়া যাইতে মনে নাই সে চায়॥৩৩৫
এক প্রহর নিশি আছে তিন প্রহর গেছে।
মরণ সুমুখে কইন্যা একটু বইস কাছে॥৩৩৭
পাষাণের বুক মোর কন্যালো হইল দেখ খালি।
এই বুকে তুল্যা লইব তোমা হেন নিধি॥৩৩৯
কাইল ত বিয়ানে কন্যালো যদি নিশ্চিত মরণ।
আর বার দেখি তোমায় ভইরা না দুই নয়ন॥৩৪১
শুন শুন পরাণের কুমার, আরে কহি যে তোমারে।
বন্ধ না খুলিয়া দিলাম যাহ নিজ দেশে॥৩৪৩
রাখ যদি রাইখ্য মনে অভাগীর কথা।
দুষ্মনের দেশে আইস্যা পাইলা মরণ-ব্যথা॥৩৪৫
এই ব্যথা পাশুরিলে সেই ব্যথা না পারি।
মনে ত রাখিও বন্ধু শ্রীচরণের দাসী।”৩৪৭
(১০)
হাতে ধইরা কুমারে কন্যা পন্থে বাহিরিল।
জঙ্গলার পথে কন্যা তবে মেলা দিল॥৩৪৯
চান্দ পলায় যেমুন রাহুর তরাসে।
বিদায়ের কালে কন্যা আঁখিজলে ভাসে॥৩৫১
“শুন শুন পরাণ বন্ধু, বন্ধু আরে কহি যে তোমারে।
আর কবে অইব দেখা কতদিন পরে॥৩৫৩
জল ছাড়া মীনের গতি আর বায়ু ছাড়া প্রাণী।
তোমারে ছাড়িয়া ভালা কেমুনে ধরিব পরাণী॥”৩৫৫
না কাইন্দ না কাইন্দ লো কন্যা মন কর থির।
তোমারে রাখিয়া যাইতে মনে নাই সে লয়।
দুষ্মন তোমার বাপ তাইতে করি ভয়॥৩৫৮
আইজ ত বিয়ার রাতি লো কন্যা থির কর মন।
ভিন্নদেশী কুমারেরে রাখলো স্মরণ॥৩৬০
বাঁচিয়া থাকিলে কন্যালো পুন হবে দেখা।
মিলন হইবে যদি অদিষ্টির লেখা॥৩৬২
বনের পথে ঘোড়া গুটা বান্ধা যে আছিল।
তাহার উপরে ত কুমার শোয়ার হইল॥৩৬৪
যোগল চরণে কন্যা, হায় ভালা, পন্নাম জানায়।
“সাক্ষী হইও চান্দ সূরুজ বন বিরক লতা।
তোমরা ত শুন্যাছ বন্ধের আইজকার কথা॥৩৬৭
সাক্ষী হইও পশু পক্ষী তোমরা সকলে।”
এহি কথা কইয়া কন্যা ভাসে আঁখি জলে॥৩৬৯
আইজের নিশি দুখের নিশি ভালা দুঃখের মিলন।
কান্দিয়া জানায় কন্যা নিজ আকিঞ্চন॥৩৭১
“তিরভুবনে আপন বলতে আর কেহ নাই।
তোমার চরণে বন্ধু পাই যেন ঠাঁই॥”৩৭৩
এতেক না বলিয়া চাম্পাবতি কোন কাম করিল।
যোগল চরণে কন্যা মাথা নুয়াইল॥৩৭৫
কন্যারে ধরিয়া কুমার মুছায় আঁখিতারা।
আপনি মুছিয়া লইল দুই নয়নের ধারা॥৩৭৭
“চান্দ সুরুজ সাক্ষী বন-বিরক-লতা।
এক সাক্ষী বনের পশু আর ধাতাকাতা[৫০]॥৩৭৯
নদী নালা সাক্ষী দেখ আর সে পরনে।
আইজ় হইতে প্রিয়া মোর জীবন মরনে॥”৩৮১
আলিঙ্গন দিয়া কুমার ভালা ঘোড়া না ছুটাইল।
পুষ্পের মুখে চুম্বা দিয়া ভালা ভমরা উড়িল॥৩৮৩
(১১)
হেরতের[৫১] সিঙ্গি রাজা ভালা কোন্ কাম করে।
তুরন্ত চলিলাইন রাজা কামিনী মুল্লুকে॥৩৮৫
কামিনী মুল্লুকে আছে মাইয়ানা বুড়ি।
কুবুদ্ধি কুমন্ত্র জানে সেই নারী॥৩৮৭
মানুষ গাছালী হয়, পঙ্খী হইয়া উড়ে।
সেই ত মাইয়ানা নারী তাল মন্ত্র পড়ে॥৩৮৯
বুড়ারে জোয়ানা করে, পুরুষ করে নারী।
সেহি ত মাইয়ানার কাছে রাজা গেলইন দরবরি॥৩৯১
শুন শুন মাইয়ানা রে কহি যে তোমারে।
বহু দেশ পার না হইয়া আইলাম তোমার গোচারে॥৩৯৩
জিয়ন মারণ মন্ত্র ভালা হায় ভালা শিক্ষা দেহ মোরে।
রাজ্যের যতেক ধন দিবাম সে তোমারে॥৩৯৫
এই কথা শুনিয়া মাইয়ানা বুড়ি কোন্ কাম করিল।
যত যত চিজ বস্তু দলা[৫২] যে করিল॥৩৯৭
হারে দেখ কাণা মশা ভালা মাছি, ভালা বাঘ ভালুকের আঁখি।
কাকড়ার টেং লৈয়া কন্টুড়াতে[৫৩] রাখি॥৩৯৯
শনিবারের পেঁচার হাড্ডি লৈল শেজা মেজার কাটা।
শকুনার পিত্তি লইয়া বানাইল বড়ি॥৪০১
শব শ্মশানের মাটি লৈয়া মাইয়া না কোন্ কাম করিল।
নানা জাতি কাষ্ঠে দেখ আগুনি জ্বালাইল॥৪০৩
আসনে বসাইয়া নিশিকালে রাজায় মন্তর দিল দান।
মন্তর পাইয়া সিঙ্গি রাজা হইল হরষিত।
আপনার দেশে রাজা চলিলাইন ত্বরিত॥৪০৬
শিবের মন্তর শিবের জটা পিংলা[৫৪] বাঘের ছাও।
ডাকিনী যোগিনী দেখ উড়ে পবন বাও॥৪০৮
কত কত মহাবিদ্যা সঙ্গে ত চলিল।
সিদ্ধি ভগবতী রাজার সহায় না হইল॥৪১০
যোড়া মহিষ কাট্যা গো রাজা দেবীদয়া পূজে।
তবে ত সিঙ্গি না রাজা সাজিল রণসাজে॥৪১২
(১২)
ভারইয়ার পুরীতে গিয়া গো রাজা মাইল তিন ডাক।
ভারইয়ার পুরীতে বাজে ভালা যত ডাম্বা ঢাক॥৪১৪
বাইর হইল ভারইয়া রাজা ভালা হাতে লৈয়া ধেনু।
ধনুতে টুঙ্কার মাইরা রাজা সামনে হইল খারা।
গোসায় জ্বলিল সিঙ্গি না রাজা ভালা জ্বলন্ত আঙ্গেরা॥৪১৭
রণথলাতে হইল রণ, ভালা কেউ না জিনে হারে।
ততক্ষণে সিঙ্গি রাজা কোন্ কাম করে॥৪১৯
হায় ভালা মাইয়ানার মন্তর পইড়া রাজা ধূলি উড়াইল।
মানুষ ভারইয়া রাজা বিরক্ক হইল॥৪২১
লোক লস্করা যতেক করে হাহাকার।
কুড়ালে কাটি সিঙ্গি রাজা করে মার মার॥৪২৩
সপ্প হইয়া ভারইয়া রাজা কায়া বদলাইল।
ময়ূর-পঙ্খী হইয়া সিঙ্গি না রাজা শূন্যে ত উড়িল॥৪২৫
তবে ত ভারইয়া রাজা ভালা বদল করে কায়া।
কইতরা হইল রাজা জানে নানান মায়া॥৪২৭
বাজ হইয়া সিঙ্গি রাজা থাপা দিয়া ধরে
মীন মচ্ছ হইয়া ভারইয়া রাজা ভালা পড়িল সায়রে॥৪২৯
উদ হইয়া সিঙ্গি রাজা ভালা পশ্চাতে চলিল।
চিলা হইয়া ভারইয়া রাজা শূন্যেত উড়িল॥৪৩১
তুবরী মন্তরে রাজা ভালা কোন্ কাম করে।
সাচান[৫৫] হইয়া রাজা শূন্নিপথে উড়ে॥৪৩৩
ধূলা হইয়া পন্থে পড়ে রাজা না দেখি উপায়।
বাতাস বাকুণ্ডি[৫৬] সিঙ্গিরাজা তাহারে উড়ায়॥৪৩৫
তবেত বীরসিংহ রাজা মারণ-মন্ত্র পড়ে।
পাষাণ করিবে রাজায় এহি মন্ত্রের জোরে॥৪৩৭
তিন ফুঁ দিয়া সিঙ্গিরাজা ডাকিনী স্মরিয়া।
ভারইয়া রাজার গায়ে দিল ধূলা উড়াইয়া॥৪৩৯
বাও বাতাসে ধূলা অঙ্গেত লাগিল।
আছিল মানুষ, রাজা পাষাণ হইল৪৪১
(১৩)
তবে ত ভারইয়ার রাণী কাইন্দা জারে জার।
ভারইয়া নগরের লোক করে হাহাকার॥৪৪৩
মালখানা দখল করে দেখ সিঙ্গিরাজার লোকে।
বীরসিংহ রাজা হইল ভারইয়ার মুল্লুকে॥৪৪৫
অষ্ট অলঙ্কার রাণী খসাইয়া রাখিল।
ভিখ্-মাঙ্গুনীর বেশে রাণী পন্থে বাহির না হইল॥৪৪৭
সোণার বরণ রাজকন্যা মায়ের পাছু চলে।
এরে দেইখ্যা নাগুরিয়া লোকে ভাসে আখি জলে॥৪৪৯
সোণার তারে বান্ধা কেশ, রূপার তারে বেড়া।
যে পইরণে ছিল কন্যার শাড়ী আস্মান তারা॥৪৫১
সেহি কেশ সেহি বেশ দেখ মৈলান[৫৭] হইল।
চান্দের না পুরীখানি যেমুন আবেতে[৫৮] ঘিরিল॥৪৫৩
সোণার পরতিমাখানি রূপে ঝলমল করে।
হেন কন্যা রাজপন্থে ভিখ্-মাঙ্গুনীর বেশে॥৪৫৫
অদিষ্টির লেখা দেখ ছাড়ানি যে দায়।
আইজে রাজা দণ্ডধর কাইল ফকির হইয়া যায়॥৪৫৭
হায় তবে ত ভারইয়া রাণী ভালা কোন্ কাম করিল।
সিঙ্গিরাজার দরবারে গিয়া রাণী দাখিল হইল॥৪৫৯
“শুন শুন সিঙ্গিরাজা কহি যে তোমারে।
পাষাণ পতির দুঃখে দুই আখ্খি ঝরে॥৪৬১
যুব্বাবতী কন্যা ঘরে এই সে হইল বড় দায়।
বাক্যিদান দিয়া গেলাইন রাজা না দেখি উপায়॥৪৬৩
তোমার পুত্রু দুধরাজ গুণের সাগর।
আমার কন্যার যোগ্য উত্তম নাগর॥৪৬৫
রাজ্য দিলাম ধন দিলাম রাজা আর দিবাম কি।
তোমার হাতে ত সইপ্যা দিলাম, রাজা গো রাজা,
বড় না দুঃখের ঝি॥৪৬৭
কলিজার লহু আমার রাজা গো দুই নয়ানের তারা।
তিলদণ্ড না দেখিলে যা’রে হইয়া যাই বাউড়া[৫৯]॥৪৬৯
আমি মরি ক্ষতি নাই সে রাজা নাহি ভাবি মনে।
চাম্পাপুতি কন্যায় রাজা রাখিও চরণে॥”৪৭১
এত শুনি নিষ্ঠুরা রাজা ভালা কোন্ কাম করে।
মুখে বলে দুরক্ষরা[৬০] বাণী দেখে অভাগা রাণীরে॥৪৭৩
থু থু কইরা তিন বার ঘিন্না সে করিয়া।
সিঙ্গিরাজা কয় কথা চক্ষু রাঙ্গাইয়া।
“জঙ্গলিয়ার কন্যায় আমি না করাইবাম বিয়া॥৪৭৬
কোচের সঙ্গে কিসের স’ন্ধ[৬১] ভালা কিসের বিহালী[৬২]।
আসমানে জমিনে কবে হয় সে মিতালী॥৪৭৮
দেবতার বংশ আমি উচ্চ কুল কুলী[৬৩]।
সিংহের সনে ত কিসের শিবার মিতালী॥৪৮০
দারাক তরুয়ার সঙ্গে নয় রে সেহরার মিলন।
দুধরাজে করাইবাম বিয়া দক্ষিণ পাটন॥৪৮২
দূর হওরে ভারইয়া রাণী মোর রাজ্য সে ছাড়িয়া।
ঘড়ুইয়া হাজঙ্গের[৬৪] কাছে কন্যায় দেওরে বিয়া॥”৪৮৪
এহি কথা শুন্যা রাণী করে হাহাকার।
মাথা থাপাইয়া কান্দে মাও সে আমার॥৪৮৬
ধরিয়া কন্যার গলা কান্দে ভারইয়া রাণী।
“এত দুঃখু কপালে তোর মাগো আছিল না জানি॥”৪৮৮
মায়ে কান্দে ঝিয়ে কান্দে, কাইন্দা জারে জার।
নগরিয়া যত লোক করে হাহাকার॥৪৯০
তবে ত ভারইয়া রাণী কোন্ কাম করিল।
সঙ্গে ছিল কাল জ’র[৬৫] তাতে চুম্বা দিল॥৪৯২
“তিরজগতে চাম্পাপুতি কেউ যে তোর নাই।
একেলা রাখিয়া গেলাম যা করেন দেবাই[৬৬]॥”৪৯৪
দুই আখি বুঞ্জিলা রাণী জন্মের মতন।
কি হইল চাম্পাপুতির শুন বিবরণ॥৪৯৬
(১৪)
উপসংহার
চম্পাবতীর বিলাপ
“একেলা রাখিয়া মাও গো মোরে গেলা ছাড়ি।
বাপ নাই মাও সে নাই হইলাম একেশ্বরী॥৪৯৮
বাপের না রাজত্বি গো হারাইলাম বাপ মায়।
কে মোরে ডাকিয়া শুধায় কার বা কাছে যাই॥৫০০
আপনা বইলা প্রাণ সপিলাম সেও করিল দূরা।
কারে বা কহিমু মন্দ কপাল হইল বুরা[৬৭]॥৫০২
সাগরে মাঙ্গিলাম পানি নাহি দিল ফোঁটা।
পশিতে সুখের ঘরে দুয়ারে মোর কাঁটা॥৫০৪
নবজলধর দেইখ্যা আমি চাতকিনী।
আকুল পিয়াসে মাঙ্গিলাম এক ফুটা পানি॥৫০৬
পানির বদলে পাইলাম জ্বলন্ত আগুনি।
বজ্জর পড়িল শিরে মুঞ অভাগিনী॥৫০৮
হায়, সাওরে মাঙ্গিলে ঠাঁই সায়র শুকায়।
জমিনে মাঙ্গিলে ঠাঁই জমিন লুকায়॥৫১০
বনে গেলে নাই সে খায় মোরে বাঘ আর ভালুকে।
অভাগী জানিয়া কেউ স্থান না দেয় মোকে॥৫২২
দুরন্ত সে অজাগরা আমারে ডরায়।
আভাগী রাজার কন্যা ধইরা নাই সে খায়॥৫১৪
“শুন শুন পরাণ-পতি তোমারে জানাই।
তোমার উর্দিশে[৬৮] আমি পন্নাম জানাই॥৫১৬
সুখে ত রাজত্বি কর নয়া নারী লইয়া।
বাঁচিয়া থাকহ বন্ধু লক্ষ পরমাই পাইয়া॥৫১৮
অভাগিনী চাম্পার কথা না রাখিও মনে।
উর্দিশে বিদায় মাগি তোমার চরণে॥”৫২০
পাগেলা রাজার কন্যা কাইন্দা কাইন্দা ফিরে।
পাষাণ ভারইয়া রাজার দুই আঁখি ঝরে॥৫২২
- ↑ সুন্দাসেতী=নদীর নাম।
- ↑ আচানৌকা=আশ্চর্য্য, চমৎকার।
- ↑ বইছ=বসিয়াছ।
- ↑ গুণাবাছা=সংখ্যা; গুণাবাছা নাই। অগণন।
- ↑ ভূমিত দরশন=স্থান পরিদর্শনের জন্য।
- ↑ কামেলা=দিন মজুর।
- ↑ বনেলা=বনের।
- ↑ সল্লা=প্রায়ই ষড়যন্ত্র অর্থাৎ খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়, এখানে পরামর্শ অর্থে।
- ↑ হালুয়া=হলধর, কৃষক।
- ↑ মাইল ফাল=লাফ মারিল।
- ↑ ঝলুঙ্গা=তূণ।
- ↑ টেডা=বল্লম।
- ↑ শল্কী=বর্ষা।
- ↑ ঝুকা=(?)
- ↑ কুঁদিয়া=(নাচিয়া কুঁদিয়া) লাফাইয়া, বীর বিক্রমে উত্তেজিত হইয়া।
- ↑ দাখিল=উপস্থিত।
- ↑ গুস্সা=রাগ।
- ↑ জল্তি=জল্দি, শীঘ্র।
- ↑ সিঙ্গির পূতি=সিংহ বংশের ছেলে, বীরসিংহ।
- ↑ সাওরে=সাগরে।
- ↑ মালেমস্ত=মল্ল ও পালোয়ানদের।
- ↑ বানা=বান্ধা।
- ↑ মুইট্=মুষ্টি।
- ↑ শুরে=স্মরণ করিল।
- ↑ উল্কা ফাল=উল্কার মত লম্ফ।
- ↑ লোহার ফাল=লৌহ ফলক।
- ↑ বায়ে...কাট্টা=বামদিকে তরবারিতে কাটা মস্তক।
- ↑ সিরগাল=শৃগাল
- ↑ খবরিয়া=সংবাদ-বাহক।
- ↑ গিরেতে=গৃহে।
- ↑ বাহিশ মুণী=বাইশ মণ ওজনের।
- ↑ পিয়ার=প্রিয়।
- ↑ পসর=আলোক। তাহার রূপ দেখিয়া দীপের আলো অন্ধকারে লুকায়।
- ↑ মুয়েত=মুখে।
- ↑ পাশুরা=ভোলা।
- ↑ বেন্নামুখী=বিষ।
- ↑ অনেয়াই=অনেক।
- ↑ রুল=রোল।
- ↑ ঘর-যুয়ানী=ঘর যুবতী, যুবতী হইয়াও যে পিতৃগৃহে আছে।
- ↑ রঙ্গসহাল=আমোদ প্রমোদ।
- ↑ উনমতি=অনুমতি
- ↑ বুণ্টায়=বোঁটায়।
- ↑ উবুরা=(?)
- ↑ আবিয়াত=অবিবাহিত।
- ↑ কিবান=কিবা।
- ↑ উপাক্যা=উপকারী।
- ↑ ফতুরী=ভিখারী।
- ↑ রুসানাই=উজ্জ্বল।
- ↑ আবের=অভ্রের।
- ↑ ধাতাকাতা=ধাতাকর্ত্তা, সকলের উপর যে বিধাতা কর্ত্তা। ‘ধাতাকাতা’ শব্দটি প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যের অনেক স্থলে পাওয়া গিয়াছে।
- ↑ হেরতের=তাড়াতাড়ি।
- ↑ দলা= চূর্ণ।
- ↑ কন্টুড়াতে=কৌটাতে।
- ↑ পিংলা=পিঙ্গলবর্ণ।
- ↑ সাচান=শকুন।
- ↑ বাকুণ্ডি=ঘূর্ণিবায়ু।
- ↑ মৈলান=মলিন।
- ↑ আবেতে=মেঘেতে।
- ↑ বাউড়া=পাগল।
- ↑ দুরক্ষরা=কঠোর।
- ↑ স’ন্ধ=সম্বন্ধ
- ↑ বিহালী=বৈবাহিক, বিবাহ-সম্বন্ধীয়।
- ↑ কুলী=কুলীন।
- ↑ ঘড়ুইয়া হাজঙ্গের=গৃহস্থ, তোমাদের ঘরের লোক; হাজঙ্গ=এক শ্রেণীর পাহাড়িয়া জাতি।
- ↑ জ’র=জহর, বিষ।
- ↑ দেবাই=দেবতা।
- ↑ বুরা=মন্দ।
- ↑ উর্দিশে=উদ্দেশে।