বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড)/১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১। ১নম্বর সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ - মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম[১] বীর উত্তম, ঢাকা, ১৯৮১ ১৯৭১

বিলম্বিত কনফারেন্স

 ১০ই জুলাই আমি আগতলা থেকে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একখানি বিমানে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে গৌহাটিতে আধ ঘণ্টার জন্য থেমে রাত সাড়ে আটটার দিকে কলকাতার আকাশে পৌঁছে গেলাম। নীচে তখন মুষলধারায় বৃষ্টির সাথে বেগে বাতাস বইছিলো। এহেন দুর্যোগে কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমাদের বিমান রানওয়ে স্পর্শ করলো। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমার চার ঘণ্টার কষ্টকর যাত্রা শেষ হলো। রাত তখন ৯টা।

 অচেনা কলকাতায় আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত আগন্তুক। বিমান বন্দরের ভবনে কিছুক্ষণ পায়চারী করার পর একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। শিখ ড্রাইভারকে বললাম বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে। কিন্তু রাতে আর্মি হেডকোয়ার্টার খুঁজে পেলাম না। তখন ড্রাইভারকে মাঝারি ধরনের একটি হোটেলে নিয়ে যেতে বললাম।

 বহুদিনের পরিচর্যার অভাবে আমার চুল, দাড়ি সমানে বেড়ে উঠেছিলো। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো জোড়া ছেঁড়া ও ময়লা, গায়ে বেঢপ মাপের জামাটিও আকারে বেশ বড়, পরনে ট্রাউজার এং হাতে কিছু সরকারী কাগজপত্র ভর্তি একটি কাপড়ের থলে, এই ছিলো আমার সেদিনকার সর্বাঙ্গীণ চেহারা। শিখ ড্রাইভার নিশ্চয়ই আমার সাথে রসিকতা করে থাকবে। সে আমাকে একটি ব্যয়বহুল হোটেলে পৌঁছে দিলো। হোটেলে ঢুকতেই অনুভব করলাম রিসেপশন রুমটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমি যেন হঠাৎ করে দারুণ একটা আঘাত পেলাম। মনের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে আমার থলেটি স্পর্শ করলাম। সেখোনে উপস্থিত সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত পুরুষ ও মহিলাদের বিস্মিত দৃষ্টির মুথে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মুহূর্তে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাস করলাম, “একটা রুম পাওয়া যাবে কি?” ভদ্রলোক আড়চোখে আমার পা থেকে মাতা পর্যন্ত একটু জরিপ করে নিলেন। আমার জুতো, ট্রাইজার, শার্ট, থলে, দাড়ি কোন কিছুই তার দৃষ্টি এড়ালো না। তারপর কিছুটা কৌতুহলের হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি...?” “হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি”, সাথে সাথে জবাব দিলাম।

 পরদিন সকালে হোটেল ত্যাগ করলাম। কিন্তু এক রাতের ভাড়া হিসাবে পকেটে যা ছিল অর্ধেকটা বেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার সারাটা পথে আমি শুধু সেই শিখ ড্রাইভারকে অভিসম্পাত করছিলাম।

 ১১ই থেকে ১৭ই জুলাই পর্যন্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনের আলোচনা সকালে শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। সেখানে সকল সেক্টর কমাণ্ডারই উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে আমরা নানা ধরনের সমস্যা এবং সমন্বিত ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করি। উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত আমাদের চিন্তার কিংবা কাজের কোন সমন্বয় ছিলো না।

 কলকাতা ৮ নম্বর থিয়টার রোডের ভবনটিতে আমরা মিলিত হয়েছিলাম। এটা ছিলো বিএসএফ-এর অফিস। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারকে এটি ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছিলো।

 আমাদের প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ বাহিনীর কমাণ্ডার-ইন-চীপ কর্নেল (অবঃ) এম, এ, জি, ওসমানী প্রথম দিনের অধিবেশনে যোগ দিতে পারেননি।

১২ই জুলাই দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ছিলেনঃ
১। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
২। কর্নেল (অবঃ) এম, এ, জি, ওসমানী।
৩। লেঃ কর্নেল এম, এ, রব।
৪। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে, খন্দকার।
৫। মেজর (অবঃ) নূরুজ্জামান।
৬। মেজর সি, আর, দত্ত।
৭। মেজর জিয়াউর রহমান।
৮। মেজর কে, এম, সফিউল্লাহ।
৯। মেজর খালেদ মোশাররফ।
১০। মেজর মীর শওকত আলী।
১১। উইং কমাণ্ডার এম, কে, বাশার।
১২। মেজর ওসমান চৌধুরী।
১৩। মেজর রফিক-উল-ইসলাম।
১৪। মেজর নাজমুল হক।
১৫। মেজর এম, এ, জলিল।
১৬। মেজর এ, আর, চৌধুরী।

 দশ দিনব্যাপী সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি। এই বৈঠকে লেঃ কর্নেল এম, এ, রব বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ-অব-স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে, খন্দকার ডেপুটি চীফ-অব-স্টাফ নিযুক্ত হন।

সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো তা হচ্ছেঃ

১। বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ।

২। নিম্নলিখিতভাবে গেরিলা যুদ্ধের আয়োজনঃ

(ক) নির্ধারিত এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে পাঁচ অথবা দশজনকে নিয়ে গঠিত ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা দলকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হবে।
(খ) গেরিলাদের শ্রেণীবিভক্তি,
অ্যাকশন গ্রুপঃ এই গ্রুপের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা হামলা পরিচালনা করবে। তারা শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ হাতিয়ার বহন করবে।
গোয়েন্দা সেনাঃ এই গ্রুপের গেরিলারা সাধারণতঃ সংঘর্ষে জড়িত হবে না। এরা শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করবে। এদের সাধারণতঃ শতকরা ৩০ ভাগের বেশী অস্ত্র থাকবে না।

 গেরিলা ঘাঁটিঃ প্রতিটি ঘাঁটিতে গেরিলাদের থাকা-খাওয়ার জন্য কয়েকটি নিরাপদ গৃহের ব্যবস্থা থাকবে যেখান থেকে যথাযথ খবরপ্রাপ্তির পরই পরবর্তী লক্ষ্যস্থলে তারা পৌঁছতে পারবে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একটি করে মেডিক্যাল গ্রুপ থাকবে যারা প্রয়োজনে গেরিলাদের চিকিৎসা করবে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একজন রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব থাকবে। এদের দায়িত্ব ছিলো বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে পাকিস্তানীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া এবং একই সংগে বাঙ্গালীরা যেন মানসিক সাহস ও শক্তি হারিয়ে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শত্রুর বিরুদ্ধে বড় ধরনের আক্রমন পরিচালনার উদ্দেশ্যে আরো বেশীসংখ্যক গেরিলা কিংবা নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের স্থান সংকুলানের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিকে তৈরী রাখাও এদের দায়িত্ব ছিল।

৩। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ব্যাটালিয়ন ফোর্স এবং সেক্টর ট্রুপস-এর ভিত্তিতে সংগঠিত করতে হবে।
৪। শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
(ক) প্রতিটি সুবিধাজনক স্থানে শত্রুর বিরুদ্ধে রেইড এবং অ্যামবুশের মাধ্যমে আঘাত হানার জন্য বিপুলসংখ্যক গেরিলাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে দেয়া হবে না। বিদ্যুতের খুঁটি, সাবস্টেশন প্রভৃতি উড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অচল করার মাধ্যমে এ কাজ করতে হবে।
(গ) পাকিস্তানীদেরকে কোন কাঁচামাল কিংবা উৎপাদিত পণ্য রফতানী করতে দেয়া হবে না। এসব জিনিস যেসব গুদামে থাকবে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে।
(ঘ) শত্রুপক্ষের সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম আনা-নেয়ার জন্য ব্যাবহারযোগ্য বাহন রেলপথ, নৌযান পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করতে হবে।
(ঙ) রণকৌশলগত পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
(চ) শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার পরে তাদেও বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলোর ওপর গেরিলারা মরণপণ আঘাত হানবে।

 বিভিন্ন সেক্টর এবং ফোর্স পুনর্গঠনের কাজে ইপিআর-এর ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইপিআর বাহিনীর কাছ থেকেই বাংলাদেশ সরকার প্রায় সমুদয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যাবস্থা করেছিলো। শুধু তাই নয়, প্রথম থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তারাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। ইপিআর-এর অয়্যারলেস সেট এবং যানবাহন ব্যাপকভাবে কাজে লেগেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর-এর সিগন্যালরা এবং ড্রাইভাররা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে। সেই দুর্দিনে স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ ড্রাইভাররা শত্রুপক্ষের তুমুল গোলাবৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের সৈন্য ও রসদ বহন করে দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টন্ত স্থাপন করেছে।

আমাদের এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।

 ১ নম্বর সেক্টরঃ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে (মুহুরী নদীর পূর্ব এলাকা) এই সেক্টর গঠিত হয়। সমগ্র সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। আমি এই সেক্টরে কমাণ্ডার নিযুক্ত হই। এই সেক্টরের মোট সৈন্যসংখ্যা ছিলো ২১শ’। এর মধ্যে ১৫শ’ ইপিআর, ২শ’ পুলিশ, ৩শ’ সাময়িক বাহিনী এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিলো প্রায় একশ’। এখানে গেরিলাদের সংখ্যা ছিলো  প্রায় ২০ হাজার, যার মধ্যে ৮ হাজারকে অ্যাকশন গ্রুপ হিসাবে গড়ে তোলা হয়। এদের মধ্যে শতকরা ৩৫ ভাগকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলি দেয়া হয়েছিলো।

 ২ নম্বর সেক্টরঃ কুমিল্লা ও ফরিদপুর জেলা এবং নোয়াখালী ও ঢাকার অংশবিশেষ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হন মেজর খালেদ মোশাররফ। সেক্টরটি ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিলো। সমগ্র সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিলো প্রায় ৪ হাজার এবং গেরিলা ছিলো ৩০ হাজার।

 ৩ নম্বর সেক্টরঃ মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধীনে মৌলবীবাজার মহকুমা,ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা, নারায়নগঞ্জ মহকুমা, এবং কেরানীগঞ্জের অংশবিশে নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। ১০টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরের গেরিলা সদস্যোর সংখ্যা ছিলো প্রায় ১০ হাজার। এস ফোর্স গঠনের পর মেজর সফিউল্লাহকে তাঁর কমাণ্ডার নিযুক্ত করা হয়। মেজর নূরুজ্জামানকে ৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়।

 ৪ নম্বর সেক্টরঃ উত্তরে সিলেট সদর এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের কমাণ্ডার নিযুক্ত হন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। সেক্টরটি ৬ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিলো। সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা ছিলো ২ হাজার এবং গেরিলা ছিলো ৮ হাজার। সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিলো করিমগঞ্জে। পরে তা নাসিমপুরে স্থানান্তর করা হয়।

 ৫ নম্বর সেক্টরঃ সিলেট জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে কমাণ্ডার নিযুক্ত হন মেজর মীর শওকত আলী। সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮শ এবং গেরিলা ছিলো ৭ হাজার। সেক্টরটি ৬ সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিলো।

 ৬ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টর রংপুর ও দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত। উইং কমাণ্ডার এম কে বাশার ছিলেন সেক্টর কমাণ্ডার। সাব সেক্টর সংখ্যা ছিলো ৫টি। সৈন্যসংখ্যা ছিলো প্রায় ১২শ' এং গেরিলা ছিলো ৬ হাজার। সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিলো রংপুর জেলার পাটগ্রামের নিকট বুড়িমারীতে।

 ৭ নম্বর সেক্টরঃ রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া জেলা এং দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হন মেজর নাজমুল হক। যুদ্ধকালে এক মটর দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেলে সেক্টর কমাণ্ডার হিসাবে মেজর কিউ এন জামন দায়িত্ব গ্রহন করেন। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিলো ৮টি। সৈন্যসংখ্যা প্রায় ২ হাজার এবং গেরিলার সংখ্যা ছিলো ২ হাজার।

 ৮ নম্বর সেক্টরঃ ১৫ই জুলাই পর্যন্ত এ সেক্টরে কমাণ্ডার ছিলেন মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী। এ সময় মেজর এম এ মঞ্জুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন এবং তাঁকে ৮ নম্বর সেক্টরের কমাণ্ডার নিযুক্ত করা হয়। এর আওতায় ছিলো কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা। পরে বরিশাল ও পটুয়াখালীকে এই সেক্টর থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেক্টরে সৈন্যসংখ্যা ছিলো ২ হাজার। গেরিলা ৭ হাজার। সাব-সেক্টর ছিলো ৭টি। সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিলো বেনাপোলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া

 ৯ নম্বর সেক্টরঃ বরিশাল, পটুয়াখালী এবং খুলনা ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়। সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হন মেজর এম এ জলিল। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিলো ৮টি। গেরিলা ছিলো প্রায় ১৫ হাজার। নিয়মিত সৈন্য ছিলো এক ব্যাটালিয়নের মত।

 ১০ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টরের কোন আঞ্চলিক সীমানা ছিলো না। শুধু নৌ-বাহিনীর কামাােদের নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের সদস্যদের শত্রুপক্ষের নৌ-যান ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্নসংখ্যাক কমাণ্ডো নিয়ে এক-একটি গ্রুপ গঠিত হতো। যে সেক্টরের এলাকায় কমাণ্ডো অভিযান পরিচালিত হতো সেই এলাকার সেক্টর কমাণ্ডারের অধীনে থেকে কমাণ্ডোরা কাজ করতো। নৌ- অভিযান শেষ হওয়ার পর কমাণ্ডোরা আবার তাদের মূল সেক্টর অর্থাৎ ১০ নম্বর সেক্টরে ফিরে আসতো।  ১১ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টরটি ছিল মেজর তাহেরর কমাণ্ডে। ১৫ই নভেম্বর এক অভিযানে তিনি আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহকে এই সেক্টরের কমাণ্ডার করা হয়। এখানে সাব-সেক্টর ছিলো ৮টি এবং গেরিলার সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০ হাজার।

 এই সম্মেলনে সেক্টরসমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্তের পর সৈনিকদেরও নিম্নলিখিত গ্রুপে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

 নিয়মিত আর্মি ব্যাটালিয়নঃ তখনকার স্বল্পসংখ্যক ব্যাটালিয়নগুলো নিয়ে প্রথম বাংলাদেশ বাহিনী গঠিত হয়। এইসব ব্যাটালিয়নের জনশক্তি ছিলো খুবই কম। প্রত্যেক সেক্টর থেকে লোক সংগ্রহ করে এই শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চলে। তারপর এগুলোকে ব্রিগেড গ্রুপে ভাগ করা হয়। কে-ফোর্স, এস-ফোর্স এবং জেড- ফোর্স নামে এগুলো পরিচিত হয়। এসব বাহিনীর অধিকাংশ লোকই ছিলো ইপিআর-এর।

 সেক্টর ট্রুপসঃ উপরোক্ত ব্যাটালিয়নগুলোতে যেসব ইপিআর, পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর লোককে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি তাদেরকে যার যার সেক্টরে যুদ্ধ করার জন্য ইউনিট ও সাব-ইউনিটে ভাগ করা হয়। নিয়মিত ব্যাটালিয়নগুলোর চাইতে সেক্টর ট্রুপের অস্ত্রবল ছিলো কিছুটা কম। ওপরের প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রুপ মুক্তিফৌজ, এম এফ, মুক্তিবাহিনী অথবা নিয়মিত সৈন্য হিসাবে পরিচিত। এদেরকে সেনাবাহিনীর বিধি- বিধান ও নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এদেরকে জীবনধারণের ভাতা হিসেবে একটা যুক্তিসংগত অংকের অর্থ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু তারা কোন বেতন গ্রহন করেনি। সরকারীভাবে তাদের নাম রাখা হয়”নিয়মিত বাহিনী”।

 অনিয়মিত বাহিনী অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স (এফএফ)

 গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যেসব লোককে ট্রেনিং দেয়া হতো তারা ছিলো ফ্রিডম ফাইটাস। এস সরকারী নাম ছিলো অনিয়মিত অথবা গণ-বাহিনী। এরা সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন অনুসারে চলতে বাধ্য ছিলো না। অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব ছিলো এই গ্রুপের বৈশিষ্ট্য। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, সুদীর্ঘ এবং কঠোর সংগ্রামী জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তারা আপনা থেকেই সুশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। সাধারণতঃ এদেরই বলা হতো 'গেরিলা'। মুক্তিফৌজ এবং ফ্রিডম ফাইটারদেরও সাধারণভাবে এফ-এফ বা ফ্রিডম ফাইটার্স বলা হতো এবং এই নামে সকল যোদ্ধাই সুপরিচিত ছিলো।

 অনিয়মিত বাহিনীর লোকরা কোন বেতন কিংবা জীবনধারণ ভাতা পেতো না। ট্রেনিংয়ের পর বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানোর সময় তাদেরকে রাহা খরচ হিসাবে কিছু অর্থ দেয়া হতে। একে বলা হতো ইণ্ডাকশন মানি' বা নিযুক্তি-ভাতা।

 আমাদের নিয়মিত (এম এফ) এবং অনিয়মিত (এফ এফ) বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং সদস্যসংখ্যা হিসাব করে তাদের জন্য কাপড়-চোপড়, রেশন, অস্ত্র, গোলাগুলি, অয়্যারলেস সেট এবং টেলিফোন সেট, কম্পাস, বাইনোকুলার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা তৈরী করে পুরো সেক্টরের অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের সাকুল্য তালিকা সরকারের কাছে পেশ করতে হতো। আমাদের সরকার আবার ভাসত সরকারের কাছ থেকে জিনিসগুলো সংগ্রহ করতেন। অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা আগেও বলেছি। নিঃসন্দেহে এই সমস্যার জন্য প্রথমদিকে আমরা মার খেয়েছিলাম। সেক্টরগুলোতে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে তেমন কোন সামঞ্জস্য ছিলো না। কিছু ছিলো চীনের তৈরী, কিছু বৃটিশ, আবার কিছু 'আমেরিকান। এগুলোর গোলাগুলি নিয়ে আমাদের নিদারুণ সংকটে পড়তে হতো। শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে শুধু একধরনের (সম্ভবত ভারতীয়) অস্ত্র দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

 যানবাহনের সমস্যার তো কোন অন্তই ছিলো না। খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে প্রায়ই গাড়ীগুলি অচল থাকতো। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেভাবে হোক যতদূর সম্ভব বেশী গাড়ী চালু রাখতে হবে। ভারত সরকারের সাথে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ই-এম-ই (ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল এ্যাও ইকুইপমেণ্ট) বিভাগকে এই কাজের ভার দেয়া হয়।

 চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিলো প্রকট। ভারতের হাসপাতালগুলো আহত শরণার্থীতে ভরে গিয়েছিল। এদের বেশীর ভাগই ছিলো বুলেট কিংবা বেয়োনেটের আঘাতে আহত। আমরা বাঙ্গালী সৈনিকদের জন্য কয়েকটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। পরে সবচাইতে বড় হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল ২ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধের সময় খুব কমসংখ্যাক চিকিৎসকই চিকিৎসকই ভারতে গিয়েছিলেন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ৪র্থ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রদের পর্যন্ত কাজে নিয়োগ করা হয়। তারা চিকিৎসা ক্যাম্প এবং সাব-সেক্টরের দায়িত্বও গ্রহণ করে। ভারতের সামরিক হাসপাতালগুলোতে আমাদের আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করানোর জন্যও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংগে একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

 এ রকম আরো অনেক সমস্যার কথা এবং সেগুলোর সমাধানের উপায় নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়। সেক্টরগুলোতে কতগুলো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য এবং যন্ত্রপাতি একেবারেই ছিলো না। এ ব্যাপারে আমাদের চাহিদা ঠিক সময়ে পূরণ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে আমরা কখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছুই পাইনি কিংবা ঠিক সময়েও পাইনি। হয়তো এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণও থাকতে পারে। বর্ষার সময়ে আমাদের অধিকাংশ সৈনিকের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আচ্ছাদন নির্মাণের কথা ছিলো, কিন্তু কোন সময়েই এ আচ্ছাদনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি। তাঁবুর সাজসরঞ্জাম ও চাহিদা অনুযায়ী কখনো পাইনি। শীতে কম্বলের সংখ্যা ছিলো অল্প, গরম কাপড় তারও কম। আমাদের সৈনিকরা অধিকাংশ যুদ্ধই করেছে খালি পায়ে। জংগলে চলাচলের বুট ছিলো মাত্র কয়েক জোড়া। আমরা বিপুলসংখ্যক প্লাস্টিকের স্যাণ্ডেল পেয়েছিলাম। ওগুলো ছিলো বাথরুমের জন্য উপযুক্ত, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নয়।

 প্রতিটি সেক্টরের সামরিক অভিযানের ক্ষমতা এবং কি পরিমাণ সৈন্য আমাদের আছে সেসব নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। কমাণ্ডো ধরনের হামলার জন্য তখনো আমরা নিয়মিত সৈন্যদের পুরা পুনর্গঠন করতে কিংবা ট্রেনিং দিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশের খুব ভেতরে প্রবেশ করার পরিকল্পনা আমরা কিছুদিনের জন্য বাদ দিয়ে তখনকার মতো সমগ্র সীমান্ত এলাকা বরাবর শত্রুর ওপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নেই। গেরিলা তৎপরতার ওপরেই সবচাইতে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে বিপুলসংখ্যক লোককে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হয়। স্থানীয়ভাবে আমরা স্বল্পসংখ্যক ফ্রিডম ফাইটারকে প্রধানতঃ বিএস এফ-এর সহযোগিতায় ট্রেনিং দেই। যুদ্ধে আমাদের লোকবলের চাহিদা পূরণের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতিমাসে কয়েক হাজার ফ্রিডম ফাইটারকে ট্রেনিং দেওয়ার একটি ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়। আমরা আশা করেছিলাম এর দ্বারা কয়েক মাসের মধ্যে আমরা পর্যাপ্তসংখ্যক গেরিলাকে গড়ে তুলতে পারবো এবং এদেরকে দিয়ে পাকবাহিনীকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত রাখা যাবে। ইত্যবসরে সরাসরি অভিযান পরিচালানার জন্যে নিয়মিত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্গঠন কাজ পূর্ণোদ্যমে চলবে। ফ্রিডম ফাইটারদের ওপর যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি ধ্বংসের দায়িত্ব থাকবে। প্রয়োজনে তারা শত্রুদলকে অ্যামবুশ করবে এবং সশস্ত্র ঘাঁটি, জ্বালানি ও অস্ত্রপাতি মজুতের স্থান কিংবা অন্যান্য সরবরাহ কেন্দ্রের ওপর হামলা চালাবে। এরপর নিয়মিত বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানে শত্রুপক্ষকে সহজেই কাবু করা যাবে।

 এইভাবে আমরা চূড়ান্ত রণকৌশল নির্ধারণ করি। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়, কে কখন সেই সর্বাত্মক অভিযান চালাবে।

 তখনকার মতো যুদ্ধের জন্য সর্বাধিকসংখ্যাক লোককে ট্রেনিং দেয়ার ব্যাপারেই আমরা বেশী আগ্রহী ছিলাম। ট্রেনিং কর্মসূচীর মেয়াদ ছিলো দুই থেকে তিন সপ্তাহের। এই সময়ের মধ্যে তারা রাইফেল, লাইট মেশিনগান, হ্যাণ্ড গ্রেনেড, বিস্ফোরক প্রভৃতি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখতো। এছাড়া অ্যামবুশের কায়দা-কানুন এবং রণাঙ্গনের বিভিন্ন কৌশল কিছু শেখানো হতো। আমাদের সব প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিলো গুণগত নয়, পরিমাণগত নয়, পরিমাণগত দিক দিয়ে কি করে আরো বেশী লোক গড়ে তোলা যায়। প্রয়োজনীয় সকল প্রকার দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ এবং ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদেরকে পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হতো। এ ব্যাপারে আমাদের সংগে সব সময় যোগাযোগ রাখার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার তাদের কয়েকজন সিনিয়র সামরিক অফিসারকে নিয়োগ করেন। ব্রিগেডিয়ার র‍্যাংকের এইসব অফিসার ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমাণ্ডের সামরিক এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতেন। তাদের নিযুক্তি ছিলো ভারতীয় সেক্টর কমাণ্ডার হিসাবে। ভারতের একজন সেক্টর কমাণ্ডার বাংলাদেশের দুই অথবা তিনটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানতঃ ভারতীয় সেক্টর কমাণ্ডারদের মাধ্যমেই বআংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার এবং ইস্টার্ন কমাণ্ডের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। যুদ্ধের যাবতীয় নীতিমালা আমাদের হেডকোয়ার্টার এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমাণ্ড যৌথভাবে প্রণয়ন করতেন। এই সকল নীতি কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হতো ভারতীয় এবং বাংলাদেশ সেক্টর কমাণ্ডারদের হাতে। অনেক সময় পরস্পরবিরোধী একাধিক নির্দেশও আসতো। তখন আমরা পড়তাম বিপাকে, কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো।

 ১৫ই জুলাই আমরা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এই বৈঠকে মিলিত হই। এ অনুষ্ঠানে অবশ্য কোন মত বিনিময় কিংবা বিভিন্ন সেক্টরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন আলোচনা হয়নি। সে রাতে সেটি ছিলো শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করি।

 কলকাতা ত্যাগের পূর্বেই জানতে পারলাম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন বাঙালী সামরিক অফিসার পালিয়ে আসতে পেরেছেন। এইসব অফিসারের কাছেই জানা গেলো যে, অন্যান্য বাঙালী অফিসারও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে পালানোর চেস্টা করছেন। কিন্তু এই পালানো চেষ্টা, অর্থাৎ পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসা এবং তারপর যুদ্ধে যোগ দেয়া খুবই বিপজ্জনক ছিলো- বিশেষ করে পাকিস্তানে যারা পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন তাদের জন্যে তো বটেই। পাকিস্তান থেকে আমাদের অফিসাররা চলে আসছেন এ খবরে আমরা খুবই খুশী হয়েছিলাম। আবার অন্য কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিলো। আমাদের যুব শিবির থেকেও ও সময় কিছু লোক পালিয়ে যায়। হয়তো যুব শিবিরের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিংবা ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা এ কাজ করেছিলো। তবে এদের সংখ্যা ছিলো নগণ্য। এই ঘটনা তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সমস্যারও সৃষ্টি করেনি।

 যুব শিবিরে কিছু লোকের মধ্যে হতাশ ছিলো এ কথা সত্য। জুলাইয়ের শেষ দিকে মেজর খালেদ মোশাররফ এবং আমি আগরতলার কাছে এই ধরনের একটি শিবির দেখতে যাই। সেখানে তিন হাজার যুবক দু'মাসেরও বেশী সময় ধরে ট্রেনিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো। স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাবস্থা ছিলো খুবই দুঃখজনক। খাদ্য ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই চললেই চলে। অন্যান্য যুব শিবিরেরও একই হাল। লক্ষ্যহীন সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি লোকের পক্ষে হতাশ হয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। যুব শিবিরের সংখ্যা পরের দিকে প্রায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও এতো বিপুলসংখ্যক যুবকের জন্য সকল ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা দুরূহ হয়ে পড়েছিলো।

 আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না- শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী খুব কম লোকের মধ্যেই ট্রেনিং গ্রহণের কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যেতো। যুদ্ধকালে এক লাখেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেয়। কিন্তু এর মধ্যে শতকরা এক ভাগও শরণার্থী শিবিরের লোক ছিলো না। এর কারণ সম্ভবতঃ যুব শিবিরগুলোতে যারা এসেছিলো তারা তাদের পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে ফেলে এসেছিল, তাই ট্রেনিংয়ের পরই তারা বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ছিলো উদগ্রীব। তাদের স্বদেশ ত্যাগের একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিলো সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করা। অন্যদিকে বাড়িঘর থেকে পলিয়ে যুব শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো তারা পরিবার-পরিজন সহই সেখানে থাকতো। জীবন বাঁচানোর জন্য অন্ততঃ দু'বেলা দু'মুঠো আহার জুটবে এই নিশ্চয়তাও শিবিরে তাদের ছিলো। বাংলাদেশে তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করার মতো খুব বেশী কেউ ছিলো না। শিবিরে তাদের জীবনের ভয়ও কম ছিলো। এসব কারণেই অন্ততঃ সেই মুহূর্তে দেশে ফেরার তেমন আগ্রহ তাদের ছিলো না। তাদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা কারা করছে, কিভাবে করছে, এ নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যাথা ছিলো না। মনে মনে তারা চাইতো কষ্টের কাজটুকু অন্যে করুক, তারা একদিন ধীরেসুস্থে ফিরতে পারলেই হলো। শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে এবং নিছক ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিলো তাদের মধ্যে এই মনেবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। যুদ্ধে তাদের বিশেষ কোন আবদার ছিল না, কিছু থাকলে তা ছিলো পরিসিস্থিতিসাপেক্ষ, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়। এদিকে শত ভয়-ভীতি এবং দারুণ বিপদের মধ্যেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী দেশেই থেকে গিয়েছিলো, স্বাধীনতার জন্য তাদেরকেই দিতে হয়েছে সবচাইতে বেশী মূল্য।

যুদ্ধের পরিবর্তিত গতি

 জুন মাসের শেষদিকে বাংলাদেশের স্বধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। এই সময়ে প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতি এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ বাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হয়। বস্তুতঃ জুনের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও বিভিন্ন সেক্টরের তৎপরতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে জুলাই মাসে আমরা এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলাম। এই সম্মেলনের কথা আগেই বলেছি। ১৫ই মে পর্যন্ত আরা যা কিছু সাহায্য পেয়েছিলাম তার ব্যাবস্থা করেছিলো ভারতীয় বিএসএফ। যাহোক, সময়ের বিবর্তনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দু'টি নতুন ডিভিশনকে বাংলাদেশে এনে মোতায়েন করারপর পুরো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই কারণে সবকিছুতে ভিন্নতর সমন্বয়, প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি এবং ব্যাপক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এই প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য বিএসএফ-এর ছিলো না। তাই ১৯৭১-এর ১৬ই মে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিএসএফ-এর কাছ থেকে বাংলাদেশের অস্বাভাবিক ঘটনাবলী মোকাবিলার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

 লক্ষ্য করার বিষয় যে, বিভিন্ন পাকিস্তনী ডিভিশনের আক্রমণকারী দলগুলো ২৫শে মার্চ রাতে আকস্মিক সশস্ত্র আক্রমণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্নস্থানে অবস্থান গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করে। চলাচলের কাজ বিমানযোগে সম্পন্ন করা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব বিবেচনা করে (১২০০ মাইল ভারতীয় এলাকা) এবং ভারতের ওপর দিয়ে সকল প্রকার পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের পুরো দুটি আর্মি ডিভিশনকে পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তর করতে অন্ততঃ এক মাসের কম সময় লাগার কথা নয়। এই হিসাবে দেখা যায় যে, এক মাস আগে অর্থাৎ ৭১-এর ২৮শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু না করলে দুই ডিভিশন পাকসেনা ২৮শে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে আসতে পারতো না। বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব আর্মি ডিভিশন এখানে এনে মোতায়ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। সবকিছুর তোড়জোড় শুরু হয়েছিলো ২৮শে ফেব্রুয়ারীর আগেই। তা হলে দেখা যায়, ভুট্টো ১৬ই ফেব্রুয়ারী যে হুমকি দিয়েছিলেন তার সাথে এই ষড়যন্ত্রের নিশ্চয়ই একটা যোগসাজশ ছিলো। ভুট্টো বলেছিলেনঃ”কেউ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা যেতে চাইলে তাকে নিজ দায়িত্বেই যেতে হবে, তা তিনি খাকী পোশাকে অথবা সাদা কালো যে পোশাকেই যান না কেন।” রাওয়ালপিণ্ডির আর্মি হেডকোয়ার্টারে ২২শে ফেব্রুয়ারী যে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন হয়, সম্ভবত সেখানেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে।

 ৯ম ডিভিশনের ৩১৩ ব্রিগেডকে বিমানযোগে সিলেট পাঠানো হয়। ১১৭ ব্রিগেড যায় কুমিল্লায়। ১৪ ডিভিশনের অধীনে কুমিল্লায় যে ৫৩ ব্রিগেড অবস্থান করছিলো ইতিমধ্যেই তাকে চট্টগ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ৯ম ডিভিশনের বাংলাদেশে আসার পরই মেঘনার পূর্বদিকের সমগ্র এলাকা অর্থাৎ সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে ৫৩ ব্রিগেড চট্টগ্রাম, ১১৭ ব্রিগেড কুমিল্লায় এবং ৩১৩ ব্রিগেড সিলেটে অবস্থান গ্রহণ করে। আগে থেকেই পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন ১৪ ডিভিশনের ওপর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, প্রভৃতি জেলার দায়িত্ব ছিলো। ৫৩ ব্রিগেডকে ৯ম ডিভিশনের অধীনে এবং ৯ম ডিভিশনের ২৭ ব্রিগেডকে ১৪শ ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৪শ ডিভিশনের ৫৭ ব্রিগেড ঢাকায় অবস্থান করছিলো। এই ডিভিশনের অপর ব্রিগেডটি ছিলো উত্তরবঙ্গে।

 পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ১৬শ ডিভিশন চলে আসার পর উত্তর বঙ্গের দায়িত্ব এই ডিভিশন গ্রহন করে। জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়া ছাড়াও এই সকল বাহিনীর সার্বিক কমাণ্ডের দায়িত্বও গ্রহন করেছিলেন। ১১ই এপ্রিল লেঃ জেনারেল এ, এ, কে, নিয়াজী ইস্টার্ন কমাণ্ডের কমাণ্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর জেনারেল টিক্কা খান তাঁর এই বাড়তি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর তিনি শুধু গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে কাজ করেন। পাকিস্তানীদের উল্লিখিত সেনাবাহিনী ছাড়াও পরে আরো দুটি ডিভিশন গড়ে তোলা হয়। এই দুটি পাক ডিভিশনের জন্য বাংলাদেশ বাহিনী এবং এমনকি ভারতীয় বাহিনীতেও পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। বাংলাদেশ বাহিনীর পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সকল সেক্টরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানও অব্যাহত থাকে। আমাদের আক্রমণাত্মক তৎপরতা অক্ষুণ্ণ রাখা এবং লড়াইয়ের উদ্যমকে সমুন্নত রাখাই ছিলো এর উদ্দেশ্য।

অপারেশন জ্যাকপট

 ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৬ই মে বিএসএফের নিকট থেকে বাংলাদেশে সামরিক তৎপরতা চালাবার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এক সপ্তাহ পরে ২৩শে মে তারিখে ভাগিরথী নদীর তীরে একটা গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। এই ক্যাম্পের অবস্থান ছিলো পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে। এর সাংকেতিক নাম দেয়া হল ক্যাম্প 'সি ২পি'। ক্যাম্পের জন্য লোক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর অফিসাররা বিভিন্ন যুব শিবির সফরে বেরিয়ে পড়েন। আমার ক্যাম্পে আগত নৌ-বাহিনীর অফিসার বললেন, 'আমি কয়েকজন নিপুণ সাঁতারু বাছাই করতে চাই, তাদেরকে তরুণ এবং ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে।' জুন মাসের মধ্যে ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের প্রথম দলটি বাছাই করে 'সি ২পি' ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এরা কঠোর এবং শ্রমসাধ্য ট্রেনিং সমাপ্ত করে। পুরো ব্যাপারটাই ছিলো ভারতীয় নৌ-বাহিনীর দায়িত্বে।

 বাংলাদেশে নৌ-পথে সৈন্য এবং অন্যান্য সমর সরঞ্জাম পরিবহনের ব্যবস্থা বানচাল করার উদ্দেশ্যে জাহাজ এবং নৌ-যানগুলো ধ্বংস করাই ছিলো এই উদ্যোগের লক্ষ্য। অল্প খরচে দ্রুত এই লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক দরকার ছিলো- যাদেরকে সাঁতারের এবং ‘লিমপেট মাইনসহ বিভিন্ন প্রকার বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়া যেতে পারে। এ কাজের জন্য উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকদের নিয়ে একটা বিশেষ কর্মসূচী গ্রহন করা হয় এ বিষয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী প্রণীত হয় নৌ-বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। পরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রাম ও মঙ্গলার সামুদ্রিক বন্দর, চাঁদপুর, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, নগরবাড়ী, খুলনা, বরিশাল, গোয়ালন্দ ফুলছড়িঘাট এবং আরিচা ঘাটের নদীবন্দরগুলোর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অভিযানের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় অপারেশন জ্যাকপট'। অপারেশন কার্যকরী করার চূড়ান্ত দায়িত্ব দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমাণ্ডারদের উপর।

 ২৮শে জুলাই আমি ডেলটা সেক্টরের কমাণ্ডিং অফিসার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবে সিং-এর সাথে বসে চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরী করেছিলেন। চার ঘণ্টারও বেশী সময় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করি এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও কর্ণফুলী নদীর ম্যাপ ও চার্ট পর্যালোচনা করি। চন্দ্রতিথি, আবহাওয়ার অবস্থা, জোয়ার-ভাটার সময় বাতাসের গতি-প্রকৃতি, স্রোতের গতি এবং আরো অসংখ্য তথ্য আমাদের আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করে। মে মাস থেকেই বন্দরের তৎপরতা সম্পর্কে খোজখবর নিচ্ছিলাম। আমরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বন্দর এলাকা সম্পর্কে একটা পরিস্কার চিত্রও পেয়ে যাই। অপারেশনে আমাদের নৌ- মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় কি ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতে পারে তাও আমরা বিশদভাবে পর্যালোচনা করি। বন্দরের জন্য পাক-বাহিনী কি ধরনের রক্ষাব্যবস্থা গ্রহন করেছে এবং সন্ত্রাসীরা কোথায় কিভাবে পাহারার ব্যবস্থা করেছে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। সে সময়ে রাতের বেলায় নদীমুখে সকল প্রকার নৌ- চলাচল নিষিদ্ধ ছিলো। প্রধান কয়েকটি গানবোট নিয়মিত টহল কার্যে নিযুক্ত ছিলো। আমাদের পরিকল্পনা গোপন রাখতে পারলে এসব বাধা তেমন কোন সমস্যাই নয়। ঠিক হলো পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ১৪ই আগস্টের ৬০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত তরুণকে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হবে। রাতে তারা সাঁতার কেটে কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে যত বেশীসংখ্যক জাহাজে গিয়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেবে। তারপর তারা ভাটার টানে দূরে সরে যাবে।

 ১০ই আগস্ট ‘অপারেশন জ্যাকপট' শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বাছাইকৃত ৬০ জন তরুণকে তিন ভাগে ভাগ করি। ১ এবং ২ নম্বর গ্রুপ স্থলপথে মিরেশ্বরাই, সীতাকুণ্ড এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলীর পূর্বপাড় চরলাক্ষার সর্বশেষ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছবে। ৩ নম্বর গ্রুপ চরলাক্ষায় উপনীত হবে নৌকাযোগে। তিনটি গ্রুপেরই সার্বিক কমাণ্ডে থাকবেন একজন কমাগুর। তাদের সকলের কাছে থাকবে লিমপেট মাইন, এক জোড়া ‘ফিন’ (সাঁতারের সময় পায়ে লাগানোর জন্য) এবং শুকনো খাবার। প্রতি তিনজনের কাছে একটি করে স্টেনগান থাকবে। সার্বিক দায়িত্বে নিযুক্ত গ্রুপ কমাণ্ডারকে আরো দেয়া হয় হালকা ধরনের অথচ শক্তিশালী একটি ট্রানজিস্টার সেট। তার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে, অল ইণ্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের প্রতিটি সঙ্গীতানুষ্ঠান তাকে শুনতে হবে খুব মন দিয়ে। এতে ব্যর্থ হলেই সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

 ৯ই আগস্ট হরিণা ক্যাম্পে তাদেরকে চূড়ান্ত নির্দেশ দেই। পথপ্রদর্শক এবং কুলীসহ তাদের সকলকে বলে দেয়া হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কখন কিভাবে অগ্রসর হতে হবে, পথে কোথায় কোথায় থামবে ইত্যাদি। প্রতিটি এলাকায় আমাদের বিশ্বস্ত গেরিলা বেস কমাণ্ডারের ঠিকানা দিয়ে দেয়া হয়, এরা তরুণদের খাদ্য ও আশ্রয় দেবে এবং চরলাক্ষার পথে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। ১৩ই আগস্ট ১ নম্বর এবং ২ নম্বর গ্রুপ চরলাক্ষার পূর্ববর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়। জায়গাটি চট্টগ্রাম শহরের কাছেই। পথে অবশিষ্ট অংশটুকু এদের জন্য খুবই মারাত্মক, কারণ তাদেরকে শহরের ভেতর দিয়ে গিয়ে নৌকায় নদী পার হতে হবে। তারপরই তাদের শেষ ঘাঁটি চরলাক্ষা।

 এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনত দিবসে দখলদার বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনী সাংঘাতিক আক্রমণ চালাবে। এ কারণে শত্রুরা ছিলো পুরো সতর্ক অবস্থায়। সারারাত ধরে কারফিউ চলতো। লোকজনকে তল্লাশীর জন্য পথের মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছিলো অসংখ্য চেকপোস্ট। মেশিনগান ফিট করা আর্মি জীপগুলো সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিলো। নতুন করে আবার বাড়ি বাড়ি তল্লাশী শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও দিয়েও অভিযান চালানো হয়। পথচারী সবাইকে কঠিন তল্লাশী করা হয়। এতসব তল্লাশী ফাঁকি দিয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে পার হতে হবে ১ নম্বর এবং ২ নম্বর গ্রুপকে। তারপর আছে নদী পার হবার সময় আর এক তল্লাশীর ঝামেলা। সেটা পার হলো আশা আছে সময়মত এই দুই গ্রুপ চরলাক্ষায় পৌছে যাবে। কিন্তু কোন কারণে যদি দলের একজনও ধরা পড়ে তাহলে সমস্ত অভিযান বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা। তাই এই হামলাকারী দলের নেতা নিজেও আমাদের মতই চিন্তিত ছিলো।

 আরো একটি কারণে এই দলের নেতা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নৌকায় করে ৩ নম্বর গ্রুপটির ১৩ তারিখে ঘাঁটিতে পৌছার কথা ছিলো, তারা সে ঘাঁটিতে পৌঁছেতে সক্ষম হয়নি। এদিকে ১৩ই আগস্ট কলকাতা রেডিওর সংগীতানুষ্ঠান শোনার জন্য ট্রানজিস্টার খুলতেই তার কানে ভেসে এলো পুরোনো দিনের বাংলা গান “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি”। এই গানের ভেতর দিয়ে সে এবং তার দল প্রথম সংকেত লাভ করে। কমাণ্ডর জানে, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি গান সে শুনতে পাবে। ওটি শোনার পরই সে ট্রানজিস্টার ফেলে দিতে পারবে। 'অপারেশন ক্যাকপট' সফল না হওয়া পর্যন্ত তাদের আর কোন গান শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রেডিও শুনতে হবে না।

 নগরীতে মোতায়েন আমাদের লোকেরা চমৎকারভাবে দায়িত্ব পারল করেছিলো। তারা মিশনের নৌ- মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে একেবারে চরলাক্ষায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়। রাস্তায় একটি এ্যাম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পিকআপ ভ্যান দেখতে পেলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের মনে তেমন সন্দেহ জাগেনি। শুধু তাই নয়, পাক-বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে গেঁয়ো পোশাক পরা একদল লোক ফলমূল, মাছ, চাউল এবং লবণের ঝুড়ি নিয়ে ফেরী নৌকায় উঠলো এবং চালক যখন নিশ্চিত মনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে কর্ণফুলীতে পারি জমালো তখনো পাকিস্তানীরা কিছু বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবেছিলো বাজার সেরে বাড়ি ফিরছে। এই সব হাটুরে সওদার জন্য আগেই তাদেরকে টাকা-পয়সা দেওয়া হয়েছিলো। প্রতিটি ঝুড়ির একেবারে তলায় চটের থলেতে ছিলো লিমপেট মাইন, 'ফিন' ইত্যাদি। আবার কোনটায় ছিলো স্টেনগান।

 ১৪ই আগস্ট রেডিওতে দ্বিতীয় বাংলা গানটি শোনা গেলঃ “আমি তোমায় যতো শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাইনি কোন দান”। আসলে এটা ছিলো সাংকেতিক নির্দেশ। যার ফলে সেই রাতেই নৌ- মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানী জাহাজসমূহে আঘাত করার কথা।

 কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই দলের অভিযান একদিন পিছিয়ে গেলো। ৩ নম্বর গ্রুপ ছাড়া সকলেই রাতের মধ্যে চরলাক্ষায় পৌঁছে গিয়েছিলো। ৩ নম্বর গ্রুপের যোদ্ধারা প্রায় ৮০ মাইল হেঁটে আসার পর ১৪ই আগস্ট একটি দিন তাদের বিশ্রাম দরকার। দিনের আলোতে কিছুটা ' রেকি করাও দরকার। লক্ষ্যবস্তুগুলো প্রতিটি সদস্যের দেখা উচিত। যেখান দিয়ে তারা পানিতে নামবে এবং কাজ শেষ করে যেখানে তাদের উঠতে হবে সেসব জায়গাও আগে থাকতে দেখে রাখতে হবে। তাই একেবারে তাড়াতাড়ি করলেও পরবর্তী রাতের আগে কিছু আর হচ্ছে না।

 ১৪ই আগস্ট এখানে কিছু না ঘটলেও শত্রুপক্ষের জন্য সময়টি খুব একটা স্বস্তির ছিলো না। সারা রাত্রি সমগ্র সীমান্ত এলাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের যোদ্ধারা অসংখ্য আক্রমণ চালায়। আমাদের হতাশাগ্রস্ত জনগণও চাইছিলেন তাদের ছেলেরা ১৪ই আগস্ট কিছু একটা করুক। এমন একটা কিছু করুক যাতে পাকিস্তানীদের উচিত শিক্ষা হতে পারে।

 ১৫ই আগস্ট চরলাক্ষায় আমাদের ৪০ জন তরুণ-যাদের অধিকাংশেরই বয়স বিশের কোটা পার হয়নি- তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে স্বল্পক্ষণের একটু ঘুম দেয়।

 রাত ১টা। বন্দরনগরী পুরো নিদ্রামগ্ন। শান্ত নদীতে শুধু স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি। নিঃশব্দে ওরা নদীর পাড়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়। অপর পাড়ের জেটিগুলো তখন বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল। সার্চলাইট ফেলে নদীর ওপর লক্ষ্য রাখছে সান্ত্রীরা। ওরা ক্লান্ত। হয়তো ঘুমে ঢুলুঢুলু।

 ১৪ই আগস্ট এবং তার পূববর্তী কয়েকদিন পাকিস্তানীদের ওপর দিয়ে বেশ বড় রকমের ধকল গেছে। এ-রাতে তাদের সকলেই যেন একটু নিশ্চিন্ত। পাকা প্লাটফরম-এর ওপর লম্বা লম্বা ক্রেনের ছায়াগুলোকে কেমন ভৌতিক মনে হয়। তবে সান্ত্রীরা এ ছায়া চেনে। নদীর দিক থেকে তাদের কোন ভয়ের আশংকা নেই। কোন নৌকা কিংবা সাম্পান জাহাজের দিকে অগ্রসর হতে চাইলেই পরিস্কার দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে দূরপাল্লার অস্ত্রের কয়েকটি রাউণ্ডই যথেষ্ট। কিন্তু তেমন কখনো ঘটেনি।

 এমভি আল-আববাস এসেছে ৯ই আগস্ট। ১২ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা এই জাহাজ ১০,৪১০ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে।

 একখানি বার্জে (ওরিয়েণ্ট বার্জ নম্বর ৬) ২৭৬ টন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই করে মৎস্য বন্দরের জেটির সামনে রাখা হয়েছে। এটাকে ট্রেনে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হবে।

 এমভি হরমুজ ১৪ই আগস্ট চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে ৯,৯১০ টন সমর সম্ভার। ১৩ নম্বর জেটিতে জাহাজটি ভেড়ানো।  আরো কয়েকখানি জাহাজ ও বার্জ এদিক-ওদিক রয়েছে। নেভাল জেটিতে ছিলো দু'টি গানবোট এবং একখানি বার্জ। সন্ধ্যার পরই গানবোট দুটি অজ্ঞাত স্থানে অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। আমাদের ছেলেদের কপাল খারাপ। এমন সুন্দর দুটি শিকার হাতছাড়া হলো। রাত সোয়া আটটা। আল-আববাস এবং হরমুজের মাস্টার এবং ক্রুরা গভীর নিদ্রায় অচেতন। পাহারাদার এবং মিলিটারী সান্ত্রী আধো ঘুম আধো জাগরণে ঢুলছে। রাত দুটো বাজলেই তাদের ডিউটি শেষ। আর মাত্র ৪৫ মিনিট বাকী। তারপর অন্যরা আসবে।

 মাথাটা পানির ওপরে রেখে ততক্ষণে আমাদের ছেলেরা যার যার লক্ষবস্তুর কাছে পৌঁছে গেছে। কালবিলম্ব না করে তারা জাহাজগুলোর গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে গিয়েই আবার তেমনি নিঃশব্দে নদীর ভাটিতে ভেসে যায়। আরো দক্ষিনে সরে গিয়ে তারা পূর্ব তীরে উঠে পড়ে। রাত পোহাতে তখনো অনেক বাকী। নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার পর্যাপ্ত সময় তারা পেয়ে যায়। সকাল নাগাদ তারা পটিয়া এবং সেখানে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে ১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।

 রাত ১টা ৪০ মিনিট। হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেঁপে ওঠে। লোকজন শয্যা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। শিশুরা ভয়ে কান্না শুরু করে। কিন্তু কি ঘটছে কেউ তা বলতে পারে না।

 ১টা ৪৫ মিনিট। আরেকটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম। একটির পর একটি বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম তখন থর থর করে কাঁপছে। আতংক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সান্ত্রীরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলি ছুড়তে শুরু করে। ৬ নম্বর ওরিয়েণ্ট বার্জ দেখতে না দেখতে তলিয়ে গেল। আল-আববাস এবং হরমুজও দ্রুত ডুবতে থাকে। জাহাজের খোলে প্রচণ্ড বেগে তখন পানি ঢুকছে। আশেপাশের জাহাজ ও বার্জগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। বিস্ফোরণে জাহাজের ক্রুদেরও অনেকে হতাহত হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ সাহায্যের জন্য ওদিকে অগ্রসর হচ্ছে না, পাছে আবার বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়।

 সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই সিনিয়র অফিসাররা দ্রুত বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। সমগ্র এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করা হলো। মুক্তিবাহিনীর খোঁজে হেলিকপ্টারগুলো তখন আকাশে উঠে গেছে। পাকিস্তানীরা তাদের জিঘাংসা মেটাতে নদীর পূর্ব পাড়ের জনপদগুলোর উপর নির্বিচারে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিরপরাধ গ্রামবাসী এবং জেলেদের ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর খবর বের করার বহু চেষ্টা হয়। শেষে কিছু না পেয়ে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। নিরপরাধ নিরস্ত্র গ্রামবাসী আর জেলেদের রক্তাক্ত লাশগুলো স্রোতের টানে ভেসে চলে সমুদ্রের দিকে।

 পটিয়াতে আমাদের যোদ্ধারা তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলো। তারা একটি অতি বিপজ্জনক ও জটিল 'মিশন' সফল করেছে। তাদের এ সফল অভিযান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

 ভোর তখন পাঁচটা। ঢাকাস্থ ইস্টার্ন কমাণ্ড হেডকোয়ার্টারের অপারেশন রুমে কর্তব্যরত স্টাফ অফিসার ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ না করেই সত্বর ঘটনা সম্পর্কে 'কোর' কমাণ্ডারকে অবিহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। গেরিলাদের চাঁদপুর এবং মঙ্গলা বন্দরের হামলার খবরও কুমিল্লা এবং যশোর সেনানিবাস থেকে তড়িৎগতিতে হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়। এই সকল আক্রমণে একদিকে যেমন শত্রুর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়, অপরদিকে পাকিস্তানীদের মিথ্যা দম্ভ আর অহমিক হয় ধূলিসাৎ। অপারেশন জ্যাকপট সফল হয় পুরোপুরিভাবে।

 এদিনের ঘটনা সম্পর্কে ১৬ই আগস্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্ট লেখা হয়েছিলো; “পরিস্থিতি পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের ব্যাপারে জাহাজের কোন ব্যক্তিকেই দায়ী করা চলে না। কারণ পূর্ব থেকে কিছুই টের পাওয়া যায়নি এবং গেরিলারা যে এমন ধরনের অভিযান চালাতে পারে বা চালাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অবশ্য নদীর দিকটা ভাল করে দেখাশোনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দিনরাত্রির কোন সময়েই কোন নৌকা ইত্যাদিকে আর জাহাজগুলোর ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়া হচ্ছে না।” (পাক সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত)।

 সামুদ্রিক ও নদীবন্দরগুলোর উপর এই চমকপ্রদ সফল হামলা পাকিস্তানীদের হকচকিত করে দিয়েছিলো। এমন একটা দুঃসাহসী অভিযান মুক্তিযোদ্ধারা চালাতে পারে এটা ছিলো পাকিস্তানীদের চিন্তারও বাইরে। এই হামলার আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধের পদ্ধতি সম্পর্কে পাকিস্তনীরা মোটামুটি পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। সারা দেশ জুড়ে এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা অসংখ্য ছোট ছোট হামলা চালায়। কিন্তু জুন-জুলাই মাসের এইসব ছোট ছোট হামলাগুলি ছিলো কম তাৎপর্যপূর্ণ। হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, শত্রুর গাড়ি ধ্বংস, রাজাকার, দালাল, শান্তিবাহিনী বা আলবদর, আলশামস-এর লোকজন হত্যার মধ্যে এ সময়ের ঘটনাবলী সীমিত ছিলো। কোন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর ওপর তখনও হামলা চালানো হয়নি। শত্রুপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলো তখন পর্যন্ত অক্ষত। এমন কি নেতৃস্থানীয় বাঙালী দালালরা পর্যন্ত বেশ আয়েশের সাথে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে- মধ্যে এদের ওপর পরিকল্পনাহীন কয়েকটি হামলা হলেও তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। মাঝখান থেকে গেরিলারা ধরা পড়ে পাকিস্তানীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে।

 রণকৌশলের দিক থেকে শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহ বিভিন্ন হেডকোয়ার্টার, অফিসার মেস, অস্ত্র ও রসদ গুদাম, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী কেন্দ্র, বন্দর, রেলওয়ে-এসবের উপর আগস্ট পর্যন্ত কোন সুপরিকল্পিত 'গেরিলা' হামলা চালানো হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশ্ন মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দেশের মানুষের মনোবল কিছুটা যেন ভেঙ্গে পড়ে।

 অন্যদিকে পাক-বাহিনীর অবস্থা তখন বেশ সুবিধাজনক। যুদ্ধের প্রথমদিকে আমাদের নিয়মিত বাহিনী তাদের বেশ কিছু ক্ষতি করেছিলো। শত্রুপক্ষে হতাহতের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে মোটামুটি জানা যায়, পাঁচ থেকে ছয় হাজার শত্রুসৈন্য নিহত এবং আট থেকে দশ হাজার তখন আহত হয়েছিলো। আহতদের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ পুনরায় যুদ্ধ করার অনুপযুক্ত হয়েছিলো।

সামরিকভাবে গেরিলা তৎপরতা সন্তোষজক না হলেও ভবিষ্যতের জন্য আমরা অবশ্যই আশাবাদী ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ প্রচলিত পদ্ধতিতে দু' থেকে তিন সপ্তাহের ট্রেনিং পেত এবং ট্রেনিং শেষ করেই বাংলাদেশের অভ্যান্তরে তাদেরকে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে হতো। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবারই বয়স কম, আবেগ বেশী। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত উচ্চভিলাষী। এরা প্রত্যেকেই গ্রুপ লিডার কিংবা ঐ ধরনের কিছু একটা হতে চাইতো। এটা বুঝতে চাইতো না যে সবাই “লিডার” হলে অনুসারী কোথা থেকে আসবে। অবশ্য যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এর চাইতে বেশী কিছু আমাদের আশা করার ছিলো না।

 এমনি যখন আমাদের অবস্থা যে সময়ে অপারেশন 'জ্যাকপট'-এর সাফল্য একথা প্রমাণ করেছিলো যে, যথাযথ শিক্ষা এবং নেতৃত্ব দিতে পারলে আমাদের ছেলেরাও অবিশ্বস্য কাজ করতে পারে। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলো না। তারা বুদ্ধিমান, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে দ্রুত তা বুঝে নিতেও সক্ষম। তাদের মানসিক উৎকর্ষ ছিলো নিঃসন্দেহে নিরক্ষর পাকিস্তানী সৈন্যদের চাইতে উত্তম। শিক্ষিত এক বিরাট গেরিলা বাহিনী আমরা পেয়েছিলাম, এটা আমাদের সৌভাগ্য।...

 সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং প্রদান করে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই হিসাবে '৭১- এর ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গেরিলাদের সংখ্যা অনুমান করা হয় এক লাখের ওপরে। এদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ যথাযথভাবে কাজ করলেও পাক বাহিনীর সময় পরিকল্পনায় একটা ভাঙ্গন ধরানো সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে গেরিলাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে। আর চূড়ান্ত আঘাত হানার সেটাই সুবর্ণ সুযোগ। একদিকে যেমন চলছিলো এসব পরিকল্পনা, অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে ভারত ও পাকিস্তান ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলছিলো একটা অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের দিকে।

কোণঠাসা

 সেপ্টেম্বর থেকেই ভারতে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু হয়। ডিভিশনাল এবং কোর হেডকোয়ার্টারগুলো অগ্রবর্তী স্থানসমূহে অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে। সরবরাহ ব্যবস্থা ও রণপ্রস্তুতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য লক্ষ করা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভাব্য সংঘর্ষস্থল- অভিমুখী সড়ক নির্মাণ, সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ পূর্ণ উদ্যমে শুরু করে। কতগুলো ইউনিট সীমান্তবর্তী ঘাঁটিসমূহে অবস্থান নেয়। ভূ-প্রকৃতি এবং সম্ভাব্য রণাঙ্গনের অবস্থা বিশ্লেষণসহ ব্যাপক পর্যবেক্ষণ তৎপরতা চলতে থাকে।

 এদিকে আমরা প্রতিদিন ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ফল পাচ্ছিলাম না। সকল স্তরে নেতৃত্বদানের অভাবই ছিল আমাদের প্রধান অন্তরায়। কোন স্থানেই আমদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হচ্ছিলো না এবং গেরিলা তৎপরতা আশানুরূপ জোরদার করার ক্ষেত্রেও পেছনে পড়ে যাচ্ছিলাম। এ সময়ে বাংলাদেশে নেতৃত্বেও শূণ্যতা পূরণের জন্য, বিশেষ করে গেরিলা ঘাঁটিগুলোর জন্য কিছুসংখ্যক এম-সি-এ (গণপরিষদ সদস্য) কে ট্রেনিং দেওয়ার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়। উপস্থিত এম-সি-এ দের যারা উৎসাহী এবং শারীরিক দিক থেকে সমর্থ- তাঁদেরকে গেরিলা যুদ্ধের কায়দা-কানুন, বিশেষতঃ গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বদানের বিষয়ে ট্রেনিং প্রদানই এই প্রচেষ্টর লক্ষ্য। কথা ছিল ট্রেনিংয়ের পর তারা বাংলাদেশে যার যার এলাকায় গিয়ে গেরিলা তৎপরতা পরিবচালনা করবেন। আমার সেক্টরে এম-সি-এ জনাব মোশাররফ হোসেন এবং আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহন করেন। গেরিলাদের নেতৃত্বদানের জন্য তাঁদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়েছিলো। অন্যান্য সেক্টরের কয়েকজন এম-সি-এ কে পাঠানো হয়। কিন্তু সারা দেশে এ কাজের জন্য প্রেরিত এম-সি-এ দের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। অল্প কয়েকজন এস-সি-এ ট্রেনিং গ্রহণ করেছিলেন, যুদ্ধ করতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন তার চাইতেও কম। ফলে পরিকল্পনাটি তেমন কোন কাজে আসেনি।

 সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একদিকে যখন ব্যাপকতর যুদ্ধ আসন্ন হয়ে আসছিলো তখন অন্যদিকে সামরিক আরো জোরদার করার জন্য আমাদের অর্থাৎ সেক্টর কামণ্ডারদের ওপরও চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। বলা হচ্ছিল শত্রুকে আগে ছত্রভঙ্গ করে ও দুর্বল করে রাখতে হবে। তাহলে সহজেই চূড়ান্ত অভিযান চালিয়ে তাদের পরাভূত করা সম্ভব হবে এবং এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে যথাসাধ্য স্বল্প সময়ের মধ্যে, সম্ভব হলে নভেম্বরের মধ্যেই।

 অথচ অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য দিক দিয়ে আমাদের যা সামর্থ তাতে করে এই সীমিত সময়ের মধ্যে আরদ্ধ দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমার ১ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিলো মহুরী নদীর সমগ্র পূর্বাঞ্চল, অর্থাৎ পুরো চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। এখানে শত্রুপক্ষের শক্তি ছিলো দুই ব্রিগেডের বেশী। এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত আরো দু'টি আধা-সামরিক ব্যাটালিয়ন এই অঞ্চলে শত্রুপক্ষের শক্তিবৃদ্ধি করছিলো। আমাদের পক্ষে ছিলো ইপিআর, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর লোক নিয়ে তিনটি ব্যাটালিয়ন। সমগ্র সেক্টরে অফিসার পেয়েছিলাম সেনাবাহিনীর চারজন এবং বিমান বাহিনীর দু'জন। পাক সোনাবাহিনীর পক্ষে এখানে অফিসারের সংখ্যা ছিলো অন্যূন ১৫০। ১ নম্বর সেক্টরে সাব-সেক্টর করেছিলাম পাঁচটি। এর প্রতিটির কমাণ্ডে ছিলো একজন অফিসার কিংবা একজন জেসিও। কমাণ্ড সংক্রান্ত জটিল সমস্যাবলীর ব্যাপারে এঁদের অভিজ্ঞতা ছিলো নিতান্তই সামান্য। আর আমার এলাকায় সক্রিয় যুদ্ধ চলছিলো অর্ধশতাধিক মাইলেরও অধিক সীমান্ত এলাকা জুড়ে।  সেক্টর হেডকোয়ার্টারেই সমস্যার চাপ ছিলো সবচাইতে বেশী। আমার একজন মাত্র স্টাফ অফিসারকে সকল প্রাশাসনিক এবং সরবরাহ ব্যাবস্থা দেখতে হতো। কাজের মেয়াদ ছিলো দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে সাত দিন। কাজের অসহ্য চাপে আমার স্টাফ অফিসার শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর আবার তাকে কাজ শুরু করতে হয়। এই অবস্থার কোন বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

 আমাদের সরবরাহ ঘাঁটি ছিলো আগরতলায়। তিন হাজার লোকের জন্য রেশন, জ্বালানী, তাঁবু ও অন্যান্য সরঞ্জাম, কাপড়-চোপড়, অস্ত্রশস্ত্র, ঔষধপত্র সবকিছু সেখান থেকে নিয়ে আসতে হতো। সেই একই গাড়িতে করে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পাড়ি দিয়ে এগুলো আবার বিভিন্ন সাব-সেক্টরে পৌঁছানো হতো। বৃষ্টি- বাদলের দিনে সরবরাহ ব্যাবস্থা চালু রাখতে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিলো। কোন কোন সময় গাড়ি রাস্তার বাইরে গড়িয়ে পড়লে কিংবা হাঁটু সমান কাঁদায় ঢাকা বসে গেলে সেই গাড়ি না তোলা পর্যন্ত কিংবা রসদপত্র মাথায় করে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত সেখানে একজন অফিসারকে অপেক্ষা করতে হতো।

 গেরিলা বাহিনীর প্রাশাসনিক এবং অভিযান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত দায়িত্ব ছিলো আরো কষ্টকর। বাংলাদেশের অভ্যান্তরে নিযুক্ত লাভের আশায় শত শত গেলিলা প্রতিদিন আমার হেডকোয়ার্টারে আসতো। তাদেরকে এলাকা ভিত্তিক গ্রুপে ভাগ করতে হতো, তারপর আসতো দায়িত্ব সম্পর্কে তাদেও ব্রিফিং-এর পালা। প্রতিটি গ্রুপকে ব্রিপিং করতে কম করে হলেও এক ঘণ্টা সময় লাগতো। বিশেষ কাজের জন্য ব্রিফিং-এ সময় লাগতো আরো বেশী। প্রত্যেক গ্রুপকেই অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, এবং রাহা খরচ দিতে হতো। ছেলেদের নিরাপদে ভেতরে পাঠানোর জন্য শত্রু বাহিনীর তৎপরতা ও চলাচল সংক্রান্ত সর্বশেষ খবর সংগ্রহ করতে হতো। টহলদার শত্রুসেনারা এক জায়গায় থাকতো না বলে সর্বশেষ খবরেরও পরিবর্তন ঘটতো। এদের কাছে গাইড থাকতো। তারা নিরাপদ রাস্তা ধরে নিকটবর্তী ঘাঁটিতে নিকটবর্তী ঘাঁটিতে (সাধারনতঃ সীমান্তরেখা থেকে ৮-১০ মাইলের মধ্যে) গেরিলাদের পৌঁছে দিতো। নতুন আগন্তুকদের সম্পর্কে ঘাঁটিতে আগেই খবর দেয়া থাকতো। সেখানে তাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা হতো। একই পদ্ধতিতে সেখান থেকে তাদের রওয়ানা হতে হতো পরবর্তী ঘাঁটিতে। তাদেরকে অতি সাবধানে আক্রমণ স্থলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য যানবাহনের দরকার হতো। প্রত্যেক গ্রুপ সদস্যদের নাম-ঠিকানা, তাদের পরিকল্পিত পথ, ঘাঁটি, অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদের হিসাব, কাপড়-চোপড়, রেশন, পথ খরচের টাকা-পয়সা সব কিছুর বিস্তারিত রেকর্ড রাখতে হতো। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর প্রতিটি গ্রুপের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা এবং নির্ধারিত দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও আমাদের তৎপর থাকতে হয়। গ্রুপগুলো নিরাপদে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে যাওয়ার পর আমাদের তারা সে খবর জানিয়ে দিতো। তারা কোন অভিযান চালালে কিংবা শত্রুপক্ষের কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেলে তাও আমাদের জানাতে হতো। আমাদের সেক্টরের ভিন্ন জায়গায় তিনটি গোপন অয়্যাসলেস সেট চালু ছিলো। এগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমরা নিয়মিত খবর সংগ্রহ করতাম। এছাড়া খবর সংগ্রহ করে এক বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলাম। বিভিন্ন দলের কাছ থেকে খবর নিয়ে এরা সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিতো। ফেরার পথে আবার তারা বিভিন্ন দলের গাইড হিসেবে কাজ করতে। এইভাবে তাদের আবর্তনমূলক কাজ চলতো দিনের পর দিন। চর্তুদিকে সবকিছু সবসময় চালু রাখাই ছিলো আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এর কোন একটা থামলেই বিপদের সম্ভাবনা।

 স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত সকল শ্রেণীর লোকেরই তখন সঙ্গীন অবস্থা। মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, আর্মি হেডকোয়ার্টারের নেতৃবৃন্দ, কিংবা ফ্রণ্ট লাইনে সংগ্রামরত যোদ্ধ সকলেরই অবস্থা অভিন্ন। যুদ্ধরত সৈনিক ও গেরিলাদের ওপর নির্দেশ আসতে থাকে যুদ্ধ আরো জোরদার করার। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে অনবরত আঘাত হেনে চলেছিলো। তাদের হাতে বিপুলসংখ্যক শত্রু নিহত কিংবা আহতও হয়েছে। নিজেরাও হতাহত হয়েছে। কিন্তু কোনদিন এর স্বীকৃতি কিংবা প্রশংসা তারা খুব বিশেষ পায়নি। এ কারণে স্বভাবতই তারা ছিলো ক্ষুব্ধ।

 পার্বত্য চট্টগ্রামের একেবারে উত্তর প্রান্তে ডেমাগিরিতে কয়েক শত ছেলে ট্রেনিং নেয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন জ্বরে এবং রক্ত আমাশয়েও মারা গেছে। অন্যদেরকে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনাহারে কাটাতে হয়েছে। শত মাইল দুর্গম এবং পার্বত্য অঞ্চল ও নিবিড় বনানী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য তারা এসেছিলো। কিন্তু কেউ তাদের সম্পর্কে সামান্যতম আগ্রহও প্রকাশ করেনি। তারা যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়িঘর ছেড়েছিল তার স্বীকৃতিও কারো কাছ থেকে তারা পায়নি।

 যুদ্ধে নিয়োজিত গেরিলাদের শতকরা পঞ্চাশ জনের জন্য ভারত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছিলো (পরে অবশ্য শতকরা ৯০ জনকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাবস্থা করা হয়)। বাকী ছেলেদের খালি হাতে যুদ্ধে পাঠানো কিংবা অপেক্ষা করতে বলা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর ছিলো না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ ছিলো, অস্ত্র ছাড়া কাউকে যেন গেরিলা যুদ্ধে পাঠানো না হয়। আমাদের সবচাইতে সহজ উপায় ছিলো দুই গ্রুপের অস্ত্র দিয়ে তিনটি গ্রুপকে পাঠানো। ফলে প্রতিটি গ্রুপের শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ছেলেকে সরবরাহের অপ্রতুলতার জন্য ক্যাম্পে বসিয়ে রাখতে হতো। এদের জন্য আবার রেশন পেতাম না, ফলে সমস্যা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতো। আমরা স্থানীয়ভাবে এর কিছুটা সমাধান বের করেছিলাম। সকল অফিসার, জেসিও এবং অন্যান্য র‍্যাংকের সৈনিক মিলে একটা মাসিক চাঁদার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর মাধ্যমে যা কিছু আয় হতো তা দিয়ে বাড়তি আহার যোগানোর চেষ্টা চলতো। এই ব্যবস্থা ছিলো অনিয়মিত এবং পরিস্থিতির চাপে পড়েই আমাদের এটা করতে হয়েছিলো। অথচ এর জন্যও আমাদের ভুল বোঝা হতো, আমরা হতাম সমালোচনার পাত্র। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদেও সম্পর্কে অনেক গোপন চিঠিতে লিখতেন, “বাংলাদেশের সেক্টও কমাণ্ডাররা পুরো নিয়ম মেনে চলছেন না”। এ বিষয়ে ভারতীয় অফিসারদেও এই মতামত সম্ভবত অনেকাংশে সঠিক ছিলো। তাদেও ওপর ভারতীয় আর্মি হেডকোয়ার্টারের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকতো, গেরিলাদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে সকলকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে হবে-তা সে সবাইকে অস্ত্র সরবরাহ করে কিংবা মাত্র কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেই হোক। কিন্তু আমাদের উপর বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ ছিলো সবাইকে অস্ত্র সজ্জিত না করে কোন গ্রুপকেই যেন বাংলাদেশের অভ্যান্তরে যুদ্ধে পাঠানো না হয়।

 বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টার এবং ভারতীয় আর্মি হেডকোয়ার্টারের মধ্যে সমন্বয় তখনও পুরো গড়ে ওঠেনি বলেই হয়তো আমাদের জন্যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো।

গেরিলা যোদ্ধা

 আগস্ট মাস থেকেই আমাকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র তৈল শোধানাগারটি অচল করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র দুটি ধ্বংস হলে পাকিস্তানীদের চাইতে আমাদের ক্ষতি বেশী হবে বলে মনে করে আমি দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করি। বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন এবং জ্বালানীর অভাব দেখা দিলে শত্রুদের যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়বে এবং এতে করে তাদের তৎপরতাও হ্রাস পাবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো কেন্দ্র দুটি ধ্বংস না করেও অন্যভাবে আমাদের লক্ষ্য হাসিল করা সম্ভব।

 আমরা ভাবনাকে সামনে রেখে একটি নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সঙ্গে কথা বলি। তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে ১,২ এবং ৩ নম্বর সেক্টরের কার্যক্রম ও চাহিদা সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন। আমার পরিকল্পনা ছিলোঃ

 ১। মদনঘাটে বিদ্যুৎ বিভাগের সাব-স্টেশন ধ্বংস করা।

 ২। কাপ্তাই এবং চট্টগ্রামের মধ্যে যতগুলি সম্ভব বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করতে হবে।

 আমার বিশ্বাস ছিলো, দু'টি কাজ করতে পারলেই শত্রুপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে এবং এতে ওদের বাণিজ্য ও অন্যান্য জাহাজ নোঙ্গরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে।  যথারীতি পরিল্পনাটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহীত হলে এ কাজের জন্য আমি আমার সাথে কার্যরত বিমান বাহিনীর নির্ভীক অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট সুলতানকে মনোনীত করলাম। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাকে আমি পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দিলাম এবং তার রেইডিং পার্টির সদস্যদেররক বেছে নিতে বললাম। এরপর সবাই মিলে আমরা কয়েকটি মহড়া দিলাম। ‘রেইডিং' পার্টির সদস্যদেরকে কি কাজে কোথায় পাঠানো হচ্ছে সেকথা আগে বলা হতো না। একবারে সর্বশেষ ঘাঁটিতে পৌঁছার পর যখন তারা লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানতে যাবে তখনই তাদেরকে বলা হবে, তার আগে নয়। সুলতান তাঁর দলের লোক এবং প্রযোজনীয় অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিলো। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ছাড়াও সুলতানের ওপর ঐ এলাকায় গেরিলা তৎপরতা হ্রাস পাওয়ার কারণ নির্ণয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো।

 ১১ই সেপ্টেম্বর সুলতানের সঙ্গে কয়েকজন বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং কিছুসংখ্যক নিয়মিত সৈন্যকে হরিণা থেকে এ অভিযানে পাঠানো হলো।

 ৩রা অক্টোবর তার পার্টি দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে শহর থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরেই মদনাঘাটের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে দিলো। বহুসংখ্যক বৈদ্যুতিক পাইলনও উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে কাপ্তাই থেকে সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে সুরক্ষিত মদনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চারদিকে ছিলো ইঁটের দেয়াল আর দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের বেড়া। এখানে মোতায়েন থাকতো ১০জন নিয়মিত সৈন্য এবং ২০ জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যের একটি প্লাটুন। তারা সব সময় চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলো। তার মধ্যে থেকে সুলতান তাঁর দল নিয়ে শত্রুর উপর সফলতার সাথে এই আক্রমণ সম্পন্ন করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে বন্দরের জাহাজ ধ্বংসের পর আবার দুঃসাহসী হামলায় শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারলো যে গেরিলারা ক্রমান্বয়ে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

 অভিযান শেষ করে ফ্লাইট লেফটেন্যাণ্ট সুলতান ঐ এলাকার অধিকাংশ গেরিলা গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের অসুবিধা এবং সমস্যাবলী নিয়েও আলোচনা হয়। ১১ই অক্টোবর হরিণায় ফিরে এসে সুলতান বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন।

 গেরিলারা গ্রামাঞ্চলে বেশ কার্যকর অবস্থান গড়ে তুলছিলো। বস্তুতঃ সারা দেশটাই তখন বিরাট এক গেরিলা ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিলো। ফলে যখন তখন ছেলেরা যেকোন দিকে অভিযান চালাতে পারতো। রাতগুলো ছিলো একান্তভাবেই তাদের। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাতের বেলায় পারতপক্ষে বাইরে বের হতো না।

 আমাদের পক্ষে জনগনের সমর্থন ছিলো ব্যাপক। গেরিলাদের সাহায্যে আসতে পারলে লোকজন সম্মানিত এবং গর্ব অনুভব করতো। গেরিলাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পাকিস্তানীরা বহু লোককে হত্যা করেছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে, সহায়-সম্পত্তি লুট করে সেই লুটের মালের বখরা পুরস্কার হিসাবে রাজাকার ও দালালদের দেয়া হয়েছে। এতদসত্ত্বেও জনগণের হৃদয় আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, যখন দেখেছে অল্প বয়সী তরুণেরা ভারী অস্ত্র-গোলাবারুদের ভারে ন্যুব্জ হয়েও দৃঢ়প্রত্যয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে শত্রুহননে এগিয়ে চলেছে। বাংলার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে দিনের পর দিন। দেশের ভেতরে অবস্থানকারী লোকজন যদি সেদিন এই ত্যাগ স্বীকার না করতো তাহলে অঙ্কুরেই আমাদের স্বাধীনত আন্দোলনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতো।

যুদ্ধের মুখোমুখি

 আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং যেসব সীমান্ত ফাঁড়িতে শত্রুর প্রহরা একটু কম, সেগুলো দখলের মাধ্যমেই আমাদের অভিযান শুরু হবে। প্রতিটি অভিযান শুরুর পূর্বেই ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের সহযোগিতা করবে। সীমান্তবর্তী এলাকা এবং সীমান্ত ফাঁড়ি দখল পরিকল্পনার পেছনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিলো, সেগুলো হচ্ছেঃ

 (ক) এইসব সীমান্ত ফাঁড়ি বা সীমান্ত এলাকা দখলের যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর দক্ষতা ও দুর্বলতা আমরা নিরূপন করতে পারবে।

 (খ) সকলকে বুঝিয়ে দেয়া যে, লক্ষ্য অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর। এবং আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। এতে করে শত্রুরা গেরিলাবিরোধী তৎপরতা কমিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় আরো বেশী শক্তি নিয়োগ করবে। শত্রুদের এভাবে সীমান্ত এলাকায় ব্যস্ত রাখতে পারলে দেশের অভ্যন্তর ভাগে শত্রুর সংখ্যা কমে যাবে, ফলে গেরিলাদের কাজ করা আরো সহজ হবে।

 (গ) এ ধরনের সংঘর্ষের মাধ্যমেই শত্রুর প্রস্তুতি এবং তার প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাও আমরা পরিমাপ করতে পারবো।

 সীমান্তরেখা বরাবর আমাদের তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীরা ঠিকই অভ্যান্তর ভাগের শক্তি কমিয়ে সীমান্তে এনে সৈন্য জড়ো করতে থাকে। এতে বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি গেরিলাদের অনুকূল হয়ে ওঠে। অবশ্য, এই সঙ্গে কিছুটা অসুবিধাও দেখা দেয়। সীমান্ত এলাকায় শত্রুর শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের সেই পথ দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে প্রবেশের প্রায় সকল পথই শত্রুসৈন্যরা বন্ধ করে দেয়।

 ২২শে সেপ্টেম্বর চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি এবং প্রধান সড়কের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বল্লভপুর এলাকা দখল করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালাই। আক্রমণের আগে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী লক্ষস্থলের ওপর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে শত্রুর সুদৃঢ় অবস্থানগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে।

 কিন্তু দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমরা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হই। কামানের গোলায় শত্রুর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানীদের বাংকারগুলো ছিলো খুব মজবুত। প্রতিটি প্রতিরক্ষা বাংকারেই শত্রুরা ভূগর্ভে কয়েকদিন থাকার মতো রসদপত্র মজুত করে রেখেছিলো। ঘাঁটিগুলোর মধ্যে আবার গভীর ট্রেঞ্চপথে যোগাযোগ ছিলো। তাছাড়া আমরা যা অনুমান করেছিলাম তার চাইতেও বেশী ছিলো তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সম্ভার।

 চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো ক্যাপ্টেন মাহফুজকে। ফাঁড়ির ডান পাশ দিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করে আমি ওদের অগ্রসর হবার নির্দেশ দেই। কিন্তু লক্ষ্যস্থলের চারপাশে কয়েকশ' গজ এলাকায় গা ঢাকা দেয়ার মত তেমন কোন ফসলের ক্ষেত, উঁচু ভূমি অথবা বন-জঙ্গল ছিলো না। পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড় থেকে আমি যুদ্ধ পরিচালানা করছিলাম। ফাঁড়িটি থেকে এর দূরুত্ব ছিলো আটশত গজের মত। সেখান থেকে আমি লক্ষ্যস্থলের অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম। অয়্যারলেসে মাহফুজ আমার সাথে যোগাযোগ রাখছিলো। আমাদের বাহিনীর 'কভার' দেয়ার জন্য কামানসহ ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীর একজন পর্যবেক্ষকও আমার সাথে ছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার আগে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। কামানের গোলাবর্ষণ শেষ হলে আমাদের বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় শত্রুরাও প্রচণ্ড বেগে গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফাঁড়ির হান এবং বাম উভয় পার্শ্ব থেকেই একটি করে মেশিনগান আমাদের 'কোম্পনীকে' যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে মাহফুজের একমাত্র অয়্যারলেস সেটটিও তখন বিকল হয়ে পড়ে। একটির বেশী দেবার মত মজুত কোন সেট আমাদের ছিলো না। অয়্যারলেস সেট নষ্ট হতেই মাহফুজ তার প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে এবং আমার ও মাহফুজের মধ্যকার সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই শুভপুর সেতুর দিক থেকে পাকিস্তানীদের কামানের গোলা আমাদের ওপর এসে পড়তে থাকে। এদিকে করেরহাট এলাকা থেকে আরো শত্রুসৈন্য দ্রুত চম্পকনগর এসে পৌঁছায়। কামানের গোলা, বিশেষ করে এয়ারবাস্তু শেল বিস্ফোরণের ফলে আমাদের কোম্পানীর পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। পাকিস্তানী মেশিনগানগুলোর সঠিক অবস্থান জানার জন্য আমি মাহফুজের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করি। অবস্থান জানতে পারলে ভারতীয় কামান থেকে মেশিনগানের ওপর গোলাবর্ষণ করা যেতো। আমাদের অবস্থান থেকে আমি কিংবা ভারতীয় গোলন্দাজ পর্যবেক্ষক কেউই মেশিনগানগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় আমাদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

 এই পরিস্থিতিতে কোম্পানীকে আরো এগিয়ে যেতে বলা আত্মহত্যারই সামিল ছিলো।

 বল্লভপুর এলাকাতেও আমাদের কোম্পানী কমাণ্ডারকে শুরুতেই থমকে পড়তে হয়। তার দুটি প্লাটুন লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, কিন্তু প্লাটুন কমাণ্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তার হাতে কোন অয়্যারলেস সেট ছিলো না। প্লাটুন দুটির সন্ধান লাভের জন্য সে তখন বার্তাবাহক পাঠায়। তাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো বটে, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো ফুটে উঠতেই পাকিস্তানীরা আমাদের দেখে ফেলে এবং তাদের কামানগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।

 এই দুটি আক্রমণেই একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আমরা সফল হতে পারিনি। কোম্পানী কমাণ্ডারদের যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমার কাছে অয়্যারলেস সেট ছিলো অপ্রতুল আর প্লাটুন কমাণ্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কোম্পানী কমাণ্ডারদের কোন অয়্যারলেস সেট ছিল না। নিজের প্লাটুনগুলোর সাথে সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকলে কোন কোম্পানী কমাণ্ডারের পক্ষে রাত্রে এ ধরনের আক্রমণ চালানো বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে।

 সাময়িকভাবে আমরা ব্যর্থ হলেও এ দুটো প্রচেষ্টায় আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের সেনারা যুদ্ধের জন্য উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। যথাযথভাবে পরিকল্পনা নেয়া হলে এবং যোগাযোগের সাজসরঞ্জাম ও ভারী অস্ত্রের সাহায্যে পাওয়া গেল, আমাদের বিশ্বাস, নিশ্চয়ই আমরা জয়ী হতে পারবো।

 যুদ্ধের তখন ছয় মাস চলছে। এ সময়ে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এগুলো পরোক্ষভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর নতুন প্রভাব বিস্তার করে। ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর। চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশ কোন সংকট এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে বলে অঙ্গিকার করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে ভারত আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করে। ভারতের সরকার এবং জনগণ বুঝতে পারে, বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সে ব্যাপারে এখন আর তারা একা নয়। অচিরেই এই প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রভাব ভারতে এবং বাংলাদেশে, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারত এতদিন পর্যন্ত খুব সন্তর্পণে এবং সাবধানে এগিয়ে চলছিলো। চুক্তির পর আমাদেরকে সর্বাত্মক সাহায্যের ব্যাপারে তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যায়।

 এদিকে দুই পক্ষেই যুদ্ধ পরিকল্পনা আরো ব্যাপকতর হয়ে ওঠে। গেরিলাদের মধ্যে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রতিদিনই সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ চলতে থাকে। প্রকাশ্য দিনের বেলাতেও হামলা ও অ্যামবুশ শুরু হয়ে যায়। ভারতীয় ও পাকিস্থানীদের উভয় পক্ষের কামানের গর্জনে সীমান্ত এলাকা হয়ে ওঠে চরম উত্তেজনাময়।

 এদিকে ২৮শে সেপ্টেম্বর নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে বাংলাদেশী পাইলটরা ট্রেনিং শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। প্রায় একই সময় পাকিস্তান নৌ-বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা ৪৫ জন নৌ-সেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীরও গোড়াপত্তন হয়। সেপ্টেম্বররে দুটি নৌ-যানও আমরা সংগ্রহ করি। এম-ভি পলাশ এবং এম-পি পদ্মা নামের জাহাজ দুটি ছিলো কলকাতা পোর্ট কমিশনারের। প্রায় ৩৮ লাখ টাকা খরচ করে এগুলোকে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা হয়। প্রতিটি নৌযানে দুটি করে ৪০ মিলিমিটার কামান (এল-৬০) বসানো হয়। অক্টোবরের মধ্যে দুটি জাহাজই অভিযান শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। “অপাশেন হট প্যাণ্টস” সাংকেতিক নামে শুরু হয় অভিযান, যার লক্ষ্য ছিলো খুলনা ও মঙ্গলা এলাকায় শত্রুপক্ষের নৌযানের ওপর আঘাত হানা এবং পসুর নদীর মোহনায় মাইন স্থাপন করা।

হতবুদ্ধি ইয়াহিয়া

 অক্টোবর থেকে আমরা গেরিলাদের তৎপরতা সম্পর্কে উৎসাহব্যঞ্জক খবর পেতে থাকি। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী বাইরে প্রেরণ এবং বাইরে থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসা অব্যাহত গতিতেই চলতে থাকে। বাইরের যেসব মালামাল আসতো সেগুলো আবার যথারীতি দেশের ভেতর বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাচ্ছিলো। নৌ-বাহিনীর ডুবুরীদের সাফল্যজনক তৎপরতা সত্ত্বেও নৌ-যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে আমরা বিশেষ সফলতা লাভ করতে পারিনি। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বেশ কতগুলো কারণে পাকিস্তান সরকার তার নৌ-যোগাযোগ মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে চালু রাখতে সমর্থ হয়েছিলো।

 (ক) বিদেশী শিপিং কোম্পানীগুলোকে পাকিস্তান সরকার যেকোন সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় ক্ষতিপূরণ দানের প্রস্তাব করেছিলো।

 (খ) অভ্যান্তরীণ নদীপথগুলোতে মোটামুটি ব্যাপকভাবে সশস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নৌ-যানগুলোর চলাচলের ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো।

 (গ) উপকূল এলাকা এবং সামুদ্রিক বন্দরগুলোতে গানবোটের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়।

 (ঘ) শত্রুরা নৌ-কমাণ্ডারদের কার্যপদ্ধতি জেনে যাওয়ায় তারা পর্যাপ্ত রক্ষাব্যাবস্থা গ্রহণ করে।

 পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে আমরা বেশি করে নৌ-কমাণ্ডো নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা আরো যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করি সেগুলো ছিলোঃ

 (ক) আই, ডব্লিউ, টি, এ- এর জাহাজগুলোতে ক্রু হিসেবে গোপনে নৌ-কমাণ্ডো নিয়োগ করা।

 (খ) নদীর তীর এবং সাগরের উপকূল থেকে সুবিধাজনক দূরপাল্লার হাতিয়ারের সাহায্যে নৌ- যানগুলোর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালানো। এবং

 (গ) এতদঞ্চলের আবহাওয়াগত কারণে সকাল-সন্ধ্যায় সৃষ্ট মৌসুমী কুয়াশার সুযোগ নিয়ে 'লিমপেট মাইন দ্বারা পাকিস্তানী জাহাজসমূহ ধ্বংস করা।

 ১২ই অক্টোবর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণ দেন। তিনি তাঁর ভাষায় 'জাতীয় জীবনের এই ভয়াবহ মুহূর্তে” আল্লাহ এবং ইসলামের নামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধ হতে বললেন। বিরস, গম্ভীর এবং মদালস কণ্ঠে তিনি বললেনঃ-

 (ক) পাকিস্তানের সমগ্র সীমান্ত বরাবর ভারত ব্যাপকভাবে সৈন্য সমাবেশ করেছে।

 (খ) ট্যাংক, গোলন্দাজ ইউনিট এবং বিমান বাহিনীকে পাক সীমান্তের কাছে এনে জড়ো করা হয়েছে (তাঁর জিজ্ঞাসা, এসবের অর্থ কি?')। এবং

 (গ) চট্টগ্রাম এবং মঙ্গলা বন্দরে নৌ-বাহিনীর ডুবুরীদের হামলা হয়েছে। সড়ক, রেলপথ ও সেতু ধ্বংস করা হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।  ইয়াহিয়ার এই বক্তৃতার বিশেষ কয়েকটি দিক লক্ষণীয়। সবকিছুর জন্য তিনি বরাবর ভারতকেই দোষারোপ করেছেন এবং সচেতনভাবে মুক্তিবাহিনীর কথা এড়িয়ে গেছেন।

 এতে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, তিনি যুদ্ধ করার একটা অজুহাত খুঁজছেন। এক বন্ধ উন্মাদ, যে মুক্তিবাহিনীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, ক্রোধোন্মত্ত- তাঁর কথায় সেটাই প্রমাণিত হলো। ততদিনে আমরা তাকে আরো নির্মম আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলিছি।

 জুলাই মাস থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার তেল সংরক্ষণাগারে একটা আক্রমণ চালানোর জন্য আমরা পরিকল্পনা করছিলাম। এ কাজের জন্য বিশেষভাবে বাছাই করা কয়েকটি ছেলেকে আলাদাভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু উপরোক্ত হাতিয়ার না পাওয়ায় অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। পাকিস্তানের বিমানের জন্য উচ্চ দাহ্যশক্তিসম্পন্ন জ্বালানী ভর্তি ট্যাংকগুলো ছিলো সংরক্ষণাগারটির প্রধান আকর্ষণ। ১৬ই অক্টোবর ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণ-পরিষদ সদস্য জনাব মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে বিশেষ দলকে উক্ত তেল সংরক্ষণাগারে আক্রমণ চালানোর জন্য পাঠানো হয়। আক্রমণের আগের রাতে শত্রুরা কিভাবে যেন শহরে গেরিলা দলের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। চট্টগ্রামে তারা যেখানে উঠেছিলো পাকিস্তানিদেরর সে এলাকা ঘিরে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে একটি ড্রেনের ভেতর দিয়ে আমাদের পুরো দলটি আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু তাদের অস্ত্রশস্ত্র খোয়া যায়। ফলে আক্রমণের পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

 ওদিকে ইয়াহিয়া খান ভারত আক্রমণের একটি যথাযথ অজুহাত খুঁজছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটি মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যাবে। তাঁর সমর-অধিনায়করাও সে ধরনের একটি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুরে এক জনসমাবেশ পাকিস্তানীদের হস্টার্ন কমাণ্ডের কমাণ্ডার লেঃ জেনারেল নিয়াজী ঘোষনা করলেন, উভয় ফ্রণ্টেই পরবর্তী যুদ্ধ ভারতের মাটিতেই হবে। নিয়াজীর মুখ থেকে কথাটা বোধ হয় বেফাঁস বেরিয়ে পড়েছিলো- কারণ ইয়াহিয়া খান তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে যুদ্ধের কথা বলেননি। কিন্তু না বললে কি হবে, ২০ এবং ২২শে অক্টোবর পাকিস্তানীদেররা সীমান্ত থেকে ভারতের পাঁচ মাইল অভ্যন্তরে কমলপুর গ্রামের ওপর গোলাবর্ষণ করলো। যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানী উস্কানিমূলক তৎপরতায় বহুসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং আহত হলো। একদিন পর ২৩শে অক্টোবর পাক বাহিনী পশ্চিম ফ্রণ্টের সম্ভাব্য রণাঙ্গনগুলোতে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে।

অঘোষিত যুদ্ধ শুরু

 নভেম্বর নাগাদ ভারতের তিনটি কোরের অধীনে সাতটি পদাতিক ডিভিশন যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্ত্ততি গ্রহন করে। কুম্ভীগ্রামের ঘাঁটি পুনরায় চালু করা হয় এবং ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লীটকে সক্রিয় করা হয়। যেকোন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তাদের ব্যাপক পরিকল্পনা তখন চূড়ান্ত।

 ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব ফ্রণ্টে পাকিস্তানের সকল দুস্কর্মের উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলো। এ সময়ই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বেলুনিয়া পুনর্দখল করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। একই সঙ্গে অন্যান্য সেক্টরেও অনুরূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বেলুনিয়া ৫ই নভেম্বর আক্রমণের (ডি-ডে) দিন নির্ধারিত হয়।

 কিন্তু ৪ঠা নভেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা সকলেই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার অন্যতম সাব- সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা সেদিন রাত সাড়ে ৮টায় মারা যান। বেলুনিয়া অভিযানে তিনটি কোম্পানীকে তাঁর নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা ছিলো। অকুতোভয় যোদ্ধা হিসাবে সৈন্যরা তাঁকে ভালবাসতো, প্রশংসা করতো। আমি নিজেও দেখেছি কি নির্ভীকভাবে রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এরূপ একজন অফিসারকে দেখলাম তাঁর ক্যাম্পের মধ্যে পড়ে আছেন, প্রাণহীন নিস্পন্দ। জায়গায়টি রক্তে ভেসে গেছে, মাথার খুলী ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে চারদিকে ছড়ানো। কয়েক মিনিট আগেও তিনি তাঁর সৈন্যদের সাথে কথা বলেছেন, পরের দিনের অভিযান সম্পর্কে কয়েকটি চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। যতদূর জানা যায়, বাড়ি থেকে তাঁর খুব খারাপ খবর এসেছিল। বিগত কয়েক মাস ধরে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে যুদ্ধ করছিলাম। অনিশ্চয়তা ও হতাশায় মনোবল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিছু লোকের পক্ষে। আমার সেক্টরে বাড়িঘর নিয়ে কিংবা পারিবারিক কোন বিষয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম। খুবই নিষ্ঠুর আদেশ সন্দেহ নেই, কিন্তু সৈনিকগণের ওপর ক্ষতিকর আবেগ সৃষ্টি করতে পারে এমন ধরনের কথাবার্তা থেকে বিরত রাখার জন্যেই এটা করতে হয়েছিলো। আমাদের দুর্ভাগ্য, ৪ঠা নভেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে ক্যাপ্টেন শামসুল হুদাকে তাঁর বিছানায় বসে কি যেন চিন্তা করতে দেখা যায়। সীমাহীন এক অবসাদ তাঁকে পেয়ে বসেছিলো। এক সময় আপনার অজান্তেই তিনি স্টেনগান হাতে তুলে নিয়ে নলটি নিজের চিবুকে ঠেকান। তারপর যন্ত্রচালিতের মতো ট্রিগার চালান।

 বেলুনিয়া অভিযান নিয়ে আমি তখন ভারতীয় ব্রিগেড কমাণ্ডারের সাথে আলোচনা করছিলাম। খবর পেয়ে প্রথম বিশ্বাসই করতে পারিনি। কিন্তু কঠিন বাস্তবতাকে এক সময় স্বীকার করে নিতেই হলো। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীকালই অভিযান শুরু হবে। পুরো একটা জাতির ঘোর দুর্দিনে ব্যক্তিজীবনের ট্রাজেডীগুলো আমরা শুধু মনে মনেই রাখতে পেরেছি, আর কিছু করতে পারিনি সেদিন।

 নিয়মিত পদাতিক বাহিনী এবং মিলিশিয়া নিয়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানের শক্তি ছিলো দুই ব্যাটালিয়নের মতো। এক ব্যাটালিয়ন ছিলো উত্তরের অংশ এবং বাকী অংশ ছিলো দক্ষিণ ভাগে। শক্তিশালী বাংকার তৈরী করে এবং বেশ বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মাইন পেতে তারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। এ সমস্ত অবস্থান সম্পর্কে সন্ধান না নিয়ে আক্রমণ চালালে অহেতুক লোকক্ষয় হতে পারে। কোনভাবে উত্তরের অংশের শত্রুদলকে বাকী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচ্ছিন্ন অংশে সাহায্য সহযোগিতা প্রেরণ বন্ধ করতে পারলে পাকিস্তনীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের নির্মূল করা সম্ভব হবে। আমরা তাই সিদ্ধান্ত নেই, উত্তরের এবং দক্ষিণের এই দুই অংশের মাঝামাঝি কোন স্থানে অতি সন্তর্পণে রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দে অবস্থান গ্রহণ করবো। ট্রেঞ্চ এবং বাংকার গড়ে তুলব রাতারাতি। এবং পরদিন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লেই পাকিস্তনীরা দেখতে পারবে তাদের উত্তরের অংশ দক্ষিণের বাহনী থেকে রাত্রির অন্ধকারে হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে বসে আছে তাদের যমদূত মুক্তিসেনারা।

 নভেম্বর ৪ তারিখ। অন্ধকার এবং শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ক্যাম্প ছেড়ে বেলনিয়া অভিযানে এগিয়ে চলে মুক্তিসেনাদের দল। সৈন্যদের দীর্ঘসারি যাত্রা শুরু করতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টির সাথে বাতাসের বেগও বেড়ে যায়। হাড় কাঁপানো শীতে আমাদের ঠোঁট কাঁপছিল। আমরা পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কষ্ট হলেও বস্তুত আমাদের সুবিধেও ছিলো যথেষ্ট। আবহাওয়া খারাপ দেখে সে রাতে শত্রুদের টহলদাররা আর বাইরে বেরোয়নি। তারা ধারণাও করতে পারেনি যে এই রাতটিকেই আমরা বেছে নেবো। দমকা বাতাসের গর্জনে আমাদের চলাফেরা এবং ট্রেঞ্চ খোঁড়ার আওয়াজ তলিয়ে যাচ্ছিলো। ভোর হতে না হতেই আমাদের সবগুলো কোম্পানী যার যার জায়গায় পৌঁছে প্রতিরক্ষামূলক ট্রেঞ্চে অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা তখন শীতে প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গিয়ে পরিষ্কার সূর্যালোক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

 দেরি না করে আমরা নিকটবর্তী শরণার্থী শিবির এবং গ্রাম থেকে লোক নিয়ে সাজসরঞ্জাম বহনের ব্যবস্থা করি। যানবাহন চলাচলের জন্য পাহাড় এবং ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে চার মাইল দীর্ঘ রাস্তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হয়। হাজার হাজার লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিনরাত কাজ করে চলে। তিনদিনের মাথায় রাস্তাটি যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে। আমাদের সাহায্য করার জন্য বেসামরিক লোকদের মধ্যে অভূতপূর্ব উৎসাহ লক্ষ্য করি। ফলে আমাদের মনোবল বেড়ে যায় বহুগুণ। একজন অধ্যাপক বাংকারের জন্য সি, আই, সিটের বোঝা মাথায় বহন করেছেন চার মাইল পথ অতিক্রম করে টিনগুলো যথাস্থানে নামিয়েই আবার তিনি পেছন দিকে দৌড়ে গেছেন আরেক বোঝা আনতে। ছয় বছরের একটি ছেলেকে দিয়ে কোন কাজ করানো হবে না বলাতে সে সেদিন কেঁদে ফেলেছিলো।

 আমাদের এই অবস্থান গ্রহণ করায় শত্রুর মধ্যে তেমন কোন ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। তারা হয়তো ভেবেছিলো, এটাও মুক্তিফৌজের এ্যামবুশ ধরনের কিছু একটা হবে তারা মুক্তিবাহিনীকে হটিয়ে দেয়ার জন্য একটি কোম্পানী পাঠায়। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে ২৯ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং অন্যেরা উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যায়। এমন কি তারা লাশগুলোও নিতে পারেনি ৭ই নভেম্বর দুটি স্যাবর জেট সারাদিন আমাদের অবস্থানের ওপর ট্র্যাপিং করে। এতে আমাদের টিন বহনকারী একজন বেসামরিক লোক নিহত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, শত্রুরা তেমন ব্যাপক আকারে আমাদের আক্রমণ করতে আসছিলো না। তাছাড়া, উত্তর অংশে পাকিস্তনীদের আমরা যেভাবে ঘেরে ফেলেছিলাম- সেখান থেকে তাদের মুক্ত করারও তেমন কোন চেষ্টাও করছিলো না আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম. পাকিস্তানীরা এতদিনের আক্রমণাত্মক ব্যবস্থার পরিবর্তে এখন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এ সময়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানীদের একটি অয়্যারলেস বার্তা আমরা ‘ইণ্টারসেপ্ট’ করি। সেটা ছিলো- “বেলুনিয়া থেকে নিজেরাই পালাবার ব্যবস্থা করো”।

 কয়েকজন শত্রুসেনা আমাদের ব্যূহ ভেদ করে পালাবার চেষ্টাও করেছিলো, কিন্তু তারা আমাদের গুলিতে নিহত হয়। ১১ই রভেম্বরের মধ্যে আমরা অবশিষ্ট শত্রুসেনাদের ধ্বংস করে ফেলি। বেশ কিছু পাকিস্তানী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

 যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুর্ভাগ্যের কথা আমরা জানতে পারি। সর্বত্রই শত্রুসৈন্যদের একটা সাধারণ অভিযোগ ছিলো যে, অফিসাররা তাদের সাথে ফ্রণ্ট লাইনে থাকতো না। শুধু গোলাগুলি ছাড়া অন্য সবকিছুরই অভাব ছিলো। তাদের তিক্ত অভিযোগঃ “এমন কি খাদ্যের জন্যও আমাদেরই ব্যবস্থা করতে বলা হতো।” প্রতিটি সেক্টরে যুদ্ধবন্দীদের কাছে এবং মৃত সৈনিকদের পকেটে অনেক চিঠি পাওয়া গেছে। এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের মা-বাবা আত্মীয়স্বজনের কাছে লেখা। কিন্তু পাঠাতে পারেনি। এসব চিঠিতে তাদের করুন অবস্থা এবং প্রতিটি স্তরে শৃংখলার কাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। এই ছিলো তাদের সাফল্য- মাসের পর মাস দস্যুবৃত্তি, পাশবিক অত্যচার এবং যাবতীয় জঘন্য অপরাধের উপযুক্ত পুরস্কার। একজন সিপাই তার বাবাকে লিখেছেঃ “গত মাসে এগারোশত টাকা পাঠিয়েছি, বোধহয় পেয়েছেন। দুদিন যাবৎ অজ্ঞাতপরিচয় এক স্থান অভিমুখে আমরা চলেছি। গতকাল মুক্তিবাহিনীর হামলার মুখে পড়েছিলাম। এতে আমাদের প্লাটুনের দু'জন মারা গেছে। এর আগে খালের পানিতে পড়েও একজন মারা যায়। এখানে ভীষণ বৃষ্টি হয়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বড় বড় নদী আর পুকুর।

 লোকজন ভয়ে আমাদের কাছে ঘেঁষতে চান না। গ্রাম থেকে আমরা খাবার সংগ্রহ করি, কিন্তু এরজন্য কোন দাম দেই না। আমাদের অফিসাররাও কোন দাম দেয় না। আমরা এখন একটি গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছি। কাল সকালেই আবার রওয়ানা হতে হবে। রাতে চলাফেরা করতে পারি না। এখানে অনেক মুক্তিফৌজ। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।”

 পরদিন ভোরই মুক্তিবাহিনী এই প্লাটুনটি অ্যামবুশ করে। ফলে দলের আরো দশজন সৈন্য মারা যায়। নিহতদের একজনের পকেটেই চিঠিটি পাওয়া গিয়েছিল।

 আমরা বেলুনিয়া অভিযানের আয়োজন করেছিলাম ৪ঠা নভেম্বর। অর্থাৎ এই তারিখ থেকেই সীমিত এবং স্থানীয় পর্যায়ে হলেও, ভারতীয়রা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। আর ৫ই নভেম্বর শুরু হয়ে যায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার অঘোষিত যুদ্ধ।

যুদ্ধ পরিকল্পনা

 নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই আমরা বেলুনিয়া থেকে শত্রুসেনাদের পুরোপুরি বিতাড়িত করি। পাকিস্তান রেডিও অবশ্য তখনো বেলুনিয়া তাদরে দখলে আছে বলে সমানে প্রচার করে চলেছিলো। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ একদিকে মিথ্যা প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিলো অপরদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কেন্দ্র ফেনী থেকে ক্রমান্বয়ে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছিলো।

 ২১শে নভেম্বর ঢাকা থেকে এপি প্রতিনিধি একটি বার্তায় বলেন, পাকবাহিনী এবং মুক্তিফৌজের মধ্যে মরণপণ লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াইয়ে পাকিস্তনীদের যে শক্তি ক্ষয় হচ্ছে তাতে ভারতের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা যে কি করবে বোঝা যাচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে গেরিলাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকিস্তানিরা দিশেহারা। এ সময়ে মুক্তিফৌজ অন্তত সাতটি থানার ওপর আক্রমণ চালিয়ে থানাগুলোকে মুক্ত করেছে। দেশের অধিকাংশ স্থানে মুক্তিবাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত করেছে। বন্দরে কাজকর্ম বন্ধ। শিল্প কারকানার শ্রমিকরা যে যার বাড়ির পথ ধরেছে। বিস্তীর্ণ পল্লী অঞ্চলে মুক্তিফৌজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সেখানে তারা নিজেদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। রাজাকার এবং দালালদের বিচার শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিফৌজের দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি এবং অভিযানের তীব্রতায় ইয়াহিয়া কান এবং নিয়াজী বেসামাল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাকিস্তানিরা বিতাড়িত হচ্ছিলো, প্রতি মুহূর্তে লোকক্ষয়ের সংখ্যা বাড়ছিলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই হাতছাড়া হয়ে যাবে এই আশংকায় তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আর এই আশংকা সত্য হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উৎকৃষ্ট কয়েকটি ডিভিশন তাদের হারাতে হবে দীর্ঘদিনের জন্য।

 ইতিমধ্যে পাকিস্তান কয়েকবারই পশ্চিম ফ্রণ্টে ভারতের আকাশসীমা লংঘন করে। পূর্ব ফ্রণ্টে নিয়াজী দুঃসাহসী একটা কিছু করে তার সৈন্যদরে মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা ২১শে নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের নিকটবর্তী ভারতীয় বয়রা গ্রামে হামলা চালায়। ট্যাংক, কামান ও জঙ্গী বিমান তাদের সহযোগিতা করেছিল। এতে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য নিহত। তবে বেশী মারা যায় বেসামরিক ব্যক্তিরাই বিপুল সংখ্যক লোক আহতও হয়। বরতের মাটিতেই যুদ্ধ হবে নিয়জী বোধ হয় তার এই দম্ভের যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশের অনুমতিও তিনি নিশ্চয়ই ইয়াহিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এর খেসারতও তাকে হাতে হাতে পেতে হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে তারা শুধু পেছনেই হটে আসে না, ১৩টি শেফি ট্যাংক এবং ৩টি স্যাবর জেটকে এই সীমিত যুদ্ধে হারিয়ে ফিরে আসতে হয় নিজ এলাকায়। দুজন পাকিস্তানী পাইলট বন্দী হয় ভারতের হাতে।

 এসব উস্কানিতেও মিসেস গান্ধী ছিলেন স্থির। পাকিস্তানী কামানের গোলায় ভারতের বেসামরিক লোক হতাহত হচ্ছিল। বিষয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির ছিল প্রচুর। তা সত্ত্বেও ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল তীব্র ক্ষোভ প্রাশ করতে থাকে। মিসেস গান্ধি অবশ্য আশা করছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বৃহৎ শক্তির সুমতি হবে। তারা ইচ্ছা করলে ইয়াহিয়াকে দিয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করিয়ে সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান করাতে পারবেন।

 ২১ নভেম্বর পাকিস্তান সমূহ বিপদ টের পেয়ে জাতিসংঘে এক নালিশ দায়ের করে বসে। তার বক্তব্য, ভারতীয় সেনাবাহিনী ১২টি ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের চারটি সেক্টরে আক্রমণ শুরু করেছে। একই দিন ইয়াহিয়া সারা পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা জারি করেন। এর চারদিন পর অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর পাকিস্তান সফররত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক চীনা প্রতিনিধিদলের ভোজসভায় ইয়াহিয় বক্তৃতাচ্ছলে জানিয়ে দেন যে, হয়তো দিনদশেকের মধ্যে আমাকে আর এখানে নাও পাওয়া যেতে পারে কারণ আমাকে সম্ভবত যুদ্ধে যেতে হবে।

 ২৭শে নভেম্বর পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী পশ্চিম দিনাজপুরের ভারতীয় শহর বালুরঘাটের উপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। কামানের গোলার ছত্রছায়ায় এক ব্রিগেড পাকসেনা হিলিতে ভারতীয় অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে ট্যাংক বহরও ছিল। প্রথম দফায় পাকিস্তানীদের ৮০ জন সৈন্য ও চারটি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়। পরের দিন দ্বিতীয় দফা হামলার সময় তিনটি পাকিস্তানী ট্যাংক আটক করা হয় এবং তাদের বহুসংখ্যাক সৈন্য প্রাণ হারায়। ভারতীয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। এবার ভারতীয়রা প্রতিশোধ নিয়ে এগিয়ে আসে বিপুল শক্তিতে। তারা আন্তর্জাতিক সীমারেখা পার হয়ে বাংলাদেশের ভেতর কয়েক মাইল ঢুকে পড়ে। ভারত সরকার আগেই তার সৈন্যদের সীমান্ত এলাকায় সীমিত আকারে অভিযান পরিচালনার আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন। নির্দেশ ছিল, সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার হুমকি দেখা দিলে সৈন্যরা তা নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে। ভারত তখন শুধু তার সীমান্ত রক্ষাই নয়, প্রয়োজন দেখা দিলে সমুচিত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যও পুরোপুরি প্রস্তুত।

 পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্ট রিচার্ড নিক্সন প্রস্তাব দেন যে, ভারত এবং পাকিস্তান দুই পক্ষকেই সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। ইয়াহিয়া খান বাহ্যত প্রস্তাবে সম্মতি জানান। অপরপক্ষে ভারত এই শর্তে সম্মত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানকে তার সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। সকল সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর কার্যকলাপ এবং এদেরকে সরিয়ে নেয়া না হলে এই অঞ্চলে শান্তি আসবে না। এই সব প্রস্তাব যখন আদান-প্রদান হচ্ছিলো পাকিস্তান তখন পশ্চিম ফ্রণ্টে রাতের অন্ধকারে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে সৈন্য সমাবেশ করে। এ ঘটনা ১লা ও ২রা ডিসেম্বর। ২রা ডিসেম্বরেই পাকিস্তান সংঘর্ষের বিস্তৃতি ঘটানোর অসৎ উদ্দেশ্য মরিয়া হয়ে আগরতলার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। এদিন নয়াদিল্লীতে কংগ্রেসে কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধি স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা করেন, তথাকথিত বৃহৎ শক্তিবর্গ যেভাবে চাইবে সেভাবে কাজ করার দিন শেষ হয়ে গেছে। ভারতের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয় সেই দিকে, দৃষ্টি রেখে আজ আমাদের কাজ করতে হবে।

 অক্টোবর মাসেই জম্মু কাশ্মীরের পুঞ্চ সেক্টরে পাকিস্তানীদের প্রথম যুদ্ধপ্রস্তুতি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের সমরপ্রস্ততি এবং তৎসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার ক্রম অবনতি এবং কোটি কোটি বাঙালীর চরম দুর্দশার প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলোর উদাসীনতা লক্ষ্য করে ভারত সরকার তখনই তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সম্ভাব্য আপৎকালের জন্য পুরোপুরি হুঁশিয়ার থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান এর আগে তিনবার ভারত আক্রমণ করেছে সে কথা ইন্দিরা গান্ধী ভুলে যাননি।

 ভারতের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে পাকিস্তান পশ্চিম ফ্রণ্টে প্রথম অভিযানেই রাজনৈতিক এবং রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ যতোদূর সম্ভব বেশী এলাকা দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলো। পাকিস্তানের মূল পরিকল্পনায় ছিলো, একটি সাঁজোয়া হিভিশন এবং দুটি পদাতিক ডিভিশন এগিয়ে গিয়ে ভারতের ওপর হামলা চালাবে। দরকার হলে আক্রমণকারী ডিভিশনগুলোর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আরো পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনীর সৈন্য পাঠানো হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্তিত পাক সেনাবাহিনীর বাকি অংশের দায়িত্ব ছিল সমস্ত বরাবর ভারতীয় বাহিনীকে স্থানীয়ভাবে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো প্রলুব্ধকারী হামলার পরিকল্পকারী করা হয়। পাকিস্তানীরা আশা করেছিল এইসব প্রলব্ধকারী হামলায় বিভ্রান্ত হয়ে ভারত তার সেনাবাহিনীকে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী রিজার্ভ বাহিনীকে মূল রণাঙ্গন থেকে অন্য কোনো ক্ষেত্রে নিয়োজিত করে ফেলবে। ফলে পাকিস্তানের মূল আক্রমণকারী বাহীনীর পক্ষে অতি সহজে এবং স্বল্প প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা এবং জয়লাভ করা সম্ভব হবে।

 এই লক্ষ্য সামনে রেখে পাকিস্তান তার ১২ পদাতিক ডিভিশনের ওপর পুঞ্চ এলাকা দখল করার দায়িত্ব অর্পণ করে। পাকিস্তান আশা করেছিল, পুঞ্চ এলাকায় হামলা চালালে জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনী এ এলাকাতে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে ফলে তারা আর চেনাব নদীর দক্ষিণে যাবার সুযোগ পাবে না। সেই ফাঁকে পাকিস্তান চেনাব নদীর দক্ষিণে তার মূল হামলা চালিয়ে সফল হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য, পাকিস্তানের এই ডিভিশনটি কাশ্মীরেই অবস্থান করেছিলো এবং এর অধিকাংশ সৈন্য কাশ্মীরেরই লোক। পাকিস্তানে আরো পরিকল্পনা করেছিলো যে রাভী নদী বরাবর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করে তারা নওশের- রাজৈরি এলাকা দখল করে ফেলবে। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হলো গুজরাটে অবস্থিত ২৩ পদাতিক ডিভিশনকে।

 ১নম্বর কোরের ওপর দায়িত্ব দেয়া হলো সাকারগড় এলাকায় ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার। প্রলুব্ধকারী হামলা চালিয়ে ভরতীয় বাহিনীকে ঐ এলাকায় যুদ্ধে নামাবার পরিকল্পনা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল আসল আক্রমণ এলাকা সম্পর্কে যেন ভারত কিছুই বুঝে উঠতে না পারে।

 লাহোর এবং কাসুর সোলেমানকি এলাকায় ৪ নম্বর কোরকে ইরাবতী এবং গ্রাণ্ড ট্র্যাংক রোডের মধ্যবর্তী চানগানওয়ালা নালা পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল রক্ষা করার দায়িত্ব দেয় হয়। রহিম ইয়ার খান এবং করাচীসহ কচ্ছের রানের মধ্যবর্তী এলাকা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় ১৮ পদাতিক ডিভিশনের ওপর।

 ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভূখণ্ড বিশেষ করে জম্মু কাশ্মীর সেক্টরের বেশ কিছু এলাকা প্রথমেই দখল করে ফেলতে। যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের কোন জায়গা খোয়া গেলে ভবিষ্যতে তা উদ্ধারের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের এই দখলকৃত জায়গার বিনিময়েও তিনি দর কষাকষি করতে পারবেন, এই ছিলো তার আশা।

 লক্ষ্য অর্জনের জন্য পশ্চিমাঞ্চলে তাকে প্রথমেই আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে হবে এবং পূর্বাঞ্চলে জেনারেল নিয়াজীকে রাখা হবে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা।

 পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার ইস্টার্ন কমাণ্ড অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য সীমিত সংখ্যক আক্রমণাত্মক অভিযানসহ প্রধানত আত্মরক্ষামূলক তৎপরতার ভিত্তিতে একটি পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো। গুটিকয়েক আক্রমণাত্মক অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল শুধু যুদ্ধটাকে ভারতের মাটিতে গড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য।

 বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সীমান্তে রেখার যতো কাছে অবস্থান দেয় যায় ততদূর পর্যন্ত এলাকা নিয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়।

 ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার যতোগুলো পথ রয়েছে সেই সবগুলো পথেই এই ধরনের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং যোগাযোগ কেন্দ্র যেমন চট্টগ্রাম, ফেনী, লাকসাম, চাঁপুর, কুমিল্লা, আখাউড়া, দাউদকান্দি, ভৈরব, ঢাকা, খলনা, যশোর, ঝিনাইদহ এবং বগুড়ার চারপাশে চুড়ান্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেয়া হয়। যে কোনো মূল্যে ঢাকাকে রক্ষা করাই ছিল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

 এই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে পাল্টা আঘাত (কাউণ্টার অ্যাটাক) হানার জন্যেও প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমাণ্ডের এই বিস্তারিত রণপরিকল্পনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফরকালে অনুমোদন করেছিলেন। পরিকল্পনা প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধারা যাতে কোনো শহর দখল করে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। কারণ এটা করতে পারলেই তারা বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবে। পাকিস্তানিরা অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলোতে তিন থেকে চার সপ্তাহ চলার মতো গোলাগুলি, রসদপত্র রাখার এবং পশ্চাত্বর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানসমূহে পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদ রাখার ব্যবস্থাও করে। অগ্রবর্তী ঘাঁটি রক্ষা দুস্কর হয়ে পড়লে সেখান থেকে যোগাযোগ কেন্দ্র কিংবা গুরুত্বপূর্ণ শহরে পশ্চাদপসরণ করে সে সব স্থান রক্ষার জন্য লড়াই করে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

 কয়েকমাস ধরে পাক সেনাবাহিনী এসব প্রতিরক্ষা ঘাঁটির সকল ব্যবস্থা নিয়ে বেশ তৎপর ছিল। তারা হাজার হাজার কংক্রিটের বাংকার এবং পিল বক্স নির্মাণ করে। ট্যাংক চলাচল ঠেকানোর জন্য সম্ভাব্য পথগুলোতে গভীর নালা কেটে রাখে।  এ ব্যাপারে পাকিস্তানীদের অর্থের কোনো অভাব ছিল না। শরণার্থী সাহায্য ও পুনর্বাসন কর্মসূচীর নাম করে ইয়াহিয়া খান মোটা অংকের অর্থ যোগাড় করেছিলেন। আসলে ভারত থেকে তখনো কোনো শরণার্থী ফিরে আসেনি। অল্প সংখ্যাক যারা এসেছিলো তারাও সেনাবহিনীর তথ্যকথিত অভ্যর্থনা কেন্দ্র দিয়ে ফিরে আসেনি। তারা যে পথে ভারত গিয়েছিলো সেই গোপন পথেই ফিরেছে। মাঝ থেকে শরণার্থীদের জন্য পাওয়া পুরো টাকাটাই প্রতিরক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে নিয়াজীর হাতে তুলে দেয় হয়। বেলুনিয়ার একটি মাত্র ট্যাংকবিরোধী নালা তৈরী করতে পাকিস্তানীরা প্রায় ২০ লাখ টাকা করচ করে।

 অপরপক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম ফ্রণ্টে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা এবং পূর্ব ফ্রণ্টে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অবশ্য পশ্চিম ফ্রণ্টে ভারতীয় সেনাবাহিনী অনুকুল পরিস্থিতির সুযোগে কোন কোন সেক্টরে পুরোপুরি আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যতোদুর সম্ভব অগ্রসর হওয়ারও পরিকল্পনা করে।

 ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো ছিল নিম্নরুপঃ

 (1) যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে (সর্বাধিক তিন সপ্তাহের ভেতরে) মুক্তিফৌজের সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন করা।

 (2) চীন দেশের দিক থেকে সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে ভারতের উত্তর সীমান্ত রক্ষা।

 (3) আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সংহতি রক্ষা এবং

 (4) নাগাল্যাণ্ড, মনিপুর এবং মিজোরাম এলাকায় বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার দমন করা।

 এই কাজগুলো মোটই সহজসাধ্য ছিলো না। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি দ্রুত সৈন্য চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত। পুরো দেশ জুড়ে রয়েছে নদীনালা খাল বিল। এগুলোর জন্য যে কোনো বাহিনীর অভিযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য।

 এই সব প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক অবস্থানের মূল্যায়ন করে বাংলাদেশকে মোটামুটি চারটি পৃথক সেক্টরে ভাগ করা হয়। এই সব সেক্টরে ভারত এবং পাকিস্তানীদের অবস্থান ছিলো নিম্নরূপঃ

 ১। উত্তর পশ্চিম সেক্টর: যমুনার পশ্চিম এবং পদ্মার উত্তরের অঞ্চল এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সেক্টরের আওতাধীন জেলাগুলো ছিলো রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা। মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহের অধীনে পাকিস্তানের ১৬ ডিভিশন এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেছিলো নাটোরে। এই সেক্টরে সর্বত্র এবং বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, হিলি ও রংপুরে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিলো।

 পাকিস্তানী ১৬ ডিভিশনের মোকাবিলায় ভারত তার ৩৩ কোরের (লে. জেনারেল থাপা) অধীনে দুটি মাউণ্টেন ডিভিশনকে নিয়োজিত করে। এই ডিভিশনগুলোর সহায়ক হিসেবে নিয়োজিত ছিলো ডিবিশনাল গোলন্দাজ বাহিনী, একটি মাঝারি ট্যাংক রেজিমেণ্ট এবং হালকা উভয়চর ট্যাংকের (পিটি-৭৬) আর একটি রেজিমেণ্ট। ভারতীয় ডিভিশনগুলো ছিলো উত্তরে কুচবিহার জেলায় ৬ মাউণ্টেন ডিভিশন, বালুরঘাট এলাকায় ২০ মাউণ্টেন ডিভিশন এবং শিলিগুড়ি এলাকায় ৭১ ব্রিগেড। বাংলাদেশে অভিযানের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ৩৩ কোরকে সিকিম ও ভুটানের মধ্যে দিয়ে সম্ভাব্য চীনা আগ্রাসন প্রতিহত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো।

 ২। পশ্চিম সেক্টর: পদ্মার দক্ষিণ এবং পশ্চিম এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল এবং পটুয়াখালি। এই সেক্টরের মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯ পদাতিক ডিভিশন মোতায়ন করা হয়। এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল যশোরে। পাকিস্তানী ৯ পদাতিক বাহিনীর মোকাবিলায় ভারতীয় পক্ষে ছিলো জেনারেল রায়নার কমাণ্ডে নবগঠিত ২ কোর। এই কোরের আওতায় দুটি ডিভিশন ছিল মেজর জেনারেল দলবীর সিং-এর নেতৃত্বে ৯ পদাতিক ডিভিশন এবং মেজর জেনারেল মহিন্দর সিং বারার-এর নেতৃত্ব ৪ মাউণ্টেন ডিভিশন। জেনারেল রায়নার সহায়তায় আরো ছিল দুটি ট্যাংক রেজিমেণ্ট এবং ডিভিশনের সহায়ক গোলন্দাজ বাহিনী।

 ৩। উত্তর সেক্টর: এই সেক্টর গঠিত হয়েছিলো ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে। পাকিস্তানীদের পক্ষে এই সেক্টরের দায়িত্ব ছিল ব্রিগেডিয়ার এ কাদেরের নেতৃত্বে ৯৩ ব্রিগেড এবং এর আওতায় ৩১ বালুচ ও ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট, আধা সামরিক বাহিনী (নবগঠিত ইপিসিএপি-এর দুটি উইং), কয়েকটি মুজাহিদ ইউনিট এবং একটি মর্টার ব্যাটারি। এই এলাকার উত্তরাংশ পাকিস্তানীদের প্রধান শক্তি ছিল লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ৩১ বালুচ রেজিমেণ্ট। এদেরকে ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে, সুলতান মাহমুদই ছিলো সবচাইতে বেশী সংখ্যক বাঙালীকে হত্যার প্রধান হোতা। কমলপুর-খকশীগঞ্জ জামালপুর এবং হাতিবান্ধা শেরপুর জামালপুর বরাবর যে এলাকা রয়েছে তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিলো এই রেজিমেণ্টের ওপর। এছাড়া ডালু-হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ বরাবর এলাকার দায়িত্ব এরা পালন করতো।

 এই সেক্টরের বিপরীতে ভারতীয় মেঘালয় এলাকায় ছিলো ১০১ কমুনিকেশন জোন। এই জোনের আওতাধীন ভারতীয় সৈন্যরা আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল, নাগাল্যাণ্ড এবং মিজোরামে দায়িত্ব পালনরত সৈন্যদের চলাচল ও রক্ষাণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করতো। এই এলাকায় ভারতীয়দের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকায় বিরাট বাহিনীর পক্ষে এখানে দীর্ঘস্থায়ী তৎপরতার চালানো সম্ভব ছিল না। তাই এই সেক্টরে ভারতীয় সৈন্য সংখ্যা ছিলো সীমিত। এলাকাটি প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং। তাঁর অধীনে ছিলো ব্রিগেডিরা হরদেব সিং ক্লেয়ার-এর নেতৃত্বে ৯৫ মাউণ্টেন ব্রিগেড গ্রুপ এবং ২৩ পদাতিক ডিভিশন থেকে আনীত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন। এখানে ভারতীয় বাহিনীকে সহযেগিতা করেছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল এলাকার সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা।

 ৪। ইস্টার্ন সেক্টর: মেঘনায় পূর্ব পার্শ্বের এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাকিস্তান এই সেক্টরে তাদের ১৪ ডিভিশন এবং ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন মোতায়েন করেছিলো। মেজর জেনারেল আবদুল মজিদের নেতৃত্বে ১৪ ডিভিশনের সৈন্যরা কুমিল্লা পর্যন্ত এলাকার দায়িত্বে ছিলো। ২০২ ব্রিগেড সিলেট, ২৭ ব্রিগেড ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া, ১১৭ ব্রিগেড কুমিল্লা, ৩১৩ ব্রিগেড ব্রাহ্মণবাড়িয়া উত্তরাঞ্চল ও মৌলভীবাজার এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। ৫৩ পদাতিক ব্রিগেড ছিলো লাকসাম ও ফেনীর দায়িত্বে।

 চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানের ৩৯ পদাতিক ডিভিশন। কমাণ্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল রহিম খান।

 ভারতের পক্ষে এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলো লে. জেনারেল সগত সিং-এর নেতৃত্বাধীন ৪র্থ কোর। তার অধীনে ছিলো মেজর জেনারেল কৃষ্ণরাও- এর অধীনে ৮ম মাউণ্টেন ডিভিশন, মেজর জেনারেল গনজালভেস-এর ৫৭ মাউণ্টেন ডিভিশন এবং মেজর জেনারেল আর, ডি হিরার অধীনে ২৩ মাউণ্টেন ডিভিশন। বাংলাদেশের ৮টি ব্যাটালিয়ন এবং আমাদের ১ থেকে ৫ নম্বর সেক্টরের সকল ট্রপসকে সগত সিং- এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছিল। অভিযান সংক্রান্ত দায়িত্ব ছাড়াও ৪র্থ কোরের ওপর আগরতলা শহর, বিমান ঘাঁটি এবং ঐ এলাকায় বিমান বাহিনীর সকল প্রতিষ্ঠান রক্ষার ভার ছিলো।

 প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশ পাকিস্তানীদের ১৪ ডিভিশনের কেবল ৪টি পদাতিক ডিভিশন ছিলো। ২৮শে মার্চের মধ্যে ৯ এবং ১৬ ডিভিশন দুটি এখানে চলে আসে। এরপর বাংলাদেশে তারা আরো দুটি ডিভিশন গড়ে তোলে। এই দুটি ছিলো ৩৬ এবং ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন। ১৯৭১-এর অক্টেবরের মধ্যে পাকিস্তান এখানকার সবগুলো ডিভিশনের পুনর্গঠন কাজ সম্পন্ন করে। ডিভিশনগুলোর সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ছিলো গোলন্দাজ ও ভারী মর্টার বহর এবং ট্যাংক বহর। আমেরিকান শেফি ট্যাংক চিলো ৬০টি। বিমান বাহিনীতে ছিলো ২০ খানি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এবং নৌবাহিনীতে ছিলো অজ্ঞাত সংখ্যাক গানবোট এবং অন্যান্য উপকূলীয় নৌযান।

 এর মোকবিলায় ভারত তার ৭টি পদাতিক ডিভিশনকে এই এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য নিয়োজিত করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রণ্টে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং চীন সীমান্তে সম্ভাব্য হামলা মোকবিলায় প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়োজিত করার পর বাংলাদেশে যুদ্ধ চালনার জন্য ভারতের হাতে এই ৭টি পদাতিক ডিভিশন ছাড়া আর কোনো নিয়মিত ফোর্স ছিলো না। এইগুলোর মধ্যে ৬টি ছিল পুর্ণাঙ্গ ডিভিশন এবং ২টি স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড। ডিভিশনগুলোকে যুদ্ধে পূর্ণ সহায়তা দেয়ার জন্য ছিলো হালকা এবং মাঝারি পাল্লার গোলন্দাজ বহর, পিটি-৭৬ ধরনের উভচর ট্যাংকের দুইটি রেজিমেণ্ট এবং টি-৫৪ ধরনের একটি ট্যাংক রেজিমেণ্ট। এছাড়া ৩টি স্বতন্ত্র ট্যাংক স্কোয়াড্রন এবং দুটি দ্রুত চলাচলে সক্ষম (মেকানাইজড) ব্যাটালিয়নকে যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত করা হয়।

 ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭টি জঙ্গী বোমারু বিমানের স্কোয়াড্রন এই এলাকার জন্যে নিয়োজিত করা হয়। এছাড়া ছিলো সৈন্য পরিবহনের জন্য কিছু সংখ্যক হেলিকপ্টার। বিমানবাহিনী জাহাজ আই.এন.এস ভীক্রান্ত সহ ইস্টার্ন ফ্লীট ছিলো এই অঞ্চলের সমুদ্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। বাংলাদেশের উপকূলের অদূরবর্তী সমগ্র সাগর এলাকা অবরোধের দায়িত্বে ছিলো এই ইস্টার্ন ফ্লীটের উপর ন্যস্ত। যুদ্ধ যদি শুরু হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে সৈন্য কিংবা সমসরঞ্জাম নিয়ে আসা নিয়াজীর পক্ষে আর কিছুতেই সম্ভব হবে না।

 এটা সাধারণ মাপকাঠি হিসাবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করতে হলে প্রতিটি আত্মরক্ষাকারী সৈনিকের বিরুদ্ধে তিনজন আক্রমণকারী নিয়োগ করতে হবে। পূর্বাঞ্চলে ভারত কিন্তু সেই অনুপাতে পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী ছিল না। অনুপাত যেখানে ৩:১ হওয়া দরকার, সেখানে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনামূলক অনুপাত ছিলো ২:১। কিন্তু ইস্টার্ন কমাণ্ডার লে. জেনারেল অরোরা যে ৭টি ডিভিশন পেয়েছিলেন তার চাইতে বেশী সৈনিক পাওয়ার আর কোনো আশাই করতে পারতেন না এবং এই বাহিনী দিয়েই তাকে তার আরদ্ধ কাজ সমাধা করতে হবে। এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

 তবে জেনারেল অরোরার আস্থা ছিল জয়ী তিনি হবেনই। বাংলাদেশের সমগ্র বাহিনী তাঁর সহযোগিতায় প্রস্তুত ছিলো। এর মধ্যে নিয়মিত ব্রিগেডগুলো ছিলো কে ফোর্স, এস ফোর্স এবং জেড ফোর্স। ৯টি সেক্টরের ২০ হাজার বাঙালী সেক্টর ট্রপস অস্ত্র হাত প্রস্তুত। এক লাখ গেরিলা সর্বত্র শত্রুকে তখন তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিলো। সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছিলো। ইয়াহিয়া কিংবা নিয়াজীর জন্য তাদের অন্তরে করুণার লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিলো না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই বাঙালীদের এই ঘৃণা পাকিস্তানের পরাজয় এক রূপ নিশ্চিত করে রেখেছিলো।

 জনসাধারণের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানত ভারতের বিজয় নিরূপণ করা হয়েছিলো। জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ ততোদিনে রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান ইত্যাদি চালানো কিংবা গ্রেনেড নিক্ষেপের কায়দা কানুন শিখে ফেলেছিল। শত্রুপক্ষের খবরা খবর সংগ্রহ করা এবং প্রায় সকল ধরনের অস্ত্রের পরিচিতি সম্পর্কে তারা মোটামুটি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। কোন অস্ত্রটি কোন দেশের তৈরী তাও অনেকে বলতে পারতো। আমার ২ নাম্বার সাবসেক্টরে আট বছরের একটি ছেলে প্রায় প্রতিটি টহলদের পার্টির সাথেই স্কাউট হিসেবে কাজ করতো। দিনের বেলা সে একাই চলে যেতো শত্রুর সব কিছু দেখে আসার জন্য। ফিল্ড ম্যাপের ওপর আঙুল দিয়ে সে আমাদের বুঝাতো: এই হচ্ছে বল্লবপুর গ্রাম স্যার। আর এখানে আছে বড় একটা পুকুর। মেশিনগানটি বসানো আছে এখানে। এই এলাকায় মাইন লাগানো আছে। কিন্তু স্যার গরু বাছুর এখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি কিছুই হয়নি। তাই ওটা নিশ্চয়ই ভুয়া মাইন ক্ষেত্র। এই যে এখানে একটি স্কুল বিল্ডিং, অফিসাররা এখানে থাকে। এই ভাবে যুদ্ধের এলাকার সব কিছু ছেলেটি আমাদের বুঝিয়ে দিতো।

 বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে জেনারেল অরোরা তাঁর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। প্রধান লক্ষ্যে ছিলো, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা মুক্ত করা। শত্রুর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলো এড়িয়ে এবং যোগাযোগ ও সরবরাহ লাইন দখল করে দ্রুতগতিতে ঢাকা দখল করাই ছিল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

 ঢাকা একবার মুক্ত হয়ে গেলেই শত্রুর বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলো আপনা-আপনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। তাহলে অত্যন্ত ধীরে সুস্থে এই সব এড়িয়ে যাওয়া অবস্থানগুলোকে ধ্বংস করা যাবে।

 প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ যুদ্ধের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। চূড়ান্ত বিজয় লাভ হলে এটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, ঢাকাকে আসল লক্ষ্যবস্তু হিসাবে যুদ্ধ চালাতে হবে এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করতে হবে প্রাকৃতিক সেক্টর হিসাবে আলাদা ভাবে।

 উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের বগুড়া ছিলো প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই সেক্টরের সকল জায়গার শত্রু সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে শেষ করতে হবে তবে প্রধান অভিযান ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়া মুক্ত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে।

 পশ্চিম সেক্টরে যশোর ছিল প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। ঝিনাইদহ-মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে ঢাকার সাথে এর সংযোগ। তাই ঝিনাইদহ এবং মাগুরা দখল করতে পারলে যশোরে পাকিস্তনীরা বিপাকে পড়বে এবং মিত্র বাহিনীর পক্ষে দ্রুত ঢাকা অভিমুখে যুদ্ধাভিযান চালানো সম্ভব হবে। তাই মূল হামলা ঝিনাইদহ-মাগুরা দখলের উদ্দেশ্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্যে যশোরের দিকে একটা আক্রমণ চালাবারও সিদ্ধন্ত নেয়া হয়।

 উত্তর সেক্টরে মিত্র বাহিনীর একটি ব্রিগেডকে জামালপুর-টাঙ্গাইল সড়ক হয়ে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।

 পূর্ব সেক্টরে লক্ষ্য রাখতে হবে, ঢাকা যেন চট্টগ্রাম কিংবা কুমিল্লা থেকে কোন সাহায্য না পেতে পারে। মেঘনা নদী বরাবর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্থাৎ চাঁদপুর, দাউদকান্দি এবং আশুগঞ্জ দখল করতে পারলেই এই উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব। প্রথম অবস্থায় কুমিল্লা, গ্যারিসন এড়িয়ে গেলেও চলবে।

 ঢাকা মুক্ত করার লক্ষ্যে দাউদকান্দি থেকে ভৈরব পর্যন্ত মেঘনা নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং এরপর জামালপুর-টাঙ্গাইল অক্ষ বরাবর অগ্রসররত দলটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে রাজধানী অভিমুখে যুদ্ধাভিযান পরিকল্পনার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়ে।

 পশ্চিম সেক্টরের অগ্রসরমান কলামের জন্য গোয়ালনন্দঘাট দিয়ে পদ্মা পার হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বিশাল এই নদীটি পার হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আগে থাকতেই করে রাখতে হবে।

 চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সময় আমর সঙ্গে নিজস্ব এক ব্রিগেড সেক্টর ট্রুপস ছাড়াও ভারতীয় ২টি বাহিনীর ব্যাটালিয়ন এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টর একটি ব্যাটালিয়ন ছিলো। এই সব সেনা নিয়ে গঠিত হয় বিচিত্র এক বাহিনী যার নাম দেয়া হলো 'কিলো ফোর্স'। আমাদের পথ ছিলো সবচাইতে দীর্ঘতম অথচ যানবহনের সংখ্যা ছিলো সবচাইতে কম। ফিল্ড আর্টিলারী আমাদের সহায়তায় ছিলো বটে, তবে কোন ট্যাংক কিংবা অন্য কোনো প্রকার সাহায্যকারী ইউনিট ছিল না। এই সেক্টরে আমি ইতিমধ্যেই শত্রুর পশ্চাৎভাগে দুটি নিয়মিত কোম্পানীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার একটি কোম্পানী মীরেশ্বরাই এলাকা এবং ফটিকছড়ি এলাকায় নিরাপদে ঘাঁটি স্থাপন করে বসেছিলো। সমগ্র বেলুনিয় অঞ্চল বেশ কয়েকদিন আগে কয়েকদিন আগে থেকেই শত্রুমুক্ত হয়েছিলো। ফেনী মুক্ত করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি চূড়ান্ত। ১৯৭১-এর ২রা ডিসেম্বরের কথা বলছি। পরের দিন মিসেস গান্ধী কলকাতায় এক জনসভায় বক্তৃতা দেবেন। আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম এই সভায় হয়তো তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা করবেন।

স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই

 বেলুনিয়ায় আমার অগ্রবর্তী কমাণ্ড পোস্টের দিকে জিপ চালিয়ে এগিয়ে যাই। ধুলায় আচ্ছন্ন পথ। দুই পাশে ফসলের সোনালী মাঠ। ধান কাটা মৌসুম এসে গেছে।

 অন্যান্য দিনের মতোই সূর্য ডুবে গেল। তারপর সমস্ত এলাকা পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভরে ওঠে। পথের পাশে একটা টহলদার দলকে ব্রিফিং দেয়া হচ্ছিলো। অল্প দূরেই আমাদের মেশিনগানের আওয়াজ শোনা যায়। ফাঁকে ফাঁকে পাকিস্তানীদের মেশিন গান....... কখনও বা আর্টিলারী শেলিং শুরু হয়। সব কিছু নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা..... বাংলাদেশের হয়তো সব ফ্রণ্টেই তা ঘটেছিলো প্রতিদিন।

 মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সেদিন কলাকাতায় এক বিশাল জনসভায় ভাষন দিলেন। তাঁর নয়াদিল্লি ফিরে

যাবার কোনো তাড়াহুড়োই ছিলো না।

 জেনারেল অরোরার ইস্টার্ন কমাণ্ড হেড কোয়ার্টারে আর একটা কর্মব্যস্ত দিনের অবসান ঘটলো। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর বাইরে তাই ইস্টার্ন কমাণ্ডে কেউ কোনো গুরুরত্বপূর্ণ নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত পাওয়ার আশা করছিলো না। ওদিকে ইয়াহিয়া খান তখন ইসলামাবাদে। দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধ করার যে পূর্বাভাস তিনি দিয়েছিলেন তা শেষ হতে আরো দুই দিন বাকী।

 ভারতের সমস্ত অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটিসমূহ যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। তবে বিমান ঘাঁটিগুলোতে যুদ্ধের সবগুলো বিমান তখন পর্যন্ত পৌছেনি। ভারতীয় নৌবাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লীট এবং ওয়েস্টার্ন ফ্লীট তখন পর্যন্ত শান্তি কালীন ঘাঁটিতেই অবস্থান করছিলো।

 পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত সাবমেরিন ৩১১ ফুট দীর্ঘ পি-এন-এস গাজী এগিয়ে চললো ভারতের নৌ ঘাঁটি বিশাখাপত্তমের দিকে। উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ 'ভিক্রান্ত' কে টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয়া। ৩রা ডিসেম্বর। শুক্রবার। ভারতীয় সময় বিকাল ৫টা ৪৭ মিনিটে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী অতর্কিতে ভারতের ৭টি বিমান ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। রাত সাড়ে আটটায় জম্মু এবং কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছাম্ব এবং পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক আক্রমণ অভিযান শুরু করে।

 এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য ভারত পুরো প্রস্তুত ছিলো। মিসেস গান্ধী দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ঐ রাতেই ১২টা ৩০ মিনিট জাতির উদ্দেশ্য প্রদত্ত বেতার ভাষণে সকলকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরী হওয়ার আহবান জানালেন। ততোক্ষণে জেনারেল অরোরাও আক্রমণের নির্দেশ পেয়ে যান। ভারতীয় নৌবাহিনী ইতিমধ্যেই সফল অভিযান শুরু করে দিয়েছিলো। বিশাখাপত্তম উপকূলের মাত্র কয়েক মাইল দূরে ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার 'আইএনএস রাজপুত' পাকিস্তানী সাবমেরিন গাজীর সন্ধান পেয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ‘রাজপুতের ডেপথ' চার্জে পাকিস্তানের সাবমেরিন গাজী টুকরো টুকরো হয়ে সাগর গর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একই সঙ্গে অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা অতিক্রম করে বাংলাদেশ প্রবেশ করলো। ইস্টার্ন ফ্লীটও দ্রুত লক্ষ্যস্থল অভিমুখে অগ্রসর হলো। ভারতীয় বিমানবাহিনী কিছুক্ষণ আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সবগুলো বিমান ঘাঁটি এবং রাডার কেন্দ্রের উপর আঘাত হেনে  চলেছিলো। রাত ৩টায় ভারতীয় বিমানগুলো ঢাকা এবং কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটির উপর প্রথম হামলা শুরু করে। ইতিহাসের আর একটি মহান স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা হলো।

 যুদ্ধের প্রথম দিনে সকল রণাঙ্গনে পাকিস্তানীরা মরণপণ শক্তিতে আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো। বেলা ১০ টার মধ্যে ভীক্রান্ত তার নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌচে যায়। কিছুক্ষণের মধ্য ৬টি ‘সী হক’ বিমান চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থলগুলোতে আঘাত হানার জন্য ডেক থেকে উড়ে গেলো।

 পূর্ব সেক্টরে অর্থাৎ মেঘনার পূর্ব দিকের অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যদের ধ্বংস করার দায়িত্ব ভারতীয় ৪র্থ কোরের ওপর ন্যাস্ত ছিলো। এই সেক্টরে প্রধান সড়কপথে রণকৌশলগত প্রতিবন্ধকতা ছিলো দুটি স্থানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং লাকসামে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করতে পারলে পূর্ব সেক্টরের সকল পাকিস্তানী সৈন্য বিশেষ করে সিলেট ও মৌলভীবাজারের সৈন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। একই সঙ্গে লাকসাম আমাদের দখলে এলে কুমিল্লা গ্যারিসন চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। চাঁদপুর ও ফেনী দখলের দায়িত্ব ছিল ৪র্থ কোরের উপর। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই এই স্থান দখল করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। একই সঙ্গে উত্তরে শমসেরনগর বিমান ঘাঁটি, মৌলভীবাজার এবং সিলেটও মুক্ত করার দায়িত্ব এই কোরের ওপর ছিলো। ৪র্থ কোরের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ঢাকা মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিলো না। সে অনুসারে কোর কমাণ্ডার সগত সিং ৮ নং মাউণ্টেন ডিভিশনকে শমসেরনগর বিমান ঘাঁটি, মৌলভীবাজার এবং সিলেট শহর মুক্ত করার নির্দেশ দেন। করিমগঞ্জের নিকট সীমান্ত অতিক্রম করে ৮ম মাউণ্টেন ডিভিশনের একটি কলাম সিলেটের দিকে এবং অন্য একটি মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। শমসেরনগর বিমার ঘাঁটি মুক্ত হয় প্রথম দিনেই। পাকিস্তানীরা অবস্থা বেগতিক দেখে এই অঞ্চলের অধিকাংশ সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে।

 এই কোরের ৫৭তম ডিভিশনকে আগরতলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর আখাউড়া মুক্ত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কুমিল্লা এবং ময়নামতি মুক্ত করার কাজে নিযুক্ত ২৩ মাউণ্টেন ডিভিশনকে সাহায্য করাও ৫৭ ডিভিশনের দায়িত্ব ছিলো। তারপর মেঘনা নদীর তীরে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র চাঁদপুর এবং দাউদকান্দি করার লক্ষে যুদ্ধভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশও এই ডিভিশনকে দেওয়া হয়।

 এই সেক্টরে দক্ষিণে ফেনী শহর থেকে পাকিস্তানীরা এক সময় সন্তপর্ণে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে আমার বাহিনী শহরটিতে প্রবেশ করে। ফেনী আমাদের হাতে চলে আসায় চট্টগ্রাম পাকিস্তানীদের সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসময় কুমিল্লা ও লাকসাম এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়।

 আমার সেক্টরে ফেনী এবং বেলুনিয়া এলাকা সম্পুর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে লাকসামের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এটাই হচ্ছে একমাত্র এলাকা (অর্থাৎ চট্টগ্রাম সেক্টর) যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন নিয়মিত পুরো ব্রিগেড যুদ্ধে নিয়োজিত হয়নি। এখানে অভিযান চলেছে প্রধানত আমার তিন ব্যাটালিয়ন সেক্টর ট্রপস (যার মধ্যে থেকে ২ কোম্পানী ইতিপূর্বেই চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হয়েছিল) এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়নের শক্তির ওপর নির্ভর করে।

 বেলুনিয়া ও ফেনীতে আমাদের হাতে চরম মার খাওয়ার পর ৫৩ ব্রিগেডসহ পাকিস্তানের ১৫ বালুচ রেজিমেণ্ট ৬ই ডিসেম্বর লাকসামের দিকে পলায়ন করেছিলো। ৬ই ডিসেম্বর আমরা ফেনী মুক্ত করে চট্টগ্রামের পথে অগ্রসর হই। সামনে আমাদের ৬৫ মাইল পথ। শুভপুরের কয়েক মাইল দক্ষিণে ধুমঘাট রেল সেতুটি দখল করা এবং রক্ষা করার জন্য আমি সাথে সাথেই দুটি প্লাটুনকে পাঠিয়ে দেই ধুমঘাটের পথে। চট্টগ্রামের পথে অগ্রসরমান আমাদের মূল বাহিনীতে ছিলো আমার সেক্টরের তিনটি নিয়মিত এবং বাংলাদেশের একটি কামান বহর নাম ছিল মুজিব ব্যাটারী। (শেখ মুজিবর রহমানের নাম অনুসারে)। ভারতীয় বাহিনীতে ছিলো ২য় রাজপুত ব্যাটালিয়ন, বিএসএফ-এর একটি গোলন্দাজ রেজিমেণ্ট। এই সেক্টরে বাংলাদেশ বাহিনীর কমাণ্ডার হিসাবে আমি এবং ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপ ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য করে চলছিলাম। আগেই বলা হয়েছে আমাদের এই যৌথ বাহিনীর নাম ছিলো 'কিলো ফোর্স”।

 ফেনী থেকে রওনা হওয়ার পথে পাকিস্তানের ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের সৈন্যদের মোকাবিলা হবে বলে আমরা জানতাম। পাকিস্তানী এই ডিভিশনের সঙ্গে কামান ও সাঁজোয়া বহরও ছিলো। আমার বা ভারতীয় বাহিনীর সাথে কোন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ছিলো না। এই কারণে ভারতীয় বাহিনী একটু সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমাদের মূল বাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পথে অগ্রসর হচ্ছিলো। একই সাথে একটি বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নকে চট্টগ্রাম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয় হাটহাজারী এবং চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করার জন্যে। এই জায়গাটি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কয়েক মাইল উত্তরে। আর আমরা মূল বাহিনী মহাসড়ক পথে চট্টগ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে এগিয়ে চললাম।

 চট্টগ্রামের অগ্রাভিযান আমরা ছাগলনাইয়া মুক্ত করার পর ৭ই নভেম্বর ফেনী নদীর সেই স্মরণীয় শুভপুর সেতুর কাছে গিয়ে পৌছি। চট্টগ্রামের পথে আমাদের সামনে এটিই হচ্ছে সর্বশেষ প্রধান বাধা। অবশ্য এরপরও কয়েকটি ছোটখাটো সেতু রয়েছে। শুভপুর সেতুর কাছে গিয়ে দেখি পাকিস্তানীরা সুদীর্ঘ সেতুটির দুটি স্প্যান সম্পুর্ণ ধ্বংস করে রেখে গেছে। আমরা আরো খবর পাই যে তারা ৮ মাইল দুরে মিরেশ্বরাইতে গিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছে।

 তৎক্ষণাৎ ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের ডাকা হয়। তারা যৌথবাহিনীর যানবাহন ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র পার করার জন্য ফেনী নদীতে একটি প্লাটুন ব্রিজ তৈরী করার কাজে লেগে যায়। কিন্তু নতুন সেতুর জন্যে অপেক্ষা না করে আমার সৈন্য দলের একটি অংশকে নিয়ে আমি ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে নৌকাযোগে নদী পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হই। স্বল্পতম সময়ে করেরহাটে আমার সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে আমরা জোরারগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করি। ভারতের ব্রিগেড কমাণ্ডারও করেরহাট পৌঁছে যান। আমার এলাকায় যুদ্ধের জন্য রসদপত্র সংগ্রহই ছিল বড় সমস্যা। আমাদেরকে খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের জন্য পুরোপুরি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিলো। এগুলোর জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আবার তাদের পেছনের ঘাঁটির ওপর নির্ভর করতে হতো। এই ঘাঁটি ছিলো শুভপুর থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে। এই পথটুকুর অধিকাংশ স্থানই ছিলো আবার ভীষণ খারাপ। তাই আমাদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় একটা মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিলো। হয়তো এই কারণেই আমার সঙ্গের ভারতীয় ব্যাটালিয়নগুলো সাবধানে এগুতে চাইছিলো। ভারতীয় কমাণ্ডার যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং রসদের সরবরাহ সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বেশি দূর সামনে অগ্রসর হতে চাইছিলো না। এদিকে শত্রুরা শুভপুর সেতু ধ্বংস করে আমাদের সকলকে আরো সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। এই প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও আমরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। জাতিসংঘে আমাদের জন্য ক্ষতিকারক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং পাকিস্তানের অনুকূলে মার্কিন ৭ম নৌবহরের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পূর্বেই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আমাদের চট্টগ্রাম পৌছতে হবে।

 ইতিপূর্বেই আমি মিরেশ্বরাইয়ের নিকট গেরিলা তৎপরতায় লিপ্ত আমার নিয়মিত কোম্পানী এবং মিরেশ্বরাই ও সীতাকুণ্ডু এলাকার সকল গেরিলা গ্রুপকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম যে, তারা যেন শত্রুর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। ৯ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে প্রতিটি গেরিলা দল মহাসড়ক অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সড়কের দিকে আসছিলো এবং এতে করে ২০ মাইল দীর্ঘ এবং ১০ মইল প্রস্থ জুড়ে এলাকায় এমন একটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো যে, মনে হচ্ছিলো মুক্তিবাহিনীর পুরো একটি কোরই বোধ হয় আক্রমণ চালিয়েছে। সেই রাতেই পাকিস্তনীরা পশ্চাদপসরণের আদেশের জন্য অপেক্ষা না করেই পেছনের দিকে পালিয়ে যায়।

 এদিকে আমরা যখন একটি জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে টিকেয়ে রাখার জন্য লড়াই করছিলাম, আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে তখন চলছিল আরেক খেলা, কিছু আমাদের সমর্থনে আবার কিছু ছিলো আমাদের বিরূদ্ধে। ৫ই ডিসেম্বর নিরাত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির জন্য যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়। পাকিস্তান যখন হেরে যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি মানা হলে ইসলামাবাদেরই তাতে সুবিধা হতো, আর আমরা যেটুকু অর্জন করেছিলাম তাও হারাতাম।

 এরপরের দিন অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করলে তা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং বাংলাদেশের জনগণের মনোবলকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের বন্দীশালায় আটক শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে সেদিন মিসেস গান্ধী বলেছিলেন, এই নবজাত রাষ্ট্রের যিনি জনক, বর্তমান মুহূর্তে আমাদের সমস্ত চিন্তা তাকেই কেন্দ্র করে।

 ৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সৈন্য প্রত্যাহারের একট প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়েছিলো। প্রস্তাবটির উদ্যোক্তা ছিলেন মার্কিন সরকার। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচানোর চন্য যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়েছিলো। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের। বৃটেন, ফ্রান্স এবং অন্য ৮টি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে।

 সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি আমাদের কাছে তেমন বিস্ময়ের কিছু ছিলো না। এতে এমন কিছুই ঘটেনি যা আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। ভারত, পাকিস্তান কিংবা এই মহতী জাতি সংস্থার অন্যান্য সদস্য হয়তো এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য। কিন্তু আমরা তখনো জাতিসংঘের সদস্য নই। এবং তাই এ প্রস্তাব মানতে বাধ্যও নই। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম নির্যাতিত বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষকে মুক্ত করতে। আমাদের এই লক্ষ্যে ছিলো অত্যন্ত পবিত্র আর সেই লক্ষ্যে অর্জনের প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। এমনকি এ সময় যদি ৭ম নৌ-বহর পাকিস্তানের সহায়তা করার জন্য যে কোনোভাবে যুদ্ধজড়িয়ে পড়তো তবুও আমরা এই মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতাম। ৭ম নৌ-বহরের যুদ্ধে যোগদানের ফলে হয়তো বাংলার আরো অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাতো। কিন্তু মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ এ দুটোর কোনটিই তখন এ দেশের মানুষের অজানা কিছু নয়। পাকিস্তানের জন্যে এই যুদ্ধ ছিল নিছক জয় এবং পরাজয়ের। কিন্তু আমাদের জন্যে এই যুদ্ধ ছিলো জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার মরণপণ সংগ্রাম, অন্যথায় সম্পুর্ন নিশ্চিহ্ন হয় যাবার। এ যুদ্ধ আমাদের দেবে গৌরবময় জীবনের সন্ধান নতুবা মৃত্যু।

 ভারতের চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এসএইচএফ মানেকশ যুদ্ধের এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন ৮ই ডিসেম্বর থেকে। যৌথবাহিনীর সাফল্যে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে তিনি এক সময়োচিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (সাইকোলজিক্যাল ওয়ার) শুরু করেন। তার ভাষণ পর্যায়ক্রমে বেতারে প্রচারিত হতে থাকে। অন্যদিকে এই ভাষন প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহায়তায় পাকিস্তানী অবস্থানসমূহের ওপর বিলি করা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সোনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশ্য মানেকশ তার বার্তায় সরাসরি বলেন, অস্ত্র সংবরণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নিয়ে আর কোনো সাহায্য পাবে না। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা। মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ এখন প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সেই সাথে তিনি তাদের এই আশ্বাসও দেন সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।

 মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন একত্রে থেকে কাজ করে আসছিলো। ১০ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমাণ্ডারের অধীনে ভারত এবং বাংলাদেশ বাহিনীর এক যৌথ কমাণ্ড গড়ে তোলা হয়।  এই দিনই (১০ই ডিসেম্বর) ঢাকা রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর সরাসরি এক বিমান হামলায় বেতার প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ভীক্রান্ত এর বিমান বহর তখন চট্টগ্রাম পোর্ট বিমানবন্দর ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কেন্দ্রের ওপর সমানে আক্রমণ যাচ্ছিলো।

 মার্কিন ৭ম নৌ-বহরের টাস্কফোর্স ইতিমধ্যেই মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে দ্রুত বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মার্কিনী এই বহরে ছিল পারমাণবিক শক্তি চালিত বিশাল বিমানবাহী জাহাজ ‘এণ্টারপ্রইজ' এবং আরো ৬টি যুদ্ধ জাহাজ। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অজুহাত ছিলো বাংলাদেশে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্যই ৭ম নৌ-বহরকে এই অঞ্চলে আনা হচ্ছে। এই যুক্তি মার্কিন জনসাধারণের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিলো না, কারণ আমাদের যৌথ কমাণ্ড ১১ই ডিসেম্বর থেকে বিমান হামলা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে ঢাকা বিমানবন্দর মেরামতের সুযোগ করে দেয়। যাতে আন্তর্জাতিক পথের বিমানগুলোতে বিদেশী নাগরিকরা ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এ সময়ে ঢাকা ত্যাগের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

 ততক্ষণে যুদ্ধ সম্পর্কে সবাই স্পষ্ট ধারনা করতে পারছিলো। যৌথবাহিনী সাফল্যের সাথে মেঘনার ওপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের পর সামরিক বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ঢাকার পতন ঘটবে। নিয়াজী অবশ্য তখনো নিরাপদে ঢাকায় বসে হুংকার দিচ্ছিলেন, প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য একটি প্রাণ বেচেঁ থাকা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। রাও ফরমান আলী কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন। খেলা শেষ। বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা যে জঘন্য অপরাধ করেছিলো, অপারেশন জেনোসাইডের অন্যতম স্তপতি ফরমান আলী সে বিষয়ে পুরো সচেতন হয়ে পড়েছিলেন। পরাজয় তখন অবশ্যম্ভাবী। মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষ পাবার উদ্দেশে ১১ই ডিসেম্বর তিনি যুদ্ধ বিরতির জন্য জাতিসংঘ সদর দফতরে এক আবেদন জানান। ফরমান আলী এখনকার সকল পাকিস্তনীকে অপসরণের ব্যবস্থা করারও অনুরোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘকে জানিয়ে দেন যে, ফরমান আলীর প্রস্তাব অনুমোদিত। ইয়াহিয়ার তখনো আশা, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাকে উদ্ধার করতে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। নিয়াজীকে তিনি আরেকটু অপেক্ষা করার জন্য নির্দেশ দেন।

 চীন বেধহয় একা অজুহাতের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আর ৪ঠা ডিসেম্বর মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে।

 চট্রগ্রাম সেক্টরে আমাদের সকল সৈন্য ৯ই ডিসেম্বর বিকালের মধ্যে শুভপুর সেতু বরাবর ফেনী নদী পার হয়ে যায়। সামনে শত্রুরা কোথায় কি অবস্থায় আছে পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা যথারীতি টহলদার দল আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পাকিস্তানীরা মিরেশ্বরাই ছেড়ে যাচ্ছে বলে ১০ই ডিসেম্বর একজন গেরিলা বেস কমাণ্ডার আমাকে খবর দেয়। মিরশ্বরাই থেকে ১৫ মাইল দূরে গিয়ে সীতাকুণ্ডুতে তারা নাকি নতুনভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমি সাথে সাথে মিরেশ্বরাই দখল করার জন্য একটি ব্যাটালিয়ন পাঠিয়ে দেই। তখনো আমাদের কোনো যানবাহন ফেনী নদী পার হতে পারেনি। ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের তাই পায়ে হেঁটেই অগ্রসর হতে হচ্ছিলো। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও মালপত্র নেওয়ার জন্য কয়েকটি রিকশা ও গরুর গাড়ি জোগাড় করা হয়।

 বিকেলে আমি পরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে একখানি রিকশায় মিরেশ্বরাইয়ের দিকে যাত্রা শুরু করি। আমাদের ব্যাটালিয়নও তখন একই দিকে মার্চ করে যাচ্ছিলো। পথে তাদের পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাই। অবশ্য এই ভাবে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পাকিস্তানীরা ঠিক কোথাও রয়েছে কিনা তখনো আমরা তা জানতাম না। তারা সকলেই মিরেশ্বরাই ত্যাগ করেছে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা ছিলো না। তবু আমি ঝুঁকিনিয়ে মিরেশ্বরাই পৌছে দেখি একটু আগে শত্রুসেনারা সে স্থান ছেড়ে চলে গেছে। স্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা মিরেশ্বাই হাইস্কুল ভবনে আমার সাথে একত্র হলেন। পাকিস্তানীরা আবার রাতে ফিরে আসতে পারে বলে তারা আশংকা করছিলেন। আমাদের তখন অত্যন্ত দ্রুত চট্টগ্রাম দখল করা দরকার। তাই মিরেশ্বরাইতে আমরা দ্রুত প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুললাম। এপ্রিল ও মে মাসে এই অঞ্চলেই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, তাই পুরো এলাকাটি আমার এবং আমার অধিকাংশ সৈন্যেও কাছে ছিলো সুপরিচিত। মিরেশ্বরাইতে আমরা বেসামরিক প্রশাসন চালু করি। করেরহাটে অবস্থানরত ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরুপকে আমার নতুন অবস্থানের কথা জানিয়ে তাঁকে সত্বর এখানে চলে আসার অনুরোধ জানাই। চট্টগ্রামের পথে শত্রুসেনার সঠিক অবস্থান জানার জন্য একটি টহলদার দলকে পাঠিয়ে দেই মিরেশ্বারই থেকে সীতাকুণ্ডের দিকে। ভোরেই আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। তাই মিরেশ্বরাই হাই স্কুলে সে রাতটা কাটালাম।

 পরের দিন স্বল্পকালীন সংঘের্ষের পারই সীতাকুণ্ডে শত্রুদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সীতাকুণ্ড অতিক্রম করার পর ১৩ই ডিসেম্বর কুমিরায় পৌছে আমরা পাকিস্তানীদের শক্তিশালী ঘাঁটির সম্মুখীন হই। ভূমি বৈশিষ্ট্যের কারণে এই জায়গাটি শত্রুদের খুবই অনুকূলে ছিলো। পশ্চিমে সাগর এবং পূর্বে উঁচু পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু এলাকা জুড়ে পাকিস্তানীদের সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে বসেছিলো। সড়কের এক স্থানে গভীর খালের ওপর সেতুটি ওরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। রাস্তার ওপর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উঁচু পাহাড়ে যক্ষ্মা হসপাতালের কাছে ছিলো তাদের মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। আমাদের কয়েকজন সংঘর্ষে হতাহত হলেও পরদিন সকালের মধ্য আমরা পূর্বদিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হই। বেসামরিক জনসাধারণ শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের খরাখবর দিচ্ছিলো। সংবাদ অনুযায়ী সঠিক লক্ষ্যস্থলের ওপর কামান দেগে ওদের ঘায়েল করছিলাম। ১৪ই ডিসেম্বর ভোর রাত ৩টায় আমরা কুমিরা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করে ফেলি। চট্টগ্রাম এখন মাত্র ১২ মাইল দূরে। কুমিরা মুক্ত হওয়ার মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের যানবাহন এবং কামানগুলো ভাঙা সেতু এড়িয়ে খাল পার হতে শুরু করে। কয়েক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু ভাঙা সেতুর কাছে জমায়েত হয়ে আমাদের সাহায্য করেছিলো। একদল খালের খাড়া পার কেটে ডাইবারসন রোডের ব্যবস্থা করছিলো। অন্য দল আবার গাছ, পাথর, মাটি যা কিছু পাচ্ছিলো তাইদিয়ে খাল ভরে ফেলার চেষ্টা করছিলো। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। এই সময় এক বৃদ্ধা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা, চিন্তা করো না। এ কাজ আমরাই পারবো। দ্যাকো তোমাদের মালপত্র আর গাড়ি-ঘোড়া কিভাবে পার করার বন্দোবস্ত করছি। দরকার হলে আমরা সবাইখালে শুয়ে পড়বো। আর তার ওপর দিয়ে তোমাদের গাড়ী পার করার ব্যবস্থা করবো। দেরি করো না বাবা। প্রত্যেক মুহূর্তে তারা আমাদের লোক মারছে। বৃদ্ধা একটু থামলেন। তার দুই চোখ পানিতে ভরে গেছে। বৃদ্ধা বলে চললেন, তোমরা জানো না, কিছুদিন আগে ঈদের সময় চাটগাঁওয়ে একটি লোকাল ট্রেন থামিয়ে তারা সকল বাঙালী যাত্রীকে খুন করেছে। প্রায় এক হাজার হবে। দা ছুরি এসব দিয়ে মেরেছে। আমার মেয়ে আর নাতি নাতনিও ছিলো আর বলতে পারবো না তোমরা এগিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাও। তিনি আমাকে প্রায় ঠেলে দিয়েই আবার কাজে ফিরে গেলেন। আমিও পাকিস্তানীদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছিলাম। তবে চট্টগ্রামের সর্বশেষ যে খবর আমি পেয়েছিলাম, তা ছিলো আরো ভয়াবহ। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করেছিলো চট্টগ্রাম শহরের কয়েক হাজার বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যা করতে। এটা ছিলো তাদের শেষ মরণ কামড়।

 ততোক্ষণে বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌ-বহরের অনুপ্রবেশে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছিলো। চট্টগ্রামের কোন সমুদ্র উপকূলে টাস্কফোর্স-এর মার্কিন বাহিনী অবতরণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছিলো। তাই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা চট্টগ্রাম মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই। সেই উদ্দেশ্য ভারতের ২৩ ডিভিশনের ৮৩ ব্রিগেড লাকসাম থেকে দ্রুত যাত্রা শুরু করে এবং কুমিরার কাছে আমাদের সাথে যোগ দেয়। অন্যদিকে ভারতের বিমানবাহিনী ও ইস্টার্ন ফ্লিট পাকিস্তানী অবস্থানগুলোর ওপর অবিরাম বোমাবর্ষণ করে চলেছিলো। এখানকার পাকবাহিনীকে ধ্বংস করা এবং পোর্ট অচল করে দেয়ার জন্যই এই আক্রমণ চলছিল। বোমার আঘাতে জ্বালানি তেলের ট্যাংকগুলো কয়েকদিন ধরে জ্বলছিল। ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিমজ্জিত জাহাজের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। ডুবন্ত চ্যানেল প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। পোর্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিলো ব্যাপক। ৫০০ এবং ১০০ পাউণ্ড বোমার গর্তগুলোর ভরাট এবং ধ্বংসস্তূপ পরিস্কার করতে পরে সময় লেগেছিলো এক বছরেরও বেশি।  মুক্তিযোদ্ধারা খবর নিয়ে এলো যে কিছু পাকস্তানী অফিসার ও সৈন্য কক্সবাজার হয়ে স্থলপথে পালাবার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবার জাহাজে করে কেটে পড়বার চেষ্টা করছে। কয়েকটি পাকিস্তানী জাহাজকে বিদেশী জাহাজের মতো রং লাগিয়ে এবং বিদেশী পতাকা উড়িয়ে ছদ্মবেশে পালাবার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই খবর ভারতের ইস্টর্ন ফ্লিটকে পাঠালে ইস্টার্ন ফ্লিট সতর্ক হয়ে যায়। ছদ্মবেশে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি পাকিস্তানী জাহাজ ভীক্রান্ত-এর গোলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 বার্মা দিয়ে পাকিস্তানীদের পালাবার চেষ্টা বন্ধ করার জন্য এ সময়ে কক্সবাজারে একটি অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই উদ্দেশ্যে রোম ফোর্স নামে এক নতুন বাহিনী সৃষ্টি হয়। এই বাহিনীতে ছিলো ভারতের ১/২ গুর্খা রাইফেলস এবং ১১ বিহার রেজিমেণ্টের দুটি কোম্পনী। মর্টার সজ্জিত এই বাহিনী ভারতের একখানি সওদাগরী জাহাজে ১৪ই ডিসেম্বর কক্সবাজারের উপকূলে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় রোম ফোর্স তীরে অবতরণ করে। কিন্তু ঐ এলাকায় কোনো পাকিস্তনীকে অবশ্য তারা পায়নি।

 ১৫ই ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের চীফ অব আর্মি স্টাফের কাছ থেকে নিয়াজী শেষ নির্দেশ লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আত্মসমর্পণের যে শর্ত দিয়েছেন যুদ্ধ বিরতির জন্য তা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে এত নিয়াজীকে পরামর্শ দেয়া হয়। এই রাতেই দুটার মধ্য বাংলাদেশের যে সব স্থানে পাকিস্তানী সোনাদল অবস্থান করেছিলো নিয়াজী তাদেরকে ওয়্যারলেস যোগে যুদ্ধ বিরতি পালন এবং যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করা নির্দেশ জারি করে দেন।

 রাত শেষ হয়ে আসে। ১৬ই ডিসেম্বর শেষ রাতের দিকে ভারতীয় ৯৫ মাউণ্টেন ব্রিগেডের কমাণ্ডে নিয়োজিত ব্রিগেডিয়ার ক্রেয়ার নিয়াজীর হেড কোয়ার্টারের একটি অয়ারলেস মেসেজ ইণ্টারসেপট করেন। এই বার্তায় ভোর ৫টা থেকে নিয়াজী তার সকল সেনাদলকে যুদ্ধ বিরতি পালন করতে বলেছিলেন। ক্লেয়ার সাথে সাথে এই অয়ারলেস বার্তার কথা জেরারেল নাগরাকে জানিয়ে দেন পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর ব্রিগেড কমাণ্ডার এবং ডিভিশনাল কমাণ্ডার মিরপুর ব্রিজের কাছে দ্বিতীয় ছত্রী ব্যাটালিয়ন যেখানে অবস্থান করছিলো সেখানে পৌছান। সেখানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন থেকে তার জানতে পারলেন যে ভোর ৫টার পর ব্রিজের কাছে আর গেলাগুলি হয়নি। এরপর জেনারেল নাগরা তার একজন এডিসি এবং ভারতীয় ছত্রী ব্যাটালিয়নের একজন অফিসারকে শ্বেত পতাকাবাহী একটি জিপে করে ব্রিজের অপর পাড়ে পাঠিয়ে দেন। তখন বেলা ৯টা। জীপের আরোহীরা নিয়াজীর উদ্দেশে লেখা জেনারেল নাগরার একটি বার্তা বহন করছিলো। রণক্ষেত্রের করোতার পরিবর্তে বার্তাটিতে নাটকীয়তাই ছিলো একটু বেশী। জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এবং জেনরেল নাগরা দুজন ছিলেন ব্যাক্তিগত জীবনে পরিচিত সম্ভবত তাই বার্তাটিতে ছিলো নরম সুর। প্রিয় আবদুল্লাহ আমি এসে পড়েছি। তোমার সব বাহাদুরী আর খেলা শেষ। আমার কাছে এখন আত্মসমর্পণ করবে, এই আমার উপদেশ। পাকিস্তানের জন্য সত্যই তখন সকল খেলা শেষ। নিজ বাহিনীর প্রতি যুদ্ধ বিরতি এবং আত্মসমর্পণ করার যে নির্দেশ নিয়াজি জারি করেছিলেন, ১৬ই ডিসেম্বর সকালেই তা ভারত সরকারকে জানিয়ে দেয়ার জন্য তিনি ঢাকাস্থ মার্কিন সামরিক এ্যাটচিকে অনুরোদ করেন। তার অনুরোধ যথারীতি ভারতে মার্কিন দুতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে জানানো হয়।

 চট্টগ্রাম এলাকায় আমরা তখন কুমিরার দক্ষিণে আরো কয়েকটি স্থান শত্রুমুক্ত করে ফেলেছি। আমাদের যাত্রা বিম্বিত করার উদ্দেশ্য এসব জায়গায় কিছুকিছু পাকিস্তানী সৈন্য অবস্থান করছিলো। পথের সকল বাধা পরাভূত করে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা ভাটিয়ারীর শক্তিশালী শত্রু ঘাঁটির সম্মুখীন হই। একান থেকে ফৌজদারহাট এলাকা পর্যন্ত পাকিস্তানীরা দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো। এখানে তাদের অধিকাংশ সৈন্য এবং সমরাস্ত্র এনেও মোতায়েন করেছিলো। আমাদের লক্ষ্য ছিলো কিভাবে এই কমপ্লেক্স আমরা ধ্বংস করতে পারি। যুদ্ধ করতে করতে ওরা যদি চট্টগ্রাম শহরে মধ্য দিয়ে গিয়ে অবস্থান করতে পারে তাহলে আমরা পড়বো বিপদে। বাড়িঘর অধ্যুষিত এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রতিটি বাড়িই আত্মরক্ষাকারীর আড়াল হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে। সেই পরিস্থিতিতে শহরের মধ্যে পা বাড়ানো আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে।

 তাই ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রামের মাঝখানে শত্রুদের অবরোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেই। উদ্দেশ্য ছিলো ভাটিয়ারী এবং ফৌজদারহাটে অবস্থান গ্রহণকারী সৈন্যরা যেন পেছনে গিয়ে শহরে প্রবেশ করতে না পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রু বাহিনীর পেছনে আমাদের সৈন্যরা তাদের পশ্চাদপসরণের পথ রুদ্ধ করে রাখবে এবং সামনে থেকে আমাদের অবশিষ্ট অংশ আক্রমণ চালাবে। অভিযানের এই পদ্ধতি কতটা “ঘাড়ে ধরে মুখে আঘাত করার মতো” বলা যেতে পারে। সেই অনুসারে ভারতের ৮৩ ব্রিগেডের দুটি ব্যাটালিয়ন ২ রাজপুত এবং ৩ ডোগরাকে পেছনের পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়। ভারতের তৃতীয় আরেকটি ব্যাটালিয়ন সম্মুখে সমরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেয়। পূর্বোক্ত ব্যাটালিয়ন দুটি রাতের আঁধারে সড়ক থেকে প্রায় ১৫ মাইল পূর্ব দিক দিয়ে পাহাড়ী রাস্তা ধরে ফৌজদারহাটের কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে আবার সড়কে উঠবে এবং সেখানে রাস্ত বন্ধ করে অবস্থান গ্রহণ করবে এই ছিলো তাদের প্রতি নির্দেশ। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে অগ্রসরমান এই দলের মালামাল বহনের জন্য প্রায় ১২০০ বেসামরিক লোক জোগাড় করা হয়। প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এই বাহিনীর সাথে থাকবে যাতে তারা অন্তত ৪ দিন চলতে পারে। খাদ্যদ্রব্য, গোলাবারুদ, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, মর্টার, মাটি খোঁড়ার সরঞ্জাম, রান্নার উনুন এবং অন্যান্য তৈজসপত্র এ পুরো দুটি ব্যাটালিয়নের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই বহন করতে হবে। এছাড়া বেসামরিক লোকজন যারা যাবে তাদের খাদ্য এবং কিছু জ্বালানি কাঠও সঙ্গে থাকবে।

 ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার কিছু আগেই ব্যাটালিয়ন দুটি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে। স্থনীয় কিছু লোক আগে আগে যেতে থাকে গাইড হিসেবে। এই অভিযানের সাফল্যের উপরই চট্টগ্রামে আমাদের চুড়ান্ত লড়াইয়ের ফলাফল নির্ভর করছে।

 ইতিমধ্যে আমার নির্দেশে মিরেশ্বরাই এবং সীতাকুণ্ড এলাকার প্রায় ২০০০ গেরিলা একত্র হয়ে কয়েকটি নির্ধারিত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। যথাসময়ে তাড়াও লড়াইয়ে যোগ দেবে। শহর এলাকা সম্পর্কে ভালো ভাবে জানে বলে রাস্তায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা খুব কাজে লাগবে। তাই এদেরকে একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখলাম।

 ভাটিয়ারীতে ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা পাকিস্তানীদের প্রথম রক্ষাব্যূহের ওপর আক্রমণ চালাই। দুটি কোম্পানীর এই আক্রমণ ওরা প্রহিত করে দেয়, আমাদের পক্ষে হতাহত হয় ২জন। ১৬ই ডিসেম্বর অগ্রবর্তী দলটি শত্রুর পেছনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করার পরই আমাদের আসল আক্রমণ শুরু হবে। তাই আমরা পরের দিন প্রধান হামলা চালাবার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করি।

 ঢাকার অদূরে ভারতীয় জেঃ নাগরা যে দুজন অফিসার জেঃ নিয়াজীর কাছে পাঠিয়েছিলেন তার ২ ঘণ্টা পর ১১টার দিকে ফিরে আসেন। তাদের জীপের পেছনে পেছনে একখানি গাড়ীতে করে আসেন পাকিস্তানের ৩৬ ডিভিশনের কমাণ্ডার চেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ। জেনারেল নিয়াজীর সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এরপর নাগরা এবং আরো কয়েকজন অফিসারকে জামসেদের হেডকোয়ার্টারে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে তারা নিয়াজীর অফিসে যাওয়ার প্রাক্কলে নাগরা কলকাতাস্থ ইস্টার্ন কমাণ্ডের হেডকোয়ার্টার এবং ৪র্থ কোরের হেডকোয়ার্টারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যথারীতি খবর পাঠিয়ে দেন। এর আগে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নিয়াজী অয়্যারলেস যোগে মানেকশকে আত্মসমর্পণের সর্বশেষ মেয়াদ আরও ৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আরো অনুরোধ করেন যে, আত্মসমর্পণের শর্তাবলী নির্ধারণ করার জন্য তিনি যেন একজন সিনিয়র ভরতীয় সামরিক অফিসারকে ঢাকা পাঠিয়ে দেন।  এতসব ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা ভাটিয়রীতে তখন যুদ্ধে লিপ্ত। আমাদের অগ্রবর্তী দল সাফল্যের সঙ্গে পাহাড়ী পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কথা ছিলো ১৬ই ডিসেম্বর কোন এক সময়ে তারা শত্রুর পেছনের দিকে রাস্তা বন্ধ করে অয়্যারলেসে সে খবর আমাদেরকে জানিয়ে দেবে। আমরা সবাই তখন তাদের খবর শোনার জন্য রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম।

 নাগরার কাছ থেকে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে জেনারেল অরোরা তার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবলকে বিমানযোগে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ততক্ষণ মিরপুর যৌথবাহিনী ব্রিজ পার হয়ে ঢাকয় প্রবেশ করতে শুরু করে। এ সময়ে নগরীর রাস্তাঘাট ছিলো জনমানবশূন্য।

 মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সৈন্যদের রাজধানীতে প্রবেশের খবর দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লাসের জোয়ারে ঢাকার লক্ষ লক্ষ লোক নেমে আসে রাস্তায়। জনমানবহীন নিঃশব্দ নগরী মুহূর্তে ভরে উঠে মানুষের বিজয় উল্লাসে। ওরা এসেছে এই বাণী উচ্চারিত হতে থাকে মানুয়ের মুখে মুখে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনি ওঠে জয় বাংলা সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যৌথ বাহিনীর জন্যে মানুষ এগিয়ে আসে ফুলের ডালি নিয়ে হৃদয়ের গভীর আর ভালোবাসা নিয়ে।

 ঢাকায় সেদিন একদিকে চলছিলো মানুষের বিজয় মিছিল। তারই পাশাপাশি ছিলো পরাজিত পাকিস্তানীদের পলায়নের হাস্যকর দৃশ্য। কিন্তু মানুষ যে কতো জিঘাংসাপরায়ণ হতে পারে পাকিস্তানীরা তার এক নতুন নজীর সৃষ্টি করেছিলো। পালিয়ে যাবার সেই মুহূর্তেও পাকিস্তানীরা বিভিন্ন নিরীহ মানুষের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ফলে বহু নিরীহ বাঙালী হতাহত হন।

 আত্মসমর্পণের একটি খসড়া দলিল সহ মেজর জেনারেল জ্যাকব বেলা ১টায় জেনালে অরোরার হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকা এসে অবতরণ করলেন। বেলা ২টা ৫০ মিনিটে জেনারেল অরোরা তাঁর সৈনিক জীবনের সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত বার্তাটি পেয়ে গেলেন। জীবনে খুব কমসংখ্যক সেনানায়কই এমন বার্তা পেয়েছেন। বার্তাটি ছিলো, নিয়াজী তার সেনাবাহিনীর সকলকে নিয়ে আত্মসমর্পণে রাজী হয়েছেন এবং আত্মসমর্পণের দলিলেও স্বাক্ষর করেছেন। পশ্চিম সেক্টরে পাকিস্তানী ৯ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনসারীর আত্মসমর্পণ পর্বর ততোক্ষণে সাঙ্গ হয়েছে। বিকাল ৩টার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর শত শত তরুণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড বিজয়ীর বেশে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য জেলারেল অরোরা তার বিমান ও নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফকে নিয়ে একটু পরেই ঢাকায় অবতরণ করলেন।

 আমার বিশ্বস্ত জেসিও সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা এতসব ঘটনার কিছুই অবহিত ছিল না। দুজনাই তখন ভাটিয়ারীতে অন্যান্যের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ। পাকিস্তানীদের একটি খালের অপর পারে হটিয়ে দিয়ে পুনরায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য তারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। অল্প বয়স্ক ছেলেটি কাছেরই এক গ্রামের। তাদের গ্রাম এর আগেই শত্রুমুক্ত হয়েছে। মা-বাবার সাথে দেখার করার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর তাকে ১২ ঘণ্টার ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো, না স্যার। চট্টগ্রাম মুক্ত করার পরই আমি বাড়ি ফিরবো। কয়েকদিন বা আর লাগবে। আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীর নির্দেশ তখনো তার সকল সেনাদলের কাছে পৌঁছেনি। আমরা জানতাম না যে, বেলা ৪টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হচ্ছে।

 চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল দূরে মহাসড়কের ওপর ভাটিয়ারী দখলের জন্য আমরা তখন লড়াই করছি। আক্রমণ চালাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী। ঘড়িতে তখন বেলা ৪টা ৩০ মিনিট। ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় অস্ত্রের গর্জন থেমে গেছে। নিয়াজী এবং অরোরা হয়তো হাতে কলম নিয়ে আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করছেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস। ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকা ঢেকে ১৬০ মাইল দূরে পাকিস্তনীদের একটি কামানের গোলা আমার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধা এই কোম্পানীর মাঝখানে এসে পড়লো।  সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের সেই ছেলেটি দুজনই গোলার আঘাতে আহত হলো। আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেল, সেই সাথে বাতাসে মিলিয়ে গেলো তাদের শেষ নিঃশ্বাস। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একজন পাকিস্তানী মেজর ভাটিয়রীর ভাঙা ব্রিজের মুখে এসে দাঁড়ালো। হাতে তার শাদা পতাকা। তারা নিয়াজীর নির্দেশ পেয়ে গেছে, এখন আত্মসমর্পণ করতে চায়।

পরিশেষ

 রণাঙ্গণে এবার নেমে আসে প্রশান্ত নীরবতা।

 রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার, কামানের গোলাগুলির শব্দ থেমে যায়। থেমে যায় আহতের কান্না, মুমূর্ষের করুণ আর্তনাদ। নতুন এই রাত্রির প্রহর আসে কোন এক হারানো অতীতের শান্তির স্বপ্ন নিয়ে। এমনি সুন্দরের স্বপ্নে আবহমানকাল ধরে মানুষের সংগ্রাম চলেছে।

 ভাটিয়ারীতে মহাসড়কের ওপর সেতুটি পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্বেচ্ছাসেবক ১৬ই ডিসেম্বর সারারাত কাজ করলো ভাটিয়ারীর খালের মধ্য দিয়ে একটা বিকল্প রাস্তা তৈরী করতে। রাতেই আমরা সমস্ত সৈন্য এবং গেরিলাদের চট্টগ্রাম শহরে এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় নিয়ন্ত্রণ্ডার গ্রহণ করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই। ফেনীর অংশবিশেষসহ শুভপুর পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণভার আমরা আগেই নিয়েছিলাম। আমার সম্পূর্ণ বাহিনীকে পর দিন খুব সকাল বেলায়ই চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণের নির্দেশ দিলাম। একটি ব্যাটালিয়নকে অবশ্য রাতেই খাল পার হয়ে শহর অভিমুখে যতোদূর সম্ভব এগিয়ে অবস্থান গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেই।

 শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সার্কিট হাউসকে আমার হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হলো পোর্ট এলাকায় নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে আত্মসমর্পণের জন্য জমায়েত হতে। পাকিস্তানী বন্দীদের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবহিনীর উপর ন্যস্ত হয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌ ও বিমান বাহিনী সমপর্যায়ের লোক এবং তিন বাহিনীর ৮,৬১৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

 ১৭ই ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত বিকল্প রাস্তার কাজ সম্পন্ন হলো না। ফলে তখন পর্যন্ত সে স্থান দিয়ে গাড়ী পার করাও সম্ভব ছিল না। আমি পুলের এপাড়ে গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম একটা ছোট প্যাকেট হাতে নিয়ে। তারপর একটা লাঠিতে ভর দিয়ে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। দুদিন আগে কুমিরার যুদ্ধে আহত হওয়ায় আমাকে লাঠিতে ভর দিয়ে বেশ খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছিলো।

 পাকিস্তানীদের আত্মসম্পর্ণের ব্যাপেরে লোকজন তখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও শহরের কিছু লোক আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ভাটিয়ারীর ভাঙা সেতু পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলাম। আমি আমার এক বন্ধুর গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ী ছুটে চললো সোজা সার্কিট হাউসের দিকে।

 অগণিত নারী-পুরুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে তারা হাত তুলে যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিলো। জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বোধ হয় তখনো পুরো বিশ্বাস করতে পারেনি যে সত্যিই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তারা সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখছিল। পাকিস্তানীদের তখন অস্ত্র সংবরণের পালা। বাস ও ট্রাকে করে তারা দ্রুত ছুটে পালাচ্ছিলো নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার এবং ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে।

 সার্কিট হাউস তখন বহু লোক জমা হয়ে গেছে। জনতার ভিড় ঠেলে আমি এগিয়ে যাই। যুদ্ধের এই কয় মাসে আবার দাড়ি বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় অনেক বন্ধু এবং পরিচিতজনই আমাকে চিনতে পারলো না।  এমনি একটা সুন্দর মুহূর্তের জন্য সযত্নে এই প্যাকেটটি সাথে রেখেছি দীর্ঘ নয় মাস। এবার ওটাকে খুলে ফেললাম। সুন্দর করে ভাজ করা বাংলাদেশের পতাকাটি একটা কিশোর ছেলেরা হাতে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলাম সার্কিট হাউসের ছাদে। সেখানে তখনো পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিলো। ছেলেটি পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় নিচে। সেখানে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বেও প্রতীক জাতীয় পতাকা। সে সময় হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে আসছে সার্কিট হাউসের দিকে। সমস্ত এলাকা ভরে গেছে মানুষের ভিড়ে। পতাকা উত্তোলনের সময় মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয় উত্তাল জনসমুদ্র অবিস্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য। তারপর বাতাসের দোলা লাগে, উড়তে থাকে নতুন পতাকা। নিস্তব্ধ নতা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সেই জনসমুদ্রে ওঠে জয়ধ্বনি জয় বাংলা।

 পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী ধ্বংসের পথযাত্রী একটা জাতি পেয়ে গেল স্বাধীনতা। দুঃস্বপ্নের রাতের শেষে সেই পতাকার রক্তিম সূর্য বাংলার মানুষের জন্য নিয়ে এলো নতুন আশার বাণী। সমস্ত পৃথিবীতে সেই বিজয়ের বার্তা পৌছে দিতে যেন মানুষ এক যোগে মুহূর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে জয় বাংলা। শহরের প্রতিটি প্রান্ত থেকে তেমনি আবেগে লক্ষ কণ্ঠ ধ্বনিত হতে লাগলো জয় বাংলা। খুলে গেল সমস্ত আবদ্ধ দুয়ার বাঁধভাঙা স্রোতের মত বেরিয়ে আসে সকল মানুষ। দীর্ঘ দিনের দুঃসহ যন্ত্রণার শেষে তারা উপভোগ করতে চাইলো উষ্ণ সূর্যালোক, মুক্ত বাতাস, সুন্দর সম্ভাবনাময় নতুন স্বাধীনতা। ভয়াবহ গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা বেঁচে থেকে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারছে এ কথা যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবুও সেই সব মানুষ বেঁচে আছে। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সোনালী সূর্যের আলোকে মানুষ বিস্ময়ে চেয়ে থেকে বাংলার নতুন পতাকার দিকে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকাকে অভিবাদন জানিয়ে আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্য, অবাক বিস্ময়ে। ভুলে গেলাম আমার চারপাশের উত্তাল জনসমুদ্রের কথা। তখন ৯টা ১৫ মিনিট, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১সাল।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন আকারের নতুন জাতীয় পতাকা শোভা পেতে লাগলো। শুধু ঘরের ছাদই নয়, গাছপালা, লাইটপোস্ট, দোকানপাট যেখানেই সম্ভব সেখানেই মানুষ উড়ালো নতুন পতাকা। উৎসবের সাড়া পড়ে গেলো সমস্ত শহরে। যুদ্ধের নয় মাস এমনি একটা সুন্দর মুহূর্তের জন্যে প্রায় প্রতিটি বাঙালীর ঘরেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা। ধরা পড়ে অনেকে আবার পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে।

 দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচাইতে বেদনাময় ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটলো হয়তো বা সাময়িকভাবে। এই নিষ্ঠুর ঘটনা ছিল অবিশ্বাস্য, আর তাই হয়তো এখানে কান্নায় ভাষারও হারিয়ে গিয়েছিলো। বিকৃত বিকারগ্রস্ত রক্তলিপ্সু পাকিস্তানীরা নিরীহ নারী-পুরুষ এবং শিশু হত্যার নৃশংসতায় হিটলারের নাজী বাহিনীকেও হার মানিয়েছিলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বনকারী দুটি সরকার ছাড়া আর সমস্ত পৃথিবীর সরকার একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিলো হিটলারের গণহত্যার বিরুদ্ধে। অথচ বাংলাদেশের পাকিস্তনীরা যখন গণহত্যা চালালো তখন এইসব সরকারের কয়েকটি পাকিস্তনীদের বিরুদ্ধে না গিয়ে বরং ইয়াহিয়াকে গণহত্যায় সহায়তা করলো। একটা কঠিন সত্য পৃথিবীর মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমান্বয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকেরই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। তাদের মুখে মানবতার বুলি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

 বিজয়ের মধ্য দিয়ে নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটলো। বাংলার মানুষ আবার তার নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করলো। পথে-প্রান্তরে পর্বতাঞ্চলে নদনদী খালে বিলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বাঙালী আবার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। ছায়ার মতো অনুসারী মৃত্যুর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবে না আর। রাতের অন্ধকারে প্রতিটি অচেনা শব্দ মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি হয়ে আসবে না। চারদিকে আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ। ২৫শে মার্চের সেই ভয়াভহ রাতের পর এই প্রথম মহিলারা নির্ভয়ে বেরুতে পারলো। ঘরের বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছুটে চলছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাত মেলাতে। মার্চ করে চলছে মুক্তিবাহিনী। পথের দুই পাশে উচ্ছ্বসিত জনতা তাদের জানাচ্ছে প্রাণঢালা অভিনন্দন। সুখী মানুষের আনন্দ কোলাহলের সে এক অভূতপূর্ব সমাবেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে কেউ। অনেকে গাইছে গান। নির্মল হাসিতে যেন সমস্ত মানুষের রূপ উদ্ভাসিত। কারো চোখে ছিল সুখের অশ্রুজল। একজন আনন্দের আতিশয্যে বাঁধ ভাঙা চোখের জল সামলাতে গিয়ে শাড়ির আঁচল কামড়ে রেখেছেন দৃঢ়ভাবে। কাছেই কোথাও মাইকে বাজছিল অতি প্রিয় সেই গান “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”। এমনি অনেক ফুলের মত জীবনকে হয়তো আমরা যুদ্ধ করে বাঁচাতে পেরেছি। আবার অনেকেই আমরা বাঁচাতে পারিনি। আমার মনে হলো সেই সব শহীদের কথা, যারা নিজ দেশে বন্দির মতো জীবন যাপন করছিলো। পাকিস্তানীরা এদেশকে পরিণত করেছিল বন্দীশালায়। যেখানে তার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে রেখেছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। সেই বন্দিশালায় পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত অসংখ্য মানুষের ত্যাগ আর গভীর জীবনবেদনা ছিল এতই মহান যে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আমি অনুচ্চ স্বরে বললামঃ

“... এবং শান্তি, আর যুদ্ধ নয়-
তোমাদের বিদেহী আত্মার জন্য
চাই শুধু শান্তি, যুদ্ধ নয়।
এই বন্দীশালা, এখানেই ছিল
তোমাদের তীর্থের জীবন।”

 ইতিহাসের এই মর্মান্তিক নাটকের যবনিকাপাত সে কি বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত নাকি শোকের বেদনায় আপ্লুত? অথবা সেখানে ঘটেছে বিজয় আর বেদনার অপূর্ব সংমিশ্রণ? এই নির্মম ও অচিন্তনীয় গণহত্যাকে কি পৃথিবীর মানুষ ইতিহাসের পালাবদলের অমোঘ বিধান বলেই সমস্ত দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে?

 সার্কিট হাউসের সামনে সবুজলনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম সেই বিষাদময় সমস্ত ঘটনার কথা। যুদ্ধের নয় মাসের শহীদদের কথা আবার মনে পড়লো। পাকিস্তানীরা এদের হত্যা করেছিলো গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে শহরে-মসজিদে-মন্দিরে। অনেককেই ধরে নিয়েছিলো আরো নিষ্ঠুরভাবে অশেষ যন্ত্রনা দিয়ে হত্যা করার জন্য। বাংলার এই অসহায় মানুষগুলো আর কোনো দিনই ফিরে আসবে না। কিন্তু পাকিস্তানীরা যখন এদেরকে বেঁধে নিয়ে যেতো হত্যা করার উদ্দেশ্যে সেই মুহূর্তে এই সব অসহায় মানুষ কি ভাবতো কে জানে? তাদের আপজনেরই বা কি গভীর মর্মবেদনায় ভেঙ্গে পড়তো চিরবিদায়ের সেই মুহূর্তে? এইসব মানুষকে যখন পাকিস্তানীরা লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করতো, রাস্তায় টেনে নিয়ে যেতো জীপের পেছনে বেঁধে, বেয়োনেট আর রাইফেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতো তখন মৃত্যুপথযাত্রী সেই সব মানুষ কি ভাবতো আমরা কোনো দিন তা জানবো না। নিষ্পাপ শিশু, অবলা নারী, অসহায় বৃদ্ধ এদের কেউই সেদিন রক্ষা পায়নি। পাকিস্তানীদের হাত থেকে।

 সেই সব প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। আমার চিন্তায় বাধা পড়লো। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন আমার দিকে। যুদ্ধে তার ছেলে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। মুখে তাঁর হাসি নেই নেই অশ্রুজল। তিনি শান্ত, অতিশান্ত। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি গভীর প্রশান্তিতে চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ।

 মানব হৃদয়ের সেই অব্যক্ত বেদনা কেউ কোন দিন বুঝতে পারবে না।

১ নম্বর সেক্টরের কতিপয় গেরিলা অপারেশন

[মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম, বীর উত্তম-এর ২০ মার্চ ১৯৮৩ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকার থেকে]

 Of the numerous raids, ambushes and attacks in all the sectors, a number of actions have been enumerated in the following texts. These actions would depict a picture of the war and the gradual process of transformation of the inexperienced freedom fighters into an effective and cohesive fighting force through continuous actions against the Pakistanis all over the country.

 No.1 Sector: A number of small guerilla groups comprising of 3 to 5 students, trained on the use of hand-grenades and small arms were being inducted into Bangladesh from as early as the first week of May. The attacks were primarily to kill leading collaborators as well as officers of the Pakistan Army. The first organized guerilla group with appropriate training on weapons and explosives was sent in No.1 Sector on June 4, through Baishnapur area in the afternoon. On June 10, one our fighting patrol laid an ambush near Iliaku on Ramgrh-karerhat road. In the subsequent encounter, 4 Pakistanis were killed. Our troops withdrew without suffering any casualty.

 It may be mentioned here that this road of about 15 miles from karerhat to Ramgarh passes through mountain area covered with dense forests. There is negligible human habitation. The mountains and the jungles provide excellent hiding places for the guerillas. There have been innumerable actions on this road. Pakistani strong defences were at Karerhat. Hiaku and Ramgrah, controlling the major roads leading upto Chittagong, 50 miles away. These positions mutually support each other and there had been heavy movement of traffic between these 3 centres throughout the war. The movement was necessitated by the need to supply arms, ammunition, fucl, ration, reinforcement and evacuation of casualties. At a later stage the Pakistanis did build up some reserve of arms, ammunition and ration, But due to the fast changing nature of the battle and the increasing number of casualties the Pakistanis had to maintain heavy traffic all through the war.

 From June onward action by our regular troops as well as the guerillas against the Pakistanis were becoming more organized and effective.

 The total frontage of No.1 sector was approximately 400 miles of which 50 miles were the active front. The entire active front was divided into 5 sub-sectors for the purpose of carrying out regular guerilla operations. Throughout the war there has been regular actions along the active frontage against the Pakistanis in every sub- sector. Besides this the trained guerillas had kept the Pakistanis restless through raids and ambushes deep inside Bangladesh.

 On June 21 a raid was conducted on the Pakistani defences at Sreenagar arca by 10 guerillas who crept close to the defences under cover of darkness. Earlier, the defences had been reconnoitered to identify the positions of the automatic and semi- automatic weapons. The raiding party successfully neutralized these weapon positions by 75 mm rocket launchers. There after the raiders lobbed grenades inside a number of bunkers and destroyed 2 parked vehicles. The Pakistanis opened up with their weapons blindly, firing in all directions, hoping to scare off the raiders. The raid lasted for more than one hour in which 2 vehicles were destroyed and 5 Pakistanis suffered casualtics.

 On June 23, another ambush was laid near Hiaku. A small convoy carrying ration to Ramgarh hit the ambush. The guerillas had take position in the dense jungle on the high ground by the road side. The convoy was attacked by rocket launchers and LMG. A microbus was destroyed, killing I officer and 3 other Pakistani soldiers, 2 others were injured. The Pakistanis were mentally prepared for ambush on this road and they took immediate cover in the dense jungle on the other side. Meanwhile from nearby camp at Hiaku reinforcement reached the scene of action. By that time our ambush party had dis-appeared into the jungle and returned to the base.

 On July 1, I sent a platoon with Capt. Shamsul Huda to raid Debipur post. The raid was successful. Our troops leaped from one bunker to another, lobbing hand- grenades and blasting the occupants of the bunkers with sub-machinegun fire. Having completed the mission, the guerillas withdrew to the base. On our side Sepoy Fazlur Rahman, Habilder Abdul Hussain, Sepoy Toha Mia fought very bravely and died in action. 6 Pakistani soldiers were killed and 12 others were injured.

 At midday on July 3, a micro-bus carrying a number of Pakistanis including one Captain was ambushed by our troops at Chikanchara on Ramgarh-Karerhat road. The Captain and 4 other Pakistanis were killed in the action. We carried out numerous actions on this road and killed a number of the Pakistanis. They rarely moved on this road at night, restricting their move to the day-light as far as possible.

 On July 11, IIanaponi Bridge in Mirsharai was demolished by the guerillas. On 15 July. Subedar Raham Ali with a group of 20 others laid on ambush between Begam Bazar and Ramgarh. A convoy carrying ration and ammunition was caught in the ambush. As our troops opened fire, the Pakistanis, new and not acquainted to the terrain, were completely be-wildered and ran in panic for shelter. 6 Pakistanis were killed and many were injured in the action.

 Most raids on the BOP's and enemy defences were almost identical. Our troops carried out reconnaissance, specially about LMG & MG positions of the Pakistanis. Thereafter, small groups of usually 10 to 15 people would stealthily creep upto their positions. Some of the guerillas would position themselves to prevent themselves to prevent the Pakistanis from receiving reinforcements, as well as to cover the withdrawal of our own forces after the actions were over. The rest of the guerillas would go for direct action against selected bunkers. Thereafter, if time and situation permitted, a few would go for more bunkers or other lucrative targets, spraying those with carbine fires or lobbing hand-grenades. The aim was to harass the Pakistanis and to inflict as much casualty as possible without suffering any loss. We did not want, at that stage, to destroy enemy in piccc-meal nor did we have adequate resources to achieve such aim. We concentrated on continuous raids and ambushes which would demorlise the Pakistani soldiers, soldiers, sap their will power to fight and inculcate in them a fear of absolute uncertainty of absolute uncertainty of the war and the cause for which they were in Bangladesh.  A raid was conducted on Guthuma BOP on July 16. The Pakistanis suffered 3 casualties. The guerillas returned safely.

 On July 19, we raided Pakistani position at Kariabazar. This raid was organized on an information that the Pakistanis under a Major from a Punjab regiment had imprisoned about 200 Bengalees who were trying to excape to India. These Bengalce prisoners, with many women in that group, were being tortured by the Pakistanis. The raid was aimed at freeing the prisoners. At about 1: 30 that night, the raiding group with 45 men, Carrying 2 inch mortars, rocket launchers, LMGs, and rifles raided the high school in Kariabazar where the Major with his Punjabi troops were staying. The prisoners were kept in nearby shops and houses. As the raid started, our soldiers kept the enemy pinned down in the school building by firing from LMGs so that the Pakistanis could not come out. Then the guerillas shouted at the prisoners to escape under cover of the fire. Taking advantage of the darkness of the night, 150 of the prisoners managed to escape. There after heavy firing from mortars and rocket launchers continued for over thirty minutes. 18 Pakistani soldiers were killed. On our side there was no casualty.

 On July 23, the freedom fighters put mines on the railway track between Bortakia and Mirsharai. The mine exploded when a train was passing. One engine and a compartment was derailed and railway communication remain suspended for some time.

 Another raid was conducted on the Pakistani location at Hiaku. The area was being used as a parking place for military vehicles. On July 27, we conducted a raid on this position at about 4 in the evening with mortars and rocket launchers. This raid in daylight caught the Pakistanis totally by surprise. During 15 minutes of the raid, the vehicle park was totally destroyed. 4 Pakistanis wet killed on the spot and unknown number of soldiers were reportedly injured. Many vehicles were set on fire and these were burning for a few hours in the night.

 On August 3, Group Captain Khandakar and Col. Rab from HQ Bangladesh Forces visited No.1 sector to discuss and co-ordinate guerilla operations as well as other military actions against the Pakistan Army. This co-ordination was being done in line with the decisions arrived at the sector commanders conference at Calcutta from July 10.

 In the co-ordination mecting it was decided to step up guerilla operations against the Pakistanis. As thousands of able bodied men were voluntarily joining the war of liberation, more and more training centers were opened all over the border regions and we were receiving hundreds of trained boys at regular intervals. The trained guerillas themselves demanded to be sent for offensive actions and we were only too obliged to accept their requests. Continuous reports of atrocities by the Pakistanis hardened the attitude of the population as well as the guerillas. The helped us in allocating aggressive and dangerous tasks to various guerilla groups. It was considered an honour if a group was allocated more difficult and risky operational tasks.

 On August 9 our troops raided Pakistani position near Andar Manik BOP and overran the Pakistani defences in the encounter, lasting over 1 hour. Naik Haris Miah took the lead in physically assaulting the defences and displayed great courage during this raid. Firing from his carbine and throwing grenades, he daringly leapt from one to the other bunker and single handedly claimed a number of Pakistani casualties. The Pakistanis, caught inside their dugouts, could not put up any meaningful fight. At the end of the encounter our troops withdrew safely-leaving behind many dead and injured Pakistanis.

 In Patacourt near Zoralganj a company of Pakistani soldiers and Razakars were ambushed on August 10. A group of 20 guerillas under Mohiuddin engaged this company and in the brief encounter I Pakistani soldier was killed while 2 soldiers and 3 Razakars were injured. The guerillas disappeared into the countryside without suffering any casualty.

 14 August was the independence day of Pakistan and we decided to carry out large scale raids and ambushes against the Pakistanis on the day. Pakistani high command apprehended such escalation and accordingly warned all its forces to remain on the maximum alert. We knew of the preparedness and planned all actions thoroughly. There were 10 planned raids on Pakistani positions in No.1 sector coinciding with the independence days. These operations were along the active battle front from Chagalnya to Ramgarh. Besides, there were many ambushes and other smaller actions throughout the sector.

 On of the most important raids was conducted on Sreenagar near Shuvapur. Shreenagar defences were reconnoitred well in advance, pinpointing the locations of command post, LMG and MG post, ration and ammunition dumps. The raiding party stealthily moved close enough to the defence and neutralized the weapon posts with rocket launchers. Thereafter it was a conventional raid, lasting a brief period and the guerillas disappeared into the darkness of the night. This particular raid was conducted by a platoon and 2 Pakistanis were killed while 4 others were injured. Our forces did not suffer any casualty.

 On August 25, a raid was conducted at Amlighat area near East Wali Nagar. The Pakistanis suffered 3 casualtics. One of our soldiers was slightly injured in the action. However they all returned to base safely.

 On August 28 railway track near Mirsharai was mined by Il group 15 led by Nizam. At 8-25 a.m. a train carrying Pakistani soldiers and Razakars was derailed by the mine explosion. It was learnt that the Pakistanis had suffered 35 casualties in the action.

 On 5 September, raid was conducted on a Razakar camp near Chittagong. 6 Razakars were killed and many were wounded seriously.

 On 12 September an ambush was laid in Samarkand area, close to the international borders, Elements of 19 Rajput Batallion (India) Provided covering fire during the operation. A Pakistani patrol party suffered 5 casualties and rest of them fled away without any fighting.

 On September 14 a very important meeting was held with the Indian Army Commander Lt. Gen. Jagjit Singh Aurora. It was decided to step up conventional military Operations side by side, with the guerillas activities. Salient features of the planned military actions were:

 1. Take over of lightly held Pakistanis positions.

 2. Retaliatory action against the Pakistanis and inflicting heavy casualties on them.

 3. Disruption of the Pakistanis lines of communication.

 4. Stepping up of guerilla activities.

 We realized that such decision, communicated by the Indian commander himself, was in fact coming from the government of India. This also indicated Indian Army's preparedness to face any adventurism by the Pakistan Army. This definitely was a welcome development for us and it was felt that the Indian Force's would, in the process, get deeply involved in our liberation struggle.

 On 15 and 16 September we held elaborate planning discussion and meeting with Brigadier Shabeg Singh, local commander of the Indian force. The meeting wall attended by Khaled Mosharaf and Shafiullah also.

 On 15 September an ambush against the Pakistanis at Amjadhat area in Pourshuram was laid by 10 of our soldiers. The Pakistani's counter attacked and the fighting continued for more than 2 hours. Naik Nadirussaman fought very galantly and helped in the safe withdrawal of the entire ambush party. The Pakistanis suffered 8 casualties. One of our man was injured.

 On 18 September the first meeting Col. Sharma of 19 Raj RIF was held at Sreenagar area. The capture of lightly held Pakistani positions were to be carried out in coordination with the Indian forces, deployed along the border. Such coordination was necessary so that if the Pakistanis made any retaliatory attack and tried to cross the international borders, these could be repulsed. However, the actual attack on the Pakistani positions and the holding of the ground had to be done by the by the Bangladesh forces. The operational plan had to cover many aspects including those of limited fire support that the Indian army promised us in time of extreme crisis.

 On the night our forces ambushed enemy patrol at Gourangapara. More than 15 Pakistanis were casualties in the action.

 On 19 September complete operational reconnaissance of the Pakistani positions were held by Col. Sharma and me jointly. The Indian artillery unit Commander was also present to prepare artillery fire support plants. We recognized our troops by drawing surplus elements from main HQ & sub-sectors. While the operations were being planned guerilla activities continued other areas and deep inside Bangladesh.

 On 20 September Subedar Raham Ali attacked the Pakistanis at Champaknagar BOP and after a brief battle withdrew to the base without suffering casualty. The Pakistanis suffered 3 casualties in the action.  Next day, on 21 September an ambush near Guthuma BOP left 3 Pakistanis injured while we suffered 1 casualty. Another ambush at Khajuria that day left one Pakistani soldier and 1 Razakar killed.

 In the morning of 22nd September one platoon ambushed the Pakistanis in area Jochandpur. A company of Pakistan army was caught in the ambush. It was too big a target for our small ambush party. On our side soldier Ruhul Amin was injured and we lost 2 rifles, 1 mortar and a spare barrel of LMG. There was no casualty on the Pakistani side. That day, in the evening there was exchange of artillery, fire between the Pakistanis and Indians in Sreenagar area.

 On 23 September, 10 Naval Commandos were sent by a small boat for attaching limpet mines against ships in outer anchorage off the port of Chittagong. Duc to long distance involved and the rough sea they rough sea they could not reach the target and had to abandon the operation. While returning to shore one commando, Muhammad Hossain, was drowned in high sea. Another party of 3 Commandos were sent for action against the Pakistani Navy's coastal gun at Patenga, on Chittagong sea shore. The Pakistanis were fully on the alert and 2 of the commandos were captured by them.

 On 23rd September at 3-30 in the morning one company attacked Pakistani position at Ballavpur. Another company under Captain Mahfuz attacked Pakistani position at Champaknagar. Prior to these attacks, artillery fired for ten minutes on both the targets. The Pakistanis had prepared very strong defences with well prepared bunkers. Artillery fire could not neutralize any of the enemy weapon positions. The Pakistanis quickly sent reinforcements and brought heavy artillery fire from Karerhat on our troop position. After repeated attempts to capture these two targets the attacks were called off. We lost 1 and 2 were injured. One Indian soldier was injured inside the Indian territory due to Pakistani counter-bombardment. The attacks failed.

 That day in the evening an ambush in West Devpur area left 2 Pakistani soldiers killed.

 On September 25 at 7 a.m. an ambush by 15 of our guerillas in arca of Guthuma left 3 Pakistani casualties. A raid on Champaknagar BOP that night left 5 Pakistani casualties. The raid was carried out with rocket launchers and many bunker were destroyed.

 On 26 September a raid was carried out on Pakistani position at Guthuma BOP. One of our soldiers, Naik IIaris Miah crawled within a few yards of the bunkers and lobbed grenades inside. Others tried into various defence positions and withdrew quickly under cover of the darkness. 2 Pakistani soldiers were casualties in the action.

 On the 26 September another ambush in Devpur area at 10-30 a.m. left 5 Pakistani casualties. One civilian was wounded due to stray firing.

 On the Feni River, Andarmanik BOP was a strong position of the Pakistanis. Every evening the soldiers would fall-in for morning and evening roll-call. On getting this information one of our ambush party laid ambush around the BOP. As soon as the rollcall was over the party opened fire with LMG's and rifles. The Pakistanis were taken completely by surprise in the open area of the BOP. By the time the Pakistan soldiers could jump into their their trenches and bunkers. 15 of them including one J. C. O. were casualties. In total 2 Pakistani platoons had assembled for the roll-call.

 At 5-00 in the morning of 29 September, another ambush was laid in East Madhupur by a section of guerillas. 3 Pakistani vehicles, apparently bringing some reinforcements, were ambushed. 2 of the vehicles were damaged. However the Pakistanis did not suffer any casualty in this action.

 That night at 11.30, raids were carried out on Ballavpur and Chagalnaya defence. Pakistani casualty in Ballavpur could not be ascertained. The raid on Chagalnaya was carried out under fire support provided by Indian artillery. In this action 5 Pakistani soldiers were killed and 7 were injured. One Pakistani artillery observer had taken position on a tree and was directing artillery fire against our forces. The raiding party located the observer and shot him down.

 Next morning at 4 an important culvert at Champaknagar was blown up and the Pakistanis there were cut off from receiving ration or reinforcement.

 On October 1. 16 guerillas under group leader Nizam raided a camp al Durgapur Iligh School in Mirsharai. The camp was mainly for the Razakars and it had earned notoriety in that area for creation a reign of terror and oppressing the people. After very careful preparation for a number of days the guerilla group raided the camp at night and in the fierce battle for more than one hour killed 20 of the collaborators and captured 7 rifles. While a number of Razakars put up some resistance initially, others fled away in the darkness of the night. In that operation one freedom fighter Farid was killed but before dying he himself had claimed 10 enemy died.

 Earlier that day at 10-30 hours a group of guerillas ambushed a section of the cncmy patrolling near Guthuma. One soldier was killed and the rest of the patrol party managed to run away, leaving behind the dead. Such ambushes during broad-day- light and the resultant success were encouraging and we were confident that the guerillas had achieved certain standard where we could start relying on them for much more effective action against the Pakistanis.

 Next day there was night raid on Pakistani position at Champaknagar BOP. In this raid 2 Pakistani soldiers were killed. One of our soldiers was hit by a bullet and was critically injured.

 In the early morning of October 3, an ambush was laid in Amjadhat area in Belonia. A small enemy party was moving to the company headquarters, probably for food. The party was ambushed at 5-00 in the morning. 2 of them were seriously injured and carried away by rest of the party. It was learnt that the 2 injured and carried away by rest of the party. It was learnt that the 2 injured soldiers had died later.

 Another ambush was laid near Karalia Tila in Karerhat on that night. 2 Pakistani soldiers and 3 Razakars were killed while they were on patrol duty and came into the ambush. Our forces returned to base safely. As the raids and ambushes were going on in different areas at different times. We were preparing to launch small scale conventional attacks on lightly held Pakistani positions with a view to capture and hold the grounds for future military operations. In my sector, Pakistani position near Pourshuram was choosen as the first target and from the morning of 3rd October was started detailed reconnaissance. Since the beginning of October, as the raids and ambushes increased in intensity, frequency and ferocity, the Pakistanis became more jittery and nervous. Indian military officials and myself came under intense fire from Pakistani M. G's and mortars during the reconnaissance. A civilian in the area was injured by stray firing. This type of sporadic firing was common feature in the battlefront from October onward.

 On 4 October further reconnaissance was carried out in other areas for suitable targets. At the same time we had to evaluate the battle worthiness of our fighting force.

 The regular soldiers had remained in the battle front from the beginning of the fighting. They had no rest and were almost continuously engage in battle. Such continuous engagement in battle affected their fighting capability. They needed rest. regrouping, rearmament. But we could not afford to provide reasonable rest since the number of regular troops were limited. And we would be required to carry out the immediate military tasks with these very troops.

 The guerillas themselves had come under tremendous pressure. They were moderately trained. The lack of adequate training was compensated to some extent by motivation and commitment to the cause of independence. We however observed that a certain amount of fear was impeding their fighting ability. The fear was not so much for their personal safety. It was of the savage reprisal by the Pakistan Army against innocent civilian population in the surrounding areas where guerilla actions took place. As a result, the guerillas were hesitant to go into action in areas with civilian population nearby.

 This hesitation in the mind of the freedom fighters allowed free hand to the Razakars who created a reign of terror and intolerable nuisance for the people. Yet with all these difficulties we were continuing conventional attacks as well as guerilla actions.

 At 10-00 a.m. on 4 October, 2 Pakistani soldiers were killed near Guthuma BOP. Next day on 5 October a senior Indian military officer visited out headquarter for coordination on the future military operations and at 11-00 a.m. that day an ambush near East Debpur BOP left 2 enemy killed. One of our soldier suffered minor injuries.

 On 6 October reconnaissance with Brig Shabcg Singh and the commanders of various Indian army units deployed along the border area near Sreenagar was carried out, At 2-45 that afternoon a guerilla group blew up bridge between Chagalnaya and Muhuriganj. At the same time raid on Pakistani position in Karimganj Bazar High School left 3 Pakistani soldiers killed. 5 Razakars and 1 civilian were also killed in the encounter.

 At 3 p.m. that day I visited number 2 Sector Headquarters at Melaghar for inter sector coordination meeting with Sector Commander Khaled Mosharraf. There we received information of heavy concentration of Pakistan Army in Chagalnaya arca.  Immediately, Chagalnaya was engaged by artillery fire. Report collected later confirmed of considerable Pakistani casualties.

 In the carly hours of 7 October a patrol of 2 sections of the Pakistanis was ambushed in Belonia in day light. In the brief encounter the Pakistanis lost 2 soldiers and 3 Razakers.

 Further to the east in Sabroom area the Pakistanis had concentrated larger forces and brought forward some of their mortars. This threatened a number of refugee camps and hospital which fell within the range or the mortars.

 There were a number of raids and ambushes against the Pakistanis on October 6. Madunaghat on the Halda river, few miles away from Chittagong City had a electric sub-station. One of our raiding parties crossed 70 miles from main camp and destroyed 2 transfomers in a daring raid in the carly hours of the day. Sepoy Mannan fired the critical shells that destroyed the transformers but in the process of firing was hit by a bullet. He succumbed to his injury later.

 At 08-00 hours there was another action against the Pakistanis in Chagalnaya BOP. Our raiding party crept close to the enemy defence at night and lay in wait. A group of Pakistanis had started preparing their bunkers very carelessly. At that time the raiding party swung into action and killed 3 Pakistanis. We suffered one casualty.

At 6-00 p.m. that evening 2 guerillas crawled upto Dhaka-Chittagong Highway where 2 vehicles were parked and some soldiers were unloading ammunition. The guerillas threw hand-grenades and soon disappeared into the darkness of the night. One of the Pakistanis lay injured and the vehicles were badly damaged.

 On October 7 a bridge on Chagalnaya-Belonia road was demolished by the guerillas. This was done to isolate the Pakistanis in the Belonia bulge. The bridge was covered with small arms, LMG and MG fire by the Pakistanis from nearby positions. But the guerillas managed to complete their task under heavy firing.

 That day the guerillas attacked and destroyed a Tehsil office at Radhanagar and raided Pakistani defences at Mokamia. In the raid in Mokamia 2 Pakistanis were killed.

 An ambush was laid at Purba Debpur area at 8-30 a.m. On October 8. A Pakistani patrol moved into the ambush and immediately came under attack. 3 Pakistanis were killed and 1 was injured. The guerillas returned to base without suffering any lose.

 A raiding party lay in wait near Pakistani defences at Guthuma in the evening of 8 October. That was the usual time for the Pakistanis to fall-in for evening roll-call. As soon as the roll-can was over and the Pakistanis were about to disperse, the raiding party opened up with LMG and 2" mortar fire. 10 Pakistani soldiers were casualties. The guerillas disappeared in the darkness of the night and returned to base safely.

 At 7-30 in the evening of October 9 there was a raid on Pakistani defences near Guthuma BOP. One Pakistani soldier was injured and a militiaman was killed.  That night I returned to my headquarters after reconnoitering of the forward areas. At the headquarters I met col. Sharma of 19 Raj RIF. We held discussions for future actions. The Indian army's role, as on that day was to halt any Pakistani attempt to cross the international border on the pretext of pursuing the Freedom Fighters. At the same time, the Indian Army was in a position to provide limited support to us as the launching base for various raids and ambushes. Soon after we had finished discussions capt. Mahfuz cntered the room to give us a good news. About 10 days earlier we had sent a special guerilla team to demolish the railway bridge between Dhumghat and Muhuriganj. It was a difficult task as the bridge was guarded. Purposefully we refrained from any activity in that area and as such the sentries on duty were not very alert. Many of our guerillas in nearby villages were advised to lic law and keep observing the Pakistanis and their habits and wait for the final raid. They were also required to provide safe base for the raiding party, guide them upto the target area and help them withdraw to safety after the raid was over.

 The raiding party along with the demolition experts were launched inside in the last weak of September. They carried out rehearsals of the action on a small bridge near the sub-sector HQ. Explosives for the action were dispatched in a number of installments to avoid detection. These were stocked in 2-isolated farm houses-only about a mile away from the target. Thereafter the main guerilla group moved inside and reached the target area. There, the party carried out detail reconnaissance for a number of days and observed the duty pattern of the sentries, their state of alertness, timings of change of sentry etc. Finally the raid was carried out on the night of 6 October and the bridge could only be damaged partially. This however disrupted the railway communication between Chittagong and Dhaka.

 During this time a rumour spread that a section of the politicians who were actually collaborators in disguise, were trying for a rapprochement with Pakistan. The rumour spread quickly. The soldiers as well as the guerillas and the people were greatly agitated. There were demands for sever punishment of the collaborators and we vowed to achieve military solution to the problem since the Pakistanis had blocked the path for a political dialogue. The fighting men were advised to hit the enemy harder for a decisive military victory.

 On 10 October the guerillas raided Pakistani position in Barabazar in which Pakistanis suffered 6 casualties.

 On October 12 there was a raid on Pakistani defences at Parshuram area. 2 sentries were killed and the guerillas withdrew immediately after the raid, lasting only fifteen minutes.

 At 9-30 p.m. the guerillas ambushed Pakistani patrol near Radhanagar on Dhaka-Chittagong road. 2 soldiers were killed and I was injured.

 That night Pakistani President Yahya Khan, speaking on the Pakistan Radio mentioned of heavy Indian build up all along Pakistani border and of commando activities in which roads, railway bridges and power supply lines had been destroyed. From the Speech it was very evident that Yahya Khan was referring to the guerilla activities of the Freedom Fighters and that our actions had hit his ego and destroyed his dreams of subduing the Bengalees.

 On 14 October the sector commanders in the eastern region went to Agartala to receive the Bangladesh Prime Minister and the Acting President. They arrived in a special aircraft of the Indian Air Force. We held brief discussion about our difficulties-specially due to the short supply of arms and ammunition. There was a reference during the discussion about the rumour of some politicians trying for a rapprochement with Pakistan. The Acting President and the Prime Minister confirmed the rumour but advised us not to give it any currency which could demoralize the fighters. We were also assured that nothing short of independence will be acceptable to them.

 On 15 October our forces raided Pakistani positions at Ballavpur, Darogarhat and Chaygharia. In all these raids 6 Pakistanis and many Razakars and militiamen were killed and 8 were injured.

 On 16 October the Acting President Syed Nazrul Islam and Prime Minister Mr. Tajuddin Ahmed visited forward defences in Sreenagar area-only about a mile away from the Pakistani defences and well within their mortar range. That day a special commando group under a political leader Mr. Mosharaf Hussain, M. C. A. was inducted inside Bangladesh. The task assigned to them was to destroy fuel dump near Chittagong Naval Base.

 The guerillas ambushed a patrol party of the Pakistanis near village Jagannath Sonapur in the early hours of 17 October. In the ambush the guerillas used 2" mortars & LMG's. 2 Pakistani soldiers and 3 militiamen were killed. Another ambush on that day at Devpur BOP arca in Belonia left 3 Pakistani soldiers killed. On our side Sepoy Amjad Ali of BDR (11 wing) was seriously injured.

 "On 17 October at 05-30 in the morning, our guerillas laid ambush in East Devpur area. Fighting continued for almost half an hour in which 3 Pakistani soldiers were killed. On that day I held discussion with Lt. Col. Bisra of 8 Bihar (Indian Army) and planned conventions operations against the Pakistani positions. More coordination was needed between Bangladesh and Indian forces in all respect including controlling and directing troop movements, deployment, ground actions and fire support. Due to lack of such coordination, Indian artillery had fired, by mistake, on our position near Chagalnaya injuring 4 of our soldiers.

 In the carly hours of 18 October we raided Guthuma BOP. Prior to the raid 50 rounds of 3" Mortar were fired. The Pakistanis called for artillery fire on our troops. The raid continued for half an hour during which 10 Pakistani soldiers were killed. We offered 2 casualties. Sepoy Latif was injured critically and evacuated to Belonia Hospital where he died later on.

 Another raid on Pakistani defences at Matua village arca that morning claimed 3 Pakistani casualties.  On 21 October, a Pakistani patrol was ambushed at Amjadnagar at 10-30 in the morning. One Pakistani soldier was killed and 3 militiamen were injured. One civilian in the nearby area was also injured by stray bullet. At 12-30 that day a group of Pakistani soldiers and militiamen were moving to Chandgazi in 5 rickshaws. They were attacked by the guerillas operating in that area at 12-30. 3 Pakistanis were killed. One of the rickshaw-pullers was also killed in the action.

 In another ambush on that day in Baro Panua near Ramgarh, 5 Pakistanis were injured.

 And in Mirdharbazar. 2 platoons lay in ambush for an expected Pakistani patrol party. One guerilla section was deployed as cut-off party in South Jodhpur. The Pakistani patrol reached the ambush and came under heavy fire. The fighting continued and reinforcement was sent by the Pakistanis from Chagalnaya through South Joshpur. This platoon of reinforcement hit the cut-off party and suffered heavy casualties. In both these ambushes our forces used 2" mortars, LMG,s and rifles. It was learnt later that 10 Pakistani soldiers were killed and 15 others were injured in both the ambushes in Mirdharbazar and South Joshput.

 On 22 October there was another ambush in Barapanua. The Pakistanis suffered 3 casualties and the guerillas captured 1 LMG, few 303 rifles and some ammunition. It was on that day that some medium guns of the Indian army were moved forward closer to the international border. Indian Corps Headquarter also moved into the battle location and movement of heavy stores and equipment were noticcable all along the border.

 On 27 October there was an ambush near Guthuma in which one Pakistani was injured. That night we sent one company under Lt. Raquib inside Bangladesh for guerilla operations in arcas between Mirsharai to Chittagong. Dr. Mannan, an M. P. from the Chittagong area also went along with the group.

 On 28 October an ambush party lay in wait near Debpur BOP. The Pakistanis received some supplics of ration and ammunition which they were unloading from bullockcarts at about 8 a.m. At that time the guerillas opened fire with LMG and killed 2 soldiers and 2 Razakars.

 Last days of October were hectic for us as well as the Indian Army. We planned large number of attacks on Pakistani position. There were exchanges of small arms fire very frequently. Sporadic exchange of artillery fire claimed heavy casualtics-specially of the civilian population. Pakistanis used to fire artillery shells on the civilian areas for reasons best known to them.

 And all Indian Army nits Started moving to their baule locations.

 On 1st November an important conference was held at 83 Brigade Headquarter at Shantir Bazar. For the first time Indian Army units were allowed to enter Bangladesh territory, occupy defences and relieve Bangladesh Forces for other tasks. 8 Bihar Regiment and 2 Rajput Battalion of the Indian Army were to establish firm bases in Belonia. From these firm bases our forces were to operate and occupy vital positions in order to cut off the Pakistanis in Belonia and Pourshuram arcas. The final date of operation was set for the night of 5/6 November. Till then, we decided to continue normal operations in the area in order not to arouse suspicion in the mind of the Pakistanis.

 On 3rd November a group of guerillas were trying to demolish a bridge on Ranirhat-Rangmati raod. Suddenly a Pakistani patrol composed of militiamen and Razakars reached the spot. One guerilla, Parimal Sikder was captured and taken to the Pakistani camp nearby. The rest of the guerillas immediately raided the camp and recovered Parimal. About 4 Pakistanis were killed in the raid. One guerrilla was injured.

 On November 5 our planned operation to cut off the Pakistanis in Belonia was launched at 20-30 hours. The operation has been described in greater detail elsewhere.

 In the morning of 6 November guerillas raided Andarmanik BOP with the help of 2"mortar and 73 mm rocket. 3 Pakistani casualtics were claimed in this raid.

 On 6 November the guerillas were engaged in a frontal encounter with a Pakistani patrol in Durgapur in Mirsharai Police Station. Fighting continued for 15 minutes. One Pakistani was killed and 2 others were injured. On our side Mozammel Huq was injured when he was hit by a bullet. The group managed to evacuate him to safety and render medical treatment secretly.

 On 7 November the Pakistanis attacked our position in Belonia with two platoons. The attack was repulsed by Habilder Ali Hossain and members of his section. They had taken defences on the high embankment of a big pond. The defence was well prepared and all areas in front and the flanks were covered by fire. The Pakistanis made successive counter attacks which were repulsed by the section.

 Another counter attack on our position in Belonia bulge made some headway when 3 of our soldiers including the platoon commander were lost in the encounter and rest of the troops started withdrawing to the rear. At that time EPR subeder Gani was rushed forward. Gani launched a bold attack on the Pakistanis. The position was retaken and the situation saved.

 On 8 November the guerillas ambushed a Pakistani patrol on Ramgrah- Karcrhat road. Occupying high ground on the roadside, the ambush party opened fire with LMG's and carbines and threw hand-grenades. 4 Pakistanis were killed and 2 others were injured in the brief encounter.

 On 12 November an ambush was laid by a platoon in Bishwanathala in Champaknagar area. At 10-00 in the morning, an enemy patrol of 2 sections was caught in the ambush. 7 Pakistanis were killed and one injured while rest of the troops ran away. One injured militiaman was captured. The prisoner died on way to our camp and was buried enroute.  On 16 November a raid was conducted on East Debpur BOP. The raid continued for one hour. The BOP at that time was being manned mainly by militiamen. 3 of the Pakistanis were killed in the action. 7 Razakars, on duty in the BOP, surrendered to our forces. Large quantity of arms and ammunition were captured.

 On 17 November Group 19 under Moinuddin ambushed a Pakistani patrol party near Mirsharai. There were 3 enemy casualties. One of the guerllas suffered minor injury.

 On 18 November an attack was launched on Pakistani camp at Karnafuli Tea Estate. There were 6 enemy casualties. Another attack that day on Pakistani position in Fatikchari left 2 Pakistani soldiers killed. Our forces captured 60 Rifles, one LMG, 2 Stenguns and huge quantity of ammunition. 11 policemen were also arrested in that operation.

 On 20 November a conference was held at 181 Brigade Headquarter to decide on the reorganization of our forces to prepare for joint military action against the Pakistanis in our arca of operation. By that time heavy movement of military personnel, vehicles, stores and equipments on both sides had reached a peak. It was apparent that the preparations were nearing completion for the final battle. After visiting some of the forward positions, 1 returned to my headquarters. The troops were offering their Eid prayers. Many of them knew nothing about their families for the last 8 months. As they bowed to Allah for prayers they were all crying like small children. I joined the prayers, tried to maintain a calm composure and later exchanged greetings with the troops with a faint smile in my face,But the smile probably betrayed the turmoil in my mind. Many of them embranced me and burst into tears.

 By 21 November the northern half of Belonia was liberated and the battle for rest of Belonia was to start soon. The Pakistanis meanwhile concentrated lager forces in Feni area.

 On 22 November there was a raid on a Pakistani camp at Tabalchari in which there were 2, Pakistani casualties. 13 Razakars along with their rifles, and ammunition, surrendered to our forces. That day 2 of our companies operating inside Belonia bulge along with 6 and 14 kumayun battalions captured 10 Pakistani soldiers. There were 22 others who were injured and taken prisoner. 2 of our guerillas were also injured and one JCO,s leg was blown in a mine explosion.

 On 23rd November an ambush in Champaknagar BOP arca claimed 2 Pakistani casualties. I held a meeting with the Zonal Council (A committee of Bangladesh political leaders of the area to advise the military commanders on civil affairs) at Shanti Bazar and discussed matters regarding civil administration in the liberated areas in Bangladesh. Thereafter meeting was held with the Commander of 'K' Force composed of Indian and Bangladesh forces in No.1 Sector. The Indian Brigade commander obtained permission from higher authorities and it was decided that in extreme emergencies Indian officers could be loaned to command our troops. We did not have even 5% of the officers required. However we did not need that help and managed to continue fighting with available officers and JCO's.

 On November 24 we captured Fulgazi and Chandgazi and consolidated our position in the whole area. Next day I visited the liberated areas in Belonia and inspected the defences there. That day the guerillas attacked a Razakars camp in Mirsharai area. They killed 3 Razakars and recovered a number of rifles and ammunition.

 On 26 November our forces liberated more areas in Belonia. As the news of our success in battle field started spreading all around, the Razakars started surrendering to our forces in larger number.

 On 27 November about 30 Razakars surrendered at Chagalnaya alongwith their arms and ammunition. That day, we visited liberated areas beyond Munshirhat along Belonia-Feni Road. The people had already started coming back to their home in the liberated areas.

 On 28 November the guerillas attacked an enemy patrol at Hadir Fakir Hat in Mirsharai. There were 4 Pakistani casualties. Soon afterwards the Pakistanis sent reinforcement in the bazar. They burnt down. They burnt down the entire bazar and started killing civilians. The guerillas who had withdrawn after the action were infuriated by the savagery of the Pakistanis and immediately launched a suicidal attack against the Pakistanis. Guerilla Shah Alam charged at the Pakistanis with his carbine and risking his life through heavy firing single handedly, climinated 8 Pakistanis before he was captured. The Pakistanis brutally tortured and killed him on the spot and left his dead body in the burning bazar. The guerillas later recovered the dead body and buried it with due solemnity.

 On 30 November the guerillas raided Pakistani position on Nalua Tea garden. There were 5 Pakistanis casualties. One LMG and 2 rifles were captured.

 Towards the end of November it was clear to all that the war would start any time. It was also talked about that Yahya Khan was looking for some pretext to start an all-out war in the region, raise the issue in the United Nations, call for immediate cease fire and deploy UN observers along the international borders. The positioning of UN observers could be a source of great hindrance to the steady supply of arms and ammunition that we were receiving from India.

 Indian Army meanwhile was in full preparedness. Our guerilla activitics which had reached the peak in the last month, were now being coordinated to coincide with the military operations by the Indian and Bangladesh forces. All guerilla groups operating inside Bangladesh were instructed to carry out their activities behind enemy lines in order to disrupt Pakistani lines of communication and inflict heavier casualtics on the Pakistanis. They were also instructed to disrupt all troop movements so that the Pakistanis could not send timely reinforcement to any places which was threatened by our joint military operations.

 On 4 December the guerillas in Hathazari arca received information that the Pakistanis had started arresting the people in Katirhat bazar area on suspicion of being members of the liberation forces. The Pakistani is burnt down a number of houses and arrested 30 Bengalees who were taken to the market to be shot. On this information the guerillas in the area raided Katirhat immediately. In the ensuing battle 6 Pakistanis were killed, while others fled to their nearby camp. The guerillas released the arrested persons and withdrew to their respective shelters.

 When the war broke out on 3 December, the guerillas intensified their activities behind Pakistani lines and carried out larger number of raids and ambushes.

 On 9 December the guerilla company operating in Nazirhat area attacked the Pakistanis there. This company under Lt. Shawkat killed 20 enemy soldiers and inflicted heavy casualties on them. The Pakistanis left their dead and fled toward Chittagong. We suffered 5 killed and 3 wounded.

Sd/-.......
20 March, 1983.

  1. একাত্তরের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম সাবেক ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন পদে সেক্টর এ্যাডজুটেণ্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন।