বনলতা সেন/অন্ধকার
অন্ধকার
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম—পউষের রাতে
কোনােদিন আর জাগব না জেনে
কোনাে দিন জাগব না আমি—কোনােদিন জাগব না আর
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলাে নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে।
রয়েছে যে অগাধ ঘুম
সে আস্বাদ নষ্ট করবার মতাে শেলতীব্রতা তােমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও—
জানাে না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানাে না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মত মিশে থেকে
হঠাৎ ভােরের আলাের মূখ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব
বুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখখামুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়—আক্রোশে ভরে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়ােরের
আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমােতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যােনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতাে মিশে
থাকতে চেয়েছি।
কোনােদিন মানুষ ছিলাম না আমি।
হে নর, হে নারী,
তােমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনােদিন;
আমি অন্য কোনাে নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শূকরের চীৎকার সেখানে,
শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি।
গভীর অন্ধকারে ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,
হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন!
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;
তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব—ধীরে ধীরে—পউষের রাতে—
কোনােদিন জাগব না জেনে—
কোনােদিন জাগব না আমি কোনােদিন আর।