প্রবাসী/১৩৩৫/মাঘ/ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস


ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস

 ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতে শেষ পর্য্যন্ত বাঙ্গলা ভাষা ও সাহিত্য কোন কোন মহাত্মার চেষ্টায় কিরূপ দ্রুততর উন্নতিমার্গে চলিয়াছিল তাহা ঐ একশত বৎসরের মোটামুটী সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে।

 ১৮০২ খৃষ্টাব্দে রামরাম বসুর “লিপিমালা” এবং তাহার কিছু পরেই তৎকৃত ‘রাজাবলী’ প্রকাশিত হয়। ইহার পূর্ব্বে ইনি “প্রতাপাদিত্যচরিত” নামক একখানি পুস্তক লিখিয়াছিলেন। এই তিনখানাই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম গদ্য-সাহিত্য। পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “প্রবোধচন্দ্রিকা” ইহার পূর্ব্বে রচিত হয়। “তোতা ইতিহাস” তাহারও পূর্ব্বে। সুতরাং রামরাম বসুই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম গদ্য-সাহিত্য-লেখক। তাঁহার “লিপিমালার” ভাষা—“তোমাদের মঙ্গল সমাচার অনেক দিন পাই নাই। তাহাতে ভাবিত আছি। চিরকাল হইল তোমার খুল্লতাত, গঙ্গা পৃথিবীতে আগমন হেতু প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তখন তাহার বিশেষণ প্রাপ্ত হইতে পারেন নাই।” রাজাবলীর ভাষাঃ—“শকাদি পাহাড়ী রাজার অধর্ম্ম ব্যবহার শুনিয়া উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য সসৈন্যে দিল্লীতে আসিয়া শকাদিত্য রাজার সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে যুদ্ধে মারিয়া আপনি দিল্লীতে সম্রাট হইলেন।”

 ১৮০৪ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “বত্রিশ সিংহাসন” রচিত হয়। তাহার ভাষাঃ—“একদিবস রাজা অবন্তীপুরীতে সভামধ্যে দিব্য সিংহাসনে বসিয়াছেন, ইতোমধ্যে এক দরিদ্র পুরুষ আসিয়া রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইল, কথা কিছু কহিল না।”

 উক্ত বিদ্যালঙ্কার মহাশয়ের “প্রবোধচন্দ্রিকার” ভাষা কিন্তু “বত্রিশ সিংহাসনের” মত সরল বা সুখবোধ্য নহে। বিকট সংস্কৃতের অনুকরণে উৎকট ভাষায় লিখিতঃ—“কোকিল কলালাপবাচাল, যে মলয়ানিল, সে উচ্ছলচ্ছীকরাত্যচ্ছ নির্ঝরারমভঃ কণাচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে।”

 তার পর ১৮১১ খৃষ্টাব্দে “কৃষ্ণচন্দ্র চরিত” রচিত হয় এবং লণ্ডনে মুদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হয়। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় ইহার রচয়িতা। কৃষ্ণচন্দ্র চরিতের ভাষা—“পরে নবাব মোহনদাসের বাক্য শ্রবণ করিয়া ভয়যুক্ত হইয়া সাবধানে থাকিয়া মোহনদাসকে পঁচিশ হাজার সৈন্য দিয়া অনেক আশ্বাস করিয়া পলাশীতে প্রেরণ করিলেন।” দীনেশবাবু যে বলিয়াছেন “কৃষ্ণচন্দ্র চরিতের ভাষা খাঁটী বাঙ্গলা, ইহার উপর ইংরাজী গদ্যের কোন ভাব দেখা যায় না” তাহা ঠিক। বোধ হয় “কৃষ্ণচন্দ্র চরিতই” খাঁটী বাঙ্গলা ভাষার প্রথম গদ্য-সাহিত্য। ঠিক এই সময়ে বা কিছু পরে রামজয় তর্কালঙ্কার কর্ত্তৃক “সাংখ্য ভাষ্য”, লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার কর্ত্তৃক “মিতাক্ষরা” ও কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন কর্ত্তৃক “ন্যায়দর্শন” বঙ্গভাষায় লিখিত হয়।

 এই সময়ে কলেজের বাঙ্গলা পাঠ্য ছিল মৃতুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের “পুরুষ পরীক্ষা” “হিতোপদেশ” প্রভৃতি। বিদ্যালঙ্কার, তর্কালঙ্কার প্রভৃতি দেখিয়া পাঠকগণ অবশ্যই বুঝিতে পারিতেছেন যে, সংস্কৃতজ্ঞ টোলের পণ্ডিত ছাড়া অন্য লোক বড় একটা সাহিত্য চর্চ্চা করিত না, তখনকার বাঙ্গলা লিখিতে হইলে রীতিমত সংস্কৃত শিক্ষা করিতে হইত তজ্জন্য তৎকালে ইহা একরূপ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরই একচেটিয়া ছিল, কিন্তু এভাব বেশী দিন থাকিল না, ইহার কিছুদিন পরেই মহাত্মা রামমোহন রায় বঙ্গভাষার উন্নতিসাধনে মনোনিবেশ করেন এবং ঐকান্তিক চেষ্টায় অনেকটা সফলতা লাভ করেন। তাঁহারই অক্লান্ত পরিশ্রমে বাঙ্গলা সাহিত্য নব কলেবর ধারণ করিয়া উন্নতিমার্গে অগ্রসর হইতে থাকে। তাঁহার “পৌত্তলিক ধর্ম্মপ্রণালী,” “বেদান্তের অনুবাদ,” “কঠোপনিষদ,” “পথ্য প্রদান” প্রভৃতি গ্রন্থ তাহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। এই সমস্ত পুস্তকের ভাষা সম্বন্ধে আমার আলোচনা করা বাহুল্য, কারণ রাজা রামমোহনের গ্রন্থ সাহিত্যসেবী মাত্রেরই অধীত। মহাত্মা রামমোহনের পর পাদরী কৃষ্ণমোহন ও ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল বাঙ্গলা ভাষায় কয়েকখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। পাদরী কৃষ্ণ বন্দ্যো “বিদ্যাকল্পদ্রুম” নামে একখানা মাসিক পত্রও প্রচার করেন।

 বড়লাট লর্ড হার্ডিং-এর নামে “বিদ্যাকল্পদ্রুম” উৎসৃষ্ট হইয়াছিল। সেই উৎসর্গপত্রের ভাষা দেখিলেই শত বৎসর পূর্ব্বের মাসিক পত্রের অবস্থা ও ভাষা কতকটা বুঝিতে পারা যাইবেঃ—“গৌড়ীয় ভাষাতে ইউরোপীয় বিদ্যার অনুবাদ যত বাঞ্ছনীয় তত সহজ নহে, অতএব অসাধ্য জ্ঞান করিয়া আমি অনেক দিন পর্য্যন্ত এ চেষ্টাতে বিরত ছিলাম; কিন্তু সম্প্রতি কেবল গবর্ণমেণ্ট সমীপে উৎসাহ পাইয়া উক্ত অনুবাদের প্রতিজ্ঞাতে পুনশ্চ প্রবৃত্ত হইলাম।”

 এই সময়ে উক্ত দেশীয় পাদরীর “ষড়দর্শন সংগ্রহ” গ্রন্থ এবং ডাক্তার রাজেন্দ্রলালের “বিবিধার্থ সংগ্রহ” নামক মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। বিবিধার্থ সংগ্রহের ভাষা—“আমরা পল্লিবাসীজনের প্রতি অমর্ষাম্বিত হইয়া দুর্ব্বল পরামর্শ পক্ষের উল্লেখ করিতেছি; কিন্তু তাহাই যে সর্ব্বত্রেরই রীতি হউক এমন আমাদের অভিসন্ধি নহে।” এই বিবিধার্থ সংগ্রহ ভিন্ন ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল “রহস্য সন্দর্ভ,” “পত্র কৌমুদী,” “শিবাজীর জীবনী,” “মিবারের ইতিহাস” প্রভৃতি অনেক গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন। ইনি, বাঙ্গলা, সংস্কৃত, হিন্দী, পার্সী, ঊর্দ্দূ, ইংরাজী, গ্রীক্, লাটীন, ফরাসী, জার্ম্মান প্রভৃতি বহুবিধ ভাষায় ব্যুৎপন্ন ছিলেন।

 এইরূপে ক্রমশঃ উন্নতিলাভ করিয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বঙ্গসাহিত্য বিশেষ প্রকারে শ্রীসম্পন্ন হইয়াছিল। এই সময়ে পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার বঙ্গভাষার উন্নতিসাধনে সবিশেষ যত্নপর হয়েন। তাঁহার “শিশুশিক্ষা” তিন ভাগ প্রকাশিত হইয়া প্রথম শিক্ষার্থী বাঙ্গালী বালকগণের বিশেষ উপকারে আইসে। মদনমোহন “সর্ব্ব শুভঙ্করী” নাম্নী একখানা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহার রচিত “রসতরঙ্গিণী”, “বাসবদত্তা” প্রভৃতি পদ্যকাব্য তৎকালে বঙ্গ সাহিত্যের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল।

 ইহার পরই গুপ্ত কবির কাল। সে সময় কবিবর ঈশ্বর গুপ্ত বাঙ্গলা সাহিত্যে কিরূপ প্রভাব সম্পন্ন হইয়াছিলেন তাহা বঙ্কিমবাবু প্রভৃতি তাঁহার শিষ্যগণের প্রভাবেই পরিলক্ষিত হইতে পারে। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে গুপ্ত কবির সুপ্রসিদ্ধ সংবাদপত্র “সংবাদ প্রভাকর” প্রকাশিত হয়। এই প্রভাকর হইতেই কবির যশঃপ্রভা চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়ে। ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে “প্রভাকর” বন্ধ হয়। ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে পুনরায় প্রকাশিত হয়। তথন সপ্তাহে তিন দিন “প্রভাকর” প্রকাশিত হইত, পরে ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দ হইতে “প্রভাকর” দৈনিক হইয়া পরে ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে মাসিকে পরিণত হয়। এই প্রভাকরই তখন বিখ্যাত সংবাদপত্র ছিল। প্রায় শিক্ষিত ভদ্রলোকমাত্রেই ইহার গ্রাহক ছিলেন। তার পর উক্ত গুপ্ত কবি “পাষণ্ড পীড়ন” নামক একখানা সংবাদপত্রও বাহির করেন। ইহা নব প্রচলিত ব্রাহ্মধর্ম্মের প্রতিকূলে সনাতন হিন্দুধর্ম্মের স্থিতি-কামনায় কিছুদিন বাগযুদ্ধ করিয়া শেষে নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হয়। তদনন্তর “সাধুরঞ্জন” নামে আর একখানি মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। ইহার প্রকাশকও কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনি বঙ্গ ভাষায় গদ্য ও পদ্যে অনকে গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার নিকট রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম্ম, সাহিত্য কোনও বিষয় বাদ যাইত না। তিনি সকল বিষয়েই লেখনী চালনা করিতেন।

 এক্ষণে আমাদের নির্দ্দিষ্ট পথে আর চারিজন গ্রন্থকারের ও গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিয়া বর্ত্তমান প্রবন্ধের উপসংহার করিব। প্রথম রঘুনন্দন গোস্বামী; ইনি রামচরিত্রাবলম্বনে “রামরসায়ন” নামক অতি সুন্দর একখানি পদ্যগ্রন্থ রচনা করেন। তার পর কৃষ্ণকমল গোস্বামীর স্বপ্নবিলাস, বিচিত্রবিলাস ও রাই উন্মাদিনী গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়া বাঙ্গলা সাহিত্যভাণ্ডারের অঙ্গ পুষ্ট করে। রাধামোহন সেন মহাশয়ও “সঙ্গীত তরঙ্গ” প্রকাশিত করিয়া এই সময় বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন, কাদম্বরীর অনুবাদক পণ্ডিত তারাশঙ্কর তর্করত্ন। তারাশঙ্করের কাদম্বরীর ভাষা দিব্য প্রাঞ্জল ও শ্রুতিসুখকর। তৎকালে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের লিখিত বাঙ্গলা একরূপ অবোধ্যই ছিল। তাহার উদাহরণ প্রবোধচন্দ্রিকা প্রভৃতি। কিন্তু তারাশঙ্কর, কাদম্বরীর অনুবাদে সংস্কৃতমূলক বাঙ্গলা যে কিরূপ সুন্দর করা যাইতে পারে তাহার পথ দেখাইয়াছেন। পরে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই পথানুসরণে বঙ্গভাষাকে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর ও শ্রীসম্পন্ন করেন।

 কাদম্বরীর ভাষাঃ—“… সখে ক্ষণকাল অপেক্ষা কর, আমি তোমার অনুগমন করি। চিরকাল একত্র ছিলাম, এক্ষণে সহায়হীন, বান্ধবহীন হইয়া কিরূপে এই দেহভার বহন করি। কি আশ্চর্য্য! আজন্ম পরিচিত ব্যক্তিকেও অপরিচিতের ন্যায় অদৃষ্টপূর্ব্বের ন্যায়, পরিত্যাগ করিয়া গেলে?” উক্ত তর্করত্ন মহাশয় “রাসেলাস” নামক একখানি ইংরাজী গ্রন্থের অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করেন। তাহার ভাষাঃ—“বৃদ্ধ এইরূপ আহ্বানে উৎসাহিত হইয়া রাজকুমারের মনোগত ভাবের পরিবর্ত্তের কথা উল্লেখ করিয়া দুঃখ করিতে লাগিলেন ও জিজ্ঞাসিলেন ‘কুমার! তুমি কি নিমিত্ত প্রাসাদের সুখসম্ভোগ ও আমোদ-প্রমোদ পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বদা নির্জ্জনে অবস্থিতি কর ও লোকের সহিত কথাবার্ত্তা না কহিয়া মৌনভাবে থাক?” এই যে তারাশঙ্কর বাঙ্গলা ভাষাকে নূতন প্রাণে অনুপ্রাণিত করিলেন তাহার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার প্রভৃতি মাতৃভাষাকে সর্ব্বপ্রকারেই নূতনভাবে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিতে লাগিলেন।

(অর্চ্চনা, পৌষ, ১৩৩৫)
শ্রী শরচ্চন্দ্র কাব্যতীর্থ

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।