প্রাকৃতিকী/লর্ড কেলভিন্

লর্ড কেল্‌ভিন্‌

লর্ড কেল্‌ভিন্

মানুষ কখনই চিরজীবী হয় না। সুতরাং অশীতিপর বৃদ্ধ লর্ড কেল্‌ভিন্ তাঁহার সুদীর্ঘ জীবন ও অপরিমেয় শক্তিকে বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে নিঃশেষে ব্যয় করিয়া জীবনের সন্ধ্যায় যখন বিশ্রামের আয়োজন করিতেছিলেন, তখন মৃত্যু যদি তাঁহাকে তাহার শান্তিময় উদার ক্রোড়ে টানিয়া লইয়া থাকে, তবে তাহাতে বিস্ময় বা ক্ষোভের কারণ নাই। দুঃখের বিষয় এই যে, ডারুইন, ম্যাক্সওয়েল, হক্সলি ও টিন্‌ডাল্’ প্রভৃতির মৃত্যুর পরও অতীত ও বর্ত্তমানের চিন্তা ও ভাবের মধ্যে যে নিগূঢ় বন্ধন রক্ষা হইয়া আসিতেছিল, লর্ড কেল্‌ভিনের মৃত্যুতে বুঝি বা তাহা ছিন্ন হইয়া যায়। নানা শাখাপ্রশাখাবিশিষ্ট বিজ্ঞানকে সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রাখা যেমন এক মহাদোষ, বাহিরের নানা অবান্তর ব্যাপার ও আবর্জ্জনাকে তাহার ভিতরে স্থান দেওয়াও ততোধিক মহাদোষ। লর্ড কেল্‌ভিনের নেতৃত্বে ইংলণ্ডে বিজ্ঞান এপর্য্যন্ত নিষ্কলুষ ছিল। এই মহারথীর অভাবে সার্ অলিভার লজ্ প্রমুখ নব্য নেতাদিগের দ্বারা ইংলণ্ডের পরীক্ষাগারে মার্কিনভূতের আবির্ভাব অসম্ভব হইবে না। এই ভৌতিক নৃত্যে নিউটন্ হার্সেলের কর্ম্মক্ষেত্র ইংলণ্ডের পূর্ব্ব পবিত্রতা ও মহিমা কতদুর অক্ষুণ্ণ থাকিবে, তাহা এখন নিশ্চয়ই চিত্তার বিষয় হইয়া দাঁড়াইবে।

 রাজার মৃত্যুতে রাজসিংহাসন শূন্য থাকে না, এবং ব্যূহবদ্ধ সমাজে অধিনায়কের অভাব হইলে, অধিনায়ক আপনা হইতে আসিয়া শূন্যস্থান অধিকার করে। কিন্তু লর্ড কেল্‌ভিনের মত রাজা ও অধিনায়ক কোথায়? যে সাধারণ শাস্ত্রজ্ঞান ও কার্য্যকুশলতার অপূর্ব্ব সম্মিলন লর্ড কেল্‌ভিন্‌কে বৈজ্ঞানিকসমাজের নেতৃত্ব দিয়াছিল, ইংলণ্ডে কোন পণ্ডিতেই ত তাহা দেখা যাইতেছে না। আধুনিক বিজ্ঞানকে যাঁহারা নিজের হাতে গড়িয়া মহিমাময় করিয়াছেন, অতি অল্পদিনের মধ্যে আমরা তাঁহাদের তিন চারিটিকে হারাইয়াছি। রসায়নবিৎ মেণ্ডেলিফ্ এবং ফরাসী পণ্ডিত কোরি ও বাঁৎলোর মৃত্যুতে য়ুরোপের বিভিন্ন দিক্ হইতে সত্যই এক একটি দিক্‌পালের পতন হইয়াছে। লর্ড কেল্‌ভিনের মৃত্যুতে য়ুরোপের আর এক দিক্ হইতে যে, আর একটি দিক্‌পালের পতন হইল, তাহা অবশই স্বীকার করিতে হইবে।

 লর্ড কেল্‌ভিন ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতাও একজন সুপণ্ডিত লোক ছিলেন। গ্লাস্‌গো বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুকাল গণিতের অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকিয়া ইনিও সুষশ অর্জ্জন করিয়াছিলেন। এই প্রকার পিতার তত্ত্বাবধানে থাকিয়া পুত্র যে সুশিক্ষিত হইবেন তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? কেল্‌ভিন্ দশ বৎসর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া একুশ বৎসরে কেম্‌ব্রিজের শেষ পরীক্ষায় উপস্থিত হইয়াছিলেন, এবং পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া বহু সম্মানে ভূষিত হইয়াছিলেন। এই সময়ে জড়তত্ত্বের গবেষণার উপযোগী ভাল পরীক্ষাগার ইংলণ্ডে মোটেই ছিল না। কেম্‌ব্রিজের অবস্থা তখনো খুব শোচনীয়। নিউটনের সময়ে পরীক্ষাগারের অবস্থা যে প্রকার ছিল, তাহার তখনকার অবস্থা প্রায় তদ্রূপই রহিয়া গিয়াছিল। ফরাসী পণ্ডিতদিগের সুযশ এই সময়ে জগৎময় পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। যুবক কেল্‌ভিন তাঁহার সেই অদম্য জ্ঞানলিপ্সায় চালিত হইয়া বিজ্ঞানের সেই কেন্দ্রের দিকে ছুটিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ফরাসী বৈজ্ঞানিক রেনো (Regnanlt) তখন পূর্ণ উদ্যমে জলীয় বাষ্পের তাপরক্ষার ব্যাপার লইয়া গবেষণায় নিরত। লর্ড কেল্‌ভিন্ ইঁহারি অধীনে কিছুদিন পরীক্ষাগারের কাজকর্ম্ম শিক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সে তাঁর আর অধিক দিন থাকা হইল না। এক বৎসরেরর মধ্যে স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাকে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়বিজ্ঞানের অধ্যাপনার ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। সেই সময় হইতে সুদীর্ঘ ৫৩ বৎসরকাল লর্ড কেল্‌ভিন্ ঐ অধ্যাপকের কাজেই নিযুক্ত ছিলেন, এবং যে সকল মহাবিষ্কার ইঁহাকে অমরত্ব দিবার উপক্রম করিয়াছে, তাহার অধিকাংশই তিনি গ্লাস্‌গোর অধ্যাপকের আসন হইতে জগতে প্রচার করিয়াছিলেন। গত অর্দ্ধ শতাব্দী ধরিয়া এক কেল্‌ভিনেরই জন্য গ্লাস্‌গো বিশ্ববিদ্যালয় বৈজ্ঞানিক জগতের এক মহাতীর্থ হইয়া দাড়াইয়াছিল।

 লর্ড কেল্‌ভিন্ অধ্যাপকজীবনের প্রারম্ভেই তাঁহার অসাধারণ প্রতিভা ও সূক্ষ্মদর্শনের পরিচয় দিয়াছিলেন। এই সময়ে ভূতত্ত্ববিদ্‌গণ ভূগর্ভস্থ শিলাস্তরের উৎপত্তিকাল নিরূপণ করিয়া পৃথিবীর বয়ঃকাল নির্দ্ধারণের চেষ্টা করিতেছিলেন। ইঁহারা হিসাব করিয়া দেখাইতেছিলেন, পৃথিবী সহস্র কোটী বৎসরেরও অনেক পূর্ব্বে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। লর্ড কেল্‌ভিন্ এই গণনার বিরুদ্ধে ঘোর প্রতিবাদ আরম্ভ করিয়াছিলেন, এবং তাপক্ষয় দ্বারা এখনকার শীতল অবস্থায় আসিতে পৃথিবী কত বৎসর অতিবাহন করিয়াছে তাহা স্থির করিবার জন্য গণনা আরম্ভ করিয়াছিলেন। গণনায় পৃথিবীর বয়স দশকোটী বৎসরের অধিক হইল না। এই ব্যাপার অবলম্বন করিয়া ভূতত্ত্ববিদ্‌গণের সহিত লর্ড কেল্‌ভিনের অনেক তর্কবিতর্ক চলিয়াছিল, এবং শেষে কেল্‌ভিনই জয়যুক্ত হইয়াছিলেন। লোকে বুঝিয়াছিল, লর্ড কেল্‌ভিন্ সাধারণ অধ্যাপক নহেন!

 তাপ ও কার্য্যের যে নিগূঢ় সম্বন্ধ (Thermodynamics) আজ বিজ্ঞানজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেরই নিকট সুপরিচিত, লর্ড কেল্‌ভিন্‌ই তাহার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মেয়ার, জুল ও কার্নো (Curnot) প্রভৃতির সহিত লর্ড কেল্‌ভিন্‌ও এই আবিষ্কারে সমান যশোভাক্ বলিয়া মনে হয়। ইহা ছাড়া তাপসম্বন্ধীয় আরো অনেক গবেষণা ও আবিষ্কারে ইনি অসাধারণ প্রতিভার অনেক পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ তাঁহার বৈদ্যুতিক গবেষণাতেই বিশেষরূপে প্রত্যক্ষ করা গিয়াছিল। ১৮৫৫ সালে যখন সমুদ্রতলে টেলিগ্রাফের তার বসাইবার কল্পনা চলিতেছিল, লর্ড কেল্‌ভিন্ সেই সময়ে গণনা করিয়া দেখাইলেন, তারের দৈর্ঘ্য যতই অধিক হয় সঙ্কেত চলাচলে ততই বিলম্ব আসিয়া পড়ে। গণনার ফলে অনেকে হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন, এবং কেহ কেহ কেল্‌ভিনের গণনার প্রতিবাদ আরম্ভ করিয়াছিলেন। কেল্‌ভিন্ কাহারো কথায় কর্ণপাত করেন নাই। তড়িৎপ্রবাহের অত্যল্প পরিবর্ত্তন ধরিবার উপযোগী কোনও যন্ত্র উদ্ভাবন করিবার জন্য তিনি মনঃসংযোগ করিয়াছিলেন। ইহাতে অতি অল্পদিন মধ্যে বার্ত্তাবহানের উপযোগী ভাল তার, এবং অতি সূক্ষ্ম তড়িৎবীক্ষণযন্ত্র (Mirror (Galvanometer) উদ্ভাবিত হইয়া পড়িয়াছিল। সমুদ্রপারে বার্ত্তাবহন যাঁহারা অসম্ভব মনে করিয়াছিলেন, কেল্‌ভিনের কৃতকার্য্যতায় তাঁহারা অবাক্ হইয়া পড়িয়াছিলেন। ইহা ছাড়া এই সময়ে লর্ড কেল্‌ভিন কর্ত্তৃক বিদ্যুৎ ও চুম্বক-সম্বন্ধীয় আরো অনেক যন্ত্র উদ্ভাবিত হইয়াছিল। অপর কোনও নূতন যন্ত্র অদ্যাপি সেই সকল পুরাতন যন্ত্রের স্থান অধিকার করিতে পারে নাই।

 পূর্ব্ব নৌচালনার উপযোগী ভাল দিগ্‌দর্শন যন্ত্রের বড় অভাব ছিল, এবং অভ্রান্তরূপে সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপেরও কোন সুব্যবস্থা ছিল না। লর্ড কেল্‌ভিন্ এই দুইটি ব্যাপার লইয়া অনেক পরীক্ষাদি করিয়াছিলেন। শুনা যায় এক দিগ্‌দর্শন যন্ত্রটিকেই নির্ভুল ও সুব্যবস্থিত করিতে তাঁহার পাঁচ বৎসর পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল! কিন্তু ইহার ফলে যে নূতন যন্ত্র পাওয়া গিয়াছে, তাহা অতুলনীয়। চলিষ্ণু জাহাজ হইতে সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপের উপযোগী যন্ত্রও এই সময়ে অতি সুকৌশলে নির্ম্মিত হইয়াছিল। অদ্যাপি এই দুই যন্ত্র প্রত্যেক জাহাজেই ব্যবহৃত হইতেছে।

 সুপ্রসিদ্ধ রসায়নবিৎ ডাল্‌টন্‌ (Dalton) কর্ত্তৃক আণবিক-সিদ্ধান্ত প্রচারিত হইলে, পদার্থবিশেষে অণুগুলি কি প্রকারে সজ্জিত থাকে এবং অণুর পরস্পর ব্যবধানই বা কি, জানিবার জন্য বৈজ্ঞানিকগণ উৎসুক হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু কোন বৈজ্ঞানিকই এই গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবার উপায় খুঁজিয়া পান নাই। লর্ড কেল্‌ভিন্‌ এ সম্বন্ধে গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রায় বাইশ বৎসর হইল এই গবেষণার ফল প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু আজও তাহার বিবরণী পাঠ করিলে কেল্‌ভিনের অত্যাশ্চর্য্য সূক্ষ্মদর্শন ও অসাধারণ গণিতজ্ঞান দেখিয়া অবাক না হইয়া থাকা যায় না। ঈথর-সাগরে অতি সূক্ষ্ম তরঙ্গ তুলিয়া আলোক যখন কাচ বা অপর কোনও স্বচ্ছপদার্থের ভিতর দিয়া বাহির হয়, তখন তাহার গতির দিকের পরিবর্ত্তন (Refraction) ঘটে। পদার্থস্থ অণুগুলিই বাধা দিয়া ঈথরতরঙ্গকে এই প্রকারে বাঁকাইয়া দেয় বলিয়া জানা ছিল। লর্ড কেল্‌ভিন্ আলোকবিশেষের তরঙ্গের দৈর্ঘ্য এবং তাহার গতির দিক্ পরিবর্ত্তনের মাত্রা অতি সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করিয়া, পদার্থের অণুর আয়তন নির্দ্ধারণের এক সুন্দর উপায় নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন। তা’ ছাড়া কৈশিকাকর্ষণের (Capillary Attraction) সাহায্য লইয়াও তিনি অণুর আয়তন নির্দ্ধারণের আর একটি নূতন উপায় আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এক ইঞ্চিকে আড়াই লক্ষ সমানভাগে বিভক্ত করিলে যে এক অতি সূক্ষ্ম দৈর্ঘ্য পাওয়া যায়, এই হিসাবে পদার্থের অণুগুলির ব্যাস তাহা অপেক্ষাও ক্ষুদ্রতর বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছিল। লর্ড কেল্‌ভিনের এই সূক্ষ্ম গণনা লইয়া অনেকে পরবর্ত্তী কালে অনেক নাড়া চাড়া করিয়াছেন, কিন্তু গণনার অণুমাত্র ভুল পাওয়া যায় নাই। সকল দেখিয়া মনে হয়, এ প্রকার সূক্ষ্ম গণনা কেল্‌ভিনের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁহার অসীম অধ্যবসায় ও অত্যাশ্চর্য্য গণিতজ্ঞান তাঁহার প্রত্যেক গবেষণাকে সাফল্য দিয়াছে।

 লর্ড কেল্‌ভিনের প্রধান গবেষণাগুলির মধ্যে কেবল দুই একটি উল্লেখ করা গেল মাত্র। ইহা ছাড়া তিনি আরো যে সকল গবেষণা করিয়াছেন তাহার গুরুত্ব ও সংখ্যা এত অধিক যে, তাহাদের বিশেষ বিবরণ দিতে হইলে একখানি প্রকাণ্ড গ্রন্থ হইয়া দাঁড়ায়। পঞ্চাশ বৎসরে তিনি নানা বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রায় তিনশত প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন! বলা বাহুল্য, প্রত্যেক প্রবন্ধই এক এক নূতন তত্ত্বের অবতারণা করিত। জড়বিজ্ঞানের কোন শাখাই তাহার গবেষণা হইতে বাদ পড়ে নাই। জড়ের উৎপত্তিতত্ত্ব প্রভৃতি কঠিন গাণিতিক ব্যাপার হইতে আরম্ভ করিয়া জলের কল প্রস্তুত করা প্রভৃতি ব্যাবহারিক বিজ্ঞানের ক্ষুদ্র অংশগুলিও তাঁহার চিন্তার বিষয় ছিল। সকল বিজ্ঞানেই তিনি এ প্রকার ছাপ রাখিয়া গিয়াছেন যে, তাহা আর মুছিবার নহে। বিধাতা যেমন তাঁহার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আশীর্ব্বাদগুলি দ্বারা ভূষিত করিয়া কেল্‌ভিন্‌কে জগতে পাঠাইয়াছিলেন, জগতের লোকও সেই সকল আশীর্ব্বাদের সমুচিত সম্মান দেখাইতে ভুলে নাই। মান ও ঐশ্বর্য্য অযাচিতভাবে তাঁহার দ্বারস্থ হইয়াছিল। দরিদ্র অধ্যাপকের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করিয়া তিনি লর্ড উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, এবং দেশবিদেশের বিখ্যাত বিদ্বৎসমাজমাত্রেই তাহাদের শ্রেষ্ঠ উপাধিগুলি কেল্‌ভিন্‌কে দান করিয়া আপনাদিগকে গৌরবান্বিত মনে করিয়াছিল।

 প্রাচীন বৈজ্ঞানিকদিগের জীবনের ইতিহাস আলোচনা করিলে একটা বুহৎ ব্যাপার আপনা হইতেই আমাদের নজরে পড়ে। মনে হয়, অনেক প্রাচীন বৈজ্ঞানিকই তাঁহাদের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলিকে মানুষের প্রাত্যহিক কার্য্যে লাগাইতে যেন ঘৃণা বা অপমান জ্ঞান করিতেন। বড় বড় প্রাচীন বৈজ্ঞানিকগণ তাঁহাদের জীবনের নানা কার্য্যে যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় প্রদান করিয়াছেন, তাহা দ্বারা হাতেকলমে কাজ করার কৌশল তাঁহারা অতি সহজেই আয়ত্ত করিতে পারিতেন। সুতরাং ঐ ভাবটা তাঁহাদের বুদ্ধির জড়িমাপ্রসূত নয়। কাজেই স্থানকালপাত্রের এক অদ্ভুত সম্মিলনজাত ঘৃণা বা অপমানবোধকেই তাহার উৎপত্তি বলিতে হয়। কথিত আছে মার্সিলসের (Marcellus) এর নৌবাহিনী সিরাকিউসের বিরুদ্ধে পরিচালিত হইতেছে জানিয়া, সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস্ অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সহিত বলিয়াছিলেন, তাঁহার নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রের তুলনায় নৌবাহিনীর ব্যবস্থা অতি তুচ্ছ। বলা বাহুল্য আর্কিমিডিসের নৌ-চালনযন্ত্র তখন প্রস্তুতই হয় নাই, কেবল কাগজেকলমে তাহার উপযোগিতা দেখিয়া, তিনি মার্সিলসের নৌবাহিনীকে অকিঞ্চিৎকর সাব্যস্ত করিয়াছিলেন। ইঁহারি অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞানকে কাজে লাগাইবার জন্য রাজা হায়রোকে (Hiero) কত কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছিল, পাঠক তাহার গল্প অবশ্যই শুনিয়াছেন। ইউডক্সস্ (Eudoxus) ও আকাইটাস্ নামক দুইজন প্রাচীন পণ্ডিত সর্ব্বপ্রথমে জ্যামিতিকে ব্যাবহারিক জ্যামিতিতে পরিণত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কাজেই জ্যামিতিকে পুঁথির পাতা হইতে বাহির হইয়া মুটে মজুর ও কলকারখানার ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইতে হইয়াছিল। জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত প্লেটো তখন জীবিত ছিলেন। এ পর্য্যন্ত যে শাস্ত্র কেবল পণ্ডিতমণ্ডলীরই সম্পত্তি ছিল, তাহার এই দুর্দশা তাঁহার সহ্য হয় নাই। প্লেটো পরুষ ভাষায় ঐ স্বেচ্ছাচারীদিগকে ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের জীবনে এই দুঃসহ পাণ্ডিত্যাভিমান এখন আর মোটেই নাই। ইঁহারা একাধারে কঠোর তপস্বী ও অক্লান্তকর্মী।

 লর্ড কেল্‌ভিনের জীবনে বৈজ্ঞানিকদিগের এই আধুনিক আদর্শটি সম্পূর্ণ ফুটিয়া উঠিয়াছিল। জড়তত্ত্বের অতি গূঢ়রহস্যের সুমীমাংসার জন্য তাঁহাকে ধ্যানমগ্ন মুনির ন্যায়ই গবেষণানিরত দেখা যাইত, এবং স্বাবিষ্কৃত তত্ত্বগুলিকে সাংসারিক কাজে লাগাইবার সময় তিনি সাধারণ শ্রমজীবীরই মত অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করিতেন। বাঁৎলো, ল্যাংলে ও টিন্‌ডাল্ প্রভৃতি অনেক স্বনামখ্যাত বৈজ্ঞানিক তাঁহাদের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলিকে স্বহস্তে নানা কার্য্যে লাগাইয়া মানুষের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করিয়াছেন সত্য, কিন্তু এ বিষয়ে বোধ হয় কেহই লর্ড কেল্‌ভিনের সমকক্ষ হইতে পারেন নাই। নব নব যন্ত্র উদ্ভাবন করিয়া ইনি জগতের যে উপকার সাধন করিয়াছেন, তাহা প্রকৃতই অতুলনীয়।

 আত্মশক্তির উপর সন্দেহ ও বিশ্বাসের শিথিলতা মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রধান অন্তরায়। ইহারা ঘাড়ে চাপিলে মানুষ কোনক্রমে মাথা তুলিতে পারে না। লর্ড কেল্‌ভিনের জীবন আলোচনা করিলে দেখা যায় তিনি এই দুই শত্রুকে সম্পূর্ণ জয় করিয়াছিলেন, এবং জয় করিয়াছিলেন বলিয়াই তিনি জগতে অমরত্ব লাভ করিতে পারিয়াছেন। ছাত্রগণকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিবার সময় লর্ড কেল্‌ভিন্ শাস্ত্রে অটল বিশ্বাস স্থাপনের জন্য প্রায়ই উপদেশ দিতেন। কোন ছাত্র তাঁহার কোন উক্তিতে অবিশ্বাস করিলে তিনি বোর্ডের দিকে অঙ্গুলি হেলাইয়া বলিতেন, “এই উক্তি আমার নয়, যে শাস্ত্রকে মানুষ প্রথম জ্ঞানোন্মেষের দিন হইতে অভ্রান্ত বলিয়া জানিয়া আসিয়াছে, সেই গণিতশাস্ত্রই তোমাদিগকে বিশ্বাস করিতে বলিতেছে।”

 আজ কয়েক বৎসর হইল, কোন বৈদ্যুতিক গবেষণা করিতে গিয়া লর্ড কেল্‌ভিন্ দেখিয়াছিলেন যে, যে তড়িৎপ্রবাহের স্পর্শে প্রাণীর জীবন সংশয় হয়, অবস্থাবিশেষে দেহের ভিতর দিয়া তাহা অপেক্ষা প্রবলতর প্রবাহ চালাইলে প্রাণীর কোনই অনিষ্ট হয় না। এই প্রকার একটা ব্যাপারে তিনি প্রথমে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারেন নাই। কিন্তু পুনঃপুনঃ গণনা করিয়া যখন হিসাবের ভুল বাহির হইল না, তখন আর তিনি ইহাতে অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। ছাত্রমণ্ডলীকে ইহার পরীক্ষা করিবার জন্য আহ্বান করিলেন, কিন্তু এই জীবনসংশয় পরীক্ষার জন্য কেহই প্রস্তুত হইতে পারিলেন না। শেষে বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক দৃঢ়পদে দাঁড়াইয়া অবিচলিত চিত্তে নিজের শরীরের ভিতর দিয়া প্রবল বিদ্যুতের প্রবাহ চালাইয়া দিলেন! প্রবাহ তাঁহার শরীরে একটুও বৈদনা দিল না। ছাত্রমণ্ডলীকে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিলেন,—“তোমরা কখনো বৈজ্ঞানিকতত্ত্ব ও গণিতের মূলসূত্রগুলিতে অবিশ্বাস করিও না। এই অবিশ্বাসই কৃতিত্ব লাভের প্রধান অন্তরায়।” এই অটল বিশ্বাসই কেল্‌ভিন্‌কে এত বড় করিয়াছিল।