বন-ফুল/সপ্তম সর্গ
সপ্তম সর্গ।
শ্মশান।
গভীর আঁধার ব্লাত্রি শ্মশান ভীষণ!
ভয় যেন পাতিয়াছে আপনার আঁধার আসন!
সর সর মরমরে সুধীরে তটিনী বহে যায়।
প্রাণ আকুলিয়া বহে ধূমময় শ্মশানের বায়।
গাছ পালা নাই কোথা প্রান্তর গভীর!
শাখা পত্র হীন বৃক্ষ, শুষ্ক, দগ্ধ উঁচু করি শির
দাঁড়াইয়া দূরে—দূরে নিরখিয়া চারিদিক পান
পৃথিবীর ধ্বংসরাশি,রহিয়াছে হােয়ে মিয়মাণ?
শ্মশানের নাই প্রাণ যেন আপনার
শুষ্ক তৃণরাজি তার ঢাকিয়াছে বিশাল বিস্তার!
তৃণের শিশির চুমি বহেনাকে। প্রভাতের বায়
কুসুমের পরিমল ছড়াইয়া হেথায় হােথায়।
শ্মশানে আঁধার ঘাের ঢালিয়াছে বুক।
হেথা হােথা অস্থিরাশি ভস্মমাঝে লুকাইয়া মুখ!
পরশিয়া অস্থিমালা তটিনী আবার সরি যায়
ভরাশি ধুয়ে ধুয়ে, নিভাইয়া অঙ্গার শিখায়!
বিকট দশন মেলি মানব কপাল—
ধ্বংসের স্মরণ স্তুপ, ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল!
গভীর আঁখি কোটর, আঁধারেরে দিয়েছে আবাস
মেলিয়া দশন পাতি পৃথিবীর করে উপহাস!
মানব কঙ্কাল শুয়ে ভাস্মের শয্যায়
কাণের কাছেতে গিয়া বায়ু কত কথা ফুসলায়!
তটিনী কহিছে কাণে উঠ! উঠ! উঠ নিদ্রা হোতে
ঠেলিয়া শরীর তার ফিরে ফিরে তরঙ্গ আগাতে!
উঠগো কঙ্কাল! কত ঘুমাইবে আর।
পৃথিবীর বায়ু এই বহিতেছে উঠ আরবার,
উঠগাে কুস্মাল! দেখ স্রোতস্বিনী ডাকিছে তােমায়
ঘুমাইবে কত আর বিসর্জন দিয়া চেতনায়!
বলনা বলনা তুমি ঘুমাও কি বোলে?
কাল যে প্রেমের মালা পরাইয়াছিল এই গলে
তরুণী ষােড়শী বালা! আজ তুমি ঘুমাওকি বলে!
অনাথারে একাকিনী সঁপিয়া এ পৃথিবীর কোলে।
উঠগো—উঠগো—পুনঃ করিনু আহ্বান
শুন, রজনীর কাণে ওই নে করিছে খেদ গান!
সময় তোমার আজো ঘুমাবার হয় নাই ত রে!
কোল বাড়াইয়া আছে পৃথিবীর সুখ তোমাতরে!
তুমিগো ঘুমাও, আমি বলিনা তােমারে।
জীবনের রাত্রি তব ফুরায়েছে নেত্র ধারে ধারে!
এক বিন্দু, অশ্রুজল বরষিতে কেহ নাই তাের
জীবনের নিশা আহা এতদিনে হইয়াছে ভোর।
ভয় দেখাইয়া আহা নিশার তামসে—
একটি জলিছে চিতা, গাঢ় ঘাের ধূমপাশি শ্বসে!
একটি অনল শিখা লিতেছে বিশাল প্রান্তরে,
অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ কণা নিক্ষেপিয়া আকাশের পরে।
কার চিতা জ্বলিতেছে কাহার কে জানে?
কমলা! কেনগাে তুমি তাকাইয়া চিতাগ্নির পানে?
একাকিনী অন্ধকারে ভীষণ এ শ্মশান প্রদেশে।
ভূষণ-বিহীন-দেহে, শুষ্ক মুখে,এলো থেলাে কেশে?
কার চিতা জান কি গো কমলে জিজ্ঞাসি!
দেখিতেছ কার চিতা শ্মশানেতে একাকিনী আসি?
নীরদের চিতা? নীরদের দেহ অগ্নি মাঝে জ্বলে?
নিবায়ে ফেলিবে অগ্নি কমলে! কি নয়নের জ্বলে?
নীরব, নিস্তব্ধ ভাবে কমলা দাঁড়ায়ে!
গভীর নিশ্বাস বায়ু উচ্ছাসিয়া উঠে।
ধূমময় নিশীথের শ্মশানের বায়ে
এলাে থেলাে কেশ রাশি চারিদিকে ছুটে।
ভেদি অমা নিশীথের গাঢ় অন্ধকার
চিতার অনলােখিত অস্ফুট আলােক
পড়িয়াছে ঘাের স্নান মুখে কমলার,
পরিস্ফুট করিতেছে সুগভীর শোক।
নিশীথে শ্মশানে আর নাইজন প্রাণী
মেঘান্ধ অমান্ধকারে মগ্ন চরাচর
বিশাল শ্মশান ক্ষেত্রে শুধু একাকিনী
বিষাদ প্রতিমা বাম্য বিলীন অন্তর!
তটিনী চলিয়া যায় কাঁদিয়া কাদিয়া।
নিশীথ শ্মশান বায়ু স্বনিছে উচ্ছাসে!
আলেয়া ছুটিছে হােথা আঁধার ভেদিয়া!
অস্থির বিকট শব্দ নিশার নিশ্বাসে!
শৃগাল চলিয়া গেল সমুচ্চে কঁদিয়া!—
নীরব শ্মশান ময় তুলি প্রতিধ্বনি!
মাথার উপর দিয়া পাখা ঝাপটিয়া,
বাদুড় চলিয়া গেল করি ঘোরধ্বনি!
এ হেন ভীষণ স্থানে দাঁড়ায়ে কমলা!
কাঁপে নাই কমলার একটি ও কেশ!
শূন্য নেত্রে, শূন্য হৃদে চাহি আছে বালা
চিতার অনলে করি নয়ন নিবেশ!
কমলা চিতায় নাকি করিবে প্রবেশ?
বালিকা কমলা নাকি পশিবে চিতায়?
অনলে সংসার লীলা করিবি কি শেষ?
অনলে পুড়াবি নাকি সুকুমার কায়?
সেই যে বালিকা তােরে দেখিতাম হায়—
ছুটিতিস ফুল তুলে কাননে কাননে
ফুলে ফুল সাজাইয়া ফুল সম কায়—
দেখাতিস্ সাজ সজ্জা পিতার সদনে।
দিতিস হরিণ-শৃঙ্গে মালা জড়াইয়া!
হরিণ শিশুরে আহা বুকে লয়ে তুলি—
সুদূর কানন ভাগে যেতিস ছুটিয়া
ভ্রমিতিস হেথা হােথা পথ গিয়া ভুলি।
সুধাময়ী বীণা খানি লোম্নে কোল পরে—
সমুচ্চ হিমাদ্রি শিরে বসি শিলাসনে—
বীণার ঝঙ্কার দিয়া মধুময় স্বরে
গাহিতিস্ কত গান আপনার মনে।
হরিণেরা বন হােতে শুনিয়া সে স্বর—
শিখরে আসিত ছুটি তৃণাহার ভুলি!
শুনিত, ঘিরিয়া বসি ঘাসের উপর—
বড় বড় আঁখি দুটি মুখ পানে তুলি!
সেই যে বালিকা তােরে দেখিতাম বনে
চিতার অনলে আজ হবে তোর শেষ?
সুখের যৌবন হায় নিবাবি আগুনে?
সুকুমার দেহ হবে ভস্ম অবশেষ!
না, না, না, সরল বালা ফিরে যাই চল,
এসেছিলি যেথা হতে সেই সে কুটিরে;
আবার ফুলের গাছে ঢালিবিলো জল!
আবার ছুটিবি গিয়ে পৰ্বতের শিরে।
পৃথিবীর যাহা কিছু ভুলে যালো সব
নিরাশ-যন্ত্রণাময় পৃথ্বীর প্রণয়।
নিদারুণ সংসারের ঘাের কলরব,
নিদারুণ সংসারের জ্বালা বিষময়।
তুই স্বরগের পাখী পৃথিবীতে কেন?
সংসার কণ্টক বনে পারিজাত ফুল।
নন্দনের বনে গিয়া, গাইবি খুলিয়া হিয়া
নন্দন মলয় বায়ু করিবি আকুল।
আয় তবে ফিরে যাই বিজন শিখরে,
নির্ঝর ঢালিছে যেথা স্ফটিকের ফুল;
তটিনী বহিছে যথা কল কল স্বরে,
সুবাস নিশ্বাস ফেলে বন ফুল দল!
বন ফুল ফুটেছিলি ছায়াময় বনে,
শুকাইলি মানবের নিশ্বাসের বায়ে,
দয়াময়ী বনদেবী শিশির সেচন
আবার জীবন তােরে দিবেন ফিরায়ে!
এখনো কমলা ওই রয়েছে দাঁড়িয়ে?
জ্বলন্ত চিতার পরে মেলিয়ে নয়ন!
এইরে সহসা ওই মূর্চ্ছি যে পড়িয়ে
ভস্মের শয্যার পরে করিল শয়ন।
এলায়ে পড়িল ভস্মে সুনিবীড় কেশ।
অঞ্চল বসন ভস্মে পড়িল এলায়ে!
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে কামু থালু বেশ—
কমলার বক্ষ হোতে, শ্মশানের বায়ে।
নিবে গেল ধীরে ধীরে তার অনল
এখনো কমলা বালা মূর্চ্ছায় মগন
শুকতারা উজলিল গগণের তল—
এখানো কমলা বালা স্তব্ধ অচেতন।
ওইরে কুমারী উষা বিলােল চরণে
উঁকি মারি পূর্ব্বাশার সুবর্ণ তােরণে—
রক্তিম অধর খানি হাসিতে ছাইয়া
সিঁদূর প্রকৃতি ভালে দিল পরাইয়া
এখনো কমলা বালা ঘাের অচেতন
কমলা কপোল চুমে তরুণ কিরণ।
গণিছে কুন্তল গুলি প্রভাতের বায়
চরণে তটিনী বালা তরঙ্গ দুলায়।
কপোলে, আঁখির পাতে পড়েছে শিশির
নিস্তেজ সুবর্ণ করে পিতেছে মিহির।
শিথিল অঞ্চল খানি লোয়ে উর্মিমালা
কতকি—কতকি কোরে করিতেছে খেলা
ক্রমশঃ বালিকা ওই পাইছে চেতন!
ক্রমশঃ বালিকা ওই মেলিছে নয়ন!
বক্ষোদেশ আবরিয়া অঞ্চল বসনে
নেহারিল চারিদিক বিস্মিত নয়নে
ভস্মরাশি সমাকুল শ্মশান প্রদেশ।
মলিন কমলা ছাড়া সেদিকে নেহারি
বিশাল শ্মশানে নাই সৌন্দর্য্যের লেশ
জন প্রাণী নাই আর কমলারে ছাড়ি!
সূর্য্যকর পড়িয়াছে শুষ্ক ম্লান প্রায়,
ভস্ম মাখা ছুটিতেছে প্রভাতের বায়,
কোথাও নাইরে যেন আঁখির বিশ্রাম,
তটিনী ঢালিছে কাণে বিষাদের গান!
বালিকা কমল ক্রমে করিল উত্থান
ফিরাইল চারিদিকে নিস্তেজ নয়ান।
শ্মশানের ভস্ম মাখা অঞ্চল তুলিয়া
নেড়ে চরণ চলে যাইল চলিয়া!