প্রহাসিনী/মিলের কাব্য

মিলের কাব্য

নারীকে আর পুরুষকে যেই মিলিয়ে দিলেন বিধি
পদ্য কাব্যে মানবজীবন পেল মিলের নিধি।
কেবল যদি পুরুষ নিয়ে থাকত এ সংসার
গদ্যকাব্যে এই জীবনটা হ’ত একাক্কার।
প্রোটন এবং ইলেকট্রনের যুগল মিলনেই
জগৎটা যে পদ্য তাহার প্রমাণ হল সেই।
জলে এবং স্থলে মিলে ছন্দে লাগায় তাল,
আকাশেতে মহাগদ্য বিছান মহাকাল।
কারণ তিনি তপস্বী যে- বিশ্ব তাঁহার জ্ঞানে,
প্রলয় তাঁহার ধ্যানে॥


সৃষ্টিকার্যে আলো এবং আঁধার
অনন্তকাল ধুয়ো ধরায় মিলের ছন্দ বাঁধার।
জাগরণে আছেন তিনি শুদ্ধ জ্যোতির দেশে,
আলো-আঁধার-’পরে তাঁহার স্বপ্ন বেড়ায় ভেসে।
যারে বলি বাস্তব সে ছায়ার লিখন লিখা,
অন্তবিহীন কল্পনাতে মহান মরীচিকা।
দিদিমণি, বাস্তব নও নিশ্চয় তা জেনো।
বিশ্বকবির স্বপ্ন বললে রাগ কোরো না যেন॥

বাস্তব যে অচল অটল — বিশ্বকাব্যে তাই
তড়িৎকণার নৃত্য আছে, বাস্তব তো নাই।
গোলাপগুলোর পাপড়ি চেয়ে শোভাটাই যে সত্য,
কিন্তু শোভা কী পদার্থ কথায় হয় না কথ্য।
বিশুদ্ধ ইঙ্গিত সে মাত্র, তাহার অধিক কী সে—
কিসের বা ইঙ্গিত সে জিনিস ভেবে কে পায় দিশে।
নিউস্‌পেপার আছে, পাবে প্রমাণযোগ্য বাক্য—
মোকদ্দমার দলিল আছে ঠিক কথাটার সাক্ষ্য।
কাব্য বলে বেঠিক কথা, এক হয়ে যায় আর-
যেমন বেঠিক কথা বলে নিখিলসংসার।
আজকে যাকে বাষ্প দেখি কালকে দেখি তারা—
কেমন ক'রে বস্তু বলি! প্রকাণ্ড ইশারা৷
ফোটা ঝরার মধ্যখানে এই জগতের বাণী
কী যে জানায় কালে কালে স্পষ্ট কি তা জানি।
বিশ্ব থেকে ধার নিয়েছি তাই আমরা কবি—
সত্যরূপে ফুটিয়ে তুলি অবাস্তবের ছবি।
ছন্দ ভাষা বাস্তব নয়, মিল যে অবাস্তব–
নাই তাহাতে হাট-বাজারের গদ্য-কলরব।
হাঁ-য়ে না-য়ে যুগল নৃত্য কবির রঙ্গভূমে।
এতক্ষণ তো জাগায় ছিলুম, এখন চলি ঘুমে॥

উদয়ন। শান্তিনিকেতন

২০ জানুয়ারি ১৯৪১

[৭ মাঘ ১৩৪৭] প্রাতে