বাঁশরী/তৃতীয় অঙ্ক/শেষ দৃশ্য
তৃতীয় অঙ্ক
শেষ দৃশ্য
বাঁশরীদের বাড়ি। সতীশ ডেস্কে বসে লিখছে
সুষমার ছোটো বোন সুষীমার প্রবেশ
সতীশ
আমার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করতে এসেছিস? বরের মুখ-দেখা বুঝি আজ?
সুষীমা
যাও!
সতীশ
যাও কী! বেশি দিনের কথা নয়, তোর বয়স যখন পাঁচ, মাকে জিজ্ঞাসা করিস আমাকে বিয়ে করতে তোর কী জেদ ছিল। আমি তোকে সোনার বালা গড়িয়ে দিয়েছিলুম, সেটা ভেঙে ব্রোচ্ তৈরি হয়েছে।
সুষীমা
সতীশদা, কী বকছ তুমি?
সতীশ
আচ্ছা থাক্ তবে, কী জন্যে এসেছিস?
সুষমা
দিদির বিয়েতে প্রেজেণ্ট্ দেব।
সতীশ
সে তো ভালো কথা। কী দিতে চাস?
সুষীমা
এই চামড়ার থলিটা।
সতীশ
ভালো জিনিস, আমারই লোভ হচ্ছে।
সুষীমা
আমি এসেছি বাঁশিদিদির কাছে।
সতীশ
ওখান থেকে কেউ তোক পাঠিয়ে দিয়েছে?
সুষীমা
না, লুকিয়ে এসেছি, কেউ জানে না। আমার এই থলির উপরে বাঁশিদিদিকে দিয়ে আঁকিয়ে নেব।
সতীশ
বাঁশিদিদি আঁকতে পারে কে বললে তোকে?
সুষীমা
শংকরদাদা। তার কাছে একটা সিগারেট্ কেস্ আছে, সেটা বাঁশিদিদির দেওয়া। তার উপরে একজোড়া পায়রা এঁকেছেন নিজের হাতে। চমৎকার!
সতীশ
প্রস্থান। বাঁশরীর প্রবেশ
বাঁশরী
কী, সুষী!
সুষীমা
তোমাকে সতীশদাদা সব বলেছেন?
বাঁশরী।
হাঁ বলেছেন। ছবি এঁকে দেব তোর থলির উপর? কী ছবি আঁকব?
সুষীমা
একজোড়া পায়রা, ঠিক যেমন এঁকেছ শংকরদাদার সিগারেট্ কেসের উপরে।
বাঁশরী
ঠিক তেমনি করেই দেব। কিন্তু কাউকে বলিস নে যে আমি এঁকে দিয়েছি।
সুষীমা
কাউকে না।
বাঁশরী
তোকেও একটা কাজ করতে হবে, নইলে আমি আঁকব না।
সুষীমা
বাঁশরী
সেই সিগারেট্ কেস্টা আমাকে এনে দিতে হবে।
সুষীমা
তাঁর বুকের পকেটে থাকে। কক্ষনো আমাকে দেবেন না।
বাঁশরী
আমার নাম করে বলিস দিতেই হবে।
সুষীমা
তুমি তাঁকে দিয়েছ, আবার ফিরিয়ে নেবে কী করে?
বাঁশরী
তোমার শংকরদাদাও দেওয়া জিনিস ফিরিয়ে নেন।
সুষীমা
কক্ষনো না।
বাঁশরী
আচ্ছা, তাঁকে জিজ্ঞাসা করিস আমার নাম করে।
সুষীমা
আচ্ছা, করব। আমি যাই, কিন্তু ভুলো না আমার কথা।
বাঁশরী
সুষীমা
কেন?
বাঁশরী
মা জানতে পারলে রাগ করবেন।
সুষীমা
কেন?
বাঁশরী
যদি তোর অসুখ করে।
সুষীমা
বলব না, কিন্তু খেতে দেব শংকরদাদাকেও।
সুষীমার প্রস্থান
একখানা খাতা হাতে নিয়ে বাঁশরী সোফায় হেলান দিয়ে বসল
লীলার প্রবেশ
বাঁশরী
লীলা
কী বলো তো, বাঁশি।
বাঁশরী
ক্ষিতীশের এই গল্পখানা।
লীলা
(খাতাটা তুলে নিয়ে) ‘ভালোবাসার নীলাম’-নামটা চলবে বাজারে।
বাঁশরী
বস্তুটাও। এ জিনিসের কাট্তি আছে। পড়তে চাস?
লীলা
না ভাই, সময় নেই, বিয়েবাড়ি সাজাবার জন্যে ডাক পড়েছে।
বাঁশরী
আমি কি সাজাতে পারতুম না!
লীলা
আমার চেয়ে অনেক ভালো পারতিস।
বাঁশরী
ডাকতে সাহস হল না! ভীরু ওরা।
লীলা।
বাঁশরী
না ডেকেই লজ্জা দিলে আমাকে। ভাবছে আমি অন্নজল ছেড়ে ঘরে দরজা দিয়ে কেঁদে মরছি। ওদের সঙ্গে যখন তোর দেখা হবে কথাপ্রসঙ্গে বলিস, ‘বাঁশী বিছানায় শুয়ে কমিক গল্প পড়ছিল, পেট ফেটে যাচ্ছিল হেসে হেসে।’ নিশ্চয় বলিস।
লীলা
নিশ্চয় বলব, গল্পের বিষয়টা কী বল্ দেখি?
বাঁশরী
হিরোর নাম স্যার চন্দ্রশেখর। নায়িকা পঙ্কজা, ধনকুবেরের মন ভোলাতে লেগেছেন উঠে পড়ে। ওঠার চেয়ে পড়ার অংশটাই বেশি। সেণ্ট্-এণ্টনির টেম্টেশন্— ছবি দেখেছিস তো? দিনের পর দিন নূতন বেহায়াগিরি তোর খুব যে শুচিবাই তা নয়, তবু ক্ষণে ক্ষণে গঙ্গার ঘাটে দৌড় মারতে চাইতিস। দ্বিতীয় নম্বরের নায়িকা গলা ভেঙে মরছে পঙ্ককুণ্ডের ধারে দাঁড়িয়ে। অবশেষে একদিন পৌষমাসের অর্ধরাতে খিড়কির ঘাটে- তুই ভাবছিস হতভাগিনী আত্মহত্যা করে বাঁচল ক্ষিতীশের কল্পনাকে অবিচার করিস নে- নায়িকা জলের মধ্যে এক পৈঁঠে পর্যন্ত নেবেছিল। ঠাণ্ডা জলে ছ্যাঁক্ করে উঠল গা’টা। ছুটল গরম বিছানা লক্ষ্য করে। এইখানটাতে সাইকলজির তর্ক এই, শীত করল বলে মরা মুলইতুবি কিম্বা শীত করাতে আগুনের কথাটা মাথায় এল, অমনি ভাবল ওদের জ্বালিয়ে মারবে বেঁচে থেকে।
লীলা
কিছুতে বুঝতে পারি নে, এত লোক থাকতে ক্ষিতীশের উপর এত ভরসা রেখেছিস কী করে।
বাঁশরী
অবিচার করিস নে। ওর লেখবার শক্তি আছে। ও আমাদের ময়মনসিংহের বাগানের আম, জাত ভালো, কিন্তু যতই চেষ্টা করা গেল ভিতরে পোকা হতেই আছে। ঐ পোকা বাদ দিয়ে কাজে লাগানো হয়তো চলবে। ঐ বুঝি আসছে।
লীলা
আমি তবে চললুম।
বাঁশরী
একেবারে যাস নে। সন্ধেবেলাটা কোনও মতে কাটাতে হবে। কমিক গল্পটা তত শেষ হল।
লীলা
ক্ষিতীশের প্রবেশ
ক্ষিতীশ
কেমন লাগল? মেলোড্রামার খাদ মেশাই নি সিকি তোলাও। সেণ্টিমেণ্টালিটির তরল রস চায় যে-সব খুকীরা তাদের পক্ষে নির্জলা একাদশী। একেবারে নিষ্ঠুর সত্য।
বাঁশরী
কেমন লাগল বুঝিয়ে দিচ্ছি (পাতাগুলি ছিঁড়ে ফেলল)।
ক্ষিতীশ
করলে কী! সর্বনাশ! এটা আমার সব লেখার সেরা, নষ্ট করে ফেললে?
বাঁশরী
দলিলটা নষ্ট করে ফেললেই সেরা জিনিসের বালাই থাকে না। কৃতজ্ঞ হোয়ো আমার ’পরে।
ক্ষিতীশ
সাহিত্যে নিজে কিছু দেবার শক্তি নেই, অথচ সংকোচ নেই তাকে বঞ্চিত করতে। এর দাম দিতে হবে, কিছুতে ছাড়ব না।
বাঁশরী
ক্ষিতীশ
তোমাকে!
বাঁশরী
ক্ষতিপূরণ এত সস্তায়, সাহস আছে নিতে?
ক্ষিতীশ
আছে।
বাঁশরী
সেণ্টিমেণ্ট্ এক ফোঁটাও মিলবে না।
ক্ষিতীশ
আশাও করি নে।
বাঁশরী
নির্জলা একাদশী, নিষ্ঠুর সত্য!
ক্ষিতীশ
রাজি আছি।
বাঁশরী
আছ রাজি? বুঝেসুঝে বলছ? এ কমিক নভেল নয়, ভুল করলে প্রুফ দেখা চলবে না, এডিশ্নও ফুবোবে না মরার দিন পর্যন্ত।
ক্ষিতীশ
বাঁশরী
না মশায়, কিচ্ছু বোঝ না। বুঝতে হবে দিনে দিনে পলে পলে, বুঝতে হবে হাড়ে হাড়ে মজ্জায় মজ্জায়।
ক্ষিতীশ
সেই হবে আমার জীবনের সব চেয়ে বড় অভিজ্ঞতা।
বাঁশরী
তবে বলি শোনো। অবোধের ’পরে মেয়েদের স্বাভাবিক স্নেহ। তোমার উপর কৃপা আছে আমার। তাই অবুঝের মত নিজের সর্বনাশের যে প্রস্তাবটা করলে তাতে সম্মতি দিতে দয়া হচ্ছে।
ক্ষিতীশ
সম্মতি না দিলে সাংঘাতিক নির্দয়তা হবে। সামলে উঠতে পারব না।
বাঁশরী
মেলোড্রামা?
ক্ষিতীশ
না, মেলোড্রামা নয়।
বাঁশরী
ক্ষিতীশ
যদি হয় তবে সেই দিনগুলোকে ঐ খাতার পাতার মতো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলো।
বাঁশরী
(উঠে দাঁড়িয়ে) আচ্ছা, সম্মতি দিলেম। (ক্ষিতীশ ছুটে এল বাঁশরীর দিকে) ঐ রে শুরু হল। ভালো করে ভেবে দেখো, এখনও পিছোবার সময় আছে।
ক্ষিতীশ
(করজোড়ে) মাপ করো, ভয় হচ্ছে পাছে মত বদলায়।
বাঁশরী
যখন বদলাবে তখন ভয় কোরো। অমন মুখের দিকে তাকিয়ে থেকো না। দেখতে খারাপ লাগে। যাও রেজেস্ট্রি আফিসে। তিন-চার দিনের মধ্যে বিয়ে হওয়া চাই।
ক্ষিতীশ
নোটিশের মেয়াদ কমাতে আইনে যদি বাধে।
বাঁশরী
তা হলে বিয়েতেও বাধবে। দেরি করতে সাহস নেই।
ক্ষিতীশ
বাঁশরী
হবে না অনুষ্ঠান, তোমার দেখছি কমিকের দিকে ঝোঁক আছে। এখনও বুঝলে না জিনিসটা সীরিয়াস্।
ক্ষিতীশ
কাউকে নিমন্ত্রণ?
বাঁশরী
কাউকে না।
ক্ষিতীশ
কাউকেই?
বাঁশরী
আচ্ছা, সোমশংকরকে।
ক্ষিতীশ
কিরকম চিঠিটা লিখতে হবে তার একটা খসড়া-
বাঁশরী
খসড়া কেন, লিখে দিচ্ছি।
ক্ষিতীশ
স্বহস্তে?
বাঁশরী
হাঁ, স্বহস্তেই।
ক্ষিতীশ
বাঁশরী
হাঁ, এখনই। (চিঠি লিখে) এই নাও পড়ো।
ক্ষিতীশের পাঠ
এতদ্দ্বারা সংবাদ দেওয়া যাইতেছে, শ্রীমতী বাঁশরী সরকারের সহিত শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশচন্দ্র ভৌমিকের অবিলম্বে বিবাহ স্থির হইয়াছে। তারিখ জানানো অনাবশ্যক- আপনার অভিনন্দন প্রার্থনীয়। পত্রদ্বারা বিজ্ঞাপন হইল, ত্রুটি মার্জনা করিবেন। ইতি-
বাঁশরী
এ চিঠি এখনি রাজার দারোয়ানের হাতে দিয়ে আসবে। দেরি কোরো না।
ক্ষিতীশের প্রস্থান
লীলা, শুনে যা খবরটা।
লীলার প্রবেশ
লীলা
কী খবর?
বাঁশরী
লীলা
আঃ, কী বলিস্ তার ঠিকানা নেই।
বাঁশরী
এতদিন পরে একটা ঠিকানা হল।
লীলা
এটা যে আত্মহত্যা।
বাঁশরী
তার পরে পুনর্জন্মের প্রথম অধ্যায়।
লীলা
সব চেয়ে দুঃখ এই যে, যেটা ট্র্যাজেডি সেটাকে দেখাবে প্রহসন।
বাঁশরী
ট্র্যাজেডির লজ্জা ঘুচবে ঠাট্টার হাসিতে। অশ্রুপাতের চেয়ে অগৌরব নেই।
লীলা
আমাদের রাশিচক্র থেকে খসে পড়ল সব চেয়ে উজ্জ্বল তারাটি। যদি তার জ্বালা নিভত শোক করতুম না। জ্বালা সে সঙ্গে করে নিয়েই চলল অন্ধকারের তলায়।
বাঁশরী
তা হোক, ডার্ক্ হীট্, কালো আগুন, কারো চোখে পড়বে না। আমার জন্য শোক করিস নে, যে আমার সাথি হতে চলল শোচনীয় সেই। এ কী! শংকর আসছে। তুই যা ভাই, একটু আড়ালে।
লীলার প্রস্থান। সোমশংকরের প্রবেশ
সোমশংকর
বাঁশি!
বাঁশরী
তুমি যে!
সোমশংকর
নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। জানি অন্য পক্ষ থেকে ডাকে নি তোমাকে। আমার পক্ষ থেকে কোনো সংকোচ নেই।
বাঁশরী
কেন সংকোচ নেই? ঔদাসীন্য?
সোমশংকর।
তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি আর আমি যা দিয়েছি তোমাকে, এ বিবাহে তাকে স্পর্শমাত্র করতে পারবে না, এ তুমি নিশ্চয় জান।
বাঁশরী
সোমশংকর
সে কথা বুঝতে যদি নাও পার, তবু দয়া কোরো আমাকে।
বাঁশরী
তবু বলল। বুঝতে চেষ্টা করি।
সোমশংকর
কঠিন ব্রত নিয়েছি, একদিন প্রকাশ হবে, আজ থাক্-দুঃসাধ্য আমার সংকল্প, ক্ষত্রিয়ের যোগ্য। কোনো-এক সংকটের দিনে বুঝবে সে ব্রত ভালোবাসার চেয়েও বড়ো। তাকে সম্পন্ন করতেই হবে প্রাণ দিয়েও।
বাঁশরী
আমাকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন করতে পারতে না?
সোমশংকর
নিজেকে কখনো তুমি ভুল বোঝাও না, বাঁশি। তুমি নিশ্চিত জান তোমার কাছে আমি দুর্বল। হয়তো একদিন তোমার ভালোবাসা আমাকে টলিয়ে দিত আমার ব্রত থেকে। যে দুর্গম পথে সুষমার সঙ্গে সন্ন্যাসী আমাকে যাত্রায় প্রবৃত্ত করেছেন সেখানে ভালোবাসার গতিবিধি বন্ধ।
বাঁশরী
সন্ন্যাসী হয়ত ঠিকই বুঝেছেন। তোমার চেয়েও তোমার ব্রতকে আমি বড় করে দেখতে পারতুম না। হয়তো সেইখানেই বাধত সংঘাত। আজ পর্যন্ত তোমার ব্রতের সঙ্গেই আমার শত্রুতা। তবে এই শত্রুর দুর্গে কোন্ সাহসে তুমি এলে? একদিন যে শক্তি আমার মধ্যে দেখেছিলে আজ কিছু কি তার অবশিষ্ট নেই? ভয় করবে না?
সোমশংকর।
শক্ত একটুও কমে নি, তবু ভয় করব না।
বাঁশরী
যদি তেমন কবে পিছু ডাকি এড়িয়ে যেতে পারবে
সোমশংকর
বা জানি, না পারতেও পারি।
বাঁশরী
তবে?
সোমশংকর
বাঁশরী
শংকর, তুমি ক্ষত্রিয়ের মতোই ভালোবাসতে পার। শুধু ভাব দিয়ে নয়, বীর্য দিয়ে। সত্যি করে বলো, আজও কি আমাকে সেদিনের মতোই ততখানিই ভালোবাস।
সোমশংকর
ততখানিই।
বাঁশরী
আর কিছুই চাই নে আমি। সুষমাকে নিয়ে পূর্ণ হোক তোমার ব্রত, তাকে ঈর্ষা করব না।
সোমশংকর
একটা কথা বাকি আছে।
বাঁশরী
কী বলো।
সোমশংকর
আমার ভালোবাসার কিছু চিহ্ন রেখে যাচ্ছি নামার কাছে, ফিরিয়ে দিতে পারবে না। (অলংকারের সেইথলি বের করলে)
বাঁশরী
সোমশংকর
ডুব দিয়ে আবার তুলে এনেছি।
বাঁশরী
মনে করেছিলুম আমার সব হারিয়েছে। ফিরে পেয়ে অনেকখানি বেশি করে পেলুম। নিজের হাতে পরিয়ে দাও আমাকে। (সোমশংকর গয়না পরিয়ে দিলে)
শক্ত আমার প্রাণ। তোমার কাছেও কোনোদিন কেঁদেছি বলে মনে পড়ে না। আজ যদি কঁদি কিছু মনে কোরো না। (হাতে মাথা রেখে কান্না)
ভৃত্যে প্রবেশ
বাজাবাহাদুরের চিঠি।
বাঁশরী
(দাঁড়িয়ে উঠে) শংকর, ও চিঠি আমাকে দাও।
সোমশংকব
না পড়েই?
বাঁশরী
হাঁ, না পড়েই।
সোমশংকর
তবে নাও। (বাঁশরী চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল) এখনো একটা কাজ বাকি আছে। এই সিগারেট্ কেস্ চেয়ে পাঠিয়েছিলে। কেন, বুঝতে পারি নি।
বাঁশরী
আর-একবার তোমার ঐ পকেটে রাখব বলে, এ আমার দ্বিতীয়বারকার দান।
সোমশংকর
সন্ন্যাসীবাবা আমাদের বাড়িতে আসবেন এখনই— বিদায় দাও, যাই তাঁর কাছে।
বাঁশরী
যাও, জয় হোক সন্ন্যাসীর।
সোমশংকরের প্রস্থান। লীলার প্রবেশ
লীলা
কী, ভাই
বাঁশরী
একটু বোসো। আর একখানা চিঠি লেখা বাকি আছে, সেটা তাকে দিতে হবে তোরই হাত দিয়ে। (চিঠি লিখে লীলাকে দিলে) পড়ে দেখ্।
চিঠি
শ্রীমান ক্ষিতীশচন্দ্র ভৌমিক কল্যাণবরেষু তোমার ভাগ্য ভালো, ফাঁড়া কেটে গেল-আমারও বিবাহের আসন্ন আশঙ্কাটা সম্পূর্ণ লোপ করে দিলুম। ‘ভালোবাসার নীলামে’ সর্বোচ্চ দরই পেয়েছি, তোমার ডাক সে পর্যন্ত পৌঁছত না। অন্যত্র অন্য কোনো সান্ত্বনার সুযোগ উপস্থিতমতো যদি না জোটে তবে বই লেখো। আশা করি, এবার সত্যের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে। তোমার এই লেখায় বাঁশরীর প্রতি দয়া করবার দরকার হবে না। আত্মহত্যায় এক পৈঁঠে পা বাড়িয়েই সে ফিরে এসেছে।
লীলা
(বাঁশরীকে জড়িয়ে ধরে) আঃ, বাঁচালি ভাই, আমাদের সবাইকে। সুষমার উপর এখন আর তোর রাগ নেই?
বাঁশরী
কেন থাকবে? সে কি আমার চেয়ে জিতেছে? লীলা, দে ভাই, সব দরজা খুলে, সব আলোগুলো জ্বালিয়ে বাগান থেকে যতগুলো ফুল পাস নিয়ে আয় সংগ্রহ কবে।
লীলার প্রস্থান। পুরন্দরের প্রবেশ
বাঁশরী
পুরন্দর
চলে যাচ্ছি দূরে, হয়তো আর দেখা হবে না।
বাঁশরী
যাবার বেলায় আমার কথা মনে পড়ল?
পুরন্দর
তোমার কথা কখনোই ভুলি নি। ভোলবার মতো মেয়ে নও তুমি। নিত্যই এ কথা মনে রেখেছি, তোমাকে চাই আমাদের কাজে—দুর্লভ দুঃসাধ্য তুমি, তাই দুঃখ দিয়েছি।
বাঁশরী
পার নি দুঃখ দিতে। মরা কঠিন নয় পেয়েছি তার প্রথম শিক্ষা। কিন্তু তোমাকে একটা শেষ কথা বলব সন্ন্যাসী, শোনো। সুষমাকে তুমি ভালোবাস, সুষমা জানে সেই কথা। তোমার ভালোবাসার সূত্রে গেঁথে ব্রতের হার পরেছে সে গলায়, তার আর ভাবনা কিসের। সত্য কিনা বলো।
পুরন্দর
সত্য কি মিথ্যা সে কথা বলে কোনো ফল নেই, দুইই সমান।
বাঁশরী
সুষমার ভাগ্য ভালো, কিন্তু সোমশংকরকে কী তুমি দিলে?
পুরন্দর
সে পুরুষ, সে ক্ষত্রিয়, সে তপস্বী।
বাঁশরী
হোক পুরুষ, হোক ক্ষত্রিয়, তার তপস্যা অপূর্ণ থাকবে আমি না থাকলে, আবশ্যক আছে আমাকে।
পুরন্দর
বঞ্চিত হবার দুঃখই তাকে দেবে শক্তি।
বাঁশরী
কখনোই না, তাতেই পঙ্গু করবে তার ব্রত। পারে ঐ ক্ষত্রিয়কে শক্তি দিতে এমন কেবল একটি মেয়ে আছে এ সংসারে।
পুরন্দর
জানি।
বাঁশরী
সে সুষমা নয়।
পুরন্দর
তাও জানি। কিন্তু ঐ বীরের শক্তি হরণ করতে পারে এমনও একটিমাত্র মেয়ে আছে এ সংসারে।
বাঁশরী
আজ অভয় দিচ্ছে সে। আপন অন্তরের মধ্যে সে আপনি পেয়েছে দীক্ষা। তার বন্ধন ঘুচেছে, সে আর বাঁধবে না।
পুরন্দর
তবে আজ যাবার দিনে নিঃসংকোচে তারই হাতে রেখে গেলেম সোমশংকরের দুর্গম পথের পাথেয়।
বাঁশরী
এতদিন আমার যত প্রণাম বাকি ছিল সব একত্র করে আজ এই দিলেম তোমার পায়ে।
পুরন্দর
আর আমি দিয়ে গেলেম তোমাকে একটি গান, তোমার কণ্ঠে সেটিকে গ্রহণ করে।
গান
পিণাকেতে লাগে টংকার—
বসুন্ধরার পঞ্জরতলে কম্পন জাগে শঙ্কার।
আকাশেতে ঘরে ঘূর্ণী
সৃষ্টির বাঁধ চূর্ণি,
বজ্রভীষণ গর্জনরব প্রলয়ের জয়ডঙ্কার॥
স্বর্গ উঠিছে ক্রন্দি,
সুরপরিষদ বন্দী,
তিমিরগহন দুঃসহ রাতে উঠে শৃঙ্খলঝংকার।
দানবদম্ভ তর্জি
রুদ্র উঠিল গর্জি,
লণ্ডভণ্ড লুটিল ধুলায় অভ্রভেদী অহংকার।