প্রাচীন ভারতে নারী/নারীদের উত্তরাধিকার বিষয়ে ব্যবহার নির্ণয়

নারীদের উত্তরাধিকার বিষয়ে ব্যবহারনির্ণয়

 বাংলাদেশে উত্তরাধিকারের বিষয়ে জীমূতবাহনের দায়ভাগই প্রধান। জীমূতবাহন ছিলেন বাঙালি এবং একাদশ শতাব্দীর লোক। দায়ভাগ তাঁহার বৃহত্তর গ্রন্থ ‘ধর্মরত্নের’ অংশবিশেষ। বাংলাদেশের নিয়মের সঙ্গে মাদ্রাজ, বোম্বাই, কাশী, মিথিলার ঠিক মিল নাই। সেসব দেশে মিতাক্ষরারই সমাদর। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির উপর বিজ্ঞানেশ্বর যে মতামত ব্যক্ত করিয়াছেন তাহাই মিতাক্ষরা, তাহাও একাদশ শতাব্দীর।

 অনেকে মনে করেন, দায়ভাগ অপেক্ষা মিতাক্ষরাতে নারীদের দায়াধিকার বেশি করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহা ঠিক নহে। বিবাহাদির জন্য অনূঢ়া কন্যা পিতৃধনের অংশ পাইতে পারেন ইহাই মিতাক্ষরার মত, তাহাদের ঠিক দায়াধিকার নাই। মিতাক্ষরার মতে, নারীদের দ্বারা ধর্মত উপার্জিত ধনেও স্বামীরই অধিকার। তাহাও স্ত্রীধন নহে। স্ত্রীধন একটি পারিভাষিক শব্দ। অধ্যগ্নি, অধ্যাবাহনিক, অন্বাধেয়, যৌতক প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ ধনই স্ত্রীধন। শ্বশুর শ্বাশুড়ীর কাছে পাওয়া ধনও স্ত্রীধন হইতে পারে, ইহা কোথাও কোথাও দেখা যায়। স্ত্রীধন ছাড়া আরও কোনো কোনো ধনে বা খোরপোশ পাইতে নারীর আধিকার আছে, কিন্তু তাহাতে নারীর দান-বিক্রয়াদির পূর্ণাধিকার নাই। স্ত্রীধনে নারীরই অধিকার। স্বামী তাহা হইতে কিছু লইতে বাধ্য হইলেও তাহা পরিশোধ করিতে বাধ্য। তবে আপৎকালে বা স্বামী অসমর্থ হইলে স্বতন্ত্র কথা।

 দায়ভাগ বা মিতাক্ষরার মতামত অনেকেই জানেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে দেশপ্রচলিত স্মৃতি-নিবন্ধাদি আলোচনা করিয়া সেই বিষয়ে শ্রীযুত নারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ মহাশয়ের ‘হিন্দু স্ত্রীধনাধিকার’ গ্রন্থখানি অতিশয় যত্নের সহিত লিখিত। তাহার বিশেষ আলোচনা না করিয়া বরদরাজ-কৃত ব্যবহার-নির্ণয়ের মতামত এই বিষয়ে কি তাহাই এখানে দেখানো যাইতেছে।

 ব্রাহ্মণের যদি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চারি জাতীয়া পত্নী ও তাহাদের গর্ভজাত সন্তান থাকে, তবে তাহাদের মধ্যে ধনবিভাগ কি ভাবে হইবে তাহা বরদরাজ মনু হইতে (৯. ১৫২) উদ্ধৃত করিয়াছেন (পৃ ৪২৮) এবং বৃহস্পতির ব্যবস্থাও দেখাইয়াছেন (ঐ)। বিষ্ণু বলেন, সর্বত্রই আনুলোময়ে জাত পিতার এক পুত্র পিতার সমগ্র ধন পাইবে—

সর্বত্রানুলোম্যেন জাতঃ পিতুরেকঃ পুত্রঃ পিত্র্যং সর্বং ধনমর্হতি। পৃ ৪২৯

দেবলও এই কথাই বলেন—

আনুলোম্যেকপুত্রস্তু পিতুঃ সর্বস্বভাগ্‌ভবেৎ।

শূদ্রাতে জাত আনুলোম্য পুত্রের পক্ষে এই বিধি চলিবে না (ঐ)—

শূদ্রায়াং জাতপুত্রব্যতিরিক্তবিষয়মিদম্। (ঐ)

 বৃহস্পতি বলেন, দ্বিজাতির যদি মাত্র শূদ্রকন্যাতে এক পুত্র হয় তবে সেই পুত্র অর্ধ ভাগ পাইবে—

দ্বিজাতেঃ শূদ্রায়াং জাতস্ত্বেকঃ পুত্রোঽর্দ্ধভাগিতি বৃহস্পতিঃ। ঐ

 বিষ্ণুও বলেন—

দ্বিজাতীনাং শূদ্রস্ত্বেকঃ পুত্রোঽর্ধহরঃ। ঐ

 দেবল বলেন, ব্রাহ্মণের যদি শূদ্রপত্নীর গর্ভজাত সন্তান থাকে তবে পিতার মরণে সে এক-তৃতীয়াংশ ও শ্রাদ্ধাধিকারী সপিণ্ড সকুল্যেরা দুই-তৃতীয়াংশ পাইবে—

নিষাদ একপুত্রস্তু বিপ্রস্য দ্ব্যংশভাগ্‌ভবেৎ।
দ্বৌ সপিণ্ডঃ সকুল্যো বা স্বধাদাতা তু সংহরেৎ। পৃ ৪৩০

 শূদ্রের যদি দাসীগর্ভজাত পুত্র থাকে তবে সেও পিতার ধনের অংশ পাইবে—

দাস্যাং বা দাসদাস্যাং বা যচ্ছূদ্রস্য সুতো ভবেৎ।
সোঽনুজ্ঞাতো হরেদংশমিতি ধর্মো ব্যবস্থিতঃ। পৃ ৪৩১

যাজ্ঞবল্ক্যও তাহা সমর্থন করেন—

জাতোঽপি দাস্যাং শূদ্রেণ কামতোঽংশহরো ভবেৎ। ঐ

 এইখানে বলা উচিত যে ‘অংশ’ ও ‘দায়’ এক কথা নয়। দায়ে নির্দিষ্ট ভাগ অভিপ্রেত, অংশ শব্দে অনির্দিষ্ট কিয়ৎপরিমাণ অর্থ বুঝায়। তাহা ভরণপোষণ বা খোরপোশ এই দুইয়েরই বহির্ভূত। যাহার দায়ে বা অংশে কোনো দাবি নাই সেও খোরপোশ পাইতে পারে। যথা, প্রতিলোমজাতপুত্রদেরও ভরণপোষণ দিতে পিতা বাধ্য এই কথা গৌতম বলেন—

প্রতিলোমানামপি সংব্যবহার্যাণাং সুতানাং শুশ্রূষূণাং জনকেন জীবনং দেয়মিত্যাহ গৌতমঃ। পৃ ৪৩০

 নারীদের দায়াধিকারের কথা প্রসঙ্গে দেখা যায় বরদরাজ খুবই উদার ও যুক্তিযুক্তভাবে তাহার সমাধান করিয়াছেন। বিষ্ণুস্মৃতির মতে তিনি বলেন, মায়েরা পুত্রেরই ভাগানুসারে ভাগহারিণী হইবেন—

মাতরঃ পুত্রভাগানুসারিভাগহারিণ্য ইতি। পৃ ৪২৯

 বরদরাজ বলেন, কেহ কেহ পত্নীদের ভাগ স্বীকার করেন না—

তত্র পত্নী নির্ভাগেতি কেচিৎ। পৃ ৪১৪

 কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের মতে, স্বামী বা শ্বশুর যদি নারীকে স্ত্রীধন না দিয়া থাকেন তবে পুত্রদের সমান অংশ পত্নীকে দেওয়া উচিত—

যদি কুর্যাৎ সমানংশান্ পত্ন্যঃ কার্যাঃ সমাংশিকাঃ।
ন দত্তং স্ত্রীধনং যাসাং ভর্ত্রা বা শ্বশুরেণ বা। পৃ ৪১৫

 যদি পিতা সব পুত্রদের ভাগ সমান করিয়া দেন তবে সজাতীয় পত্নীদেরও সমান ভাগ দেওয়া উচিত। যদি স্বামী বা শ্বশুরের দেওয়া কিছু স্ত্রীধন নারীরা পাইয়া থাকেন তবে যতটা দিলে পুত্রদের সঙ্গে তাহাদের ভাগ সমান হয় ততটা দেওয়া কর্তব্য—

 যদা স্বেচ্ছয়া পিতা সর্বানেব সুতান্ সমভাগিনঃ করোতি, তদা সজাতীয়পত্ন্যশ্চ পুত্রসমাংশভাজঃ কর্তব্যাঃ। যাসাং পত্নীনাং ভর্ত্রা শ্বশুরেণ বা স্ত্রীধনং দত্তং, দত্তে চ স্ত্রীধনে তদপেক্ষয়া ভাগপরিপূরণং কর্তব্যম্। পৃ ৪১৫

 মিতাক্ষরাতেও ঠিক এই বিধানই দেখা যায় (২. ১১৫)। কাজেই মিতাক্ষরাও এই মতই সমর্থন করেন (ঐ)।

 পিতার জীবৎকালে বিভাগ হইলে মাতাদের ভাগ সমান হইবে। এই কথা বলিয়া যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, পিতামৃতেও মাতারা সমাংশভাগিনী হইবেন।

 এবং জীবদ্বিভাগে সমাংশভাগিত্বং মাতৃণামুক্ত্বা পিতরি মৃতেঽপি সমাংশভাজো ভবন্তীত্যাহ যাজ্ঞবল্ক্যঃ। ব্যবহার নির্ণয়, পৃ ৪১৫

 যাজ্ঞবল্ক্য আরও বলেন, পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগকালে মাতাও সমান অংশ পাইবেন—

পিতুরূর্ধ্বং বিভজতাং মাতাঽপ্যংশঃ সমং হরেৎ। ঐ

 নারদও বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর মাতা সমাংশভাগিনী—

মাংশভাগিনী মাতা পুত্রাণাং স্যান্মৃতে পতৌ। ঐ

 বৃহস্পতির মতেও—

তদভাবে তু জননী তনয়াংশসমাংশিনী। পৃ ৪১৬

 ব্যাসও এই কথা সমর্থন করেন এবং পিতামহীকেও মাতার মত ভাগাধিকার দেন—

অসুতাস্তু[১] পিতুঃ পত্ন্যঃ সমানাংশাঃ প্রকীর্তিতাঃ।
পিতামহ্যশ্চ সর্বাস্তু মাতৃতুল্যাঃ প্রকীর্তিতাঃ।

 কাজেই মায়েদের মত পিতামহীদেরও ভাগাধিকার থাকা উচিত—

পিতামহ্যা অপি মাতৃবদ্ভাগকল্পনং যুক্তমিতি।

 বিষ্ণু বলেন, মাতা এবং অবিবাহিতা কন্যা পুত্রভাগানুসারিভাগহারী—

মাতরঃ পুত্রভাগানুসারিভাগহারিণ্য অনূঢ়াশ্চ দুহিতরঃ ইতি। ঐ

 বৃহস্পতি বলেন, মায়ের ভাগ সমান, কন্যার ভাগ একচতুর্থাংশ—

সমাংশা মাতরস্তেষাং তুরীয়াংশা চ কন্যকা। ঐ

 কাত্যায়নও অবিবাহিতা কন্যার এক চতুর্থাধিকারই সমর্থন করেন—

কন্যকানাং ত্বদত্তানাং চতুর্থো ভাগ ইষ্যতে।
ভ্রাতৃণাং চ ত্রয়ো ভাগঃ সমং স্বল্পধনে স্মৃতম্।

 সামান্য সম্পত্তি হইলে কন্যা ও পুত্রদের ভাগ সমানই হইবে।

 মনু বলেন, ভাইরা আপন ভাগ হইতে কন্যাকে ভাগ দিবেন। না দিতে চাহিলে ভ্রাতারা পতিত হইবেন—

স্বেভ্যোংঽশেভ্যস্ত কন্যাভ্যঃ প্রদদ্যুর্ভ্রাতরঃ পৃথক্।
স্বাৎস্বাদংশাচ্চতুর্ভাগং পতিতাঃ স্যুরদিৎসবঃ। ঐ

 শঙ্খ-লিখিত এবং বোধায়ন বলেন, দায়ভাগকালে কন্যা আপন ভাগের সহিত নিজ অলংকার ও বৈবাহিক স্ত্রীধনও পাইবেন—

বিভজ্যমানে দায়াদ্যে কন্যালংকারং বৈবাহিকং স্ত্রীধনং চ কন্যা লভেত। পৃ ৪১৭

 পৈঠীনসি বলেন, কন্যা এই সঙ্গে বৈবাহিক স্ত্রীধনও পাইবেন—

কন্যা বৈবাহিকং স্ত্রীধনং চ লভেত। ঐ

 পুত্রাভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার কিরূপ হইবে সেই বিষয়ে বরদরাজ বহু প্রাচীন বিধি সংকলিত করিয়া বিচার করিয়াছেন (পৃ ৪৪৮-৪৬১)। স্ত্রীগণের দায়াধিকার বিষয়ে যে অনেকের ভালো সম্মতি নাই তাহা তিনি দেখাইয়াছেন। এবং সেইসব প্রতিকূল মত খণ্ডন করিয়া যুক্তিযুক্ত উত্তম মতটি স্থাপন করিয়াছেন। বরদরাজ বলেন, অনেকে মনে করেন পুত্রাভাবেই কন্যারা পিতার সম্পত্তি পাইতে পারেন—

যানি পুনর্দুহিতৄণাং ধনপ্রতিপাদকানি বাক্যানি তানি পুত্রিকাবিষয়াণি। ঐ পৃ ৪৫৬

আবার অনেকে মনে করেন, স্ত্রীগণের দায়সম্বন্ধ নাই—

অন্যে তু স্ত্রীণাং ন দায়সম্বন্ধঃ। ঐ

কারণ শ্রুতিতে আছে—

তস্মাৎ স্ত্রিয়ো নিরিন্দ্রিয়া অদায়াদীঃ। ঐ

 এই বাক্যটি আপস্তম্ব-ধর্মসূত্রের।

 এইখানে বরদরাজ স্মৃতি ও পুরাণ হইতে বিস্তর প্রতিকূল বচন একত্র করিয়া দেখাইয়াছেন যাহাতে নারীদের উত্তরাধিকার নাই। কোনো কোনো পুরাণবাক্যে আছে, স্বামীর মৃত্যুর পরে বিধবাকে খোরাক-পোশাক মাত্র দিতে হইবে, তাহাও দিবে, হিসাব করিয়া—

বসনাশনবাসাংসি বিগণয়্য ধবে মৃতে। ঐ

কোনো কোনো স্মৃতিতে আছে, সবদ্রব্যই যজ্ঞার্থ উৎপন্ন, সেখানে নারীর অধিকার নাই, তাই তাহাদের উত্তরাধিকার নাই। মাত্র গ্রাসাচ্ছাদন তাহারা পাইতে পারে—

যজ্ঞার্থং দ্রব্যমুৎপন্নং তত্র নাধিকৃতাঃ স্ত্রিয়ঃ।
অরিক্‌থভাজস্তাঃ সর্বাঃ গ্রাসাচ্ছাধনভাজনাঃ॥ ঐ

 বৃহস্পতি বলেন, যৌবনে বিধবা হইলে নারী কর্কশা হইয়া যায়। তাই জীবন যাপন করিবার মত তাহাকে সামান্য কিছু খোরপোশ দিলেই চলে—

বিধবা যৌবনস্থা চেন্ নারী ভবতি কর্কশা।
আয়ুষঃ ক্ষপণার্থং তু দাতব্যং জীবনং তদা॥ পৃ ৪৫৭

 মনুর মতে, অপুত্রা বিধবা সৎপথে থাকিলে ভরণপোষণমাত্র পাইতে পারে। প্রজাপতি বলেন, বিধবার খোরাকী বলিয়া আঢ়ক-প্রমাণ শস্য দিবে—

আঢ়কং ভর্তৃহীনায়া দাতব্যং বিধবাশনম্। ঐ

অপরাহ্ণে ইন্ধন ও একপ্রস্থ চাউল তাহাকে দিবে—

অন্নার্থং তণ্ডুলপ্রস্থমপরাহ্ণে তু সেদ্ধনম্। ঐ

 বরদরাজ বলেন, এইসব কথায় বুঝা যায়, ব্যবস্থাপকদের মতে বিধবা জ্ঞাতিদের কাছে খোরাকি মাত্র পাইবেন। দায়াধিকার বিধবার নাই, কিন্তু সেইসব কথায় কোনো যুক্তি নাই।

 বিষ্ণুর মতকে প্রমাণ করিয়া বরদরাজ বলেন, পুত্রহীন পরলোকগতের ধন পত্নীতেই যাইবে, পত্নী না থাকিলে দুহিতা, দুহিতার অভাবে পিতা অধিকারী—

 অনপত্যস্য প্রমীতস্য ধনং পত্ন্যভিগামি। তদভাবে দুহিতৃগামি। তদভাবে পিতৃগামি। তদভাবে মাতৃগামি। ইত্যাদি পৃ ৪৪৮

 বৃহস্পতি বলেন, ভার্যাসুতবিহীন পরলোকগতের ধনাধিকারিণী মাতা বা তদাজ্ঞায় ভ্রাতা—

ভার্যাসুতবিহীন্স্য পুরুষস্য মৃতস্য চ।
মাতা রিক্‌থহরা জ্ঞেয়া ভ্রাতা বা তদনুজ্ঞয়া। ঐ

 বৃদ্ধমনু বলেন, অপুত্রা সাধ্বী পত্নী স্বামীর পিণ্ডদানের ও সম্পূর্ণ অংশের অধিকারিণী—

পত্যৈব দদ্যাৎ তৎপিণ্ডং কৃৎস্নমংশং লভেত চ। ঐ

 প্রজাপতিকে উদ্ধৃত করিয়া বরদরাজ বলেন, ভার্যা অর্ধাঙ্গিনী, পুণ্যাপুণ্যফলভাগিনী, তিনি বাঁচিয়া থাকিতে স্বামীর ধন কেন অন্যে পাইবে?—

আম্নায়ে স্মৃতিতন্ত্রে চ লোকাচারে চ সূরিভিঃ।
শরীরার্ধং স্মৃতা জায়া পুণ্যাপুণ্যফলে সমা।
যস্য নোপরতা ভার্যা দেহার্ধং তস্য জীবতি।
জীবত্যর্ধশরীরেঽর্থং কথমন্যঃ সমাপ্নুয়াৎ।[২]পৃ ৪৪৯

 শ্রুতির মতেও স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে এক পূর্ণ স্বরূপেরই দুই অংশ। স্ত্রী যদি স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী হন তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর মধ্যে তিনিই বর্তিয়া থাকেন (continues to exist), কাজেই তখনও উত্তরাধিকারের প্রশ্নই উঠে না। কারণ তখনও অধিকারীর আর-এক অংশ বাঁচিয়া-বর্তিয়াই আছেন। সুতরাং তখন ধন-“অধিকারী” বলিয়া সেই অর্ধাঙ্গেরই প্রাপ্য, “উত্তরাধিকারী” বলিয়া নহে। পত্নী না থাকিলে তখন সন্তানদের উত্তরাধিকারের কথা। সেখানেও পুত্র অপেক্ষা কন্যার দাবি কেন কম হইবে?

 বৃহস্পতিও বলেন, পত্নী স্বামীর ধনহারিণী, পত্নীর অভাবে দুহিতা—

ভর্তুর্ধনহরী পত্নী তাং বিনা দুহিতা স্মৃতা। ঐ

 পিতামহও বলেন, অপুত্র স্বামীর পত্নীই স্বামীর ভাগহারিণী—

অসুতস্য প্রমীতস্য পত্নী তদ্‌ভাগহারিণী। ঐ

 কাত্যায়নের মতেও অব্যভিচারিণী পত্নী স্বামীর ধনহারিণী, তদভাবে তাঁহার কন্যা যদি সে তখনও অনূঢ়া থাকে—

পত্নী ভর্তুর্ধনহরী যা স্যাদব্যভিচারিণী।
তদভাবে তু দুহিতা যদ্যনূঢ়া ভবেৎ তদা। পৃ ৪৫

 দেবল বলেন, পিতৃদ্রব্য ও বৈবাহিক ধন কন্যাদের দিতে হইবে। অপুত্রদের ধর্মজা কন্যা পুত্রবৎ পিতৃধনের অধিকারিণী—

কন্যাভ্যশ্চ পিতৃদ্রব্যং দেয়ং বৈবাহিকং বসু।
অপুত্রকস্য স্বং কন্যা ধর্মজা পুত্রবদ্ধরেৎ। পৃ ৪৫১

 মনু-নারদ উভয়েই বলেন, পুত্র যেমন আত্মসম, দুহিতাও তেমনি পুত্রসমা কাজেই আপনার ও পুত্রকন্যার মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই। সেই আপনি বাঁচিয়া থাকিতে, অর্থাৎ পুত্রকন্যা থাকিতে, কেন অন্যে ধন হরণ করিবে?—

যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ। ঐ

প্রসঙ্গবশে এই শ্লোকটির উল্লেখ পূর্বেও করা হইয়াছে।

মনুও (৯.১৩০) বলেন—

যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।

নারদও বলেন, পুত্রকন্যা উভয়ই সমান। কাজেই পুত্রাভাবে দুহিতাই পুত্র। পুত্রকন্যা উভয়ই পিতার বংশ রক্ষা করে—

পুত্রাভাবে তু দুহিতা তুল্যসন্তানদর্শনাৎ।
পুত্রশ্চ দুহিতা চোভৌ পিতুঃ সন্তানকারকৌ। ঐ

বৃহস্পতি বলেন, পত্নী স্বামীর ধনহারিণী, পত্নী না থাকিলে দুহিতাই শাস্ত্রবিহিত উত্তরাধিকারিণী। অঙ্গ-অঙ্গ হইতে সম্ভূতা কন্যা তো মানুষের পক্ষে পুত্রেরই সমান। তাহার পিতৃধন কেন অন্যলোক হরণ করিবে?—

ভর্তুর্ধনহরী পত্নী তাং বিনা দুহিতা স্মৃতা।
অঙ্গাদঙ্গাৎ সম্ভবতি পুত্রবদ্ দুহিতা নৃণাম্।
তস্যাঃ পিতৃধনং ত্বন্যঃ কথং গৃহ্ণীত মানবঃ॥ পৃ ৪৫১-৪৫২

দুহিতা না থাকিলে দৌহিত্রেরা পাইবেন ইহাই বরদরাজের মত—

দুহিত্রভাবে দৌহিত্রাঃ গৃহ্ণীয়ুঃ। ঐ

 পুত্র উপার্জন করিতে পারেন। পিতৃধন না পাইলেও তাঁহার চলে। কন্যার উপার্জনক্ষমতা বা ধন যদি না থাকে তবে পিতৃধন না পাইলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। তাঁহার দাবি বরং বেশি। পতির জীবৎকালে স্ত্রীর অঙ্গে যে অলংকার থাকে তাহাতে পতিকুলস্থ লোকের কোনো দাবি নাই। দাবি করিলে তাঁহারা পতিত হন। মনুর এই মত বরদরাজ উদ্ধৃত করিয়াছেন—

পত্যৌ জীবতি যঃ স্ত্রীভিরলঙ্কারো ধৃতো ভবেৎ।
ন তং ভজেরন্ দায়াদাঃ ভজমানাঃ পতন্তি তে। পৃ ৪৬৮

ইহাতে কাত্যায়নের যে সমর্থন তাহাও এখানে উদ্ধৃত হইয়াছে—

স্ত্রীণাং ভর্র্তৃকুলাল্লব্ধং পিতুঃ কুলত এব বা।
ভূষণং ন বিভাজ্যং স্যাৎ জীবনে ন চ যোজয়েৎ। ঐ

 পতির বা পিতার কুলের কাছে প্রাপ্ত সব অলংকারই স্ত্রীর নিজস্ব। জ্ঞাতিগণ তাহার দ্বারা সেই নারীর খোরপোশের দাবি মিটাইতে পারিবেন না।

 আপস্তম্ব যদিও বলিয়াছেন, কেহ কেহ কিন্তু ভার্যার অলংকারকেও জ্ঞাতিধন বলেন—

অলঙ্কারো ভার্য্যায়া জ্ঞাতিধনং চেত্যেকে। পৃ ৪৬৯

এইখানে বরদরাজ নারদের মতের দ্বারা এই বৃথা দাবি নিরস্ত করিয়াছেন। নারদ বলেন, স্বামীর দ্বারা প্রীতিদত্ত অলংকার স্বামীর মৃত্যুর পরেও সম্পূর্ণভাবে স্ত্রীর। তাহারই ভোগ-ত্যাগের দানবিক্রয়ের পূর্ণাধিকার। কিন্তু স্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রীর দানবিক্রয়ের অধিকার নাই—

প্রীতিদত্তস্যালংকারস্য স্বত্বে প্রাপ্তে স্থাবরেঽপবাদমাহ নারদঃ
ভর্ত্রা প্রীতেন যদ্দত্তং স্ত্রিয়ৈ তস্মিন্ মৃতেঽপি তৎ।
সা যথাকামমশ্নীয়াৎ দদ্যাদ্‌ বা স্থাবরাদৃতে। ঐ

 কাজেই স্থাবর সম্পত্তিতে নারদের মতে স্বামীর মৃত্যুর পর স্বত্ত্ব হয় না। কিন্তু অন্যান্য অনেক শাস্ত্রকারের মতে প্রীতিদত্ত স্থাবরেও স্ত্রীরই স্বত্ব হয়—

প্রীতিদত্তং স্থাবরং দাতরি মৃতে স্ত্রিয়াঃ ন স্বং ভবতি ইত্যর্থঃ।
কেচিৎ তু প্রীতিদত্তং স্থাবরমপি স্বমেব। ঐ

 এখানে যাজ্ঞবল্ক্যের একটি বিশেষ বিধি বরদরাজ উদ্ধৃত করিয়াছেন— দুর্ভিক্ষে, ধর্মকার্যে, ব্যাধিতে, রাজার হাতে বন্দী হইলে যদি স্বামী স্ত্রীধন হইতে কিছু নেন তবে তাঁহাকে বাধ্য করিয়া তাহা আদায় করা অনুচিত—

দুর্ভিক্ষে ধর্ম কার্যে চ ব্যাধৌ সংপ্রতিরোধকে।
গৃহীতং স্ত্রীধনং ভর্ত্রা নাকামো দাতুমর্হতি॥ ঐ

 এইখানে কাত্যায়ন বলেন, স্ত্রীধনে স্বামী-পুত্র পিতা-ভ্রাতা কাহারই কোনো অধিকার নাই। যদি ইহাদের মধ্যে কেহ বলপূর্বক তাহা ভোগ করেন তবে তিনি দণ্ডনীয় এবং সুদসহ তাহা ফিরাইয়া দিতে বাধ্য—

নৈব ভর্তা নৈব সুতো ন পিতা ভ্রাতরো ন চ।
আদানে বা বিসর্গে বা স্ত্রীধনে প্রভবিষ্ণব।
যদি হ্যন্যতরো হ্যেষাং স্ত্রীধনং ভক্ষয়েদ্ বলাৎ।
সবৃদ্ধিকং প্রদাপ্যঃ স্যাৎ দণ্ডং চৈব সমাপ্নুয়াৎ। ঐ

 তবে কাত্যায়ন বলেন, যদি ইহাদের কেহ ঠেকায় পড়িয়া স্বত্বাধিকারিণীর আজ্ঞানুসারে কিছু ভোগ করেন তবে সমর্থ হইলেই সেই মূল্যধন তিনি ফিরাইয়া দিতে বাধ্য। ব্যাধিত ব্যসনার্ত বা ঋণের দায় দেখিয়া যদি স্বত্বাধিকারিণী আপন খুশিতে তাহাকে কিছু সাহায্য করিয়াও থাকেন তবে পরে সেই স্ত্রীধন আপন ইচ্ছায় তাঁহারই ফিরাইয়া দেওয়া উচিত—

তদেব যদনুজ্ঞাপ্য ভক্ষয়ে‍ৎ প্রীতিপূর্বকম্।
মূল্যমেব স দাপ্যঃস্যাৎ যদাসৌ ধনবান্ ভবেৎ।
ব্যাধিতং ব্যসনার্তং চ ধনিকৈর্বোপপীড়িতম্।
জ্ঞাত্বা নিসৃষ্টং যৎপ্রীত্যা দদ্যাদাত্মেচ্ছয়া তু সঃ। পৃ ৪৭০

 দেবল বলেন, বৃত্তি আভরণ শুল্কলাভ সব সমেতই স্ত্রীধন। স্ত্রীই তাহা ভোগ করিবেন। বিপদগ্রস্ত না হইলে পতির তাহাতে কোনো দাবি নাই। যদি বিনা কারণে পতি তাহা ভোগ করেন তবে স্ত্রীকে সুদ সমেত ফিরাইয়া দিতে তিনি বাধ্য। পুত্রের পীড়ার প্রতিকারেও স্ত্রীধন লওয়া যাইতে পারে—

বৃত্তিরাভরণং শুল্কং লাভং চ স্ত্রীধনং ভবেৎ।
ভোক্ত্রী তৎস্বয়মেবেদং পতির্নার্হত্যনাপদি॥
বৃথা মোক্ষে চ ভোগে চ স্ত্রিয়ৈ দদ্যাৎ সবৃদ্ধিকম্।
পুত্রার্তিহরণে চাপি স্ত্রীধনং ভোক্তুর্মহতি॥ ঐ

এই বিষয়ে ইহার পরেও বরদরাজ (পৃ ৪৭০-৪৭১) নানাশাস্ত্রকারের মতামত উদ্ধৃত করিয়া স্ত্রীধনের বিষয়ে নানাদিক দিয়া বিচার করিয়াছেন।

 স্ত্রী, কন্যা প্রভৃতি নারীদের অধিকার বিষয়ে বরদরাজ অতিশয় স্পষ্টভাবে নিজ মত ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি বলেন, পুত্র-পত্নী-কন্যাদের অসদ্ভাবেই আত্মীয়েরা ধন পাইতে পারেন, ইহাই শাস্ত্রকারগণের অনেকের মত—

যদিদং সংসৃষ্টিনো ধনগ্রহণমুক্তং তৎপুত্রপত্নীদুহিতৄণামভাবে ইতি কেচিৎ। পৃ ৪৭৬

 বৃহস্পতির মতে, কেহ মারা গেলে বা প্রব্রজ্যা লইলে সে যদি অপুত্র ও অপত্নীক হয় তবেও তাহার ভাগ লুপ্ত হইবে না। সোদর ভাই তাহার ভাগ পাইবেন, ভগিনীও পাইবেন—

যা তস্য ভগিনী সা তু ততোঽংশং লব্ধুর্মহতি। ঐ

নারদবচনেও ইহা সমর্থিত (পৃ ৪৭৭)। বরদরাজ প্রাচীন শাস্ত্রকারদের মতামত আলোচনা করিয়া বলেন, ভার্যা না থাকিলেই আত্মীয়েরা ধনাধিকারী হইতে পারেন—

ভার্যাঽসদ্ভাব এব সংসৃষ্টিনো ধনগ্রহণমিতি গম্যতে। ঐ

 যেসব স্মৃতিকার ‘যোষিৎ, বিধবা, নারী, স্ত্রী, ভার্যা’ প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন তাঁহারা স্ত্রীর জন্য ভরণপোষণমাত্র ব্যবস্থা করেন। আর যেসব স্মৃতিতে ‘পত্নী’ শব্দের প্রয়োগ, তাঁহারা সম্পূর্ণ দায়াধিকার পত্নীকেই দেন। ইহাই বৃদ্ধদের মত—

ইতি নারদবচনাৎ ভার্যাসদ্ভাব এব সংসৃষ্টিনো ধনগ্রহণমিতি গম্যতে।
সত্যম্, পত্নী দায়াযোগ্যা স্ত্রীষু নারদবচনমিত্যবিরোধঃ।
যাসু স্মৃতিষু যোষিদ্বিধবানারীস্ত্রীভার্যেত্যাদি শব্দ প্রয়োগঃ, তাসু তানাং ভরণমেব।
যাসু স্মৃতিযু পত্নীশব্দপ্রয়োগঃ তাসু দায়গ্রহণমিতি বৃদ্ধাঃ। ঐ

অর্থাৎ তখনকার দিনেও বৃদ্ধ শাস্ত্রকারদের জানা ছিল, একদল স্ত্রীর দায়াধিকার ভালো করিয়া না মানিলেও আর-একদল তাহা মানেন। যাঁহারা স্ত্রীদের অধিকার মানেন না, তাঁহারা স্ত্রীকে বুঝাইতে ‘ঘোষিৎ’ ‘বিধবা’ ‘নারী’ ‘ভার্যা’ প্রভৃতি হীনতাবাচক শব্দ ব্যবহার করেন। আর যাঁহারা অধিকার মানেন তাহারা শ্রেষ্ঠত্ববাচক ‘পত্নী’ শব্দ ব্যবহার করেন। বরদরাজ শেষোক্ত দলেরই মত সমর্থন করেন। তাঁহার মতে স্ত্রী সম্মানার্হা, ‘পত্নী’পদবাচ্যা।

 পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, প্রজাপতি প্রভৃতি যেসব শাস্ত্রকারেরা জ্ঞাতিদের কাছে বিধবার খোরপোশের ব্যবস্থামাত্র মানেন, দায়াধিকার মানেন না, তাঁহাদের সঙ্গে বরদরাজ একমত নহেন। তাঁহারা বলেন, জ্ঞাতিরাই দায়াধিকারী। বরদরাজ অতি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, এইসব কথা অতিশয় অন্যায় ও একেবারে যুক্তিহীন—

অপুত্রায়া বিধবায়া জ্ঞাতিভরণমাত্রমের ন দায়প্রাপ্তিঃ।
পায়প্রাপ্তিস্তু জ্ঞাতীনামেব মন্যন্তে। এতৎ সর্বমযুক্তম্॥ পৃ ৪৫৭

 মনু যে বলেন—

পিতা হরেদপুত্রস্য রিক্‌থং ভ্রাতর এব বা। পৃ ৪৫৮

ইহাতে বরদরাজ বলেন, এখানে ‘এব’ শব্দের দ্বারা পিতা হইতে ভ্রাতার প্রাথম্য বুঝায় মাত্র, স্ত্রীর স্বত্ব নাই এইরূপ বুঝায় না, কারণ ইহাতে ক্রমপ্রতিপাদক শব্দের অভাব রহিয়াছে—

ক্রমপ্রতিপাদকশব্দাভাবান্ ন প্রথমং পত্নীব্যুদাসঃ।
এবকারাৎ পিত্রপেক্ষয়া ভ্রাতুঃ প্রাথম্যম্। পৃ ৪৫৮

তথা

অনপত্যস্য পুত্রস্য মাতা দায়মবাপ্নুয়াৎ। ঐ

এই মনুবচনেও ক্রমপরশব্দাভাববশতঃ পত্নীর দাবি অস্বীকৃত হইল না—

ইতি মনুবচনেঽপি ক্রমপরশব্দাভাবান্ ন পত্ন্যা ব্যুদাসঃ। পৃ ৪৫৮

 বরদরাজ বলেন, শঙ্খ-লিখিতোক্ত এবং দেবলবচনে যদিও সোদর ভ্রাতাদেরই প্রথম ধনগ্রহণ বুঝা যায় তবু, নানা শাস্ত্রকারদের বচন-আলোচনে বুঝা যায়, সাধ্বাচারা পত্নীর সকলধন গ্রহণই প্রথম। বহু-বহু বচনের দ্বারা তাহাই প্রতিপন্ন হয়। সেইসব বচনের সঙ্গে সংগত করিয়াই শঙ্খ-লিখিতোক্ত এবং দেবলোক্ত বচনের ব্যাখ্যান করা উচিত—

 শঙ্খলিখিতদেবলবচনয়োঃ যদ্যপি সোদরভ্রাতৄণাং প্রথমং ধনগ্রহণং প্রতীয়তে, তথাপি সাধ্বাচারায়াঃ পত্ন্যাঃ সকলধনগ্রহণং প্রথমং বহুভিঃ বচনৈঃ প্রতীয়ত ইতি, তেষামানুগুণ্যেন তয়োর্বচনয়োঃ ব্যাখ্যানং কর্তব্যম্। পৃ ৪৫৮-৪৫৯[৩]

 সর্বমতেই প্রমাণিত হয়, সাধ্বী পত্নী স্বামীর সকল ধন পাইতে পারেন। শঙ্খ-লিখিত ও দেবলের বচন ইহার সহিত সুসংগত করিয়া বুঝিতে হইবে, হইাই বরদারাজের সিদ্ধান্ত।

 তবে এখন বিচার করিতে হইবে শ্রুতির বচনে ইহাতে কোনো বাধা আছে কি না। পূর্বে যে শ্রুতি উদ্ধৃত করা হইয়াছে—

তস্মাৎ স্ত্রিয়ো নিরিন্দ্রিয়া অদায়াদীঃ। পৃ ৪৫৬

তাহার কি করা যায়? ইহাতে যদি নারীদের উত্তরাধিকার নিষিদ্ধই হইয়া থাকে তবে পূর্বোক্ত সব ব্যবস্থাপক মুনিগণ কখনো তাঁহাদের গ্রন্থে নারীদের উত্তরাধিকারব্যবস্থা দিতে পারিতেন না। তবে আপস্তম্ব ধর্মসূত্রোক্ত বচনটির যথার্থ তাৎপর্য কি? এই বচনে দেখা যায়, তাই নারীরা ‘নিরিন্দ্রিয়া আদায়াদীঃ’। এখন ‘নিরিন্দ্রিয়’ কথার প্রকৃত অর্থ কি?

 এখানে ইন্দ্রিয় শব্দে বীর্য বুঝায় না, কারণ শাস্ত্রে নারীদের বীর্যবত্ব দেখা যায়। তাই সেইভাবে স্ত্রীগণকে নিরিন্দ্রিয় বলা যায় না। ইহাতে বুঝা যায় এখানে ‘ইন্দ্রিয়’ শব্দে সোমই বুঝাইতেছে—

 স্ত্রীণামপি বীর্যবত্বদর্শনাৎ। তশ্মাৎ স্ত্রিয়ো ‘নিরিন্দ্রিয়া’ ইতি বক্তূং ন শক্যত ইতি ইন্দ্রিয়শব্দঃ সোমপর এব যুক্তঃ। পৃ ৪৫৯

 কাজেই নির্বীর্য বলিয়াই স্ত্রীগণের দায়াধিকার নাই ইহা বলা অসংগত। বীর্য না থাকিলে তখনকার দিনে ভূসম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব হইত না, ইহা ঠিক। কিন্তু এই মত যদি এখনো চালানো যায় তবে আমাদের দেশে এখন পুরুষদেরও অধিকার নিষিদ্ধ হয়। কারণ এখন আর এ দেশে পুরুষদেরই বা বীর্য কই?

 তবে আসল কথা, নিরিন্দ্রিয় অর্থে নির্বীর্য নহে। বরদরাজ ‘ইন্দ্রিয়ে’র অর্থ উদ্ধৃত করিয়া দেখাইতেছেন যে তাহাতে ‘সোমপীথঃ’ বা সোমপান বুঝায়—

‘ইন্দ্রিয়ং বৈ সোমপীথঃ’ ইতি ইন্দ্রিয়শব্দস্য সোমে দর্শনাৎ। পৃ ৪৫৯

 সোমপানের অধিকারও যজ্ঞবিশেষেই নারীর নাই, ইহাই বুঝিতে হইবে। তবে পূর্বে দেখানো গিয়াছে এককালে নারীরা সোমপানেরও অধিকারী ছিলেন।

 রামায়ণে দেখা যায়, কৌশল্যা ছিলেন দশরথের যজ্ঞাংশভাগিনী। কুন্তী বলেন, আমি বিধি অনুসারে সোমপান করিয়াছি—

পীতঃ সোমো যথাবিধি। মহাভারত, আশ্রমিক ১৭, ১৭

 যাহা হউক, যজ্ঞবিশেষে সোমপানাধিকার না থাকিলেই যে স্বামীর ধনে অধিকার থাকিবে না ইহা কোনো যুক্তিযুক্ত কথা নহে।

 ইন্দ্রিয় অর্থে বরদরাজ কেন যে সোম ধরিয়াছেন তাহার প্রমাণও তিনি দিয়াছেন। সোমার্থে ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার আমরাও বহুস্থলে পাই। ঋগ্বেদে প্রথমমণ্ডলে ৮৪ সূক্তের প্রথম ঋকে ‘ইন্দ্রিয়ম’ অর্থে সায়ণ ‘সোমপানোৎপন্নম্ প্রভূতম্ সামর্থ্যম্’ ধরিয়াছেন। সায়ণ-মতে, ঋগ্বেদে ১. ১১১ দ্বিতীয়মন্ত্রে এবং ১. ১০৭. ২; ৫. ৩১.৩; ৬. ২৫. ৮ ঋকে ‘ইন্দ্রিয়’ অর্থ ধন ঐশ্বর্য। ঋগ্বেদে ৮. ৯৩. ২৭ ঋকে ইন্দ্রিয় অর্থ সায়ণ করেন ‘বীর্যবন্তং সোমম্’— অর্থ ধন ঐশ্বর্য। ঋগ্বেদে ৯. ২৩. ৫. ঋকে ‘ইন্দ্রিয়’ অর্থ ইন্দ্রিয়বর্দ্ধক রস (ইন্দ্রিয়বর্দ্ধকং রসম্) অর্থাৎ সোমরস। ১০. ৩৬. অষ্টম ঋকে, মূলেই আছে, ‘সুরশ্মিং সোমম্ ইন্দ্রিয়ং বীর্যং যমীমহি’। ১০. ১১৩ প্রথম ঋকে, মূলেই আছে ‘ইন্দ্রিয়ং পীত্বী সোমস্য’। ৮. ৩. ২০ ঋকে ‘সোম ইন্দ্রিয়ো রসঃ’—সায়ণ অর্থ করেন ‘ইন্দ্রিয়’, ‘ইন্দ্রেণ সেব্যো রসঃ’। ৯. ৮৬. ১০ ঋকে ‘ইন্দ্রিয়ো রসঃ’ অর্থে সায়ণ করেন, ‘ইন্দ্রেণ জুষ্ট ইন্দ্রস্য বর্ধকো বা রসঃ’। ৮. ১৩.২৭ ঋকে ইন্দ্রিয় অর্থে সায়ণ বলেন ‘বীর্যবন্তং সোমম্’। ১০. ৬৫, ১০ ঋকে ‘ইন্দ্রিয়ং সোমম্’ মূলেই আছে। সায়ণ অর্থ করেন, ইন্দ্রিয়ং ‘ইন্দ্রজুষ্টম্ সোমম্’। ঋগ্বেদে ৯. ১০৭. ২৫; ৯. ১১৩. ১ ঋকেও তাই। অথর্ববেদে ১৯. ২৭.১ ঋকে ইন্দ্রিয় অর্থ সায়ণ করেন ইন্দ্রসৃষ্ট বা ‘ইন্দ্রজুষ্ট’। St. Petersburg অভিধানও ইন্দ্রিয় অর্থে প্রথমেই রস ও সোম ধরিয়াছেন। তাহার পরে আসিতেছে অন্য সব অর্থ।

 ‘ইন্দ্রিয়’শব্দের আসল এবং আদি অর্থ ই হইল যাহা ‘ইন্দ্রযোগ্য’, ‘ইন্দ্রজুষ্ট’ ‘ইন্দ্রবিষয়ক’। সোমরসই ইন্দ্রের প্রিয়। শক্তি ও বীর্যও ইন্দ্রের প্রিয়। আমাদের তথাকথিত ইন্দ্রিয়গুলিই সেই শক্তি ও বীর্যপ্রকাশের উপায়। সেই হিসাবে বরদরাজ ‘ইন্দ্রিয়’ শব্দের অর্থ করিতে কষ্টকল্পনামাত্র করেন নাই। তাঁহার গৃহীত অর্থ ই আদিম অর্থ এবং তাহা সর্বভাবেই শ্রুতিসংগত। তাহা না হইলে তাঁহার মত লোক এইরূপ অর্থ স্বীকার করিতেন না।

 তবু যে বিশেষ বিশেষ শাস্ত্রে বিশেষ বিশেষ স্থলে দায়াধিকারে নারীদের অধিকার নাই, এই কথা বলা হইয়াছে, সেখানেও বিশেষ বিশেষ কারণবশত সেই সেই স্থলে অধিকার নিষিদ্ধ হইয়াছে— ইহাই বুঝিতে হইবে (পৃ ৪৫৯)। তাই বরদরাজের চরম সিদ্ধান্ত হইল, সুশীলা পত্নীর সর্বধনগ্রহণ যুক্তিযুক্ত—

সাধুবৃত্তযুক্তায়াঃ পত্ন্যাঃ সকলগ্রহণং যুক্তমেব। পৃ ৪৬১

এই কথাটি আরও স্পষ্টভাবে দেখানো হইয়াছে ঐ গ্রন্থের শেষে স্বতন্ত্র আরএকটি অনুবন্ধে (পৃ ৫৩৭)। সেখানে বরদারাজ-উক্ত শাস্ত্রসিদ্ধ রীতিতে রিক্‌থগ্রাহীদের অর্থাৎ দায়াধিকারীদের প্রাধান্য অনুসারে পর-পর ক্রম দেখানো হইয়াছে: ১ ঔরসাদিপুত্র, ২ পত্নী, ৩ দুহিতা, ৪ অনূঢ়া কন্যা, ৫ দৌহিত্র, ৬ মাতা, ৭ পিতা, ৮ সহোদর, ৯ তৎপুত্র, ১০ ভিন্নোদর ভ্রাতা, ১১ তৎপুত্র, ১২ সমানোদক জ্ঞাতি, ১৩ সগোত্র, ১৪ আত্মবান্ধব, ১৫ পিতৃবান্ধব, ১৬ মাতৃবান্ধব, ১৭ শিষ্য, ১৮ সব্রহ্মচারী, ১৯ শ্রোত্রিয়।

 ব্যবহার নির্ণয়ে (পৃ ৪৫০) যাজ্ঞবল্ক্য রিক্‌থগ্রাহীদের আর-একটি ক্রম দিয়াছেন। সেখানেও দেখা যায়—‘পত্নী দুহিতরশ্চৈব পিতরো ভ্রাতরস্তথা’ ইত্যাদি।

 সর্ব ভাবেই দেখা গেল, ঔরসপুত্র না থাকিলে প্রথম দাবিই হইল পত্নীর। আর পত্নী স্বামীরই অংশ বলিয়া তাঁহার দাবিকে ‘উত্তরা’ধিকার না বলিয়া স্বামীর অধিকারেরই অনুবৃত্তি (বা continuity) বলা যায়। পতির বিত্তে পত্নীর ‘উত্তর’-অধিকারের প্রশ্নই ওঠে না।

  1. ‘সসুতা’ পাঠও আছে।
  2. এখানে বরদরাজ একটি চমৎকার যুক্তির অবতারণা করেন। শ্রুতি অনুসারে স্বামী ও স্ত্রী দুইই এক। এক সত্তারই দুই অর্ধ ভাগ। কাজেই স্বামীর মৃত্যুর পরেও স্ত্রীতে স্বামী অনুবর্তন করেন (continues to exist)। তাই স্বামীর অভাবে স্ত্রীর যে অধিকার তাহাকে ‘উত্তরা’ধিকার বলা উচিত নহে। স্ত্রীর মধ্যে যে স্বামী তখনও বর্তিয়া আছেন। এ যেন ব্যাঙ্কের Payable to either or surivor। অর্থাৎ এখানে উভয়ের যুক্তাধিকার। এক জনের অভাবেও অন্যজনে সেই অধিকারই চলিতে থাকিবে। কাজেই ইহা উত্তরাধিকার নহে। ইহাতে অধিকারের অনুবৃত্তি (continuation) মাত্র বুঝায়। শ্রুতির দোহাই দিয়াই এই বিচারের আরম্ভ।
  3. এই তর্কের মাঝখানে বরদারাজ অনেক শাস্ত্রকারদের মতের যে নিষ্কর্য দিয়াছেন তাহা তাঁহার ভাষাতেই উদ্ধত করা যাউক—

    অনপত্যস্য প্রমীতস্য ধনং পত্ন্যভিগামি (অর্থাৎ অপুত্র মৃতের ধন পত্নীতে যাইবে)। ইতি বৈষ্ণববচনাৎ।
    ‘ভার্যাসুতবিহীনস্য’—ইতি বৃহস্পতিবচনাৎ,
    ‘অপুত্রা শয়নং ভর্তুঃ’—ইতি বৃদ্ধমনুবচনাৎ,
    ‘আম্নায়ে স্মৃতিতন্ত্রে চ’— ইতি প্রাজাপত্যবচনাৎ,
    ‘ভর্তুর্ধনহরী পত্নী’—ইতি বৃহস্পতিবচনাৎ,
    ‘অপুত্রস্যাথ কুলজা’—ইতি কাত্যায়নবচনাৎ,
    ‘কুল্যেষু বিদ্যমানেষু’—ইতি পিতামহবচনাৎ,
    ‘অসুতস্য প্রমীতস্য’—ইতি বৃহস্পতিবচনাৎ,
    ‘পত্নী দুহিতরশ্চ’—ইতি যাজ্ঞবল্ক্যবচনাৎ। পৃ ৪৫৮