পৃথিবী/ভূমিকা
গণিত শাস্ত্রের সাহায্য ব্যতীত বিজ্ঞানের অন্তরে প্রবেশ করা অত্যন্ত কঠিন; নানা কারণবশতঃ অঙ্ক শিক্ষাও সকলের পক্ষে ঘটিয়া উঠে না,—বিজ্ঞান এইরূপ কষ্টসাধ্য বসিয়া ইহা বিশ্ববিদ্যালয়েই একরূপ আবদ্ধ। বিজ্ঞানের এই দুরূহ পথ সুগম করিবার জন্য ইয়োরোপ ও আমেরিকা দেশে গণিতের সাহায্য ব্যতীত যেরূপ বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ সকল প্রচার হইতেছে এই পুস্তকখানি সেই প্রেকার গ্রন্থের আদর্শানুসারে রচিত।
পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের মনে প্রধানতঃ যে সকল প্রশ্ন উদিত হইতে পারে, তাহারি মীমাংসা-স্বরূপ, প্রচলিত বিজ্ঞানের উপদেশ অনুযায়ী সাধারণের পাঠোপযোগী কতকগুলি প্রবন্ধ, গত দুই বৎসরের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী-পত্রিকায় ও ভারতীতে প্রকাশিত হয়। সেইগুলি পরিবর্তিত ও পরিবর্দ্ধিত করিয়া এক্ষণে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইল।
প্রধানতঃনর্ম্মাণ লকিয়ার, গডফ্রে নিউকাম ব্যালফোর-ষ্টুয়ার্ট ও ফিগুয়ের গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া ইহা রচিত, অপরাপর যে সকল গ্রন্থ হইতে সাহায্য পাওয়া গিয়াছে তাহা যথা স্থানে স্বীকৃত হইয়াছে।
বাঙ্গলায় বৈজ্ঞানিক পুস্তক সঙ্কলন সম্বন্ধে প্রধান অসুবিধা পারিভাষিক শব্দের অভাব। এ পুস্তকে পূর্ব্ববর্ত্তী লেখক মহাশয়দিগের ব্যবহৃত শব্দ প্রায়ই গ্রহণ করা হইয়াছে—তবে দু একটি প্রচলিত শব্দের স্থানে অন্য শব্দও ব্যবহৃত হইয়াছে। সচরাচর অগ্ন্যুৎগারী পর্ব্বত সকলকে আগ্নেয় গিরি বলিয়া উল্লিখিত হয় কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যের জ্বালামুখী শব্দে যখন ঐ অর্থটি আরো সুস্পষ্ট হয় তখন সে কথাটিও বা বঙ্গভাষায় চলিবে না কেন? ঐ উৎকৃষ্ট কথাটি বঙ্গভাষায় প্রবেশার্থী করিয়া এ পুস্তকে ব্যবহার করিতে সাহসী হইয়াছি।[১] যে যে স্থানে পারিভাষিক শব্দের অপ্রতুল হইয়াছে সেই সেই স্থানে নূতন শব্দ রচনা করিতেও কুণ্ঠিত হই নাই। সকল নূতন রচিত কথাগুলিই যে গৃহীত হইবে তাহা প্রত্যাশা করি না। জীব জগতেও যেমন শব্দ জগতেও তেমনি—যাহা যোগ্য তাহাই জীবিত থাকিবে। যদি বিজ্ঞানের পারিভাষিক শব্দ গুলি, সকল ভাষায় একই রাখা যায়—তাহাতে ক্ষতি নাই, বরং ভাষার উন্নতি হয় দেখিয়া যে স্থানে মনোমত প্রতি-শব্দ না পাওয়া গিয়াছে সে স্থানে ইংরাজি মূল শব্দই রাখা হইয়াছে।
সচরাচর ইংরাজি জ্যোতিষিক পাঠ্য পুস্তকে বাস্তবিক পৃথিবী সচল এবং সূর্য্য স্থির বলিয়া দিয়া তাহার পর পৃথিবীকে স্থির অনুমান করিয়া, সূর্যের দৃশ্যতঃ গতি আলোচিত হইয়া থাকে কিন্তু তাহাতে পৃথিবীর গতিবিধি যথার্থরূপ বুঝিবার পক্ষে ধাধা লাগিতে পারে, সে জন্য এখানে পৃথিবীর বাস্তব গতি অবলম্বন করিয়াই অপর সকল বিষয় আলোচিত হইয়াছে।
অঙ্ক বিদ্যার সাহায্য ছাড়িয়া কোন ইংরাজি গ্রন্থে ক্রান্তিপাতের গতি বুঝান হইয়াছে এরূপ দেখিতে পাই নাই এ পুস্তকে সে বিষয়ে যত্ন করা হইয়াছে, কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারিনা।
ডেরাড়ুনের ভারতবর্ষীয় সরবে অফিসের সুযোগ্য গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতিষী শ্রীযুক্ত বাবু কালীমোহন ঘোষ মহাশয় এই পুস্তকের প্রথম দুই অধ্যায়ের প্রুফ সংশোধন করিয়া যে সাহায্য করিয়াছেন সে নিমিত্ত এইস্থলে তাহার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি।
উপক্রমণিকাতে আমাদের দেশের প্রাচীন জ্যোভিষিক উন্নতি সম্বন্ধে যে কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া হইয়াছে তাহার অধিকাংশ শ্লোকই আমাদিগের অনুরোধে পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত কালীবর বেদান্তবাগীশ মহাশয় অনুসন্ধান করিয়া দিয়াছেন, তাঁহার সেই পরিশ্রমের নিমিত্ত তাঁহার নিকট উপকৃত রহিলাম।
অগ্রে মূল গ্রন্থখানি পড়িয়া পরে উপক্রমণিকাটি পড়িলে ভাল হয়, কারণ মূল গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়ের সহিত উপক্রমণিকাটি এমন বিশেষ রূপে জড়িত যে অগ্রে উপক্রমণিকা পড়িলে তাহার স্থানের স্থানের যথার্থ অর্থ সহজে বোধগম্য হইতে পারে।
- ↑ বোধ হয় এ কথাটি ব্যবহার করা অসঙ্গত হয় নাই, আশ্বিন মাসের ভারতীতে পৃথিবীর পরিণাম শীর্ষক প্রবন্ধে প্রথম ইহা ব্যবহার করা হয়। তাহার পর মাসে দেখিলাম চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত লেখক শ্রীযুক্ত কৈলাসচন্দ্র সিংহও ঐ অর্থে উহা ব্যবহার করিয়াছেন।