বর্ণপরিচয় (দ্বিতীয় ভাগ, ১৮৭৬)/৫ পাঠ
৫ পাঠ।
নবীন।
নবীন নামে এক বালক ছিল। তাহার বয়ঃক্রম নয় বৎসর। সে খেলা করিতে এত ভাল বাসিত যে, সারা দিন পথে পথে খেলিয়া বেড়াইত, এক বারও লেখা পড়ায় মন দিত না। এজন্য, সে কিছুই শিখতে পারিত না। এই কারণে, গুরু মহাশয় প্রতিদিন তাহাকে ধমকাইতেন। ধমকের ভয়ে সে আর পাঠশালায় যাইত না।
এক দিন, নবীন দেখিল, একটি বালক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে যাইতেছে, তাহাকে কহিল, অহে ভাই, এস দুজনে খানিক খেলা করি।
সে বলিল, আমি পড়িতে যাইতেছি, এখন খেলতে পারিব না। পড়িবার সময় খেলা করিলে, লেখা পড়া শিখিতে পারিব না। বাবা আমাকে পড়িবার সময় পড়িতে ও খেলিবার সময় খেলিতে বলিয়া দিয়াছেন। আমি যে সময়েরা যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। এজন্যে, বাবা আমাকে ভালবাসেন, আমি তাঁর কাছে যখন যা চাই, তখন তাই দেন। যদি আমি এখন, পড়িতে না গিয়া, তোমার সহিত খেলা করি, বাবা আমাকে আর ভাল বাসিবেন না। আমি শুনিয়াছি, লেখা পড়ায় অবহেলা করিয়া, সারা দিন খেলিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। অতএব, আমি চলিলাম। এই বলিয়া সে সত্বর চলিয়া গেল।
নবীন খানিক দূর গিয়া দেখিল, একটি বালক, চলিয়া যাইতেছে। তাহাকে কহিল, ভাই, তুমি কোথায় যাইতেছ? সে বলিল, বাবা আমাকে এক জিনিস আনিতে পাঠাইয়াছেন। তখন নবীন কহিল, তুমি পরে জিনিস আনিতে যাইবে। এখন এস, দুজনে মিলিয়া খানিক খেলা করি।
সেই বালক বলিল, না ভাই, এখন আমি খেলিতে পারিব না। বাবা যে কাজ করিতে বলিয়াছেন, অগ্রে তাহা করিব। বাবা কহিয়াছেন, কাজে অযত্ন করা ভাল নয়। আমি কাজের সময় কাজ করি, খেলার সময় খেলা করি, কাজের সময় কাজ না করিয়া, খেলিয়া বেড়াইলে চির কাল দুঃখ পাইব। আমি কখনও কাজে অমনোযোগ করি না। যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। আমি তোমার কথা শুনিয়া কাজে অবহেলা করিব না।
এই কথা শুনিয়া, নবীন সেখান হইতে চলিয়া গেল। খানিক গিয়া, এক রাখালকে দেখিয়া কহিল, আয় না ভাই, দু'জনে মিলিয়া খেলা করি। রাখাল কহিল, আমি গরু চরাইতে যাইতেছি, এখন খেলা করিতে পারিব না। এখন খেলা করিলে, গরু চরান হইবেক না। প্রভু রাগ করিবেন, গালাগালি দিবেন। আমি কাজে অযত্ন করিব না। কাজের সময় কাজ করিব, খেলার সময় খেলা করিব। বাবা এক দিন বলিয়াছিলেন, কাজের সময় কাজ না করিয়া, সারা দিন খেলা করিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। তুমি যাও, এখন আমি খেলা করিব না।
এই রূপে, ক্রমে ক্রমে তিন জনের কথা শুনিয়া, নবীন মনে মনে ভাবিতে লাগিল, সকলেই কাজের সময় কাজ করে। এক জনও, কাজে অবহেলা করিয়া, সারা দিন খেলিয়া বেড়ায় না। কেবল আমি সারা দিন খেলা করিয়া বেড়াই। সকলেই বলিল, কাজের সময় কাজ না করিয়া, খেলিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। এজন্য, তারা সারা দিন খেলা করিয়া বেড়ায় না। আমি যদি, লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া না করিয়া, কেবল খেলিয়া বেড়াই, তা হলে, আমি চির কাল দুঃখ পাইব। বাবা জানিতে পারিলে, আর আমায় ভাল বাসিবেন না, মারিবেন, গালাগালি দিবেন, কখনও কিছু চাহিলে, দিবেন না। আর আমি লেখা পড়ায় অবহেলা করিব না, আজ অবধি, লেখা পড়ার সময় লেখা পড়া করিব।
এই ভাবিয়া সেই দিন অবধি, নবীন লেখা পড়ায় মনোযোগ করিল। তার পর, আর সে সারা দিন খেলা করিয়া বেড়াইত না। কিছু দিনের মধ্যেই নবীন অনেক শিখিয়া ফেলিল। তাহা দেখিয়া সকলে নবীনের প্রশংসা করিতে লাগিল। এই রূপে লেখা পড়ায় যত্ন হওয়াতে, নবীন ক্রমে ক্রমে অনেক বিদ্যা শিখিয়াছিল।