প্রাচীন ভারতে নারী/আদর্শ ও অধিকার

আদর্শ ও অধিকার

 নর ও নারী এই দুই লইয়াই মানব-সংসার। যতদিন মানুষের সৃষ্টি, ততদিন এইভাবেই চলিয়া আসিতেছে। শ্রুতি বলেন, আদিতে একমাত্র পরমপুরুষ ছিলেন একা। একা-একা তাঁহার ভালো লাগিল না—

স বৈ নৈব রেমে। বৃহদারণ্যক ১.৪.৩

 তখন সেই প্রজাপতি নিজেকে দুই ভাগে বিভক্ত করিলে পুরুষ ও নারীর উৎপত্তি হইল। সেই পুরুষ প্রকৃতিই আদি পতি ও পত্নী—

স ইমমেবাত্মানং দ্বেধা পাতয়‍ৎ
ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবতাম্। বৃহদারণ্যক ১.৪.৩

তাই শ্রুতি বলিলেন, এই যে জায়া তিনি নিজেরই অর্ধ ভাগ—

অর্ধো হ বা এষ আত্মনো যজ্ জায়েতি।

 পুরুষ ও নারী একই পরমপুরুষের দুই ভাগ। এককে বাদ দিয়া অন্যে অসম্পূর্ণ। যে সমাজ নারীকে জ্ঞানহীন করিয়া শুধু পুরুষকেই শক্তিশালী করিতে চায় বা পুরুষকে পঙ্গু করিয়া শুধু নারীকেই প্রবল করিতে চায় তাহারা পরম-পুরুষের এক অর্ধেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত করিয়া তাঁহার অংশমাত্র লইয়া অগ্রসর হইতে চাহে। শাস্ত্রে আছে, রথের দুই চাকা, তাদের একটিকে বাদ দিয়া আর-একটিমাত্র চাকা লইয়া রথ চলিতে পারে না—

যথা হ্যেকেন চক্রেণ ন রথস্য গতির্ভবেৎ।

 মহাভারতের যুগেও নারীদের এই সম্মানের কথা দেখিতে পাই। মহাভারত (আদি ৭৪.৪১) বলেন, মানুষের আধখানাই তার পত্নী। স্বামী ও স্ত্রী দুই যুক্ত না হইলে পরিপূর্ণ সাধনা হইবে কেমন করিয়া?

 নরনারী উভয়ের প্রাণশক্তিতেই ভারতের সাধনা দিনে-দিনে অগ্রসর হইতেছিল। যেদিন হইতে নারীর সাধনাকে পঙ্গু করিয়া ভারতীয় সাধনা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইল সেইদিন হইতে ভারতের সাধনার ইতিহাস নানা শোচনীয় দুর্গতিতে ভরিয়া উঠিল।

 ঋগ্বেদে দেখি নববধূকে আশীর্বাদ করিয়া ঋষি বলিতেছেন, শ্বশুর শাশুড়ী ননদ দেবর সকলেরই কাছে তুমি সম্রাজ্ঞী হও—

সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব সম্রাজ্ঞী শ্বশ্র্বাং ভব
ননান্দরি সম্রাজ্ঞী সম্রাজ্ঞী অধি দেবৃষু। ঋগ্বেদ ১০.৮৫.২৬

আপন সংসারের রানী হইয়া তুমি তোমার সংসারে প্রবেশ কর—

গৃহান্ গচ্ছ গৃহপত্নী যথাসো। ঋগ্বেদ ১০.৮৫.২৬

এই সংসারকে পরিচালনা করিবার জন্য সদা সাবধানে জাগিয়া থাক—

অস্মিন্ গৃহে গার্হপত্যায় জাগৃহি। ঋগ্বেদ ১০.৮৫.২৭

 তাই ঘরে-ঘরে বধূকে ‘সুমঙ্গলী’ বলিয়া স্বাগত করা হইয়াছে। সকলের কাছে নববধূর সৌভাগ্য-আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হইয়াছে—

সুমঙ্গলীরিয়ং বধূরিমাং সমেত পশ্যত।
সৌভাগ্যমস্যৈ দত্তয়াথাস্তং বি পরেতন। ঋগ্বেদ ১০.৮৫.৩৩

 নববধূর প্রতি তাঁহাদের আশীর্বাদ ছিল, ইন্দ্রাণীর ন্যায় নিত্য শোভনবোধনে প্রবুদ্ধা হইয়া জ্যোতির্মুকুটভূষণা উষার সঙ্গে তুমি নিত্য প্রতিজাগরিতা থাকিও—

ইন্দ্রাণীব সুবুধা বুধ্যমানা। জ্যোবিরগ্রা উষসঃ প্রতি জাগরাসি। অথর্ব ১৪.২.৩১

 বধূকে সম্রাজ্ঞী হইতে আশীর্বাদ করার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাজ্ঞী হইবার উপায়ও বলা হইয়াছে। নদী তো অনেকই আছে, কিন্তু সিন্ধুই আপন দাক্ষিণ্য ও উদারতার গুণে সকলের প্রধান হইয়াছে; তুমিও পতিগৃহে গমন করিয়া আপন মহত্ত্ব ও দাক্ষিণ্য-গুণে সম্রাজ্ঞীর পদলাভ করিও—

যথা সিন্ধুর্নদীনাং সাম্রাজ্যং সুষুবে বৃষা।
এবা ত্বং সম্রাজ্ঞ্যেধিপত্যুরস্তং পরেত্য। অথর্ব ১৪.১.৪৩

 সকলের মধ্যে দাক্ষিণ্য ও কল্যাণ বিতরণ করিতে হইলে নারীকে পঙ্গু করিয়া রাখা চলিবে না।

 এই তো হইল বৈদিক যুগের আদর্শের কথা। কথা হইল, সামাজিক ইতিহাসে আমরা এই আদর্শকে অনুসৃত দেখিতে পাই কি না। বৈদিক যুগের পরে ক্রমে নারীদের অধিকার অনেক বিষয়ে যে সংকুচিত হইয়া আসিয়াছে তাহার কারণ সন্ততিলাভের জন্য বাধ্য হইয়া আর্যগণ শূদ্রকন্যাদের বিবাহ করিতেন। কন্যা কম ছিল বলিয়াই হউক, বা শীঘ্র শীঘ্র বংশবিস্তার করিবার জন্যই হউক, আর্যগণের মধ্যে শূদ্রকন্যাকে বিবাহ করার প্রথা বিলক্ষণ প্রচলিত হইল। তাই যেসব অধিকার আর্যকন্যাগণ পাইতেন সেইসব অধিকার পরে শূদ্রকন্যাদের হয়তো দেওয়া হইত না। ক্রমে এইসব কারণে ভারতে নারীদেরই অধিকার কমিয়া আসিতে লাগিল। এখন তো ব্রাহ্মণকন্যা ব্রাহ্মণের পত্নী হইয়াও শূদ্রারই সমতুল্যা। বেদাদিতে তাঁহাদের অধিকার নাই। বলা বাহুল্য, পূর্বকালে এইসব শূদ্রকন্যার গর্ভে ব্রাহ্মণের পুত্রেরা ব্রাহ্মণই হইতেন। তাহা প্রসঙ্গান্তরে দেখানো হইয়াছে।

 মহাভারতের যুগেই নারীদের অনেক অধিকার সংকুচিত, নারীদের চরিত্রের বিরুদ্ধে বহু কথা আলোচিত দেখিতে পাই। তবু মহাভারতের ইতিহাসের মধ্যে নারীদের গৌরবেরও বহু সাক্ষ্য রহিয়া গিয়াছে। জায়াকে মাতৃবৎ সম্মানার্হা মনে করিবে—

ভার্যাং নরঃ পশ্যেন্‌মাতৃবৎ। আদি ৭৪.৪৮

 স্ত্রীগণ যেখানে পূজিতা, সেখানে দেবতারা সুখী। যেখানে নারীগণ অপূজিতা সেখানে সমস্ত ক্রিয়া নিষ্ফল—

স্ত্রিয়ো যত্র চ পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
অপূজিতাশ্চ যত্রৈতাঃ সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ। অনুশাসন ৪৬.৫.৬

 নারীগণ পূজনীয়া, মহাভাগা, পুণ্যা ও সংসারের দীপ্তিস্বরূপা। তাঁহারাই সংসারের শ্রী, তাই যত্নপূর্বক তাঁহারা রক্ষণীয়া—

পূজনীয়া মহাভাগাঃ পুণ্যাশ্চ গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়ো গৃহস্যোক্তাস্তস্মাদ রক্ষ্যা বিশেষতঃ। উদ্যোগ ৩৮, ১১

 কেহ কেহ বলিবেন, নারীদের প্রতি এইসব কথা শুধু ভাবুকতা মাত্র। আসলে নারীরা দাসী মাত্র। কিন্তু তাঁহাদের মনে রাখা উচিত, তাহা হইলে তাঁহারাই হইলেন দাসীপুত্র। সংস্কৃতে ইহার চেয়ে ঘৃণ্য গালি আর নাই। সংস্কৃত নাটকগুলিতে অতি ইতরজনের প্রতি ইতরজনোচিত চরম গালাগালি হইল ‘দাস্যাঃ পুত্রঃ’। পত্নীভাবে দেখিলেও নারীদের বড় পরিচয় তাঁহাদের মাতৃত্বে। ‘জায়া’ কথার অর্থ পত্নী হইলেও তাহার মধ্যে মাতৃত্বই প্রধান কথা। যাঁহার মধ্যে নিজে জন্মগ্রহণ করা যায় তিনিই জায়া, অর্থাৎ মাতৃরূপই নারীদের যথার্থ স্বরূপ। নারীদের প্রতি ভদ্রব্যবহার করার কথা সংহিতাকারগণ সকলেই বলেন। অসংগত ভাষা বা অভদ্র ব্যবহারে পুরুষ যে নিন্দার্হ ও দণ্ডনীয় তাহা প্রায় সর্বসম্মত। এরূপ ক্ষেত্রে অপরাধীকে ভদ্রতার শিক্ষা দিতে হইবে, ইহাই ছিল রীতি। এই প্রসঙ্গে কৌটলীয় অর্থশাস্ত্রের ধর্মস্থীয় তৃতীয় অধ্যায়ে ঊনষষ্টিতম প্রকরণে ‘নগ্নে বিনগ্নে’ ইত্যাদি বচন দর্শনীয়।[]

 অথর্ববেদে দেখা যায়, পূর্বকালে কন্যারাও ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া পতিলাভ করিতেন—

ব্রহ্মচর্যেণ কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্। অথর্ব ১১.৭.১৮

 এখানে ভাষ্য বলেন, ‘অকৃতবিবাহা স্ত্রী ব্রহ্মচর্যং চরতি’। শুক্ল যজুর্বেদও কন্যাদের শিক্ষা-দীক্ষা সমর্থন করেন। এমনকি স্মৃতির যুগেও এই প্রথার স্মৃতি মুছিয়া যায় নাই। দেবণ্ণ ভট্টের স্মৃতি-চন্দ্রিকায় বিবাহকালে নারীদের বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করিবার ব্যবস্থা দেখা যায়—

বিবাহস্তু সমন্ত্রকঃ। সংস্কারকাণ্ড, স্ত্রীসংস্কার

 মনুর মতে দেখা যায় যে, বিবাহই স্ত্রীলোকের উপনয়ন—

বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ। ২.৬৭

 ইহা উদ্ধৃত করিয়াও দেবণ্ণ ভট্ট হারীতের মত উদ্ধৃত করিয়াছেন। হারীত (২১, ২৩) বলেন, নারীদের মধ্যে একদল ব্রহ্মবাদিনী, অন্যেরা সদ্যোবধূ। ব্রহ্মবাদিনীরা উপনয়ন, অগ্নীন্ধন, বেদাধ্যয়ন ও স্বগৃহে ভিক্ষাচর্যা পালন করিবেন। সদ্যোবধূদের বিবাহকালে কথঞ্চিৎ উপনয়ন মাত্র করিয়া বিবাহ করিতে হইবে—

দ্বিবিধাস্ত্রিয়ো ব্রহ্মবাদিন্যস্‌সদ্যোবধ্বশ্চ। তত্র ব্রহ্মবাদিনীনাম্ উপনয়নম্ অগ্নীন্ধনং বেদাধ্যয়নং স্বগৃহে চ ভিক্ষাচর্যেতি। সদ্যোবধূনাং চোপস্থিতে বিবাহে কথংচিদ্ উপনয়নমাত্রং কৃত্বা বিবাহঃ কার্যঃ।—স্মৃতিচন্দ্রিকা, সংস্কার কাণ্ড, স্ত্রী সংস্কার

 এই বিষয়ে কল্পান্তরাভিপ্রায় অর্থাৎ অন্যান্য স্মৃতির সমর্থন দিতে গিয়া তিনি যম হইতে উদ্ধৃত করেন, পুরাকালে নারীদেরও মৌঞ্জীবন্ধন অর্থাৎ উপনয়ন সংস্কার হইত। তাঁহাদের পক্ষে বেদের অধ্যাপন ও সাবিত্রীবচন বিহিত ছিল। তাঁহাদিগকে পিতা পিতৃব্য বা ভ্রাতা পড়াইতেন, অন্যেরা নহে। স্বগৃহেই তাঁহারা ভৈক্ষচর্যা করিতেন। তবে তাঁহারা অজিন চীর জটাধারণ বর্জন করিয়া চলিতেন—

পুরা কল্পে তু নারীণাং মৌঞ্জীবন্ধন মিষ্যতে।
অধ্যপনং চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা।
পিতা পিতৃব্যো ভ্রাতা বা নৈনামধ্যাপয়েৎ পরঃ।
স্বগৃহে চৈব কন্যায়া ভৈক্ষচর্যা বিধীয়তে।
বর্জয়েদজিনং চীরং জটাধারণমেব চ।

—স্মৃতিচন্দ্রিকা, সংস্কারকাণ্ড Mysore, G. O. L. S. p 62

 ঠিক এই বিধানই পরাশর মাধবে দেখা যায়। সেখানেও যম ও হারীত হইতে এই ব্যবস্থা উদ্ধৃত করা হইয়াছে।[]

 সাধনার ক্ষেত্রে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা পাইতেন। কেহ কেহ নারীদের এই অধিকার পছন্দ করেন নাই। মহাভারতে দেখা যায়, কুনির্গর্গ নামে এক মহাবীর্য ঋষি ছিলেন (শল্য ৫২.৩), তাঁহার কন্যা কঠোর তপস্যা করিয়াও পরমা গতি লাভ করিতে পারেন নাই। নারদ বলিলেন, হে অনঘে, তোমার বিবাহসংস্কার হয় নাই, তখন কেমন করিয়া পরমলোক লাভ হইবে?—

অসংস্কৃতায়াঃ কন্যায়াঃ কুতো লোকাস্তবানঘে। শল্য ৫২.১০

 তখন কন্যা বিবাহার্থিনী হইয়া তাঁহার তপস্যার অর্ধফল দিয়াও যে-কোনো বরকে প্রার্থনা করায় মুনি গালবি তাঁহাকে বিবাহ করিয়া একরাত্রি মাত্র তাহার সঙ্গে বাস করেন (শল্য ৫২.১৩-২২)। ৫২তম অধ্যায়ে এই কথা। অথচ মহাভারতে সেই পর্বের ৫৪তম অধ্যায়েই সাব্বী কৌমারব্রহ্মচারিণী তপঃসিদ্ধা তপস্বিনী ধৃতব্রতা শাণ্ডিল্যসুতার বহু প্রশংসা আছে—

অত্রৈব ব্রাহ্মণী সিদ্ধা কৌমারব্রহ্মচারিণী।
যোগযুক্তা দিবং যাতা তপঃসিদ্ধা তপস্বিনী
বভূব শ্রীমতী রাজন্ শাণ্ডিল্যস্য মহাত্মনঃ।
সুতা ধৃতব্রতা সাধ্বী নিয়তা ব্রহ্মচারিণী। শল্য ৫৪.৫-৭

 স্ত্রীলোক হইলেও তিনি ঘোর তপস্যা করিয়া স্বর্গে গেলেন এবং মহাভাগা সেই নারী দেবব্রাহ্মণ-পূজিতা হইয়া রহিলেন—

মা তু তৃপ্ত্বা তগো ঘোরং দুশ্চরং স্ত্রীজনেন হ।
গতা স্বর্গং মহাভাগা দেবব্রাহ্মণপুজিতা। শল্য ৫৪.৭-৮

 আবার অনুশাসনপর্বে অষ্টাবক্র মুনি উত্তরদেশে গিয়া তপস্বিনী মহাভাগা দীক্ষাধর্মপালনে রতা এক বৃদ্ধা নারীকে দেখিলেন—

তপস্বিনীং মহাভাগাং বৃদ্ধাং দীক্ষামনুষ্ঠিতাম্। অনুশাসন ১৯.২৪

 পরে এই কন্যাকে অষ্টাবক্র বিবাহ করিতে বাধ্য হইলেন, কারণ যত তপস্যাই থাকুক না কেন নারীদের পক্ষে তাহা যথেষ্ট নহে। বিবাহ নারীর অবশ্য ধর্ম।

 শান্তিপর্বে (৩২০. ৭) ‘স্থলভানাম ভিক্ষুকী’র কথা আছে। সেইখানে টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেন, স্ত্রীলোকদেরও বিবাহের পূর্বে বা বৈধব্যের পরে সন্ন্যাসে অধিকার আছে। তখন তাঁহারা ভিক্ষাচর্য, মোক্ষশাস্ত্রশ্রবণ একান্তে আত্মধ্যান ত্রিদণ্ডাদি ধারণ করিবেন— স্ত্রীণামপি প্রাগ্‌বিবাহাদ্ বৈধব্যাদূর্ধ্বং বা সন্ন্যাসে, অধিকারোঽস্তি ইতি দর্শিতম। তেন ভিক্ষাচর্যং মোক্ষশাস্ত্রশ্রবণম্ একান্তে আত্মধ্যানঞ্চ তাভিরপি কর্তব্যম্, ত্রিদণ্ডাদিকঞ্চ ধার্যম্।  এই সুলভার সঙ্গে রাজর্ষি ব্রহ্মবিত্তম জনকের গভীর যোগশাস্ত্রের কথা হয়।

 রামায়ণেও (আরণ্য ৭৪. ৩১) সিদ্ধা ধর্মসংস্থিতা শবরীর কথা আছে। তাঁহার রম্য আশ্রমে রাম গিয়াছিলেন (ঐ ৭৪.৪-৫)। সেই সিদ্ধা সিদ্ধসম্মতা বৃদ্ধা শবরী (ঐ ৭৪. ১০) রামকে স্বাগত করেন। সাধ্বী শংসিতব্রতা (ঐ ৭৪.৩১) জটাযুক্তা চীরকৃষ্ণাজিনাম্বরা শবরী (ঐ ৭৪. ৩২) জ্বলন্তপাবকসংকাশা হইয়া স্বর্গে গমন করিলেন (ঐ ৭৪. ৩৩.)।

 শ্রুতিতে ব্রাহ্মণগ্রন্থে দেখা যায়, পত্নীরা কটিতে মেখলা ধারণ করিতেন। তাঁহাদের পক্ষে ব্রহ্মচর্য বিহিত ছিল।[] কাত্যায়ন-শ্রৌতসূত্রে বৈদিককর্মে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের (অধিকারী-নিরূপণ, ১, ৬) বলিয়াই বলা হইয়াছে—ঠিক এইরূপই নারীরও অধিকার, তাহাতে কোনো বিশেষ নাই—

স্ত্রী চাবিশেষাৎ। ঐ ১.৭

আচার্য কর্ক তাঁহার ভাষ্যে কথাটা আরও ভালো করিয়া বলিয়াছেন; পরবর্তী সূত্রে কাত্যায়ন বলেন, নারীদের এই অধিকার সর্বত্র দেখা যায়—

দর্শনাচ্চ। ঐ ১.৮

ভাষ্যকার কর্ক এখানে বলেন, যজমানকে মেখলার দ্বারা দীক্ষা দেওয়া হয়, যোক্ত্রের দ্বারা পত্নীকে। পুরুষের সঙ্গেই তাঁহার অধিকার, পৃথক নয়। একই কাজে যেমন যজমানসাধ্য কৃত্য আছে তেমনি পত্নীসাধ্য কৃত্যও আছে।

 হারীতও যে নারীদের ব্রহ্মচর্য ও উপনয়নের অধিকার সমর্থন করিয়াছেন তাহা বুঝা যায় তাঁহার ‘প্রাগ্ রজসঃ সমাবর্তনম্’ কথাতে। বৃহদ্দেবতাতে দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৭২-৮১ শ্লোকগুলিতে ব্রহ্মবাদিনী ‘বাক্’এর কথাই বর্ণিত। ৮২, ৮৩ ও ৮৪ শ্লোকে বেদের কয়েকটি নারী-ঋষির কথা বলা হইয়াছে। তাঁহাদের নাম ঘোষা, গোধা, বিশ্ববারা, অপালা, উপনিষৎ, নিষৎ, জুহূনাম্নী ব্রহ্মজায়া, অগস্ত্যের ভগ্নী অদিতি, ইন্দ্রাণী, ইন্দ্রমাতা সরমা, রোমশা, উর্বশী, লোপামুদ্রা, নদীসকল, যমী, নারী শশ্বতী, শ্রী, লাক্ষা, সার্পরাজ্ঞী, বাক্, শ্রদ্ধা, মেধা, দক্ষিণা, সূর্যা ও সাবিত্রী। ইঁহারা সকলেই ব্রহ্মবাদিনী বলিয়া বিঘোষিত—

ঘোষা গোধা বিশ্ববারা অপালোপনিষন্‌নিষৎ।
ব্রহ্মজায়া জুহূর্ণাম অগস্তস্য স্বসাদিতিঃ। ২.৮২
ইন্দ্রাণী চেন্দ্রমাতা চ সরমা রোমশোর্বশী।
লোপমুদ্রাচ নদ্যশ্চ যমী নারী চ শশ্বতী। ২. ৮৩
শ্রীর্লাক্ষা সার্পরাজ্ঞী বাক্ শ্রদ্ধা মেধা চ দক্ষিণা।
রাত্রী সূর্যা চ সাবিত্রী ব্রহ্মবাদিন্য ঈরিতাঃ। ২. ৮৪

 বৃহদ্দেবতা ইঁহাদিগকে ‘ব্রহ্মবাদিনী’ বলিয়াই ঘোষিত করিলেন, সমাজেও তাঁহারা ব্রহ্মবাদিনী নামেই প্রখ্যাত ছিলেন। কাজেই নারীদের ব্রহ্মবাদিনী হওয়ার অধিকার তখনও ছিল।

 গোভিল-গৃহ্যসূত্রে (২.১. ১৯) একটি মন্ত্রে আছে— প্রাবৃতাং যজ্ঞোপবীতিনীম্। সেখানে ভাষ্যকার দেখাইয়াছেন, নারীদের যজ্ঞসূত্রধারণ প্রচলিত ছিল। হারীতও যে ইহা বৈধ বলিয়াছেন তাহা বুঝা যায় তাঁহার ‘প্রাগ্‌রজসঃ সমাবর্তনম্’ এই কথায়

 আপস্তম্ব নারীদের শিক্ষা সমর্থন করিয়াছেন।[]

 দুহিতাকে পণ্ডিতা করিবার ইচ্ছা থাকিলে (য ইচ্ছেদ্ দুহিতা যে পণ্ডিতা জায়েত) কি করিতে হইবে তাহারও বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৬.৪.১৭) ব্যবস্থা দিয়াছেন। এখানে মূলের উদারতাটুকু শাঙ্কর ভাষ্যে দেখা যায় না। বৌধায়নেও (গৃহ্যসূত্র ৩.৪) এইরূপ উদারতার অভাব দেখা যায়। মীমাংসকদের মধ্যে প্রভাকর যে দ্বিজনারীর বেদপাঠ সমর্থন করিয়াছেন তাহা মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা দেখাইয়াছেন।[]

 মহাভারত (অনু ৪০. ১২) নারীদের কোথাও কোথাও ‘অশাস্ত্রা’ বলিলেও বহুস্থলে নারীদের শিক্ষাদীক্ষার কথা বলিয়াছেন। স্মৃতির যুগে, মনুর সময়ে নারীদের শিক্ষার অধিকার অনেকটা সংকুচিত দেখা যায়। মনু (৯.১৮) বলিয়াছেন, নারীদের আবার বেদমন্ত্র দিয়া কী হইবে—

নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈঃ

 বৈবাহিক বিধিই তাঁহাদের বৈদিক সংস্কার (২.৬৭)। যজ্ঞে নারীরা চালক হইতে পারেন না (৪. ২০৫.৬)। নারীরা যজ্ঞে আহুতি দিলে বা নারীদের দ্বারা যজ্ঞে আহুতি দেওয়াইলে নরকে পতিত হইতে হয় (১১.৩৭)। কিন্তু এখানে মনে রাখা উচিত, মনু (২. ২১৩-১৫) বহুস্থলে নারীদের চরিত্রকেও বিষম আক্রমণ করিয়াছেন। স্ত্রীদিগকে শারীর দণ্ড দিবার ব্যবস্থাও মনু দিয়াছেন (৮. ২৯৯-৩০০)। অথচ নারীদের প্রতি ভালো ব্যবহার ও নারীদের মহত্ত্বের কথাও মনুতে বহু স্থানে আছে।

 বেদের মন্ত্রে কেহ কেহ নারীদের অধিকার অস্বীকার করিলেও মনে রাখিতে হইবে বহু বেদমন্ত্র নারীদেরই রচিত। বৃহদ্দেবতায় উক্ত তালিকা পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে, ঋগ্বেদেও দেখা যায় বহু নারী মন্ত্ররচনা করিয়াছেন।রোমশা (১. ১২৬), লোপামুদ্রা (১. ১৭৯), বিশ্ববারা (৫. ২৮), অপালা (৮. ৯১.৭), যমী (১০.১০), বসুত্রুজায়া (১০. ২৭-২৮), ঘোষা (১০. ৩৯), সূর্যা (১০.৮৫), উর্বশী (১০. ১৫), সরমা (১০. ১০৮), বাক্ (১০. ১২৫), ইন্দ্রাণী (১০. ১৪৫), ইন্দ্রজননী (১০. ১৫৩), বিবস্বৎকন্যা যমী (১০.১৫৪) শচী (১০. ১৫৯), সার্পরাজ্ঞী (১০. ১৮৯) ছাড়া আরও বহু নাম ঋগ্বেদ-সংহিতায় ও অন্যান্য বেদে পাওয়া যায়।

 উপনিষদেও মৈত্রেয়ী, গার্গী-বাচক্লবী প্রভৃতি ব্রহ্মবাদিনীর নাম পাওয়া যায়। পতঞ্‌চল কাপ্যের কন্যা গন্ধর্বগৃহীতা (বৃহদারণ্যক ৩.৩.১) ও উমা হৈমবতীর (কেন ২৫) কথা বলিয়া লাভ নাই। কারণ তাঁহারা সাধারণ বিধির বাহিরে। ব্রহ্মবাদিনী নারীরা বড় বড় সংসদে ও বিদ্বজ্জনের সভাতে যে যোগ দিতেন সে কথা নানা উপনিষদেই আছে।

 গোভিল-গৃহ্যসূত্রে (২. ১. ১৯-২০) এবং কাঠক গৃহ্যে নারীদের বেদমন্ত্রে অধিকারের কথা দেখা যায়। নারীরা যে শিক্ষাও দিতেন তাহা বুঝা যায় পাণিনির ‘আচার্যা’ এবং ‘উপাধ্যায়া’ ও ‘উপাধ্যায়ী’ (৩. ৩. ২১) শব্দগুলিতে। এখানে কাশিকাবৃত্তি কথাটা আরও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন। কাশকৃৎস্নি ছিলেন একজন মীমাংসাচার্য। তাঁহার মীমাংসার নাম কাশকৃৎস্নী (৪.১.৪)। সেই মীমাংসায় ব্যুৎপন্না নারীকে বলে ‘কাশকৃৎস্না’ (৪.১.১৪)। প্রাচীন ব্যাকরণ আপিশল যে নারী শিখিয়াছেন, তিনি ‘আপিশলা’ (৪.১.১৪)। পতঞ্জলি ইহাদের পরিচয় দিয়াছেন। তাহাতে আরও জানিতে পারি যে, অনেক সময় নারীরা নারীগুরুর কাছেই শিক্ষা করিতেন (৪-১.৭৮)। পুরুষদের কাছে পুরুষছাত্রদের সঙ্গেও যে নারীরা অধ্যয়ন করিতেন তাহার কথা আমরা খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর লেখক ভবভূতির উত্তররামচরিতে পাই। ভগবান বাল্মীকি যখন লবকুশকে ত্রয়ীবিদ্যা শিখাইতেন তখন নারী আত্রেয়ী সেই সঙ্গে পড়িতেন, তবে মনস্বী লবকুশের শিক্ষার গতিবেগের সঙ্গে তিনি তাল রাখিয়া চলিতে পারিতেছিলেন না (দ্বিতীয় অঙ্ক)। মালতীমাধবেও ভবভূতি দেখাইয়াছেন, নরনারী একত্র আচার্যকুলে পড়িতে পারিতেন। কামন্দকী সেখানে পড়িয়াছেন। ইহার প্রায় একশত বৎসর পূর্বে বাণভট্ট তাঁহার কাদম্বরীতে দেখাইয়াছেন মহাশ্বেতার রূপখানি। ব্রহ্মসূত্রের দ্বারা মহাশ্বেতার কায়া ছিল পবিত্রীকৃত— ব্রহ্মসুত্রেণ পবিত্রীকৃতকায়াম্। কাদম্বরী নির্ণয়সাগর, ১৯১২, পৃ ৪৮২  যাঁহারা দেবীদের পুরাতন মূর্তি দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন বহু দেবীরই উপবীত আছে। দেবীর ধ্যানেও ‘নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্’ প্রভৃতি কথা মেলে। মহাভারতে নারীদের বেদপাঠের রীতিমতই উল্লেখ আছে। শিবা নামে বেদপারগা সিদ্ধা ব্রাহ্মণী সর্ববেদ অধ্যয়ন করিয়া অক্ষয় দেহ লাভ করেন—

অত্র সিদ্ধা শিবা নাম ব্রাহ্মণী বেদপারগা।
অধীত্য সাখিলান্ বেদান্ লেভে স্বং দেহমক্ষয়ম্॥ উদ্যোগ, ১০৯.১৯

 ভারতবর্ষ সব সত্যের মূলে দেখিয়াছে ব্রহ্মকে। কাজেই তাঁহাদের মতে নরনারীর পার্থক্য কেন হইবে। শ্বেতাশ্বতর বলেন, তুমিই স্ত্রী, তুমিই পুরুষ—

ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি। ঐ, ৪.৩

 স্ত্রী পুরুষ বলিয়া তবে কেন ভেদ হইবে? একই আত্মা যখন যে শরীরে যুক্ত হয় তখন তার সেই রূপ। এই পরিচয় তো বাহ্যমাত্র, আসলে সর্বত্রই আত্মা তো এক—

নৈব স্ত্রী ন পুমানেব ন চৈবায়ং নপুংসকঃ।
যদ্‌যচ্ছরীরম্যদত্তে তেন তেন স যুজ্যতে। শ্বেতাশ্বতর ৫, ১০

 জৈন ও বৌদ্ধ সাধনাতেও বহু নারী তপস্যার উচ্চতম সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন থেরীগাথা গ্রন্থে এইরূপ বহু বৌদ্ধ তপস্বিনীর পরিচয় আছে।

 সংসারাশ্রমেও পত্নীর অধিকার কম ছিল না। যজ্ঞে ও সামাজিক ধর্মাচরণে পত্নীর পূর্ণ অধিকার ছিল।[] ‘জায়া’ কথাতে ততটা অধিকার সূচিত হয় না।

 জায়াশব্দে তিনি পুত্রের জননী মাত্র। ‘পত্নী’ কথাতে বুঝা যায়, নারীদেরও অধিকার ও নেতৃত্ব আছে। তবে অনেকস্থলে পত্নীকে জায়া বলিয়া প্রকরণবিশেষে উল্লেখ করা হইয়াছে। শতপথ-ব্রাহ্মণের (১. ১. ৪. ১৩) জায়াকে মৈত্রায়ণী-সংহিতা (৪.৮. ১) বলিলেন ‘পত্নী’, মনু বলিলেন, ‘স্ত্রী’। পূর্বে যেখানে জায়াই আহুতি দিতে পারিতেন সেখানে পরে সেই আহুতি দিতেন পুরোহিতেরা।[] অর্থাৎ জায়ার এই অধিকারটুকু ক্রমশ সংকুচিত হইল।

 তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেখা যায়, মন্ত্রপাঠে হোমে আহুতিতে স্ত্রী সমানভাবে যোগ দিতে পারিতেন, সামগানের সময়ে ধুয়াও ধরিতে পারিতেন। পরে এরূপ তর্কও উঠিল, যেহেতু স্ত্রীর নিজস্ব অর্থ নাই তাই তাঁহার যজ্ঞ অসম্ভব। জৈমিনি এইরূপ তর্ক তুলিয়া তাহার উত্তর দিয়াছেন যে, অর্থে স্বামীর ও স্ত্রীর অধিকার সমবেত, ‘অর্থেন চ সমবেতত্বাৎ’[]; কাজেই সেখানে ভাষ্যকার মাধবও বলেন, নারীদেরও ধর্মকর্মের অধিকার আছে, ‘অস্তি স্ত্রিয়াঃ কর্মাধিকারঃ’। এইরূপ ক্ষেত্রে স্বামীর ও স্ত্রীর একই অধিকার এবং একত্র অধিকার[] আশ্বলায়ন-শ্রৌতসূত্রে যজ্ঞপত্নীর কর্তব্যের কথা পাওয়া যায়। তাহার আদি— ‘বেদং পত্ন্যৈ প্রদায় বাচয়েদ্ হোতা অধ্যর্যুবা বেদোঽসি বিত্তিরসি’ ইত্যাদি (১.১১)। মহাভারতে অনেক স্থলে নারীদের এই অধিকার স্বীকৃত হয় নাই। স্বামীর সেবা ছাড়া যাগযজ্ঞ বা শ্রাদ্ধ-উপবাস নারীদের নাই।[১০] অথচ কুন্তী বলিতেছেন, আমি যথাবিধি সোমপান করিয়াছি।[১১] তাহাতেই মনে হয়, যজ্ঞে সোমের অধিকার তখনও নারীদের ছিল। রামায়ণেও দেখা যায়, কৌশল্যা ছিলেন দশরথের যজ্ঞাংশভাগিনী। মহাভারতে (অশ্ব ৮৯. ২) দেখা যায়, ব্রাহ্মণেরা বিধিবৎ রাজসূয় যজ্ঞে অশ্ব সমানয়ন করিয়া দ্রুপদাত্মজাকে সেখানে যজ্ঞকর্মের জন্য বসাইলেন। মহাভারত এই কথাও বলেন, ধর্ম দারারই অধীন।[১২] রামায়ণে (সুন্দর ১৪.৪৯) দেখা যায়, জানকী নিয়মিত সন্ধ্যাবন্দনাদির জন্য নদীর তীরে আসিতেন। এখানে টীকাকার রামায়ণতিলকে তর্ক তুলিতেছেন যে, নারী তো বৈদিকমন্ত্র উচ্চারণ করিবেন না, তবে বাকি কাজ করিতে পারেন। মূলে কিন্তু এইসব আপত্তি দেখা যায় না। বরং ইহার পূর্বেই কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে (২৪. ৩৮) তাঁরা বেদ ও শাস্ত্র প্রমাণে সিদ্ধ করিতেছেন যে, স্বামী ও স্ত্রী অভিন্ন। বালিপত্নী তারা তো মাত্র কপিকুলসম্ভবা। নীতাদেবীর সঙ্গে কি তাঁহার তুলনা। তবু টীকাকার উৎসাহবশে নারীদের বেদাচার অপ্রমাণ করিতে চাহেন, এমনকি সীতাদেবীর কথাপ্রসঙ্গেও। পরমপাবনী নারায়ণী সীতাদেবীকেও এইসব টীকাকারেরা ছোট না করিয়া ছাড়িতে চাহেন নাই। সাধারণ নারীরা আর তাঁহাদের কাছে কতটুকু আশা করিতে পারে?

 প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা শুদ্ধ যাগযজ্ঞে নহে লোকশিক্ষার্থ নানাস্থানে ভ্রমণ করিবার সময়েও স্ত্রীদের সঙ্গে লইতেন (মহাভারত, অনু, ৯৩, ২১) মহাভারতের যুগে সভাতেও নারীদের স্থান প্রস্তুত রাখিতে হইত (আদি, ১৩৪, ১১)। কখনও কখনও পরামর্শ দিবার জন্য নারীরা সভাতে আহুতা হইতেন। গান্ধারীকে এইরূপ সভাতে মন্ত্রার্থ আহ্বান করা হইয়াছিল (উদ্যোগ, ৬৭-৬)। দেবী গান্ধারী ছিলেন মহাপ্রজ্ঞা বুদ্ধিমতী ‘আগমাপায়তত্ত্বজ্ঞা’ (আশ্রম, ২৮,৫)। ধর্মপ্রাণা গান্ধারীর আপন পর বলিয়া কোনো সংকীর্ণতা ছিল না। সত্যধর্ম রক্ষার্থ নিজের পুত্র পাপী দুর্যোধনকে তিনি ত্যাগ করিবার জন্য বারবার ধৃতরাষ্ট্রকে ধরিয়াছেন—

তস্মাদয়ং মদ্বচনাৎ ত্যজ্যতাং কুলপাংসনঃ। সভা, ৭৫ ৮

 গান্ধারীর জা’ কুন্তীও বৈদিকমন্ত্রে দীক্ষালাভ করিয়াছিলেন (বন ৩০৪-২০)। তপস্বিনী শাণ্ডিলী ছিলেন মনস্বিনী সর্বজ্ঞা সর্বতত্ত্বজ্ঞা (অনু ১২৩-২)। এক পতিব্রতা নারী সাঙ্গোপনিষৎ অধীতবেদ তপস্বী কৌশিককে সুন্দর ধর্মোপদেশ দিয়াছিলেন (বন ২০৫. ৩৩-৩৮)। তপোবৃদ্ধা অরুন্ধতী বশিষ্ঠের সমানশীলা ও সমানব্রতচারিণী ছিলেন (অনু ১৩০. ২); তাঁহার কাছে পিতৃগণ ও ঋষিগণ ধর্মের গুহ্যতম তত্ত্ব শুনিতে চাহিলেন এবং শুনিয়া ধন্য হইলেন (ঐ ১৩০ অধ্যায়)। তপস্বিনী সুলভার কাছে সর্ববেদবিৎ ব্রহ্মবাদী জনক যে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন তাহা শান্তিপর্বের ৩২০তম অধ্যায়ে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। সেইসব কথা যোগতত্ত্বের সার। জনক তাঁহার স্বাগতার্থ পাদশৌচ করাইয়াছিলেন (৩২০. ১৪)। অনুশাসনপর্বের আরম্ভেই (১-১৭) স্থবিরা শমসংযুতা তাপসী গৌতমীর কথা দেখা যায়। অশ্বমেধপর্বের ব্রাহ্মণী-ব্রাহ্মণসংবাদে (২০-২৫ অধ্যায়) পতিশিষ্যা ব্রাহ্মণীর কথা সকলেই শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করিয়াছেন।

 নারীগণ জ্ঞানে ধর্মে ও তপস্যায় অধিকারিণী ছিলেন বলিয়া যে সংসারের কাজে তাঁহারা মনোযোগ দিতেন না তাহাও নয়। দ্রৌপদী ধর্মজ্ঞা ও ধর্মদর্শিনী ছিলেন (মহাভারত, শান্তিপর্ব, ১৪-৪)। নীতিশাস্ত্রেও তাঁহার গভীর জ্ঞান ছিল।

 মধ্যযুগের সাধক-সন্তদের মধ্যেও অনেক নারী ছিলেন। ক্ষেমা পদ্মাবত দাদূর কন্যা নানীবাঈ ও মাতাবাঈ সাধনার রাজ্যে প্রখ্যাত। ভক্তিমতী করমা ও মীরাবাঈর কথা তো সর্বজনবিদিত। প্রেমের ও ভক্তির গানে মীরার সমতুল্য কেহ নাই। তারপর প্রায় দুই শত বৎসর পূর্বেকার সহজোবাঈ, দয়াবাঈ প্রভৃতি নারী আছেন। প্রায় একশত বৎসর পূর্বে যোধপুরে তপস্বিনী অজনেশ্বরী, বীকানীরে গৌরাঁজী, জনাবাঈ, মহারাষ্ট্রদেশে কৃষ্ণানদীতটনিবাসিনী সখূবাঈ, পাণ্টরপুরের কান্‌হূ পাত্রা, পুনাতে বাবাজান, মহিশূরে শান্তিবাঈ, মধ্য প্রদেশে মায়াবাঈ, নামদেবের পরিচারিকা প্রভৃতি ছিলেন। কয়েক শতাব্দী পূর্বে সূফী সাধিকা বাউরী সাহিবা দিল্লীপ্রদেশে এক সাধকের ধারা প্রবর্তন করেন। বাল্যকালে আমরা কাশীতে বরুণাসঙ্গমে তপস্বিনী মাতাজীকে দেখিয়াছি। রাধাস্বামী সম্প্রদায়ে মহারাজসাহেব পণ্ডিত ব্রহ্মাশঙ্কর মিশ্রের ভগ্নী মাহেশ্বরী দেবীকে সকলে তপস্বিনী মহারানী বূআজী (পিসিমা) বলিতেন। তিনি কাশীর কন্যা, কাজেই তাঁহার সঙ্গে আমাদের দেখা-শোনা ছিল। পরমহংসদেবের স্ত্রী সারদেশ্বরী দেবী বহু লোককে সাধনা দিয়াছেন। ভারতের বাহিরেও বহু নারী ভক্ত আছেন, তাঁহাদের নাম আর করিলাম না। কাজেই দেখা যাইতেছে, ভারতে চিরদিনই নারীদের প্রতি সর্বসাধারণের চিত্তে একটি শ্রদ্ধার ভাব চলিয়া আসিতেছে। যদি কোনো ব্যবস্থাপক ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলিয়াও থাকেন, তবু সাধারণের মধ্যে নারীমাহাত্ম্যের গৌরব তাহাতে ক্ষুণ্ণ হয় নাই। সেই মহাভারতের যুগেও দেখি পরিবারে নারীর বিলক্ষণ সম্মান ছিল (বিরাট ৩-১৭)। তাই যদিও আদিপর্বে (১৫৯-১১) একবার দুহিতাকে ‘কৃচ্ছ’ বলা হইয়াছে তবু পুত্রের চেয়ে কন্যাকে কেহ কম করিয়া দেখেন নাই। ভীষ্ম বলেন, পুত্র তো নিজেরই স্বরূপ, কন্যাও পুত্রেরই সমতুল্য, এই আত্মস্বরূপ ইঁহারা থাকিতে কেন ধন অন্যে পাইবে—

যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ। অনুশাসন ৪৫-১১

 কন্যারা যে রীতিমতই উত্তরাধিকারিণী সে কথা ভীষ্ম স্পষ্টাক্ষরেই বলিয়া গেলেন যে, কন্যা থাকিতে অন্যের কোনো অধিকারই নাই।

 তাই পুত্রের মত কন্যাদেরও রীতিমত জাতকর্মাদি মহাভারতের যুগে অনুষ্ঠিত হইত (আদি ১৩০-১৮)। সাবিত্রীর জন্মের পরেও জাতিক্রিয়াদি যথাবিধি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল (বন ২৯২-২৩)। ভার্যারূপেও নারীরা সেই যুগে যথেষ্ট সম্মান পাইয়াছেন—

অর্ধং ভার্যা মনুষ্যস্য ভার্যা শ্রেষ্ঠতমঃ সখা। ভার্যা মূলং ত্রিবর্গস্য ভার্যা মূলং তরিষ্যতঃ। আদি ৭৪-৪১

 ইহার পরও ৪২-৪৭ শ্লোকে এবং ৫১ শ্লোকে ভার্যারই মাহাত্ম্য কীর্তিত। অনুশাসনপর্বে নারীদের স্বাধীনতা সংকোচের কথা বলিয়াও নারীদের যে সৎকার করিতে হইবে ও সর্বক্ষেত্রে তাঁহারাই যে শ্রী, এই কথা বলিতে মহাভারত বাধ্য হইয়াছেন (৪৬-১৫)। শান্তিপর্বের ১৪৪তম অধ্যায়টি আগাগোড়াই ভার্যা-প্রশংসা।

 রামায়ণেও দারাকে আত্মা বলা হইয়াছে (অযোধ্যা ৩৭-২৪)। অর্থাৎ, পত্নীকে পতি অপরজ্ঞানে হীনদৃষ্টিতে বা নীচভাবে দেখিতে পারিবেন না।

 মহাভারতের যুগে নারীদের অধিকারের বিরুদ্ধে মুখে কেহ-কেহ কিছু বলিলেও সামাজিক জীবনে নারীদের অনেক অধিকারই দেখা যায়। রাজকন্যাদের তখন প্রায়ই স্বয়ংবর প্রথায় বিবাহ হইত। সাবিত্রী দময়ন্তী কুন্তী দ্রৌপদী প্রভৃতি অনেকের বিবাহে কন্যারা নিজেরাই বর বরণ করিয়াছেন। এই স্বয়ংবর প্রথায় নারীর অধিকার কিরূপ ছিল তাহা জানিতে হইলে বনপর্বের ২৯২তম অধ্যায়ে সাবিত্রীর প্রতি তাঁহার পিতার প্রদত্ত উপদেশগুলি দেখা উচিত (৩২-৩৬ শ্লোক)। যম ও সাবিত্রীর মধ্যে যে কথাবার্তা তাহাও (বনপর্বের ২১৬তম অধ্যায়) পড়া উচিত।

 স্বয়ংবর প্রথাতেই বুঝা যায়, তখন যুবতীবিবাহই সমধিক চলিত ছিল। বালিকাবিবাহ যে ছিল না তাহা নহে, তবে যুবতীবিবাহই তখন বেশি প্রচলিত ছিল। তখনকার বৈদিক মন্ত্রাদিতেও ইহাই বুঝা যায়। মনু তো নারীদের বিষয়ে খুবই সাবধানে বিধান দিয়াছেন। তবু তিনি অপাত্রকে কন্যাদানের চেয়ে ঋতুমতী কন্যা যাবজ্জীবন ঘরে থাকাও ভালো বলিয়াছেন (৯.৮৯)। এখানে টীকাকার মেধাতিথি বলিয়াছেন, ঋতুর পূর্বে কন্যাকে দান করিবে না, যাবৎ গুণবান বর না মেলে—

প্রাগ্‌ঋতোঃ কন্যায়া ন দানম্···
যাবদ গুণবান্ বরো ন প্রাপ্তঃ

 যুবতীদের বিবাহে যে অনেকসময় জাতিভেদ প্রভৃতির অনুশাসন পালিত হইতে পারিত না, তাহা সহজেই বুঝা যায়। আমার ‘জাতিভেদ’ পুস্তকে এই বিষয়ে আমি বহু আলোচনা করিয়াছি। বৌদ্ধদের মধ্যে তো জাতিভেদের এত মানামানিই ছিল না। কোশলপতি পসেনদি দাসীকন্যা মল্লিকাকে বিবাহ করেন। বণিককন্যা দেবীর গর্ভেই অশোকের পুত্র মহিন্দ ও সংঘমিত্তার জন্ম। শিকারীদের রাজকন্যার সহিত সাধু উপদের বিবাহ হয়। সর্দার পুত্র শার্দূলকর্ণের সহিত ব্রাহ্মণকন্যার বিবাহ ঘটিয়াছিল।

 আবার মাঝে মাঝে আভিজাত্যগর্বিত রাজকুলে ভাইবোনেও যে বিবাহ হইত বৌদ্ধদের কথায় তাহা দেখা যায়। রাজা ওঙ্কারের চারিপুত্র। তাঁহাদের সমান অভিজাতকন্যা কোথাও আর মিলিল না বলিয়া চারি ভাই চারিটি বোনকে বিবাহ করেন। লাঢ়রাজ সিংহবাহুও ভগ্নীকে বিবাহ করেন। অজাতশত্রুর স্ত্রী বজিরা ছিলেন তাঁহার মামাতো বোন। আনন্দের স্ত্রী উৎপলবর্ণা ছিলেন তাঁহার পিসতুত বোন। মগধের এক গৃহপতি আপন মামাতো বোন সুজাতাকে বিবাহ করেন। পুণ্ডকাভর-পত্নী সুবন্নপালী ছিলেন তাঁহার মামাতো বোন। লঙ্কার রাজকন্যা চিত্তার বিবাহ হয় তাঁহার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে। বেদে যম-যমী ছিলেন ভাইবোন। কুন্তীও ছিলেন বসুদেবের ভগ্নী (বসুদেবস্য ভগিনী, মহাভারত, বন ৩০২-২৪)—

স্বসারং বহুদেবস্য শত্রুসঙ্ঘবিমর্দিনঃ।
কুন্তিরাজসুতাং কুন্তীং সর্বলক্ষণপূজিতাম্। আদি ১৫১-২৪

কাজেই বসুদেব হইলেন অর্জুনের মামা (সহিতো বাসুদেবেন মাতুলেন, অশ্ব ৮৩-১৬)। সেই মাতুলের কন্যা সুভদ্রাকে দেখিয়াই অর্জুন কন্দর্পাহত হইলেন—

দৃষ্টৈব তাম্ অর্জুনস্য কন্দর্পঃ সমজায়ত। আদি ২১৯-১৫

 শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের অবস্থা দেখিয়া সুভদ্রার পরিচয় দিয়া বলিলেন, যদি তুমি ইহাকে চাও তবে আমি পিতাকে বলি—

যদি তে বর্ততে বুদ্ধির্বক্ষ্যামি পিতরং স্বয়ম্। আদি ২১৯-১৭

 অর্জুন বলিলেন, যদি তোমার এই ভগ্নী আমার মহিষী হন তবে আমার পরম উপকার করা হয়—

কৃতমেব তু কল্যাণং সর্বং মম ভবেদ ধ্রুবম্।
যদি স্যান্ মম বার্ষ্ণেয়ী মহিষীয়ং স্বসা তব। আদি ২১৯-১৯

 তখন শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, তবে স্বয়ম্বরে কাজ নাই, কারণ তাহাতে ফল সংশয়িত। বরং তুমি ইহাকে হরণ কর; ক্ষত্রিয়দের তাহাতে দোষ নাই (আদি ২১৯, ২১-২৩)। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সব কথা জানানো হইলে তিনিও ইহা সমর্থন করিলেন—

শ্রুত্বৈব চ মহাবাহুরনুজজ্ঞে স পাণ্ডবঃ। আদি ২১৯-২৫

 এই মামাতো বোন সুভদ্রার গর্ভেই বীরকুলশিরোমণি অভিমন্যুর জন্ম।

 বিদর্ভরাজ ভীষ্মক ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মাতুল। তাঁহার কন্যা রুক্মিণীকে শ্রীকৃষ্ণ রিবাহ করেন। এই কন্যাকে পূর্বে চেদিপতি শিশুপালের সঙ্গে বিবাহ দিবার কথা হইয়াছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীর রূপে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে হরণ করিয়া বিবাহ করেন। ভীষ্মকের পুত্র রুক্মী আপনার ভগ্নীর এই হরণকে পছন্দ করেন নাই। মহাভারতে আছে—

নাঽমৃষ্যত পুরা যোঽসৌ স্ববাহুবলগর্বিতঃ।
রুক্মিণ্যা হরণং বীরো বাসুদেবেন ধীমতা। উদ্যোগ ১৫৭-১১

 হয়তো শ্রীকৃষ্ণের এই মামাতো বোনকে হরণ করিয়া বিবাহ করা রুক্মী সঙ্গত মনে করে নাই। শ্রীকৃষ্ণের এই বিবাহ পরবর্তীকালের কোনো কোনো ধর্মনেতাও পছন্দ করেন নাই। তাই তর্কস্থলে সেইসব পণ্ডিতেরা যুক্তি দেখাইয়াছেন যে, রুক্মিণী ভীষ্মকের ঔরসজাতা না হইতেও পারেন। তাঁহাদের এইরূপ তর্ক পূর্বমীমাংসা-গ্রন্থে আরও আছে। ভীষ্ম যজ্ঞ করিয়াছিলেন, অথচ স্ত্রী-বিনা যজ্ঞ হয় না। তাই তাঁহাদের বলিতে হইল, মহাভারতে লেখা না থাকিলেও ভীষ্ম নিশ্চয় বিবাহ করিয়াছিলেন, নহিলে স্ত্রী-বিনা যজ্ঞ করিবেন কেমন করিয়া? মহাভারতে তো স্পষ্টই দেখি ভীষ্মকের পুত্র রুক্মী (পুজো রুক্মীতি বিশ্রুতঃ। উদ্যোগ ১৫৭, ১-২)। মহাভারত আদিপর্বে আছে রুক্মিণী হইলেন শ্রীর অংশাবতার। তিনি পৃথিবীতে ভীষ্মকের কুলে জন্ম নিলেন—

শ্রিয়স্তুভাগঃ সংজজ্ঞে রত্যর্থং পৃথিবীতলে।
ভীষ্মকস্য কুলে সাধ্বী রুক্মিণী নাম নামতঃ। আদি ৬৭-১৫৬

 পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডেও (৬৭ অধ্যায়) দেখা যায়, ভীষ্মকের পুত্র রুক্মী এবং তাঁর অবরজা (কনিষ্ঠ।) কন্যা রুক্মিণী। এই বিবাহে মহাভারতের সম্মতি যে আছে, তাহা বুঝি পূর্বোক্ত ‘সাধ্বী রুক্মিণী’ এই কথায়। দ্রৌপদী ও শ্রীকৃষ্ণকে বলিয়াছেন, তুমি যেমন ধর্মতঃ রুক্মিণীকে বিবাহ করিয়াছ, আমিও তেমনি অর্জুনের ধর্মপত্নী—

লব্ধাঽহমপি তত্রৈব বসতা সব্যসাচিনা।
যথা ত্বয়া জিতা কৃষ্ণ রুক্মিণী ভীষ্মকাত্মজা। বন ১২-১১৫

এখানে দ্রৌপদীও বলিতেছেন রুক্মিণী ভীষ্মকের আত্মজা, শুধু পালিতা নহেন।

 সুভদ্রা ও অর্জুনের বিবাহকথা মহাভারত ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থেও আছে। রুক্মিণীর এই বিবাহ রুক্মী যে পছন্দ করেন নাই তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। শিশুপাল তো পছন্দ করিতেই পারেন না। শিশুপাল সভামধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে এই বলিয়াই তিরস্কার করিলেন, “রুক্মিণীর সঙ্গে আমারই পূর্বে বিবাহের কথা হইয়াছিল। সভামধ্যে, বিশেষত রাজাদের সভায়, তাহার কথা মুখে আনিতে তোমার লজ্জা করে না?”

শিশুপালঃ...বাক্যং চেদমুবাচ হ। সভা ৪৫-১৭

মৎপূর্বাং রুক্মিণীং কৃষ্ণ সংসৎসু পরিকীর্তয়ন।
বিশেষতঃ পার্থিবেষু বৃড়াং ন কুরুষে কথম্। সভা ৪৫-১৮

 রুক্মিণীর বিবাহ শিশুপালের পক্ষে ক্ষোভের বিষয় হইলেও মুনি-ঋষি-সাধু-সজ্জন সকলেই এই বিবাহ সম্মানের সহিত স্বীকার করিয়াছেন। নহিলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ধর্মসংস্থাপক হইয়া তো আর ধর্মনাশ করিতে পারিতেন না। কাজেই গালব-মুনির কথায় দেখা যায় যেমন স্বাহাতে অগ্নি ও লক্ষ্মীতে নারায়ণ প্রেমে যুক্ত (উদ্যোগ ১১৭-১০), সাবিত্রীতে যেমন সত্যবান (উদ্যোগ ১১৭-১২), দময়ন্তীতে যেমন নল (উদ্যোগ ১১৭-১৫), বৈদেহীতে যেমন রাম, তেমনই রুক্মিণীতে জনার্দন প্রেমে যুক্ত হইলেন।

বৈদেহ্যাঞ্চ যথা রামো রুক্মিণ্যাঞ্চ জনার্দনঃ। উদ্যোগ ১৭

 ইহাতে মনে হয় তখনকার দিনে শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে এই বিবাহ কিছুমাত্র অগৌরবের বস্তু হয় নাই। তাই মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণগৌরব-বর্ণনায় দেখি— যিনি (শ্রীকৃষ্ণ) একা স্বীয় বলে সমস্ত ভোজরাজগণকে পরাস্ত করিয়া যশস্বিনী দীপ্যমানা রুক্মিণীকে ভার্যারূপে জয় করিয়া আনিলেন এবং এই রুক্মিণীতে মহাত্মা রৌক্মিণেয় অর্থাৎ প্রদ্যুম্নকে জন্ম দিলেন—

যো রুক্মিণীমেকরথেন ভোজানুৎসাদ্য রাজ্ঞঃ সমরে প্রসহ্য।
উবাহ ভার্যাং যশসা জ্বলন্তীং যস্যাং জজ্ঞে রৌষ্মিণেয়ো মহাত্মা। উদ্যোগ ৪৮-৭৪

 হরিবংশে দেখা যায়, রুক্মিণীর গর্ভে শ্রীকৃষ্ণের প্রদ্যুম্ন ছাড়া আরও অনেক সন্ততি জন্মলাভ করেন। মূল উদ্ধৃত করিয়াই তাহা দেখান যাউক—

প্রদ্যুম্নং প্রথমং জজ্ঞে শশ্বরান্তকরঃ সুতঃ।
দ্বিতীয় চারুদেষ্ণশ্চ বৃষ্ণিসিংহো মহারথঃ।
চারুভদ্রশ্চারুগর্ভঃ সুদংষ্ট্রো দ্রুম এব চ॥
সুষেণশ্চারুগুপ্তশ্চ চারুবিন্দশ্চ বীর্যবান্।
চারুবাহুঃ কনীয়াংশ্চ কন্যা চারুমতী তথা। ১৬০, ৫-৬

 রুক্মিণী ভীষ্মকাত্মজা নহেন এরূপ তর্ক করা বৃথা অথচ এইরূপ যুক্তিকে আশ্রয় করিয়াই মীমাংসাদর্শনের তর্কে বলা হইয়াছে, সুভদ্রা ছিলেন অর্জুনমাতুল বসুদেবের পালিতা কন্যা। কিন্তু মহাভারতে তাঁহাকে যদুবংশীয়া ‘মাধবী’ই বলা হইয়াছে।

সুভদ্রাং মাধবীম্। আদি ১.১৫১

 এখানে টীকাকারও বলেন সুভদ্রা মধুবংশজাতা (মধুবংশজাম্)। মাধব মধুবংশীয় বলিয়া শ্রীকৃষ্ণের এক নাম মাধব। বাসুদেবের পরে সুভদ্রা জন্মগ্রহণ করেন—

অনুজাং বাসুদেবস্য। আদি ৬১.৪৪

 অর্জুন দ্বারবতীতে গিয়া বাসুদেবের ভগ্নী ভদ্রভাষিণী সুভদ্রাকে বিবাহ করিলেন—

অর্জুনঃ খলু দ্বারবতীং গত্বা ভগিনীং বাসুদেবস্থ সুভদ্রাং ভদ্রভাষিণীং ভার্যামুদাবহৎ। আদি ৯৫.৭৮

 অর্জুন-মুখেও শুনা গেল সুভদ্রা হইলেন বসুদেবের কন্যা ও শ্রীকৃষ্ণের ভগিনী—

দুহিতা বসুদেবস্য বাসুদেবস্থ চ স্বসা। আদি ২১৯.১৮

 শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন, ইনি আমার ভগ্নী এবং সারণের সহোদরা এবং আমার পিতার দয়িতা সুতা—

মমেবা ভগিনী পার্থ সারণস্য সহোদরা।
সুভদ্রা নাম ভদ্রং তে পিতুর্মে দয়িতা সুতা। আদি ২১৯.১৭

 সারণ বসুদেবেরই পুত্র (আদি ২১৯.১০)। সারণের সহোদরা হইলে সুভদ্রা বসুদেবের ঔরসজাতা কন্যা। অর্জুন-সুভদ্রার বিবাহে সারণ উপস্থিত ছিলেন (আদি ২২১.৩২)। যদুবংশীয় আরও অনেকে ঐ বিবাহে যোগ দিয়াছিলেন।

 রুক্মিণী যে ভীষ্মকের ‘আত্মজা’ সেই কথা যুক্তি-চাতুরীতে ‘পালিতা’ বলিয়া চাপা দিবার চেষ্টা মহাভারতে নাই (বন ১২-১১৫)। শ্রীমদ্ভাগবতেও দেখা যায়, বিদর্ভরাজ মহাত্মা ভীষ্মকের পাঁচটি পুত্র ও একটি সুন্দরী কন্যা জন্মিলেন। ছেলেদের নাম রুক্ম্যগ্রজ রুক্মরথ রুক্মবাহু রুক্মকেশ ও রুক্মমালী, ইঁহাদের ভগ্নী হইলেন সতী রুক্মিণী—

রাজাসীদ্‌ভীষ্মকো নাম বিদর্ভাধিপতির্মহান্।
তস্য পঞ্চাভবন্‌পুত্রাঃ কন্যৈকা চ বরাননা।
রুক্ম্যগ্রজো রুক্মরথো রুক্মবাহুরনন্তরঃ।
রুক্মকেশো রুক্মমালী রুক্মিণ্যেষাং স্বসা সতী। ১০, ৫২. ২১-২২

এখানেও সতী শব্দের দ্বারা ভাগবত রুক্মিণীর এই বিবাহ সমর্থন করিয়াছেন। রুক্মিণীর আগাগোড়া চরিতকেও গৌরবেরই মনে করিয়াছেন।

 শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে লইয়া শুধু ভোগ-সুখেই রত ছিলেন না। পবিত্র হিমালয়পার্শ্বে শ্রীকৃষ্ণ দ্বাদশ বৎসর মহদ্‌ঘোর ব্রহ্মচর্য পালনপূর্বক তপস্যা করেন। সেই তপস্যাতে পত্নী রুক্মিণীও সমান ব্রতচারিণী ছিলেন। তাহার পরে তাঁহাদের তেজস্বী পুত্র প্রদ্যুম্নের জন্ম হয়। কাজেই মাতুল-কন্যাকে বিবাহের দ্বারা অর্জুনের তপস্যারও কোনো ক্ষতি হয় নাই—

ব্রহ্মচর্যং মহদ্‌ঘোরং চীর্ত্বা দ্বাদশবার্ষিকম্।
হিমবৎপার্শ্বমভ্যেত্য যো ময়া তপসার্জিতঃ।
সমানব্রতচারিণ্যাং রুক্মিণ্যাং যোঽন্বজায়ত।
সনৎকুমারস্তেজস্বী প্রদ্যুম্মো নাম যে সুতঃ। সৌপ্তিক ১২, ৩০, ৩১

 শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে সত্যভামা প্রভৃতি কৃষ্ণপত্নী বৈধব্যব্রত পালন করিয়া জীবিত রহিলেন, কিন্তু রুক্মিণী ও আর-কয়েকটি পত্নী কৃষ্ণের সঙ্গে অগ্নিপ্রবেশ করিলেন—

রুক্মিণীত্বথ গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতীত্যপি।
দেবী জাম্ববতী চৈব বিবিশুর্জাতবেদসম্। মৌষল ৭.৭৩

 মহাভারতের যুগে নারী যে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারিতেন তাহারও খবর মেলে দময়ন্তীর দ্বিতীয় স্বয়ংবরের আয়োজনে। জানাইয়া দেওয়া হইল, নল রাজা জীবিত আছেন কি না জানা যাইতেছে না, অতএব সূর্যোদয়ে দময়ন্তী দ্বিতীয়বার ভর্তা বরণ করিবেন—

সূর্যোদয়ে দ্বিতীয়ং সা ভর্তারং বরয়িষ্যতি।
নহি স জায়তে বীরো নলো জীবতি বা ন বা। বন ৭০.২৬

ভীমকন্যা দময়ন্তী পুনরায় স্বয়ংবর করিবেন শুনিয়া রাজা ও রাজপুত্রগণ সেখানে যাইতে লাগিলেন (বন ৭০. ২৪)। কাজেই ইহা বৈধ ও সর্বসম্মত ছিল। বিবাহে নারীদের এইসব অধিকারের কথা তখনকার অন্যান্য বহু পুরাণেই পাওয়া যাইবে

 বিবাহের অধিকার বাদ দিলেও তখনকার দিনে নারীরা ধর্ষিতা হইলে এখনকার নারীদের মত সমাজে পরিত্যক্তা হইতেন না। ধর্ষণকারী পুরুষই অপরাধী বলিয়া গণ্য হইত। ইহাই মহাভারতের যুক্তিসংগত মত—

এবং স্ত্রী নাপরাধ্নোতি নর এবাপরাধ্যতি।
নাপরাধোঽস্তি নারীণাং নর এবাপরাধ্যতি। শাস্তি ২৬৫, ৩৮

 এইখানে চিরকারিকোপাখ্যানে পিতার মহত্ত্বও ঘোষিত—

পিতা ধর্মঃ পিতা স্বর্গ পিতাহি পরমং তপঃ।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে সর্বাঃ প্রীয়ন্তি দেবতাঃ। শান্তি ২৬৫, ২১

 আবার মাতাই সর্বকুলের রক্ষয়িত্রী। কোন্ সন্তান কাহার ঔরসে জাত, কাহার কি গোত্র, কে কাহার সন্তান তাহার তত্ত্ব একমাত্র জানেন মাতা। সমাজ তাহার কি খবর রাখে—

মাতা জানাতি যদ্ গোত্রং মাতা জানাতি যস্য সঃ। শান্তি ২৬৫.৩৫

 নারীদের যে শুধু সামাজিক অধিকারই তখন প্রশস্ত ছিল তাহা নয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তাঁহাদের তখন সাধনারও বিলক্ষণ অধিকার ছিল। যযাতির কন্যা মাধবী ছিলেন ‘বহুগন্ধর্বদর্শনা’ (উদ্যোগ ১১৬. ৩)। এখানে নীলকণ্ঠ বলেন—

গন্ধর্বাণাং দর্শনং শাস্ত্রং গীতবিদ্যাদি যস্যাম্ সা।

 মহাভারতের মনস্বিনী নারীদের মধ্যে শুধু দ্রৌপদীর নামই নহে, আরও অনেকের নাম করা যায়। বনপর্বের ৫৩-অধ্যায় হইতে ৭৯-অধ্যায় পর্যন্ত দময়ন্তীর সৌন্দর্য মাধুর্য তেজ নীতি ধর্মজ্ঞান সবই চমৎকার। যাঁহার জানিতে ইচ্ছা হয় তিনি মহাভারতে মূল আখ্যানগুলি দেখিবেন।

 ধীমতী সুলভার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। পিঙ্গলা নামে এক বারনারীর কথা মহাভারতে (শাস্তি ১৭৪. ৫৬) আছে। প্রেমের বেদনাতে তাঁহারও শান্তা বুদ্ধি ও গভীর জ্ঞান জন্মিয়াছিল। পিঙ্গলার গাথার কথা তাই মোক্ষধর্মপর্বে ভীষ্মের মুখে শুনিতে পাওয়া যায় (১৭৪ অধ্যায়)। তাহার শ্রোতা যুধিষ্ঠির। এই পিঙ্গলাই একদিন আশা নিরাশা জয় করিয়া পরমাশান্তি লাভ করিয়াছিলেন (শান্তি ১৭৪. ৬২)।

 শকুন্তলার শ্রী ও মাধুর্যের কথাই সবাই জানেন। তাঁহার তেজও কিরূপ অপরিসীম ছিল তাহা জানিতে হইলে আদিপর্বের ৭৪-অধ্যায়টি আগাগোড়া পড়িতে হয়।

 ক্ষত্রিয়কন্যা বিদুলাও বহু বেদ অধ্যয়ন করিয়া বিশ্রুতা ও বহুশ্রুতা তপস্বিনী হইয়াছিলেন—

ক্ষত্রধর্মরতা দান্তা বিদুলা দীর্ঘদর্শিনী।
বিশ্রুতা রাজসংসৎসু শ্রুতবাক্যা বহুশ্রুতা। উদ্যোগ ১৩৩, ৩

তেজের বিষয়ে বলিতে গেলে বিছুলার কথাই সকলের আগে মনে হয়। মহাভারতের উদ্যোগপর্বে ১৩৩ হইতে ১৩৬ পর্যন্ত পুরাপুরি চারটি অধ্যায়ই বিদুলার অগ্নিময়ী বীরবাণীতে ভরা। আপন পুত্রদের বীর্যাভাব দেখিয়া তাঁহার যে বজ্রসার বাণী তাহা চিরদিন সর্বমানবের কর্ণে ধ্বনিত হইতে থাকিবে— আপন আত্মাকে অপমান করিও না, অল্পে আত্মাকে পূর্ণ করিতে যাইও না; ভয় ছাড়, সুমহৎ কল্যাণের জন্য মনকে মুক্ত কর—

মাত্মানমবমন্যস্ব মৈনমল্পেন বীভরঃ।
মনঃ কৃত্বা সুকল্যাণং মা ভৈস্ত্বং প্রতিসংহর। উদ্যোগ ১৩৩, ৭

 কুনদী অল্প জলে ভরিয়া যায়, ইন্দুরের অঞ্জলি অল্পে পূর্ণ হয়, কাপুরুষদের সহজে স্বল্পেই সন্তোষ হয়—

সুপূরা বৈ কুনদিকা সুপূরো মুষিকাঞ্জলিঃ।
সুনন্তোষঃ কাপুরুষঃ স্বল্পকেনৈব তুষ্যতি। উদ্যোগ ১৩৩, ৯

 অতএব কেন বজ্রাহত প্রেতের মত পড়িয়া আছ? হে কাপুরুষ, উঠ, শত্রুনির্জিত হইয়া ঘুমাইয়া থাকিও না— ত্বমেবং প্রেতবচ্ছেষে কস্মাদ্ বজ্রহতো যথা। উত্তিষ্ঠ হে কাপুরুষ মা স্বাপ্পীঃ শত্রুনির্জিতঃ। উদ্যোগ ১৩৩. ১২  হয় আপন বীর্যকে জাগ্রত কর, নয় তো শুভা ও ধ্রুবাগতি (মৃত্যুকে) আলিঙ্গন কর—

উদ্ভাবয়স্ব বীর্যং বা তাং বা গচ্ছ শুভাং গতিম্। উদ্যোগ ১৩৩, ১৮

 মানুষ হও, কেবল সংখ্যাপূর্ণ করিবার মত না-নর বা না-নারী ক্লীবমাত্র হইয়া লাভ কি—

রাশিবর্ধনমাত্রং স নৈব স্ত্রী ন পুনঃ পুমান্। উদ্যোগ ১৩৩, ২৩

অর্থাৎ মানুষের পরিচয় তাহার মনুষ্যত্বে, শুধু সংখ্যাগত আধিক্য অথবা বাহুল্য দিয়া নহে। অংশবিশেষ উদ্ধৃত করার চেষ্টা বৃথা বিড়ম্বনা; আগাগোড়াই পড়িয়া দেখা উচিত। আশ্রমবাসিক-পর্বে (১৬. ২০) মনস্বিনী বিদুলার কথা আবার উল্লিখিত দেখি।

 তাই নারীদের সেই যুগে যেমন সংসারধর্ম তেমনই মানুষোচিত তেজস্বিতা তেমনি জ্ঞান ও ধর্মের সাধনা দেখা যায়। এইসব সাধনার সর্বপথেই মহাভারতের যুগে নারীদের গতিবিধি দেখা যায়। ভীষ্মের দ্বারা নিগৃহীতা কাশীরাজকন্যা অম্বা তপস্যা করিতে বনে গেলেন—

বনং প্রায়াৎ সা কন্যা তপসেবৃতা। উদ্যোগ ১৮৮ ১৫

বনে আশ্রমবাস করিয়া তিনি কঠোর তপস্যা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন (উদ্যোগ ১৮৮. ১৯-২৯)। পুরুষদের মত নারীরাও তখন সংসারধর্ম পালন করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করিতে পারিতেন। তাই পুত্রবধূদের লইয়া সত্যবতী বনে গমন করিলেন (আদি ১২৮. ১২)। ইহাদের বহুকাল পরে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীও বনে গিয়া শেষজীবনের তপস্যা পূর্ণ করেন (আশ্রমবাসিক ১৫-অধ্যায়)। সত্যভামা প্রভৃতি শ্রীকৃষ্ণের পত্নীগণও বানপ্রস্থ আশ্রয় করিয়াই জীবনকে সার্থক করেন (মৌষল ৭. ৭৪)।

 নারীদের এই তপস্যার অধিকার জৈন ও বৌদ্ধগণের মধ্যেও অব্যাহত ছিল। বৌদ্ধযুগে মহাপ্রজাপতি গোতমী তিস্‌সা মিত্তা ভদ্দা ধীরা উপশমা প্রভৃতি বহু শাক্যনারী প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। এইসব তপস্বিনীদের কথা ভালো করিয়া জানিতে হইলে থেরীগাথা গ্রন্থখানি দেখিতে হয়।

 জৈনদের মধ্যে এখনও কেহ কেহ সন্ন্যাসিনী হন। তাঁহাদের সাধ্বী বলে। তাঁহাদের পৃথক উপাশ্রয় আছে। আচারাঙ্গ সূত্রে (২. ১. ১-১) ইঁহাদের ‘ভিক্ষুণী’ও বলা হইয়াছে। প্রথম তীর্থংকর ঋষভদেবের সময়ে ব্রাহ্মী ও সুন্দরী নামে দুই ভগ্নী প্রবজ্যা অবলম্বন করেন (জিনসেনকৃত মহাপুরাণ)। চেতকদুহিতা ব্রহ্মচারিণী চন্দনা ছিলেন মহাবীর শিষ্যা এবং ছত্রিশ হাজার ভিক্ষুণীগণমুখ্যা। তীর্থংকর অজিতনাথের তিন লক্ষ বিশ হাজার শিষ্যা ভিক্ষুণী ছিলেন। আরও বহুস্থানে ভিক্ষুণীদের কথা পাওয়া যায়।

 দক্ষিণভারতে অল্‌ৱার ভক্ত নারীদের মধ্যে অণ্ডাল একজন মহাগুরু। উত্তরভারতেও বহু বৈষ্ণব ভক্তনারী হইয়াছেন। মহাপ্রভুর সম্প্রদায়ে হেমলতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত গুরু। কবিকর্ণপুর পরমানন্দ তাঁহার শিষ্য। মনস্বিনী গঙ্গা ও জাহ্নবী বহুলোককে ভক্তিশিক্ষা ও দীক্ষা দিয়াছেন।

 তন্ত্রে তো নারীরা দেবী আদ্যাশক্তিরই অংশ, ‘মদংশা যোষিতা মতাঃ’। শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ তাঁহার তন্ত্রসারে বলেন—

সাধ্বী চৈব সদাচারা গুরুভক্তা জিতেন্দ্রিয়া।
সর্বমন্ত্রার্থতত্ত্বজ্ঞা সুশীলা পূজনে রতা।
গুরুযোগ্যা ভবেৎ সা হি। ১. ৭৪

 স্ত্রীর কাছে দীক্ষা শুভা, মায়ের কাছে দীক্ষার অষ্টগুণফল—

স্ত্রিয়া দীক্ষা শুভা প্রোক্তা মাতুশ্চাষ্টগুণাঃ স্মৃতাঃ। ঐ

 মহানির্বাণতন্ত্রে তো স্বয়ং শিব বলিতেছেন— হে আদ্যাশক্তি, জগতে সকল নারী তোমারই স্বরূপ, জগতে তাঁহারা আচ্ছন্ন বিগ্রহ—

তব স্বরূপা রমণী জগত্যাচ্ছন্নাবিগ্রহা। মহানির্বাণ ১০. ৮০

 কাদম্বরীতে মহাশ্বেতা সংগীতশাস্ত্রে বিলক্ষণ পারগা। তপস্যার সঙ্গে সংগীতের বিরোধ নাই। নানাপুরাণে ও প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্যে তাহার পরিচয় মিলিবে। অযোধ্যাপতি অজের পত্নী ইন্দুমতী ছিলেন ‘ললিতে কলাবিধৌ প্রিয়শিষ্যা’। মালবিকাগ্নিমিত্র-নাটকে (অঙ্ক ৩) নারীদের নৃত্যের কথা দেখি। মহাদেবের নৃত্যানুকারে ভবানী যে দণ্ডপাদনৃত্য করিয়াছেন, তাহার খবর পাই মম্মটের কাব্যপ্রকাশে। পুরুষের নৃত্য হইল তাণ্ডব। নারীর নৃত্যের নাম লাস্য। জয়দেব ছিলেন নৃত্যকুশলা পদ্মাবতীর ‘চরণচারণচক্রবর্তী’। তবে পদ্মাবতীর কথা বলিতে সাহস হয় না, কারণ নৃত্যই তাঁহার জীবনের সবখানি। কিন্তু সতী বেহুলার নৃত্যের কথা তো তেমন করিয়া উড়াইয়া দিতে পারি না। নৃত্য করিয়াই বেহুলা মৃত পতিকে জিয়াইলেন। বিক্রমোর্বশী- নাটকের চতুর্থ অঙ্কে চিত্রলেখা নৃত্য করিয়াছেন এবং কঠিন কঠিন রাগ-রাগিণীতে গানও করিয়াছেন। সমাজব্যবস্থাপকেরা নারীদের জন্য নৃত্যগীতাদি শাস্ত্রের ব্যবস্থা করিয়াছেন। বৃহস্পতি বলেন, নারীদের জন্য প্রসাধন, নৃত্যগীত-সমাজোৎসবদর্শন বিহিত হইলেও স্বামী যখন বিদেশে থাকেন তখন তাহা স্থগিত রাখা উচিত—

প্রসাধনং নৃত্যগীতসমাজোৎসবদর্শনম্।
মাংসমদ্যাভিযোগং চ ন কুর্যাৎ প্রোষিতে প্রভৌ।

—স্মৃতিচন্দ্রিকাধৃত ব্যবহার কাণ্ড, প্রোষিতভর্তৃকস্ত্রীধর্মাঃ, পৃ ৫৯৩

 সেই অবস্থায় নারীগণ অগর্হিত শিল্পের দ্বারা সময় যাপন করিবেন—

প্রোষিতে ত্ববিধায়ৈব জীবেচ্ছিল্পৈরগর্হিতৈঃ। ঐ পৃ ৫৯২

বাৎস্যায়ন বলেন—

প্রাগ্‌যৌবনাৎ স্ত্রী কামসূত্রং তদঙ্গবিদ্যাশ্চাধীয়ীত পিতৃগৃহে এব।

 দর্শন পুরাণ ইতিহাস ও নানাবিধ কলাবিদ্যার সঙ্গে নারীরা বিবাহের পূর্বে পিতৃগৃহে ও বিবাহের পরেও পতির অভিপ্রায়ানুসারে কামসূত্র এবং তদঙ্গবিদ্যা অধ্যয়ন করিতে অধিকারিণী ছিলেন (বাৎস্যায়ন কামশাস্ত্র, তৃতীয় অধ্যায়)। টীকাকার যশোধরেন্দ্র এই বিষয় আরও স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন। কলাবিদ্যা হিসাবে নারীদের প্রতি আয়ুর্বেদশাস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল। বাৎস্যায়ন ও যশোধর চতুঃষষ্টি অঙ্গবিদ্যার বিস্তৃত উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন (কামশাস্ত্র তৃতীয় অধ্যায়)। নারীনৃত্যের সর্বাপেক্ষা বড় দৃষ্টান্ত হইল বৃহন্নলার কাছে বিরাটগৃহে রাজকন্যাদের নৃত্যশিক্ষার কথা—

স শিক্ষয়ামাস চ গীতবাদিতং
সুতাং বিরাটস্য ধনঞ্জয়ঃ প্রভুঃ॥ বিরাট ১১.১২

 বৌদ্ধযুগে দেখা যায়, সংঘমিত্তা হেমা ও অগ্‌গিমিত্তা ত্রিবিধবিজ্ঞান-পারদর্শিনী (দীপবংশ, ১৫ পর্ব)। সীবলা ও মহারুহা বিনয় সুত্তপিটক ও অভিধম্ম পড়াইতেন (ঐ)। অঞ্জলি ছিলেন শাস্ত্রে ও দৈবশক্তিতে অধিকারিণী। থেরীগাথায় বহু নারীর নানা বিষয়ে গভীর সাধনা ও বিদ্যার পরিচয় মেলে।

 খ্রীস্টায় ১১৮৩ সালে কাকতীয় রাজকন্যা রুদ্রদেবী বাংলাদেশ হইতে পরমশৈব বিশ্বেশ্বরকে দক্ষিণদেশে নিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। মালকাপুর-শাসনে দেখা যায়, এই কন্যা পুরুষের মত রাজা হইয়া প্রবল প্রতাপে এবং জ্ঞান ও কলার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া রাজ্যশাসন করেন। ইহার এক শতাব্দী পরে বিজয়নগরসম্রাট কম্পরায়ের মহিষী গঙ্গাদেবী ছিলেন জ্ঞানে ও কাব্যরচনায় প্রখ্যাত। তাঞ্জোরপতি রঘুনাথভূপের সভাকবি ছিলেন স্ত্রীকবি মধুরবাণী। মালাবারের প্রধান সপ্তকবির চারিজনই স্ত্রীলোক। তাঁহাদের মধ্যে নারীকবি অব্যার অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। লীলাবতীর নাম সবাই জানেন। বাংলাদেশে খনার নাম ঘরে ঘরে। মণ্ডনমিশ্রের পত্নীর কথাও সুবিদিত। দর্শনশাস্ত্রে উভয়ভারতীর অসাধারণ অধিকার ছিল। মিথিলাধিপতি পদ্মসিংহের রানী বিশ্বাসদেবী ছিলেন স্মৃতিশাস্ত্রের প্রখ্যাত আচার্য। বহু নারীকবির রচনার পরিচয় সংস্কৃতসাহিত্যে পাওয়া যায়। তাহা লিখিতে গেলে স্বতন্ত্র একখানি পুঁথি হইয়া উঠে এবং সে বিষয়ে গ্রন্থ লিখিতও হইয়াছে। অধ্যাপক কানে-লিখিত ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাসে নারীদের রচিত বহু স্মৃতিগ্রন্থের পরিচয় মেলে।

 বীরনারী হিসাবেও ভারতের বহু মহিলা প্রসিদ্ধ। ঋগ্বেদেও সেইরূপ নারীদের পরিচয় মেলে। আহমদনগরের রানী চাঁদবিবি মোঘল সেনাপতিকে যুদ্ধে বিস্মিত করিয়া দেন। সিপাহীবিদ্রোহের সময়ে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ স্যার হগ্ রোজকে সহজে ছাড়িয়া দেন নাই। ভীমসিংহপত্নী পদ্মিনীর বীরত্ব আর-এক রকমের। এইসব মহীয়সী মহিলা যেভাবে প্রাণ দিয়াছেন তেমন করিয়া প্রাণ দিতে বীরপুরুষরাও পারেন নাই। স্বামীর সঙ্গে অনুমৃতা সতীদের আত্মত্যাগের মধ্যে যে শান্ত বীরত্ব আছে তাহার মহত্ত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন।

 বাংলাদেশে হঠী বিদ্যালংকার প্রভৃতি নারী নানাশাস্ত্র অধ্যাপনা করিয়া অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন।

 কাশী যখন মোগল শাসনের শেষভাগে নিষ্প্রভ ও অশক্ত হইয়া পড়িল তখন তাহাকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিলেন দুই নারী। একজন রানী ভবানী আর-একজন অহল্যাবাঈ। কাশীকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া তাঁহারা ভারতীয় সংস্কৃতিকে নবজীবন দান করিলেন।

 কাজেই নারীরা যে এদেশে শুধু ঘরে ও সংসারেই রাজত্ব করিয়াছেন তাহা নহে। মহাভারতে দেখি, সেখানেও সকলের আহারে-বিহারে নারীরাই কর্তৃত্ব করিতেন। পত্নীরা স্বামীদের কাছে সম্মানও যথেষ্ট পাইয়াছেন। পথশ্রান্তা দ্রৌপদীর পথখেদ দূর করিতে নকুল ও সহদেব তাঁহার পাদসংবাহনও করিয়াছেন—

তস্যা যমৌ রক্ততলৌ পাদৌ পূজিতলক্ষণৌ।
করাভ্যাং কিণজাতাভ্যাং শতকৈঃ সংববাহতুঃ। বন ১৪৪-২০

 নারীদের ভালো দিকই দেখান হইল। তাঁহাদের মধ্যে মন্দও কিছুকিছু যে না ছিল তাহা নহে। মহাভারতের যুগেও দেখা যায়, নারীদের মধ্যে সুরাপানাদি দোয বেশ ছিল। খাণ্ডবদাহপর্বে দেখা যায়, দ্রৌপদী সুভদ্রা প্রভৃতি সহ বড় বড় ঘরের নারীরা তাহাতে ছিলেন। সেখানেও উৎসবের আনন্দে কোনো নারী হাসিতেছেন, কেহ হল্লা করিতেছেন, কেহ নাচিতেছেন, কেহ সুরাপান করিতেছেন—

কাশ্চিৎ প্রহৃষ্টা ননৃতুশ্চুক্রূশুশ্চ তথাপরাঃ।
জহসুশ্চাপরা নার্যঃ পপুশ্চান্যা বরাসবম্। আদি ২২২ - ২৪

শিশুপালবধকাব্যেও রেবতী-বলরামের সুরাপান-উৎসব চমৎকার বর্ণিত দেখা যায়—

ঘূর্ণয়ন্ মদিরাস্বাদমদপাটলিতদ্যুতৌ।
রেবতী বদনোচ্ছিষ্টপরিপূততটে দৃশৌ। ২.১৬

তবে পাণিনির (৩.২.৮) বার্তিকে (২) নারীদের সুরাপান পাতক বলিয়াই উল্লিখিত। কিন্তু, তাহা সত্ত্বেও সমাজে নারীদের মধ্যে সুরার বিলক্ষণ প্রচলন ছিল।

 সহমরণ প্রথার কথা পূর্বে হইয়াছে। এই প্রথা আর্যদের মধ্যে খুব প্রাচীন বৈদিক যুগে ছিল না। রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর বলেন, বরং এই প্রথা প্রাচীনকালে য়ুরোপে ও পশ্চিম এশিয়ায় আর্যেতর জাতির মধ্যেই প্রচলিত ছিল। এদেশে আর্যদের মধ্যে এই প্রথা বিদেশী অনার্যদের নিকট হইতে আমদানি করা। পঞ্চনদ প্রদেশের তক্ষশিলাদি ভূভাগে তখন গ্রীকদের প্রভাব ছিল বেশি। খ্রীস্টের তিন-চারিশত বৎসর পূর্বে সেইসব স্থানে সতীদাহ খুব বেশি রকম প্রচলিত ছিল।[১৩]

 বেদের যেসব মন্ত্র এই প্রথার প্রমাণরূপে ব্যবহৃত হয় তাহাদের অর্থ কিন্তু সতীদাহকে সমর্থন করে না। পরবর্তী স্মৃতি ও ব্যাখ্যানাদির রচয়িতারা বরং ইহার সমর্থন করেন। অথর্বের একটি মন্ত্র আছে—

ইয়ং নারী পতিলোকং বৃণানা, ইত্যাদি। ১৮. ৩. ১.

ভাষ্যে স্বামীর চিতায় আরোহণ-সমর্থনে শঙ্করাচার্য শ্রুতিবাক্য না পাইয়া স্মৃতি র বাক্য উদ্ধৃত করিয়াছেন—

স্মর্যতে হি, ভর্তার উদ্ধরেন্নারী প্রবিষ্টা সহ পাবকম্।

আশ্বলায়ন-গৃহ্যসূত্রেও এই একই মত দেখা যায়। ঋগ্বেদের যে মন্ত্রটি এখন সতীদাহের প্রধান সমর্থকরূপে ব্যবহৃত, রমেশ দত্ত প্রভৃতি পণ্ডিতেরা দেখাইয়াছেন তাহার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূলে আছে, ‘আরোহন্তু জনয়ো যোনিরগ্রে’ (ঋগ্বেদ ১০, ১৮, ৭), কিন্তু তাহা বদলাইয়া করা হইয়াছে ‘যোনিমগ্নে’।

 ঋগ্বেদের মূল হইল এই—

ইমা নারীরবিধবাঃ সুপত্নীরাংজনেন সর্পিষা সংবিশস্তু।
অনশ্রবোঽনমীবাঃ সুরতা আরোহন্তু জনয়ে যোনিরগ্রে। ১০. ১৮.৭

 সায়ণও ইহার ভাষ্যে বলেন, এইসব অবিধবা শোভনপতিকা নারী স্নেহসিক্ত ও অঞ্জনে মণ্ডিত হইয়া আপন ঘরে প্রবেশ করুন। অশ্রুজলহীন ও নীরোগ হইয়া শোভন রত্নে মণ্ডিতা হইয়া এইসব ভার্যা প্রথমেই আপন ঘরে আসুন।

 ইহার পরের মন্ত্রটিতেও এই কথারই সমর্থন—

উদীর্ষ্ব নার্য্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।
হস্তগ্রাভস্য দিধি যোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সং বভূথ। ঋগ্বেদ ১০. ১৮, ৮

 সায়ণ ইহার অর্থ করেন, হে মৃতের পত্নি, পুত্রপৌত্রাদিযুক্ত জীবলোকের উদ্দেশ্যে এই স্থান হইতে উঠিয়া এস। গতপ্রাণ পতির পাশে কেন এখন শুইয়া আছ, সেখান হইতে উঠিয়া এস। যিনি তোমার পাণিগ্রহণ ও গর্ভাধান করিয়াছিলেন তাঁহার পত্নীজনোচিত কাজ তুমি যথেষ্ট করিয়াছ, এখন উঠিয়া এস।

 এই মন্ত্রটি অথর্ববেদের অষ্টাদশ কাণ্ডের তৃতীয় সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্র। আশ্বলায়নও (৪. ২. ৩) এই মন্ত্রের সমর্থন করিয়াছেন।[১৪]

 এইখানে ভট্টভাস্কর ভাষ্য করেন সেই নারীকে পতিস্থানীয় দেবর ধরিয়া উঠাইবেন। কারণ প্রাচীন বিধি আছে—

তামুত্থাপয়েদ্ দেবরঃ পতিস্থানীয়োঽস্তেবাসী
জরদ্দাসো বোদীর্ঘ নার্যভিজীবলোকমিতি।

 পতিস্থানীয় দেবর, স্বামীর ছাত্র বা বৃদ্ধ দাস সেই নারীকে সেখান হইতে উঠাইতে গিয়া বলিবে, হে নারী, জীবলোকে ফিরিয়া এস (উদীর্ষ্ব নার্য্যভিজীবলোকম্)। মহাভারতে দেখা যায় মাদ্রী পতিসহ চিতারোহণ করেন, কিন্তু কুন্তী সংসারের ভার লইয়া রহিলেন। বাসুদেবসহ শ্রীকৃষ্ণপত্নীগণ সহমৃতা হইলেও তখনকার বহু সতী সহমৃতা হন নাই। দক্ষ প্রভৃতি স্মৃতিতে স্বামীর সঙ্গে চিতারোহণের প্রশংসা আছে—

মৃতে ভর্তরি যা নারী সমারোহেদ্ধুতাশনম্।
সা ভবেত্তু শুভাচারী স্বর্গলোকে মহীয়তে। ৩০,১৯,২০

 স্বামীর সহমৃতা হইলে নারী শুভাচারা হয়েন এবং স্বর্গলাভ করেন। বিধবার ব্রহ্মচর্যের প্রশংসা মনু বিশেষভাবেই করিয়াছেন—

মৃতে ভর্তরি সাধ্বী স্ত্রী ব্রহ্মচর্যে ব্যবস্থিত॥
স্বর্গং গচ্ছত্যপুত্রাপি যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ॥ ৫. ১৬০

 কাজেই সহমরণ প্রথা যখন প্রচলিত হইল তখনও সকলে ইহা স্বীকার করেন নাই। মহানির্বাণ-তন্ত্র তো স্পষ্টভাবেই বলিলেন, স্বামীর সঙ্গে কুলকামিনীকে কখনও দগ্ধ করিবে না—

ভর্ত্রাসহ কুলেশানি ন দহেৎ কুলকামিনীম্। ১০, ৭৯

  1. গণপতি শাস্ত্রী, সংস্করণ ১৯২৪, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ২০
  2. পরাশর-মাধব, আচারকাণ্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়, Bibliotheca Indica, A. S. B. চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার কর্তৃক সম্পাদিত, পৃ ৪৮৫
  3. স্মৃতি-চন্দ্রিকা, সংস্কারকাণ্ড, স্ত্রীসংস্কার
  4. যজ্ঞপরিভাষা, দ্বিতীয় সূত্র, ভাষ
  5. Prabhakar School and Popular Mimamsa
  6. শতপথ ব্রাহ্মণ—১, ৯, ২, ১৪; পাণিনি, ৪, ১, ৩৩
  7. ঋগ্বেদ ১.১২২.২; ৩,৫৩.৪-৬; ৮.৩১.৫; ১০.৮৬.১০ ইত্যাদি; শতপথ ব্রাহ্মণ ৪. ১৩
  8. জৈমিনি ন্যায়মালা ৬.১.৩.১৪
  9. জৈমিনি ন্যায়মালা ৬.১.৩.১৬-১৭
  10. অনুশাসন, ৪৬. ১৩; ৫৯. ২৯
  11. পীতঃ সোমো যথাবিধি। আশ্রমবাসিক, ১৭. ১৭
  12. দারেষুধীনো ধর্মশ্চ। অশ্বমেধ, ৯০. ৪৮
  13. Oxford History of India, V. A. Smith. p 665
  14. Mysore Edn G. O. L. S., No. 26, Vol. 1, p 327