বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (প্রথম খণ্ড)/ভাগবত/ঈশ্বরচন্দ্র সরকারের প্রভাস-খণ্ড

ঈশ্বরচন্দ্র সরকারের প্রভাস-খণ্ড।

(রচনা-কাল ১৯শ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ।)
বটতলার পুথি হইতে উদ্ধৃত হইল।

মথুরায় কৃষ্ণ-কর্ত্তৃক রজক-বধ।

বলরামের প্রতি শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র কয়।
এ বেশে কংসের বাসে যাওয়া যোগ্য নয়॥
কংস সভা করি বসিয়াছে সিংহাসনে।
কেমনে যাইব বল এমন বসনে॥
কোন্‌ লাজে সভার মাঝে করিব প্রবেশ।
সকলে হাসিবে দেখে রাখালের বেশ॥
চূড়া ধড়া ব্রজের ভাব করিয়া গোপন।
রাজসভা-যোগ্য চাই উত্তম বসন॥
বিশেষ মাতুল হন কংস নরপতি।
আমরা হব রাজার ভগ্নীর সন্ততি॥
লোকাচার বেদাচার বল কিসে ঢাকে।
এই বেশে গেলে সব হাসিবেক লোকে॥

বেদাচারে কংস শক্র লোকাচারে মাতুল।
বল দাদা কিসে হয় দুদিক প্রভুল॥
লোকাচারে বেদাচারে করিব গোপন।
বল কোথা পাই দাদা উত্তম বসন॥

এই কথা কৃষ্ণচন্দ্র বলিল যখন।
হেন কালে কংসের রজক দিল দরশন॥
রাজ-সভায় যায় রজক বসন লইয়া।
ধোপাকে ডাকেন হরি বিনয় করিয়া॥
কংস রাজার রজক ভয় নাই মনে।
যত ডাকে তত ষায় শুনেও না শুনে॥
তাহা দেখি ক্রোধ করে হইয়া অনিষ্ট।
ধোপার বস্ত্রের মোট কেড়ে লন কৃষ্ণ॥
রজক বলে কেরে তুই বালক দুর্জ্জন।
জাননা যে কংস রাজা দ্বিতীয় শমন॥
তাহার রজক আমি জান না কারণ।
জোর করে কেড়ে লও রাজার বসন॥
রজকের কটূক্তি। অজ্ঞান বালক তুই এ কি অসঙ্গত।
কটিদেশে ধটি আটা রাখালের মত॥
মরা ময়ূরের পাখা বাঁধিয়া মাথায়।
দস্যুগীরি কর্ত্তে বেটা এসেছ হেথায়॥
এমনি অতিশয় দুষ্টমি তোর দেখে।
কোন্‌ দ্বিজ পদাঘাত কৈল তোর বুকে॥
বামন হইয়া চন্দ্র ধরিবারে মন।
রাখাল হয়ে পর্ত্তে চাও রাজার বসন॥

এতেক ভর্ৎসনা যদি রজক করিল।
অনিষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ গর্জ্জিয়া উঠিল॥
রজক-বধ। দক্ষ[১] করে রজকেরে করিয়া ধারণ।
চপেটাঘাতে কৈল তার মস্তক ছেদন॥

রজক বধ করি হরি লইল বসন।
কে পরাবে বস্ত্র চিন্তা করেন তখন॥

জন্মেজয় রাজা বলে কহ তপোধন।
এত অবিচার কেন কৈল নারায়ণ॥
কি দোষে বধিল রজক কহ তপোধন।
রজকে বধিয়া কেন লইল বসন॥
কৃষ্ণের ন্যারপরতা-সম্বন্ধে প্রশ্ন। রাজার রজক কাচে রাজার বসন।
বস্ত্র হরণ কৈল তার বধিয়া জীবন॥
পরধন-হরণে অনেক অত্যাচার।
জগৎ-ইষ্ট কৃষ্ণ হয়ে কৈল অবিচার॥
কি কথা শুনালে মুনি অতি অত্যাচার।
রজকে বধিল হরি করি অবিচার॥
কোন দোষের দোষী রজক তার নয়।
দয়াময় হয়ে কেন এতেক নিদয়॥
ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ডোদর দেব নারায়ণ।
তিনি কেন হরিলেন পরের বসন॥
হরির বসনে যদি ছিল প্রয়োজন।
ব্রহ্মারে করিলে আজ্ঞা যোগাত বসন॥
ব্রহ্মা মহেশ্বর আদি যার আজ্ঞাকারী।
দেবের দুর্লভ যার কুবের ভাণ্ডারী॥
পরম লক্ষ্মী গৃহিণী যার বিরাজমান।
বিনা দোষে রজকের বধিলা জীবন॥
ইহার তদন্ত কহ মুনি মহাশয়।
শুনিতে বাঞ্ছা করে শুনাতে আজ্ঞা হয়॥


মুনি বলে নৃপমণি করহ শ্রবণ।
কেন অবিচার করিলেন নারায়ণ॥
বস্ত্র-উপলক্ষে কৈলা রজক-উদ্ধার।
যেহেতু রজক-বধ শুন তত্ত্ব তার॥
রজকের জন্মান্তরের কথা। ত্রেতাযুগে হৈল হরি রাম-অবতার।
অযোধ্যায় আইলে করি সীতার উদ্ধার॥
অযোধ্যায় শ্রীরাম যে রজকের ভাষে।
পঞ্চ মাসের গর্ভ সীতা দিল বনবাসে॥
লোক-মুখে শুনিয়া রজক গুণধাম।
যোড়করে আইল যথা আছেন শ্রীরাম॥

রামের নিকটে রজক আইল তখন।
গলে বাস দিয়া বলে শুন নারায়ণ॥
আমি অতি দুরাচার পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।
আমার কথায় হৈল জানকীর বন॥
কত অপরাধ কৈনু না যায় বর্ণন।
নিজ-হস্তে কর মম মস্তক ছেদন॥
পাপে মুক্ত হই আমি দেহ পরিহরি।
স্বহস্তে মস্তক ছেদ কর ধনুর্ধারী॥
শ্রীরাম বলেন যদি বধিব তোমাকে।
নিন্দুকের অপরাধ ভুগিবেক কে॥
মম হস্তে দেহত্যাগ করে যেই জন।
অপরে গোলোকে কিম্বা বৈকুণ্ঠে গমন॥
এই হেতু বলি তোমায় রজক-কুমার।
বর দিলু কৃষ্ণরূপে করিব উদ্ধার॥
বর পেয়ে রজক-পুত্ত্র অতি সমাদরে।
দ্বাপরে জন্মিল আসি মথুরা-নগরে॥
বস্ত্র-উপলক্ষ মাত্র শুনহ রাজন।
এই হেতু করিলেন রজক-নিধন॥
সংক্ষেপে কহিনু রাজা শুন তত্ত্ব তার।
ঈশ্বরচন্দ্র রচিল রজক-উদ্ধার॥

শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক কংস-বধ।

এখানেতে কংস করি যজ্ঞ আরম্ভণ।
সিংহদ্বারে শঙ্খচূড় কৌবল[২] বারণ॥
স্থানে স্থানে আয়োজন ঘৃতের কলসী।
পট্ট বস্ত্রাদি মধু তণ্ডুল রাশি রাশি॥
আম্র-শাখা স্থানে স্থানে কদলী-রোপণ।
আতপ তণ্ডুল স্থানে ঘট-সংস্থাপন॥
পাঠ করে দ্বিজগণ হোমে দিল মন।
যজ্ঞ-মন্ত্র পাঠ কত করে জনে জন॥

চন্দন ঘর্ষণ আদি করি রাশি রাশি।
বেদীমঞ্চে রাখিয়াছে মিশায়ে তুলসী॥
যজ্ঞ-রক্ষার্থে আছে সৈন্য বহুতর।
সুহৃদ্‌ বান্ধব কত পুরীর ভিতর॥
নন্দ উপানন্দ আছে ব্রজবাসিগণ।
যজ্ঞস্থলে বসিয়াছে হরষিত মন॥


স্নান করি পট্ট-বস্ত্র করিয়ে ধারণ।
চন্দন তুলসী অঙ্গে করিল লেপন॥
সুগন্ধি-পুষ্পের মালা গলদেশে পরি।
আছেন যজ্ঞ-মঞ্চে সুশোভন করি॥
এইরূপে কংস রায় বসি মঞ্চোপরে।
যজ্ঞে আহুতি দিতে অনুমতি করে॥


হেন কালে উপনীত দেব নারায়ণ।
সিংহদ্বারে আসি হরি দিল দরশন॥
দ্বারের অনতিদূরে ছিল সে কৌবল।
রাম কৃষ্ণ প্রতি আসি করিলেন বল।
কুবলয়াপীড়-বধ। কৌবলের বল দেখি দেব নারায়ণ।
ক্রোধভরে কুঞ্জরের ধরিল দশন॥
দশন ধরিয়ে হরি মারিল আছাড়।
মরিল রাজার হস্তী চূর্ণ হৈল হাড়॥
হস্তীর দুই দন্ত উপাড়ি নারায়ণ।
দুই ভাই হস্তে দন্ত করিল ধারণ॥


কৌবল পড়িল রণে করিয়া চীৎকার।
সভা-সহিত সবে হৈল চমৎকার॥
অতি অসম্ভব সবে করে নিরীক্ষণ।
কৌবল বধিল সেই শিশু দুই জন॥
কেহ বলে দুজনে নহে বধে এক জন।
নব কলেবর জিনি মেঘের বরণ॥
তাহার প্রমাণ দেখ রুধির কলেবরে।
দিগম্বরী আসি যেন রণেতে বিহরে॥

শঙ্খচূড় বলে আমি দেখেছি নয়নে।
ঐ কাল শিশু বধেছে কৌবল-জীবনে॥
ঐ কাল শিশু হয়ে পর্ব্বত-আকার।
কৌবলের দন্ত ধরি করিল বিদার॥
স্বচক্ষে দেখেছি আমি শুন হে রাজন।
হস্তী বধি শিশুরূপ করেছে ধারণ॥
ঐ কালটি দুষ্টের শেষ শুন নরবর।
ঐ কালটী বধেছে তব কৌবল কুঞ্জর॥
অতি শান্ত দান্ত শিশু শ্বেতবর্ণ যিনি।
ঐ কালটীর প্রায় দুষ্টের শিরোমণি॥
শঙ্খচূড়-বধ। এই কথা শঙ্খচূড় বলিল যখন।
ক্রোধাভরে বলেন তখন দেব নারায়ণ॥
শ্রীহরি বলেন শুন ওরে শঙ্খচূড়।
মুষ্ট্যাঘাতে তোমার এবার দর্প করিব চূর॥
ইহা বলি ক্রোধভরে দেব গদাধর।
মুষ্ট্যাঘাত করে তার মস্তক উপর॥
পড়িল যে শঙ্খচূড় ভূতলে লোটায়।
শঙ্খচূড়-বধ-গীত সরকার গায়॥


শঙ্খচূড় বধ করে দেব হৃষীকেশ।
যজ্ঞস্থলে শ্রীকৃষ্ণ করিলেন প্রবেশ॥
বসিয়াছে কংসরায় যজ্ঞ ভাবি হৃষ্ট।
কংসের সভায় গিয়া দাণ্ডাইল কৃষ্ণ॥
দর্শনার্থে দরশন উভয়ের হইল।
কংস কৃষ্ণ দেখিল কৃষ্ণ কংসে দেখিল॥
কংস বলে শুন ওরে পাগল দুর্জ্জন।
কৌবল-বধে কার বল করেছ ধারণ॥
রাজার কৌবল বধ ভয় নাই মনে।
এখনি পাঠাব তোরে যমের সদনে॥
পূতনা স্ত্রীহত্যা বধ করেছ দুরাচার।
সেই পাপ আসি তোরে করিল সঞ্চার॥
কারাগারে ভূমিষ্ঠ হইয়া দুরাচার।
আমার ভয়েতে তুমি যমুনা হৈলে পার॥

নরের মধ্যেতে তোরে নাহি করি গণ্য।
গোকুলে খাইলি তুই গোপ-গৃহে অন্ন॥
মাঠে মাঠে গোঠে গোঠে রাখালের সনে।
কংস-বধ। চরালি গোধন গরু গিয়া বৃন্দাবনে॥
এতেক ভর্ৎসনা যদি কৃষ্ণকে করিল।
মহাক্রোধ-ভরে কৃষ্ণ গর্জ্জিয়া উঠিল॥
ক্রোধ-ভরে কংসরাজার ধরি দুই কর।
হস্তি-দন্তাঘাত মারে মস্তক উপর॥
শিরভঙ্গ হইয়া সে কংস মহাবীর।
কুঞ্জরের দন্তাঘাতে ত্যজিল শরীর॥


  1. দক্ষিণ।
  2. কুবলয়াপীড় নামক হস্তী।