বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (দ্বিতীয় পুস্তক)/উপসংহার



উপসংহার

শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রভৃতি প্রতিবাদী মহাশয়েরা, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ডের শাস্ত্রীয়তাপক্ষ সমর্থন করিবার নিমিত্ত, যে সমস্ত শাস্ত্র ও যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, তৎসমুদয় সবিস্তর আলোচিত হইল। যদৃচ্ছাক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা কোনও ক্রমে শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্রেত নহে, ইহা যাহাতে দেশস্থ সর্ব্বসাধারণ লোকের হৃদয়ঙ্গম হয়, এই আলোচনাকার্য্য সেইরূপে নির্ব্বহিত করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইয়াছি; কিন্তু কত দূর কৃতকার্য্য হইয়াছি, বলিতে পারি না। তবে, এক কথা সাহসপূর্ব্বক বলিতে পারা যায়, ঈদৃশ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়া, যদ্রূপ যত্ন ও যদ্রূপ পরিশ্রম করা উচিত ও অবশ্যক, সাধ্যানুসারে সে বিষয়ে ক্রটি করি নাই। যে সকল মহাশয়েরা, কৌতুহলাবিষ্ট হইয়া, অথবা আমার প্রতি দয়া প্রকাশ করিয়া, পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক, কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ সহকারে, এই পুস্তক আদ্যোপান্ত অবলোকন করিবেন, আমার যত্ন ও পরিশ্রম কিয়দংশেও সফল হইয়াছে, অথবা সর্ব্বাংশেই বিফল হইয়াছে, তাঁহারা তাহার বিচার ও মীমাংসা করিতে পারিবেন। আমি এই মাত্র বলিতে পারি, পূর্ব্বে যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রবহির্ভূত ও ধর্ম্মবিগর্হিত ব্যবহার বলিয়া আমার যে সংস্কার জন্মিয়াছিল, সাতিশয় অভিনিবেশ সহকারে, বিবাহসংক্রান্ত শাস্ত্রসমূহের সবিশেষ অনুশীলন করাতে, সেই সংস্কার সর্ব্বতোভাবে দৃঢ়ীভূত হইয়াছে। ক্রমাগত কিছু কাল এই বিষয়ের আলোচনা করিয়া, আমার এত দূর পর্য্যন্ত বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রসিদ্ধ ব্যবহার, ইহা কেহ প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, এরূপ নির্দ্দেশ করিতে ভয়, সংশয় বা সঙ্কোচ উপস্থিত হইতেছে না। ফলতঃ, আমার সামান্য বুদ্ধিতে, যত দূর শাস্ত্রের অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তদনুসারে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড শাস্ত্রসম্মত ব্যবহার বলিয়া সমর্থিত হওয়া সম্ভব নহে।

 যদৃচ্ছাক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমত ও অনুমোদিত কার্য্য, ইহা প্রতিপন্ন করিতে উদ্যত হইলে, যে কেবল ধর্ম্মশাস্ত্রবিষয়ে স্বীয় অনভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয় এরূপ নহে, নিরপরাধ শাস্ত্রকারদিগকেও নিতান্ত নৃশংস ও নিতান্তু নির্বিবেক বলিয়া বিলক্ষণ প্রতিপন্ন করা হয়। যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড যে যার পর নাই লজ্জাকর, ঘৃণাকর ও অনর্থকর ব্যবহার, তাহা প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করিবার প্রয়োজন নাই। আমার বোধে, যে সকল মহাত্মারা, জগতের হিতের নিমিত্ত, শাস্ত্রপ্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহারা তাদৃশ ধর্ম্মবহির্ভূত লোকবিগর্হিত বিষয়ে অনুমতিপ্রদান বা অনুমোদনপ্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন, ইহা মনে করিলে মহাপাতক জন্মে। বস্তুতঃ, মানবজাতির হিতাহিত ও কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য নিরূপণ করিবার নিমিত্ত যে শাস্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহুরূপ পিশাচব্যবহার সেই শাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী কার্য্য, ইহা কোনও মতে সম্ভব হইতে পারে না। ফলতঃ, যাঁহারা একবারে ন্যায় অন্যায় বোধশূন্য, সদসদ্বিবেচনাশক্তিবর্জিত এবং সম্ভব অসম্ভব ও সঙ্গত অসঙ্গত বিবেচনা বিষয়ে বহির্মুখ নহেন, ধর্ম্মশাস্ত্রে অধিকার থাকিলে, এবং তত্ত্বনির্ণয়পক্ষ লক্ষ্য হইলে, তাদৃশ ব্যক্তিরা, যদৃচ্ছাক্রমে যত, ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রানুমোদিত কার্য্য, ঈদৃশ ব্যবস্থা প্রচারে প্রবৃত্ত হইতে পারেন, এরূপ বোধ হয় না।

 শাস্ত্রে দ্বিবিধমাত্র অধিবেদন অনুমত ও অনুমোদিত দৃষ্ট হইতেছে; প্রথম ধর্ম্মার্থ অধিবেদন, দ্বিতীয় কামার্থ অধিবেদন। পূর্ব্বপরিণীতা পত্নী বন্ধ্যা, ব্যভিচারিণী, সুরাপারিণী, চিররোগিণী প্রভৃতি স্থির হইলে, শাস্ত্রকারেরা পুরুষের পক্ষে পুনরায়দারপরিগ্রহের অনুমতি দিয়াছেন। সেই অমুমতির অনুবর্ত্তী হইয়া, পুরুষ যে দারপরিগ্রহ করে, উহার নাম ধর্ম্মার্থ অধিবেদন। পুত্রলাভ ও ধর্ম্মকার্য্যসাধন গৃহস্থশ্রমের প্রধান উদ্দেশ্য। স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব প্রভৃতি দোষ ঘটিলে, ঐ দুই প্রধান উদ্দেশ্যের সমাধান হয় না। ঐ দুই প্রধান উদ্দেশ্য সমাহিত না হইলে, গৃহস্থ ব্যক্তিকে প্রত্যবায়গ্রস্ত হইতে হয়। এজন্ত, শান্ত্রকারেরা তাদৃশ স্থলে অধিবেদনের অনুমতি প্রদান করিয়া গিয়াছেন। আর, পূর্ব্বপরিণীতা পত্নীর সহযোগে রতিকামনা পূর্ণ না হইলে, ধনবান্ কামুক পুরুষের পক্ষে শাস্ত্রকারেরা অসবর্ণাপরিগ্রহের অনুমোদন করিয়াছেন। সেই অনুমোদনের অনুবর্ত্তী হইয়া, কেবল কামোপশমনবাসনায়, কামুক পুরুষ অনুলোমক্রমে বর্ণান্তরে যে দারপরিগ্রহ করে, উহার নাম কামার্থ অধিবেদন। নিবিষ্ট চিত্তে, শাস্ত্রের তাৎপর্য্য পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে, স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শাস্ত্রোক্ত নিমিত্ত ঘটনা ব্যতিরেকে সবর্ণা পত্নীকে অপদস্থ বা অপমানিত করা শাস্ত্রকারদিগের অভিমত বা অভিপ্রেত নহে। কামোপশমনের নিমিত্ত নিতান্ত আবশ্যক হুইলে, তাঁহারা কামুক পুরুষের পক্ষে অসবর্ণা পরিগ্রহের অনুমোদন করিয়াছেন বটে; কিন্তু, পূর্ব্বপরিণীতা সবর্ণা সহধর্ম্মিণীর সন্তোষসম্পাদন ও সম্মতিলাভ ব্যতিরিক্ত স্থলে তাদৃশ অধিবেদনে অধিকার বিধান করেন নাই; সুতরাং, কামার্থ অধিবেদনের পথ এক প্রকার ব্রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বলিতে হইবেক; কারণ, পূর্ব্বপরিণীতা সহধর্ম্মিণী সন্তুষ্ট চিত্তে স্বামীর দারান্তরপরিগ্রহে সম্মতি দিবেন, ইহা কোনও মতে সম্ভব নহে; আর, যদিই কোনও অর্থলোভিনী সহধর্ম্মিণী, অর্থলাভে চরিতার্থ হইয়া, তাদৃশ সম্মতি প্রদান করেন, এবং তদনুসারে তাঁহার স্বামী অসবর্ণা বিবাহ করিলে, উত্তর কালে তন্নিবন্ধন তাঁহার ক্লেশ, অসুখ বা অসুবিধা ঘটে, সে তাঁহার নিজের দোষ। আর, যদি পূর্ব্বপরিণীতা সবর্ণা সহধর্ম্মিণীর সম্মতিনিরপেক্ষ হইয়া, অথবা এক বারেই শাস্ত্রীয় বিধি ও শাস্ত্রীয় নিষেধ উল্লঙ্ঘন করিয়া, যথেচ্ছচারী ধার্ম্মিক মহাপুৰুষেরা স্বেচ্ছাধীন বিবাহ করিতে আরম্ভ করেন, এবং ধর্ম্মশাস্ত্রানভিজ্ঞ সর্ব্বজ্ঞ মহাপুরুষেরা তাদৃশ অবৈধ বিবাহকে বৈধ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তজ্জন্য লোকহিতৈষী নিরীহ শাস্ত্রকারেরা কোনও অংশে অপরাধী হইতে পারেন না। তাঁহারা পূর্ব্বপরিণীত সবর্ণা সহধর্ম্মিণীকে ধর্ম্মপত্নী ও কামোপশমনের নিমিত্ত অনন্তরপরিণীতা অসবর্ণ ভার্য্যাকে কামপত্নী শব্দে নির্দ্দেশ করিয়াছেন। শাস্ত্রানুসারে, ধর্ম্মপত্নী গৃহস্থকর্তব্য যাবতীয় লৌকিক বা পারলৌকিক বিষয়ে সহাধিকারিণী; কামপত্নী কেবল কামোপশমনের উপযোগিনী; সুতরাং, শাস্ত্রকারের কামপত্নীকে উপপত্নীবিশেষ বলিয়া পরিগণিত করিয়াছেন। ফলতঃ, অসবর্ণা কামপত্নী, কোনও অংশে, সবর্ণ ধর্ম্মপত্নীর প্রতিদ্বন্দ্বিনী বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে, তাঁহারা তাহার পথ রাখেন নাই। এ স্থলে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক, কামুক পুরুষ, কেবল কামোপশমনের নিমিত্ত, দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে, এ বিষয়ে ধর্ম্মশাস্ত্রপ্রবর্ত্তকদিগের ঐকমত্য নাই। মহর্ষি আপস্তম্ব, অসন্দিগ্ধ বাক্যে, পুত্রবর্তী ও ধর্ম্মকার্য্যোপযোগিনী পত্নী সত্ত্বে একবারে দারান্তর পরিগ্রহ নিষেধ করিয়া রাখিয়াছেন। কেবল কামোপশমনের নিমিত্ত, পুরুষ পুনরায় বিবাহ করিতে পারে, তদীয় ধর্ম্মসূত্রে তাহার কোনও চিহ্ন দেখিতে পাত্তয়া যায় না।

 যাহা হউক, যে দ্বিবিধ অধিবেদন উল্লিখিত ছইল, এতদ্ব্যতিরিক্ত স্থলে, শাস্ত্রানুসারে, পূর্বপরিণীতা সবর্ণা সহধর্ম্মিণীর জীবদ্দশায়, পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার অধিকার নাই। যিনি যত ইচ্ছা বিতণ্ডা করুন, যিনি যত ইচ্ছা পাণ্ডিত্যপ্রকাশ করুন, যদৃচ্ছাক্রমে যত ইচ্ছা বিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমত বা অনুমোদিত কার্য্য, ইহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইবার নহে। শাস্ত্রের অর্থ না বুঝিয়া, অথবা বিপরীত অর্থ বুঝিয়া, কিংবা অভিপ্রেতসিদ্ধির নিমিত্ত স্বেচ্ছানুরূপ অর্থান্তর কল্পনা করিয়া, শাস্ত্রের দোহাই দিয়া, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বহুবিবাহকাণ্ড বৈধ বলিয়া ব্যবস্থা প্রচার করিলে, নিরপরাধ শাস্ত্রকারদিগকে নরকে নিক্ষিপ্ত করা হয়।

 এই স্থলে, সমাজস্থ সর্ব্বসাধারণ লোককে সম্ভাষণ করিয়া, কিছু আবেদন করিবার নিতান্ত বাসনা ছিল, কিন্তু, শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ অসুস্থতার অতিশয্য বশতঃ, যথোপযুক্ত প্রকারে তৎসম্পাদন অসাধ্য বিবেচনা করিয়া, সাতিশয় ক্ষুব্ধ হৃদয়ে সে বাসনায় বিসর্জন দিয়া, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্বক, বিরত হইতে হইল।

শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্ম্মা

 কলিকাতা

১লা চৈত্র। সংবৎ ১১২১