বর্ণপরিচয় (দ্বিতীয় ভাগ, ১৮৭৬)/৬ পাঠ
৬ পাঠ
মাধব।
মাধব নামে একটি বালক ছিল। তাহার বয়স দশ বৎসর। তাহার পিতা তাহাকে বিদ্যালয়ে শিক্ষা করিতে দিয়াছিলেন। সে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাইত এবং মন দিয়া লেখা পড়া শিখিত। কখনও কাহারও সহিত ঝগড়া বা মারামারি করিত না, এজন্য সকলেই তাহাকে অত্যন্ত ভাল বাসিত।
এ সকল গুণ থাকিলে কি হয়, মাধবের একটি মহৎ দোষ ছিল। সে পরের দ্রব্য লইতে বড় ভাল বাসিত। সুযোগ পাইলেই কোনও দিন কোনও বালকের পুস্তক লইত, কোনও দিন কোনও বালকের কলম লইত, কোনও দিন কোনও বালকের কাগজ লইত, কোনও দিন কোনও বালকের ছুরী লইত। এই রূপে প্রায় প্রতিদিন এক এক বালকের এক এক দ্রব্য চুরী করিত।
মাধব যে বালকের কোনও বস্তু চুরী করিত, সে পণ্ডিত মহাশয়ের নিকটে গিয়া কহিত, মহাশয়! আমার অমুক বস্তু কে লইয়াছে। মাধব চুরী করিয়া এমন লুকাইয়া রাখিত যে, শিক্ষক মহাশয়, অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহার সন্ধান করিতে পারিতেন না। কে চুরী করিয়াছে স্থির করিতে না পারিয়া, তিনি সকল বালককেই তিরস্কার করিতেন।
প্রত্যহ গালাগালি খাইয়া, কয়েকটি বালক পরামর্শ করল, আজ অবধি আমরা সতর্ক থাকিব এবং দেখিব কে চুরী করে। দুই তিন দিনের মধ্যেই, তাহারা মাধবকে চোর বলিয়া ধরিয়া দিল। মাধব সে দিন এক বালকের একখানি পুস্তক লইয়াছিল। পণ্ডিত মহাশয় চোর বলিয়া তাহাকে গালাগালি দিতে লাগিলেন। তখন মাধব কহিল, আমি চুরী করি নাই, ভুলিয়া লইয়াছিলাম। পণ্ডিত মহাশয় সে দিন তাহাকে ক্ষমা করিলেন, কহিয়া দিলেন, তুমি আর কখনও কাহারও দ্রব্যে হস্তার্পণ করিও না। মাধব বলিল, আমি আর কখনও কাহারও কোনও দ্রব্যে হাত দিব না।
দুই তিন দিন কাহারও কোনও দ্রব্য হারাইল না। পরে পুনরায় বিদ্যালয়ের বালকদিগের দ্রব্য হারাইতে লাগিল। মাধব পুনরায় চোর বলিয়া ধরা পড়িল। সে বারেও শিক্ষক মহাশয় তাহাকে ক্ষমা করিলেন এবং অনেক বুঝাইয়া কহিয়া দিলেন, যদি তুমি পুনর্বার চুরী কর, তোমাকে বিদ্যালয় হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিব। সে কহিল, আমি আর কখনও চুরী করিব না। আর চুরী করিব না বলিয়া, পণ্ডিত মহাশয়ের নিকট কহিয়াও, কয়েক দিন পরে পুনর্বার চুরী করিল এবং চোর বলিয়া ধরা পড়িল।
এই রূপে বারংবার চুরী করাতে পণ্ডিত মহাশয় তাহাকে বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। তাহার পিতা, এই সকল জানিতে পারিয়া তাহাকে যথেষ্ট তিরস্কার ও প্রহার করিলেন। কিছু দিন পরে, তাহার পিতা তাহাকে আর এক বিদ্যালয়ে পাঠাইলেন। সে সেখানেও চুরী করিতে লাগিল। সেই বিদ্যলয়ের পণ্ডিত মহাশয়, বিস্তর ভর্ৎসনা ও প্রহার করিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিলেন।
এই সকল দেখিয়া, শুনিয়া, তাহার পিতার মনে অতিশয় ঘৃণা হইল। তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। বাল্যকালে চুরী অভ্যাস করিয়া মাধব আর সে অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে পারিল না। ক্রমে ক্রমে যত বড় হইতে লাগিল, ততই তাহার ঐ প্রবৃত্তি বাড়িতে লাগিল। সে সুযোগ পাইলেই, কাহারও বাটীতে প্রবেশ করিয়া, চুরী করিত। এজন্য, যে দেখিত, সেই তাহাকে ঘৃণা করিত। কেহ তাহাকে বিশ্বাস করিত না। কাহারও বাড়ীতে গেলে, সে তাহাকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিত।
মাধবের দুঃখের সীমা ছিল না। সে খাইতে না পইয়া, পেটের জ্বালায় ব্যাকুল হইয়া, দ্বারে দ্বারে কাঁদিয়া বেড়াইত, তথাপি তাহার প্রতি কাহারও স্নেহ বা দয়া হইত না।