প্রমোদকামিনী কাব্য

প্রমোদকামিনী কাব্য
প্রমোদকামিনী
কাব্য।


শ্রীআশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্ত্তৃক
প্রণীত ও প্রকাশিত।

     “একমন হয়ে
সাধিলে আশার ফল ফলে শ্রম শাখে,’’

কলিকাতা।
শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং বহুবাজারস্থ ২৪৯ সংখ্যক ভবনে
ষ্ট্যানহোপ যন্ত্রে মুদ্রিত।

সন ১২৭৮ সাল। মূল্য চারি আনা মাত্র।

প্রমোদকামিনী
কাব্য।


শ্রীআশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্ত্তৃক
প্রণীত ও প্রকাশিত।

     “একমন হয়ে
সাধিলে আশার ফল ফলে শ্রম শাখে,’’

কলিকাতা।
শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বসু কোং বহুবাজারস্থ ২৪৯ সংখ্যক ভবনে
ষ্ট্যানহোপ যন্ত্রে মুদ্রিত।

সন ১২৭৮ সাল।


বিজ্ঞাপন।


আলিবর্‌ গোল্‌ডস্মিথ সাহেবের “হারমিট্” নামক উৎকৃষ্ট কবিতা অবলম্বন করিয়া এই প্রমোদকামিনী কাব্য রচিত হইল। বিশুদ্ধ প্রণয় বর্ণন এবং স্ত্রীলোকের স্বভাব প্রকটন এই গ্রন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য। এক্ষণে সাধারণ-সমক্ষে প্রার্থনা এই যে, বিদ্যোৎসাহী মহোদয়গণ ক্ষণ কালের নিমিত্ত এই ক্ষুদ্র কাব্য খানির প্রতি কৃপাকটাক্ষপাত করেন। তাহা হইলেই আমার শ্রম সফল এবং আমি কৃত কৃতার্থ হইব।

 পরিশেষে সাতিশয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পূর্ব্বক স্বীকার করিতেছি যে, বরাহনগর নিবাসী আমার বন্ধু শ্রীযুক্ত বাবু বীরেশ্বর ঢোল এবং শ্রীযুক্ত বাবু রামচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ইহার মুদ্রাঙ্কন বিষয়ে অনেক উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন। তাঁহাদের উৎসাহ ব্যতীত আমি এরূপ কার্য্যে সাহসী হইতে পরিতাম না।

বরাহনগর।
১৭ বৈশাখ।
শ্রীআশুতোষ শর্ম্মা।

উপহার।

পরম প্রণয়াস্পদ শ্রীযুক্ত হেম চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

প্রিয়বরেষু।

ভাই হেম।

 আমার এই কাব্যমালা তোমার গলদেশে প্রদান করিলাম! কুসুম রমণীয় হউক বা না হউক—গাথনি দশ জনের মনোরঞ্জন করিতে পারুক বা না পারুক, যদি তুমি তোমার প্রিয় বয়স্যের আদরের ধন আদর কর, আমি আমার প্রমোদ-কামিনীকে সুদ্ধ তোমার আদরে আদরিণী করিয়া যাবজ্জীবন সুখী হইব।

ইতি।

তোমার চিরপ্রিয়,
গ্রন্থাকার।

প্রমোদকামিনী কাব্য।
ভূমিকা।

ফুটেছে কামিনী-ফুল!সুবাসে ভুলিয়া
স্নিগ্ধময়ী তটিনীর প্রণয় পিপাসা
পরিহরি, সুধামাখা সমীরণ সদা
ভ্রমিছে নিকুঞ্জবনে। ফুটেছে কুসুম
মাঝে মাঝে রমণীয় সাজে; কেহ লাজে
আধো বিকশিত-কেহ হাসি হাসি মুখে,
ভুবনমোহন রূপ ভুবনমোহন
পরিমল সহ সুখে পেতেছে প্রেমের
ফাঁদ! মধুকর মধুলোভে গুণ গুণ
স্বরে চুম্বিছে অধর কারো, কারো মুখ
চারু—বসিয়া হৃদয়ে কারে পশিছেরে
সুখে সুখের সাগরে; হেনকালে পরি

তারার মোহনমালা যামিনী কামিনী
আলোকেরা প্রাণনাথে সাথে করি হাসি,
সে কুঞ্জকাননে আসি দিল দরশন।
ভুবনমোহিনী রমণীর রমণীয়
আঁখি—যে আঁখির বলে ভুলায় ভুবনে
চন্দ্রননা, সেই আঁখি যে আঁখির সনে
কবি দেয়রে তুলনা বাড়াইয়া, সেই
সুন্দর সরোজ আঁখি মুদিল নলিনী।
সুখে রত সবে—আহা নীরব স্বভাব!
হেনকালে কাঁদিতেছে, আলো করি রূপে,
সোণার নলিনী এক সরসী সোপানে!
জলজ-নলিনী সম কাতরা বিরহে
ধনী, কহিছে মনের দুঃখ সম দুঃখী
জনে:—
“কি হয়েছে সরোজিনি?
আহা! কি হয়েছে সরোজিনি লো?
কোথা সে প্রফুল্ল সাজ?
ছল ছল আঁখি আজ,
বিরস, অবনি মাঝে যেন অনাথিনী লো!

কোথা সে মোহন হাসি?
নলিনি! বল প্রকাশি,
কি সুখে বঞ্চিত হয়ে এমন মলিনী লো?
কে করেছে অনাদর সরোজ-কামিনী লো?

“বল সখি! সত্য করি,
আজি বল সখি! সত্য করি লো,
উদিত হলে মিহির,
শোষে সরোবর-নীর,
সে তাপে তাপিত তুমি না হও সুন্দরি লো!
হায় কি এমন দুখ?
শুকাল সরোজ-মুখ!
তোমার অসুখে, সই! ইচ্ছা করে মরি লো।
আয় বোন্‌! দুই বোনে কাঁদি গলা ধরি লো।

“দেখিয়াছি কত দিন;
আমি দেখিয়াছি কত দিন লো;—
মলয় সমীর আসি,
সযতনে হাসি হাসি,
দোলাইতো, তুমি যবে আছিলে নবীন লো।



তাহার প্রণয়ে ভুলে,
তুমি ধনি! মন খুলে,
দিয়াছিলে মনঃ প্রাণ, প্রাণের নলিন্‌ লো!
তখন ভাবিয়াছিলে সে তব অধীন লো।

“দেখ তার আচরণ!
আজ দেখ তার আচরণ লো!
যে তোমারে কোলে করে
দোলায়েছে  সমাদরে,
গলা ধরে সেই করে জলেতে মগন লো!
তখন সে নিশিদিনে
যেন, সই, তোমা বিনে,
জানিতো না এ জগতে, আর কোন জন লো
এখন দেখে না যেন চিনে না কখন লো!

“আগে সেই শঠ অলি,
দেখ আগে সেই শঠ আলি লো,—
হেরি তোমার সম্পদ,
সাদরে ধরিয়া পদ,
করেছিল তোষামদ কত কথা বলি লো।

দেছো তুমি বুকে স্থান,
সে করেছে মধু-পান,
কত ভাব! কত স্নেহ! কত গলাগলি লো!
এখন সে দিন গেছে গিয়াছে সকলি লো!

“দিনমণি প্রাণ-প্রিয়া,—
তুমি দিনমণি প্রাণ-প্রিয় লো!
তোমারে ভাসায়ে জলে,
পশিল সে অস্তাচলে,
লভিতে বিরাম সুধা হাসিয়া হাসিয়া লো।
ভেবে যারে আপনার,
গলে দিলে প্রেম-হার,
সে করিল পরিহার কিসের লাগিয়া লো?
এত অবিচার দেখে ফেটে যায় হিয়া লো।

“সখি! পুরুষের প্রাণ।–
আহা সখি! পুরুষের প্রাণ লো!—
থাকে না কাহারো বশে,
রসে না স্নেহের রসে,
দয়াহীন সুকঠিন পাষাণ সমান লো!

আদর করিয়া তায়,
যে জন ধরিতে যায়,—
এ জনম মত তার সুখ অবসান লো;
যথা তথা পদে পদে সহে অপমান লো।

“সই! আমি ও তখন,
আহা সই! আমিও তখন লো,—
দিয়াছিনু এক জনে,
প্রাণ মনঃ সযতনে,
হৃদয়েতে রেখেছিনু ভাবিয়া সুজন লো।
মনে ছিল চিরকাল,
সে মোরে বাসিবে ভাল,
আমি তার সে আমার যাবৎ জীবন লো।
এখন ভেঙেছে, সই, আশার স্বপন লো!

“সই! কি কব তোমায়?
প্রিয় সই! কি কব তোমায় লো?—
মনে করি কত বার,
ভাবিব ন। তারে আর,
সে এসে মনের পথে হাসিয়া দাঁড়ায় লো

সাধের প্রণয়-তৃষা,
যদি কভু হয় কৃশা,
মায়াবিনী আশা তারে তখনি বাড়ায় লো!
চেয়ে থাকি পথ পানে চাতকিনী-প্রায় লো।

“তাহারে কি ভোলাযায়?
আহা! তাহারে কি ভোলাযায় লো?
সোহাগ করিয়া কত
যে তুষেছে বিধিমত,
দাস মত অনুগত সতত আমায় লো।
দেখিলে আমার মান,
হয়ে যেন ম্রিয়মাণ,
পরিহরি নিজ মান ধরিয়াছে পায় লো!—
কোন্‌ প্রাণে মনান্তর করিব তাহায় লো?

“তারে যথায় তথায়,
আমি তারে যথায় তথায় লো,—
না ভাবিয়া পরিণাম,
অবিরাম হয়ে বাম,
করিয়াছি অপমান, কথায় কথায় লো।

শুনিনে কারো প্রবোধ,
মানি নাই উপরোধ,
কটু কয়ে স্থানান্তরে করেছি বিদায় লো।
পোড়া ক্রোধ, প্রিয় সই! সকলি ঘটায় লো!

“কেন হবে বা কাঁদিতে?—
আজ কেন হবে বা কাঁদিতে লো?
কেবা সখি! আমা হতে,
সুখী ছিল এ জগতে?
(চির বাঁধা ঘন যথা দামিনী পিরিতে লো!)
বেঁধেছিনু প্রেম ফাঁদে,
মোর হৃদয়ের চাঁদে,
করিতে মানস আলো কৌমুদী-হাসিতে লো।
কি সুখে ছিলাম সুখী পারিনে বলিতে লো!

“সাধে তারে ভাল বাসি–
আমি সাধে তারে ভাল বাসি লো?
‘প্রাণের প্রেয়সি!’ বই
শুনিনে কখন সই!
এমনি প্রাণেশ মোর সুমধুর-ভাষী লো!

এত মোরে অনুরাগ!
কখন দেখিনে রাগ;
যুগে যুগে তার পায়ে হয়ে রব দাসী লো।
সে মোর প্রাণের প্রাণ হৃদয়-নিবাসী লো!

“আহা! না বুঝে তখন!
সই! আহা! না বুঝে তখন লো।
গরিমা-তটিনী-তটে
বসিয়া, মঙ্গল ঘটে
ঠেলিনু চরণে সখি! হয়ে অচেতন লো।
যত সখীর সমুখে,
বলিনু যা এল মুখে;—
স্ত্রীলোকের এত তেজ ভাল কি কখন লো?
আপনি হইনু নিজ দুঃখের কারণ লো!

“সব দৈব নিয়োজন!
সখি! সব দৈব নিয়োজন লো!
আমি যে ফণিনী, ধনি!
মোর মণি গুণমণি,
গেঁথেছিনু প্রেম-তারে করিয়া যতন লো;

কুবুদ্ধে ফেলিনু খুলে
বিরহ-সাগর-কূলে,
কপালে, অতল জলে হইল মগন লো,
আর কি পাব সে মণি মনের মতন লো?

“কেঁদে কি হবে এখন?
মিছে কেঁদে কি হবে এখন লো?
ফেলিলে চোকের জল,
ফলিবে না সুখ-ফল,
সমূলে যাহার তরু করেছি ছেদন লো!
এখন যদি সুন্দরি!
সে সিন্ধু[১] মথন করি,
উঠিবে যাতনা-বিষ, পাবনা রতন লো!—
দুঃখ লাগি বিধি মোরে করেছে সৃজন লো

“আগে ভাবিনে তা মনে,
আহা! আগে ভাবিনে তা মনে লো,—
দুখের আঁধার এসে,
যাতনা দিবে রে শেষে;
নিবাবে প্রণয়-দীপ বিরহ-পবনে লো:

ভালবাসা-নদী সই!
শুকাবে দুদিন বই;
মরিবে আশার লতা হৃদয়-কাননে লো;
অসুখের দাবানল জ্বলিবে সঘনে লো;

“ফুটিবে না সুখফুল;
আর ফুটিবে না সুখফুল লো;
ঋতুরাজ মোর কান্ত,
সে রসে হবেন ক্ষান্ত;
পলাবে তার বিরহে হর্ষ-পিক-কুল লো;
স্নেহের সমীর গিয়ে,
তুলিবে না উথলিয়ে,
আর সে আনন্দ-সিন্ধু ছাড়াইয়া কুল লো;
বাঁচিবে না প্রেম-তরু ছিঁড়ে গেছে মূল লো।

“সই! সহে না এখন,
প্রিয় সই! সহে না এখন লো।
মিছামিছি করি মান,
হারানু প্রাণের প্রাণ,—
দুই এক দিন নয়—জন্মের মতন লো!

সতীর কি অপমান,
আছে লো পতির স্থান?—
হায়! কেন না ধরিনু চরণে তখন লো?
কেন না সাধিনু, সে যে সাধনের ধন লো!

“হতো সকলি বজায়!
সখি! হতো সকলি বজায় লো!—
দয়ার সাগর নাথ,
তখনি ধরিয়া হাত,
‘প্রাণপ্রণয়িনি!’ বোলে তুলিত আমায় লো।
বসিয়া পতির সনে,
সুখময় স্নেহাসনে,
মনোসাধে পূরাতাম্ মনের আশায় লো;
দিতাম সাঁতার সুখে সুখের সুধায় লো!

“সখি! দম্পত্য-প্রণয়,
আহা সখি! দাম্পত্য-প্রণয় লো,—
পবিত্র আকার ধরি,
জগত পবিত্র করি,
প্রসবে পবিত্র মুখ ত্রিভুবনময় লো।

অকলঙ্ক সুনির্ম্মল,
স্নেহ করে টল মল;
প্রতিক্ষণে নব নব আনন্দ উদয় লো।
অনুপ এ প্রেম-নিধি যশের আলয় লো!

“সই! পরীক্ষা কারণ,
স্নেহ, সই! পরীক্ষা কারণ লো,—
এক দিন করি ছল,
বদনে দিয়ে অঞ্চল,
ঘুমালেম্‌ মিছা ঘুম মুদিয়া নয়ন লো।
কত যে মধুর স্বরে।
তুষিলেন সমাদরে;
হরষে সুখ-সরসে হলেম মগন লো।
এত আদরের হয়ে এখন এমন লো!

“কিছু চিরদিন নয়!
কভু, কিছু চিরদিন নয় লো!—
সাগর নদী ভূধর,
শশধর দিনকর,
এক দিন কাল-গ্রাসে সব হবে লয় লো।

নতুবা ঘটনা হেন,
প্রণয়ে ঘটিবে কেন?
সদয় প্রাণেশ কেন, হবেন নিদয় লো?
অদৃষ্ট ভাঙিলে সই! এই সব হয় লো!

“সাধে কাঁদে কি এ প্রাণ;
সখি! সাধে কাঁদে কি এ প্রাণ লো;—
আমার অদৃষ্ট হয়ে,
আমার নিকটে রয়ে,
আমারি সুখেতে করে কণ্টক প্রদান লো!
যে যাহার কাছে থাকে,
অসুখী করেনা তাকে,—
সুজনের এই রীত, এইতো বিধান লো।
না জানি অদৃষ্ট মোর কেমন পাষাণ লো!

“নাথ বিরূপ আমায়,
যেন, নাথ বিরূপ আমায় লো,—
নদী পড়ে সিন্ধুনীরে,
সিন্ধু তো আসে না ফিরে;
আমারি উচিত, সখি! ধরা তাঁর পায় লো।

যাঁর মানে মোর মান,
বাড়ালে তাঁহার মান,
অপমান মোর কভু নাহিক তাহায় লো;
আমি সতী—তিনি পতি সংসারে সহায় লো!

“মনে তারে ভালবাসি,
আমি মনে তারে ভালবাসি লো;
ক্ষণেক অন্তর হলে,
অন্তর উঠিত জ্বলে,
সহিতাম, লাজভয়ে মুখে না প্রকাশি লো।
না হেরে স্বজনি! যায়,
তিল আধো থাকা দায়,
সমুখে কাঁদায়ে তারে মনে মনে হাসি লো;
আপনি আপন দোষে আঁখিনীরে ভাসি লো!

“পাইলাম তার ফল,
ভাল পাইলাম তার ফল লো!
না দেখে প্রাণের প্রাণ
এমনি অস্থির প্রাণ,
যে দিকেতে চাহি দেখি আঁধার কেবল লো!

—হারাইনু অযতনে—
এ কথা পড়িলে মনে,
অনুতাপে তনু কাঁপে চোকে ঝরে জল লো;
প্রবল হইয়া জ্বলে বিরহ অনল লো।

“আমি হয়েছি পাগল,
ভাবি আমি হয়েছি পাগল লো;—
প্রাণনাথের উদ্দেশে,
ফিরিব রে দেশে দেশে
কুল শীল মান মোর কায কি সকল লো?—
এইরূপ ভেবে ভাই,
চরণ বাড়াতে যাই,
আছাড় খাইয়া পড়ি যেন নাই বল লো!
জীবন জীবন বিনা হয়েছে বিকল লো!

“আজ করিয়াছি পণ
কিন্তু আজ করিয়াছি পণ লো,—
প্রভাত হইবে যবে,
যা থাকে কপালে হবে,
একাকিনী যথা নাথ করিব গমন লো।

ধরিয়া পুরুষ সাজ,
খুজিব সে রসরাজ,
বাছিব না গিরি গুহা নগর কানন লো।
রতন যতন বিনা পায় কোন্‌ জন লো?”





বলে কয়ে নলিনীরে সে কুঞ্জ কানন
হতে কুঞ্জর-গামিনী কুঞ্জর গমনে
পশিল গৃহ পিঞ্জরে। উথলি দুখের
সিন্ধু বহিল প্রবাহ আলোকরানীল-
নলিন-নয়ন-যুগে। আগে অযতন
করি যে রতন হেতু সহিছে যাতনা
ধনী, পতন না হলে তনু কমিবার
নয় সে বিষম জ্বালা! আহা! সদ্য জাত
শিরীষ কুসুমোপম কমনীয় দেহ
বিরহ আতপ আঁচে হয়েছে লাবণ্য
হীন, তবু সে মাধুরী অনায়াসে করে
চুরি মুনিজন-মন। কক্ষবাতায়নে
বসি নিরখে রূপসী নৈশ গগনের
শোভা; প্রকৃতিসুন্দরী তারক-হীরক—

রাজি বিরাজিত নীল-অম্বর-অম্বর
পরি বিতরিছে সুখে অভুক্ত জগত
জনে শান্তি সুধারস; স্থানে স্থানে শাখি-
শাখে উজলি নয়ন ফলেছে রতন
ফল খদ্যোত আবলি; কসুম কামিনী
মৃদু আন্দোলিত হয়ে মলয় পবনে
বিতরিছে পরিমল, যে গুণের গুণে
সাদরে দেবের শিরে আরোহে রূপসী।—
আরো কত মনোরমা সুষমা সমূহ
বিলোকিল বিধুমুখী, কিন্তু রে কুসুম
বন নিরানন্দ সদা জগত আনন্দ
কান্ত[২] ঋতুকান্ত বিনা মণিহারা ফণি
মত! ঘামিল বদন শশী। বিন্দু বিন্দু
স্বেদ জল মতিহার সম শ্রেণী গাঁথা
মধুর মধুর সাজে কপালে কপোল-
যুগে প্রকাশিল আসি। অঞ্চল লইয়া
করে চঞ্চলা বরণী, মুখ-সুধাকরে
সুধাবৃষ্টি ঘর্ম্মবারি, মুছিল যতনে।

আবার অশ্রু প্রবাহ বহিল সঘনে।
ব্যাকুল হৃদয়ে ধনী ত্যজি বাতায়ন,
নিদ্রার কোমল অঙ্কে লভিতে বিরাম,
শুইল পর্য্যঙ্কোপরি। পয়োফেননিভ
শয্য নবনীতোপম সুকোমল, থরে
থরে সাজান মুকুতানরে চারি পাশ,
মধ্যে বিধুমুখী, বিধু প্রতিবিম্ব যথা
ভাগীরথী নীরে আলোকরা! কি সুন্দর
করের মৃণাল শোভে নলিন বদন!
মধুপানে মধুকর মধুমাখা আঁখি
মোহিত হইয়া ঢলে পড়িছে হাসিয়া।
কচিতাল-শাঁস সম ননীমাখা মরি,
ক্ষীরের চিবুক ভাসিছে রূপ-সাগরে,—
বিকচ কমল যথা বিমল সলিলে
মনোহর! অকস্মাৎ নিদ্রা আসি দিল
দরশন। ধীরে ধীরে নয়ন পল্লব
দুটি পড়িল ঢলিয়া তারাকাুরা আঁখি-
তারা ঢাকিয়া যতনে; নীল শতদল
যথা দিবা অবসানে, ঢাকে রে বদন

চিরসুখের সদন। ঈষদ্ বঙ্কিম
করি কৃশ কটিদেশ রাখি চারু বাম
উরু পার্শ্ব উপাধানে অলসে অবশ
অঙ্গ পড়িল নতিয়া, ছিন্নমুলা লতা
যথা রবি-করজালে। দেখ হে ভাবুক
জন ভাবিয়া অন্তরে, সে মোহন রূপ-
রাশি। কেমনে বর্ণিবে কবি সে সুবর্ণ
অনুপম? স্বরূপিতে আহা যার সনে
সুবর্ণ বিবর্ণ হয়, পদ্মপর্ণ কাল।
চঞ্চলা দামিনী সদা খর্ব্বিতে কামিনী-
গর্ব্ব প্রকাশে আকাশে, কিন্তু যদি স্থির
ভাবে দাঁড়ায় আসিয়া সে লাবণ্য কাছে,
বুঝা যায়, কে বা হীরে, কেবা জিতে, কেবা
রূপবতী! রূপেতে তো আঁখি ভুলে, গুণে
ভুলে মন। পরশে যে দহে দেহ, হক
সে সুন্দর অতি, অম্বতে রহিলে বিষ
কে আদরে তারে? চল পাঠক! আমার,
দেখিগে মাধুরীলতা বেষ্টিত লাবণ্য-
তরু রূপের কাননে। এখন নিদ্রিত

আছে সোণার নলিনী; এখন বিহরে
মৃদু অকলঙ্ক হাসি নব-প্রফুল্লিত-
গোলাপ-দল-বিমল মধুর-অধরে।
মদন-বিলাস-স্থল সুচারু ললাটে,–
সুষুপ্তি সুলভ–পদ্মপর্ণ গত মরি
নিশার তুষার সম বিমল বরণ
ঘর্ম্মবিন্দু ঢল ঢল টল টল করে
ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণপ্রভ; এলায়ে পড়েছে
কাল চিকুর চিকণ ঢাকি চারু গণ্ড-
দেশ, ছুটিছে মোহিনী দ্যুতি অবারিত,
অথচ প্রচ্ছন্ন ভাবে,—সুধাংশু জলদে
যথা শৈবালে নলিনী! রয়েছে নয়ন-
অসি পল্লব-পিধানে, এবে হীন তেজ,
নিষ্কোশিত হলে পারে কাটিতে ধৈর্য্যের
পাশ জিতেন্দ্রিয় মনে। বিচিত্র কাঁচলি
ঢাকা বিমল বরণ, সুধাময় পয়ো-
ধর সুধাংশু কিরণ! হেমাঙ্গ রয়েছে
ঢাকা নীলাম্বর মাঝে, দামিনী কামিনী
যেন জলদে বিরাজে! কুসুম-কোমল

বলি রমণীর তনু কমনীয় গুণে
কবি করেন বর্ণনা; কিন্তু এ কামিনী
কুসুম সমান নয়, কুসুম রচিত—
তাই কুসুম-কোমল!—বদন সরোজ,
দশন কুন্দ-কলিকা, আঁখি নীলোৎপল,
অধর বান্ধুলি, গগু কুমুদিনী-দল,
মনোহর পয়োধর কমল কোরক,
মৃণাল সুকর-যুগ, করতল তাহে
প্রফুল্ল গোলাপ শোভে, অঙ্গুলি চম্পক-
কলি, নাভি সরোজিনী, স্থলপদ্ম মরি
চরণ যুগল! দেখ পাঠক! বিচারি
মনে কোন্‌ গুণে গুণবতী পরিচিত
এ কাব্য সরসে, বলি ‘সোণার নলিনী!’





পরদিন বিধুমুখী উদিলে তপন,
—পরি পুরুষের সাজ,
খুঁজিব সে রসরাজ,
এপ্রতিজ্জ্ঞা পূরাইতে করিল মনন।


কোকনদ-বিনিন্দিত চরণ-কমলে,
কিঞ্চিৎ কুষ্ঠিত হয়ে,
পোড়া লোক-লাজ ভয়ে
পরিল পাদুকা-যুগ বসিয়া বিরলে।

কাঁচলি উপরে জামা মুকুতার নরে,
ধরেছে অপূর্ব্ব বিভা,
পাইয়া রূপের নিভা,
নিশার শিশির যথা দিনকর করে!

জিনিয়া চম্পক-কলি অঙ্গুলি নিকরে,
হীরক অঙ্গুরী ধরি
পরিল যতন করি,
দ্বিতীয়ার চাঁদ যেন অমল অম্বরে।

মস্তকে পরিল তাজ মুনি-মনোহর;
মনের মতন করে
সাজাইয়া অশ্ববরে,
চলিল মাধবীলতা যথা তরুবর।


মনোগতি ছুটে অশ্ব দুলিছে কামিনী;
যথা সরোবর কোলে,
মৃদু  মলয়-হিল্লোলে,
দোলে রে সুখের দোলে নবীনা নলিনী

মধুকণা ঘর্ম্মবারি বদন-কমলে,
সেজেছে কি চমৎকার,
যেন সুধার আধার,
তারা বেড়া চাঁদ মরি উদিত ভূতলে!

উতরিল নদ নদী নগর কানন।
যার তরে প্রাণ কাঁদে,
সেই  হৃদয়ের চাঁদে,
না পাইল, কোন স্থানে করি অন্বেষণ।

বহিল নিরাশাবায়ু, অমনি তখন
বিরহের দাবানল,
জ্বলিল করিয়া বল,
পোড়াতে সে চিন্তা-শুষ্ক হৃদয় কানন।


দুঃখ-ঘনে আবরিল মুখ-চাঁদ খানি;
নয়নে বহিল জল,
ভিজাইল গণ্ডস্থল;
সুখের চকোর কাঁদে মনে দুঃখ মানি।

ছয়মাস শশিমুখী ভ্রমি নানা স্থান,
হরিদ্বারে অবশেষে,
উপনীত হল এসে,
ভুবন পাবনী গঙ্গা যথা অধিষ্ঠান।

নিবিড় নীরদ সম ভূধর নিচয়,
ভীষণ মূরতি ধরি,
রয়েছে আঁধার করি,
দিবসে রজনী বলি অনুভব হয়।

নির্জ্জন প্রদেশ একে, তাহাতে যামিনী,
নাহিক সুধাংশুশশী—
যেন রে তিমির মসি,
মেখেছে কি পাপে হেথা প্রকৃতি কামিনী।


পড়িছে তুষার-কণা ঝর ঝর করে;
শীতেতে কম্পিত-কায়
মুখ-নলিন শুকায়
বিশেষ আতঙ্ক আসি উদিত অন্তরে।

ঘোটকের পদ-শব্দে হয় প্রতিধ্বনি,—
ক্ষণেক অগ্রেতে ধায়,
ক্ষণেক পশ্চাতে চায়,
ক্ষণেক মুদিয়া আঁখি থমকে অমনি।

উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বলে “কে আছো নিকটে?
হলেম্‌ শরণাগত
এ ঘোর রজনী-মত,
কর ত্রাণ যায় প্রাণ পড়িছি সঙ্কটে।”

অদূরে কুটীর হতে এক যোগিবর,
শুনি এই আর্ত্তনাদ,
ভাবি কার পরমাদ,
আলোক লইয়া তথা আসিল সত্বর।


ছদ্মবেশি-রূপে যোগী মানিল বিস্ময়,
হেরি মুখ চাঁদ খানি
বদনে না সরে বাণী,
অনিমেষ আঁখি-যুগ, মোহিত হৃদয়।

রমণী সরম-লতা, সরমে বিকল,—
ধরেছে পুরুষ-সাজ,
তা বলে কি গেছে লাজ?
সেই আঁখি-সেই মন—সেই তো সকল!!

অনন্তর যোগিবর আদর করিয়া,
কহে “বৎস! এই আমি,
হও মোর অনুগামী,
এসেছি এখানে দেখ তোমার লাগিয়া।

“একাকী তাপস আমি থাকি এই স্থানে;
ঈশ্বরের নাম করি,
সুখেতে সময় হরি,
নাশিয়াছি ক্ষুধা-তৃষা শান্তি-সুধাপানে।


“করেছে তিমিরা নিশা গতি দৃষ্টি রোধ,
এস বৎস! মোর ঘরে,
যেওনা সাহস করে,
কেটোনা জীবন-তরু হইয়া নির্ব্বোধ।”

অগত্যা চলিল সতী যোগির সহিতে,—
মনের যাতনানল,
জ্বলিল করিয়া বল,
নলিন-নয়নে ধারা লাগিল বহিতে।

বৃথা চেষ্টা করে যোগী সান্ত্ব্না কারণ,
মন পুড়ে যে অনলে,
সে জ্বালা না যায় মলে!
জলে কি বাড়বানল নিবে রে কখন?

পর দুঃখে দুঃখী হয়ে সুজন তাপস
কহিছে বিনয় ভাষে—
“কি দুঃখে জীবন ভাসে?
কহ বৎস! কি লাগিয়া এমন বিরস?


হয়েছো কি প্রিয়তম মিত্রেতে বঞ্চিত?
অথবা রমণী হেতু,
ভাঙিয়া আশার সেতু,
পড়েছো ঘাতনা জলে কণ্টকে বেষ্টিত?

জলবিম্ব সম, পু্ত্র! নারীর প্রণয়;–
অঙ্গ ভঙ্গি দেখাইয়া,
পুরুষেরে মজাইয়া,
ভঙ্গ দেয় রঙ্গরসে হইয় নিদয়।

দিনমণি-প্রণয়িনী সরোবরে স্থান
চেয়ে থাকি পতি পানে,
গোপনে পরেরে আনে,
মধকরে বঁধু করে করে মধুদান!

পদাঘাতে রমণীরে করহ বৰ্জ্জন;–
কামিনী দামিনী প্রায়,
দেখিলে আঁখি যুড়ায়,
কিন্তু সে অনলরাশি পরশে নিধন;


ভর্ৎসিয়া রমণী-জাতি তাপস সুজন,
ক্ষণকাল অধোমুখে,
থাকিয়া মনের দুঃখে,
দেখিতে লাগিল পুনঃ অতিথি-বদন,—

নব ভাব আবির্ভাব অপরূপ অতি;
দেখে, অকলঙ্ক শশী
আলো করে আছে বসি,—
যুবক যুবক নয় ষোড়শী যুবতী!!

বিস্ময় মানিল যোগী, রোমাঞ্চ শরীর।
হৃদয়-সরসী-মাঝে,
কমল-কোরক-সাজে
দেখে, পীন পয়োধর তুলিয়াছে শির;

নলিন-নয়ন দুটি সরমে কম্পিত,
নধর গোলাপ দল
ওষ্ঠাধর সুকোমল,
স্বভাবতঃ, যেন কত তাম্বুলে রঞ্জিত!


এত শোক! বিধুমুখে তবু রে এখন
চির বাঁধা মৃদুহাসি,
আলো করিতেছে আসি,
নিবিড় নীরদ মাঝে দামিনী যেমন।

বলি বলি করে যোগী বাক্য নাহি সরে,
জানিতে রমণী-ধাম,
কোন্‌ জাতি কিবা নাম,
জ্বলিছে বাসনানল হৃদয়-বিবরে।

আপনি তাহার সূত্র তুলিল কামিনী।
যোগির চরণ ধরি,
বিবিধ বিনয় করি,
কহিতে লাগিল নিজ দুঃখের কাহিনী।

অপরাধ ক্ষমা মোর কর যোগিবর!
আমি হে পাপিনী অতি,
সতত পাপেতে মতি,
মরিলে আমার গতি নরক ভিতর।


“শুনেছ মথুরা নামে নগরী সুন্দর;
যমুনার কাল নীর,
আলো করে যার তীর,
কামিনীর কটিতটে যথা নীলাম্বর।

মাঝে মাঝে সৌধরাজি–সুখের সদন—
কি সুন্দর শোভ করে,
স্ফটিকের সরোবরে,
যেন সোণার নলিনী নয়ন-রঞ্জন!

“স্থানে স্থানে উপবন পরিমলময়;
স্বভাবে লইয়া সঙ্গে,
বসন্ত পরম রঙ্গে,
সাজাইছে যারে সদা দিয়া ফুলচয়।

“মলয় সমীর ছাড়ি লন্দন কানন,
পাইয়া মধুরাস্বাদ,
পূরাইছে মনোসাধ,
অন্দরে কামিনী লয়ে নৃপতি যেমন!


“কোন স্থানে সরোবর—শোভার সাগর!–
কুমুদ কহ্লার কত,
সরোজিনী নানা মত;
মধুপানে মত্ত হয়ে ভ্রমে মধুকর।

“কোন স্থানে সুবিস্তীর্ণ সুন্দর প্রান্তরে,
সমীর হিল্লোল-কোলে,
নব তৃণ সুখে দোলে,
হরিত তরঙ্গ যেন হরিত সাগরে।

“কোন স্থানে প্রস্রবন—রজত প্রতিম!—
ঝর ঝর ঝর করি,
ঝরিছে দিবা শর্ব্বরী,
বাড়াইছে নগরীর সুষমা অসীম।

“আরো কত মত শোভা কহিব কেমনে?
জগতে নাহিক সম,
সকলই অনুপম,
কমল অচলা তথা স্নেহের কারণে।


“সেই স্থানে অধিনীর পিতার ভবন,
পিতা নিজ বুদ্ধিক্রমে,
বাণিজ্যেতে ক্রমে ক্রমে,
অতুল বিভব রাশি করেন্‌ অর্জ্জন।

“এক মাত্র কন্যা আমি, স্নেহের আধার;
প্রাণের অধিক করে,
তুষিতেন সমাদরে,
দেখিতেন অদর্শনে জগত আঁধার।

“নবম বরষ যবে বয়োক্রম মোর;
জনক যতন করে,
আমার বিবাহ তরে,
আনিলেন্‌ একজন নবীন কিশোর।

“বালিকা বয়স মম—সরল জীবন,—
দেখিনু কি শুভক্ষণে,
মনঃ প্রাণ সযতনে,
সমপিনু সেই জনে অমনি তখন!


“একত্রে দুজনে বোসে যমুনার তটে,
খুলি মনের কপাট,
পড়িতাম্ সুখ পাঠ;—
আজো লেখা সে আনন্দ হৃদয়ের পটে।

কভু বা কুসুম-বনে কুসুম তুলিয়া,
গাঁথিয়া চিকণ হার,
হাসিতে হাসিতে তাঁর,
সাজাতাম্‌ গল-দেশ সোহাগ করিয়া।

কখন সুধাংশুময়ী যামিনী সময়,
গলা ধরাধরি করি,
সুখের আসনোপরি,
বসিয়া, মনের দুঃখ করিতাম্‌ ক্ষয়।

“কখন পরায়ে তাঁরে রমণীর সাজ,
পুরুষ হইয়া আমি,
হইতাম্ অনুগামী,—
ছলেতে ঘোমটা টেনে জানাতেন লাজ!


“কখন সন্ন্যাসী করি, সন্ন্যাসিনী হয়ে
সুখে বাম পাশে বসি,
হেরিতাম্‌, মুখশশী,—
হাসিতাম্‌, হাসাতেন্‌ কত কথা কয়।

“কখন অধোবদনে ছলে করি মান,
কাঁদাতাম্ প্রাণনাথে;
কিন্তু কাঁদিতাম্ সাথে—
কত যে জ্বলিত জ্বালা নাহি পরিমাণ!

“কখন বা বসি দোঁহে সুখময় রথে,—
লোল করি লজ্জা ডোর,
মারিতাম করি জোর,
ছুটিত মানস অশ্ব প্রণয়ের পথে।

এইরূপে ছয় বর্ষ কাটিল আমার।
সুখ-রবি অস্তে গেল,
দুঃখের যামিনী এল;
ঘেরিল মানস, আঁখি যাতনা আঁধার।—


আপনি লাগানু নিজ কপালে আগুণ!
মনে মনে ভালবাসি,
মুখেতে নাহি প্রকাশি,
আরম্ভিনু ঘৃণিতে তাঁহার রূপ গুণ।

“যখন তখন তাঁকে মিছামিছি রাগে,
হানিতাম্‌ বাক্যবাণ,
করিতাম্ অপমান,
নিষেধ করিলে কর্ম্ম করিতাম্‌ আগে।

“অহঙ্কার দেখে, মোর নয়নের তারা,
‘নিশ্চয় মরিব বলে’–
কোথায় গেলেন্‌ চলে!
সে অবধি হয়ে আছি শিরোমণি হারা।

“আশার মায়াতে ভুলে তরু এত দিন,
—অবহেলি লোকলাজে—
নারী হয়ে নরসাজে,
খুঁজিলাম রসরাজে নগর বিপিন।


“কি এমন পুণ্য পুনঃ হেরিব সে ধনে?—
মন তাঁর অনুগত,
সে জন মনের মত,
ভুলিতে নারিব তাঁরে নিদ্রা জাগরণে!

“আহ! কোথা হৃদয়েতে রাখিব যতনে!—
আহা! কোথা সুখ-হারে,
গাঁথিব প্রেমের তারে,
সে দুর্লভ-অনুপম-অমূল্য-রতনে!

“মনেতে মনের আশা রহিল সকল;—
বিধাতা সাধিল বাদ,
সাধে ঘটিল বিষাদ,
কলিল প্রেমের গাছে বিরহের ফল!

“পাব না সে চাঁদ মুখ বিলোকিতে আর।
—নিশ্চয় মরিব বলে’—
প্রাণেশ গেছেন চলে,
পূরালেন সে প্রতিজ্ঞা কপালে আমার।


“হা নাথ! হা প্রাণনাথ! ফেটে যায় প্রাণ;
একান্ত কি প্রাণধন
করিলে হে সমৰ্পণ,
অকালে কালের করে, হইয়া পাষান?

“বলে ছিলে, ‘তোমা বই কারো নই,’ নাথ!
তবে কি হেতু না বলে,
ছাড়িয়া গেলে হে চলে?
পড়ি পায় প্রাণ যায় লহ তব সাথ।

“সজল জলদ সনে দামিনী যেমন!
রহিতাম্ কাছে কাছে,
তোমারে হারাই পাছে,
দিবস শর্ব্বরী করি প্রহরী নয়ন।

“একত্রে করেছি খেলা, একত্রে শয়ন,
একত্রে করেছি সব,
—এ কি নাথ অসম্ভব!—
মরিবার কালে একা করিলে গমন!


“প্রমোদ কামিনি!’ বলে হইতে অজ্ঞান;
তিল আধো ছাড়া হতে,
ভাবিতে হে বিধিমতে;
কেমনে জন্মের মত করিলে প্রয়াণ?

“চল নাথ! সঙ্গে যাই আমিও তোমার;
তুমি হে আমার তরে,
দিলে প্রাণ অকাতরে,
আমিও এ প্রাণ দিয়ে সুধিব সে ধার!”

যার তরে প্রমোদের সুখের অভাব,
সেই ধন কাছে বসি,
(ঘনাচ্ছন্ন যেন শশী!)
দেখিছে প্রিয়ার কত ফিরেছে স্বভাব।

শত দোষে দোষী যদি হয় প্রিয়জন,
‘মরিব,’ এ কথা চিতে
প্রিয় কি পারে সহিতে?
শুখায় কি স্নেহ, জল-রেখার মতন?


আর কি থাকিতে পারে নীরবে তাপস?
ধরিয়া প্রেয়সীকরে,
বিনয়ে মধুর স্বরে,
কহিতে লাগিল, যেন ক্ষরে সুধারস!—

“প্রাণ দিয়ে?’ কি বলিলে প্রাণের প্রমোদ?
তা কভু দিব না আমি,
এই যে তোমার স্বামী,
পূরিল আশার নদী, সুখের ক্ষীরোদ!”

অনন্তর যোগিবর উঠিয়া যতনে,
অনুপ সুখের আশে,
বান্ধিল রে ভুজ পাশে,
ধরিতে হৃদয়-শশী হৃদয় গগনে।

ফুটিল আনন্দ-ফুল মানস-কাননে।
মোহিত হয়েছে সুখে,
বচন না সরে মুখে,
বরষে হরষ-নীর যুগল-নয়নে।


হেরি রূপ মনে মনে উপজে গরিমা;
কহিল আদর করি,
ক্ষীরের চিবুক ধরি,
“প্রোণের প্রমোদ! তুমি প্রণয়-প্রতিমা।

“প্রিয়লাগি পর দেশে পুরুষের সাজে,
পথ-শ্রম পরিহরি,
প্রাণধন পণ করি,
প্রদর্শিলে প্রেমলীলা পৃথিবীর মাঝে।

“প্রণয় পবিত্র হলে পীযুষ সমান!
পশু পক্ষী প্রেম লাগি,
প্রিয়-সুখ-দুঃখ-ভাগী;
পতঙ্গ প্রদীপে পড়ে পরিহরে প্রাণ।

“পরিলে প্রণয়-মালা পরিশুদ্ধ মনে;
মধুমাখা পরিমল,
প্রাণ করে সুশীতল,
প্রফুল্লিত এ কুসুম জীবনে মরণে।


“এস প্রণয়িনি! থাকি এক দেহ হয়ে!
যত দিন রবে প্রাণ,
কায়া ছায়ার সমান,
যেখানে যখন যাব, যাব তোম। লয়ে।”

“যেখানে যখন যাবে, যাবে মোরে লয়ে?
কেন মিছে প্রাণনাথ!
অবলা সরলা সাথ
করিছো এ ছলা আজ মিছে কথা কয়ে?

“প্রণয় স্বপন খেলা, নিদ্রা হ’লে ক্ষয়,—
ফুরাইবে ভালবাসা,
ভাঙিবে সুখের বাসা,
কেবল যাতনা রবে দহিতে হৃদয়।”

“না না বিধুমুখি! আর ভেবনা তা মনে,
তোমারে হৃদয়ে লয়ে,
থাকিব তোমার হয়ে;
তোমার প্রণয়-নীরে ভাসিব যতনে।


“তোমারে করিয়া হার পরিব লো গলে,
সদা রহিবে সমুখে,
দেখিব মনের সুখে;
নিবাব মিলন-নীরে বিরহ-অনলে।

“তুমি যে কনক লতা হৃদয় কাননে।–
নতিয়া নতিয়া উঠি,
মনঃ প্রাণ শাখী দুটি,
ঢেকেছো লো বিধুমুখি! স্নেহ বিতরণে!

“আমি ফণি তুমি মণি কি দিব প্রমাণ?
দুদে যথা ননী ভাসে–
থাকিব তোমার পাশে;
রাখিব লো বুক চিরে প্রাণের সমান!

“ললিত, তোমার বই আর কারে নয়।
তুমি আলোকরা মণি,
উজলিতে মন-খনি,—
তোমারে দেখিলে বুক দশ হাত হয়।


“তুমি আমি এক প্রাণ এক দেহ মন!—
যদি লো কৃতান্ত মোরে,
ধরে লয়ে যায় জোরে,
কাটিতে নারিবে তবু প্রণয়-বন্ধন!

“দেহের এ পঞ্চভুত ছাড়া ছাড়ি হয়ে
রহিবে তোমার পাশে,
অনুপ সুখের আশে,
ভাসিবে আনন্দ রসে সুখে তোমা লয়ে;–

“দিবস শর্ব্বরী সদা হাসিয়া হাসিয়া,
যেখানে বেড়াবে হাঁটি,
আমার দেহের মাটি,
সে মাটিতে, বিধুমুখি, রহিবে মিশিয়া।

“যে জলেতে স্নান কর, সেই জলে জল
আমার দেহের যত,
হয়ে তব অনুগত,
পরশি শরীর তব হইবে শীতল।


“যে অনলে, প্রণয়িনি! কর লো রন্ধন,
দেহের অনল মোর,
হরষে হইয়া ভোর,—
হেরিবে, মিশিয়া তাতে এ বিধু-বদন।

“দেহের সমীর মম আনন্দিত হয়ে,
লাগিবে তোমার গায়;
আদর করিয়া হায়,
যথা পাবে পরিমল এনে দিবে বয়ে।

“আকাশে মিলিত হয়ে আকাশ আমার,
উন্মীলি সহস্র আঁখি,
তোমারে ঘেরিয়া থাকি,
দেখিবে লাবণ্যরাশি সুধার আধার।”

পতির আদরে সতী মনে মনে হাসে;
অসীম আনন্দ রাশি,
বদন সরোজে আসি,
কোমল-অধরোপরি ঈষৎ প্রকাশে।


একেতো বিমল রূপ মুনি-মন রসে,
সুখের পীযুষ তায়,
দ্বিগুণ শোভা বাড়ায়,
কনক প্রতিমা যেন রসান পরশে!

দশনে অধর খানি ঈষদ দংশিয়া,
সুধামাখা হাসি হেসে
ভুবন মোহন বেশে,
ধরিল পতির গলা সোহাগ করিয়া।

কত যে আনন্দ রসে ললিতের মন,
সুখে দিতেছে সাঁতার,
পরি সে প্রেমের হার,
যে হার করিয়া ছিল বিরহে ছেদন!

ভুবন ভামিনী নারী গুণবতী হলে,—
যে সুখ পতির মনে
উপজে রে ক্ষণে ক্ষণে,—
রসিক প্রেমিক হলে রসে যায় গলে।


একেতো সুধাংশুমুখী প্রমোদ-কামিনী;
তাতে প্রাণপতি-তরে,
এসেছেন সমাদরে,
তৃষিত চাতকী সম হয়ে প্রেমাধিনী।–

এই দুই আনন্দেতে ললিত মোহন,
হেসে ঢলে পড়ে গায়,
দ্বিগুণ স্নেহ জানায়,
গলাগলি ভালবাসা না হয় বর্ণন।

প্রমোদ ক্ষীরের নদী ললিত-সাগরে,
ভ্রমি নানা দেশে দেশে,
মিলেছে মিশেছে এসে,
সোণায় সোহাগা আজ! সুধা সুধাকরে।

উভয়ের মনোসাধে উভয়ের আশ,
(এত বিমোহিত সুখে!)
বলিতে না পারে মুখে,
কিন্তু অনিমেষ আঁখি করিছে প্রকাশ।


সুখের তরঙ্গ আজি সুখের সাগরে,
সুখের হিল্লোলে নড়ে,
সুখে উথলিয়া পড়ে,
ছড়া ছড়ি সুখ-সুধা বহু দিন পরে।

এ রূপে ললিত লয়ে প্রমোদকামিনী,
থাকি এই পূত স্থানে,
প্রণয় পীযূষ-পানে,
নব নব সুখে সুখী দিবস যামিনী।

সম্পূর্ণ।


Printed by I. C. Bose & Co., Stanhope Press, 249, Bow-Bazar Road, Calcutta, for the Author and Publisher.

  1. বিরহ-সিন্ধু।
  2. কমনীয়।

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।