পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/মলয়ার বারমাসী

মলয়ার বারমাসী

 মৈমনসিংহ নেত্রকোনায় কেন্দুয়া থানার অধীন আওয়াজিয়া গ্রামে রঘুসুত নামক পাট্‌নিজাতীয় এক গায়েন বাস করিতেন। এখন তাঁহার বংশতালিকা দৃষ্টে পুরুষ গণনা করিয়া, রঘুসুতের সময় আড়াই শত বৎসর পূর্ব্বে বলিয়া নির্দিষ্ট করা যায়। এই রঘুসুত দামোদর, নয়নচাঁদ ঘোষ ও শ্রীনাথ বেণিয়া নামক তিনজন কবির সাহায্যে ‘কঙ্ক ও লীলা’ নামক পালাগানটি রচনা করেন। রঘুসুতের লেখাই এই পালাতে বেশী।

 এই পালাগানের মধ্যে যে সব কথা আছে তাহা মূলতঃ ঐতিহাসিক ঘটনা বলিয়াই মনে হয়। ইহার বর্ণনানুসারে বিপ্রপুর গ্রামে গুণরাজ নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁহার পত্নীর নাম বসুমতী। ইঁহাদেরই পুত্র আমাদের প্রসিদ্ধ কবিকঙ্ক। যখন শিশুর বয়স ছয়মাস মাত্র, তখন বসুমতীর মৃত্যু হয় এবং সেই শোকে তাঁহার পিতা গুণরাজও পাগল হইয়া যান এবং কিছুদিনের মধ্যেই দেহত্যাগ করেন। পিতামাতাকে বধ করিয়াছে সুতরাং শিশু অপয়া, এই সংস্কারবশতঃ সেই অনাথ বালকের প্রতি কাহারও অনুকম্পা হইল না। নিরাশ্রয় শিশু একা এক ঘরে শুইয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল। কুসংস্কারের পাষাণ-প্রাচীর ভেদ করিয়া সেই চীৎকার কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিল না। কিন্তু আভিজাত্য ও শাস্ত্রজ্ঞানের অভিমানে অন্ত্যজ শ্রেণীরা তাহাদের হৃদয় হারাইয়া ফেলে নাই। মুরারি নামক এক চণ্ডাল শিশুটিকে কোলে তুলিয়া লইল এবং তাহার পত্নী কৌশল্যা অতি যত্নের সহিত শিশুটিকে লালনপালন করিতে লাগিল। এইখানে আমরা রঘুসুত কবির দুইটি ছত্র উদ্ধৃত করিতেছিঃ—

“ব্রাহ্মণ কুমার হল চণ্ডালের পুত।
কর্ম্মফল কে খণ্ডায় কহে রঘুসুত॥”

কিন্তু পাঁচবৎসর না যাইতেই ত্রিদোষযুক্ত জ্বরে আক্রান্ত হইয়া চণ্ডাল মুরারি প্রাণত্যাগ করিল। দিনরাত্র কৌশল্যা স্বামীর জন্য কাঁদিয়া কাঁদিয়া স্বর্গবাসিনী হইল। সেই শ্মশানের ভস্মের উপর পাড়িয়া পঞ্চবৎসর বয়স্ক কঙ্ক কঁদিতে লাগিল। এবার সে যে অপয়া তাহার একেবারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হইয়া গিয়াছে, সুতরাং কেহ আর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল না।

“কেহ নাহি হাত ধরে নেয় ফিরে ঘরে।
ভাত পানি দিয়া কেহ জিজ্ঞাসা না করে॥”

 কিন্তু তখনও প্রকৃত ব্রাহ্মণ সমাজে ছিলেন, যাঁহাদের জ্ঞান সমুদ্রের মতই গভীর এবং হৃদয় আকাশের মতই উদার। বিপ্রগ্রামবাসী গর্গ ছিলেন সেইরূপ একজন সর্ব্বজনপূজ্য ব্রাহ্মণ। তিনি রাজরাজেশ্বরী নদীতে স্নান করিয়া শ্মশানের পথ দিয়া গৃহে ফিরিতেছিলেন, এই সময়ে সেই শিশুর ক্রন্দনে আকৃষ্ট হইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহার পবিত্র নামাবলী দিয়া সেই ‘চণ্ডাল-শিশু’র মুখ মুছাইয়া তিনি অতি যত্নে তাহাকে কোলে করিয়া লইয়া আসিলেন এবং তঁহার পত্নী গায়ত্রী দেবীর উপর সেই শিশুর ভার অৰ্পণ করিলেন। গায়ত্রী দেবীর পুত্র ছিল না এবং কঙ্কও মাতৃহীন। কবি লিখিয়াছেনঃ—“পুত্রহীনা পুত্র পাইলো—মাতা মাতৃহীনা।” চণ্ডালী কৌশল্যা সেই শিশুর নাম রাখিয়াছিল কঙ্ক, নাম রাখিলেন—“গোপাল।” গায়ত্রী দেবীর পরম স্নেহে কঙ্ক লালিতপালিত হইলেন। এদিকে গৰ্গ দেখিলেন, ছেলেটি অসাধারণ মনস্বী সুতরাং তাহার দশবৎসর বয়সে তাহাকে হাতে খড়ি দিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিলেন এবং মুখে মুখে নানা শ্লোক শিখাইয়া ফেলিলেন। গর্গের একটি সুরভি নাম্নী গাভী ছিল। দিনের বেলায় কঙ্ক সেই গাভী চরাইত ও বাঁশী বাজাইত, কিন্তু রাত্রিকালে সে অতি মনোযোগের সহিত গর্গের নিকট সর্ব্বশাস্ত্রের পাঠ লইত। কিন্তু কঙ্কের দুঃখের এইখানেই শেষ হয় নাই। বসন্ত রোগে গায়ত্রী প্রাণত্যাগ করিলেন, তখন কঙ্কের বয়স দশ এবং গৰ্গকন্যা লীলার বয়স আট বৎসর। রঘুসুত লিখিয়াছেনঃ—

“অষ্ট না বছরের লীলা মায়ে হারাইয়া।
বুঝিল কঙ্কের দুঃখ নিজ দুঃখ দিয়া॥”

কারণ কঙ্ক এইবার লইয়া তিনবার মাতৃহারা হইয়াছে। এই সহানুভূতি ও সাহচর্য্যের দরুন কঙ্ক ও লীলার মধ্যে যে প্রীতি হইয়াছিল তাত “গঙ্গাসম সুনির্ম্মল।” কিন্তু এই প্রীতি তাহদের জীবনে কালস্বরূপ হইয়াছিল। শৈশব-অতীতে কঙ্ক তাহার অপূর্ব্ব বাঁশীর সুরে যেরূপ সকলের মনোহরণ করিত, তেমনি তাহার কবিত্ব-শক্তিও সর্ব্বত্র পরিচিত হইয়াছিল। এই সময়ে তিনি ‘মলয়ার বারমাসী’ প্রণয়ন করেন। ঐ বিপ্রপুর গ্রামে এক মুসলমান ফকির আসিলেন, তাহার সঙ্গে পাঁচটি সাকরেদ বা শিষ্য। পীর সেইখানে একটি দরগা স্থাপন করিলেন। তদ্দেশবাসী লোকেরা পীরের নানারূপ হেকমতের পরিচয় পাইল। যে সকল রোগী তাঁহার কাছে আসিত, তিনি ধূলিপড়া দিয়া তাহাদিগকে নীরোগ করিতেন। মুখ না খুলিতেই আগস্তুকের মনের ভাব সমস্ত নিজে কহিয়া দিতেন। মাটি দিয়া মেওয়া প্রস্তুত করিয়া বালকগণের মধ্যে বিতরণ করিতেন, তাহারা তাহাতে অমৃতের স্বাদ পাইত। তাঁহার কাছে যে যাহা মানত্ করিত তাহাতেই সিদ্ধিলাভ করিত। সুতরাং সেই দেশে পীরের নাম খুব জাহির হইয়া পড়িল। বহুদূর হইতে নানা লোক তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিত এবং তাঁহার দরগায় সিন্নিদান করিত। কিন্তু,

“সিন্নির কণিকা মাত্র পীর নাহি খায়।
গরীব দুখীরে সব ডাকিয়া বিলায়।”

অদূরে কঙ্ক ধেনু চরাইতে চরাইতে যে বাঁশী বাজাইত, তাহা পীরের মর্ম্মে মর্ম্মে প্রবেশ করিত এবং তিনি এই মনস্বী বালকের সঙ্গে পরিচিত হইবার জন্য মনে মনে অভিলাষী হইলেন। সেই মনের আহ্বানে কঙ্কও সাড়া দিল। সে নিজে হইতে তথায় আসিয়া পীরের চরণে লুটাইয়া পড়িল। পীরের কাছে বসিয়া সে যখন তাহার রচিত ‘মলয়ার বারমাসী’ গান করিত, তখন পীরের চক্ষু জলে ভাসিয়া যাইত। কালক্রমে কঙ্ক পীরের এতটা বশীভূত হইল যে সে পীরের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিল। যে শিশু ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াও চণ্ডালের অন্নে প্রতিপালিত হইয়াছে, সে ব্রাহ্মণ্য-তেজ ও মনস্বিতার অধিকারী হইয়াও ব্রাহ্মণ্য-সংস্কারের বশীভুত হয় নাই। ধর্ম্মান্ধতা তাহার ছিল না। লোকে রটনা করিতে লাগিল যে কঙ্ক পীরের নিকট কালাম্ (মুসলমানী ধর্ম্মশাস্ত্র) শিখিতেছে এবং মুসলমান পীরের প্রসাদ অমৃতজ্ঞানে খাইতেছে। কিন্তু এসকল কথা গৰ্গ কিছুই জানিতেন না। এদিকে পীরের আদেশে কঙ্ক বিদ্যাসুন্দরের কেচ্ছা সমেত একখানি সত্যপীরের পাঁচালী রচনা করিলেন। কিন্তু পীর এই ঘটনার পর সে দেশ হইতে কোথায় চলিয়া গেলেন, কেহ জানিল না। রঘুসুত লিখিয়াছেনঃ—

“গুরুর আদেশ মানি লিখিয়া পাঁচালীখনি
পাঠাইলা দেশ আর বিদেশে।
কঙ্কের লিখন কথা ব্যক্ত হইল যথা তথা
দেশ পূর্ণ হইল তার যশে।
কঙ্ক আর রাখাল নহে ‘কবি কঙ্ক’ লোকে কহে
শুনি গৰ্গ ভাবে চমৎকার।
হিন্দু আর মুসলমানে সত্যপীরে উভে মানে
পাঁচালির হইল সমাদর॥
যেই পুজে সত্যপীরে কঙ্কের পাঁচালী পড়ে
দেশে দেশে কঙ্কের গুণ গায়।
বুঝি কঙ্কের দিন ফিরে রঘুসুত কহে ফেরে
দুঃখিতের দুঃখ নাহি যায়॥”

 কঙ্কের বিদ্যাসুন্দর দেশময় প্রচারিত হইয়া গেল এবং কবি হিসাবে তিনি দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হইলেন। গর্গ দেখিলেন,—কঙ্কের মত বিনীত, বিশ্বাসী, যশস্বী এবং সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণ-বালক যে সমাজের বহির্ভূত হইয়া থাকিবেন, ইহা ভারী অন্যায়। সুতরাং তিনি ব্রাহ্মণ-সমাজের এক সভা আহবান করিয়া কঙ্ককে জাতে তুলিবার প্রস্তাব করিলেন। তিনি বলিলেন, “কঙ্ক আতি শৈশবাবস্থায় চণ্ডালের অন্নে প্রতিপালিত হইয়াছিল। ইনি সদ্‌ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং জ্ঞাতসারে কোন অপরাধ করেন নাই। সুতরাং ইঁহাকে সমাজ-বহির্ভূত রাখা উচিত নহে।” গোঁড়া দলের নেতা ছিলেন নন্দু, তিনি বলিলেন, “যে ফুল একবার মাটিতে পড়িয়াছে, তাহা আর দেব পূজায় লাগে না। অদৃষ্ট-অনুসারে মানুষ ধন্যবান্ হয়, দরিদ্র হয়। তাহার দোষ থাকুক বা না থাকুক। সে কর্ম্মফল এড়াইতে পারে না। বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ-সমাজ চণ্ডাল-গৃহে প্রতিপালিত বালককে কখনই গ্রহণ করিতে পারেন না।” খুব জোরে তর্ক চলিল। গর্গের অসামান্য প্রতিষ্ঠা, বিদ্যাবত্তা এবং সমাজের উপর প্রভাবের গুণে, কতকগুলি ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সমর্থন করিলেন। সভা-গৃহ তৰ্ক-কোলাহলে মুখরিত হইল। এদিকে যাহারা মুখে সায় দিয়াছিলেন, তাঁহারাও গোড়াদের দলে মিশিয়া ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন। কঙ্কের সর্ব্বনাশের জন্য তাঁহারা এবার এক ফন্দি আঁটিলেন। তাঁহারা প্রচার করিয়া দিলেন, কঙ্ক শুধু চণ্ডালের অন্ন খায় নাই, সে মুসলমানের প্রসাদ খাইয়া তাহার নিকট মুসলমানি ধর্ম্মে দীক্ষা লইয়াছে। ইহা হইতেও গুরুতর দোষ আরোপ করা হইল; তাঁহারা প্রচার করিলেন, গৰ্গকন্যা লীলা কঙ্কের অনুরাগিনী হইয়া কলঙ্কিতা হইয়াছে। দেশে এই কথা প্রচার হওয়ার পরে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। কঙ্ক প্রতিষ্ঠার শিখর-দেশে যতটা উঠিয়াছিলেন, তাঁহার অধঃপতনও ততটা সংঘটিত হইল। দেশের লোক ক্ষেপিয়া গিয়া তাঁহার সত্যপীরের পুথি তাহদের বাড়ী হইতে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল। কেহ কেহ তাহা আগুনে পুড়াইয়া ফেলিল। মুসলমানের পুঁথি ধর্ম্মগ্রন্থ বলিয়া পড়িয়াছে, এবং ঘরে রাখিয়াছে, এই ভাবিয়া দেশময় লোক প্রায়শ্চিত্ত করিল।

 এদিকে গৰ্গ পীর সম্বন্ধে কিছুই অবগত ছিলেন না, এবং লীলা সম্বন্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা যে সমস্ত মিথ্যা প্রমাণ উপস্থিত করিয়াছিল তাহাও তিনি অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না, কারণ তিনি অতি সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন। এবার সরলে গরল উঠিল। কঙ্কের চরিত্রে সন্দিগ্ধ হইয়া তিনি উন্মত্তবৎ হইয়া পড়িলেন এবং কঙ্ককে বিনষ্ট করিয়া এবং তাহার পরে লীলার প্রাণনাশ করিয়া তিনি নিজে আত্মহত্যা করিবেন, এই সঙ্কল্প করিলেন। কঙ্ক গরু রাখিতে মাঠে গিয়াছে, লীলা তাহার জন্য প্রস্তত করিয়া অপেক্ষা করিতেছে, এই সুযোগে গৰ্গ সেই অন্নে বিষ মিশাইয়া দিলেন। অপর গৃহ হইতে লীলা তাহার রুদ্র মূর্ত্তি এবং এই কুকার্য্য দেখিয়া ভয় ও বিস্ময়াভিভূত হইল। কঙ্ক গৃহে আসিলে পরে লীলা অশ্রুনেত্রে তাঁহাকে সকল কথা কহিল; কিন্তু কঙ্কের সংযম ও ধৈর্য্য কিছুতেই টলে নাই। সে লীলাকে বলিল, “গৰ্গ মহাপুরুষ, দেবতুল্য। ষড়যন্ত্রকারীদের অভিসন্ধিতে তাঁহার সরল প্রাণে ব্যথা লাগিয়া তিনি এই সকল কাজ করিয়াছেন, কিন্তু আমার নিশ্চয় বিশ্বাস তিনি অতি বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি, শীঘ্রই সত্য কথা বুঝিতে পরিবেন। তুমি তোমার পরমারাধ্য পিতৃদেবের প্রতি শ্রদ্ধা হারাইও না, কিন্তু আমি আর এখানে থাকিব না।” গভীর মনোবেদনায় কঙ্ক সারারাত্রি বিনিদ্র অবস্থায় কাটাইয়া শেষ রাত্রিতে তন্দ্রার ঘোরে দেখিলেন যেন পিশাচেরা তাঁহাকে শ্মশানের আগুনে পোড়াইতেছে এবং এক গৌরকান্তি দিব্য মহাপুরুষ রক্ত কমলহস্তে তাঁহার বাহু ধারণ করিয়া তাঁহাকে সেই শ্মশানের পিশাচদের হস্ত হইতে মুক্তি দিয়া সঙ্গে লইয়া চলিয়াছেন। নিদ্রা-ভঙ্গে কঙ্ক বুঝিলেন, যিনি তঁহাকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছিলেন—তিনি গৌরাঙ্গ। আর কাল বিলম্ব না করিয়া তিনি গৌরাঙ্গ-দৰ্শন-মানসে পশ্চিমদিকে রওনা হইলেন।

 লীলা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত অন্ন খাইয়া সুরভি গাভীটি প্রাণত্যাগ করিল। ব্রাহ্মণের বাড়ীর গাভী গৃহকর্ত্তার প্রদত্ত বিষে মরিল, এই ঘোর অনাচার এবং দুর্ঘটনা গর্গের মনকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। পূজার ঘরে তিনি লীলার সংগৃহীত পুষ্পবিল্বপত্র ও জল কলঙ্কিত মনে করিয়া সেগুলি ফেলিয়া দিলেন, এবং মন্দিরের অর্গল বন্ধ করিয়া তিন দিন তিন রাত্রি পর্য্যন্ত উপবাসে কাটাইয়া ধন্না দিয়া রহিলেন। “আমার এই বিপদে কি কর্ত্তব্য ভগবান্ আমাকে কহিয়া দাও, তাহা না হইলে আমি এইখানেই প্রাণত্যাগ করিব।” এই সঙ্কল্প করিয়া তিনি উপবাস করিতে লাগিলেন। চতুর্থ দিনে তিনি যে স্বপ্নাদেশ পাইলেন তাহার মর্ম্ম এই,—“তুমি মহাপাপী, তোমার নির্দ্দোষ পুত্রকন্যাকে মারিতে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলে এবং স্বগৃহ-পালিত গাভীকে হত্যা করিয়াছ। লীলার হস্তের যে ফুল ফেলিয়া দিয়াছ তাহা দিয়াই আমাকে পূজা কর।” এই আদেশ প্রাপ্ত হইয়া গৰ্গ অনুতাপে পাগলের মত হইলেন। তিনি তাঁহার প্রিয় শিষ্য বিচিত্র-মাধব দুইজনকে দেশবিদেশে কঙ্কের সন্ধানে পাঠাইয়া দিলেন;—বলিলেন, ‘আমি তোমাদিগকে অতি যত্নের সহিত পড়াইয়াছি। আমাকে এই দক্ষিণা দিয়া আমার প্রাণরক্ষা কর। কঙ্ককে না পাইলে আমি বাঁচিব না।’ তাহারা দুইবার নানা দেশে ঘুরিয়া কঙ্কের সন্ধান পাইল না। শেষবার মাধব আসিয়া একটা জন রবের কথা বলিল। কঙ্ক চৈতন্যকে দর্শন করিবার অভিপ্রায়ে নবদ্বীপাভিমুখে রওনা হইয়াছিল, পথে ঝড়ে নৌকাডুবি হইয়া সে প্রাণত্যাগ করিয়াছে। লীলা কঙ্কের শোকে মৃতপ্রায় হইয়াছিল। এই আঘাত সে সহ্য করিতে পারিল না। তাহার মৃত্যু হইল এবং গর্গও বিপ্রগ্রামের গৃহ-পাট উঠাইয়া একান্ত অনুরক্ত কয়েকটি শিষ্যের সহিত পুরীর দিকে চলিয়া গেলেন।

 রঘুসুত প্রভৃতি কবিরা লিখিয়াছেন যে যখন লীলার দেহ শ্মশানে ভস্মীভূত হইতেছিল তখন কঙ্ক সেই শ্মশানের নির্ব্বাণোন্মুখ স্ফুলিঙ্গ দেখিতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।

 এই পালাগানের প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাই ঐতিহাসিক। বিপ্রগ্রাম কেন্দুয়া পোষ্ট অফিসের অধীন। ইহার বর্ত্তমান নাম বিপ্রবর্গ। রাজেশ্বরী এখন শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার খাদের চিহ্ন এখনও কর্ত্তমান। যেখানে পীর তাঁহার আস্তানা করিয়াছিলেন সে স্থান এখনও ‘পীরের স্থান’ নামে প্রসিদ্ধ। তথায় একটা পাথর আছে, উহাকে লোকে ‘পীরের পাথর’ বলে। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই এই পাথরের উপর সিন্নি দিয়া থাকেন। কঙ্কের প্রণীত ‘মলয়ার বারমাসী’ অসম্পূর্ণভাবে সংগৃহীত হইয়াচে, তাহাই এইখানে প্রকাশিত হইল। বারমাসী বর্ণনায় কবির শক্তি বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই কবিতা চণ্ডীদাসের একশতাব্দী কাল পরে লিখিত হইয়াছিল। ইহা আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের একটি সম্পদ্। পীরের আদেশে কঙ্ক যে সত্যপীরের গান লিখিয়াছিলেন, তাহাও আমরা পাইয়াছি। এই গান যখন লিখিত হয়, তখনও কঙ্কের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণদের কোন ষড়যন্ত্র হয় নাই। ইহাতে কঙ্ক সংক্ষেপে যে আত্মবিবরণী দিয়াছেন, তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল। পাঠক দেখিবেন রঘুসুত প্রভৃতি কবিরা তৎ সম্বন্ধে যাহা যাহা লিখিয়াছিলেন কবি স্বয়ং তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন। অবশ্য পরবর্ত্তী ঘটনার উল্লেখ এই কাব্যে নাই, কারণ কাব্য তাহার পূর্ব্বে লেখা হইয়াছিল। কিন্তু আমরা মনে করি পূর্ব্ববর্ত্তী অংশের ন্যায় পরবর্ত্তী ঘটনাও সম্পূর্ণ ইতিহাসমূলক। লীলার প্রেম-সম্বন্ধে যে সমস্ত বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে, তাহার মধ্যে কতকটা কবি-কল্পনা অবশ্যই আছে, কিন্তু মূল ঘটনা বর্ণনাকালে কবিরা ইতিহাসের পথ সাবধানে অনুসরণ করিয়াছেন, ইহাই মনে হয়। কঙ্ক যে শ্মশান-ঘাটে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছিলেন, এ কথাটা খুব বিশ্বাসযোগ্য নহে, কারণ ‘কঙ্ক ও লীলা’র আরও কয়েকটি সংস্করণ আছে তাহাদের সঙ্গে এই পালার মূলতঃ কোন পার্থক্য নাই।—কেবল শেষভাগে কোন কোন কাব্যে কবিরা কঙ্কের সহিত লীলার যুগল-মিলন ঘটাইয়া কাব্যখানি “মধুরেণ সমাপয়েৎ” করাইয়াছেন, কেহ-বা কঙ্কের সহিত লীলার স্বর্গের ওপারে মিলন ঘটাইয়াছেন। আমাদের মনে হয়, যে জনরব রাষ্ট্র হইয়াছিল তাহাই সত্য। চৈতন্য-দর্শনকামী কঙ্ক ঝড়ে নৌকাডুবি হইয়া মারা গিয়াছিলেন। গৰ্গ শিষ্যদ্বয়কে কঙ্কের অনুসন্ধানে পাঠাইয়া এই কথাগুলি বলিয়াছিলেনঃ—

“কিন্তু এক কথা মোর শুন দিয়া মন।
গৌরাঙ্গের পূর্ণভক্ত হয় সেই জন॥
যে দেশে বাজিছে গৌর-চরণ-নুপূর।
সেই পথ ধরি তোমরা যাও ততদূর॥
যে দেশেতে বাজে প্রভুর খোল করতাল।
হরিনামে কাঁপাইয়া আকাশ পাতাল॥
সেই দেশে কঙ্কর করিও অন্বেষণ।
অবশ্য গৌরাঙ্গ-ভক্তের পাবে দরশন॥
যে দেশে গাছের পাখী গায় হরিনাম।
নাম সংকীর্ত্তনে নদী বহে যে উজান॥
শিষ্য-পদধূলি-মেঘে ছাইছে গগন।
সে দেশে অবশ্য কঙ্কের পাবে দরশন॥”

সত্যপীরের পুঁথিতে প্রদত্ত আত্ম-বিবরণঃ—

“পিতা বন্দি গুণরাজ মাতা বসুমতী।
যার ঘরে জন্ম লইলাম আমি অল্পমতি॥
শিশুকালে বাপ মইল মাও গেল ছাড়ি।
পালিল চণ্ডাল পিতা মোরে যত্ন করি॥
জ্ঞানমানে খাই অন্ন চণ্ডালের ঘরে।
চণ্ডালিনী মাতা মোর পালিলা আদরে॥
গঙ্গার সমান তার পবিত্র অন্তর।
সেও ত রাখিল মোর নাম কঙ্কধর॥
জনম অবধি নাহি হেরি বাপ মায়।
শিশু থুইয়া মোরে তারা স্বৰ্গপুরী যায়॥
মুরারি চণ্ডাল পিতা পালে অন্ন দিয়া।
পালিলা কৌশল্যা মাতা স্তনদুগ্ধ দিয়া॥
মুরারি আমার পিতা ভক্তির ভাজন।
বার বার বন্দি গাই তাহার চরণ॥
গৰ্গ পণ্ডিতে বন্দুম পরম গিয়ানী।
যাঁর আশ্রমে থাকিয়া ধেনু চরাইতাম আমি।
পুনঃ পুনঃ বন্দি আমি গর্গের চরণ।
যাঁর সম জ্ঞানী নাই এ তিন ভুবন॥
বেদ-পুরাণ-সার কণ্ঠে তাঁর গাঁথা।
সাধনার ঘরে বাধা সরস্বতী মাতা॥
বেদ বিধি শাস্ত্রে যাঁর ক্ষমতা অপার।
আর বার বন্দি গাই চরণ তাঁহর॥
শ্মশানের বন্ধু মোর দুঃসময় পাইয়া।
জীবন করিলা দান পদে স্থান দিয়া॥
দুই দিন নাহি খাই অন্ন আর পানি।
হাতে ধরি আশ্রমে লইলা মোরে মুনি॥

ক্ষীর সর দিলা মোরে গায়ত্রী জননী।
মরিবার কালে মোর বাঁচাইলা প্রাণী॥
কঁদিয়া কহিছে কঙ্ক সভার চরণে।
শোধিতে মায়ের ঋণ না পারি জীবনে॥
নদী মধ্যে বন্দি গাই রাজরাজেশ্বরী।
তিয়াস লাগিলে যাঁর পান করি বারি॥
তাহার পারেতে বইসা সুন্দর গেরাম।
জন্মভূমি বন্দি গাই নাম বিপ্রগ্রাম॥
সভার চরণে বন্দি জুড়ি দুই পাণি।
কি বলিতে কি বলিব আমি অল্পজ্ঞানী॥”

 এই সত্যপীরের পাঁচালীতে বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যানটি প্রদত্ত হইয়াছে। ইহাই বঙ্গের সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন বিদ্যাসুন্দর। ইহার পরে নিম্‌তা গ্রামবাসী কৃষ্ণরাম, তৎপরে রামপ্রসাদ সেন এবং সর্ব্বশেষে ভারতচন্দ্র বিদ্যাসুন্দর লিখিয়াছিলেন। কবিকঙ্কের বিদ্যাসুন্দরে অশ্লীলতার লেশ নাই এবং ঘটনার কেন্দ্রস্থান বৰ্দ্ধমান নহে। এই পুস্তকখানি এখনও প্রকাশিত হয় নাই।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

মলয়ার বারমাসী

মলয়ার বারমাসী

(১)

আদিতে বন্দনা করলাম প্রভু সত্যনারায়ণ।
এক বৃক্ষ এক ফল ছিষ্টির[১] পত্তন।
সত্যনারায়ণ প্রভো অগতির গতি।
তাহার চরণে করি শতেক পন্নতি॥
বরমা[২] বিষ্ণু বন্দি গাইলাম লক্ষ্মী সরস্বতী।
কৈলাশ পর্ব্বত বন্দি গাই হর আর পার্ব্বতী॥
স্বর্গেত বন্দিয়া গাইলাম দেবী সুরধনী।
মর্ত্ত্যেত বন্দিয়া গাই আমি পতিত পাবনী॥
শিবের জটায় ছিল যাহার বসতি।
ভগীরথে আনল গঙ্গা অনেক করিয়া স্তুতি॥
চাইর কোনা পৃথিমী বন্দুম আগুন আর পানি।
ত্রেত্রিশ কোটী দেবেরে বন্দি জানি বা না জানি॥
আর বন্দি পার বন্দি বন্দি তরুলতা।
জন্মদাতা বন্দি গাইলাম মাও আর পিতা॥
মায়ের দুটি তন[৩] বন্দুম অক্ষয় ভাণ্ডার।
শত জন্মম গেলে মানুষ শোধিতে নারে ধার॥
চন্দ্র বন্দুম সূর্য্য বন্দুম তারা দুটি ভাই।
গ্রহ তারা বন্দি গাই লেখা জোখা নাই॥
বারে বারে বন্দি গাই ওস্তাদের চরণ।
মিন্নতি করিয়া বন্দি সভার চরণ॥

কিবা গাই কিনা গাই আমি অন্ধমতি।
নিজগুণে ক্ষমা কর মোরে সভাপতি॥
আর বার বন্দি নাই সভার চরণ।
আমার সভাতে আইস সত্যনারায়ণ॥
আইস মাগো সরস্বতী কণ্ঠে কর ভর।
তুমি হইলা তাল যন্ত্র আমি মাত্র ভর॥
ছারি না ছারম মাগো না যাও অন্যথা।
বেইরা[৪] রাখব যোগল[৫] চরণ ছাইরা যাইবা কোথা॥
এই বেলা বন্দনা থইয়া আসল গাওয়া গাই।
আমারে করিও কৃপা যত মমিন ভাই॥
সভা কইরা বইছ ভাইরে হিন্দু মুসলমান।
তোমার জনাবে আমি অধমের ছেলাম॥(১—৩২)
* * * *


(২)

ধন বিত্তে সদাগর গো ও ভালা নবরঙ্গ পুরে।
তাহার খেতিমা[৬] কথা জানাই সভার আগে॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা ঘাটে বাঁধা রাখে সদাগর।
জলের উপুরে যেমন ভাসিছে নওগর॥
ধনদৌলত আছে কত লেখাজোখা নাই।
গজমতি লক্ষ্মী ঘরে দুঃখু কিছু নাই॥
এক কন্যা আছে সাধুর লক্ষ্মীর সমান।
বাপ মায়ে রাখ্যাছে তার মলয়া সে নাম॥
চন্দ্রের সমান কন্যা দেখিতে সুন্দর।
আইন্ধার করিয়া আলো রূপের পশর॥

নবম বছর কন্যা কুলের পরদীম।
ইহারে দেখিয়া সাধু গণে বিয়ার দিন॥
সিন্দুর বরণা ঠোঁট দেখিতে সুন্দর।
সদাগর ভাবিয়া মরে কোথায় যুগ্য বর॥
শিরেত চাচর কেশ মেঘের সমান।
কোথা সে রাজার বেটা কারে দিব দান॥
মুখখানি দেখি কন্যার যেন চন্দ্রকলা।
কার গলে দিব কন্যা আপন বিয়ার মালা॥

ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু কোন্ কাম করে।
বাণিজ্য করিতে যায় বৈদেশ নগরে॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা সাজাইল তৈল সিন্দুরে।
মাঝি মাল্লা লইয়া সাধু যায়ত সফরে॥
চৌদ্দ খানি নয়া পাল মাস্তুলে তুলিল।
বৈদেশ নগর পানে পক্ষী উড়া দিল॥
সামন্ত নগর বামে নয়া রাজার দেশ।
সেই দেশে করয়ে সাধু পাত্রের উরদেশ[৭]

উত্তর ময়ালে দেখে ভানু রাজার দেশ।
তথায় না মিলে সাধু করিল উরদেশ॥
দক্ষিণ ময়ালে দেশে ক্ষীর নদী সাগর।
তথায় বসতি করে সাধু দণ্ডধর॥
সে দেশের সাধুপুত্র দেখিতে কেমন।
দেখিয়া না হইল সাধুর মনের মিলন॥
পূর্ব্ব পশ্চিম সাধু ঘুরিয়া দেখিল।
কন্যার যোগ্য বর তবু খুঁজিয়া না পাইল॥

তবে সাধু নিতিমাধব চিন্তিত হইল।
পশ্চিম ময়াল ছাড়ি ডিঙ্গা ফিরাইল॥
আরবার পূর্ব্ব দেশে করিল গমন।
ছয় বচ্ছর গোয়াইল সাধু কন্যার কারণ॥(১—৩৮)


(৩)

সাধুর সফর কথা এইখানে থুইয়া।
দেশেতে ঘটিল কিবা শুন মন দিয়া॥
হারমাদ ডাকাইত এক নবরঙ্গপুরে।
ডাকাইতি করিয়া বেটা খাইত নগরে॥
ধর্ম্মের নহিক ভয় যারে তারে মারে।
নরহত্যা বরমহত্যা সদাকাল করে॥
একদিন রাইতের নিশা হার‍্যা[৮] কোন্ কাম করিল।
লইয়া চল্লিশা সাইথ পুরিখান বেড়িল॥
ভাণ্ডারের যত ধন লইল কাড়িয়া।
হীরামণ মাণিক্য যত লইল বাছিয়া॥
বাণিজ্য করিয়া সাধু পৃথিবী নগরে।
যত যত ধন পায় সাধু আনে নিজ ঘরে॥
সেই সব ধনের কথা লেখা জুখা নাই।
পরেত করিল কিবা শুন যত ভাই॥

অন্দর কোটাতে দেখে হার‍্যা একটি মাণিক।
অন্ধকারে বাতি যেমুন জ্বলে ঝিকিমিক্।
পালঙ্কে শুইয়া কন্যা লক্ষ্মীর সমান।
রূপের তুলনা নাই জগতে বাখান॥

এরে দেখ্যা পাগল হারা কোন্ কাম করিল।
ঘুমন্ত কন্যারে তবে বুকে তুল্যা লইল॥
মায়ের কান্দনে কন্যা চক্ষু মেল্যা চায়।
মায়ের বুকের ধন চুরে[৯] লইয়া যায়॥(১—২২)

(৪)

পাইলা[১০] বনের মাঝেরে দারাক সারি সারি।
সেই বনে বসতি করে হার‍্যা নাইক ঘর বাড়ী॥
কুটিয়া বানাইয়া হার‍্যা মাটির না তলে।
সেইখানে আছে হার‍্যা লইয়া দল বলে॥
সাধুর যতেক ধন কুটিতে লুকাইল।
নও না বছরের কন্যা তথায় রাখিল॥
এক বচ্ছর দুই বছর তিন বছর যায়।
মাও বাপের কথা হার‍্যা কন্যারে ভুলায়॥
কান্দন কাটি করে কন্যা তাহারে লইয়া।
মায়েরে দেখিব বলি ফাটে তার হিয়া॥
যে দেশের যত দ্রব্য দেখ চুরি কইরা পায়।
ভাল ভাল বনের ফল কন্যারে বিলায়
পালকিয়া[১১] পালায় যেমুন পিঞ্জরের পাখী।
কন্যারে পালনা করে সেই মত দেখি॥
পুত নাই সে কন্যা নাই সে হার‍্যার বুকে হইল দয়া।
পরের ধন লইল হার‍্যা বুকেত তুলিয়া॥
কত কত বচ্ছর যাইল এমনি করিয়া।
তারপর হইল কিবা শুন মন দিয়া॥(১—১৮)

(৫)

থল কুলের ভুমা রাজা ক্ষেমতা অপার।
হাত্তী ঘোড়া লোকজন আছে বহুতার॥
ছিপাই[১২] লস্কর যত লেখা যোখা নাই।
ধন দৌলত রাজার গুণ্যা না বাড়াই[১৩]
মত্তের না বালু যত আসমানের তারা।
সেই মতন রাজার ধন গুণ্যা না পাই সারা॥
থল বসন্ত নামে ছিল রাজার কুঙার[১৪]
দেখিতে সুন্দর রূপ কার্ত্তিক কুমার॥
যেই দেখে সেহি জনে রূপেরে বাখানে।
রাজপুত্রের রূপ দেখ চন্দ্রকলা জিনে॥
প্রথম যৌবন পুত্র যে পুরী উজ্জ্বলা।
রাজা শিখায়েছে তারে নানা শাস্ত্রকলা॥

এক দিনের কথা সবে শুন দিয়া মন।
শিকারে যাইবা কুমার কর‍্যাছে মনন॥
“শুন শুন পিতা ওগো কহি যে তোমারে।
শিকারে যাইব আমি পাইলা বনের মাঝে॥”
শুনিয়া বনের কথা রাজার লাগে চমৎকার।
বাঘ ভালুক ধত আছে লেখা নাই সে তার॥
রাজপরী দলে দলে ভ্রময়ে তথায়।
সেই বনে যাইতে পুত্রে মানা করে মায়॥

তবেত রাজার পুত্র মানা না শুনিল।
লোকলস্কর লইয়া কুমার শিকারে মেলা দিল[১৫]

মঞ্চের না ধূলা কুড়া[১৬] আসমানেতে উড়ে।
পাইলা বন বেইড়া লইল রাজার লস্করে॥(১—২৪)

* * * *

(৬)

একদিন হইল কিবা শুন দিয়া মন।
ডাকাতি বাহারে গোল হার্যার লোকজন॥
শূন্য কুটি পাইয়া না কন্যা কোন কাম করিল।
আলোক ডেঙ্গাইয়া[১৭] কন্যা বনে বাহিরিল॥
চারি দিকে দেখে কন্যা দাড়াক সারি সারি।
প্রথম যৌবন কন্যা চলে একেশ্বরী॥
চাইর দিকে দেখে কন্যা পশুপক্ষী চরে।
চাইর দিকে ফুটে ফুল দেখে সুবিস্তরে॥
ময়ূর ময়ূরী কত উইরা বৈসে ডালে।
বনের পন্থ পাইয়া কন্যা আস্তে মস্তে চলে॥(১—১০)

* * * *

(৭)

“কে তুমি সুন্দর কন্যা বনে একেশ্বরী।
মনুষ্য নহত কন্যা কিবা রাজপরী॥
কেবা তোমার মাতা পিতা কেবা তোমার ভাই।
পরিচয় কথা কহ কন্যা শ্রবণ জুড়াই॥
নয়ন জুড়াই কন্যা তোমার রূপ দেখি।
কোথান হইতে আইলে তুমি কার পিঞ্জরার পাখী॥

কার বুক খালি সে করিয়া বনেতে বেড়াও।
পরিচয় কথা কন্যা আমারে জানাও॥”

“বাপ মোর সদাগর নবরঙ্গপুরে।
নিত্যি মাধব নাম জানাই তোমারে॥
মাও মোর কাঞ্চনমালা আর কেহ নাই।
মায়ের কোলেতে কুমার সুখে নিদ্রা যাই॥
দুরন্ত দুষ্মন হার‍্যা কোন্ কাম করিল।
মায়ের বুক কর‍্যা খালি আমারে লইল॥
মায়ের আঁখির জল হইল বুঝি সার।
সেই হইতে আছি গো কুমার বনের মাঝার॥
বনের ফল খাই কুমার ভূয়েত শয়ন।
অঝুরে মায়ের লাগ্যা ঝরে দুই নয়ন॥
ছয় বচ্ছর গত হইল মানুষ নাইসে দেখি।
আজি মাত্র দেখিলাম বনের পশুপাখী॥
শুন শুন রাজার কুমার কহি যে তোমারে।
শীঘ্র কইরা যাহ কুমার ফির‍্যা আপন ঘরে॥
দুরন্ত দুষ্মন হার‍্যা যদি লাগাল[১৮] পায়।
আমার মায়ের মতন কাইন্দা মরব মায়॥
দয়ামায়া নাই হার‍্যার নিদয়া পাষাণ।
লাগল পাইলে তোমার বধিব পরাণ॥”

থলবসন্ত কুমার কহে “কন্যা মন করলো দড়।
বহির বনেতে আমার আছরে লস্কর॥
হের দেখ ঘোড়া গোটা পবন সমান।
তরয়ালে কাটিয়া লইব হারার পরাণ॥

শুন শুন সুন্দর কন্যা আমার কথা ধর।
আমার না সঙ্গে তুমি চল নিজ ঘর॥
মাও বাপ কাইন্দা কন্যা লো তোর অন্ধ করছে আঁখি।
এমন সুন্দর রূপ কভু না চখে দেখি॥
ছয় বচ্ছর গেছে লো কন্যা তারা আছে বা না আছে।
নবরঙ্গপুরের কথা আমার জানা আছে॥
পরিচয় কথা কন্যা কহি যে তোমারে।
থলভূমের ভূমা রাজা আমি পুত্র তার॥
বনেত আইলাম কন্যা করিতে শিকার।
শিকার না পাই কন্যা ঘুরিয়া বিস্তর।
বিধি মিলাইল নিধি বনের ভিতর
চল চল সুন্দর কন্যা আপন দেশে চল।
জুড়িয়া রহলো কন্যা আপন মায়ের কোল॥
তোরে থইয়া কেমনে যাইব আমার রাজ্যদেশ।
ঝাড়িয়া বান্ধলো কন্যা আপন মাথার কেশ॥”(১—৪৬)

(৮)

রাজার পুত্র পাগল হইল রাজা ভাবিয়া না পায়।
সাধুরে ডাকিয়া রাজা বৃত্তান্ত জানায়॥
তবে সাধু কহে রাজা আমার কথা ধর।
এই কন্যা না করিব তোমার পুত্রের ঘর॥
বয়সে বয়সী কন্যা মন গেছে তার।
থলভূমের রাজপুত বসন্ত কুমার॥
তবেত শুনিয়া রাজা গোম্বায়[১৯] জ্বলিল।
কোটালে ডাকিয়া রাজা সাধুরে বান্ধিল॥(১—৮)

(৯)

* * * *
রাত্রি নিশাকালে কন্যা কোন্ কাম করে।
পতিরে বাঁচাইয়া সতী কন্যা গেল সুয়ামীর ঘরে॥
রাজ্যেত বাজিল ডঙ্কা আনন্দ অপার।
বাজিল বিয়ার বাদ্যি জয়ত জোকার॥
তবেত ভূমানা রাজা কোন্ কাম করিল।
যত যত রাজগণে নিমন্ত্রণ দিল॥
আইরা রাজা পাইরা রাজা রাজা ধনেশ্বর।
থলকুলে আই—তারা পাইয়া নিমন্তন॥
পূর্ব্ব হইতে আইল রাজা নামে লম্বোদর।
দক্ষিণ দেশের রায় রাজা গদাধর॥
পশ্চিম হইতে আইল মস্ত অধিকারী।
যার ধন রক্ষা করে কুবের ভাণ্ডারী॥
উত্তর হইতে আইল রাজা চন্দ্রকেতু নাম।
পৃথিবী জুড়িয়া যার ধনের বাখান॥
মধ্যম ময়াল হইতে আইল রাজা মল্লশাট।
হীরা মাণিক্য দিয়া যে বাইন্ধাছে ঘাট॥

কত কত রাজা আইল লেখাজোখা নাই।
গোপনেতে আইল রাজা দুষ্মন বলাই॥
নবরঙ্গপুর হইতে বলাই আসিয়া।
যুক্তি করে বলাই রাজা রাজা সবে লইয়া॥
কোথাকার হইতে আইল রাজা কেবা মাতাপিতা।
ভাল করিয়া নাইসে জানি সেই কন্যার কথা॥
বনেত করিয়াছে বসতি কন্যা দশ না বচ্ছর।
যৌবনের কালে কন্যা রইল একেশ্বর॥
পরীক্ষা দেহুক কন্যা এহি সভা স্থানে।

কিবান পরীক্ষা কথা করহ বিচার।
রাজাগণ মিল্যা যুক্তি করে আরবার॥
গোপনে বলাই রাজা সকলে বুঝায়।
আমার যুকতি বাক্য শুন যত রায়॥
বাণিজ্যের ধন ভইরা ডিঙ্গা লইয়া যাও।
সমুদ্র সাওরে নিয়া তাহারে ভাসাও॥
দাড়ী নাইসে মাঝি নাইসে ডিঙ্গা ফিইরা আইসে ফেরে।
তবে জানি সতী কন্যা তুল্যা লহ ঘরে॥

গলুইয়ে লাখের বাত্তি[২০] দেওত জ্বালায়া।
উজলা বাওয়ারে[২১] বাত্তি যায়ত নিভিয়া॥
তবে জান এহি কন্যা অসতী সমান।
বিচার করিয়া তার কাট নাক কাণ॥
রাজঘোড়া ছাইরা দেন বনের মাঝারে।
বিনিত সুওয়ারে[২২] ঘোড়া ফিরিব নগরে॥
সেই ঘোড়া আইসে যদি নগরে ফিরিয়া।
সোহাগে কন্যারে লহ ঘরেতে তুলিয়া॥
বনেতে হারাই পন্থ ঘোড়া নাইসে ফিরে।
রাক্ষুসী জানিয়া কন্যা পাঠাও বনবাসে॥

গুড়িকাডা[২৩] চাম্পা বিরক্কে যদি ধরে ফুল।
তবে জান এহি কন্যা সীতা সমতুল॥
অজরা চাম্পা না গাছে পুষ্প নাহি ধরে।
তিল দণ্ড এহি কন্যা না রাখিহ ঘরে॥
খাঁচায় না পোষাপাখী উড়াও বাহিরে।
উড়িয়া আসুক পাখী আপন পিঞ্জরে॥

তবে জানি সতী কন্যা ঘরে তুল্যা লইও।
যোড়ের মন্দির মাইঝে যতনে রাখিও॥
যদি দেখ পোষা না পঙ্খী ফিইরা নাই আসে।
রজনী না পোহাইতে দিব বনবাসে॥

ঘরের কপিলা গাই দুগ্ধ যদি শোষে।
এক দণ্ড এহি কন্যায় না রাখিও বাসে॥
যতেক পরীক্ষার কথা রাজা সে জানিল।
বাণিজ্য ভরিয়া ডিঙ্গা সায়রে ভাসাইল॥
পরীক্ষার কাল দেখ উত্তুরিয়া যায়।
ঘাটে নাইসে ফিরে ডিঙ্গা কি হইল হায়॥
রাজ-ঘোড়া গেল বনে আর না ফিরিল।
বিষতীর খাইয়া ঘোড়া জীবন ত্যজিল॥
গুড়িকাটা বিরেকে[২৪] কবে ধরে চাম্পাফুল।
গোপনে বলাই রাজা বুঝাইয়াছে ভুল॥
পোষানিয়া টিয়াপাখী উড়িয়া পলায়।
চিন্তিত হইয়া রাজা করে হায় হায়॥
কপিলার নালে দেখে রক্তধারা বয়।
এরে দেখ্যা হইল রাণীর পরাণ সংশয়॥

নিবিয়া লাখের দীপ হইল অন্ধকার।
এই কন্যা ঘরে দেখ রাখা নাই সে যায়॥
পৃথিমীর রাজাগণ একমত হইল।
অভাগী মলয়া কন্যা বনে পাঠাইল॥
দুঃখের কপাল কন্যা কত দুঃখ পায়।
দেশেতে পৌছিল খবর কাইন্দা মরে মায়॥(১–৬২)

বারমাসী

(১০)

কান্দে মলয়া কন্যা চক্ষে বহে ধারা।
কোথায় রইলা পরাণ পতি দেওত মোরে দেখা॥
যত যত রাজগণ দুষ্মন হইল।
কলঙ্কী বলিয়া মোরে বনে পাঠাইল॥

আইল আইল ফাগুন মাসরে গাছে নানা ফুল।
গন্ধতৈল দিয়া নারী বান্ধে মাথার চুল॥
নবীন যৈবন ভারে হাল্যা পড়ে গাও।
শরীল দহিয়া বয় পবনের বাও॥
গাছে গাছে সোণার কোইল রঙ্গে হুলা গায়[২৫]
খঞ্জনা নাচিয়া পড়ে খঞ্জনীর গায়॥
কুক্ষণে দুষ্মন হার‍্যা মায়েরে ভাণ্ডাইয়া।
কুক্ষণে বনের মাঝে আনিল হরিয়া॥
কুক্ষণে ছাড়িলাম বাস আমি অভাগিনী॥
* * * *
কোথার তনে আইলা পুরুষ সোণার বরণ।
বনের অতিথে দিলাম জীবন যৌবন॥
স্বপনের দেখা যেমুন স্বপনে মিলায়।
বন বাহুরিয়া[২৬] ঘোড়া শুন্যেতে মিলায়॥
দুই আঁখি বুঞ্জিয়া রইলাম কুমারে ধরিয়া।
কোন্ রাজার পুরে আইলাম অদিষ্টিরে লইয়া॥

আইল আইল চৈত্রি মাসরে বসন্ত দারুণ।
যৌবনের বনে মোর লাগিল আগুন॥
পুষ্প যেমুন পাগল হইয়া সম্ভাষে ভ্রমরে।
যাচিয়া দিলাম মধু ভিন্ন দেশী কুমারে॥
সোণার পুরী পাইলাম শ্বশুরা শাশুরী।
কামটুঙ্গী ঘরে শুইয়া নিদ্রা হইল ভারী॥
মলয়ের হাওয়া বয় কোকিলা করে গান।
বন্ধুর মুখেতে তুল্যা দেই চুয়া পান॥
গাথিয়া ফুলের মালা বন্ধুরে পরাই।
পুষ্পের শীতলা শেষে শুইয়া নিদ্রা যাই॥
আচমকা স্বপন যেন সকলি ভুলায়।
স্বপনের দেখা যেমুন স্বপনে মিলায়॥
বেলাত হইল ভারি নিদ নাহি টুটে।
এক দুই তিন করি চৈত্র মাস কাটে॥

আইল বৈশাখ মাসের গ্রীষ্ম নিরদয়।
আগুন মাখিয়া অঙ্গে ভানুর উদয়॥
বন্ধু কয় কামটুঙ্গি ছাড়লো সুন্দরী।
চলিতে চলেনা পদ যৌবন হইল ভারী॥
আস্তে বেস্তে চলিলাম জলটুঙ্গি ঘরে।
বিছান শীতলপাটি পালঙ্ক উপরে॥
শীতল চন্দন বন্ধু মাখে সর্ব্ব গায়।
বন্ধুর উরেতে শুইয়। সুখে দিন যায়॥
এই দিন স্বপ্নের মত সপনে মিলাইল।
এক দুই তিন করি বৈশাখ কাটিল॥

জ্যৈষ্ঠ মাসেত দেখ দুঃখের বিবারণ।
পৃথিমীর রাজগণে পাঠায় নিমন্ত্রণ॥

সুখের স্বপন মোর এখনে কাটিল।
দারুণ পরীক্ষা কাল সুমুখে আসিল॥
প্রাণপতি বন্দি মোর হইল বৈদেশে।
তরাসে কাঁপিল পরাণ জানিয়া হুতাশে॥

ধরিয়া অতিথের বেশ বন্ধুরে বাঁচাই।
যত কষ্ট দিল মোরে দুখন বলাই॥
বাহুরিয়া ডিঙ্গা দেখ ঘরে নাই সে ফিরে।
রাজঘোড়া মইল বনে খাইয়া বিষতীরে॥
বনবাসে আইলাম বন্ধুরে ছাড়িয়া।
দৈচ্ছতে[২৭] কান্দিল পরাণ বিভুইয়ে[২৮] পড়িয়া॥

কোথায় রৈলা পরাণ পতি কারে কহি কথা।
বারমাসী কাহিনী মোর শুন তরুলতা॥
বনের ময়ূরী আর ডালের পঙ্খিনী।
তোমরা বইসা শুন মোর দুষ্কের কাহিনী॥
অচিন বনের রাজ্য কোন্ দিকে যাই।
কলঙ্কী কন্যারে রাখে এমুন সুহৃদ্ নাই॥
মাও বাপ এমুন কালে রইল জানি কোথা।
দুঃখের লাগিয়া কন্যায় সৃজিল বিধাতা॥
গলায় তুলিয়া দিব ঘাসুনার[২৯] ফাঁস।
কঙ্ক কয় না ছাড় কন্যা আপন পরাণ আশ॥
বাঁচিয়া থাকিলে হবু বন্ধুর দরশন।
সুমুখে আষাঢ় মাস থির কর মন॥

আইল আষাঢ় মাস ঘন ডাকে দেওয়া।
পাটুনী পাটিয়া ধরে নয়াগাঙ্গে খেয়া॥
নদীতে যৌবন ভারি কূল ভাঙ্গি চলে।
যতেক সাধুর ডিঙ্গা উড়াইল পাল॥
পূবেত গৰ্জ্জিয়া দেয়া পশ্চিমে মিলায়।
বিরক্ক তলে থাক্যা কন্যা রজনী গুয়ায়[৩০]

কান্দে মলয়া নারী চক্ষে বহে পানি।
বনে বনে কাইন্দা কন্যা ফিরে উন্মাদিনী॥
বিরক ডালে বসিয়ারে ময়ূরা পেখম ধরে।
তা দেখ্যা পড়য়ে মনে কন্যার জলটুঙ্গি ঘরে॥
শয্যায় শীতল পাটী গায়েত চন্দন।
একে সঙ্গে আর পড়ে বন্ধুর বাহুর বন্ধন॥
আউলা কেশ ঝাড়িয়া বান্ধে কন্যা পূর্ব্ব কথা সুরি[৩১]
আমার না সোণাবন্ধু কে করিল চুরি॥
শুন বিরক কহিরে কথা দুঃখু বিবারণ।
তোমার তলায় যেন আমার মরণ॥
মরিলে আভাগী কন্যা যদি দেখা পাও।
আমার দুষ্কের কথা বন্ধুরে জানাও॥
কঙ্ক কহে নাহি সে ছাড় কন্যা জীবনের আশ।
সুমুখে আসিল তোমার ওইনা শাওন মাস॥

আইল আইল শাওন মাসের ঘন বরিষণ।
দেওয়ার গর্জ্জন শুন্যা কাঁপে নারীর মন॥
উলকিয়া ফিনকি ঠাডা[৩২] আসমান ভাইঙ্গা পড়ে।
চমকাইয়া বেসুরা নারী আপন স্বামী ধরে॥

গলায় সাফলার মালা আর শীতল পাটি।
ভালত বিছায়া শয্যা করি পরিপাটি॥
বিভোলা বন্ধেরে লইয়া ঘুমে অচেতন।
এইকালে মলয়ার দুঃখ বিবারণ॥
ভাঙ্গিয়া গাছের ডাল ধরিয়াছে শিরে।
দুরন্ত বাদলা বর্ষ্যা[৩৩] অঙ্গ বাইয়া ঝরে॥
ভিজা চুল ভিজা বস্ত্র মাটিত শয়ান।
এত দুঃখেতেও কেন না বাইরায়রে পরাণ॥
কঙ্ক কহে কন্যালো না ছাড় তার আশ।
সুমুখেতে ভাদ্রমাস চান্নির[৩৪] পরকাশ॥

আইল আইল ভাদ্রমাস রাত্রিখানা ছোট।
অভাগী মলয়া কন্যার নিদ নাই সে মোট॥
ভাদ্রের নিরল[৩৫] চান্নি নদী নালা ভাসে।
বাণিজ্য করিয়া সাধু ফিরে আপন দেশে॥
কেমুন জানি আছে বাপ কেমুন জানি মাও।
অঙ্গ শীতলিয়া বায়রে নদীর শীতল বাঙ॥
সেই বাওয়ে জ্বলে অঙ্গ দহেত পরাণী।
কি জন্য রাখ্যাছি পরাণ কিছু ত না জানি॥

আশ্বিনে শুকাইয়া দরিয়া মন্দ পড়ব পানি।
ডুবিয়া মরিতে কন্যা ছুটে পাগলিনী॥
কঙ্ক কহে গুলো কন্যা নিজেরে বাঁচাও।
বাঁচিলে অবশ্যি দেখা পাবে বাপ মাও॥

আইল আশ্বিন মাস দুর্গাপূজা দেশে।
ভাগ্যবানে পূজে দুগ্‌গা অশেষে বিশেষে॥

বাপর বাড়ী দুগ্‌গাপূজা কিছু মনে পড়ে।
শৈশবের যত সুখ গেল কোন্ ফেরে॥
যত সুখ ছিল ভালে তত দুঃখ আইল।
সোণার না রাজ্যপাট কাড়ি খেদাইল॥
রাজার ছাওয়াল মোর হইল সোয়ামী।
বনেতে কান্দিয়া আজি পোহাই রজনী॥
বিষ গাছ বিষ ফল কন্যা বনেতে বিছরায়[৩৬]
এমুন দুঃখের পরাণ রাখা হইল দায়॥
কঙ্ক কয় কন্যা তুমি না হও উতালা।
দুঃখেরে করিয়া লহ আপন গলার মালা॥
সুখ পাইতে চাও কর দুঃখের ভজনা।
* * * *
আইল কার্ত্তিক মাসরে আসমান উজল।
নিয়ারে[৩৭] জ্বলিয়া মরে জলের কমল॥
সোণার কমল বনরে হইল উজার।
আমার সুখের আশা হইল ছারখার॥
নদীতে ডুবিয়া মরি নদীত শুকায়।
বিষফল খাইতে গেলে পরাণ না যায়॥
বস্ত্র হইল জীন্ন শীন্ন কেশ হইল ঝারা।
গাছের না পাতা হইল কণ্ঠার অঙ্গ জোরা॥
দুই নয়ানে বহে ধারা কন্যা কান্দিয়া পোহায়।
ছোট বেলা ছোট দিন কার্ত্তিক মাস যায়॥

আইল আগুন মাস জ্বলিল আগুনি।
শিশিরে দহিল অঙ্গ কাতর হইল প্রাণী॥
শুন শুন তরুলতা আমার দুঃখের কথা।
দুঃখের লাগিয়া মোরে সৃজিল বিধাতা॥

ঘর নাই দুয়ার নাই সে বিরক তলায় বাস।
এই মতে কাইন্দা কন্যার যায় দশ মাস॥

সুমুখে দারুণ শীত অঙ্গে বাস নাই।
দারুণা শীতের কাল কিমতে কাটাই॥
দুঃখিনী দুঃখের কপাল কাইন্দা কঙ্কে কয়।
সাওরে বিছায়া শেষ কন্যা নিয়ারে কি ভয়[৩৮]

এই পথে চললো কন্যা পাবে বন্ধুর দেখা।
সুমুখেতে পৌষা আন্ধি অন্ধকারে ঢাকা॥
পুষমাসেতে কন্যা কান্দিয়া আকুল।
চাকুলীর[৩৯] আঁশ কন্যা রুক্ষু মাথার চুল॥
দুই নয়ানে ধারা বহে কন্যা কান্দে বনে বনে।
কান্দিতে কান্দিতে গেল কাঠুরীর থানে॥
মাঘ মাসেতে কন্যার দুঃখ হইল ভারী।
বন ছাইরা নগরেতে চলিল কাঠুরী।
উদাস বনেতে কন্যা থাকে একেশ্বরী॥
দারুণ মাঘের শীতে অঙ্গে পড়ে ঢাকা।
এনকালে হার‍্যার সঙ্গে আরবার দেখা॥(১–১৫৮)

(১১)

* * * *
যত যত রাজগণ সভা কইরা বসে।
হার‍্যারে বান্ধিয়া কুমার আনে নাগপাশে॥
* * * *

বন বিচরিতে কুমার ঘোড়ায় চড়িল।
যতেক লস্কর তার সঙ্গেত চলিল॥
কোথায় রইল লোক লস্কর শুন্যে ঘোড়া ছুটে।
আর বার যায় ঘোড়া গইন বনের মাঝে॥(১—৬)

(অসমাপ্ত)

  1. ছিষ্টি=সৃষ্টি।
  2. বরমা=ব্রহ্মা।
  3. তন=স্তন।
  4. বেইরা=বেড়িয়া।
  5. যোগল=যুগল।
  6. খেতিমা=খ্যাতি।
  7. উরদেশ=উদ্দেশ।
  8. হার‍্যা=ডাকাতের নাম। হারমাদ-জাতীয় বলিয়াও “হারা” নামে উক্ত হইতে পারে।
  9. চুরে=চোরে।
  10. পাইলা বন=বনের নাম।
  11. পালকিয়া=পালক।
  12. ছিপাই=সিপাহি।
  13. গুণ্যা না বাড়াই=গুণিয়া ‘বাড়’ (শেষ) করিতে পারা যায় না।
  14. কুঙার=কুমার।
  15. মেলা দিল=যাত্রা করিল।
  16. কুড়া=কুটা।
  17. ডেঙ্গাইয়া=ডিঙ্গাইয়া, লঙ্ঘন করিয়া।
  18. লাগল=নাগাদ।
  19. গোস্বা=ক্রোধ।
  20. লাখের বাত্তি=বহুসংখ্যক বাতি।
  21. বাওয়ারে=বাতাসে।
  22. বিনিত সুওয়ারে=বিনা সওয়ারে!
  23. গুড়িকাডা=যাহার গোড়া কাটা গিয়াছে।
  24. বিরেকে=বৃক্ষে।
  25. হুলা গায়=কলরব করে।
  26. বন বাহুরিয়া=বন ঘুরিয়া।
  27. দৈচ্ছতে=দুঃখে।
  28. বিভুইয়ে=বিদেশে।
  29. ঘাসুনার=একরূপ লতার।
  30. গুয়ায়=কাটায়।
  31. সুরি=স্মরিয়া
  32. ঠাডা=বজ্র।
  33. বর্ষ্যা=বর্ষা।
  34. চান্নির=চন্দ্রের।
  35. নিরল=নির্ম্মল।
  36. বিছরায়=সন্ধান করে।
  37. নিয়ারে=নীহারে।
  38. সমুদ্রে শয্যা প্রস্তুত করিয়াছ, শিশিরে ভয় কেন?
  39. চাকুলীর=পাটের(?)।