পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/শীলা দেবী
শীলাদেবী
১৯২৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে চন্দ্রকুমার দে মৈমনসিংহের আদমগুজি নিবাসী কালু সেখ এবং কদমশ্রী গ্রামের নন্দলাল দাস নামক এক মাঝির নিকট হইতে এই পালাটি সংগ্রহ করেন।
পালাটির ঘটনা সম্ভবতঃ ঐতিহাসিক। মৈমনসিংহের বহুস্থানে শীলাদেবী সম্বন্ধে বহু প্রবাদ প্রচলিত আছে। উক্ত জেলায় নববৃন্দাবনের আরণ্য প্রদেশে শীলাদেবী-সংশ্লিষ্ট অনেক কাহিনী এখনও শোনা যায়।
এই পালাটির আর একটি সংস্করণ সম্বন্ধে আমরা জানিতে পারিয়াছি। মৈমনসিংহের গোপাল আশ্রম নিবাসী গোপালচন্দ্র বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি বহুপূর্ব্বে স্থানীয় ‘আরতি’ নামক পত্রিকায় শীলাদেবী সম্বন্ধে একটি পালার সারাংশ সঙ্কলন করিয়া দিয়াছিলেন। গোপালবাবু এখনও জীবিত আছেন এবং তাঁহার বয়স ৭৪৷৭৫ বৎসর হইবে। বর্ত্তমান পালার সঙ্গে আরতি পত্রিকায় প্রকাশিত পালাটির তুলনা করিলে দেখা যাইবে উভয় পালাই অনেকটা একরূপ হইলেও তাঁহাদের মধ্যে কিছু গুরুতর পার্থক্য বিদ্যমান। মুণ্ডাদস্যুর ব্রাহ্মণ-রাজগৃহে চাকরি গ্রহণ হইতে তাহার রাজকুমারীর পাণিপ্রার্থনা এবং অবশেষে বন্দীশালা হইতে পলায়ন ও কয়েক বৎসর পরে বন্য মুণ্ডার দল সংগ্রহ করিয়া ব্রাহ্মণ-রাজার প্রাসাদ লুণ্ঠন—এই কাহিনী উভয় পালাতেই একরূপ। ব্রাহ্মণ-রাজা তাঁহার কন্যা-সহ পলাইয়া আর একটি হিন্দু রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেন—এই পালায় আমরা ইহাই পাইতেছি। কিন্তু আরতির সারাংশতে দেখা যায় যে ব্রাহ্মণ-রাজা পলাইয়া গাজীদের শরণাপন্ন হন। বঙ্গের ইতিহাসজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই অবগত আছেন যে খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গে গাজীদের অতুল প্রতাপ হইয়াছিল! তাহারা ভাওয়াল ও ধামরাই, সাভার এবং মৈমনসিংহের অনেক স্থানের হিন্দুগৌরব নষ্ট করিয়াছিল। যে গাজীর নিকট ব্রাহ্মণ-রাজা শীলদেবীকে লইয়া উপস্থিত হন, তিনি যথেষ্ট আতিথ্য দেখাইয়াছিলেন; কিন্তু গাজীর এক তরুণবয়স্ক পুত্র শীলাদেবীর রূপমুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করিবার জন্য চেষ্টিত হন। ব্রাহ্মণ-রাজা পলাইয়া নিজেকে মুসলমানের আত্মীয়তা হইতে রক্ষা করেন। ত্রিপুরার রাজা ব্রাহ্মণ-রাজাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাইয়া নিজ প্রাসাদের এক অংশে স্থান প্রদান করেন। এখানেও ত্রিপুরার যুবরাজ শীলাদেবীর অনুরাগী হইয়া পাণিপ্রার্থী হন। ব্রাহ্মণ-রাজা নানারূপ বিপদের অভিঘাতে বিচলিত হইয়া এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিতে পারেন নাই, এবং শীলাদেবীও ত্রিপুরার রাজকুমারের অনুরাগিণী হইয়াছিলেন। ত্রিপুরার যুবরাজ অসংখ্য সৈন্য লইয়া মুণ্ডা-দলনের অভিপ্রায়ে ব্রাহ্মণ-রাজার প্রদেশে অগ্রসর হন। মুণ্ডারা এবার প্রমাদ গণিল, কিন্তু সাহস হারাইল না। তাহারা রাজকুমারের অগ্রগামী সৈন্যের পথের নদীর বাঁধ ভাঙ্গিয়া দিল। বর্ষাকালের উন্মত্ত বন্যা নদীবক্ষ স্ফীত করিয়া একটা বৃহৎ ভূভাগ ভাসাইয়া ফেলিল। শীলাদেবী ত্রিপুরার রাজকুমারের পার্শ্বে পুরুষ যোদ্ধার বেশে সৈন্য পরিচালনা করিতেছিলেন। এই আকস্মিক বন্যার প্রকোপে রাজকুমারের সমস্ত সৈন্য ধ্বংস হইয়া যায় এবং শীলদেবী ও যুবরাজ অতল জলে নিমজ্জিত হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। ইহার পরে অশিক্ষিত ও বর্ব্বর মুণ্ডার দলকে দমন করিতে ত্রিপুরা-রাজের বিশেষ কষ্ট পাইতে হয় নাই। তিনি সমস্ত মুণ্ডার দল জালের দড়ি দিয়া ঘিরিয়া ফেলিয়া তাহাদিগকে বন্দী করেন এবং তোপের মুখে তাহাদিগকে উড়াইয়া দেন। যে স্থানে মুণ্ডারা এইভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহার নাম ‘কাঁকড়ার চর’। এখনও সেই স্থানটিতে তাহাদের সম্বন্ধে অনেক গল্পগুজব প্রচলিত আছে।
মূল ঘটনা ঐতিহাসিক। যে সময়ে কোন স্থানীয় কোন প্রসিদ্ধ ঘটনা ঘটিয়া থাকে তাহার অব্যবহিত পরেই তথাকার সাধারণ লোকেরা তৎসম্বন্ধে পালা প্রস্তুত করে। এই হিসাবে অনুমান করা যাইতে পারে যে মূল পালাটি চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে বিরচিত হইয়াছিল, কারণ ঐ সময়েই গাজীরা অতি পরাক্রান্ত ছিল।
‘আরতি’তে যে পালাটির সারাংশ সঙ্কলিত হয় সে পালাটি হারাইয়া গিয়াছে, এখন আর তাহা পাইবার উপায় নাই। কিন্তু উহার সারাংশ দ্বারা আমরা যতটা বুঝিতে পারি তাহাতে অনুমিত হয় যে সেই পালাটিই খাঁটি ছিল এবং বর্ত্তমান পালাটিতে রচয়িতা ইচ্ছাপূর্বক কতকগুলি পরিবর্তন সাধন করিয়াছেন। শীলা দেবীর পিতা পলাইয়া যে রাজার নিকট গিয়াছিলেন, এই পালাটিতে তাহার নাম বা কোন পরিচয় নাই। কিন্তু আমার বিশ্বাস ব্রাহ্মণ-রাজা গাজীদের নিকটই সাহায্য প্রার্থনার জন্য প্রথম গিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের আতিশয্যে দ্বিতীয় পালা-লেখক মুসলমান-সংশ্লিষ্ট ঘটনাটা গোপন করিয়াছেন এবং তৎস্থলে একটি অজ্ঞাতকুলশীল অনামা হিন্দুরাজাকে আনিয়া সে স্থান পূরণ করিয়াছেন। এই পরিবর্তন স্বেচ্ছাকৃত। পূর্ব্বকালে ত্রিপুরার রাজারা গাঙ্গেয় উপত্যকার উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক আদান-প্রদানের জন্য লালায়িত ছিলেন, ইহা অনেকেই জানেন। সুতরাং ত্রিপুরার যুবরাজের ব্রাহ্মণকুমারীর পাণিপ্রার্থী হওয়া বিচিত্র নয়।
যদিও বর্ত্তমান পালাটি সম্ভবতঃ এইভাবে পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, তথাপি মূল পালার সহিত ইহার ভাব ও ভাষাগত যে খুব বেশী পার্থক্য আছে ইহা আমার মনে হয় না। যে আকারে এই পালাটি পাইতেছি, তাহা পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব্বভাগে বিরচিত হইয়াছিল, ইহাই আমাদের ধারণা।
মুণ্ডার চরিত্রটি যথাযথভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। অল্প কথায় একটা লৌহবক্ষ বৃষস্কন্ধ মহাতেজস্বী অসভ্য বীরের আকৃতিটি আমাদের চক্ষের সম্মুখে উপস্থিত করা হইয়াছে। তাহার স্পৰ্দ্ধা, তেজ এবং চক্রান্ত করার শক্তি একটা ভীষণ বন্য শার্দ্দুলেরই অনুরূপ। শীলদেবী এবং যুবরাজের প্রেম-কাহিনী একটি দুর্ঘটনাময় আঁধার রাজ্যের মধ্যে বিদ্যুৎ-স্ফুরণের ন্যায়। মামুলী বারমাসীটি আছে এবং স্থানে স্থানে গ্রাম্য পাণ্ডিত্যের চিহ্ন দেখিয়া মনে হয় পালার লেখক নব ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের হাত একেবারে এড়াইতে পারেন নাই। বারমাসী এবং প্রেমকাহিনী একটু অতিরিক্ত মাত্রায় দীর্ঘ হইয়াছে; তথাপি তন্মধ্যে যথেষ্ট পল্লী-সৌন্দর্য্যের প্রভা বাড়িয়াছে। মোটামুটি বলিতে গেলে পালাটি প্রাচীন ভাল পালাগুলির সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে স্থান লইবার দাবী করিতে পারে এবং ভাষাও অনেকটা প্রাচীন আদর্শেরই অনুরূপ। প্রাচীন পল্লীগুলির তৎসাময়িক যে চিত্র দেওয়া হইয়াছে তাহার একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অসভ্য এবং বন্য জাতিরা সহসা যূথবদ্ধ ব্যাঘ্রের মত পাহাড় হইতে কিভাবে নিম্ন সমতল ভূমির উপরে আসিয়া পড়িত এবং নিরীহ ব্যক্তিদের সর্ব্বনাশ-সাধন করিত, তাহা এই পালাটিতে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। সাঁওতাল, গারো এবং কুকীদের আক্রমণ সম্বন্ধে বহু পালাগান আমরা পাইয়াছি। তৎসঙ্গে এই পালাতে মুণ্ডারা আসিয়া জুটিয়াছে। যখন হিন্দু রাজত্ব নষ্ট হইয়া যায়, এবং মুসলমানেরা নিজেদের শাসন তখনও ততদূর সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারেন নাই সেই সময় মৎস্যন্যায়ের যুগ। পাল-রাজাদের অভ্যুদয়ের পূর্ব্বে একবার সেইরূপ একটা যুগ আসিয়াছিল। এই বর্ব্বর যুগের অত্যাচার এবং স্পৰ্দ্ধা এক সময়ে এত বেশী হইয়াছিল যে রাজা-রাজড়াও ইহাদের সঙ্গে আঁটিয়া উঠিতে পারেন নাই।
পালাটিতে ৫২০ ছাত্র আছে এবং আমি ইহা ১৪ অধ্যায়ে ভাগ করিয়াছি।
শীলাদেবী
শীলাদেবী
(১)
মুণ্ডা
বাড়ী নাই ঘর নাই জঙ্গল্যা মুণ্ডারে ফিরে দেশে দেশে
দৈবেত আনিল তারর ভালা বামুন রাজার দেশেরে
দুষ্মনা জঙ্গল্যা মুণ্ডারে—
মাও নাই বাপ নাই জঙ্গল্যা মুণ্ডারে ফিরে বাড়ী বাড়ী
দৈবেত আনিল তারে ভালা বামুন রাজার বাড়ীরে
দারুণা জঙ্গল্যা মুণ্ডারে—
জঙ্গলেতে জনম মুণ্ডারে জাতিত জঙ্গলিয়া
দরবারে খাড়াইল মুণ্ডা ছেলাম ত জানাইয়ারে
“শুন শুন বামুন রাজারে
শুন শুন বামুন রাজারে কহি যে তোমারে
আমার দুঃখের কথা ভালা
জানাই তোমার দরবাররে
হারে শুন বামুন রাজারে
দীন দুনিয়ার মালিক তুমিরে
আমি পন্থের না ভিখারী
বাড়ী ঘর নাই রাজা গাছতলায় বসতি
শুন শুন বামুন রাজারে
জন্মিয়া না দেখি বাপমায়েরে গর্ভসোদর ভাই
সুতের সেহলা যেমুন ভাস্যা ভাস্যা ফিরিরে
শুন মোর দুষ্কের কথারে
কোন জনে দিয়াছে জনম ভালা কে ধইরাছে পেটে
কড়ার কাহনী[১] দিয়া মোরে কে বিকাইল হাটেরে
শুন শুন বামুন রাজারে
বড় দুষ্কে পইরা আমিরে ভালা
ছাড়লাম তার বাড়ী
সেইদিন হইতে রাজা আমি দেশে দেশে ফিরিরে
শুন শুন বামুন রাজারে
মেঘেতে ভিজিয়া মরি রইদে নাই সে পুড়ি
বিরকতলায়[২] নাই সে ঠাঁই কপাল হইল বৈরীরে
শুন শুন বামুন রাজারে”
বামুন রাজা
“বড় দয়া লাগে তোরে রে জঙ্গলার বাসী
আমার রাজ্যেত থাইক্যা কর ঠাকুরালীরে
শুন শুন জঙ্গল্যা মুণ্ডারে
বাড়ী দিবাম জমিন দিবাম আর দিবাম মাহিনা
রাজ্যের কোটাল হইয়া থাকিবা মোর পুরীরে
শুন শুন জঙ্গলিয়া মুণ্ডারে”
মুণ্ডা
“বাড়ী নাই সে চাই আমি রাজাগো
জমিন নাই সে চাই
তোমার ছিচরণে আমি একটু পাই ঠাঁইরে
তবে মোর জন্নম ভালারে
আমার না চক্ষের জলেরে রাজা নদী নালা ভাসে
দশ বছর ঘুইরা মল্লাম কত কত না দেশেরে
তবে মোর জন্নম ভালারে
পায়ের নফর হইয়া আমি রাজা থাকিমু দুয়ারে
চোর চোট্টায় রাজ্যের কি করিতে পারেরে
শুন শুন বামুন রাজারে
জঙ্গলাতে জনম আমার রে জাতিত জঙ্গলী
বাঘ ভালুকে রাজা ভয় নাই সে করিয়ে
শুন শুন বামুন রাজারে
দুই হাতে ধইরা রাখিরে রাজা জঙ্গলার হাতী
জঙ্গলাতে জন্নম আমার জঙ্গলীর জাতিরে
শুন শুন বামুন রাজারে
লোহার শাবল মোররে হাত দুই খান
এ মোর বুকের পাটা পাত্থর সমানরে
শুন শুন বামুন রাজারে”
গাবুরালী অঙ্গ দেইখ্যারে রাজার ভয় বাসিল মনে
ধীরে ধীরে কয় কথা জঙ্গল্যার স্থানেরে
“শুন শুন জঙ্গল্যা মুণ্ডারে
কালাদিঘির পাড়েরে কোটালিয়ার খানা
সেইখানে পাতিয়া লহরে আপন বিছানারে
শুন শুন নতুন কটুয়ালরে
ডাইল দিবাম চাইলি দিবাম ভালা রসুই কইরা খাইও
বালাখানা ঘর দিবাম শুইয়া নিদ্রা যাইওরে
শুন শুন নতুন কটুয়ালরে
বারশত কটুয়াল আমাররে করেরে খবরদারী
তা সবায় উপরে তুমি করবা ঠাকুরালীরে
শুন শুন নতুন কটুয়ালরে”
এই কথা শুনিয়া মুণ্ডারে কোন কাম্ না করে
হাজার ছেলাম জানায় (ভালা)
রাজার দরবারেরে
নতুন কটুয়াল হইলামরে (১-৭১)
(২)
কাঞ্চানা সোণার অঙ্গরে যেমুন ঝলমল
একক কন্যা আছে রাজার দশনা বচ্ছরেররে
কাঞ্চা বরণ কন্যারে
পঞ্চ সখী সনে শীলারে রঙ্গে করে খেলি
দেখিতে সুন্দর কন্যা কনক চম্পার কলিরে
কাঞ্চা সোণার বরণরে
হাটু বাইয়া পড়ে কেশরে যে দেখে নয়ানে
আসমানের মেঘ যেমুন লুডায় জামিনেরে
মেঘের বরণ কেশরে
ডালুমের দানা যেনরে দন্ত সারি সারি
চাঁপালিয়া হাসি কন্যা ঠোটে রাখে ধরিরে[৩]
মেঘের বরণ কেশরে
দুই আঁখি দেখি কন্যার পরভাতের তারা
গোলাপী ছুরত কন্যার না যায় পশুয়ারে[৪]
মেঘের বরণ কন্যারে
দুষ্মনে পাগল করেরে পর করে আপনা
দিনে দিনে হইল রাজার দুরন্ত ভাবনারে
মেঘের বরণ কন্যারে
যেদিন ফুটিবে এইরে কদম্বের কলি
ভাবে রাজা যোগ্গি[৫] বর কোন দেশে মিলিরে
চিন্তিত হইল বামুন রাজারে
দেশে দেশে ভাট রাজারে পাঠাইয়া দিল
পান ফুল হাতে লইয়া ভাট না চলিলরে
চিন্তিত হইল বামুন রাজারে
হাসিয়া খেলিয়া কন্যারে খেলার সময় যায়
পঞ্চ সখী সঙ্গে কন্যা রঙ্গেত খেলায়রে
বাহারে সোণার যৈবনরে
আইল যৈবন কালরে মানা নাই সে মানে
কাল নদীতে ডাকে জোয়ার কেউত নাহি জানেরে
আইল সোণার যৈবনরে
খেল খেল কন্যা তুমি লো শিশুতির[৬] খেলা
কালুকে বিয়ানে তুমি পড়িবে একেলারে
কাল যৈবন কন্যাররে
কেউনা দিল খবর তোরে লো কন্যা খেলার সময় যায়
দিনে দিনে দিন কত ঘটবে বিষম দায়রে
কাল যৈবন কন্যাররে
খেলার ঘর ভাইঙ্গা পড়বে লো কন্যা
আইজ বাদে কালি
যখন ফুটিয়া উইঠে মালঞ্চ মুকলীরে
কাল যৈবন কন্যাররে
প্রাণের পরাণ পঞ্চ সখীরে দুষ্মন হইবে
বনের পাখীর মতন যখন শূন্যেতে উড়িবেরে
কাল যৈবন কন্যাররে
“শুন শুন পঞ্চ সখীরে একি হইল দায়
আজ কেন কোকিলার ডাক কঠিন শুনায়রে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
পিঞ্জরার শুক শারীরে কৈছনে গায় গান
বুকের ভিতর থাক্যা কাপ্যা উঠে পরাণরে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
কি হইল কি হইল আমার রে সখী বুঝিতে না পারি
ফাপ্লা[৭] বেদনে আমার বুক হইল ভারীরে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
নিলাজ অঙ্গ সে সখী বসন না চায়
কি জানি অজানা গান মন-কোকিলা গায়রে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
কইও কইও পঞ্চ সখীরে কইয়া দিও তোরা
যে অঙ্গ বসনে মোর না পইরাছে ঘিরারে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
বানছি না বান্ধিয়াছি কেশ কইয়া দিও মোরে
পরভাতে জাগাইয়া দিও যদি ঘুমের ঘোরে
লাজে মরি শুন সখীরে
ফুল কেন মৈলান দেখিরে চান কেন মৈলান
আবেতে ঘিরিয়া লইছে জমিন আসমানরে
দেখ দেখ পঞ্চ সখীরে
বাপে মায় জানে যদিরে পড়িবে বিপাকে
আহার নিদের কথা মোর মনে নাহি থাকেরে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দুইনাই[৮] নতুনে গড়িল
কোন বিধি হইল বাদী পরাণ কাইড়া নিলরে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
মুখের আহার নিলরে নিদ্রা নয়নের
সর্ব্বস্ব কাইড়া নিল যা ছিল জীবনেরে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে
মুখ বান্ধা ফুলের কলিরে না ফুইট্ট তোমরা
পরাণ ভাঙ্গাইতে আইবে দারুণ ভোমরারে
শুন শুন ফুলের কলিরে
আইজ যে দিন হইল গতরে না আসিব কাইল
লোকে কহে সোণার যৈবন আমার কাছে গাইলরে
দুঃখের যৈবন কালরে
দুনিয়া দুষ্মন মোররে বিধি প্রতিবাদী
মনে লয় নিরালে বসি আনছলেতে কান্দিরে
শুন শুন পঞ্চ সখীরে”
ন কাইন্দ ন কাইন্দ কন্যা লো চিত্ত কর দর
আসিবে মালঞ্চে তোমার মন মধুকররে
শুন শুন রাজবালারে
এই বসন খুলিয়া কন্যা লো নয়ালী পইরারে
আভের গায় চাঁন্দের কিরণ তেমুন শোভা পাবেরে
শুন শুন রাজবালারে
এহিত কেশের বাঁধন কন্যা লো যতনে খুলিয়া
নতুন নবেলা বন্ধু দিবেক বান্ধিয়ারে
শুন শুন রাজবালারে
এহিত আঁখির কাজল কন্যা লো যতনে মুছিয়া
নতুন নবেলা বন্ধু দিবেক আঁকিয়ারে
শুন শুন রাজার বালারে
এহিত কানের ফুলরে যতনে খুলিয়া
নতুন মালঞ্চ ফুল দিব সে গাঁথিয়ারে
শুন শুন রাজবালারে
এহিত নাকের বেশর কন্যা লো যতনে খুলিয়া
ফুলের বেশর কন্যা দিবে সে গাঁথিয়ারে
শুন শুন রাজার বালারে
পুরুষ পরশমণি লো পরশে যে জনা
সঙ্গ গুণে রঙ্গ ফলে মাট্টি হয় সোণারে
শুন শুন রাজার বালারে” (১-১০৫)
(৩)
এক দুই তিন করিতে পাঁচ গুজারী যায়।
দরবারে আসিয়া মুণ্ডা ছেলাম জানায়॥
“শুন শুন বামুন রাজা হায় কহি যে তোমারে।
পাউনী[৯] মাহিনা আমার দেও ত চুকাইয়ারে॥
পাঁচ বচ্ছর খাটিলাম আমি তোমার পুরীতে।
এই স্থান ছাড়িয়া যাইবাম আমি তিরপুরার সহরে॥”
“শুন শুন মুণ্ডা আরে কহি যে তোমারে।
তোমারে লইয়া চল যাইবাম রাজত্বির ভাণ্ডারে॥
আপন হাতে লহ ধন বাছিয়া গুছিয়া।
ভাণ্ডারের দুয়ার আমি দিলাম ত খুলিয়া॥”
মুণ্ডা
“ধনের কাঙ্গাল নহিরে রাজা বুদ্ধি কর স্থির।
সাবধানে শুন কথা ভালা না হইও অস্থির॥
ধনের ত নহিরে কাঙ্গাল শুন মন দিয়া।
বিদায় কালে এক ধন যাইব চাহিয়া॥
দিবা কিনা দিবারে রাজা সে ধন আমারে।
শুন শুন ধনের কথা কহি যে তোমারে॥
ও রাজা তোমার ভাণ্ডারে ওগো রাজা যত ধন আছে।
সকল ত ধূলা বালি রাজা সে ধনের কাছে॥
যুব্বামান[১০] কন্যা তোমার রাজা নাইসে দিয়াছ বিয়া।
আমার পরাণ রাখত রাজা সেই ধন দিয়া॥
মুরুই(?) মাইনা কিছু রাজা নাই সে চাহি আমি।
এই ধন দেহত দান লইয়া যাই আমি॥
পাঁচ বছর খাটুলাম খাটুনিরে যে ধনের আশায়।
সেহি ধন কর দান কহি যে তোমায়॥”
এই কথা শুনিয়া রাজা জ্বলন্ত আগুনি যে হইল।
যতেক কোটালে মুণ্ডারে ভালা বান্ধিতে বলিল॥
কেউ-বা মারে কিলরে চাপ্পড় দুহাতিয়া বাড়ি।
কেউ-বা কহে দুষ্মনেরে আগুন দিয়া পুড়ি॥
হায় ভালা দেউড়ি থানা ঘরে সবে লহেত টানিয়া।
কেউ বলে ‘রাজার কন্যায় আয় দিবাম বিয়া’॥
জহ্লাদ ধাইয়া আইল শির লইবারে।
ভয় নাই সে পাইল মুণ্ডা ডর নাই সে করে॥
রাত্রি নিশা কালে মুণ্ডা ছিকল ভাঙ্গিয়া।
গেল ত জঙ্গল্যা মুণ্ডা জঙ্গলে পলাইয়া॥ (১-৩৬)
(8)
হায় ভালা এক বচ্ছর দুই বচ্ছর ও ভালা
তিন বচ্ছর যায়।
বনে ত থাকিয়া মুণ্ডা কোন্ কাম করে—
বনে ত থাকিয়া মুণ্ডা কোন্ কাম করিল।
জঙ্গলীর দল লইয়া রসুই পাকাইল॥
“শুন শুন জঙ্গলীর জাতি কহি যে তোমরারে।
আইজ রাত্রে যাইবাম মোরা বামুন রাজার ঘরে॥
ধন দৌলতের রাজার নাই সীমা পরিসীমা।
একদিন মারিলে পাইব বচ্ছরের দানা॥”
একে ত’ জঙ্গল্যার জাতি হায় ভালা ক্ষুধায় কাতর।
ধনের কথা শুইন্যা সবে হইল পাগল॥
রাত্র নিশা কালে মুণ্ডা কোন্ কাম করিল।
জঙ্গলিয়া দল লইয়া মেলা যে করিল॥
ধরিল কামুলীর বেশ হাতে দাও কাঁচি।
বোচকা বাঁধিয়া লইল যতেক সামগ্রী॥
বাছিয়া লইল সঙ্গে ত ভালা তীর ধনুকখানি।
লুকাইয়া লইল ভালা কেহ ত না জানি॥
সবে বলে কামুলারা কাম করিতে যায়।
যার যার কাম আছে ডাকিয়া জিগায়॥
মুণ্ডা বলে এই দেশে কাম করা হইল দায়।
এই দেশের মানুষ যত বেগার খাটায়॥
কাম করাইয়া দেখ পয়সা নাই সে মিলে।
এই দেশ ছাড়িয়া যাইবাম বামুন রাজার দেশে॥
হায় ভালা এক দুই তিন করি তার তিনমাস পর।
অস্তে ব্যস্তে যায়গো মুণ্ডা বামুন রাজার ঘর॥
দুষ্টবুদ্ধি মুণ্ডা তবে রইল পলাইয়া।
কামুলা গণেরে দিল রাজ্যে পাঠাইয়া॥
ভাব বুঝিয়া দুষ্মন মুণ্ডা হায় ভালা কোন কাম সে করে।
নিশি রাইতে পড়লো গিয়া বামুন রাজার পুরে॥
ভেরংগের[১১] চাকে যেমন পুমুকি[১২] পড়িল।
যত যত পাইক পহরী তুরন্তে জাগিল॥
বাছা বাছা তীর মারে জঙ্গলা দুর্জ্জনে।
বামুন রাজার লোক লস্কর পড়িল নিদানে॥
তীর লইতে তীরন্দাজ রে ভালা যায় জুন্নত ঘরে।
জঙ্গলীর তীর খাইয়া পন্থে পইড়া মরে॥
আগুন লাগাইল মুণ্ডা বামুন রাজার বাড়ি।
আগুন ত নিবাইতে গেল যতেক পহরী॥
সুযোগ পাইয়া মুণ্ডা ভাণ্ডার লুটিল।
অন্দর মোহলেতে তবে কুঁদিয়া[১৩] চলিল॥
দেখে শুন্য পইরা আছে মহলে কেউ নাই।
দেশ ছাইড়া বামুন রাজা হায় বৈদেশী হইল।
পরগনার রাজার কাছে আশ্রা যে চাহিল॥ (১-৮২)
(৫)
বামুন রাজা
“শুন শুন পরগনার রাজা ওগো কহি যে তোমারে।
ভিক্ষা করিতে আইলাম আমি তোমার নগরে॥
দৈবে ত রাজত্ত্বি নিল ঝুলি দিলক হাতে।
বিনা মেঘে ঠাণ্ডা বজ্জর আমার মারিলেক মাথে॥
সঙ্গে আছে এক কন্যা নাহি দিলাম বিয়া।
বিপদ কালে ত তারে আমি কোথায় যাই থইয়া॥”
এই কথা শুইন্যা রাজা কোন কাম করিল।
নতুন একখান রাজ্যপুরী বানাইয়া সে দিল॥
বিদেশী রাজা
“শুন শুন বামুন রাজা কহি যে তোমারে।
কিছুকাল থাক তুমি আমার নগরে॥
কিছুকাল থাক তুমি ভালা চিত্তে ক্ষমা দিয়া।
যাহাব্য[১৪] জঙ্গলার মুণ্ডায় ভালা না আনি ধরিয়া॥”
রাজার পুরীতে দেখ ছয় মাস যায়।
এদিকে হইল কিবা শুন সমুদায়॥
সুন্দর যুবা রাজার বেটা ভালা দেখিতে সুন্দর।
এইমত নাগর নাহি দেখি সে ভালা পৃথিমী ভিতর॥
সোণার হরিণ যেমুন ভালা আসম্কা[১৫] তার আঁখি।
এমন সুন্দর রূপ জগতে না দেখি॥
যৈবনেতে যুব্বামান গায়ে গাবুরালী।
রাজ্যের উপরে দেখ করে ঠাকুরালী॥
এমন যৈবন কালে গো না কইরাছে বিয়া।
দেখিয়া শুনিয়া বাপে করাইব বিয়া॥ (১-২২)
(৬)
অস্তেব্যস্তে ফুলের সাজি কন্যা তুলিয়া লইল।
নয়াবাগে ফুল তুলিতে গমন করিল॥
বায়ে উড়ে অঞ্চলখানি গায়ে ফুটে কাঁটা।
আজিকে তুলিতে ফুল ঘটলো বিষম লেঠা॥
শুন শুন কোকিলারে কহি যে তোমারে।
কি দাগা দিহ লো জানি দুষ্মন কোকিল তোরে॥
“শুন শুন কন্যা হায় কন্যা কহি যে তোমারে।
কি লাগিয়া তুল ফুল কহ লো আমারে॥
নিত্য নিত্য তুল ফুল গো কন্যা কারে পূজা কর।
অবিয়াত কন্যা তুমি কিবা মাগ বর॥
দেখিয়া তোমার রূপ কন্যা হইয়াছি পাগেলা।
এই ফুল গাঁথিয়া কারে পইরাইবা মালা॥
রাজার কুমারী কন্যা শুন দিয়া মন।
কোন্ জনে বিলাইবা কন্যা এমন যৈবন॥
হেলা নাইসে কর কথা শুন মন দিয়া।
বাপেরে কহিয়া কন্যা তোমায় করবাম বিয়া॥”
শীলাদেবী
“শুন শুন সুন্দর নাগর কহি যে তোমারে।
বসন ছাড়িয়া দেও লজ্জায় যাই যে মরে॥
আছিলাম রাজার ঝি গো হইলাম ভিখারী।
দারুণ পেটের দায়ে আইলাম তোমার বাড়ী॥
দারুণ পেটের দায়ে দেশে দেশে ঘুরি।
চোখে নাইসে নিদ রে কুমার ছয়মাস যায়।
কান্দিয়া আমার বাপে রজনী পোহায়॥
সোণার রাজত্ত্বি তোমার রাখিছ বান্ধিয়া[১৬]
ভিক্ষু বাউনের কন্যা কেন করিবা বিয়া॥”
রাজকুমার
“শুন শুন কন্যা আলো কন্যা কহি যে তোমারে।
আর নাইসে দিও লো দাগা আমার অন্তরে॥
লোকে বলে পুরুষ জাতি কঠিন অন্তরা।
আমি বলি নারীর মন পাষাণ দিয়ে গড়া॥
কেতকী কৈরবী চাম্পা আছে যত ফুল।
দেখিতে শুনিতে তোমার নাইসে সমতুল॥
ধরিতে ছুইতেরে নারি পথে যদি বিন্ধে।
এহিত পশিল মনে ভার নানা সন্দে॥
এহিত কোমলা অঙ্গে লো কন্যা তোমার লাগে যদি হানা।
কতদিন ফিইরা যাই মনে করি মানা॥
মনেরে বুঝাইয়া রাখিলো কন্যা শিকলে বান্ধিয়া
আজি না পারিলাম কন্যা কইয়া বুঝাইয়া॥
চিত্তে ক্ষমা দেওগো কন্যা রাগ নাই সে মনে।
না কইয়া না বইলা আইলাম তোমার বাগানে॥
যেদিন হইতে কন্যা লো আইলা আমার পুরী।
যেদিন হেইরাছি কন্যা তোমার সুন্দর মুখখানি।
সেদিন হইতে হিয়া আমার হইল উন্মাদিনী॥
আজি রাত্রে যাইওগো কন্যা আমার মন্দিরে।
মনের যতেক লো কথা কহিব তোমারে॥
না ধরিব না ছুঁইব কন্যা এহি যাইসে কইয়া।
কেবল দেখিব রূপ দূরে ত খাড়াইয়া॥”
শীলাদেবী
“চিত্তে ক্ষেমা দেহরে কুমার শুন মন দিয়া।
মাও বাপে সুন্দর নারী করাইব বিয়া॥”
রাজকুমার
কুমার বলে, “শুনগো কন্যা যার মনে যা চায়।
পাইলে হাজার দান ভিক্ষা না তার যায়॥
ধন দৌলত রাজত্ত্বি তোমার দুই পায়ের না ধূলি।
তোমার দুয়ারে খাড়া হস্তে ভিক্ষার ঝুলি॥
ভিক্ষা যদি দেও লো কন্যা হস্ত পাত্যা লইব।
রাজত্ত্বি ছাইড়া না আমি বনবাসে যাইব॥
তোমায় যদি পাইগো কন্যা আর কারে না চাই।
এই ভিক্ষা ছাড়া কন্যা অন্য আশা নাই॥
শীলাদেবী
“শুন শুন কুমার ওহে গো কুমার কহি যে তোমারে।
বাপের আছে দারুণ পণ কহি যে তোমারে॥
আমার আছে ব্রত না পূজা মনে মনে পূজি।
পুষ্প তুলিতে আইলাম হাতে লইয়া সাজি॥
আজিকার ব্রত পূজা কুমার বিফল ত গেল।
বাপে ত কইরাছে পণ কুমার রাজ্য হারাইয়া।
যে জন আনিতে পারে মুণ্ডারে বান্ধিয়া॥
তাহার কাছেতে বাপে কন্যা দিব বিয়া।
হাড়ী চণ্ডাল নাইসে বিচার দুষ্মনের লাগিয়া॥”
রাজকুমার
“শুন শুন সুন্দর কন্যা আলো কহি যে তোমারে।
কালুকা যাইবাম রণে কহিয়া বাপেরে।
মরি কিবান বাঁচি রণে না আইসি ফিরিয়া।
দুষ্মন মুণ্ডারে আনবাম গলে দড়ি দিয়া॥
আজির লাগি যাও গো কন্যা আপন মন্দিরে।
কালুকা বিয়ানে আমি যাইবাম রণে॥”
শীলাদেবী (নেপথ্যে)
“কঠিন পরাগ মোররে কুমার কি করিলাম কাম।
কেন বা লইলাম আমি দুষ্মমনের নাম॥
রাজত্ত্বে দৌলতে মোর কোন কার্য্য নাই।
আমার লাগিয়া রণে তোমারে পাঠাই॥
নিজের কাণা কড়ি মোর ঘোর সায়রের তলে।
তাহারে তুলিতে কেন পাঠাই রে তোরে॥
বড়ই দারুণ মুণ্ডা কি জানি কি কি হয়।
রণে ত পাঠাইয়া তোমায় না হইব নির্ভয়॥”
রাজকুমার
“না কাইন্দ না কাইন্দ লো কন্যা না করিও ভয়।
জঙ্গল্যা মুণ্ডারে আমি করিবাম জয়॥
রণ জিনি ঘরে তোমার ফিরিয়া আসিব
হাতে গলে মুণ্ডারে যে বাঁধিয়া আনিব॥”
এই কথা শুন্যা কন্যা আরে হরষিত মন।
নারীর কোমল অঙ্গ শানে বান্ধা হিয়া।
অন্তরে হইল খুশী কন্যা যায় ত চলিয়া॥
দারুণ জঙ্গল্যার রণে পাঠাইয়া কুমারে।
কি মতে থাকিব কন্যা আপন মন্দিরে॥ (১-৮৮)
(৭)
পরভাতে উঠিয়া কুমার কোন্ কাম করিল।
বাপের না আগে কুমার মেলানি মাগিল।
বামুন রাজার আগে ত কুমার মেলানি মাগিল॥
যাইতে না পারে আর কুমার কন্যার মন্দিরে।
দূর হইতে বিদায় মাগে দুটি আঁখি ঝরে॥
“থাক থাক কন্যা গো আমার বাপের বাড়ী।
যাবৎ মুণ্ডারে লইয়া আমি নাই সে ফিরি॥
থাক থাক কন্যা লো আশার পন্থে চাইয়া।
রণ জিত্যা যাবৎ আমি না আইসি ফিরিয়া॥
ভাল কইরা বান্ধিবাম কন্যা জলটুঙ্গির[১৭] ঘর।
ভাল কইরা বানবাম কন্যা কামটুঙ্গির[১৮] ঘর॥
শীতল পুষ্পেত কন্যা শয্যা বানাইব।
মন সুখে দুই জনাতে শুইয়া নিদ্র। যাইব॥”
রণে ত চলিল কুমার হায় ভালা সঙ্গে ত লস্কর।
মার মার কইরা চলে বামুন রাজার সর[১৯]॥
তীরন্দাজ ঘোর সুয়ারী চলে পালে পাল।
ঘোড়ার দাপটে কাপে আসমান আর পাতাল॥
মঞ্চের না ধূলা বালু হায় ভালা আসমানেতে উড়ে।
নদী নালা এড়াইয়া যায় বামুন রাজার সরে॥ (১-১৯)
(৮)
দিশা— বন্ধু আজ তোমারে স্বপন দেখি রাইতে।
লোকলাজে সময় পাই না কইতে।
আমি যে অবুলা নারী মনের কথা কইতে নারি
চক্ষের জলে বুক ভেসে যায় বালিস ভাসে শুতে।
সময় পাই না কইতে॥
মনের মানুষ পূজবাম বইলা গাঁথলাম বনমালা।
কাল বিধাতা বাদী হইল আমার ছুটলো বিষম জ্বালা॥
(গো সখি) সময় পাই না......
(আমার) চন্দন বনে ফুল ফুটিল সখি গন্ধের সীমা নাই।
কোন দৈবেরে দিল আগুন আমার সকল পুইড়া ছাই॥
(গো সখি) সময় পাই না.......
একদিন পথের দেখা গো আমি পাশুরিতে না পারি।
মনেছিল প্রাণবন্ধুরে আমি কাজল কইরা পরি॥
সময় পাই না.......
ফুল বাগানে হইল দেখা পুষ্পের ভ্রমরা।
সুন্দর নাগর পুরুষ নবীন কিশরা॥
(গো সখি) সময় পাই না.......
দেখিতে অদেখা হইল দিন দুই চারি।
মনেছিল মন পাখীরে রাখি হৃদ্ পিঞ্জিরিয়ায় ভরি॥
(গো সখি) সময় পাই না.........
বন্ধু যদি হইত আমার কনক চাম্পার ফুল।
সোণায় বান্ধাইয়া তারে কাণে পরতাম ফুল॥
(রে সখি) সময় পাই না.......
বন্ধু যদি হইত আমার পইরন নীলাম্বরী।
সর্ব্বাঙ্গ ঘুরিয়া পরতাম নাইসে দিতাম ছাড়ি॥
(গো সখি) সময় পাই না.......
বন্ধু যদি হইতরে ভালা আমার মাথার চুল।
ভাল কইরা বানতাম খোপা দিয়া চাম্পা ফুল॥
(গো সখি) সময় পাই না......
আমার বন্ধু হইত যদি দুই নয়নের তারা।
তিলদণ্ড অভাগীরে না হইত ছাড়া॥
(রে সখি) সময় পাই না.......
দেহের পরাণী ভালা বন্ধু হইত আমার।
অভাগীরে ছাইরা বন্ধু না যাইত স্থান দূর॥
(লো সখি) সময় পাই না.......
এক অঙ্গ কইরা যদি বিধি গড়িত তাহারে।
সঙ্গে কইরা লইয়া যাইত এহি অভাগীরে॥
(গো সখি) সময় পাই না ........
কি জানি কি হয় রণে কে কহিতে পারে।
রাজ্য ধনে কোন্বা কার্য্য আমার বন্ধু যদি না ফিরে॥
(গো সখি) সময় পাই না.........
(৯)
তিন মাসের পন্থ ভালা সবে তিন দিনে গেল।
বামুন রাজার দেশে দাখিল হইল॥
মার মার কইরা যত ঘোড়ার সোয়ার।
বাড়ি ঘর ভাইঙ্গা সব কইল একাকার॥
তীর বিন্ধিয়া বুকে পড়ে যত মুণ্ডার দল।
তবে দুষ্মন মুণ্ডা হইল আগুয়ান।
জঙ্গলী হাতীর মতন সেই পালোয়ান॥
মুণ্ডারে দেখিয়া সবে করে মার মার।
বাছাবাছা তীর মারে ভালা মুণ্ডার উপর
তীর খাইয়া মুণ্ডা হইল পরাণে কাতর॥
তীর খাইয়া জঙ্গল্যা মুণ্ডা গেল ত পলাইয়া।
রণজয় কইরা কুমার গেল দেশে ত ফিরিয়া॥
ঘন ঘন জয়ডঙ্কা পুরীত উঠে ধ্বনি।
অঞ্চল শয্যা ছাইড়া উঠে কন্যা যেমুন পাগলিনী॥ (১-১৪)
পরগনার রাজার সঙ্গে বামুন রাজার কথা হয়। বামুন রাজা কন্যাসহ নিজরাজ্যে গমন করেন। রাজপুত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ প্রস্তাব হয়। বিবাহের দিন বিবাহ-বাসরে মুণ্ডা আবার দলবল-সহ বামুন রাজার পুরী আক্রমণ করে।
(১০)
চাম্পা মালতীর মালা গাথে যত সখী।
বিয়ার গান গায় দেখ ডালে বইসা পাখী॥
উজান নদী ভাট্যাল বায় খাড়া সুতে চলে।
জয়াদি জোকার পড়ে বামুন রাজার পুরে॥
আমলকী গাইষ্ট খিলা হায় ভালা বাটুনি বাটিল।
বারতীর্থের জল দিয়া ভালা ছান না করাইল॥
নিছিয়া মুছিয়া তুলে মায় চান্দ মুখখানি।
কপালে সিন্দুরের ফোঁটা রূপের বাখানি॥
সোণার তার বাজুয়ারে যতনে পইরাইল।
মেঘডুম্বুর শাড়ী খানা যতনে পইরাইল॥
কাণে দিল কন্ন ফুল নয়ানে কাজল।
মেন্দিতে আঁকিয়া দিল সে কন্যার রাঙ্গা পদতল॥
সোণার ঘুঙ্ঘুর দেখ কোমরে পইরাইল।
বিবিধ সাজুয়া কড়ি সাজাইয়া লইল॥
কলাগাছ সারি না সারি ঘিয়ের বাতি জ্বলে।
নানাজাতি বাজুনিয়া ঢোলের বাদ্যি বাজে॥
উত্তর হইতে আসে একত বাজুনিয়া।
জয়ডঙ্কা ফুঁকের বাঁশী বিন্না মুরী লিয়া[২০]॥
পুরব হইতে আসে পূবের বাজ্জনী।
খড়কর তাগী সঙ্গি জয়ঢাকের ধ্বনি॥
পশ্চিম হইতে আইল চিনি বা না চিনি।
বহুত লস্করা সঙ্গে একত বাজুনি॥
শুন শুন বামুন রাজা কহি যে তোমারে।
বাদ্য বাজাইতে আইলাম তোমার না পুরে॥
হায় ভালা রাত্রি নিশাকালে গো বিয়া ঢোলে মাইল তালি।
বামুন রাজার দেশে ভালা উঠ্লো উত্তরুলি॥
হেন কালেতে দুষ্মন মুণ্ডা কোন্ কাম করে।
ছাড়িয়া বাজুনিয়ার সাজ ধনু লইল হাতে॥
বাচ্ছ্যা[২১] মারে বিষের তীর বামুন রাজার লস্করে।
কাত্যালীর কলাগাছ যেমন উপড়াইয়া পড়ে॥
বিয়ার সাজ থুইয়া ভালা কুমার কোন্ কাম করিল।
রণের না সাজ কুমার জল্তি[২২] পড়িল॥
আনিল রণের ঘোড়া কুমার হইল সোয়ার।
মুণ্ডার উপরে পড়ে করি মার মার॥ (১-৩৪)
(১১)
“হায় বিকালির গাঁথা মালা হায় না হইল বাসি।
মাথার না ফুলের মডুক[২৩] না হইল বাসি॥
আর না বাজাইও ঢোল বিয়ার বাজুনিয়া।
কপাল পুড়িল মোর খেড়ের আগুন দিয়া।
আর না বাজাইও তোরা আমার বিয়ার বাঁশী।
না ফুটিতে বিয়ার ফুল কলির মুখ বাসি॥
না উঠিতে চান্দ মোর আন্ধারে ডুবিল।
আষাঢ়ে আশার নদী শুকাইয়া গেল॥
মিছা আশায় বান্ধিলাম রে সোণার বাড়ি ঘর।
কোন দৈবে আগুন দিয়া পুইড়া করলো ছাই॥
মনের কথা যত ইতি রহিল রে মনে।
কি কার্য্য করিল হায় দারুণ দুষ্মনে॥
পুষ্পের সমান বুকে তীর না মারিল।
দারুণ বিষের তীর পৃষ্ঠে বাহিরিল॥
কিবা ধন লইয়া আমি থাকিবাম ঘরে।
দুরন্ত দুষ্মন মুণ্ডা মারিল আমারে॥
বনের না গাছ গাছালী পশু পক্ষী যত।
মনের বেদনা আমি কহিব বা কত॥
আর না সে হইবে দেখা প্রভুর সঙ্গেতে।
জন্মের মত অভাগীরে রাইখ্যা গেলা পথে॥
শুনরে গরল বিষ আমার মাথা খাও।
যে পথে গিয়াছে বন্ধু সে পথ মোরে না দেখাও॥
সে পথ আন্ধাইর যদি মোরে লইয়া চল।
দাগা দিয়া পরাণবন্ধু কৈবা ছাইরা গেল॥
সোণার পালঙ্ক আর ফুলের বিছানা।
এই হইতে শেষ আজ দিন দুনিয়ার দানা॥
বিদায় দেও মাও বাপগো বিদায় দেও মোরে।
আর না যাইবাম আমি পরগনা সহরে॥
আর না দেখিবাম আমি তোমাদের মুখ।
আর না দেখিবাম চাইয়া পরগনার লোক॥
নিবিল ঘরের বাতি আচমকা বাতাসে।
নগর কাণা কালা মেঘরে উড়িল আকাশে॥
চান্দ খাইল তারা না খাইল আসমান জমিন।
না থাকিব পাপ সংসারে দারুণ মুণ্ডার চিন॥
শুনরে দারুণ বিষ মোর মাথা খাও।
যে পন্থে গিয়াছে বন্ধু সে পথ দেখাও॥” (১-৩৬)
(১২)
তবে ত বামুন রাজা হায় রাজা কোন কাম করিল।
তিরপুরার রাজার কাছে ভালা শরণ লইল॥
তিরপুরার লোক লস্কর চলিল ধাইয়া।
তিরন্দাজ গোলন্দাজ সঙ্গেত লইয়া॥
হাতিয়ার বান্ধিলেক তারা পিষ্ঠের উপর।
লম্প দিয়া উঠে ভালা ঘোড়ার উপর॥
পরন বাহনে ছুটে ঘোড়া ভালা বামুন রাজার দেশে।
তিন মাসের পথ দেখ যায় একদিনে॥
দেখিয়া দুর্জ্জন মুণ্ডা পরমাদ গণিল।
জঙ্গলীর দল লইয়া আগ বাড়ন্ত[২৪] দিল॥
একেত জঙ্গলীর দল লড়াই নাই সে জানে।
ডাকাইতি দাগাবাজি এই সে ভালা জানে॥
শাউনিয়া ধারা যেমন নালাঙ্গা ছুটিল।
মুণ্ডার লস্কর যত বিছাইয়া পড়িল॥
দড়িবেড় দিয়া সবে মুণ্ডারে ধরিয়া।
তিরপুরার সরে দেখ দাখিল করলো নিয়া॥
রাজার হুকুমে মুণ্ডারে সবে ময়দানে খাড়াইল।
তিন তোপ মারিয়া তারে শুইনে উড়াইল (১-১৮)
- ↑ কাহনী=মূল্য।
- ↑ বিরকতল=বৃক্ষতলা।
- ↑ চাপালিয়া......ধরিরে=তাহার অধরে চাঁপাফুলের হাসি বন্দী হইয়া আছে
- ↑ পশুয়ারে=পাশরা, তোলা।
- ↑ যোগ্গি=যোগ্য।
- ↑ শিশুতি=শৈশব।
- ↑ ফাপ্লা=মিছামিছি।
- ↑ দুইনাই=দুনিয়া, জগৎ।
- ↑ পাউনী=প্রাপ্য
- ↑ যুব্বামান=যুবতী
- ↑ ভেরংগের=মধুমক্ষিকার।
- ↑ পুমুকি=ঢিল (?)।
- ↑ কুঁদিয়া=লাফাইয়া; কুর্দ্দন=লাফানো, ক্রীড়া-কৌতুক-প্রদর্শন: নর্ত্তন-কুর্দ্দন নাচা-কুঁদা। পূর্ব্ববঙ্গে সর্ব্বদাই বিক্রম-প্রকাশার্থে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়, যখা, “সে তাহাকে কুঁদিয়া মারিতে গেল।”
- ↑ যাহাব্য=যে পর্য্যন্ত, যাহাতক।
- ↑ আসম্কা=আচম্কা, বিস্ময়সূচক চম্কে চাওয়ার ভাববিশিষ্ট।
- ↑ সোণার...... বান্ধিয়া=তোমার গৃহে লক্ষ্মী বান্ধা আছেন। তোমার রাজশ্রীকে তুমি বাঁধিয়া রাখিয়াছ।
- ↑ জলটুঙ্গিয় ঘর=বড় লোকেরা কোন দীঘি বা বৃহৎ পুষ্করিণীর মধ্যে ভিত্তি গাড়িয়া গ্রীষ্মবাসের জন্য জল-গৃহ রচনা করিতেন।
- ↑ কামটুঙ্গির ঘর=আরাম করিবার গৃহ।
- ↑ সর=সহর।
- ↑ বিন্না মুরী লিয়া=বিন্নি (একরূপ খই) এবং মুড়ি লইয়া দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিতে হইবে বলিয়া তাহারা খাদ্য সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল।
- ↑ বাচ্ছ্যা=বাছিয়া।
- ↑ জল্তি=জল্দি, শীঘ্র।
- ↑ মুডুক=মুকুট।
- ↑ আগ বাড়ন্ত=অগ্রসর হইয়া যুদ্ধ করিল।