বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড)/১২

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১২। ৬নং সেক্টরের যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ ও তথ্যাদি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র .....১৯৭১

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল দেলোয়ার হোসেন[]
১৬-১০-১৯৭৪

 ২২মে আগষ্ট আমাকে ৬নং সেক্টরে (রংপুর-দিনাজপুর), ক্যাপ্টেন আজিজ পাশাকে ২নং সেক্টরে এবং ক্যাপ্টেন শাহজাহানকে ৯নং সেক্টরে পোস্টিং দেয়া হয়। ২৩শে আগস্ট রাতে আমি শিলিগুড়ি পৌঁছি এবং প্রথমে ৬নং সেক্টরে কর্তব্যরত ক্যাপ্টেন নজমুল হকের (বর্তমান মেজর) সাথে দেখা করি।

 বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় এসে নিজেকে গৌরবান্বিত করি। আমার এত আনন্দ হয়েছিল যা আজ আমি আর প্রকাশ করতে পারব না। শীঘ্রই আমি ৬নং সেক্টরে কর্তব্যরত স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীনের সাথে দেখা করি। এরপর আমি আমাদের সাহায্যে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করি। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম-কবে আমি অর্গবর্তী ঘাঁটিতে যাব এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাব। যদিও আমার রংপুর ও দিনাজপুর এলাকা সম্বন্ধে ধারণা খুব কম ছিল, তবুও দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এই সময় আমি শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রথম অপারেশন শুরু করি। আমি শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ৫ জনকে নিহত ও ১২ জনকে আহত করি। আমার সাথে যারা ছিল তারা সবাই নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ১ জন সামান্য আহত হয়। আমরা হালকা মেশিনগান, এসএমজি, ৩০৩ রাইফেল ও ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিলাম। আমাদের ডিফেন্স পজিশন থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্য দেয়া হয়।

 অমরখানা সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা আমি জীবনে কোনদিন ভুলতে পারব না। তার মত সাহসী যোদ্ধার কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে বলে আমি মনে করি। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছিল। পাকসেনাদের কাছ থেকে সে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে একটানা কয়েকদিন ও রাত না ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি। ৬নং সেক্টরের অন্যান্য অফিসারদের তার মত এত কৃতিত্বের দাবীদার আর কেউ নয়। আমি ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারকে কোন সময়ে বিমর্ষ দেখিনি। দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত যোদ্ধার মত তিনি শত্রুদের মোকাবিলা করেছিলেন।

 ৬নং সেক্টরের উইং কমাণ্ডার মিঃ বাশারের (বর্তমান গ্রুপ ক্যাপ্টেন) সাথে আমার তখনও পরিচয় হয়নি। একদিন তিনি আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য বলে পাঠালেন। আমি তাঁর নির্দেশ মত দেখা করি। একজন এয়ার ফোর্সের অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ৬নং সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তা যে কোন দক্ষ পদাতিক অফিসারের সাথে তুলনা করা চলে। তিনি নিপুণতার সাথে ৬নং সেক্টর পরিচালনা করেন। দীর্ঘ ৯ মাস তিনি সুদক্ষভাবে ৬নং সেক্টরে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। ৬নং সেক্টর রংপুর-দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। অনেক সময় তিনি আমাকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অপারেশনে বহু সাহায্য করেছেন।

 আমাদের সেক্টর ৬-এর সদর দফতর বুড়িমারীতে স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরগুলির তুলনায় একমাত্র আমাদের সেক্টরেই বহু মুক্ত এলাকা ছিল। আমাদের সেক্টর সদর দপ্তর ও সাব সেক্টর দপ্তর বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের (বর্তমান মেজর) উপর ন্যস্ত ছিল সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর। তাঁর নিয়ন্ত্রণে কিছু নিয়মিত ও ই পি আর বাহিনীর সৈন্য ছিল। সাহেবগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ অনেক আগেই শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাটগ্রাম সাব-সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের উপর। তিনি অনেক স্থান শত্রুমুক্ত করে রেখেছিলেন। দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া সাব-সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল স্কোয়াড্রন লীডার সদরুদ্দীনের (বর্তমান উইং কমাণ্ডার) উপর। এখানেও অনেক এলাকা মুক্ত ছিল।

 মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সেক্টর ৬-এর বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি, কোটগাছ, হিমকুমারী শীতলকুচি, গিতলদহ, সোনাহাট প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। সেই সময়ে সামরিক অফিসারের অভাবে ঠাকুরবাড়ি এবং কোটগাছ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছিল না। সেক্টর কমাণ্ডার বাশার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাকুরবাড়ি এবং কোডগাছ ক্যাম্প পরিচালনার ভার দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশমত ঠাকুরবাড়ি ও কোটগাছ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে থাকি। শত শত শিক্ষিত ও অশিক্ষত যুবককে সামরিক ট্রেনিং দিতে থাকি। এরা প্রায় সকলেই সামরিক ট্রেনিং-এ অনভিজ্ঞ ছিল। সহযেই বুঝতে পারা যায় যে অনভিজ্ঞ যুবকদের কত কষ্টে সামরিক শিক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার অধীনে শিক্ষা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ট্রেনিং ও জ্ঞান অর্জনে যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। তারা কোনদিন কোন অসুবিধার কথা আমাকে জানায়নি। তাদের যাকে যা কাজ দেওয়া হত তারা তা ভালভাবেই সম্পন্ন বা কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হত। সেই জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে পাঠাবার পূর্বে সেই স্থান ভালভাবে রেকী করা হত এবং আমি নিজেই অনেক স্থান রেকী করে তাদের পাঠিয়েছি।

 প্রথমে আমি যেসব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাই সে এলাকাগুলো হল দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গি, রুহিয়া, লেহেরী এবং আটাওয়ারী। এসব এলাকায আমিই রেকী পরিচালনা করেছিলাম। রেকী করা কালে অনেক সময় ইপিকাফ, রাজাকার এবং পাকিস্তানী রেঞ্জারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলাম। এই রকম একটি ঘটনা ঘটে ৫ই সেপ্টেম্বরে। রেকী করার জন্য যাই। আমার সাথে ১২/১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আর সঙ্গে ২টা এল এম জি, একটি ২ ইঞ্চি মর্টার, স্টেনগান ও ৩০৩ রাইফেল ছিল। একটি স্কুলে পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। সেখানে পাকসেনাদের ২টা প্লাটুন ছাড়াও ইপিকাফ ও বিহারী রাজাকারও ছিল। আমাদের রেকী করার খবর কিছু দালাল পাকসেনাদের জানায়। আমি সাধারণত গেরিলা যুদ্ধ চালাতাম। শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমণ করে দ্রুত সরে পড়াই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। তিন ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার পর আমি আমার দল নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। এ যুদ্ধে আমার ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই ঘটনার পর আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের ভিতরে অনুপ্রবেশ করানোর জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী কয়েক স্থানে বেইস স্থাপন করি। পরে এই স্থানগুলি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করানো হয়। ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিষ্ঠিত বেইস দিয়ে ঠাকুরগাঁও, রানীসংকৈল, বোদা, পঁচাগড় ইত্যাদি স্থানে পাঠানো হয়। এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার বাশার আমাকে রংপুরের গীতলদহ ও শীতলকুচিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিতে নির্দেশ দেন। তখন পর্যন্ত এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। গীতলদহ ক্যাম্পে ২ হাজার এবং শীতলকুচি ক্যাম্পে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিচ্ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপঃ

 (ক) ট্রেনিং থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রহণ করা।

 (খ) মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করা। তাদের এ্যামবুশ, রেইড, আক্রমণ, রেল ও সড়ক সেতু (যেগুলি শত্রুদের যাতায়াতে সাহায্য করত) উড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান।  (গ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য বিষয়ে জানানো।

 (ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার জনগণের সাথে মিশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে জানানোর ব্যবস্থা করা,

 (ঙ) সর্বোপরি পাকসেনাদের অধিকৃত এলাকার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করা।

 আমি এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিয়ে প্রথমে তাদের পরীক্ষা করে দেখি। তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে কিছু জানা নাই এবং সামরিক কৌশল সম্বন্ধে ধারণা নাই। সামরিক অফিসারের অভাব থাকার জন্যই তাদের পক্ষে সামরিক কৌশল জানা সম্ভব হয়নি। সেই জন্য ক্যাম্প দুটির মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকমত পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। আমি তাদের সুস্পষ্টভাবে সামরিক কৌশল শিখিয়ে অপারেশনে পাঠানোর জন্য তৈরী করি। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে বিভক্ত করি। তাদের সংগঠিত করে পাকসেনাদের উপর দিনে কমপক্ষে পাঁচবার হামলা করতে থাকি। এর ফলে তারা এত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে পাকসেনারা দিনেও বাংকার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করত না। আমি অনেক অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যেতাম এবং এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে তুলি। আমার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আমার নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা চালায়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের এ্যামবুশ ও রেইড করা এবং রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেই। তাদেরকে অধিকৃত অঞ্চলে বেইস গড়ে তোলার জন্য নির্দেশ দেই। অনেককে ভেতরে পাঠিয়ে দেই পাকসেনাদের এ্যামবুশ ও রেইড করে পর্যুদস্ত করার জন্য।

 যেসব মুক্তিযোদ্ধা নতুন ট্রেনিং নিয়ে আসত, তাদেরকে প্রথমে শত্রুদের বিরুদ্ধে এ্যামবুশ ও রেইড করার নির্দেশ দিতাম। রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধার সৃষ্টি করার জন্য পাঠাতাম। ছোটখাটো অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী করে তোলা হত।

 একটি অপারেশনের কথা আমার মনে পড়ছে। লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটে অবস্থানরত পাকসেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে রসদ ও সৈন্য আসত। এই সাব সেক্টরের দায়িত্ব ছিল অসমসাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উপর। তিনি আমাকে এই অপারেশন পরিচালনার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি পিছনে অবস্থানরত প্লাটুনের সাহায্যে শত্রুট্রেনের উপর মর্টার চালাবার নির্দেশ দেন। দিনটি ছিল যতদূর সম্ভব ৬ই সেপ্টেম্বর। ভোর ৫টার সময় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোগলহাট রেললাইনের নিকট অবস্থান নেই। রেললাইনের উপর এ্যাণ্টি ট্যাংক মাইন বসানো হয়। গ্যালাটিন ও পি-ই-কে ঠিকমত বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে শত্রু ট্রেন আসার অপেক্ষায় অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিক সময়মত ট্রেনটি সামনের কয়েকটি বগীতে বালি এবং অন্যান্য জিনিস ভর্তি করে পিছনের বগীগুলিতে আসে। আমাদের এ্যাণ্টি-ট্রাঙ্ক মাইনের আঘাতে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগী বিধ্বস্ত হয়। পাক-সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের গোলাগুলির জবাব দিতে শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে নেমে তিনদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের আমি পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দেই। আমার কাছে ১টা হালকা মেশিনগান ছিল। সেই মারণাস্ত্র দিয়ে আমি শত্রুসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাই এবং এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পিছনে সরে যেতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে ২ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমিও বাঁ হাতে সামান্য আঘাত পাই। শত্রুদের ৫ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এই অপারেশন পরিচালনার জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। এই অপারেশনের খবরটি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। এ ছাড়া আমি যেসব অপারেশনে অংশগ্রহণ করি সেগুলো হলঃ মোগলহাট পাক অবস্থানের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ, নাগেশ্বরী পাক-কোম্পানী হেডকোয়ার্টার আক্রমণ, কম্বলপুর ব্রীজ অপারেশন, কুলাঘাট শত্রু অবস্থানের উপর হামলা, দোরাকুটি পাক অবস্থানের উপর হামলা, নুমেরী পাক অবস্থানে আক্রমণ, পাটেশ্বরী শত্রু গোলন্দাজ অবস্থানের উপর হামলা, ভাতমারী শত্রু কোম্পানী অবস্থানের উপর হামলা, কালীগঞ্জ পাক-অবস্তান আক্রমণ, তুষভাণ্ডা শত্রু প্লাটুনের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ, হাতিবান্ধা শত্রু কোম্পানীর উপর আক্রমণ ইত্যাদি।

 বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী থানাগুলিতে আক্রমণ চালানোর জন্য আমি কয়েকটা বেইস গড়ে তুলি। ফুলবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। লালমনিরহাট থানার ইমানগঞ্জ হাট ও কর্নারহাট এলাকায় আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। কালীগঞ্জ থানায় দাইখোয়া ও চালতায় বেইস গড়ে তোলা হয়। এসব স্থান তেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বিভিন্ন পাক অবস্তানের উপর এ্যামবুশ ও রেইড করত। তারা রেল ও সড়কসেতু উড়িয়ে দিয়ে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধার সৃষ্টি করত।

 এসব সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করার পর রংপুর জেলার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে অনুপ্রবেশ করানো যায়, সে চিন্তা করতে থাকি। সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিসাধন করতে থাকে। পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এমনকি দিনের বেলাতেও পাকসেনারা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করত না। পাক-সেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। আমাদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবার ফলে পাকসেনারা গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর পূর্বে পাকসেনারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ, নারীধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া এবং গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাত। আমাদের কার্যকলাপের ফলে গ্রামবাসীরা অনেক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা আমাদের শত্রুপক্ষের অনেক গোপন তথ্য জানিয়ে সাহায্য করত। আমার পক্ষে সব বেইস এলাকায় থাকা সম্ভব ছিল না। তাই মাঝে-মধ্যে প্রায় সব ক'টি বেইস এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে অনেক অপারেশনে অংশগ্রহন করতাম। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। আমি ভিতরে অনেক লোককে নিয়োগ করি শত্রুপক্ষের গোপন তথ্যাদি ও গতিবিধি সম্বন্ধে খবর দেবার জন্য। তারা আমাকে ঠিকমত খবরাখবর দিয়ে অপারেশনে সাহায্য করত।

 মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি রাতেই তাদের অবস্থান বদল করত। এক স্থানে অবস্থান নিয়ে বসে থাকত না। আমি নিম্নলিখিত এলাকায় বেইস তৈরী করি। এগুলো হলঃ লালমনিরহাট থানার কস্তুরীহাট, কাউনিয়া থানার তেপাহাটা, গংগাচরা থানার গংগাচরা, লালমনিরহাট থানার শিবরাম ও পাঁচ গ্রাম কাউনিয়া থানার সারাই ও নাজিরদহ, পীরগাছা থানার জিগাবড়ি ও বাজে মশকুর, কাউনিয়া থানার তেপামধুপুর, মিঠাপুকুর থানার রাজপুকুর, জলঢাকা থানার খৈলমারী ইত্যাদি।

 এসব এলাকায় বেইস তৈরী করার পর আমি প্রতি এলাকর জন্য ১০ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার পার্টি নিয়োগ করি শত্রুদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য। তিনদিন অন্তর তাদের প্রত্যেক পার্টিকে ভাগাভাগি করে অপারেশনের দায়িত্ব দিতাম। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় সব কটি বেইস এলাকায় তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। অক্টোবর মাসের শেষদিকে প্রায় প্রতি বেইসে ১৫০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ করতে সক্ষম হই। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৭০ মাইল ভিতরেও বেইস তৈরী করতে সক্ষম হই। এক বেইস এলাকার সাথে অন্য বেইস এলাকার যোগাযোগ রাখা হত। এইভাবে তারা এক অন্যের সাহায্য করে এবং আমার সাথে চেইন হিসেবে যোগাযোগ রাখে। প্রতি বেইস এলাকা থেকেই তারা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাত। আমি কোম্পানী কমাণ্ডারদের কাছে নির্দেশ পাঠাতাম এবং সপ্তাহ অন্তর কোম্পানী কমাণ্ডাররা তাদের রিপোর্ট পাঠাত। দূরবর্তী কোম্পানী কমাণ্ডারদের এক সপ্তাহের কাজ দিতাম। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল শত্রুদের সামনে থেকে আক্রমণ না করে এ্যামবুশ ও রেইড করে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য এবং যোগাযোগ ও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়ার জন্য, সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস ও উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আরও নির্দেশ ছিল গ্রামবাসী ও এলাকাবাসীদের সাথে মিশে তাদের সাহায্য নিয়ে অপারেশন করার জন্য। কিন্তু আবার এই সময় রাজকার, আলবদর, আল-শামস, মুসলীম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর দালালরা ও বিহারীরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করত। কিন্তু আবার অনেক রাজাকার এমনকি শান্তি কমিটির অনেক সদস্য গোপনে শত্রুদের অনেক খবর আমাদেরকে দিত। লালমনিরহাট থানার বাবোবাড়ি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য আবুল কাসেমের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ায় পাকসেনারা নির্মমভাবে আবুল কাসেমকে হত্যা করে। আবুল কাসেমের স্বাধীনতা সংগামে অবদান কম নয়।

 নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। প্রতি রাতেই তাদের উপর হামলা চালান হত। রংপুরের সিনেমা হলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১০ জনের মুক্তিবাহিনীর একটা পার্টিকে এ কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল। লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ, ভোতমারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম, তিস্তাঘাট, কাউনিয়া, পীরগাছা, গঙ্গাচরা, মিঠাপুকুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পাক অবস্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এমনকি রংপুর শহরেও আমাদের কার্যকলাপ শুরু হয় যায়। এর মধ্যে আমাদের কার্যকলাপ গ্রাম ছাড়িয়ে শহর ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শুরু হয়। পাকসেনারা এরপর আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারা প্রায়ই সবসময় বাঙ্কার আর ছাউনি ছেড়ে বাইরে যেত না। কোন অপারেশনে গেলে তারা রাজাকারদের সামনে এগিয়ে দিত এবং নিজেরা ডিফেন্স পজিশনে থাকত।

 ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা অনেক এলাকা পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে ফেলি। পীরগাছা, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচরা ও কাউনিয় থানা এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ২রা ডিসেম্বরে সেক্টর কমাণ্ডার বাশার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ১টা ব্যাটালিয়ন তৈরী করে লালমনিরহাট ও তিস্তাঘাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশসহ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হই। পাটগ্রাম সাব সেক্টরের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান বারখাতা, হাতিবান্ধা কালিগঞ্জ হয়ে লালমনিরহাটের দিকে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পাটেশ্বরী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন। নীলফামারী মুক্ত করে আমরা তিস্তা ঘাটে একত্রিত হয়ে রংপুর শহরের দিকে অগ্রসর হই। ১৫ই ডিসেম্বর অনেক বাধাবিপত্তির পর রংপুর শহরে পৌছাতে সক্ষম হই। আমরা তাদের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে শহর থেকে সরে ক্যাণ্টনমেণ্ট এলাকায় যেতে বাধ্য করি। ১৬ই ডিসেম্বর পাকসেনারা মিত্রবাহনী ও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

 পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অভ্যন্তরে চলে যায়। এসব মুক্তিযোদ্ধারা অসমসাহসী ছিল। তারা পাকসেনাদের বারবার আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। আগস্টের শেয়ে প্রাক্তন এমসি-এ কে, বি, এম, আবু হেনা এদেরকে নিয়ে সিরাজগঞ্জে চলে যান। জনাব হেনা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তার মত সাহসী এম সি এ ও মুক্তিযোদ্ধা আমি খুব কমই দেখেছি। দেশকে মুক্ত করার জন্যে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিলেন। সিরাজগঞ্জের ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আবু হেনাকে কোম্পানী কমাণ্ডার, মিঃ সাইদুর রহমানকে সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, মিঃ আমির হোসেন, বেলায়েত হোসেন ও বজলুর রহমানকে প্লাটুন কমাণ্ডার করে আবু হেনার নেতৃত্বাধীনে সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাঠিয়ে দেই।

 মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃংখলা বজায় রাখার জন্য তাদের মধ্য থেকে কোম্পানী কমাণ্ডার, প্লাটুন কমাণ্ডার ও সেকশন কমাণ্ডার নিয়োগ করি। মুক্তিবাহিনীকে কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করি শত্রুদের উপর সুষ্ঠুভাবে আক্রমণ পরিচালনার জন্য। আমার কয়েকজন সাহসী শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধার নাম নিম্নে প্রদান করছিঃ

 ১। বদরুজ্জামান, কোম্পানী কমাণ্ডার; ২। সিরাজুল ইসলাম, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড; ৩। মজাহার আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, ৪। একরামুল হক, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড; ৫। নূরুল আলম খোকন, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৬। শহীদুর রহমান প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৭। ওয়াদুর রহমান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৮। আব্দুল করিম, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, ৯। মোঃ তাজিব উদ্দিন, কোম্পানী কমাার; ১০। গোলজার হোসেন, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ১১। ইমান-আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার; ১২। রবিউল আলম, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, ১৩। শফিকুল ইসলাম, প্লাটুন কমাণ্ডার; ১৪। আব্দুস সালাম, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ১৫। মোজাফ্ফর হোসেন, প্লাটুন কমাণ্ডার; ১৬। খোরশেদ আলম, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, ১৭। মাহতাব আলী সরকার, কোম্পানী কমাণ্ডার; ১৮। নুরুল আজিজ, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ১৯। শামসুল আলম, প্লাটুন কমাণ্ডার; ২০। আবুদর রশিদ, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ২১। আশরাফ আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার; ২২। জমির আলী আহমেদ, সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ২৩। ওয়ারেশ আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার; ২৪। আতিয়ার রহমান, সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ২৫। আবদুর রউফ, কোম্পানী কমাণ্ডার; ২৬। মোঃ ইলিয়াস, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন- কমাণ্ড; ২৭। জয়দেব রায়, প্লাটুন কমাণ্ডার; ২৮। দীনেশ রায়, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ২৯। নুরুদ্দিন, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৩০। যোগেশ সরকার, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৩১। মজিবর রহমান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৩২। মোঃ আজাদ, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৩৩। সিরাজুল হক, কোম্পানী কমাণ্ডার; ৩৪। লুৎফর রহমান, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৩৫। কলিমমুদ্দিন, প্লাটুন কমাণ্ডার, ৩৬। ওসমান গনি, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৩৭। মোস্তাফিজুর রহমান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৩৮। খাইরুজ্জামান, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৩৯। ফরিদ হোসেন, প্লাটুন কমাার; ৪০। জুলহাস হোসেন, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৪১। মোখলেসুর রহমান, কোম্পানী কমাণ্ডার; ৪২। কফিলউদ্দীন, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৪৩। আবুল হোসেন, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৪৪। মোহাম্মদ আলী, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৪৫। আবদুস সামাদ, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৪৬। আবদুস সামাদ (২), প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৪৭। এ, কে, এম, আবদুর রশিদ, প্লাটুন কমাণ্ডার, ৪৮। বেলাল হোসেন, প্লাটুন সেকেণ্ড ইন-কমাণ্ড, ৪৯। মফিজুল হক, কোম্পানী কমাণ্ডার; ৫০। সাবের আল, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৫১। আয়ুব আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৫২। মোঃ আবু সিদ্দিক, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৫৩। মজিবর রহমান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৫৪। আজিজুল হক, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৫৫। জহুরুল হক প্রধান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৫৬। আবুদর রাজ্জাক, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৫৭। আজহারুল ইসলাম, কোম্পানী কমাণ্ডার; ৫৮। বেলায়েত হোসেন, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৫৯। মোঃ শাজাহান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৬০। আনিসুর রহমান, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৬১। মুসলিম উদ্দিন, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৬২। ওয়াজেদ আলী, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৬৩। সিরাজুল ইসলাম, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৬৪। দেলোয়ার হোসেন, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৬৫। খাইরুজ্জামান, কোম্পানী কমাণ্ডার; ৬৬। মোঃ শামসুল আলম, কোম্পানী সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৬৭। এম আর প্রধান, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৬৮। রফিউল আলম, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৬৯। আকবর আলী, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৭০। খুরশিদ আলম, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৭১। মেসবাহউদ্দিন, প্লাটুন কমাণ্ডার; ৭২। আতিয়ার রহমান, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড; ৭৩। শমসের আলী, প্লাটুন কমাার এবং ৭৪। শামসুল হক, প্লাটুন সেকেণ্ড-ইন- কমাণ্ড।

 এ ছাড়া আমি কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করি। নীচে সেসব অপারেশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলঃ

 প্রথম অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং মোগলহাটের মধ্যবর্তী রেললাইন ও ইঞ্জিনসহ উড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রকাশ যে, মোগলহাটে পাকবহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে প্রত্যেক দিন সকাল সন্ধ্যায় পাকসেনারা একদলকে রেখে ডিউটিরত দলকে অন্যত্র নিয়ে যেতো। ১৫ই সেপ্টেম্বর ভোর রাতে দুরাকুটি নামক জায়গাতে মাইন এবং বিস্ফোরক পদার্থ সহযোগে পাক-সেনাবাহিনীর রেলগাড়ী উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই অপারেশনে অন্ততপক্ষে ২৭ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে এবং ১০/১২ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচার করা হয়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করে। এই অপারেশনে আমি নিজে আহত হই এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা একজন শহীদ হন এবং ৪ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।  দ্বিতীয় অপারেশনঃ রংপুরের ভূরুঙ্গামারী জয়মনিরহাট রায়গঞ্জ অপারেশন। যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে করে পাকবহিনী কুড়িগ্রাম থেকে ধবলানদী অতিক্রম করে রসদ, গোলাবরুদ এবং সৈন্য পাটেশ্বরী, নাগেশ্বরী এবং ভুরুঙ্গামারীর দিকে সরবরাহ না করতে পারে সে জন্য এই অপারেশন চালানো হয়। এই অপারেশনে ভুরুঙ্গামারীতে মেজর নওয়াজেশ তার দল নিয়ে আক্রমণ করেন আর আমার দলের দুটো গ্রুপের একটা ছিল পাটেশ্বরী এবং অপরটি ছিল নাগেশ্বরীতে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঈদের রাতে এই অপারেশন চলে। এই অপারেশনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ১০/১২ জন সদস্য শহীদ হন, অপরদিকে পাকসেনাদের কমপক্ষে সোয়শ' সেনা নিহত হয়। এই অপারেশনেও আমরা সাফল্য অর্জন করি। এই অপারেশনে ১ জন অফিসারসহ ১০ থেকে ১৫ জন পাকসেনা ধরা পড়ে এবং ২ জন অফিসার নিহত হয়।

 ৩য় অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং তিস্তাঘাটের মধ্যবর্তী বড়বাড়ি ইউনিয়নে পাকবাহিনীর আরেকটি ঘাঁটি ছিল। নভেম্বরের ১০ তারিখের সন্ধ্যায় এই ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। আমার বাহিনীর মাত্র ৬০ জন সদস্য নিয়ে আমি নিজে এই ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের তীব্র আক্রমণের ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বাকীরা পালিয়ে যায়। আমরা ওদের রান্নার কাজে সহযোগিতাসহ আমাদের খবর সরবরাহকারী তাদের পাচক এবং সেই ক্যাম্পে যে মহিলাকে নিয়ে পাকসেনারা রাত কাটাতো তাকেও ধরে নিয়ে আসি। এই অপারেশনে আমাদের ৪/৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক ভাবে আহত হয়। পূর্বোল্লিখিত আমার বাহিনীর ২-এম দল তিস্তাঘাট এবং তার আশেপাশে ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই পাক-সেনাদের অবস্থানগুলোয় আক্রমন চালায় এবং তাদের সফল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে তারা রংপুর হেডকোয়ার্টারে কেন্দ্রীভূত হয়। এছাড়া ২-এম দলও পীরগাছা থানা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোর ঊর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায়। তাদের সে আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী কুলাতে না পেরে পীরগাছা ছেড়ে রংপুরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এইসব আক্রমণে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হই। এসব আক্রমণে বিপুলসংখ্যক রাজাকারও নিহত হয়। প্রসঙ্গতক্রমে আরো উল্লেখ্য যে, এরা ছিল পাকবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ এলাকার আক্রমণকারী।

 সীমান্ত এলাকা থেকে দীর্ঘ ৬৫ মাইল ভিতরে আমার বাহিনীর ১-পি দল মিঠাপুকুর থানার রানীপুকুরে শত্রুবাহিনীর উপর সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। তারাও ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই শত্রুবাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে তোলে এবং তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। তাদের হাতেও অনেক রাজাকার নিহত হয় এবং আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে ১০ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই সমস্ত এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এরপরে ক্যাপ্টেন মতিউর রহামন পাটগ্রাম থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন এবং আমি আমার বাহিনী নিয়ে লালমনিরহাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। ডিসেম্বরের ১১/১২ তারিখের দিকে আমরা তিনজন নিজ নিজ দলসহ লালমনিরহাটে মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি এবং ১৪ই ডিসেম্বরে রংপুর শহরে পৌঁছে রংপুর ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকি। বিকেলে মিত্রবাহিনীও রংপুর পৌঁছে এবং তারা আমাদেরকে ক্যাণ্টনমেণ্টে আক্রমণ স্থগিত রাখার অনুরোধ জানান। তাঁরা ইতিমধ্যে মেসেজ পেয়েছিলেন যে রংপুরস্থ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে এবং সেজন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমণ থেকে বিরত হই। আমাদের রংপুর পৌঁছার খবর পেয়ে সেখানকার জনগণ ও আশেপাশের গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আগত সাধারণ মানুষ আমাদেরকে এবং মিত্রবাহিনীকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেন। তাদের বিজয়োল্লাস এবং আমাদের প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ও প্রাণবন্ত সংবর্ধনায় আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি।

স্বাক্ষরঃ এম, দেলোয়ার হোসেন
১৬-১০-৭৪

সাক্ষাৎকারঃ মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশীদ

 আমাকে দেওয়া হয় ৬নং সেক্টরের ১নং সাব-সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব। ১৩ই জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয় থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে ৬নং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণাধীনে দিনাজপুর জেলার তেতুলিয়া নামক স্থানে ১৭ই জুলাই দায়িত্বভার গ্রহণ করি।

 প্রথম সপ্তাহে আমার সাব-সেক্টরের মুক্ত এলাকা রেকি করা হয় ও পরিচয় হই। সেই সময় উক্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছিল। জুলাই মাসের ২৯ তারিখে তেঁতুলিয়া থানা উন্নয়ন কেন্দ্রে সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে একত্রিত করার চেষ্টা করি। সেখানে তৎকালীন ই-পি-আর, আনসার মুজাহিদ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের জোয়ানরা একত্রিত হই। তার মধ্যে তৎকালীন ৯নং ই-পি-আর উইং-এর জোনের সংখ্যাই বেশী ছিল। এখানে তিনটি কোম্পানী গঠন করা হয়।

 ‘এ’ কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার আহমেদ হোসেন, প্রাক্তন ই-পি-আর,

 ‘বি’ কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার খালেক, প্রাক্তন ই-পি, আর;

 ‘সি’ কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার আবুল হোসেন, প্রাক্তন ই-পি-আর।

 আগষ্ট মাসের ২ তারিখে ভজনপুরে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। ৪ঠা আগষ্ট ভজনপুর থেকে কোম্পানী দেবনগরে ডিফেন্স নেয়। সেখানে অবস্থানকালে ময়নাগুড়ি, কামারপাড়া, বিলখাঁজুদ, ফকিরপাড়া, নয়াপাড়া গ্রামসহ সাত-আট মাইল জায়গা দখল করে নেয়া হয়। সেখানে পাকবাহিনীর পোস্ট হিসাবে ছিল। এইসব এলাকা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের ভিতরেই আমাদের দখলে চলে আসে। আগস্ট মাসের ২য় সপ্তাহের মধ্যে সম্মুখের দিকে ১ মাইল জায়গা আমরা দখল করে নেই। প্রশস্ত ছিল ৭ মাইল। সেখানে জাবরী দেয়ার, গোয়ালঝার, বানিয়াপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, বামনগাঁও, কামাদা ও ভেলুকা পাড়া গ্রাম দখল করে নেই। সেখানে পাক বাহিনীর প্রতিরক্ষা বৃহ্য ছিল। এই সময় পাকবাহিনী আমাদের উপর ভেল্‌কাপাড়া, গোয়ালঝাড় ও জারীদোয়ার গ্রামে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে প্রথমে আমাদের কোম্পানী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেই সময় আমার অনুরোধে ভারতীয় আর্টিলারী রেজিমেণ্ট পাকবাহিনীর উপর শেলিং করে। এই সুযোগে আমরাও তাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালাই, ফলে পাকবাহনী উক্ত গ্রামগুলি ছেড়ে পিছনে চলে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদত্বরণ করে ও কয়েকজন আহত হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকে আর এক কোম্পানী গঠন করা হয় ছাত্র, যুবক ও কিছু সামরিক জোয়ান দিয়ে। এই কোম্পানী কমাণ্ডার নিযুক্ত হয় সুবেদার আবুল হোসেন। সে সময় আমাদের মোট শক্তি চার কোম্পানীর মত। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে চুই নদীর পশ্চিম পাড়ে চকরমারী গ্রাম, ফকিরপাড়া, খইপাড়, ডাঙ্গাপাড়া, পাথিলগাঁও, জুতরারপাড়া, খাসপাড়া, বালিয়াপাড়া ও প্রধানপাড়া আমরা দখল করে নেই। এই এলাকা দখলে আনতে আমাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সঙ্গে কয়েকবার সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং সমস্ত চুই নদীর পশ্চিম পারে পাক-বাহিনীর মুখোমুখি ডিফেন্স নেওয়া হয়। সেই সময় ভারতীয় বি- এস-এফ বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সময় সাহায্য করে। চুই নদীর পশ্চিম পারে চার কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্স লাগিয়েছিল। সে সময় আমাদের অপর কোম্পানী ও আমাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।

 সেপ্টেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহে পাকবাহিনীর পাক্কা ঘাঁটি অমরখানা তিন কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ করি। অমরখাণায় পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় কিন্তু পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পুনরায় চুই নদীর পশ্চিম পারে আমাদের ডিফেন্সে চলে আসি। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে জগদলহাটে পাকবাহিনীর ঘাঁটির উপরে আক্রমণ চালাই। জগদলহাটেও পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের ভীষণ যুদ্ধ হয় কিন্তু তাদের তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে চুইনদীর পশ্চিম পারে চলে আসি।

 অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে অমরখানা ও জগদলহাটে পুনরায় আক্রমণ করা হয়। কিন্তু পাক-বাহিনীকে প্রতিহত করা যায় নাই। অক্টোবর মাসের ২য় সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত ২য় লেঃ এ, মতিন চৌধুরী ও ২য় লেঃ মাসুদুর রহমান আমার সাব-সেক্টরে যোগদান করে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ভিতরে পচাগড়, পুটিমারী, বোদা, ঠাকুরগাঁও ও বীরগঞ্জে এবং দিনাজপরের এফ এফ বাহিনীকে হালকা অস্ত্র ও গ্রেনেড দিয়ে পাঠান হয়। সেই সময় পাকবাহিনী-রাজাকারদের ডিফেন্সের উপর আমাদের কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধাগণ সেকশন ভিত্তিতে ভাগ হয়ে পাকবাহিনীর গতিপথে রেইড ও এ্যামবুশ করে। আমাদের এ্যামবুশে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। এইভাবে নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত পাকবাহিনীর উপর হামলা, রেইড ও এ্যামবুশ চলতে থাকে।

 ২২শে নভেম্বর রাতে আমার তিন কোম্পানী নিয়ে পুনরায় অমরখানা আক্রমণ করি। এই যুদ্ধে ভারতীয় আর্টিলারী পাকবাহিনীর ঘাঁটির উপরে খুব শেলিং করে। তীব্র আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী হটে যায়। আমরা অমরখানা দখল করি। এই যুদ্ধে বি-এস-এফ বাহিনী আমাদেরকে কভারিং ফায়ার দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করে। সেই দিনই ভারতীয় ১২-রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেণ্ট অমরখানার সম্মুখে অবস্থান নেয়। নভেম্বর মাসের ২৩ তারিখে চুই নদীর পশ্চিম পারে আমদের ডিফেন্সের পিছনে ভারতীয় ৭নং মারাঠা রেজিমেণ্ট অবস্থান নেয়। মুক্তিযুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যায়।

 ২৩শে নভেম্বর রাতে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় আমরা জগদলহাট আক্রমণ করি। উভয়পক্ষে ভীষণ গুলি বিনিময় ও আর্টিলারী শেলিং হয় কিন্তু সেদিন জগদলহাটে আমাদের সাফল্য লাভ হলো না। আমাদের পক্ষে সেই যুদ্ধে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়। ২৪শে নভেম্বর পুনরায় জগদলহাট আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে পাক বাহিনী জগদলহাট ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে পচাগড় অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করে। জগদলহাট আক্রমণে ভারতীয় ১২- রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেণ্টের 'এ' কোম্পানী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে যুদ্ধ করে। জগদলহাট দখলে আমাদের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত্বরণ করে। তার মধ্যে হাওলাদার সকিমউদ্দিন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদাত্বরণ করে। কয়েকজন আহত হয়।

 এই সময়ে চুই নদীর পশ্চিম পারে অমরখানা ও জগদলহাটে বরাবর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যগণ পজিশন নেয়। ২৪শে নভেম্বর সম্মিলিত বাহিনী জগদলহাট থেকে পচাগড় অভিমুখে রওনা হয়। পথে পচাগড় থেকে ১ মাইল দূরে থাকতে পাকবাহিনী আমাদের উপর বিক্ষিপ্তভাবে শেলিং ও গুলি করতে থাকে। ফলে সেখানে ডিফেন্স নিতে হয়। উক্ত জায়গায় আমাদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত্বরণ করে ও সাতজন আহত হয়। তার মধ্যে ২য় লেঃ এম, মতিন চৌধুরীও গুরুতরভাবে আহত হয়।

 পঁচাগড়ে পাকবাহিনীর খুব মজবুত ঘাঁটি ছিল। এখানে পাকবাহিনীর প্রায় তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়োজিত ছিল। পাকবাহিনীর পচাগড়ের চতুর্দিকে পাক্কা বাংকার ও মজবুত ট্রেঞ্চ ছিল।

 ২৬ শে নভেম্বর রাতে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ১ ব্যাটালিয়ন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২ ব্যাটালিয়ন যৌথভাবে পাক-বাহিনীর পাকা ঘাঁটি পচাগড় আক্রমণ করে। সারারাত যুদ্ধ চলে কিন্তু পাকবাহিনী পচাগড় ডিফেন্সে থাকতে সমর্থ হয়। এই রাতে ভারতীয় বাহিনীর ১০০ জনের মতো জোয়ান ও ২২ জন মুক্তিবাহিনী হতাহত হয়। ২৭ তারিখ সারা দিনরাত যুদ্ধ চলে। সেদিন ভারতীয় বিমান বাহিনী পঁচাগড়ে পাকবাহিনীর উপর বিমান হামলা চালায় এবং ২৮ তারিখ দিনেও আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২৮ তারিখ রাতে পুনরায় ভারতীয় বাহিনীর তিন ব্যাটালিয়ন ও মুক্তিযোদ্ধা ১ ব্যাটালিয়ন ও ৩ শত এফএফ তাদের উপর আক্রমণ চালায়। সেই রাতে ভারতীয় আর্টিলারী রেজিমেণ্ট ৬০টি গান থেকে একসাথে শেলিং করে। উক্ত রাতে ৬ হাজার গোলা পাক ডিফেন্সের উপর নিক্ষিপ্ত হয়। পাক-বাহিনী ২৮ তারিখ রাতে পঁচাগড় ছেড়ে ময়দান দিঘীতে ডিফেন্স নেয়। ঐ রাতের যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর ২৫০ জনের মত হতাহত হয়। এখানে পাক বাহিনীর ২শত জনের মত হতাহত হয়। ২৭ জন পাক-সেনাকে জীবন্ত ধরে ফেলা হয়। প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ৮টি গাড়ী উদ্ধার করা হয়। পঁচাগড় যুদ্ধ মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবহিনীর বাংলাদেশের ভিতরে বৃহৎ যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম।

 ৩০ তারিখ দিনের বেলায় বোদা থানার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বেলা তিনটার সময় পুটিমারী নামক স্থানে দুশমন আমাদের অগ্রগতি প্রতিহত করে। ফলে আমরা সেখানে ডিফেন্স নিতে বাধ্য হই।

 ৩১ তারিখ ১২টায় আমরা পাকবাহিনীর উপর আক্রমন চালাই। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর ৫ জন ও ভারতীয় বাহিনীর ৫৫ জন হতাহত হয়। পরে আমরা ময়দানদীঘি দখল করে ফেলি। বিকালে আমরা বোদার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পাকবাহিনী বোদাতে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমরা বাধ্য হয়ে বোদা থানার ১ মাইল দূরে ডিফেন্স নেই। বিকালে বোদা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করি। এখানে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের ভীষণ যুদ্ধ হয়। এখানে ভারতীয় আর্টিলারীর ক্যাপ্টেন সুধীর নিহত হয়। সন্ধ্যায় বোদা থানা আমাদের দখলে আসে। পাকবাহিনীর ৬০/৭০ জন হতাহত হয়। ভারতীয় বাহিনী বোদাতে এসে বিশাম নেয় কিন্তু মুক্তিবাহিনী বোদা থেকে তিন মাইল সম্মুখে ঠাকুরগাঁয়ের পথে ডিফেন্স নেয়। সেদিন রাতে ভুলে মিস ফায়ার হয়। তাতে ভারতীয় ২০/২৫ জন জোয়ান হতাহত হয় এবং আমাদের খাদ্য ও রান্না বহনকারী পার্টির ৪/৫ জন নিহত হয়। এ রাতেই ভারতীয় কোম্পানীর সহিত মুক্তিবাহিনীর ৪০ জন জোয়ানকে পাঠাই। তারা ভুলিরপুলের নিকটে গেলে পাকবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তখন ভারতীয় বাহিনীও তাদের পাল্টা জবাব দেয়। পাক সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে তাহারা ভুলির ব্রীজ নষ্ট করে পিছনে হটে। ১লা ডিসেম্বর আমরা ব্রীজ থেকে ২ মাইল দূরে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকি। ভারতীয় বাহিনী তখন ব্রীজ মেরামত করে।

 ৩রা ডিসেম্বর আমরা সম্মিলিত বাহিনী ঠাকুরগাঁও দিকে অগ্রসর হই। এই সময় পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁ ত্যাগ করে। ঠাকুরগাঁতে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের কোন সংঘর্ষ হয় নাই। ঐ দিনই আমরা ঠাকুরগাঁও দখল করে ঠাকুরগাঁও থেকে আরো তিন মাইল সম্মুখে অগ্রসর হই। ৪ তারিখে আমরা বটতলী নামক স্থানে ডিফেন্স করি। ৫ তারিখ সারাদিন পাকবাহিনীর পুতে রাখা মাইন উঠাই। ৬ তারিখে আমরা বীরগঞ্জ আক্রমণ করি। পাকবাহিনীর সহিত আমাদের বহু সময় যুদ্ধ চলে। শেষে পাকবাহিনী বীরগঞ্জ ছেড়ে পিছনে হটে। এখানে ভারতীয় বাহিনীর ১০/১২ জন জোয়ান নিহত হয়। ৭ তারিখে আমরা সম্মিলিত বাহিনী ভাতগাঁও ব্রীজের দিকে রওনা হই। পাকবাহিনী তখন ভাতগাঁও ব্রীজ নষ্ট করে রাস্তার দু পাশে মাইন পুঁতে রেখে পিছনের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তখন ভাতগাঁও ব্রীজের চারপাশ থেকে মাইন তুলতে শুরু করি।

 ৯ তারিখে আমাদের দুটি কোম্পানী ও ভারতীয় দুটি ব্যাটালিয়ন দিনাজপুর আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। দিনাজপুরের নিকটে গিয়ে কাঞ্চন নদী পাড় হয়ে আমরাও দিনাজপুর আক্রমণ করি। এখানে পাকবাহিনীর সহিত আমাদের অনেকক্ষন যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর ৩০/৩৫ জন নিহত ও ১০/১২ জন নিখোঁজ হয়। পরে আমরা সেখান থেকে পিছনে হাঁট। ফেরার পথে দশ মাঙ্গল নামক স্থানে পাকবাহিনীর আর একটি ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করি। এখানে আমরা ২৩ জন পাকসৈন্যকে জীবন্ত ধরে ফেলি এবং প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি সরে পড়ি। কারণ পাকবাহিনীর কয়েকটি ট্যাংক পিছন থেকে আসছিল।

 ১০ তারিখে ভারতীয় দুটি ব্যাটালিয়ন সৈন্য পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে, কিন্তু এখানে পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণে তারা আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ১৫০ জন জোয়ান মারা যায়। পরে পাকবাহিনী পিছনে হটে। তখনও আমাদের হেডকোয়ার্টার বীরগঞ্জেই ছিল। ইতিমধ্যেই হিলি থেকে আমাদের বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী হিলি দখল করে দিনাজপুরের নিকট এসে পড়ে। ১২ই ডিসেম্বর আমরা দিনের বেলায় খানসামা আক্রমণ করি। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীও ছিল। এই আক্রমণে ভারতীয় বাহিনীর ১৫ জনের মত ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবং আমাদের ৭ জন মারা যায়। এখানে আমরা মেজর খুরশিদসহ ১৯ জনকে জীবন্ত ধরে ফেলি। ঐ দিনই আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হই এবং নীলফামারী দখল করে ফেলি।

 ১৩ তারিখে আমরা সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হই। সৈয়দপুর থেকে ৫ মাইল দূরে পাক ট্যাঙ্কের সহিত আমাদের ট্যাঙ্কের সংঘর্ষ হয়। তাতে ভারতীয় বাহিনীর দুটি ট্যাঙ্ক ও পাকবাহিনীর তিনটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ১৩ তারিখ বিকালে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অধিনায়ক ও একজন অফিসারসহ প্রায় ১০৭ জন পাকসৈন্য আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

 ১৫ই ডিসেম্বর রাতে পাক ব্রিগেড কমাণ্ডার সাইফুল্লাহ যুদ্ধ স্থগিত রাখবার জন্য অনুরোধ করেন। কিছুক্ষন পর তিনি কয়েজন গার্ডসহ আমাদের সম্মিলিত ক্যাম্পে আসেন। তার সঙ্গে আমাদের অনেক সময় ধরে আলাপ-আলোচনা হয়। পরে পাক ব্রিগেড কমাণ্ডার চলে যান।

 ১৭ তারিখ সকালে সেখানে অবস্থানরত সকল পাকসৈন্য মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

স্বাক্ষরঃ মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশীদ
কুমিল্লা সেনানিবাস
১৪-১০-৭৩

সাক্ষাৎকারঃ সৈয়দ মনসুর আলী

 ১৯৭১-এর ২রা নভেম্বর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব আমাকে মুক্তিবাহনীর দুটি এলাকার (বুড়াবুড়ি এবং যাত্রাপুর) কোম্পানী কমাণ্ডার করে পাঠান। প্রথমে নগেশ্বরী থানার মাদারগঞ্জে করা হয় ক্যাম্প এবং সেখান থেকে যাত্রাপুর অপারেশন করা হয়। একদিন যাত্রাপুর বাজারে তিনজন পাকসেনা এবং ৯ জন রাজাকার আসলে তাদের আক্রমণ করি এবং ৩ জন পাকসেনা এবং ৯ জন রাজাকার সংঘর্ষে নিহত হয়। জনগণের সহায়তায় ১৫০ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করা হয় (৯ই নভেম্বর, ১৯৭১)। ৯ই নভেম্বর স্বাধীন বাংলায় প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সংঘর্ষের খবর পেয়ে কুড়িগ্রাম থানায় ঘোগাদেহ ইউনিয়নের ৩০০ রাজাকার স্বেচ্ছায় তাদের হাতিয়ারসহ যাত্রাপুরে আমার নিকট আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের খবর বিভিন্ন স্থানের রাজাকরাদের মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা কুড়িগ্রাম মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে যেমন নুনখাওয়া বুড়াবুড়ি, মোগলবাছা ইত্যাদি ইউনিয়ন থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কুড়িগ্রাম শহরের পাকসৈন্যের ঘাঁটি থেকে বহু রাজাকার তাদের হাতিয়ারসহ পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

 কুড়িগ্রাম শহরের নিকটবর্তী মোগলবাছা ইউনিয়নে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি ছিল আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনবার পাক ঘাঁটি আক্রমণ করি। তৃতীয়বারের সংঘর্ষে উনিপুরগামী ট্রেনের দুটি বর্গী বিচ্ছিন্ন করি ডিনামাইট দিয়ে। এত প্রায় ৩৫ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। মোগলবাছা ইউনিয়নের অর্জুনমালায় রেলসেতুর লাইনের নীচে ডিনামাইট রাখা হয়েছিল। পাকবাহিনীর ট্রেন অতিক্রমের সময় ডিনামাইটটি বিস্ফোরিত হয়। কার্যরত সময়ে বিস্ফোরণে মীর নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়।

 ৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যোশীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে বর্বর পাক বাহিনীর অবস্থানে ভারী ও দূরপাল্লার কামান দিয়ে আক্রমণ করে। পাক বাহিনী তেমন মোকাবিলা না করেই কুড়িগ্রাম থেকে সরে পড়ে।  মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ১০ই ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম নতুন শহরে উঁচু পানির ট্যাংকে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। পাকবাহিনীর অবস্থান ঘাঁটিসমূহ ছিলঃ (১) রিভারভিই হাইস্কুল (ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং গোলন্দাজ গ্রুপ) (২) কুড়িগ্রাম ধরলা নদীর ঘাট; (৩) কুড়িগ্রাম সি-এণ্ড-বি অফিস গোডাউন; (৪) নূতন টাউন কোর্ট বিল্ডিং; (৫) শান্তি কমিটি ও রাজাকার ট্রেনিং কেন্দ্র (সঞ্জীব করঞ্জাইয়ের গোডাউন ও কুড়িগ্রাম কলেজ)।

স্বাক্ষরঃ সৈয়দ মনসুর আলী টিংকু
29-9-93

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর মোঃ কাজিমউদ্দীন

 জুন মাসের শেষের দিকে উইং কমাণ্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার আমাদের সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হইয়া আসিলেন এবং তেঁতুলিয়ায় তাঁহার দপ্তর স্থাপন করিলেন। তিনি পাক বিমান বাহিনীর অফিসার। সদ্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। স্থলযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁহার সীমাবদ্ধ বৈকি! তবু তাহাকে পাইয়া আমরা আরও উৎসাহিত হই এবং আমাদের মনোবল বাড়িয়া যায়। তিনিও অল্পদিনের মধ্যে বিশেষ নিপুণতার পরিচয় দিয়া আমাদেরকে চমৎকৃত করিলেন। রংপুর ও ঠাকুরগাঁও এলাকা নিয়া সেক্টর গঠিত ছিল। তেতুলিয়ায় থাকিয়া কিছুদিন পর্যন্ত কাজ করার পর স্কোয়াড্রন লীডার সদরউদ্দিন সাহেব আসিলেন। ৬নং সেক্টরকে ২টি সাব সেক্টরে ভাগ করা হইল। ঠকুরগাঁ এলাকা নিয়া সাব সেক্টর ৬-এ এবং রংপুর এলাকা নিয়া সাব সেক্টর ৬-বি। সদরউদ্দিন সাহেব ৬-এ সাব সেক্টর কমাণ্ডার এবং ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব সাব সেক্টর ৬-বি এর কমাণ্ডার নিযুক্ত হইলেন। তখন ক্যাপ্টেন নজরুল হক সহ-সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হইলেন। জুলাই মাসের প্রথম দিকে নজরুল হক সাহেব অসুস্থ হওয়ায় আমাকেই পুনরায় কমাণ্ড নিতে হইল, কেনন সদরউদ্দিন সাহেবও উপস্থিত ছিলেন না। আমাদের কাজ চলিতে থাকে। প্রারম্ভ হইতে এই সময় পর্যন্ত আমরা স্বাধীন এলাকার জনসাধারণের সাহায্য-সহানুভূতি পাইয়াছি প্রচুর। সমর্থন ও ভালবাসা পাইয়াঠি অফুরন্ত। এই দুর্দিনে এদের মধ্যে এককভাবে যিনি আগাগোড়া আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসিতেন, এমনকি অনেক সময় সামরিক অফিসারের ভূমিকা নিয়া কাজ করিতেন তিনি হইলেন পঞ্চগড় ময়দানদীঘির স্বনামধন্য এডভোকেট জনাব সিরাজুল ইসলাম এম-সি-এ।

 যাই হউক, ইতিমধ্যে আমরা নূতন সেক্টর কমাণ্ডারের নির্দেশ ও প্রেরণায় এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পাইতেছি। দুশমনকে অনেকটা ঘেরাও করিয়া তাহার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টায় আছি। ভজনপুর ডিফেন্স হইতে কোম্পানীগুলিকে উঠাইয়া এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে ৩-৬ মাইল আগে বাড়াইয়া অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে লাগানো হইল। কাজেই দুশমনের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষ আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল। বন্ধুরাষ্ট্রের সাহায্যে আমরাও দুশমনকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিলাম। দিনে দিনে নূতন মুক্তিসেনার দল ট্রেনিং শেষে বাহিনীতে আসিয়া যোগ দিতে লাগিল, আর পরিকল্পনা অনুসারে আমরা তাহাদিগকে দখলকৃত এলাকায় পাঠাইতে আরম্ভ করিলাম। এই সময় আমরা ফিল্ড হেডকোয়ার্টার ভজনপুর হইতে ৫ মাইল সামনে দেবনগর নামক স্থানে স্থাপন করিলাম এবং সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার তেঁতুলিয়া হইতে ভজনপুর নিয়ে আসা হইল। তখন কোম্পানীগুলোর পজিশন ছিল-সুবেদার হাফিজের ‘এ’ কোম্পানী পঞ্চগড়ের পিছনে কাগপাড়া ওমরখানা, নায়েক সুবেদার আবদুল খালেকের 'বি' কোম্পানী সাহেবজুত- বেরাজুত এবং নায়েক সুবেদার মুরাদ আলীর ‘সি' কোম্পানী নয়াপাড়া এলাকা। সন্দেহ নাই, পূর্বের বিধ্বস্ত অবস্থা কাটাইয়া আমরা তখন অনেকটা সংগঠিত ও সুবিন্যস্ত। তবু যেন একটা বিরাট শূন্যতা সব সময় আমরা অনুভব করিতে লাগিলাম। মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় এমনি সময় জুলাই মাসের ১৫ তারিখে আঞ্চলিক অধিনায়ক উইং কমাণ্ডার বাশার একজন নূতন অফিসার নিয় দেবনগর আসিলেন কনফারেন্স করিতে। তথায় উপস্থিতদের মধ্যে সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন, সুবেদার মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ, নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলী এবং নয়িক সুবেদার আব্দুল খালেকের নাম উল্লেখযোগ্য। সি-ও সাহেব বলিলেন, “আমাদের মুক্তিবাহিনী পুরোপুরি সংগঠিত হইতে যাইতেছে এবং ভবিষ্যতে আমাদেরে যুদ্ধের অসুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই লাঘব হইবে।” তারপর তিনি সঙ্গে আসা সেই নতুন অফিসারকে পরিচয় করাইয়া দিলেন এবং তাহাকে আমাদের সাব-সেক্টরের ফিল্ড অফিসার হিসাবে নিযুক্ত দিলেন। অন্যান্য অফিসারের অনুপস্থিতিতে সাময়িকভাবে তিনি সাব-সেক্টর কমাণ্ডার পদেও অধিষ্ঠিত হইলেন। আমি আবার সহকারী হিসেবে কাজ করিতে লাগিলাম।

 নূতন ফিল্ড অফিসার পাইয়া আমরা ভারী খুশী। তাহার সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হইল। খুব হাসিখুশী, চটপটে আর ছোট্ট গড়নের মানুষটি তিনি, কিন্তু তেজোদিপ্ত চেহারা। পাক পদাতিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন তিনি। নাম সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান। কুমিল্লার অধিবাসী। বর্তমান বসতি চাটগাঁ। ’৬৮তে কমিশন পাইয়াছেন- শুরুতে ১১-বালুচ ও পরে ৩১-এফ-এফ রেজিমেণ্টে চাকুরী করিয়াছেন। সেখান হইতে ন্যাশনাল সার্ভিস ক্যাডেট কোরে চলিয়া যান এবং পলায়ন পূর্বপর্যন্ত লাহোর রৈস্যাবারে পি-টি-এস-ও এবং প্রশিক্ষণদাতার পদে বহাল ছিলেন। কার্য উপলক্ষে আজাদ কাশ্মীর, ঝিলাম, মংলা, শিয়ালকোট প্রভৃতি স্থান ঘুরিয়া অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। '৭১ সালের ৩রা জুলাই কোন এক সুযোগে (পশ্চিম) পাকিস্তান হইতে পালাইয়া আসেন তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিতে। শুধু নিজেই আসেন নাই সঙ্গে নিয়া আসিয়াছেন আরও তিনজন অফিসার। যাই হউক, অতঃপর কনফারেন্স শেষে অফিসাররা চলিয়া গেলেন সেদিনকার মত।

 ১৮ই জুলাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার আমাদের অধিনায়ক পদে যোগদান করিলেন দেবনগরে। দেখিলাম আমাদের প্রথম দর্শনের অনুমান মিথ্যা নয়। তাহার উপস্থিতিতে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম অভূতপূর্ব এক নিহত মোড় নিল। তাহার যাদুস্পর্শে যেন সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল সুপ্ত সাব-সেক্টর, অকুতোভয় অপারাজেয় মনোবলের অধিকারী আর নিবেদিতপ্রাণ খাঁটি বাংলা মায়ের সন্তান তিনি। নিমেষে খাপ খাওয়াইয়া নিলেন নিজেকে বাংলার কাদামাটির সঙ্গে। নিখুঁত বীর, মর্দে মোজাহিদ তিনি। মুক্ত এলাকার জনসাধারণ এবং আমরা তাহার কাজে মুগ্ধ হইয়া আদর করিয়া তাহাকে বাংলার বিচ্ছু বলিয়া ডাকিতাম। অনেকের মত নাক সিটকাইয়া ভ্রু কুচকাইয়া ভড়ং দেখান না। তিনি আসিয়াই সমস্ত ডিফেন্স এরিয়া ঘুরিয়া প্রত্যেকটি সৈনিকের সঙ্গে দেখা করিলেন এবং তাহাদিগকে বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা ও উৎসাহ দান করিলেন। সৈনিকেরা তাঁহার পরশে আবার যেন নতুন করিয়া আশার আলো দেখিতে পাইল। তাহাদের এতদিনের শূন্যতা ঘুচিয়া একটা মুখ্য অভাব পূরণ হইল। কারণ ক্যাপ্টেন ছিলেন পদাতিক বাহিনীর লোক। তাই নবম শাখার অভাব-অসুবিধা সম্বন্ধে অবগত হইতে এবং খুটিনাটি খুঁজিয়া বাহির করিতে তাঁহার বেশী সময়ের প্রয়োজন হয় নাই। অবশ্য মানসিক ও দৈহিক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল যথেষ্ট। সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল রেশন ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও সংগ্রহ নিয়া। এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও এজেন্সীর সাথে যোগাযোগ করিয়া আন্তরিক সম্পর্কের মাধ্যম সংগ্রহ ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করিয়া আনিলেন তিনি। তারপর ডিফেনসিভ পজিশন ও যুদ্ধের অন্যান্য জরুরী ব্যাপারগুলির খুটিনাটি খুঁজিয়া বাহির করিয়া কিছুটা ঠিক করিলেন। যে সমস্ত সৈন্য নানাভাবে বিভিন্ন সময়ে ছত্রভঙ্গ হইয়া বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়াছিল তাহাদিগকে খবর পাঠানো হইল। কোন কোন স্থানে লোকও পাঠানো হইল যাহাতে তাহারা নিজেদের ইউনিটে যোগদান করে। ক্রমে সৈন্যসংখ্যা বাড়িতে লাগিল এবং তাহারা মাসিক ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পাইতে শুরু করিল। সৈন্যদের মনোবল ক্রমাগত দৃঢ় হইতে লাগিল এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে বুঝিতে পারিল এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর শক্তি ও রণনৈপুণ্য দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে। তাই তাহারাও তাহাদের শক্তি ও সংখ্যা বাড়াইতে লাগিল। এইদিকে নবম শাখার কিছু লোক, পুলিশ ও আনসার তেঁতুলিয়া, বাংলাবান্ধা ও অন্যান্য স্থানে বিশ্রামে রত ছিল। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার সেই দিকেও খেয়াল করিলেন। ইতিমধ্যে আমাদের পুরাতন তিনটি কোম্পানী পঞ্চগড়ের দিকে আরও দুই মাইল অগ্রসর হইয়া পজিশন নিল। পাকিস্তানীদের শক্তি এবং সংখ্যাও দিন দিন বাড়িতে লাগিল। তাই তেঁতুলিয়া ও অন্যান্য স্থানের বিশ্রামরত লোকদেরকে ক্যাপ্টেন নিজে গিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়া আসিলেন এবং তাহাদিগকে নিয়া নতুন কোম্পানী খাড়া করিলেন। কোম্পানীর নাম দেওয়া হইল 'ডি' এবং সুবেদার আবুল হাশেমকে সেই কোম্পানীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হইল। নূতন কোম্পানীর কিছু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল, তাই কয়েকদিন তাহারা ডিফেন্সের পিছনে থাকিয়া তা সমাপ্ত করিল। ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর কর্মতৎপরতা বাড়িয়া উঠিল। তাহাদের সাথে আমাদের ছোটখাটে সংঘর্ষ হইল। এরপর প্রধানপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া ও নুনিয়াপাড়া নামক গ্রামে তাহারা হঠাৎ আমাদের উপর বড় রকমের আক্রমণ চালায়। ইহাতে আমাদের কিছু লোক আহত ও শহীদ হইলেন। ‘এ’ কোম্পানী যেটা উক্ত এলাকায় ছিল প্রায় ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। কিন্তু তাহার সুযোগ্য অধিনায়ক সুবেদার হাফিজ একদিনের মধ্যেই সমস্ত কোম্পানীকে একত্র করতঃ আরও শক্ত করিয়া ডিফেন্স নিলেন। তারিখটি ছিল ২৮শে জুলাই। দিন কয়েক পর পাকিস্তানীদের কয়েকটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি- যাহা চাওই নদীর তীরে ছিল- তাহাতে আমরা প্রচণ্ড আঘাত হানি। তাহাদের অনেক হতাহত হয়। আমরা কিছু হাতিয়ার ও গোলাবারুদ কব্জা করি। এরপর ঘন ঘন ছোটখাটো আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ বেশ কয়েক দফা হইয়া গেল। আমাদের নিয়মিত ফাইটিং পেট্রল পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাইয়া বহু হতাহত করিতে লাগিল। এমন একটি দিন ও রাত বাকী থাকিত না যে, পাকিস্তানীরা আহত ও মৃত সৈন্য নিবার জন্য পাল্টা আক্রমণ ও কভারিং ফায়ার না করিত। এইদিকে আমাদের নবগঠিত 'ডি' কোম্পানীও পজিশনে আসিল এবং সবাই মিলে আরও এক মাইল অগ্রসর হইয়া পজিশন নিল। পাকিস্তানীদের বিতৃষ্ণার সীমা রহিল না কিন্তু সংখ্যা তাহাদের পূরণ হইতে থাকিত পিছনে হইতে নিয়মিত সৈন্য আমদানী করিয়া। এই পর্যায়ে একদিন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয়বারের মত আমাদের সাব সেক্টরে যান এবং ফিল্ড হেডকোয়ার্টার দেবনগরে শুভাগমন করতঃ বিভিন্ন অগ্রবর্তী ঘাঁটি পরিদর্শন করিয়া আমাদের জোয়ানদেরকে উৎসাহিত করেন।

 আমাদের কর্মতৎপরতা দেখিয়া কর্তারা খুশী হইলেন এবং গোলাবরুদ ও গোলন্দাজ সাহায্য নিয়মিতভাবে দিতে লাগিলেন। এইদিকে আমাদের মর্টার প্লাটুনও গোলাবারুদ পাইয়া গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী অবস্থানসমূহের উপর সুযোগমত বার বার গোলাবর্ষণ করিয়া তাহাদের মনে ভীতির সঞ্চার করিয়া দিল। আমাদের সাব-সেক্টরের সৈন্যসংখ্যা বাড়িল, হাতিয়ার বাড়িল, গোলাবরুদ বাড়িল, শক্তি এবং মনোবল আরও দৃঢ় হইল, কর্মতৎপরতা এবং রণনৈপুণ্যে পাকিস্তানীরা পরাজিত হইতে লাগিল, কিন্তু পূর্ণতার জন্য আরো কিছু প্রয়োজন ছিল, আরও প্রশিক্ষণ ও কলাকৌশল দরকার ছিল। তাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার একখানা ছোট বই ছাপাইয়া তাহার কপি সবাইকে দিলেন। তাহাতে সব নূতন-পুরাতন হাতিয়ারের যাবতীয় বিবরণ ও ব্যবহার পদ্ধতি সুন্দরভাবে লিখা ছিল। তাহাতে আরও ছিল বিভিন্ন ধরনের খবরাখবর ও উৎসাহের কথা, যাহা যুদ্ধের প্রয়োজনে জানা নেহায়েত দরকার। এইভাবে কাজের ও যুদ্ধের ফাঁকে অসুবিধা সত্ত্বেও চারিদিকে প্রশিক্ষণ চলিতে লাগিল। আমাদের ক্যাপ্টেন শ-খানেক উৎসাহী গ্রাম্য ছেলে ভর্তি করিলেন, যারা ছিল অত্র এলাকার বাসিন্দা। তাহাদের একমাস প্রশিক্ষণ দিবার পর চারটি কোম্পানীতে ভাগ করিয়া দেওয়া হইল, যাহাতে রাজাকার ও অন্যান্য দালাল ধরিয়া দিতে অসুবিধা না হয়। অধিকিন্তু এলাকা ও দুশমন সম্বন্ধে যেন সঠিক খবর পাওয়া যায়। এইসব নতুন লোক ভর্তি ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের বদৌলতে ইতিমধ্যে সাব-সেক্টরে একটি সুসংগঠিত পদাতিক ব্যাটালিয়নে পরিণত হইল।

 সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ একবার জগদলহাট অধিকার করা হইল কিন্তু পাকসেনাদের গোলন্দাজ ও জীপে বসানো মেশিনগানের গোলাগুলিতে টিকিয়া থাকা মুশকিল হইল। তাহারা পাল্টা আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। ঐ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হইতে পাকিস্তানীরা রীতিমত ভড়কাইয়া গেল, কারণ, তখন হইতে হাতেকলমে সামরিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভের জন্য সদ্য ও স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২/৩ শত করিয়া আমাদের কাছে আসিতে লাগিল। তাহারা সপ্তাহ দুই-একের জন্য আসিত এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের পর নিজ নিজ অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের জন্য চলিয়া যাইত। ইহাতে আমাদের সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার অনেক অসুবিধা হইত বটে কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে সুবিধও ছিল অনেক। আমাদের ক্লান্ত সৈন্যরা মাঝে মাঝে স্বস্তিতে বিশ্রাম করিতে পারিত।  জগদলহাটের আক্রমণটা কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত যুদ্ধের মহড়া ছিল। এ ধরনের মহড়া আমরা প্রায়ই করিতাম। ভীত ও নিরাশ পাকিস্তানীরা বহু হতাহতের দরুন হাঁপাইয়া উঠিল। সুযোগ বুঝিয়া আমরা আরও দুই মাইল অগ্রসর হইলাম এবং চাওই নদী আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়া আসিলাম। তাহাতে অবশ্য আমাদেরও কিছু হতাহত হইল। এ পর্যায়ে ৯ই অক্টোবর স্বাধীন বাংলার কমিশন প্রাপ্ত প্রথম ক্যাডেট দলের সদ্য পাশ করা তরুণ সেঃ লেফটেন্যাণ্ট আব্দল মতিন চৌধুরী ও সেঃ লেফটেন্যাণ্ট মাসুদুর রহমান আমাদের সাব-সেক্টরে যোগদান করিলেন। অফিসারের নিতান্তই অভাব ছিল, তাই নতুন হইলেও এতে আমরা যথেষ্ট উপকৃত হইলাম।

 এরপর পাকিস্তানীদের চলাচল একেবারে সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িল, কারণ আমরা অগ্রসর হওয়াতে অমরখানা-পঞ্চগড় রাস্তা আমাদের পেট্রল ও প্রতিরক্ষা হাতিয়ারের আঘাত ক্ষমতার আওতায় আসিয়া গেল। আমরা তাহাদের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিকর রক্ষাব্যূহ রচনা শুরু করিলাম। গড়ে বিভিন্ন অপারেশনে প্রতিদিন পাকিস্তানীদের পাঁচ/ছয়জন করিয়া হতাহত হইতে লাগিল। ২০/২৫ দিন এমনতর চলিল। পাকিস্তানীরা সৈন্য পরিবর্তন ও পরিপূরণ করিতে লাগিল।

 তারপর আমরা দুশমনদের সুদূরবিস্তৃত ঘাঁটিগুলি এমনভাবে ঘেরাও করিয়া বিভিন্ন হাতিয়ারের সাহায্যে আক্রমণ চালাইতে লাগিলাম যাহাতে তাহারা অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি ছাড়িয়া পিছে হটিতে শুরু করিল। এই সূত্র ধরিয়া ২১শে নভেম্বর বিকাল ৪ ঘটিকায় আমাদের প্রথম অগ্রভিযান শুরু হয় তেঁতুলিয়া-ঠাকুরগাঁ-সৈয়দপুর পাকা রাস্তাকে অক্ষরেখা ধরিয়া। দুশমন পালাইতেছে আর আমরা পিছনে ধাওয়া করিয়া চলিয়াছি। ২২ তারিখ অমরখানা দখল করিয়া জগদলের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। লাল স্কুলের কিছু আগে দুশমনের আভাস পাওয়া গেল। রাত তখন ১১টা। পিছনে বহু কিছু বাকী ভাবিয়া ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার অগ্রগমন বন্ধ করিয়া আত্মরক্ষামূলক পজিশন নিতে বলিলেন। অগ্রাভিযানের অক্ষে ছিল 'বি' ও 'সি' কোম্পানী। ‘বি’ কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আব্দুল খালেক আর 'সি' কোম্পানীতে ছিলেন লেফটেন্যাণ্ট আব্দুল মতিন এবং সুবেদার হাজী মুরাদ আলী। আবার তাহাদের ডাইনে-বামে ছিল যথাক্রমে সুবেদার আহমদ হোসেনের ‘এ’ কোম্পানী ও সুবেদার আবু হাশেমের 'ডি' কোম্পানী। তাহারা সকলে নিজ নিজ কোম্পানীর জিম্মাদারী এলাকা বুঝিয়া নিলেন ক্যাপ্টেনের কাছ হইতে।

 পরদিন সকাল হইতে শুরু হইল আমাদের অগ্রাভিযান। আমরা এখন দলে ভারী। আমাদের চার কোম্পানী ছাড়াও ৫/৭ শত মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। গোলাবারুদ সাজসরঞ্জামেরও কমতি নাই। কাজেই দুশমনের উপর দিলাম ভীষণ চাপ। দুশমনদের পা এখন শূন্যে। তাহারা বহুদিনের পুরাতন রক্ষাব্যূহসমূহ ছাড়িয়া দিয়া আর পা মাটিতে লাগাইতে পারিতেছে না। তাহাদের ভাব এখন পালাই পালাই, প্রাণ বাঁচাই। আমাদের ভাব মার-মার। তাহারা ভীতসন্ত্রস্ত সদাচকিত পলায়নপর। আর আমরা মহাপ্রাপ্তির বিজয়ের নেশায় আরও শতগুণে উৎসাহিত ও মাতোয়ারা দিগ্বিজয়ী বীরের বেশে অগ্রসরমান। এ যেন অনেকটা নেকড়ে আর মেষের মোকাবিলা। তবু জগদলের নিকট বেশ কয়েকজন আহত ছাড়াও আমার সাব-সেক্টরের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লেঃ নায়েক শকিলউদ্দিন শহীদ হন। আমাদের আগে বাড়ার পালা চলিতে লাগিল। কোথাও তুমুল সংঘর্ষ, কোথাও মামুলি, আবার কোথাও একবারে না।

 ২৭শে নভেম্বর। পঞ্চগড় শহর মুক্ত হইল। আগাইয়া চলিলাম। বোদা পৌঁছিলাম। যুদ্ধের সাধারণ বাধাবিপত্তি কাটাইয়া (কোথাও দুশমন কর্তৃক পুল উড়াইয়া দেওয়া, কোথাও বা মাইন পুঁতিয়া রাখা) অগ্রাভিযান জারি থাকিল। ৩রা ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁ শহর কব্জা হইল। ৪ঠা ডিসেম্বর সমাগত। এক্ষণে মিত্রবাহিনী সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ইউনিটসহ আমাদের সঙ্গে আসিয়া যোগ দিলেন। কেননা পকিস্তান ততক্ষণে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে এবং মহান ভারতও তাহার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করিয়া প্রত্যক্ষ সমরে নামিয়াছে। বাস। আমাদের পায়াভারী। আরও নির্ভয় ও বেপরোয়া হইয়া উঠিলাম- আগে বাড়িয়া চলিলাম। বিরাম নাই। আগে বাড়িতে বাড়িতে একেবারে বীরগঞ্জ-ভাতগাঁও ব্রীজ। এ অগ্রভিযানে ইতিমধ্যে বোদা, বীরগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে বহু দুশমন হইয়াছে আহত আর বন্দী। প্রচুর হাতিয়ার ও গোলাবারুদ, রেশন ও অন্যান্য সরঞ্জাম হইয়াছে আমাদের হস্তগত। রাজাকার এবং দালালের তো কথাই নাই। কুড়ি-কুড়ি শ-শ প্রতিদিন আত্মসমর্পণ করিতেছে আর অজস্র হাতিয়ার- গোলাবারুদ দিয়া যাইতেছে জমা।

 ৯ অথবা ১০ই ডিসেম্বর। স্থান ভাতগাঁও ব্রীজ আর তার আশপাশ এলাকা। দুশমনদের নিকট হইতে আসিল ভীষণ বাধা। দুইটি ট্যাঙ্ক ধ্বংসসহ বহু মিত্র সৈন্য হতাহত হইল, যাহা এই এলাকায় এর আগে হয় নাই কখনো। অগত্যা একনাগাড়ে কয়েকদিন ওখানে থাকিতে হইল, মিত্রবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হইল। সম্মুখের দিকে একেবারে চুপ থাকিয়া বাম হাতে খানসামা হইয়া হঠাৎ প্রবল আক্রমণ চালান হইল- যাহাতে অংশ নিল মিত্রবাহিনীর ছয়টি মাঝারিসহ ৬০টি কামান, একখানা হেলিকপ্টার, দুইটি ফাইটার ও একটি ট্যাঙ্ক বহর। মূহুর্তে বহু দুশমন সেনা হতাহত হইল, ধ্বংস হইল ৬ খানা ট্যাঙ্ক, বাকী দুশমন সৈন্য ঘাঁটি ছাড়িয়া লেজ গুটাইয়া নীলফামারীর দিকে দিল ছুট। ফলে প্রধান অংশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অবরুদ্ধ হওয়ার নিশ্চিত আশঙ্কায় দুশমনরা ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাহারা ভাতগাঁওয়ের বিখাত ও গুরুত্বপূর্ণ মজবুত পুলটিকে একবারে ধ্বংস করিয়া আমাদের জন্য একটি বিরাট বাধা সৃষ্টি করতঃ সে এলাকায় হইতেও পাততাড়ি গুটাইল একেবারে সৈয়দপুরে। আমাদের তরফ হইতেও দুইমুখী পশ্চাদ্ধাবন চলিতে লাগিল নাছোড়বান্দা হইয়া। সৈয়দপুর প্রায় ঘেরাও। হঠাৎ দেখা গেল পাকবাহিনীর হাতে সাদা নিশান-শান্তির প্রতীক-আত্মসমর্পণের চিহ্ন। জেনেভা কনভেশন- নমস্য। তাই আমাদের অস্ত্র সংবরণ করিতে হইল- লড়াইয়ে দিতে হইল ইতি। দিনটি ছিল ১৬ই ডিসেম্বর।

স্বাক্ষরঃ মোঃ কাজিমউদ্দিন
ডি-এ-ডি
১২-৬-১৯৭৪

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ নূরুজ্জামান[]

 ২৭শে মে ভোরবেলা সেক্টর কমাণ্ডিং প্রধান ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব, সুবেদার গোলাম মোস্তফা এবং আমি থানা হেডকোয়ার্টারে বসে ছিলাম। এমন সময় উলিপুর (থানা) নিবাসী বলে পরিচয়দানকারী দু'জন মৌলভী সাহেব পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা নদী অতিক্রম করে নাই বলে জানায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পুনরায় পাটেশ্বরী ডিফেন্সে পাঠাতে অনুরোধ করে। হানাদার সৈন্যরা ধরলা নদী অতিক্রম করে নাই এই মর্মে তারা শপথ করে। উক্ত শপথের উপর ভিত্তি করে একটি ট্রাক, একটি পিকআপ গাড়ী ও একটি জীপগাড়ী বোঝাই প্রায় ১০০জন গেরিলাকে ঐ দিনই পুনরায় পাটেশ্বরী ডিফেন্সে পাঠানো হয়। গেরিলদের বহনকারী গাড়ী তিনটি পাটেশ্বরী ডিফেন্সের কাছাকাছি পৌঁছাতেই এ্যামবুশরত পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে গেরিলারা দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে হানাদার সৈন্যদের সাথে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেরিলারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং বেশ কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। গেরিলা যোদ্ধাদের অন্যতম প্রধান কমাণ্ডার মোজাহিদ ক্যাপ্টেন শত্রুসৈন্যদের অজস্র গুলির মুখেও সংঘর্ষস্থল পরিত্যাগ করে নাই। বেশ কিছুসংখ্যক হানাদার সৈন্যকে খতম করে তিনি বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেন। এই সংঘর্ষে নিহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেনঃ ১। সিপাহী আবুল কালাম, সাবেক ই-পি-আর নং ১৯৩৭৭; ২। সিপাহী আবুল কাশেম, সাবেক ই-পি-আর নং- ৫৫৩৪; ৩। সিপাহী সেকেন্দার আলী, সাবেক ই-পি-আর নং- ১৪২৮০; ৪। এম এপ, দেলওয়ার হোসেন; ৫। এম, এফ ড্রাইভার আফজাল হোসেন; ৬। এম, এফ ড্রাইভার গোলাম রব্বানী; ৭। আতিকুর রহমান (কুক); ৮। সিপাহী আবুদল আলী, সাবেক ই-পি-আর; ৯। মোজাম্মেল হক (কুক); ১০। এম, এফ রবীজউদ্দিন ভুইয়া (ছাত্র); ১১। এম, এফ, আবুল কাশেম (ছাত্র); ১২।এম, এফ, আসাদুল্লা (ছাত্র); ১৩। এফ, এম, আব্দুল ওহাব (ছাত্র)। এই ঘটনার পর পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা নাগেশ্বরী থানা বাজারে ঢুকে সমগ্র বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাজারে অবস্থানরত একজন পাগলকে দেখামাত্র সৈন্যরা তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। হানাদার সৈন্যরা নাগেশ্বরী বাজারে প্রবেশের পরপরই রায়গঞ্জ সেতুর নিকট ডিফেন্সরত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়। ভূরুঙ্গামারী থানার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী রায়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন বৃহৎ সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

 নাগেশ্বরী থানায় অবস্থান পাকাপোক্ত করার পর হানাদার সৈন্যরা ভূরুঙ্গামারী থানার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ভূরুঙ্গামারী থানা সদরে অবস্থিত গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গেরিলা দফতর সীমান্তের ওপারে পশ্চিম বাংলার কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ বাজারে সরিয়ে নেয়া হয়। সেখানেই দ্রুত কয়েকটি অস্থায়ী গেরিলা ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়। পরে গেরিলা যোদ্ধারা এই অস্থায়ী ঘাঁটিগুলো থেকে ভূরুঙ্গামারী থানা সদরে পার্শ্ববর্তী স্থানে অবস্থানরত হানাদার সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ শুরু করে।

 সুবেদার বোরহান তাঁর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভূরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গত সাবেক রেলওয়ে স্টেশন সোনাহাটে চলে যান। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভূরুঙ্গামারী থেকে সাবেক পাটেশ্বরী রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী দুধকুমার নদীর উপর অবস্থিত পাটেশ্বরী রেলওয়ে ব্রীজ অতিক্রম করে সোনাহাটে যাতে পৌছতে না পারে সেজন্য পাটেশ্বরী ব্রীজের পূর্বতীরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মোতায়েন করা হয়।

 ১৫ই জুন সাহেবগঞ্জ অস্থায়ী ঘাঁটির গেরিলারা ভূরুঙ্গামারীর অদূরে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ই-পি- আর ফাঁড়িতে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। গেরিলাদের পক্ষে মোট তিনজন নিহত হন। নিহত গেরিলারা হলেনঃ (১) সিপাহী আব্দুস সোবহান, ই-পি-আর নং-১৬০৭৪; (২) সিপাহী মনসুর আহমদ, ই-পি-আর নং-৫৮০৪; (৩) কুক আবু কালাম (ই-পি- আর)।

 ২৯শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মোগলহাটে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর হঠাৎ হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হতাহত করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের বেশ কিছু অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হন।

 ১৪ই জুলাই বড়খাতায় অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুহাম্মদ আলী (ই-পি-আর নং ৭২৯৬) হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। বড়খাতায় হানাদার সৈন্যদের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর আর একটি দল আক্রমণ চালায় ২৩শে জুলাই। সিপাহী আনোয়ার হোসেন, ই-পি-আর এই সংঘর্ষে নিহত হন।

 ভূরুঙ্গামারী থানা সদরে প্রবেশের পর পাকসৈন্যরা বাজার সংলগ্ন ভূরুঙ্গামারী কলেজে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট দল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ২রা আগস্ট হানাদার সৈন্যদের উক্ত অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষই মেশিনগান ও কামান ব্যবহার করে। মুহুর্মুহু প্রচণ্ড কামানের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকে। হানাদার সৈন্যরা তাদের অবস্থান থেকে সরে না গেলেও বহু হতাহত হয়। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলী নিহত এবং বেশকিছুসংখ্যক আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর চাপ অব্যাহত রাখেন। ১৩ই আগস্ট পুনরায় বুরুঙ্গামারী বাজারের সন্নিকট থেকে হানাদার সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণ অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচণ্ড সংঘর্ষের রূপ নেয়। সৈন্যরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী কবির আহমদ, ই-পি-আর নিহত হন। এর পর থেকে আমাদের গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। ভারত থেকে আমরা পর্যাপ্ত গোলাবারুদ পাচ্ছিলাম। ভারী অস্ত্র চালনায় গেরিলা যোদ্ধারা বেশ দক্ষ হয়ে উঠছিল।  ২৫শে আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লীডার সিপাহী মকবুল হোসেনকে (ইপকাপ নং ২৯১২৭) কুড়িগ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে প্রতাপ গ্রামে ছদ্মবেশে তৎপর থাকাকালীন আমাদের গেরিলারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লীডার মকবুল নারীর ছদ্মবেশে উক্ত গ্রামে খবর সংগ্রহের জন্য ঘোরাফেরা করছিল।

 ৬ই নভেম্বর প্রত্যুষে প্রায় আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধা এম এফ/এফ-এফ ৪ থেকে ৫ ব্যাটেলিয়ান ভারতীয় সৈন্যদের সহযোগিতায় ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাটে (মহাযুদ্ধকালীন বৃটিশরাজ নির্মিত রেলওয়ে স্টেশন) পাকিস্তানী সৈন্যদের শক্তিশালী অবস্থান ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে দখল করে নেয়। এই প্রচণ্ড সংঘর্ষে বহুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানীদের বিপুলসংখ্যক আধুনিক মারণাস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী হস্তগত করে। ভারতীয় বাহিনীর কিছুসংখ্যক জোয়ান সংঘর্ষকালীন নিহত হয়। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের এম-এফ/এফ-এফ'দের মধ্যে মাত্র কয়েকজন নিহত হন।

 ১৩ই নভেম্বর ভূরুঙ্গামারী থানার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এইদিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সহায়ক সৈন্যদের সম্মিলিত বিরাট বাহিনীর বীরযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের দখল থেকে ভূরুঙ্গামারী মুক্তি করেন। এই অভিযানে ভারতীয় সহায়ক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার যোশী এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিচালনা করেন সাবেক বিমান বাহিনীর উইং কমাণ্ডার ও যুদ্ধকালীন সেক্টর কমাণ্ডার কে, এম, বাশার ও সাব-সেক্টর কমাণ্ডার মেজর নওয়াজেশ। ১৩ই নভেম্বরের এই সম্মিলিত আক্রমণে ৩ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে জীবন্ত ধরা হয়। কোন পথেই পাকিস্তানীরা পালাতে না পেরে বহু মারা পড়ে। সৈন্যদের পরিত্যক্ত বিপুল সমরসম্ভার সম্মিলিত বাহিনীর হস্তগত হয়। ভূরুঙ্গামারী দখলের পরপরই বেশ কিছুসংখ্যক বাঙ্গালী শিক্ষিতা মহিলাকে স্থানীয় সার্কেল অফিসার উন্নয়ন অফিসে বন্দী অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মহিলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বর্বর সৈন্যরা এদেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ করে এখানে এনে রেখেছিল।

 ২২শে নভেম্বর রংপুর জেলার অন্তর্গত বড়খাতায় হানাদার বাহিনীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে কোম্পানী কমাণ্ডার মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান (নং ০৫৯৩) শহীদ হন। এছাড়া আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা সংঘর্ষকালে শহীদ হন। সংঘর্ষে পাকিস্তানীরা গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেনঃ হাবিলদার রঙ্গু মিয়া (নং ৭০২১২৪৭) ও এম-এফ নাসির আহমেদ। (এম-এফ নাসির আহমদ ঐ সময় মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন)।

 ২০শে নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র লেঃ সামাদ কুড়িগ্রাম মহকুমার অন্তর্গত রায়গঞ্জ সি এণ্ড বি পুলের দুই পার্শ্বে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালান। তাঁকে ভারতীয় সহায়ক বাহিনী দিয়ে সাহায্য করে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার যোশী। প্রচণ্ড সংঘর্ষে এক পর্যায়ে যখন হানাদার সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতাহাতি সংঘর্ষ শুরু হয় তখন দুঃসাহসী সামাদ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিচালনা করছিলেন বীরবিক্রমে। হঠাৎ হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে তিনি আহত হয়ে সংঘর্ষে ক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত অপর মুক্তিযোদ্ধা হলেন ই-পি-আর সিপাহী কবীর আহমদ (৫০১৬৫) এবং আবদুল আজিজ। তীব্র মুখোমুখি যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাগণ শত্রুদের রায়গঞ্জ ও আন্ধারীঝাড় অবস্থান দখল করেন। বহুসংখ্যক পাকিস্থানী সৈন্য হতাহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আসে।

 ২৪শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নাগেশ্বরী থানাও পাটেশ্বরীতে অবস্থানরত সৈন্যদের ঘেরাও করে। ঐ দিনের সংঘর্ষে সাইদুর রহমান এফ-এফ ৯০/৩৫, সেরাজুল হক এফ-এফ ১১৮/২০ এবং সোহরাব আলী এফ-এফ ১১৮/৩৬ নিহত হন।  ২৮শে নভেম্বর সম্মিলিত বাহিনী নাগেশ্বরী ও বেপারীহাট মুক্ত করে। বেপারীহাট সংঘর্ষে সিপাহী এম-এফ আলী আকবর (৫০৭১২) এবং সিপাহী এম-এফ আবুল হোসেন (৫০৮৫৩) নিহত হন। এর পর পরই ধরলা নদীর উত্তর তীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়।

মোঃ নূরুজ্জামান
বাংলাদেশ রাইফেলস
১০ম শাখা, রংপুর
১৫-৭-৭৮

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মতিউর রহমান[]

 আমরা দিল্লী থেকে কলকাতাতে ফ্লাই করি মে মাসে। তারপর আমরা বাংলাদেশের ফোর্সেস হেডকোয়ার্টারে আসি। সেখানে নুরকে নিযুক্ত করা হলো এ-ডি-সি টু সি-ইন-সি। আমি এবং ডালিম- দু'জনকেই সি-ইন-সি'র গেরিলা এডভাইজার হিসাবে এ্যাপয়েণ্টমেণ্ট দেয়া হয়। আমি ছিলাম ৬নং সেক্টরের জন্য ডালিম ছিল যশোর এরিয়ার অর্থাৎ ৮নং সেক্টরের জন্য। আমরা জেনারেল ওসমানীর সাথে দিল্লী থেকে কলকাতা এলাম। যদিও আমি আমার ইউনিটে অর্থাৎ ৩য় ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু জেনারেল ওসমানী তাতে মত দিলেন না। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ৬নং সেক্টর এলাকায়। তখনও ৬নং সেক্টর হয়নি। ওখানে তখন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ছিলেন। তাঁর কাছে আমাকে রেখে দেন। আমাকে ইনস্ট্রাকশন দেয়া হয় আমি যেন বাংলাদেশের ভেতরে না ঢুকি। কেন আমাকে এই ইনস্ট্রাকশন দেয়া হলো আমি বুঝতে পারিনি। ইণ্ডিয়ানদেরকেও বলে দেয়া হয় আমাকে যেন বাংলাদেশের ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেয়া না হয়। আমি কর্নেল নওয়াজেশের সাথে থাকতে থাকতে বোর ফিল করি। কোন কাজ নেই একমাত্র এ্যাসেসমেণ্ট ছাড়া। আমি আস্তে আস্তে বি-ডি-আর ট্রুপস নিয়ে ছোটখাটো রেইড, এ্যামবুশ করতে থাকি। কর্নেল নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারী এলাকায় থাকতেন।

 একবার মনে আছে, ইণ্ডিয়ানরা খবর দেয় যে ভূরুঙ্গামারীতে ৩০/৩৫ জন পাকসেনা আছে। ৩৫ জন লোক খুব কমই। তখন আমি একটা প্লাটুন এবং কর্নেল নওয়াজেশ একটা প্লাটুন নিয়ে ভূরুঙ্গামারী রেইড করতে যাই। ম্যাপ অনুযায়ী আমাকে শুধু একটা নদী পার হতে হবে। আমার কাছে পাকিস্তানী সৈন্যের বুলেটকে যত না ভয় ছিল তার থেকে পানি পার হওয়া বেশী ভয়ের ব্যাপার ছিল। যাই হোক, তারা আমাকে দুটো কলাগাছ একসাথে করে ভেলা বনিয়ে তার উপর শুইয়ে টেনেটেনে পার করায়। এই নদীই রাতে আমাকে চারবার পার হতে হয়েছে। আমাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য তারা একবার এপারে আবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওপারে এভাবে চারবার পার করিয়েছে। যে সময়ের মধ্যে আমাদের ভূরুঙ্গামারী যাবার কথা সেই সময় পার হয়ে যায়। ম্যাপ অনুযায়ী আমি বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি, কেননা পানিতে আমি পুরোপুরি অন্য লোকের উপর নির্ভর করতাম। যখন ভোর হয়ে আসে তখন আমি ওদের চালাকি বুঝতে পারি। আমরা ফেরত আসি। তখন ইণ্ডিয়ান যে ব্রিগেডিয়ার ছিলেন তিনি খুব তচ্ছিল্যের সাথে আমাকে বলেছিলেন যে আমার জন্যই রেইডটা সফল হয়নি, আমার সাহস নেই এইসব। এতে আমার খুব রাগ ধরে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে দেখাবার জন্যে, সম্ভবতঃ জুলাই মাস হবে, পরের রাতে আমিও আমার ব্যাটম্যান এবং আরেকটা লোক আমরা তিনজনে ভূরুঙ্গামারী যাই। সেখানে আসলে একটা কোম্পানী ছিল। এই কোম্পানীর ৪ মাইল দূরে আরেকটা প্লাটুন ছিল। কোম্পানী কমাণ্ডার সন্ধ্যার সময় প্রায়ই বলতে গেলে রোজই, ঐ প্লাটুন থেকে মূল কোম্পানীতে চলে যেতো। আমরা প্ল্যান করি পথের মধ্যে ঐ কোম্পানী কমাণ্ডারকে এ্যামবুশ করবো। আমরা দুপুরে খাওয়ার পরে রওনা হলাম। আমরা বর্ডার ক্রস করে ভিতরে ঢুকি। জায়গায় পৌঁছে রাস্তা থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে থাকতে কোম্পানী কমাণ্ডারের জীপ আমাদেরকে ক্রস করে চলে যায়। ফলে তাকে এ্যামবুশ করা সেদিনের মত হয়নি। কিন্তু তাকে ধরবার জন্য খোলা মাঠের উপর দিয়ে আমরা পিছনে পিছনে দৌড়ে যাই, হঠাৎ দেখি সামনে সাদা বিল্ডিং। আমি শুনেছিলাম যে, ভূরুঙ্গামারী কলেজে পাকিস্তান আর্মি থাকে। ভূরুঙ্গামারীর একমাত্র সাদা বিল্ডিং হচ্ছে ঐ ভুরুঙ্গামারী কলেজ। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে ঐ সাদা বিল্ডিং-এর প্রায় ৩০ গজ দূরে চলে গিয়েছিলাম। যখন বাঁশঝাড় থেকে বের হই তখনই দেখি সাদা বিল্ডিং এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা থেমে যাই। আবার বাঁশ ঝাড়ের ভিতর চলে যাই। কেননা, এখানেই পাকিস্তান আর্মি থাকে। আমরা তখন ওদের কথাবার্তা শুনছি। বাঁশঝাড় থেকে কলেজ খুব বেশী হলে ৫০ গজ। সামনে ছোট ছোট পাটগাছ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চাঁদ ছিল, তাই পরিষ্কার সবকিছু দেখা যায়। কলেজের পাশ দিয়ে পাকিস্তানী সেণ্ট্রীগুলো হাঁটছে, আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ইণ্ডিয়ান ব্রিগেডিয়ার যে কমেণ্ট করেছিলো সেটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমার মাথায় চিন্তা ছিল কিছু একটা করতে হবে। সেজন্য আমি অপেক্ষা করতে থাকি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন বৃষ্টি আসে। অন্ততঃ মেঘ আসুক যাতে চাঁদ না থাকে, অন্ধকার হয়ে যায়। এ রকম অপেক্ষা করতে করতে রাত যখন দেড়টা-দুইটা তখন ঠিকই মেঘ আসলো এবং ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। রাত সাড়ে দশটার দিকে পাকিস্তানী আর্মি দিনের ডিউটি শেষ করে ঘুমাতে যায়, সেণ্ট্রী বাদে। আমরা সেনট্রীদের দেখতে পাচ্ছিলাম। হাঁটাচলা করছে। আমি এবং আমার ব্যাটম্যানের হাতে দুটা করে গ্রেনেড। আমাদের সাথে যে আরেকটি লোক ছিল ও হাতে এল-এম-জি ছিল। তাকে আমরা পাশে রেখেছিলাম। তাকে অর্ডার দিয়েছিলাম যে, গ্রেনেডের চারটা এক্সপ্লোশন হওয়ার পরে সে ফায়ার করতে থাকবে যেন আমরা উইথড্র করতে পারি। বৃষ্টির ভিতর আমরা পাটক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রস করতে করতে বিল্ডিং-এর কাছে পৌছাই এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি বিল্ডিং-এর বারান্দায় চৌকীর উপরে পাকিস্তানী আর্মিরা শুয়ে আছে। পাকিস্তানী সেনট্রীটা যখন হেঁটে আমাদের ক্রস করে চলে যায় তখন আমরা দুজন দৌড়ে আমাদের গ্রেনেড ফেলে দিয়ে ফেরত চলে আসি। তখনও আমরা জানতাম না পাকিস্তানীদের কি ক্ষয়ক্ষতি হলো। আমরা দৌড়ে ফেরত আসছি, ততক্ষণে পাকিস্তানীরা গুলি করতে শুরু করেছে। হঠাৎ আমি আছাড় খেয়ে পড়ে যাই। মনে হলো আমার পায়ে কিছু একটা লেগেছে। পরে দেখি আমার ডান পাটা অবশ হয়ে গেছে, আমি আর উঠতে পারছি না। আমার ব্যাটম্যান এবং আমার সাথের লোকটি দু'জনে ধরে আমাকে উঠায়। তখন দেখি যে আমার পায়ে একটা গুলি লেগেছে। গুলিটা বেশী ভেদ করে যেতে পারেনি, কেননা আমরা বেশ দূরে ছিলাম ওরা তাড়াতাড়ি ঘাড়ে করে আমাকে নিয়ে আসে। এবং আমরা আবার ইণ্ডিয়াতে ফেরত আসি। সেখানে আমাদের ডাক্তার ছিল, সে গুলি বের করে ব্যাণ্ডেজ করে দেয়। আমি সতিদিন পরেই ঠিক হয়ে যাই। পরে আমরা জানতে পারি যে, সেদিনের গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে ৭ জন পাক আর্মি নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়েছে।

 কয়েকদিন পর ভুরুঙ্গামারীতে দুই কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ করার প্ল্যান করা হয়। খুব সম্ভব জুলাই/আগস্টের দিকে। সেখানে পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল। ঐ জায়গাটা দখল করার জন্য আক্রমণের প্ল্যান করা হয়। ইণ্ডিয়ানরা আমাদের আর্টিলারী সাপোর্ট দেবে। আমরা দুই কোম্পানী সারারাত হাঁটার পরে ভোরবেলা ঐ কলেজের কাছে পৌছাই। ভোর হচ্ছে হচ্ছে এমন সময় জয়বাংলা বলে আক্রমণ করি। মোট দুটি কোম্পানী ছিল। দুটিরই ফিল্ড কমাণ্ডার আমি ছিলাম। কর্নেল নওয়াজেশ অবশ্য কোম্পানী কমাণ্ডারের কাজ করেননি, তিনি ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডারের কাজ করেছেন। তিনি যুদ্ধকে ডাইরেকক্ট করছিলেন। পিছন থেকে। এছাড়াও আরো ৮০জন গিয়েছিল, সেটা লেঃ ফারুকের অধীনে ছিল। তাদের কাজ ছিল নাগেশ্বরী থেকে যে রোড এসেছে ভূরুঙ্গামারীতে সেই রোডের উপর এ্যামবুশ করা, যাতে পাকিস্তানীরা রিইনফোর্সমেণ্ট না আনতে পারে। এজন্য সে প্রায় সাড়ে তিন মাইল দূরে জয়মনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এ্যামবুশ পাতে এবং আমরা ৫০ গজ দূর থেকে জয়বাংলা বলে আক্রমণ শুরু করি। পাকিস্তানীরা প্রথমেই গুলি করে। তাদের সম্মুখে যে বাঙ্কারগুলো ছিল সেগুলো থেকে উইথড্র করে তারা পিছনে সরে যায়। আমাদের লোকেরা সবাই পাকিস্তানীদের গুলি আসার সাথে সাথে মাটিতে শুয়ে পড়ে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাদের মাটি থেকে উঠাতে পারিনি। তবে আমি কিছু লোক নিয়ে কলেজ বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে যাই। ইতিমধ্যে ইণ্ডিয়ানরা যে আমাদের আর্টিলারী সাপোর্ট দিচ্ছিলো সেটা ভুল হওয়াতে আমাদের গোলাই আমাদের উপর এসে পড়তে শুরু করে, যার ফলে আমাদের ৪/৫ জন মারা যায়। আমরা দেখছিলাম যে পাকিস্তানীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা তাদের উপর গুলি করছিলাম। এবং কলেজ বিল্ডিং-এ তাদের যা কিছু ছিল তাতে আমরা আগেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ইতিমধ্যে পেছন দিক থেকে লেঃ ফারুক যে রোডের উপর এ্যামবুশ করেছিল শত্রুরা সেই এ্যামবুশের উপর দিয়ে তাদেরকে ক্রস করে আমাদের পিছনের দিকে চলে আসে। সুতরাং আমাদের সামনেও পাকিস্তানীরা ছিল, পিছন দিকেও পাকিস্তানীরা ছিল। যদিও কর্নেল নওয়াজেশ আমাকে আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলেন কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া মানে আমার দলের অনেক লোক হতাহত হওয়া। কারণ আমার দলের লোকদের ভাল ট্রেনিং নেই। পাকিস্তানীরা মর্টার ছোড়া শুরু করেছিল। ওখানে থাকা মানে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া। এই জন্য আমি ওখান থেকে আমার লোকজন নিয়ে উইথড্র করে আবার ইণ্ডিয়াতে ফেরত চলে আসি। এই ব্যাপারটা নিয়ে কর্নেল নওয়াজেশের সাথে আমার বেশ গণ্ডগোল হয়, যার ফলে তখন আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন এম, কে, বাশার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আমাকে একটা আলাদা সাব-সেক্টর দেয়া হবে। সেটা হচ্ছে পাটগ্রাম। পাকিস্তান আর্মি তখনও পাটগ্রামে আসেনি।

 পাটগ্রাম এমন একটা জায়গা যেটা লম্বায় প্রায় ২২ মাইল, চওড়ায় দু'পাশে ইণ্ডিয়া, অনেকটা লাউয়ের মত। লাউয়ের গলাটা আড়াই মাইল। আড়াই মাইল জমি বাংলাদেশের, দু'পাশে ইণ্ডিয়া। মধ্যখান দিয়ে একটা রেলওয়ে লাইন চলে গেছে। এজন্যই হয়তো সেই এলাকায় পাকিস্তান আর্মি আসেনি বা আসতে সাহস করেনি। আমাকে বি-ডি-আর মুক্তিফৌজের একটা কোম্পানী দিয়ে বলা হলো যে পাটগ্রাম এলাকাকে যে কোভাবে মুক্ত রাখতে হবে। আমি ঐ এক কোম্পানী নিয়ে সোজা চলে যাই পাটগ্রাম এলাকাতে। এবং লাউয়ের গলার মাঝখানটা অর্থাৎ যেখানটায় সবচেয়ে কম জায়গা সেখানে একটা ডেফেন্স নেই এবং এক কোম্পানী দিয়ে পাটগ্রামের ডিফেন্সের আয়োজন করি। এটা খব সম্ভব আগস্টের শেষের দিকে হবে। পরে অবশ্য আমাকে পাটগ্রাম ডিফেন্সের জন্য ৫টা কোম্পানী দেয়া হয় ৫টা মুক্তিফৌজ কোম্পানী। বাওরা বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে আমরা ডিফেন্স নেই। ইতিমধ্যে, খুব মজার ব্যাপার, পাকিস্তানীরা হাতীবান্ধায় চলে এসেছে। হাতীবান্ধা ও বাওরার মধ্যে পার্থক্য তিন থেকে সাড়ে তিন মাইল। পাকিস্তানীরা হাতীবান্ধায় এসে ডিফেন্স নিয়েছে আর আমি বাওরায় একটা ডিফেন্স খুলেছি। তখন বর্ষাকাল ছিল বলে রেললাইনের উপর ছাড়া কোন যানবাহন চলতে পারতো না। আমি চিন্তা করলাম রেলাইনটা যদি কাট করা যায় তাহলে পাকিস্থানীরা আর আসতে পারবে না। আমার সাথে ৯০ জন লোক, হাতে কোন মেশিনগান ছিল না। কিন্তু আমি তখনকার ইপিআরদের দেখে বুঝতে পারছিলাম যে তাদের পক্ষে পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে সবসময় একজায়গা ধরে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্য আমি রেলওয়ে লাইনের আশে-পাশে যে সকল গ্রাম ছিল প্রত্যেক গ্রামে ডিফেন্স করে রেখেছিলাম। আমি ভাবছিলাম যদি পাকিস্তানীরা একটা গ্রামে আক্রমণ চালায় তাহলে তারা যেন সেই জায়গা ছেড়ে পরবর্তী গ্রামে গিয়ে বসতে পারে। পাকস্তানীরা সাধারণতঃ এক এক রাতে এক এক গ্রামে আক্রমণ চালাতো। আমাদের লোকেরা পরবর্তী গ্রামে গিয়ে ডিফেন্স নিতো। ডিফেন্স খোলা ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গায় এসে কিছুক্ষণ থাকার পরে ভোর হওয়ার আগেই তাদের মেইন ডিফেন্স হাতীবান্ধায় চলে যেতো। আমরা আবার সকালবেলায় আমাদের পুরনো জায়গায় গিয়ে বসতাম। এ রকম খেলা চলতে লাগলো প্রায় এক মাসের মত। পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল হাতীবান্ধায়। এভাবে আগষ্ট মাস পার হয়ে যায়। এর মধ্যে আমি আরেকটা কোম্পানী পাই। তখন রেললাইনের দু'পাশে দুটো কোম্পানী লাগিয়ে একটা পার্মানেণ্ট ডিফেন্স নিযুক্ত করি। পাকিস্তানীদেরও তখন শক্তি বেড়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমার ৫টা কোম্পানী গড়ে ওঠে। আমাদের উপর বার বার আক্রমণ হওয়ার ফলে আমাদের বেশ ক্যাজুয়েলটি হতো। ফলে আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার মনে করলেন যে জায়গাটা ধরে রাখতে হবে, জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তিনি আমাকে আরো ৫টা কোম্পানী পরে দেন। আমার পিছনে বি-এস-এফ-এর এটা ব্যাটালিয়ন ছিল, তার পরে ইণ্ডিয়ান আর্মির একটা ব্যাটালিয়ন ছিল। আমাদের সাপোর্টে তিনটা ট্যঙ্ক ছিল এবং ইণ্ডিয়ান আর্টিলারীর ব্যাটারী ছিল। আমাদের ডিফেন্স খুব শক্তিসম্পন্ন হয়ে গেছে। পাকিস্তানীদেরও আর্টিলারী ব্যাটারী ছিল। মোট কথা, ডিফেন্সিভ যুদ্ধ দুই পাশ থেকেই চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা ক্রমাগত আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। কেননা আমাদের সামনের গ্রামে যদি আর্মিরা না থাকতো তখন আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে বসে থাকতাম। এভাবে এগোতে এগোতে আমরা সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানীদের থেকে ৪০০ গজ দূরে এসে ডিফেন্স নিলাম। মধ্যখানে ধানক্ষেত। এপাশে আমরা, ওপাশে ওরা। সে সময় আমাদের মরাল খুবই ডাউন ছিল। কেননা এ পর্যন্ত আমরা কোন কিছুতেই তেমন সফলকাম হতে পারিনি। পাকিস্তানী ডিফেন্সের বিপরীতেও আমরা আক্রমণ চালাই কিন্তু তাদের ডিফেন্স এত শক্ত ছিল যে, আমার লোকজনের তেমন ভাল ট্রেনিং না থাকায় অনেক সময় আমরা তাদের বাঙ্কারের উপর উঠে বসে থাকতাম। তারা বাঙ্কারের ভিতরে কিন্তু আমরা তাদেরকে মারতে পারতাম না। ফলে আমরা হতাহত হয়ে পিছনে হটতাম। এবং তারা যে মাইন বসাতো তাতে আমাদের অনেক লোক হতাহত হতো। সুতরাং আমি দেখলাম যে এভাবে আমাদের কোন সাকসেস হবে না, অন্যভাবে হয়তো হবে। আমার ডানপাশে ছিল তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর ওপাশে পাকিস্তানীদের অবাধ গতি। রৌমারী থানার অন্তর্গত সুঠিবাড়ী এলাকা বলে একটা জায়গা ছিল। আমরা খবর পেতাম সেখানে পাকিস্তানীদের একটা প্লাটুন আছে এবং সাথে ইপিকাফের আরো একটি প্লাটুন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী নিয়ে ঐ জায়গাটি রেইড করবো। আমার বিশ্বাস ছিল সাফল্য আমাদের আসবে। এবং এ সাফল্যে আমার ট্রুপসের মনোবল বেড়ে যাবে।

 আমি এক কোম্পানী নিয়ে বাওরা থোকে দুটি নৌকাযোগে তিস্তা নদী পার হই। সে রাতে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীর মাঝখানে পৌঁছে মনে হয়েছিল আমারে নৌকা বুঝি ডুবে যাবে এবং আমরা সবাই ডুবে মারা যাব কারণ নদীতে ছিল প্রচণ্ড স্রোত। নদী পার হয়ে গাইডের সাহায্যে আমরা সুঠিবাড়ী- যেখানে একটা বিল্ডিং ছিল, সম্ভবতঃ কৃষি দফতরের ভবন- প্রায় পৌছে যাই। বিল্ডিং-এর সামনে প্রায় ৫০ গজ চওড়া একটা ছোট ক্যানেল ছিল। আমাদের আক্রমণ করতে হলে ক্যানেলটি পার হতে হবে। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। আমি আমার কোম্পানীকে দু'ভাগে ভাগ করলাম। একটি দল ইতিমধ্যে ক্যানেল ক্রস করে রৌমারীর দিকের যে রাস্তা সেই রাস্তায় এ্যামবুশ করে বসেছে। প্ল্যান ছিল আমি আক্রমণ চালালে পাক ফৌজ পালিয়ে যেন রৌমারীর পথে যেতে না পারে। অপরদিকে রৌমারী থেকেও যেন পাকসেনারা সাহায্যে এখানে আসতে না পারে। আমি ক্যানেলটির পার থেকে পাকসেনাদের মুভমেণ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি নিজে ক্যানেল ক্রস করতে পারছিলাম না। দ্রুত সময় পার হচ্ছিলো। ক্রমশঃ আমার মনে দ্বিধা জন্মাচ্ছিলো আক্রমণ করবো কিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমণ করবোই। আমি আমার মর্টার দিয়ে প্রথম ফায়ার ওপেন করলাম। পাকসেনারা কিছুক্ষণ বিচলিত হয়ে পরক্ষণেই পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমি একসময় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার কোমরে দড়ি বাঁধা থাকতো। আমার ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাটম্যানও নদীতে ঝাঁপ দেয়। দড়ির বাকি অংশ তার হাতেই ছিল। ব্যাটম্যান টেনে আমাকে ক্যানেলের অপর পাড়ে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গের সবাই ক্যানেল পার হয়ে বিল্ডিং-এর উপর চড়াও হয়। পাকিস্তানীরা তখন পালাবার চেষ্টা করতে থাকে। এই আক্রমণে ১৫ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। ১৫ জনের ৭ জন ছিল পাক সেনাবাহিনীর এবং ৮ জন ছিল ইপিকাফ। আহত হয় প্রচুর। ঐ সংঘর্ষ আগস্টের শেষের দিকে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘটে। ঠিক তারিখ আজ আর মনে নেই। ভারতীয়রা বলতো প্রমাণ স্বরূপ যুদ্ধে নিহত পাকসেনাদের মাথা কেটে নিয়ে আসতে হবে। আমরা ১৫টি মাথা কেটে এবং তাদের ইউনিফর্ম নিয়ে আমাদের গন্তব্যে রওয়ানা হই। এই সংঘর্ষে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তিনজন গুরুতররূপে আহত হন। এই আক্রমণের জন্যেই পরবর্তীতে আমাকে বীরবিক্রম উপাধি দেয়া হয়। সংঘর্ষে আমার ছেলেদের মনোবল সাংঘাতিকভাবে বেড়ে যায়। পাকসেনারা যখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছিলো, তখন আমার ছেলেরা পিছু ধাওয়া করে তাদের হত্যা করছিলো। আমার ছেলেদের সাহসিকতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম আমি সেদিন। এই অপারেশনে আমার সাব-সেক্টরে ভীষণ মরাল ইফেক্ট হয়েছিল- যার ফলে আমার রেইডিং পার্টি পরবর্তীতে সৈয়দপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে রেইড করতো। এবং প্রতিটি রেইডই সাকসেসফুল হয়েছে।

 বয়রাতে আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা লম্বালম্বি নিয়েছিলাম। আমাদের সামনে ৪০০/৫০০ গজ দূরে পাকসেনারা ডিফেন্সে ছিল। পাকিস্তানীরা প্রায়ই আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ডিফেন্স দখল করার চেষ্টা করতো কিন্তু আমাদের ডিফেন্স এত মজবুত ছিল যে তারা বারবারই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করতাম তাদেরকে পিছু হটাতে।

 একটি অপারেশনের কথা আমার মনে আছে। পাকিস্তানীদের ডিফেন্সের সামনে মাইনফিল্ড ছিল। আমাদের এ্যাটাকিং ফোর্স লেঃ ফারুকের কমাণ্ডে মাইন ফিল্ড অতিক্রম করে পাকসেনাদের বাঙ্কারের উপর চলে গিয়েছিল-কিন্তু আমাদের ছেলেরা যুদ্ধের সকল বিষয় ওয়াকিবহাল না হওয়ায় যথাযথ আক্রমণে ব্যর্থ হয় এবং মাইনে আমাদের বেশ হতাহত হয়।

 পাটগ্রাম থানা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশেই চলতো আমাদের প্রশাসন ছিল এবং আমরা পুরো থানা নিয়ন্ত্রণ করতাম। পাটগ্রামের পিছনে বুড়িগ্রামে আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। হেডকোয়ার্টারে আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার এম, কে, বাশার থাকতেন। তিনি দিনাজপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত কমাণ্ড করতেন। তাঁর সম্পর্কে দু'একটি কথা বলতে হয়। যদিও তিনি বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন তথাপি তিনি অতি সাফল্যের সঙ্গে আমাদের প্রায় ৩০০ মাইল সেক্টর এরিয়া দেখতেন। তাঁকে কোন সময় রাতে বিছানায় শুতে দেখিনি। জীপে জীপেই একটু-আদটু ঘুমাতেন। কারণ সারারাতই তাঁকে এক সাব-সেক্টর থেকে অন্য সাব- সেক্টরে ঘুরতে হতো। তাঁর প্রেরণা ছিল অফুরন্ত- আমাদের পাথেয়।

 আমাদের হাতীবান্ধা অপারেশন ছিল ভয়াবহ। হাতীবান্ধাতে পাকিস্তানীদের একটি কোম্পানী ছিল। আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার চেষ্টা করেছি- হাতীবান্ধা দাখল করতে ব্যর্থ হয়েছি। নভেম্বর ২০/২১ হবে। ঈদের দিন ছিল। আমরা ঈদের সুযোগ নিয়ে ঠিক সকাল ৮টায় হাতীবান্ধা আক্রমণ করি যদিও দিনের আলোতে ঐ সময় আক্রমণের উপযোগী ছিল না। আমরা অবশ্য ভেবেছিলাম ঈদের দিন পাকসেনারা হয়তো একটু রিলাক্স করবে এবং ঐ সময় অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকবে। আমরা চারটি কোম্পানী নিয়ে দুদিক থেকে আক্রমণ করি। আমাদের সৌভাগ্য ছিল বলতে হবে। কারণ পাকসেনাদের একটি কোম্পানী বদলী হচ্ছিলো এবং নতুন দল সে স্থান দখল করছিল, কিছু সৈন্য রওয়ানা হয়েছে, কিছু হচ্ছে- কিছু নতুন সৈন্য পজিশনে গেছে, ঠিক এমনি সময়ে আমরা আক্রমণ করে বসি। আমাদের প্রথম আক্রমণেই পাক অফিসার কোম্পানী কমাণ্ডার নিহত হয়। কমাণ্ডার নিহত হওয়ায় পাকসেনারা পিছু পালাতে থাকে। তারা প্রায় ১০০০ গজের মত পিছু হটে একটি গ্রামে পৌছে ডিফেন্স নেয়। সেখানে তাদের আর্টিলারী পজিশন ছিল। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নেই। এই আক্রমণে ভারতীয় আর্টিলারী অবশ্য খুব সাহায্য করে। পরবর্তীতে সকল আক্রমণেই ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারী প্রভূত সাহায্য করে। আমরা ক্রমশঃ আঘাত হেনে পাকিস্তানীদের পিছু হটিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। আমার সাব-সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ১০ই ডিসেম্বর লাঙ্গলেরহাটে পৌঁছাই। ইতিপূর্বে হাতীবান্ধা ছাড়া এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ আর হয়নি। পাকসেনারা লাঙ্গলহাটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে তিস্তার অপর পারে চলে যায়। আমরা ১৩ই ডিসেম্বর হারাগাছা এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করি। সেখানে কোন পাকসেনা ছিল না। হারাগাছার এই স্থান থেকে রংপুরের দূরত্ব ৮ মাইল হওয়া সত্ত্বেও রংপুর পৌছাতে আমাদের সময় লাগে তিনদিন। কারণ পথে অনেক জায়গায়ই পাকসেনা ছিল। রংপুর এলাকাতে পৌছাই ১৫ই ডিসেম্বর। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলেও রংপুরে পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। হিলির দিক থেকে আগত ভারতীয় সেনাবহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইতিমধ্যে কর্নেল নওয়াজেশের সাব-সেক্টর ট্রুপসও চলে আসে। আমাদের দুই সাব-সেক্টর ট্রুপস এক হয়ে গিয়েছিল। আমরা আমাদের ট্রুপস নিয়ে রংপুরে থাকি। ভারতীয় বাহিনী রংপুর সেনানিবাসে অবস্থান নেয়।

 প্রশ্নঃ সমগ্র যুদ্ধকালীন সময়ে আপনার এমন একজন সহকর্মীর কথা বলুন যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা দেখিয়েছেন।

 উত্তরঃ আমি ফারুকের কথা বলবো। ফারুককে লেফটেন্যাণ্ট বলা হলেও যে কারণেই হোক পাকিস্তানে সে কমিশন পায়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে সে আমার সাব-সেক্টরে যোগদার করে। সে সময় আমার সাব-সেক্টরে আমিই একমাত্র অফিসার ছিলাম। আর একজন অফিসারের অভাব আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করছিলাম। ফারুককে পেয়ে আমি ভীষণভাবে খুশী হই। বস্তুতঃ তাঁর মত সাহসী ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। হাতীবান্ধা আক্রমণের পর আমি একটি বি-ও-পি থেকে অয়ারলেসযোগে পাকিস্তানীদের উপর 'আঘাত হানার জন্যে আর্টিলারী ডাইরেক্ট করছিলাম। সেক্টর কমাণ্ডার বাশার আমার প্রায় ৬০০ গজ পিছনে ছিলেন। আমি আর ফারুক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আর্টিলারীর গোলা ছুড়ছিলো। গোলা যখন পড়ে তখন লক্ষ্যবস্তুর আশেপাশে পড়ার পরই লক্ষ্যবস্তুর উপর ফেলা হয়। আমাদের আশেপাশে গোলা পড়ছিলো এবং বুঝতে পারছিলাম এখনই আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে পড়বে। ফারুককে বললাম কভার নিতে কিন্তু সে কভার না নিয়ে আমার কাছে সরে আসে। পাকিস্তানী কামানের গোলা তখন ১৫/১৬ গজ দূরে এস পড়ে। সৌভাগ্যই বলতে হবে, ডিপ্রেসন থাকায় গোলা তেমন কাজে আসে না। আমি গ্রাউণ্ডে গেলাম। আমি উঠেই তার খোঁজ করলাম, দেখি সে হাসছে। আমি বললাম চলো কভারে যাই। সে বললো, স্যার এখানে আর শেল পড়বে না। আমরা দু'জন যেখানে গোলা পড়েছিল সেই গর্তে গিয়ে দাঁড়ালাম। তেমনি ছোট ছোট অনেক ঘটনার মধ্যদিয়েই লেঃ ফারুকের সাহসিকতার পরিচয় পেয়েছি।

 আমি সেক্টর কমাণ্ডারের কথা বলবো। তাঁর সকল অপারেশনে যাওয়ার কথা নয়- কিন্তু তিনি মেজর অপারেশনের প্রতিটিতেই স্বয়ং থাকতেন, তদারক করতেন। এতে ট্রুপস- এর মনোবল বৃদ্ধি পেত।

 আর একজন বি-ডি-আর হাবিলদার রাঙ্গু মিয়ার কথা বলবে। তার চেহারা দেখতে মনে হতো যেন সে একটা ডাকাত। হাতীবান্ধা অপারেশনে রাঙ্গু মিয়া (শহীদ) বীরবিক্রম এবং নায়েব সুবেদার সম্ভবতঃ লুৎফর (শহীদ) বীরবিক্রমের কথা না বললেই নয়। তখন বেলা সাড়ে আটটা। পাকিস্তানীদের ডানদিকের পজিশন ফল করছে। কিন্তু বামদিকের অবস্থান চিল একটি বি-ও-পিতে। বেশ উঁচুতে। আমাদের উচিত ছিল আগে বামদিকের পজিশন দখল করা। পরে ডানদিকের পজিশনে আঘাত হানা। আমার প্ল্যানিং-এ ভুল হওয়ায় আমি প্রথমে ডান ও পরে বামদিকে আক্রমণ চালাই। কিন্তু ডানদিকে আক্রমণ চালিয়েই আমি আমার ভুল বুঝতে পারি এবং বামদিকে দখল না করতে পারলে যে আমরা এখানে থাকতে পারবো না তাও বুঝতে পারলাম। দুটি কোম্পানীর একটির কমাণ্ডার ছিলেন বি-ডি-আর নায়েক সুবেদার লুৎফর আর তাঁরাই সঙ্গে ছিল হাবিলদার রাঙ্গু মিয়া। আমরা এ্যাটাকিং পজিশন থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে একটা বাঁশছাড় থেকে এগুচ্ছি বামদিকে। সময় তখন বেলা সাড়ে দশটা। আমরা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পাক আর্টিলারী গোলা (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়তে লাগলো। এই গোলা শূন্যেই ফাটে এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশী। এরই মধ্য দিয়ে এই দু'জন বিডিআর সৈনিক নির্ভয়ে পাকিস্তানীদের বাঙ্কার চার্জ করে এবং দখল করে। এদের সাহস ও আত্মত্যাগ তুলনাহীন। জাতির দুর্ভাগ্য, দু'জনই সংঘর্ষে পাকিস্তানী বাঙ্কার চার্জ করতে গিয়ে শহীদ হন।

 প্রায় বাইশ মাইল লম্বা এবং চওড়া ন্যূনতম ৩ মাইল, কোথাও ১৮ মাইল আমার সাব-সেক্টর মুক্ত ছিল। বলতে গেলে পুরো পাটগ্রাম থানাটাই আমরা মুক্ত রেখেছিলাম আমার সাব-সেক্টরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একবার আসেন। স্থানীয় এম পি মতিউর রহমান মাঝে মাঝে আসতেন অন্য আর কেউ তেমন আসতেন না। সি-ইন-সি কোনদিন আসেননি। বিদেশী সাংবাদিক আসেননি, তবে ভারতীয় সাংবাদিকরা আসতেন।

সাক্ষাৎকারঃ মেজর মোঃ আবদুস সালাম[]

 জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ফুলবাড়িতে যে ক্যাম্প দেখে এসেছিলাম সেখানে যোগদান করি। শুরু থেকে আমার গেরিলা জীবনের শেষ পর্যন্ত এখানেই ছিলাম, অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এখান থেকেই ছোটখাটো অনেক অপারেশনে গিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বোয়ালিয়া ব্রীজ অপারেশন। আমরা বড় পুল বলতাম। এখানে রাজাকাররা পাহারায় ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই ব্রীজে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা। আমরা এ পরিকল্পনায় বেরিয়েছিলাম। ঐদিনই সম্ভবতঃ কুড়িগ্রাম থেকে একটা দল ট্রেনে করে তিস্তার দিকে যাচ্ছিলো। এই ব্রীজের আরেকটু দূরে আরেকটা দল বি-ডি-আর এর নায়েক সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। পরে আমরাও যোগ দেই সেই আক্রমণে, এবং আশেপাশের অনেক লোক, আনসারদের মধ্যে যারা ছিল তারা সবাই যোগ দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে হানাদারদেরকে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা সেখানে গিয়ে অনেক রক্তের দাগ দেখতে পাই এবং পরে জেনেছিলাম তাদের অনেক হতাহত হয়েছে। তারপর রেললাইনের নীচু দিয়ে অপর পাশের কভার দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাটা একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

 প্রঃ কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?

 উত্তরঃ এটা 'আনন্দবাজার' পত্রিকায় ছাপা হয়। ঐ সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলা তৎপরতার একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের খবর ছিল এটা।

 দ্বিতীয় ঘটনাটা তবে সম্ভবতঃ জুলাইয়ের শেষের দিকে বা আগস্টের প্রথম দিকে। আমি এই ঘটনায় প্রথমে ছিলাম না, পরে জড়িয়ে পড়ি। ঘটনাটা আমাদেরই এলাকায়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মেয়েলোকের পোশকে ঐ এলাকায় আসে। মকবুল খান তার নাম ছিল। মহিলা সেজে অন্য মেয়েলোক ধরতে অসুবিধা হবে না এই রকম একটা মোটিভ নিয়ে সে এসেছিল। আমরা গ্রামের মধ্যে আর্লি ওয়ানিং‍ সিস্টেম রেখেছিলাম। গ্রামের কোণে কোণে আমাদের যুবকরা পাহারা দিত। গ্রামের মধ্যে কেউ ঢুকলে ওরা তাড়াতাড়ি খবর দিত। একজন এসে বললো যে একটা মেয়েলোক গ্রামের দিকে আসছে, সে দেখতে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের মেয়েলোক সাধারণতঃ এই রকম দীর্ঘকায় মোটাসোটা হয়না। তাই সবার মনেই একটা সন্দেহ হলো। সে গ্রামে ঢুকেছে, মেয়েলোকদের ধরার চেষ্টা করেছে, পারেনি এবং এক জায়গায় একটা মেয়েকে ধরেছিল, সে চীৎকার করে পালিয়ে গেছে। এই খবরটা কিছুদূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এক পর্যায়ে যুবক দলের মধ্যে আবদুর রহমান নামে একটি সাহসী ছেলে লোকটিকে ধরে ফেলে। লোকটির কাছে বোধহয় একটা হুইসেল ছিল অথবা তার ঠোঁট দিয়ে সে খুব জোরে একটা হুইসেল দেয়। হুইসেল দেয়ার ফলে সেই বোয়ালিয় ব্রীজ থেকে গুলি গুরু হয়। সেখানে পোস্ট ছিল। সেখানকার লোক এসে তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ছেলেদের সেই দল মকবুল খানকে ধরে নিয়ে ধরলা নদী পার হয়ে ফুলবাড়িতে চলে আসে। সেদিনই আমরা যাচ্ছিলাম একটা অপারেশনে। ধরলার পারে ওদের দেখা পেলাম। মকবুল খানকে ফুলবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে আসি। পরে তাকে সাহেবগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তার কাছ থেকে অনেক কথা জানা যায়। সে ছিল পাঞ্জাবী। তার উদ্দেশ্য ছিল ঐ একটাই- গ্রামে এসে মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া। এটা একটা চমকপ্রদ ঘটনা বলতে হবে।

 তারপর ডাইরেক্ট কোন সংঘর্ষ আর হয়নি। তবে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। তখন আমরা ফুলবাড়ি ডিফেন্সে ছিলাম। লালমনিরহাট থেকে ফুলবাড়ির দিকে একটা রাস্তা গেছে। লালমনিরহাট এবং ফুলবাড়ি মধ্যে ধরলা নদী। ফেরীর ওপারে অর্থাৎ ফুলবাড়ির দিকে আমাদের এফ-এফ কোম্পানী ডিফেন্স ছিল এবং ডানদিকে এম-এফ কোম্পানীর ডিফেন্স ছিল। এম-এফ কোম্পানী ছিল মোবাইল। তারা ঐ এলাকায় যেতো, পেট্রোলিং করে আবার ফিরে আসতো। কিন্তু এফ-এফ কোম্পানী পার্মানেণ্টলি ওখানে থাকতো। একবার আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। সারারাত ওখানে পেট্রোলিং করেছি। আমার জীবনে এই প্রথম সেদিন গুলি ছুড়ি। আমাকে সেখানে শিক্ষা দেয়া হয় কিভাবে গুলি ছড়তে হয়। সারারাত খাওয়া হয়নি। দুপুরবেলা খাবার কিছু পাইনি। স্থানীয় এক বাড়িতে বসে আমরা জাউ খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের উপর মেশিনগানের ফায়ার। নাদীর এপার ওপার। মাঝখানে নদীর দূরত্ব ৫০০/৬০০ গজ। আমরা যে বাড়িতে খাচ্ছিলাম সে বাড়ির কলাগাছে এবং টিনের চালে খুব গুলি পড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গিয়ে পজিশন নিলাম। প্রশিক্ষণ তখনও কিছু নেই। তবে একটা রাইফেল হাতে কেবল নিয়েছি, দৌড়ে কিভাবে গুলি করতে হয় সেটা শিখেছিলাম। ওরা সবাই দৌড়ে গিয়ে রাইফেল হাতে তাড়াতাড়ি পজিশন নিয়েছে। আমিও নিয়েছি, তবে তত তাড়াতাড়ি না পারায় ১০/১৫ হাত পিছনে পজিশন নিয়েছি। ওরা সেখান থেকে ফায়ার করছে, পাল্টা জবাব দিচ্ছে। আমিও অনুমান ১০/১৫ হাত পিছনে একপাশ থেকে পাল্টা জবাব দিচ্ছি। আনসারের একজন লোক ছিল, সে আমাকে যেভাবে গালি দিচ্ছিলো, সে গালির কথা আমি কখনও ভুলবোনা। খুব মজার গালি- 'সামনে, সামনে এসে ফায়ার কর, নইলে তোকে মেরে ফেলবে।' ও শেখাচ্ছিলো যেন আমি আমার নিজের জীবন বাঁচাতে পারি। এবং একই সময় আমি আমার বন্ধুর জীবনকেও যেন রক্ষা করতে পারি। তারপর সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফায়ার করলাম। ২" মর্টার ছিল আমাদের কাছে। এক সময় ফায়ার বন্ধ করি। পরে জানতে পেরেছিলাম ওদের উদ্দেশ্য ছিল নদী পার হয়ে আসা। কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরী করেছিল তারা। পাকসেনারা লং রেঞ্জে ফায়ার করে দেখতে চেয়েছিল আমরা এপারে কেউ আছি কিনা। পরে আমাদের পাল্টা জবাব পেয়ে তারা আর নদী পার হবার সাহস পায়নি। এটা আগস্টের ঘটনা হবে। তারপর সেখান থেকে আমরা চলে যাই বাগভাণ্ডার বি-ও- পি তে। বাগভাণ্ডারে বি-ডি-আর' এর সুবেদার মেজর আরব আলী ছিল। তার একটি কোম্পানী ছিল এবং আমি সেই কোম্পানীর একজন সাধারণ সৈনিক ছিলাম। সুবেদার আরব আলীই সেই কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর অধীন বাগভাণ্ডার ডিফেন্সই আমি বেশ কিছুদিন ছিলাম ওখানে থাকাকালীন আমাদের কটা উল্লেখযোগ্য অপারেশন হয়েছিল অক্টোবরের শেষের দিকে। লেঃ সামাদ, যিনি শহীদ হয়েছেন জয়মনিরহাটে এবং লেঃ আবদুল্লাহ এরা কেবল কমিশন পেয়ে এসেছেন আর আমরা সেকেণ্ড ব্যাচের জন্য সিলেক্ট হয়েছি যাবো। এরা যখন প্রথম আসলো তখন এদেরকে নিয়ে একটা অপারেশন করা হলো, জয়মনিরহাটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা কোম্পানী সেখানে ছিল। আমরা তা জানতে পেরেছিলাম। এই রেইডের পরিকল্পনা করেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ, আমি সেদিন তাঁর সাথেই ছিলাম। আমি ছিলাম তাঁর সিগনাল অপারেটর, অয়ারলেস সেট নিয়ে একটা তেঁতুল গাছের উপরে মাচা তৈরী করে উনি ছিলেন আর আমি তেঁতুল গাছের নীচে অয়ারলেস সেট নিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে তিনি পাক ক্যাম্পের উপর ডাইরেক্ট করছিলেন আক্রমণ। আমার কোম্পানী, অর্থাৎ যেটা সুবেদার আরব আলীর কোম্পানী এবং ডানদিকে একটা এফ-এফ কোম্পানী ছিল সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে- এই দুটো কোম্পানীর একটি দেওয়া হল লেঃ সামাদের নেতৃত্বে এবং অপরটা লেঃ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে। এই দুটো কোম্পানী নিয়ে ভূরুঙ্গামারী আক্রমণ করি, সন্ধ্যের পর। পরিকল্পনা মোতাবেক দুটি কোম্পানী প্রায় ভূরুঙ্গামারীর কাছে পৌঁছে যায়। বাঁ দিকে সোনারহাটে যে কোম্পানী ছিল তাদেরকে রাস্তার উপর ব্লক করতে বলা হলো যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঐ দিকে পালিয়ে যেতে না পারে। তাদের একটাই পথ খোলা রাখা হয়েছিল, সেটা হলো নাগেশ্বরীর দিকে। কিন্তু ঐ কোম্পানী ঠিকমত এ্যাকশন নিতে পারেনি, ফলে পাকস্তানীরা ভুরুঙ্গামারী ছেড়ে সোনাহাটা দিয়ে ভিতরে ঢোকে এবং উল্টা দিক দিয়ে আমাদের দিকে ফায়ার করতে শুরু করে। আমরা জানতে পাই যে ওটা আমাদের এফ-এফ কোম্পানীর দল না। ওটা পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হয়ে উল্টা দিক দিয়ে ভিতরে এসে আমাদের ওপর আঘাত হানছে, এজন্যে সেখানে বেশীক্ষণ থাকা সম্ভব হয়নি। সব কিছু তছনছ করে, বাঙ্কার ভেঙ্গে দিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারেই ওখান থেকে ফিরে আসি। রেইড হিসাবে এটিকে আমরা সফল রেইড বলতে পারি, তবে আক্রমণ হিসাবে এটা সফল ছিল না। কেননা, পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা আবার সেখানে ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি[]

॥ রায়গঞ্জ দখলের লড়াই॥

 লেঃ সামাদ আর লেঃ আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের অয়ারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমাণ্ডো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো ১৯শে নভেম্বর পাকিস্তানীদের শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের জন্যে। সবার হাতে একটা করে স্টেন আর কিছু গ্রেনেড। প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারা বেরুলো রায়গঞ্জ দখলের। লেঃ সামাদের গ্রুপে ছিলো কমাণ্ডো মাহবুব, কাসেম ও অন্যরা এবং লেঃ আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিল ১৫জন শক্তিশালী কমাণ্ডো। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫- পাঞ্জাব রেজিমেণ্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। ঠিক হয় ৫০০ গজের মধ্যে গিয়ে অয়ারলেসে সামাদ ও আবদুল্লাহ দু'জনের পজিশন জানিয়ে দেবে। জাঙ্গল-শু পরে, চাদর গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাত ন'টায় নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে ৬নং সাবসেক্টর ভুরুঙ্গামারী থেকে ঈদের আগের রাতে। সোয়া ঘণ্টা যাত্রার পর রায়গঞ্জ ব্রীজের সন্নিকটে পৌছে লেঃ সামাদ সহসা দেখলেন তার গ্রুপের সবাই ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ট্র্যাপে পড়ে গেছেন। তিনি বুঝলেন ভুল রেকি হয়েছে। রায়গঞ্জ ব্রীজের নিচে ২৫ পাঞ্জাবের এল- -এম-জিসহ বাঙ্কার রয়েছে এ খবর তিনি পাননি। ছোট শিস-এর সংকেতে তিনি সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। অয়ারলেস সেট ওপেন করে 'হ্যালো আবদুল্লাহ' বলতেই শুরু হয়ে গেল ক্রস ফায়ারিং- সেই সাথে পাকিস্তানীরা তাদের ওপর আর্টিলারী গান ও ৩" ইঞ্চি মর্টার চালাতে লাগলো। বীর সামাদ বললেনঃ “কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না, মরলে সবাই মরবো, বাঁচলে একসাথেই বাঁচবো।” শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমৃত্যু পাঞ্জা লড়াই। অনেক শক্তিশালী ও দক্ষ এবং অনেকগুণ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ২৫-পাঞ্জাব বাহিনীর ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে বাংলার তরুন বীরেরা সেদিন ফুলের মত ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো। কিন্তু কেউ সামাদের আদেশ অমান্য করেনি। নিশ্চিত মৃত্যুমুখে থেকে, মুহুর্মুহু মর্টার শেল ও বুলেটের মুখে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কেউ এতটুকু দমেনি। নিজের শেষ বুলেটটি শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করেছে, তারপর নিজে শহীদ হয়েছে। আমাদের ১৫/২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন এক ব্যাটালিয়ন ২৫-পাঞ্জাবের বিরুদ্দে যে অসম সাহস ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করেছে পৃথিবীর যে কোন বীরত্বব্যঞ্জক লড়াই-এ সাথে তার তুলনা হতে পারে।

 অপরদিকে লেঃ আবদুল্লাহ হেডকোয়ার্টারকে ডেভলপমেণ্ট জানিয়ে দিল। ৬নং সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার বাশারের নেতৃত্বে মূল বাহিনী এগিয়ে এলো। ১৯ তারিখ ভোর থেকে ২০ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত কামান ও আর্টিলারী দিয়ে তিনি আঘাত হানলেন ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের উপর। গ্রাম থেকে লোক এসে বললো খান সেনারা ভেগে যাচ্ছে। ২১শে নভেম্বর সকালে সেই শক্তিশালী ট্ৰেইণ্ড ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট বিধ্বস্ত হয়ে রিট্রিট করলো ৫ মাইল দূরে নাগেশ্বরীতে।

 এই যুদ্ধে ২৫-পাঞ্জাবের কমপক্ষে সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচশ জন নিহত অথবা আহত হয়েছে। রণাঙ্গনেই পড়ে ছিল ৩০/৩৫ জনের মৃতদেহ। লেঃ সামাদের গ্রুপে মাহবুব ও কাশেম (অন্য রণাঙ্গনে তিনি পরে শহীদ হন) ফিরে আসতে পেরেছিল। এই যুদ্ধ ছিল আমাদের একটা বড় বিজয় এবং পাকিস্তানী ফোর্সের জন্য একটি আঘাত। কেননা ২৫-পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট ছিল তাদের গর্ব। কিন্তু এই যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা হারিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বীর। এবং সেই যুদ্ধে প্রত্যেকেই বীরের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আমরা তাদের সবাইকে সালাম জানাই। সালাম জানাই সেই নির্ভীক যোদ্ধা লেঃ সামাদকে। ২১ তারিখ ভোরে রায়গঞ্জ ব্রীজের কাছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, প্যাণ্টের ভিতর হাফশার্ট ঢোকানো, মাটির উপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় লেঃ সামাদকে সবাই দেখলো- জীবনে যেমন সে বীরবিক্রমে লড়াই করেছে, মরণেও তেমনি বীরবিক্রমে মাতৃভূমিকে আলিঙ্গন করে শুয়ে রয়েছে। উইং কমাণ্ডার বাশার সামরিক কায়দায় ডান হাত কপালে তুলে সেল্যুট করলেন তাকে। সেল্যুট করলো সবাই। জয়মনিরহাট মসজিদের পাশে তাকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু জানাজা পড়ার জন্য মৌলভী পাওয়া গেল না। সীমান্তের ওপার থেকে এক মসজিদের ইমামকে আনা হলো জানাজার জন্য। ৪১ বার গান সেল্যুটের সাথে সাথে রণাঙ্গনে বেজে উঠল লাস্ট পোস্ট। সব শহীদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করে সবাই চললো ফ্রণ্টের দিকে, হাতে ইস্পাতের চকচকে অস্ত্র, চোখে পানি। উইং কমাণ্ডার বাশার অন্যদের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। নিজে কাঁদছিলেন। ফ্রণ্টে ফ্রণ্টে বিজয় হয়েছে, সেই সাথে বেদনার সুর বেজেছে। অশ্রুজলে সবাই সিক্ত হয়েছে।

॥ বড়খাতা ব্রীজঃ ব্রীজ অন রিভার তিস্তা॥

 রাজধানী ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে বসে যারা ব্রীজ অন রিবার কাউয়াই” দেখে আতংকে ভয়ে শিউরে ওঠেন, তাদের কেউ জানলেন না কোনদিন যে, একাত্তরে সারা বাংলার বুক জুড়ে ব্রীজ কাউয়াই' এর চেয়ে লোমহর্ষক বহু অপারেশন করেছিল আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

 ‘বড়খাতা ব্রীজ’ অপারেশন তার একটি। এই ব্রীজটি উড়ানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্ল্যান করে মে মাসে। এই ব্রীজটি পাক হানাদারদের জন্য ছিল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কেনন, এই ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। যার সাথে রংপুরের সমগ্র এলাকা যুক্ত রেখে পাকবাহিনী ভারী রসদ ও সমরাস্ত্র সরবরাহ অটুট রেখেছে। এই ব্রীজ খতম করতে পারলে সরাসরি রংপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে হাতীবান্দা, বড়খাতাসহ ২২ মাইল এলাকা।

 ৬নং সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার খাদেমুল বাদশার সিদ্ধান্ত নিলেন হানাদারদের রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে। ওদের কাবু করতে হবে এবং এই বড়খাতা ব্রীজ উড়িয়ে দিতে হবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটা কমাণ্ডো গ্রুপ পাঠালেন তিনি। বড়খাতা ব্রীজের ওপর পাক-পাঞ্জাবীর বাহিনী ছিল প্রস্তুত। কোন সুযোগই ছিল না। মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডো গ্রুপটাকে কাছে ভিড়বার। ফিরে এলো তারা।

 জুলাই মাসের মাঝামাঝি আরেক কমাণ্ডো গ্রুপকে পাঠালেন। দুর্ভেদ্য সে অঞ্চল। পিঁপড়ের মত ছেয়ে আছে পাকফৌজ ব্রীজের ওপরে। নীচে। ডাইনে ও বামে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তারা।

 আগস্ট মাসের ৪ তারিখ। তৃতীয়বারের মত একটা গ্রুপ গেল সাথে প্রাক্তন ই-টি-আর বাহিনী বাঙ্গালী জোয়ান। ব্রীজের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছেছিল তারা। কিন্তু না। হানাদার বাহিনী শকুনের চোখ মেলে প্রস্তুত ছিল। ফায়ার ওপেন করে দিল আমাদের কমাণ্ডো গ্রুপটার ওপর। ক্যাজুয়েলটিসহ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তারা।

 বসলেন কমাণ্ডার খাদেমুল বাশার। হেডেকোয়ার্টারে ডাকলেন ঐ এলাকার সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে (বীরবিক্রম), ডাকলেন কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকারকে (বীরপ্রতীক)। চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়ে গেল হাতীবান্দার ম্যাপ নিয়ে। পথঘাট এঁকে দিয়ে দিলেন তিনি ক্যাপ্টেন মতিউর ও হারেসউদ্দিনের কাছে।

 পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ১ কোম্পানী ফোর্স ছিল এই ব্রীজ রক্ষায়। এতেই অনুমান কারা যায় এই ব্রীজের গুরুত্ব তাদের জন্য কত অপরিসীম ছিল। পাকিস্তানীদের পজিশন ছিল বড়খাতা ২ নং ব্রীজের ওপর ও দুই সাইড। রেলওয়ে স্টেশন ও গড্ডিমারির সংযোগ এই ব্রীজটি ছিল তিস্তা নদীর ওপর।

 তিন-তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর এই গুরুত্বপূর্ণ ‘এ্যাসাইনমেণ্ট' ঘাড়ে তুলে নিলেন বাংলার দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর ও হারেস। তৃতীয় ব্যর্থতার ৮ দিন পর ১২ই আগস্ট, রাত ৮ টা। এক কোম্পানী শক্তিশালী পাঞ্জাবী আর্মির সামনে কতজন বাঙ্গালী বীর গেলেন? ১২ জন। হ্যাঁ, মাত্র ১২ জন বাঙ্গালী বুকে দেশপ্রেমের মন্ত্র নিয়ে, মুখে কলেমা শাহাদাত 'লাইলাহা ইল্লাল্লাহু' পড়তে পড়তে বাউরা রেলস্টেশন থেকে যাত্রা করলো ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বীরবিক্রম), কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকার (বীরপ্রতীক), মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন (পরে যিনি পাটগ্রামে হানাদারদের হাতে শহীদ হন), নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, শওকত আলী প্রমুখ। হাতে তাদের এক্সপ্লোসিভস, ডেটনেট, এল-এম-জি, স্টেনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার। তাদের পেছনে প্রয়োজনমত কভারিং দেয়ার জন্য লেঃ মেজবাহউদ্দিনের (বীরবিক্রম) ও সুবেদার আবদুল মালেকের নেতৃত্বে ২টা এফ-এফ কোম্পানী থাকলো। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাউড়া থেকে জীপে যাত্রা শুরু করে তখন পাক-পজিশন ছিল ৫ মাইল দূরে ‘বড়খাতা ব্রীজ'। পাকবাহিনীর পজিশনে দুই মাইল দূরে গিয়ে জীপ যখন থামলো রাত তখন পৌনে বারোটা। জীপ থেকে সবাই নামলো। এবার হাঁটার পালা। পায়ের তলায় শুকনো পাতা ও যেন না পড়ে এমন সতর্কতায় পা ফেলে চলেছে ১২ জন বঙ্গ-জননীর বীর সন্তান। সামনে লক্ষ্য শুধু ব্রীজ বড়খাতা। তিন-তিনবার ফিরে গেছে মুক্তিবাহিনী। এবার তারা জীবন দেবে, তবু ব্রীজ অক্ষত রেখে যাবে না। কদম কদম পা ফেলে যখন তারা এগুচ্ছে, এলো আল্লাহর আর্শীবাদ, মূষলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিকে সাথী করে গায়ের জামা খুলে 'এক্সপ্লোসিভ' গুলোকে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো ব্রীজ ‘বড়খাতার' দিকে। আকাশ ঘনিয়ে এলা অন্ধকারে। বৃষ্টির গতি গেল বেড়ে। ব্রীজ বড়খাতার ওপর চোখ পড়লো মুক্তিবাহিনীর। বৃষ্টিতে মুখ বুজে আছে পাকিস্তানীদের বাঙ্কারগুলো। ব্রীজের দুই মুখে পৌছে গেল হারেসউদ্দিন, মতিউর রহমান ও অন্য সাথীরা। রাত তখন দেড়টা হবে। পাঞ্জাবীরা বৃষ্টির মুখে বাঙ্কারে ঢুকে বসে আছে। তলায় ততক্ষণে ত্রস্ত হাতে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলেছে মুক্তিবাহিনী অপারেশন। ব্রীজের তিন জায়গায় এক্সপ্লোসিভ বাঁধা হলো। মূল প্লানে ছিল দুই জায়গায়। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পাক-হানাদাররা যখন “ওয়াচ” করতে পারছে না কিছুই তখন মতিউর রহমান সেই সুযোগটা কাজে লাগালেন। মাত্র ২৫ মিনিটে ‘এক্সপ্লোসিভস' লাগানোর কাজ শেষ হয়, যেটার জন্য সময় দেয়া ছিল ৩০ মিনিট। এটা সম্ভব হলো কেননা মুক্তিবাহিনীর যেসব ছেলেদের তিস্তার পাড়ে গার্ড থাকার কথা ছিল তারা বরং ব্রীজের তলায় কাজ করে। বৃষ্টির সুবিধাটার জন্য সিদ্ধান্তটা অন দি স্পট চেঞ্জ করা হয়। এক কোম্পানী পাঞ্জাবী হানাদার ব্রীজের ওপর, ডানে-বামে দুর্ভেদ্য বাঙ্কারে বসে বসে যখন বৃষ্টির শব্দ শুনেছে, ততক্ষণে তাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে তিস্তা নদীর স্রোতের ওপর।

 অত্যন্ত সন্তর্পণে ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন মতিউর তিস্তার ওপর থেকে তুলে আনলেন তাঁর বারজন সাথীকে। গুনে গুনে নিলেন তিনি। হ্যাঁ, এবার পেছনে চলো সবাই। ৬০০ গজ দূরে এসে থামলেন তারা। সেই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে রাত পৌনে দুটার দিকে ডেটনেটে আগুন ধরালেন তারা। প্রচণ্ড শব্দে, সেই বৃষ্টিপাতের মধ্যে মনে হলো আকাশ ভেঙ্গে রাশি রাশি বজ্রপাত হচ্ছে “ব্রীজ বড়খাতার” ওপর। তিস্তার বুকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে হানাদারদের বাঙ্কার, ভেঙ্গে পড়ছে হানাদারদের শরীর। 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়ে এল-এম-জি'র ফায়ার ওপেন করে দিল মতিউর হারেসরা। পেছন থেকে কভারিং ফায়ার এলো লেঃ মেজবাহউদ্দীনের কাছ থেকে। ছুটছে হানাদাররা, ব্রীজের চারপাশের বাঙ্কার ছেড়ে ভাগছে প্রাণভয়ে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাচ্ছে পেছন পানে। আক্রমণের আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত হানাদারদের ওপর বৃষ্টির ধারার মত গুলিবর্ষণ করে চলেছে বীর মতিউর, বীর হারেসরা। বাংলার দুশমনরা পেছনে ১৫টি ডেডবডি ফেলে রিট্রিট করলো। ব্রীজ বড়খাতার ওপারে উড়লো মুক্তির পতাকা। তিস্তার ওপাশ মুক্ত হয়ে গেল চিরতরে। যে ব্রীজের জন্য পাঞ্জাবীরা গর্ব করে বেড়াত, তাদের দালালরা যে “বড়খাতা ব্রীজের” কথা বলে মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের প্রমাণ খাড়া করতো সেই বড়খাতা ব্রীজের বিজয় যখন সম্পন্ন হলো আনন্দে আবেগে কাঁদলো ক্যাপ্টেন মতিউর, কাঁদলো হারেসরা। এক অপরকে জড়িয়ে ধরলো বুকে।

 যুদ্ধের ইতিহাসে “ব্রীজ রিভার অন কাউয়াই” এর নাম যদি থাকে, থাকবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গাঁথা নিয়ে “ব্রীজ রিভার অন তিস্তা”র নাম।

॥ চার রাত্রির কাহিনী॥

 ক'জন জানেন যে, আমাদের ৩১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৪ দিন আটকা পড়ে শুধু বিস্কিট আর পানি খেয়ে বেঁচে ছিল? ৬নং এইচ-কিউ-তে বসে সেক্টর কমাণ্ডার খাদেমুল বাশার সাহেব পর্যন্ত প্রায় ধরে নিয়েছিলেন তারা মারা গেছে।

 সেই ‘দুঃখের চার রাত' ছিল ৩রা সেপ্টেম্বর থেকে ৭ই সেপ্টেম্বরের রাত। এই রাতের শুরু হয়েছিল আরো আগে তিস্তার গা বেয়ে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে।

 মুক্তিবাহিনীর পজিশন ছিল শঠিবাড়ির উত্তর ও পূর্ব দিকে। তাদের এক মাইল পেছনে তিস্তা নদী বয়ে চলেছে। তিস্তা নদীর অপর পাড়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে এফ-এফ কোম্পানী নং ৭-এর কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকার ৩৫০ জন এফ-এফ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন। হানাদার পাকিস্তানীদের ডিফেন্স হচ্ছে শঠিবাড়ি বন্দরের দক্ষিণ এবং পশ্চিম সাইডে। এক কোম্পানী ফোর্স নিয়ে সিমেণ্টের মজবুত বাঙ্কারে মেজর হায়াত শক্তিশালী ডিফেন্স নিয়ে দীর্ঘ ছয় মাস বসে আছে। তাদের সাথে আছে ই-পি-কাফ (ই-পি-আর-এর ধরনে সে সময় পাক ফোর্সদের গঠিত একটি বাহিনী) এর ১ কোম্পানী, রাজাকার ছিল শ'তিনেক। তার ওপর পেছনে ছিল আর্টিলারী। হেভি মেশিনগান, ছয় ইঞ্চি মর্টার, এল-এম-জি, ১টা তিন ইঞ্চি মর্টার, কিছু স্টেনগান আর বাকী সব থ্রি-নট-থ্রি।\

 সেক্টর কমাণ্ডার খাদেমুল বাশার সাহেবের নিকট থেকে ৭নং কোম্পানী কমাণ্ডার নির্দেশ পান শঠিবাড়ির হানাদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য। প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা “হিট এণ্ড রান” পদ্ধতি অনুসরণ করে পুরা আগষ্ট মাস। সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত তাদেরকে ব্যস্ত রাখে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা গড়ে তোলে পাকা বাঙ্কার। শঠিবাড়ি বন্দরের পূর্ব ও উত্তর দিকে পাক হানাদারদের এক হাজার গজ দূরে এই সব বাঙ্কার তৈরী করে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল বাড়িয়ে তোলে। এবং এই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদারা যার যার পজিশন থেকে গোলাগুলি বিনিময় করতো।

 সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ। কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদারদের ৬০০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে আসে। ২রা সেপ্টেম্বর রাত ৩টায় কমাণ্ডার নিজে এস-এল-আর নিয়ে হানাদার পজিশনে ফায়ার ওপেন করে দেন। শুরু হয় মরণযুদ্ধ। হারেসের ছেলেরা প্রতিজ্ঞা করে শঠিবাড়ি বন্দর দখল না করে তারা পিছু ফিরবে না।

 শঠিবাড়ি হাইস্কুলের ভেতরে নির্মিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটি থেকে শেল বর্ষণ করে খান সেনারা। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। খান সৈন্যদের মুহুর্মুহু শেল ও রকেটের আঘাত এস পড়ছে মুক্তিবাহিনীর ওপর। ভাঙ্গছে বাঙ্কার, আহত হচ্ছে মুক্তিসেনা। ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে পিছনে। সামনে এগুচ্ছে আরেকজন মুক্তিসেনানী, করছে আঘাত শত্রুর বাঙ্কারে, পজিশনে গোলা-গুলি আর আর্তনাদে ভরে উঠলো ডিমলা থানার শঠিবাড়ি বন্দর। সমান গতিতে যুদ্ধ চলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটছে না। সমানে সমানে যুজে যাচ্ছে একে অপরকে একদিকে কমাণ্ড করছেন হানাদার বাহিনীর দুর্ধর্ষ মেজর হায়াত, অন্যদিকে শ্যামল বাংলার এক তরুণ বীর হারেসউদ্দিন সরকার। এক বাহিনী ছুড়ছে কামানের গোলা, রকেট ও শেল। অন্য বাহিনী দুয়েকটি এল-এম-জি আর থ্রি-নট-থ্রি দিয়ে তার জবাব দিচ্ছে।

 ঘণ্টার পর ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। ৪ তারিখ সকাল থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। হারেস উদ্দিন সরকার কয়েকজন সাহসী সাথীকে নিয়ে পর পর কয়েকটি সম্মুখের বাঙ্কার পার হায়ে এ্যডভান্স করে গেল সম্মুখপানে। হানলো এ-এম-জি'র নিখুঁত আঘাত হানাদার বাহিনীর মেইন পজিশন শাঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরের বাঙ্কারে। দুপুর বারোটার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল হানাদারদের বাঙ্কারে ও ডিফেন্স পজিশনে। দ্বিগুণ শক্তিতে হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যেতে লাগলো সম্মুখপানে। সে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শঠিবাড়ি বন্দর আর কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের করায়ত্ত হবে। প্রতিটি বাঙ্কারের মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টির ঝাঁকের মত গুলি ছুড়ছে। হানাদার বাহিনী তাদের ডিফেন্স লাইন ছেড়ে পিছনে হটে যাচ্ছে বীর হারেস, বীর তার বাহিনী, বুকে থ্রি-ট- থ্রি চেপে ধরে সম্মুখপানে গড়িয়ে গড়িয়ে দখল করছে সামনের ভুমি। মরিয়া হয়ে টিপে যাচ্ছে থ্রি-নট-থ্রি ট্রিগার। জয় তারা ছিনিয়ে আনবেই। হানাদারকে পালাতে হবে শঠিবাড়ি থেকে। ট্রেও পাকিস্তানী বাহিনী তাজ্জব বনে গেল। এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কমাণ্ডে এগিয়ে আসছে থ্রি-নট-থ্রি হাতে বাঙালী তরুণ বালক। অব্যর্থ গুলি ছুড়ছে তাদের বাঙ্কারে। ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাদের ডিফেন্স পজিশন।

 কোম্পানী কমাণ্ডার হারেসউদ্দিন ঘোষণা কর দিল ৪ঠা সেপ্টেম্বর সূর্য ডোবার আগেই শঠিবাড়ি বন্দর মুক্ত হয়ে যাবে। তিনশ' মুক্তিযোদ্ধা দম ধরে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে হানাদারদের প্রত্যেকটা বাঙ্কারে। শঠিবাড়ি বন্দরের জয় অত্যাসন্ন। আক্রমণের মুখে আর দাঁড়াতে পারছে না হানাদাররা। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পতন হয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা পতাকা তুলে ধরে 'জয় বাংলা' বলে চীৎকার করছে। এমন সময় হানাদার এলো আকাশ পথে। ৪ঠা সেপ্টেম্বরের শঠিবাড়ি বন্দরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলনের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, পশ্চিম গগনে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে, ঠিক তেমন সময় গর্জন করতে করতে এলো দুটি হেলিকপ্টার। হারেসউদ্দিন ও তার বাহিনীর বাঙ্কারের পজিশনে বৃষ্টির মত বোমা ফেলল তারা। আক্রোশে ক্ষোভে মুক্তিযোদ্ধারা এল-এম-জি'র ফায়ার করলো। হেলিকপ্টার দুটো চলে গেল প্রায় বিশ মিনিট ধরে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন পজিশনে বোমা বর্ষণ করে। ডান পায়ে, ডান হাতে এবং কপালে বোমার আঘাতে আহত হলেন সেই বীর তরুণ, যিনি ছিলেন সেই তিনশ' মুক্তিযোদ্ধার বীর নায়ক। আহত হলো আরো অনেকে। এক নিমিষেই নিভে গেল সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের আশা। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত আহতদের ব্যাণ্ডেজ ও ফার্স্ট এইড শুরু হলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ৬নং এইচ-কিউ'এর সাথে সকল যোগাযোগ। খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর উপর বোমা পড়ায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল যদিও অস্ত্র ও গোলাবারুদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার এবং ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় হানাদার বাহিনী শুরু করলো নতুন উদ্যমে গুলি-গোলা বর্ষণ।

 সেই অসহায় অবস্থায় ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাত্রে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পড়েছিল তখন রক্তাপ্লুত কোম্পানী কমাণ্ডার চীৎকার করে বললেনঃ “যুদ্ধ চলবে, মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে, কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। কাউকে যদি পিছনে তাকাতে দেখি, এই আহত অবস্থায় তার উপরে আমি গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মত লড়ে প্রাণ দাও সবাই। হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা তিনশ' জন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে নাও আমরা সবাই মরে গেছি।” তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বললেন, “মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই লড়ে যাও।”

 মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেল। আবার ফিরে গেল বাঙ্কারে। হাতে তুলে নিল থ্রি-নট-থ্রি। এমনভাবে পার হয়ে গেল ৪ তারিখ রাত। পাঁচ তারিখ সারাদিন যুদ্ধ চললো -সন্ধ্যায় দু'পক্ষেই ফায়ার বন্ধ হলো। সারারাত আহতদের সেবা শুশ্রূষা হলো। ছয় তারিখ ভোরে হানাদার বাহিনী ছয় ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লাঞ্চার দিয়ে তুমুল আক্রমণ শুরু করলো।

 একদিকে খাবার নেই। আড়াই দিন পার হয়ে যাচ্ছে। বিস্কুট এবং পানি খেয়ে বেঁচে আছে তিনশ' মুক্তিযোদ্ধা। শুধু ব্যাণ্ডেজ বেঁধে আহতরা পড়ে আছে বাঙ্কারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে পাকিস্তানী কামানের গোলা, মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সবদিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন। তবু মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেল। সবকিছু অনিশ্চিত জেনেও দাঁতে দাঁতে কামড়ে জীবন বাজি ধরে লড়ে গেল শঠিবাড়ি বন্দরে। ছয় তারিখ রাত আটটায় শঠিবাড়ির ডানদিকে মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিকভাববে তিনশ' গজ ছুটে গিয়ে হানাদারদের কয়েকটি ডিফেন্স পজিশন দখল করে নেয়। এটা ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সেই ডিফেন্স লাইনে ছিল প্রায় দেড়শ' রাজাকার। তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আহত কোম্পানী কমাণ্ডারের নির্দেশ মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রণ্ট লাইনে বসিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি চালাবার আদেশ দেয়া হয়। ধৃত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। চাঙ্গা হয়ে ওঠে তারা। ৬ই সেপ্টেম্বর সারারাত গুলি আর পাল্টা গুলি চলতে থাকে। ৭ই সেপ্টেম্বর ভোর বেলা পাকবাহিনী অবস্থান ত্যাগ করে নীলফামারীর দিকে পালিয়ে যায়। ৭ই সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ২০ মিনিটে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে উড়লো মুক্তির পতাকা।


  1. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন।
  2. সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ১৫-৭-৭৮ তারিখে গৃহীত।
  3. সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ১৮-১-১৯৮০ তারিখে গৃহীত।
  4. সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ২২-১-১৯৮৯০ তারিখে গৃহীত।
  5. দৈনিক 'সংবাদ'- এর ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত মুসা সাদিক রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।