বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড)/১৪
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
---|---|---|
১৪। ৭নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের আরও বিবরণ | ...... | .....১৯৭১ |
একটি অপারেশন[১]: ডাঃ মাহবুবুল আলম, এমবিবিএস, বিপি
৩০-১০-১৯৭৯
১৪ই আগস্ট, ১৯৭১ সন। রাজশাহীর দক্ষিণাঞ্চল বন্যাকবলিত। পদ্মা নদীর দুই কূল ভেসে গেছে। যেদিকে চোখ যায় মনে হয় যেন একটা সাগর, তারই মাঝে চোখে পড়ে দু-একটি গ্রাম। বহু গৃহপালিত পশু ভেসে যাচ্ছে আর নদীর দু’পাশের লোকজন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে ঠাঁই পেতে চেষ্টা করছে তারই ঘরের চালে বসে অনাহারে-উপবাসে। সেই দিনটিতেই পাকবাহিনী ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করতে চাইছে ১৪ই আগষ্ট, স্বাধীনতা দিবস। আর তার সাথে যোগ দিয়েছে তাদেরই পদলেহনকারী কিছু সংখ্যক আলবদর বাহিনীর লোক। চাঁপাইনওয়াবগঞ্জ শহরের লোকজনকে জড়ো করা হয়েছে পাকসেনাদের মহত্ত্বের প্রশংসা করতে, বিকেলে টাউন হলে সম্বর্ধনা সভা ডেকে। আর্মি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক প্রধান অতিথি। জাঁকজমক পরিবেশে সবকিছুর পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এদিকে ফরিদপুর বি-ও-পি তে সকাল ৭টায় সেদিন প্রায় এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত করেছেন মেজর গিয়াস (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার)। পদ্মা ও মহানন্দা নদীর মাঝামাঝি এ বি-ও-পিসহ আরও চারটি বি-ও-পি জুড়ে প্রায় দুইশত বর্গমাইল এলাকা ২৬শে মার্চের পর থেকেই মুক্ত ছিল। পাকবাহিনী বহু চেষ্টার পরও এর কোনটি অধিকার করতে পারেনি স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। ৮৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে মনোনীত করা হল অপারেশনের জন্য। বি-ও-পি’র ভিতরে পাকা মেঝেতে সুন্দর একটা নকশা পূর্ব থেকে বানান ছিল-যার আশেপাশে সকলকে বসানো হল। সেদিন প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধার চোখেমুখে ছিল জিঘাংসা আর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের চিহ্ন।
নকশনার উপর শত্রুর ঘাঁটি আর অবস্থান সম্বন্ধে একে একে বুঝিয়ে দিলেন মেজর গিয়াস। শত্রুর অবস্থান ছিল তখন নিম্নরূপঃ
ক) একটি ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার নওয়াবগঞ্জ ও তার সাথে একটি কোম্পানী, যারা নওয়াবগঞ্জ শহরের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে সি-এ-এফ’র সাথে নিয়োজিত ছিল।
খ) হরিপুর পুলের উপর দুই সেকশনের কিছু বেশী লোক পাহারা দিচ্ছিল। ২২০ ফুট লম্বা এ ব্রিজটি নওয়াবগঞ্জ থেকে দুই হাজার গজের কিছু বেশী দূরে রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ রাজপথের উপর অবস্থিত।
গ) আমনুরা রেলওয়ে স্টেশনে ছিল সেনাবাহিনীর একটা প্লাটুন, আর এক প্ল্যাটুন ছিল নওয়াবগঞ্জ স্টেশনে। এই প্লাটুনদ্বয়ের কাছে একটা ইঞ্জিন ও দুটি করে বগি থাকত এবং বিশেষ করে রাত্রে তারা আমনুরা ও নওয়াবগঞ্জের সাথে পেট্রোলিং করে বেড়াত।
এছাড়া এক প্লাটুন আর্মি ও সি-এ-এফ’এর গার্ডও ছিল, যারা নওয়াবগঞ্জের অদূরে নওয়াবগঞ্জ-আমনুরা রেললাইনের উপর দুটি পুল বিদিলপুর নামক জায়গায় পাহারা দিচ্ছিল।
এই ৮৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করলেন মেজর গিয়াস নিজে। তিনি তাদের তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। ঘোষণা করলেন যে তিনি নিজে সেই অপারেশন পরিচালনা করবেন। কিংবদন্তীর নায়ক মেজর গিয়াসের নামরাজশাহীর লোকের মুখে মুখে। তিনি নিজে অপারেশন পরিচালনা করেছেন শুনে সকলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো।
ক) এক নম্বর গ্রুপে বিশজন লোক দেওয়া হলো- যার কমাণ্ডার সুবেদার ইসমাইলকে করা হয়। তার কাছে দেওয়া হল তিনটি মাঝারি মর্টার আর ৯০টি বোমা। কাজ দেওয়া হল নওয়াবগঞ্জ শহরে ১৪ই আগস্ট রাত দশটা হতে এগারটা পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করা।
খ) দুই নম্বর গ্রুপে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দেওয়া হল। কমাণ্ডার নিযুক্ত হলেন সুবেদার আমিরুজ্জামান। মেজর স্বয়ং এই গ্রুপের সাথে রইলেন-তিন গ্রুপের পরিচালনা করবেন অয়ারলেসের সাহায্যে। কাজ দেওয়া হল হরিপুর পুলের উপর হামলা করা এবং প্রহরারত হানাদার বাহিনীর লোকদেরকে হত্যা অথবা বন্দী করে পুলটিকে উড়িয়ে দেওয়া, যাতে করে নওয়াবগঞ্জ আর রাজশাহীর মধ্যেকার একমাত্র সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গ) তৃতীয় গ্রুপের কমাণ্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার আমানউল্লাহ, যাকে দেওয়া হয়েছিল ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা। কাজ দেওয়া হয়েছিল বিদিলপুর রেলওয়ে পুলটি উড়িয়ে দেওয়ার।
ছয়খানা নৌকা যোগাড় করা হয়েছিল আগে থেকে। আমাদের নৌকার কাণ্ডারী ৫৯ বছর বয়স্ক হুরমত আলী। সাদা ধবধবে লম্বা দাড়ি-চুলের অধিকারী এই বৃদ্ধের মাথায় ছিল গোল একখানি টুপি। কপালে দেখা যাচ্ছিল সুস্পষ্ট কাল দাগ, এবাদতের চিহ্ন। ছয়টি নৌকায় সকলে গিয়ে উঠলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমরা সাগর পাড়ি দিচ্ছি অথৈ জলের মাঝে। হুরমত আলী রওনা হওয়ার আগে কি যেন বিড় বিড় করে পড়ল, তারপর মোনাজাত করল। সকাল নটার সময় আমরা গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। হুরমত আলীর নৌকা সকলের আগে ছিল, তাতে ছিলেন মেজর গিয়াস নিজে। সব মিলে ১৭ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। নৌকার পাল উঠাতেই নৌকার গতিবেগ চার থেকে পাঁচ মাইলে পৌঁছাল।
সন্ধ্যা হতে না হতেই টারগেটের দু মাইলের মধ্যে পৌছান গেল। কিন্তু সবচেয়ে বন্ধুর আর ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দুই মাইল রাস্তা। যেতে হচ্ছে মহানন্দার ছোট্ট উপনদী-শাখানদী ধরে। আগে থেকে জানা ছিল মীরজাফরের বংশধরদের বেশকিছু লোক এ অঞ্চলে এসেছে, যারা আলবদর আর রাজাকারের মুখোশ পরে এতদঞ্চলে অবস্থান করছে। বহু কষ্টে আরও এক মাইল পথ অতিক্রম করতে আরও দেড় ঘণ্টা সময় লেগে গেল। এক মাইল রাস্তা আরও যেতে হবে। রাত তখন সাড়ে সাতটা। সাড়ে দশ ঘণ্টা কেটে গেছে নৌকায়। হঠাৎ হুরমত আলী ইশারা দিল সকলকে থাতমে। আমার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল যে, সে রাস্তাটা যেন হারিয়ে ফেলেছে। সব কটা নৌকায় হঠাৎ ফিসফিস শব্দ বেড়ে উঠল আর নীরব গুঞ্জন ভেসে এল। পাশের একটা গ্রামে কিছু হারিকেনের আলো চোখে পড়ল। মেজর গিয়াস হুরমত আলীকে নিয়ে সেই গ্রামে উঠলেন এবং সেখান থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে পুনরায় গন্তব্য স্থানের দিকে দৃষ্টি রেখে রওনা হলেন। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রাম থেকে উঠানো ছেলেটি নৌকায় উঠে সেদিন এতগুলি মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে কেঁদে ফেলেছিল। ভেবেছিল বুঝিবা তার জীবনের অবসান ঘটাবার জন্য তাকে নেওয়া হচ্ছিল।
হরিপুরের পুল থেকে ছয়শত গজ পেছনে রাত ৯টায় রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ সড়কের উপর এক নম্বর ও দুই নম্বর গ্রুপকে অবতরণ করতে আদেশ দিলেন মেজর গিয়াস। তিন নম্বর গ্রুপকে পাঠান হল বিদিলপুর রেলওয়ে পুলের উদ্দেশ্যে দুটো নৌকা করে। বন্যায় ডুবন্ত রাস্তার উপর দিয়েই নৌকা দুটি অতিক্রম করে গেল। এক নম্বর গ্রুপকে অবতরণ ক্ষেত্রে ডিফেন্স লাগাতে বলে দুই নম্বর গ্রুপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পুলের দিকে অগ্রসর হল সড়কের ডান ও বাঁয়ের কিনারা ধরে। আকাশে চাঁদ ছিল না তবে তারকারাশির মিটিমিটি আলো বন্যার পানিতে পড়ে পরিবেশকে বেশ আলোকিত করে তুলেছিল। প্রায় একশত গজের মধ্যে পৌঁছাতেই আধো আলো আর ছায়ার মাঝে মনে হল কারা যেন তড়িৎ গতিতে পুলের পাশে পজিশন নিচ্ছে। আর একটু অগ্রসর হতেই শত্রুপক্ষের একজন চেঁচিয়ে উঠল 'হল্ট' 'হ্যাণ্ডস আপ'। নায়েক মিহনাজউদ্দিন, সম্মুখবর্তী সেকশন-এর কমাণ্ডার, তারাই জবাবে আমগাছের আড়াল থেকে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “তেরা বাপ আয়া, শালা সারেঙ্কার কর'। একথা শেষ হতে না হতেই শত্রুপক্ষ পুলের উপর থেকে একটা এল-এম-জি ও তিন-চারটা রাইফেল থেকে গুলি চালালো আমাদের প্লাটুনের উপর কালবিলম্ব না করে। আমাদের প্লাটুন ঝাঁপিয়ে পড়ল দুশমনদের উপর। পেছন থেকে আমাদের মেশিনগান সহায়তা করে চলল। পুল দখলে এসে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে, দুশমন অনুধাবন করার আগেই দু'জন শত্রুসেনা মারা গেল। দু'জন ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে পালিয়ে গেল। একজন আহত হল এবং বাকী ১১ জনকে বন্দী করা হল। আমাদের পক্ষে একজন নিহত ও একজন আহত হয়।
পুল কব্জা করার সাথে এক নম্বর প্লাটুনটি পুলের উপর দিয়ে নওয়াবগঞ্জের দিকে দ্রুত ধাবিত হল। নওয়াবগঞ্জ শহর থেকে মাত্র এক হাজার গজ দূরে রাস্তার পাশেই তারা মর্টারের জন্য স্থান বেছে নিল আর শহরের উপর শুরু হল গোলাবর্ষণ। শত্রুপক্ষ কোনদিন এত নিকটে আমাদেরকে আশা করেনি। হানাদার বাহিনীর জন্য মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে নাকি সে সময় বেশ জমে উঠেছিল টাউন হলে আলবদর বাহিনীর বদৌলতে। প্রথম গোলা টাউন হলের নিকটে পড়ার সাথে সাথে প্রধান অতিথিসহ তাদের চেলা-চামুণ্ডা হলঘর ছেড়ে দে ছুট- এই বুঝি শহর মুক্তিবাহিনীর কবলে গেল। যখন এদিক থেকে গোলাবর্ষণ চলছিল তখন সব কয়েকটি দুশমনের অবস্থান থেকে গোলাগুলি আসছিল। তৃতীয় গ্রুপটি তাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই দুশমন তাদের মেশিনগান আর রহিফেল থেকে গুলি ছোড়া শুরু করল। তৃতীয় গ্রুপটি পুল দখল করতে পারেনি। এদিকে দু'নম্বর গ্রুপটি পুল উড়াবার কাজ করেই চলছে। ‘ডিপ মাইন ও প্রেশার চার্জ দিতে হবে। পুলের গোড়ার অংশ ৫ ফুট পরিমাণ খুঁড়তে হল ডিপ মাইন' চার্জ বসাবার জন্য। আমাদের প্রয়োজন ছিল সাড়ে চারশত পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভের। আমাদের কাছে ছিল যে সময় তিনশত পাউণ্ড জিলাটিন এক্সপ্লোসিভ যেগুলো সাধারণত খনিজ পদার্থের মাইন। ফিল্ডে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ছয়টি পুরাতন ধরনের ব্রিটিশ এ্যাণ্টি ট্যাংক মাইন সাথে আনতে বলেছিলেন মেজর সাহেব। সেগুলো জুড়ে দিয়ে পুলের এবেটমেণ্ট উড়াবার জন্য চার্জ তৈরী করতে বললেন মোট ২৪০ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে। উপরে অনুমান একশত দশ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে প্রেশার চার্জ লাগান হল। মাটি ভরে দিয়ে ডিপ মাইন চার্জ আর পুলের উপর প্রেশার চার্জ লাগিয়ে রিং যেন সার্কিট বানান হল কর্ডেক্স-এর সাহায্যে। এদিকে মর্টার প্লাটুনের কয়েকজন ফেরৎ এসে পড়েছে। পুলের উপর উঠে পুলটা শেষবারের মত দেখে নিলেন আমাদের অধিনায়ক মেজর গিয়াস। বন্যার পানি পুলের উপর ছুঁই ছুঁই করছে, আর স্রোতের গতিবেগ জোরে বয়ে যাচ্ছিল। নওয়াবগঞ্জের দিক থেকে কিছু মর্টার আর মেশিনগানের গুলি পুলের দিকে আসছিল। এক সময় আমরা সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিলাম যখন দু'তিনটি গাড়ীর বগী রাজশাহীর দিকে থেকে আসতে দেখতে পেলাম রাজপথ ধরে, কিন্তু কিছু দূর আসতেই যেন গাড়ীর বাতিগুলি থেমে গেল। তারপর বুঝতে পেলাম যে রাস্তা এক মাইল পেছনে জলমগ্ন হয়ে আছে যার ফলে গাড়ী আর বেশীদূর এগুতে পারেনি। ওরা রাস্তার পেট্রোলিং-এ বেরিয়েছিল সম্ভবত।
রাত ঠিক বারটা বেজে পাঁচ মিনিট। সকলকে প্রায় ছয় শত গজ দূরে নৌকায় বসতে হল কানে হাত চেপে। ফিউজে আগুন লাগাতে বললেন অধিনায়ক। পেছনে দৌড়িয়ে এসে ৫০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে বসে পড়লাম, মেজর গিয়াস ও সুবেদার আমিরুজ্জামান। গগনবিদারী আওয়াজে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সেই আওয়াজের সাথে সাথে বেশ কয়েকটি গ্রামের লোক ঘুম থেকে চীৎকার করে উঠল, ভাবল হয়ত কেয়ামত এল বুঝি। বেশ কয়েক সেকেণ্ড লেগে গেল আকাশে উত্থিত ইট, কংকর, পাথর নেমে আসতে। আনন্দে উচ্ছ্বাসে সকলে দৌড়িয়ে গেল পুলের অবস্থা দেখতে। পুল আর দেখা যাচ্ছে না-দেখা যাচ্ছিল অপর অংশের অর্ধেকটা দূরে কাত হয়ে পড়া অবস্থায়। স্রোতের টানে ইত্যবসরে ছোট নদীটার এপারের অংশ পুলের ভিত্তিপ্রস্তর থেকে আরও ১০/১৫ ফুট বেড়ে গেছে। আমরা নৌকায় উঠে আরও একটু পেছনে চলে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে রেলওয়ে পুল উড়াবার তৃতীয় গ্রুপও আমাদের সাথে যোগ দিল। তারা কৃতকার্য হতে পারেনি তাদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শত্রুর যে ক্ষতি করতে পেরেছে তা আরেক মজার কাহিনী।
শত্রুর যে দুটি প্লাটুন একটা আমনুরা ও অপরটি নওয়াবগঞ্জে ছিল, সে দুটি প্লাটুনই গোলাগুলির আওয়াজ শুনতেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রেলের ইঞ্জিন আর বগি নিয়ে রওয়ানা দিল, তাদের পেট্রোল করার রাস্তায়। পুলের কাছে আমনুরা হতে আগত পেট্রোলটি পৌঁছাতেই কিছু গুলির আওয়াজ পেল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ইঞ্জিনও এসে পৌঁছাল। শত্রুপক্ষ মনে করছিল হয়ত বা নওয়াবঞ্জ মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে আর তাদেরই লোকজন সম্ভবতঃ সম্মুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি বেশ কিছুক্ষণ চললো। সুযোগ বুঝে সেই ফাঁকে কেটে পড়ল আমাদের তৃতীয় গ্রুপটি। নিজেদের গুলিতে সেইদিন দুশমনের ৬ জন নিহত হয় আর ৭ জন আহত হয় সেই স্থানেই।
সেই অপারেশনে আমরা আমাদের একজন প্রিয় সিপাইকে হারাই ও দুজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতররুপে আহত হয়। যুদও অতি সাধারণ কিন্তু দুর্গম শত্রুর এলাকার ভিতর অপারেশন করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। এটাও সম্ভব হত না যদি না জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা আর জাগ্রত মনুষ্যত্ববোধ, আত্মবিশ্বাস আর অপরাজয়কে জয় করে প্রমাণ করার অভিলাষ থাকতো।
সাক্ষাৎকার[২]: নায়েক মোঃ আমিনউল্লাহ
১২-৬-১৯৭৩
৩০শে মে আমি ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়া মহিসকুন্তি (কুষ্টিয়া জেলা) হামলা করিতে রওয়ানা হই। শত্রুর সংখ্যা খুব বেশী জানিতে পারিয়া মাঝ পথে আমার কিছু মুক্তিযোদ্ধা পিছনে পালাইয়া যায়। আমি মাত্র ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়া পাক বাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্যের উপর বেলা ৩টার সময় অতর্কিত আক্রমণ চালাই। ফলে পাক সৈন্য ৩২ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩৫ জন আহত হয়, যাহা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে প্রচার করা হইয়াছিল।
১৫ই জুন আমাকে বেতার যোগাযোগের জন্য আবার লালগোলা ডাকা হয়। আমি পুরা সাব-সেক্টর ৪ নং এর বেতার পরিচালনা করি এবং কোয়ার্টার মাস্টারের কাজও পরিচালনা করিয়া থাকি।
২০শে সেপ্টেম্বর মেজর সাহেব আমাকে নিয়া স্পেশাল অপারেশনের জন্য সাব-সেক্টর ৩ ও ৭ নং সেক্টর মেহেদীপুর যান এবং এখানে আমাদের নেতৃত্বে সোনা মসজিদ (রাজশাহী) এলাকায় দুটি বড় অপারেশন সমাধা হয়। এতে মিত্রবাহিনী আমাদিগকে আর্টিলার দ্বারা সাহায্য করে যার ফলে আমরা ধোবড়া পর্যন্ত দখল করি। এই সময় বহু পাকসৈন্য হতাহত হয় এবং বাদবাকী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এখানে উল্লেখ থাকে যে, ১৫ই সেপ্টেম্বর আমার কাজে মুগ্ধ হইয়া মেজর সাহেব আমাকে হাবিলদার হইতে নায়েক সুবেদারে পদোন্নতি দেন।
১লা অক্টোবর আমাকে সম্মুখযুদ্ধের জন্য এক প্লাটুনের পরিচালনভার দেওয়া হয় এবং আমি হাকিমপুর ঘাট হইতে আস্তে আস্তে অগ্রসর হইতে থাকি। এতে বহু বড় বড় অপারেশন করিয়াছি এবং শত্রুকে পিছনে হটিতে বাধ্য করিয়াছে।
১০ই অক্টোবর আমাকে ৪ নং সাব-সেক্টরে 'বি' কোম্পানী পরিচালনার ভার দেওয়া হয়। ১২ই নভেম্বর আমি ইসলামপুর পাক ঘাঁটিতে হামলা করি। এতে বহু রাজাকার ও পাক সৈন্য হতাহত হয় এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার সহকর্মী হাবিলদার জামান সাহেব শত্রুর গুলিতে বাগডাঙ্গায় আহত হন। আমি আমার বেতারে খবর পাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া তিন মাইল দূর হইতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে সক্ষম হই। প্রকাশ থাকে যে, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাকে বন্ধুর মত সাহায্য করিয়াছেন।
১২ই ডিসেম্বর যুদ্ধ পুরাদমে শুরু হয়ে যায়। আমি আমার ঘাঁটি (হাকিমপুর) হইতে নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হইতে থাকি। পথে পোড়াগ্রামে শত্রুর ঘাঁটির সম্মুখীন হই এবং তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। শত্রুরা বহু মৃতদেহ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া পলায়ন করিয়া বাহারমপুর গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করে।
১৩ই ডিসেম্বর আমি ও আমার দল শত্রুর এলাকায় গিয়া এ্যামবুশ পাতি। দুইখানা সৈন্যবাহী গাড়ীসহ অগ্রসররত বহু শত্রুকে সমূলে ধ্বংশ করি। শহীদ সিপাহী নজীরউদ্দিনের কবর ঐ স্থানেই বিরাজমান।
১৪ই ডিসেম্বর আমরা নবাবগঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে নবাবগঞ্জ পাকঘাঁটির উপর হামলা চালাই। সারাদিন যুদ্ধ চলে এবং এতে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের ৬ জন মুক্তযোদ্ধা এখানে শহীদ হন। আমরা নবাবগঞ্জ শহরে উঠিয়া পড়ি। বিকাল বেলা রাজশাহী হইতে ৫০/৬০ গাড়ী পাক সৈন্য নবাবগঞ্জ ঢুকিয়া পড়ে যাহার জন্য আমাকে একটু পিছু হটিয়া যাইতে হয়। রাত্রি ১২টার সময় তাহারা তাহাদের ১৪০ জন মৃতদেহসহ পাকা রাস্তার ওভারপুল উড়াইয়া রাজশাহীর দিকে পলায়ন করে।
১৫ই ডিসেম্বর আমরা নবাবগঞ্জ দখল করিয়া দেখিতে পাই বহু পাঞ্জাবীর মৃত দেহ ই-পি-আর লাইনের বাগানে পড়িয়া আছে। এবং অনেকেই মরিচার ভিতরে দাফন করিয়া রাখিয়াছে। তারপর আমরা রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকি কিন্তু অভয়া পুল ভাঙ্গা থাকায় পার হইতে দেরি হয়।
১৬ই ডিসেম্বর আমি গোদাগাড়ীতে ১৪০ জন রাজাকারকে অস্ত্রশস্ত্রশহ আত্মসমর্পণ করাইতে সক্ষম হই এবং শত্রুর পিছন পিছন ধাওয়া করি।
ঐদিন সন্ধ্যা ৭ টার সময় রাজশাহী দখল করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় শত্রুদের আর পাওয়া যায়না। তারা নাটোর গিয়া আত্মসমর্পণ করিবে বলিয়া খবর পাঠায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ঐদিনই আমাদের বিজয় দিবস-১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
সাক্ষাৎকার[৩]: হাবিলদার মোঃ ফসিউদ্দিন আহমদ
২-৫-১৯৭৪
ভারতের সহযোগিতায় আমাদের পুনর্গঠন শুরু হয়। গেরিলা যুদ্ধ বাংলাদেশের ভেতরে চলতে থাকে।
ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে পোলাডাঙ্গা এবং সাহেবনগর চরে মুক্তিযোদ্ধারা এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ডিফেন্স নেয়। চর এলাকাকে নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য মে মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের কিছুসংখ্যক লোক হতাহত হয়। পাকিস্তানীদেরও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় চর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
মে মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদী পার হয়ে ফরিদপুরে ডিফেন্স তৈরি করে। ডিফেন্স মজবুত করা হয়। সেখান থেকে প্রায়ই গেরিলা অপারেশন চালানো হতো। জুলাই মাস পর্যন্ত আমরা পোড়াগাঁও, হাকিমপুর, বাঘের আলী এলাকা আমাদের দখলে আনি। পোড়াগাঁওতে আমাদের উপর পাকিস্তানীরা আক্রমণ চালায়। উভয়পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর আমরা পোড়াগাঁও এলাকা ছাড়তে বাধ্য হই। ভারতের লালগোলা এবং বাংলাদেশের ভেতরে ফরিদপুর থেকে বিভিন্ন গেরিলা দলকে রাজশাহী শহর, নওয়াবগঞ্জ, পাবনা এবং বগুড়াতে গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্য পাঠাতে হত।
অক্টোবর মাসে আমরা আবার পোড়াগাঁও পর্যন্ত দখল করে নেই। ডিসেম্বর মাস থেকে আমাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। ডিসেম্বরে আমরা নওয়াবগঞ্জ দখল করে নেই। নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হবার সময় আমাদের ও পাকিস্তানীদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর নওয়াবগঞ্জ দখলের সময় শহীদ হন। নওয়াবগঞ্জ দখলের পূর্বদিন আমাদের সাথে ভারতীয়ি এক রেজিমেণ্ট বি-এস-এফ দেয়া হয়। দুই-তিন মিনিট যুদ্ধের পর তাদের বহু আহত হয়। এবং মর্টার, মেশিনগান এবং গোলাবারুদ ফেলে তারা পলায়ন করে। নওয়াবগঞ্জ দখলের সময় কোন ভারতীয় সৈন্যের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে নাই।
১২ই ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নওয়াবগঞ্জ থেকে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহী ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে নাটোরে আশ্রয় গ্রহণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি[৪]
॥ সে পথ দিয়ে পাকসেনারা ফিরলো না আর॥
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আকস্মিকভাবে একটি সিক্রেট ইনফরমেশন পেয়ে গেলেন। ধেয়ে চললেন তিনি তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে। হাতে তাদের থ্রি-নট-থ্রি, গ্রেনেড আর দুটি এল-এম-জি। হানাদার পাক বাহিনী সেদিন দিনাজপুর শহর থেকে স্কুলপাড়া হয়ে বর্ডার সাইডে আসছিল যে রুটে সেই রুটে পৌঁছে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিস, খানসেনারা পৌঁছানোর আগেই। বিকেল তিনটা। খানদের ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া গেল। দিনাজপুরের স্কুলপাড়ার রাস্তার পাশে, ঝোঁপঝাঁড়ে, গাছের ফাঁকে, আমগাছের ওপর, বাঁশঝাড়ের ফাঁকে প্রস্তুত লেঃ সাইদুল্লাহ, লেঃ আমিন, লেঃ কায়সার, সুবেদার এস এ রহমান, সুবেদার ইয়াসিন, হাবিলদার হাসান, হাবিলদার আজিজ, প্লাটুন কমাণ্ডার দেলওয়ার হোসেন, এফ-এফ- বাবলু, আবদুল লতিফ, আদুর রাজ্জাক, নূর মোহাম্মদসহ দেড়শ' মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানী। এগিয়ে আসছে হানাদার ট্রাক দুটো স্কুলবাড়ির সন্নিকটে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস পর পর দুটো শিস দিলেন। ফায়ারিং-এর সংকেত আসবে শুধু একটা শিস। সবাই প্রস্তুত। থ্রি-নট-থ্রি'র ট্রিগারে আঙ্গুল নিশপিশ করছে। দম ধরে মুক্তিযোদ্ধারা শুণে যাচ্ছে প্রতিটি সেকেণ্ড। মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশের ভেতরে ঢুকেছে হানাদারদের প্রথম ট্রাক। ট্রাকের ওপর ২০/৩০ জন জোয়ান, হাতে তাদের অটোমেটিক চায়নিজ অস্ত্র। ট্রাকের ওপর এল-এম-জি ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাগড়া দুজন, সামনের ট্রাক এ্যামবুশ পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সংকেত দিচ্ছেন না। সবাই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের লক্ষ্য তখন পেছনে। আরও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢুকছে আরেক ট্রাক পেছনে, সেটাকে এ্যামবুশের মধ্যে এনে না ফেলে তিনি পারেন না। সামনের ট্রাকে ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দিলেন। সৌভাগ্য খানদের। পেছনের ট্রাক প্রায় ১৫০ গজ ব্যবধানে এলো এবং এ্যামবুশের এলাকায় এক ইঞ্চি ঢোকা মাত্র ক্যাপ্টেনের শিস সাথে ফায়ার। বজ্র কড় কড় আওয়াজের মত ভেংগে পড়লো মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ওপর। এমন হাতের মুঠোয় বহুদিন পায়নি খানদের। সম্পূর্ণ নিরাপদে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা। পেছনের ট্রাক, সামনের ট্রাক-দুই ট্রাকের ওপরেই চলছে বৃষ্টির মত থ্রি-নট-থ্রি আর এল-এম-জি’র ফায়ার। সম্বিত ফিরে পাবার আগেই পেছনের ট্রাক শেষ, এ্যামবুশের যেখানে ঢুকেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে। খুনী ৩২ জন হানাদারদের ছিন্নভিন্ন দেহ সেখানেই লুটিয়ে। কোনটা ট্রাকের ওপর। বাকীগুলি পাশে, রাস্তায়, নীচের খানায়। কিন্তু না, সামনের ট্রাককে ততখানি কাবু করা গেল না। মাত্র দুটো ডেডবডি পেছনে ফেলে ট্রাকটি গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের কব্জা থেকে- যদিও ট্রাকটি পালাবার আগেই গাছের ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ফায়ার করে কয়েকজনকে আহত ও নিহত করে। পাওয়া যায় বহু গোলাবারুদ, এক ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এল-এম-জি, দুই ইঞ্চি মর্টার এবং চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল কিছু। ৩রা অক্টোবর সেই সাফল্যের পর এ্যামবুশে হানাদারকে খতম করার পরিকল্পনা ক্যাপ্টেন ইদ্রিস বাড়িয়ে দেন এবং বহু এভাবে খানসেনারা ঐ সেক্টরে হতাহত হতে থাকে এবং গেরিলা যুদ্ধের এই কৌশলের ও সাফল্যের প্রোগ্রাম সকল সেক্টরে জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সব স্থানে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হতে থাকে। ৪ঠা অক্টোবর সেই আম-জাম-বাঁশঝাড়ে ঢাকা স্কুলপাড়া দেখতে যায় হামজাপুরের সকল মুক্তিযোদ্ধা। খানদের চরমভাবে পরাজিত ও খতম করে দেয়ার সেই পবিত্র ভূমিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলপাড়ার মাটি কপালে ছুঁইয়ে যাত্রা করে ফ্রণ্টের দিকে। ১৪ই ডিসেম্বর যুদ্ধে লেঃ সাইদুল্লাহ’র একটা হাতের সমস্ত মাংস কাঁধের নীচ থেকে উড়ে যায়। শত্রুর ব্রাশ ফায়ারে। কিন্তু হাড় ভাঙ্গেনি। দিনাজপুরের রণাঙ্গনে যে বীর বহুবার পাঞ্জা লড়েছে হানাদারদের সাথে বিজয়ের দু’দিন আগে তিনি আহত হন। দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ইদ্রিসও আহত হন অন্য যুদ্ধে এবং তার কোমরের নীচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার লেগে হিপের মাংস ধসে যায়।
৭নং সেক্টর আওতাধীন বগুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা[৫]
পশ্চিমবঙ্গ হইতে সামরিক ট্রেনিং লইয়া সাইফুল ইসলাম বগুড়া জেলার পূর্বাঞ্চলে ফিরিয়া আসে। সাইফুলের নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা দল জুলাই মাসে ধুনট থানা আক্রমণ করে। থানাতে বেশ কিছুসংখ্যক পাঞ্জাবী পুলিশ ছিল। এই অতর্কিত হামলায় ৭ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয় এবং গেরিলা দল পূর্ব বগুড়ার কয়েকটি সামরিক কনভয় এবং হানাদার সৈন্য বোঝাই ট্রেনের উপর আক্রমণ চালায়।
জুলাই মাসে গেরিলা বাহিনীর কমাণ্ডার হারুনুর রশিদের দল ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনে সিচারপাড়ার উত্তর ধারে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী স্পেশাল ট্রেন বিধ্বস্ত করার ফলে চারজন অফিসারসহ সাতাশ জন পাকসৈন্য নিহত হয়।
৭ই আগস্ট সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের সময় ৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা প্রধান আহসান হাবিব (ওয়ালেস)এর নেতৃত্বে তাহার দল সাবগ্রামে একটি মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী লরী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। ঘটনাস্থলেই তিনজন পাকসৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। পুনরায় ৯ই আগস্ট তারিখে বেলা ১১ টার সময় পাকসৈন্যরা বিধ্বস্ত লরীটি উদ্ধার করিতে যায়। ঐ দিনই মাইন বিস্ফোরণের ফলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয়।
বগুড়া শহরের ওয়াপদা পাওয়ার হাউস সাব-সেকশন উড়ইয়া দেওয়ার অভিপ্রায়ে সাইফুল ইসলাম মত্র দুইজন সঙ্গী লইয়া ১১ই আগস্ট হাটসেরপুর হইতে বগুড়া শহরের দিকে রওনা দেয়। তাহারা ৯ ঘটিকায় মাদলার ঘাটে আসিয়া পৌঁছে। তখন কোন নৌকা না থাকায় কলাগাছের ভেলা তৈয়ারী করিয়া ৩ জন সূর্যসৈনিক করতোয়া নদী পার হয়। পরিকল্পিত পথে মালগ্রামের ভিতর রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হইতে থাকে। হানাদার বাহিনী প্রহরীরা তাহাদিকে চিনিয়া ফেলে। আত্মরক্ষার কোন পথ নাই জানিয়া সাইফুলেরা হানাদার বাহিনীর দিকে গ্রেনেড ছুড়িয়া মারে। হানাদারদের রাইফেল তখন গর্জিয়া ওঠে। তিনজনই অন্ধকারের মধ্যে তিনদিকে দৌড় দেয়। খানসেনাদের এলোপাতাড়ি গুলি আসিয়া সাইফুলের মাথায় লাগে। সাইফুল তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটাইয়া পড়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় হানাদার বাহিনী সাইফুলকে ধরিয়া ফেলে।
আগস্ট মাসের মধ্যভাগে একদিন রাত্রি তিন ঘটিকার সময় গেরিলা বাহিনী কর্তৃক বগুড়া- সারিয়াকান্দি রাস্তায় লাঠিমাররঘোন গ্রামের নিকটবর্তী ব্রীজটি ডিনামাইট দ্বারা উড়াইয়া দেয় এবং ব্রীজের দুই ধারে ৫০/৬০ গজ দূরে মাইন মাটির নীচে পুঁতিয়া রাখিয়া তাহারা চলিয়া যায়। পরের দিন সকালে ব্রীজের দুই ধারে পশ্চিম দিকের মাইনটি পাকসেনারা সন্ধান পাইয়া তুলিয়া নিয়ে যায় কিন্তু পূর্ব দিকের মাইনটির সন্ধান পায় নাই। তার পরের দিন ভোরে কয়েকটি গরুর গাড়ী পার্ট লইয়া গাবতলী বন্দরে যাইতেছিল। একটি গরুর গাড়ীর চাপ মাইনের উপর পড়িলে মাইনটি বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে গাড়ীটি ছিন্নভিন্ন হইয়া উড়িয়া যায়। একজন গাড়োয়ান সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যবরণ করে। আর একজন গুরুতররুপে আহত হয়। এর পরের দিন সারিয়াকান্দি ক্যাম্প হইতে পাকসেনারা আসিয়া ব্রীজের অবস্থাদৃষ্টে লাঠিমাররঘোন গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের লোদিগকে অমানুষিকভাবে মারপিট করে এবং কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগাইয়া পোড়াইয়া ফেলে। তৎপর তাহারা কালূডাঙ্গা, শাহবাজপুর এবং সাতটিকরি গ্রামে প্রবেশ করিয়া কতকগুলি বাড়ি আগুন লাগাইয়া ভস্মীভূত করে। এই ব্রিজ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করিয়া বর্বর পাক বাহিনী লাঠিমারঘোন গ্রামে পর পর তিনবার প্রবেশ করিয়া বাড়িঘর লুটপাট করে।
১৬ই আগস্ট সৈয়দ ফজলুর আহসান দিপুর দল সারিয়াকান্দি থানার নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে পাক বাহিনীর সহিত এক ভীষণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রচুর গোলাগুলির পর ময়নুল হক নামে সারিয়াকান্দি থানার এক দারোগা, ৫ জন পাকসৈন্য ও কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।
আগস্ট মাসের মধ্যভাগে কমাণ্ডার আবুল হোসেন (বালুরঘাট), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর), এস, এম, ফারুক (বগুড়া), প্রভৃতির দ্বারা হিলিতে ট্রেন অপারেশন হয়। ইহার ফলে বহুসংখ্যক এবং কিছুসংখ্যক অবাঙ্গালী নিহত হয়। লাইন অপারেশনের সময় আবুল হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।
আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে গেরিলা দল বগুড়া-সারিয়াকান্দি রাস্তার একটি ব্রীজে এক্সপ্লোসিভ লাগাইয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং ব্রীজের এক মাইল দূরে রাস্তায় মাইন পুঁতিয়া রাখে। পরে মাইন বিস্ফোরণে একটি মিলিটারী জীপগাড়ী ধ্বংস হওয়ার ফলে একজন অফিসারসহ ৬ জন পাকসৈন্য নিহত হয়।
২০শে আগষ্ট মাসুদ হোসেন আলমগীর নবেলের দল সারিয়াকান্দি থানার আওলাকান্দী গ্রামের পূর্বে যমুনা নদীতে একটি মিলিটারী লঞ্চ রকেট দ্বারা বিধ্বস্ত করে।
২রা সেপ্টেম্বর বর্বর পাকবাহিনী গাবতলী থানার জাত হলিদা গ্রামে অতর্কিত আক্রমণ করে। তখন সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর দল পাল্টা গুলিবর্ষণ করার ফলে একজন পাকসৈন্য নিহত হয়। পাকসৈন্যরা নিরীহ ৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পরে সমস্ত গ্রামটাই আগুন জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দেয়।
৪ঠা সেপ্টেম্বর ৬ জন পাক পুলিশ খাদ্য লইয়া বগুড়া হইতে সারিয়াকান্দি যাইতেছিল। পথে পাক পুলিশেরা যখন ফুলবাড়ি ঘাটে খেয়া নৌকায় উঠে তখন মুজিববাহিনীর মোফাজ্জল হোসেন (লাঠিমারঘোন), গোলাম জাকেরিয়া রেজা (ধাওয়া), সাইদুল ইসলাম, (বাইগুলি), মণ্টু (হুমাকুয়া) এবং গেরিলাবাহিনীর সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা রাইফেল, মেশিনগান দ্বারা গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে দুইজন পুলিশ নিহত হয়। আর ৪ জন জীবন্ত অবস্থায় দৌড়াইয়া পালাইয়া যাইবার কালে ধরা পড়ে। জনগণ তাহাদিগকে লাঠিসোটার দ্বারা পিটাইয়া হত্যা করে। পাক পুলিশদের রাইফেল ও কিছু খাদ্যসামগ্রী মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
গেরিলা বাহিনী কমাণ্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৭ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নৌকা পথে আনিবার কালে বাহাদুরাবাদ ঘাটের নিকট সশস্ত্র সংঘর্ষে শত্রুদের একটি টহলদার গানবোট সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দেয়।
১৮ই সেপ্টেম্বর ই-পি-আর কমাণ্ডার সালেক (বগুড়া), বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মান্নান, ঢাকা পুলিশের হাবিলদার রজব আলী এবং ছাত্র রঞ্জিত কুমার মহন্ত, প্রদীপ কুমার কর (গোবিন্দগঞ্জ) প্রভৃতির নেতৃত্বে হিলির পার্শ্ববর্তী স্থানে পাকবাহিনীর সহিত ভীষণ সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। ঘোড়াঘাটের ফিলিপস-এর (সাঁওতালী) নেতৃত্বে মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাদের একটি বেডফোর্ড মটর কার ভীষণভবে ধ্বংস হয়।
গেরিলা বাহিনীর কমাণ্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে ১৯শে সেপ্টেম্বর সারিয়াকান্দি থানার তাজুরপাড়া গ্রামে অনুপ্রবেশকারী একদল পাকবাহিনীকে ঘেরাও করা হয়। প্রচণ্ড গোলাগুলির পর ঘটনাস্থলে শত্রুপক্ষের কতক সেনা নিহত ও বাকী সেনা পলায়ন করিতে বাধ্য হয়।
২৪শে সেপ্টেম্বর আহসান হাবিব ওয়ালেসের নেতৃত্বে বেলা দুপুর সাড়ে বারোটার সময় হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করিলে সুখানপুকুর রেলস্টেশন গৃহে আগুন ধরিয়া যায় এবং তাহাতে টেলিফোন লাইন নষ্ট হয়। একটি রাইফেল ও কিছু গুলি, সাত জোড়া পাকসেনার পোশাক উদ্ধার করা হয়। কিছু সৈন্য ও রাজাকার পালাইতে সক্ষম হয়।
২৭শে সেপ্টেম্বর কমাণ্ডার মোত্তালিব এবং কমাণ্ডার এস, এম ফারুকের নেতৃত্বে হিলিতে পাকবাহিনীর সহিত প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আড়াই ঘণ্টা যাবৎ যুদ্ধ চলিতে থাকে। কমাণ্ডার মোত্তালির মর্টারের গুলিতে আহত হয় এবং ৪ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ঐ সময় বগুড়ার একটি ১৪ বৎসরের অসমসাহসী ছেলে সাইদুর রহমান (চুটকু) হিলি স্টেশনে রেললাইনের মাইন বিস্ফোরণ ধ্বংস করিয়া দেয়। সেইদিন রেল চলাচল সম্পূর্নরুপে বন্ধ হইয়া যায়। এই ঘটনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আসাম রেজিমেণ্ট ও বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষভাগে মুক্তিবাহিনী নশরতপুর রেলস্টেশনের পশ্চিম ধারে একটি এণ্টি-ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতিয়া রাখে। তাহার বিস্ফোরণে একটি মিলিটারী ট্রেন আক্রান্ত হয়। ফলে হানাদার পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হইয়া লাইনের ধারের লক্ষীপুর, পূর্ব ডালম্বা, কোটকুরী ও শিতলাই গ্রামে আক্রমণ চালায় এবং কফিরউদ্দিন মিস্ত্রী, আবেদ আকন্দ, আজিজ প্রাং (লক্ষীপুর), মহীরউদ্দিন প্রাং (পূর্ব ডালম্বা) ভোলা প্রাং, কোরবান আলী (কোচকুরী) শরিফউদ্দিন সরকার (শিতলাই) প্রভৃতি লোকদিগকে লাইন করিয়া গুলি করিয়া হত্যা করে।
অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে গাবতলী থানার শিহিপুর গ্রামে সরকার-বাড়িতে মুক্তিবাহিনী ঘাঁটি ছিল। মুক্তিবাহিনী রাত্রি নয় ঘটিকায় সরকার বাড়ির পিছনে রেললাইনে একটি মাইন পুঁতিয়া রাখে। কারণ মুক্তিবাহিনী জানিতে পারে যে সৈয়দপুর হইতে বোনারপাড়া জংশন হইয়া একটি সৈন্যবাহী ট্রেন আসিতেছে। সেই ট্রেনটি ধ্বংসই তাহাদের লক্ষ্য ছিল কিন্তু ১৫ মিনিট পূর্বেই মাইনটির বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সৈন্যবাহী ট্রেনটি ঐদিন আর আসে না। পরের দিন রাত্রি ১১টার সময় সৈন্যবাহী ট্রেনটি সুখানপুকুর ষ্টেশন অতিক্রম করিবে জানিতে পারিয়া মুক্তিবাহিনী সরকার-বাড়ির অর্ধ মাইল দক্ষিণে মাইন পুঁতিয়া রাখে। মাইন বিস্ফোরণে সৈন্যবাহী ট্রেনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ৪ জন পাক ইঞ্জিনিয়ারসহ ১৪৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে ওয়াপদার নিকট কৈচোর রেললাইনের ব্রীজের দুই পাশে মাসুদ হোসেন আলমগীর (নবেল) মাত্র ৬ জন সঙ্গী লইয়া পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। বহু গুলি বিনিময়ের পর ৬ জন খানসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কতকগুলি পাকসৈন্য অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া কাহালুর দিকে পালাইতে বাধ্য হয়।
অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে মুক্তিবাহিনীর দল গাবতলী থানার জয়ভোগা গ্রামের নিকটস্থ সারিয়াকান্দি রোডের উপর মাইন পুঁতিয়া রাখিয়া যায়। পরে তাহা বিস্ফোরণ ঘটিয়া ৫ জন পাকসৈন্যের মধ্যে ৩ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়।
১৮ই অক্টোবর বগুড়া শহরের পশু ডাক্তার থানার নিকটস্থ ট্রান্সমিটারটি গ্রেনেড দ্বারা ধ্বংস করিবার জন্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ফলে ট্রান্সমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্শবর্তী দোকানদার মুন্সী নজরুল ইসলামকে বর্বর হানাদারবাহিনী ধরিয়া ক্যাম্পে লইয়া যায়। ৪ দিন অমানুষিক নির্যাতন করার পর মুক্তি দেয়।
২০শে অক্টোবর নারচী ও পার্শববর্তী গণকপাড়া গ্রামে পাকসৈন্যদের সহিত গেরিলা বাহিনীর চারটি দলের এক ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সকাল ৭টা হইতে পরের দিন সকাল ৭ পর্যন্ত চলে। এইসব দলের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মকবুল (চরহরিন), সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপু, শোকরানা (রানা), আবদুস সালাম (বুলবুল), রেজাউল বাকী, গোলাম মোস্তফা (গাবতলী), কামাল পাশা (বৃন্দাবনপাড়া), রিজাউল হক মঞ্জু (ধাওয়া), স্বপন এবং হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মণ্টু, আখতার হোসেন বুলু, আতোয়ার হোসেন গামা, আবদুর রাজ্জাক হাঞ্জু, আবদুল বারী ও আরও অন্যান্য গেরিলাদের সহিত পাকবাহিনীর প্রচণ্ড গোলাগুলি বিনিময় হয়। সেই সময় গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জীবনের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রাম ছাড়িয়া পালাইতে থাকে, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলিতে থাকে। পাকসেনার দল দিপুর দলকে ঘিরিয়া ফেলে। উপায়ান্তর না দেখিয়া দিপুর দল গ্রেনেড নিক্ষেপ করিয়া ধূম্রজাল সৃষ্টি করিতে বাধ্য হয়। তৎপর গণকপাড়া ঈদগাহ মাঠে গেরিলাবাহিনী পজিশন লইয়া তুমুল গোলাগুলি বর্ষণ করিতে থাকে। পাকসৈন্যরা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে গেরিলা বাহিনী টিকতে না পারিয়া অবস্থান পরিবর্তন করিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় বহু বাড়ি জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া দেয়। এদিকে শোকরানা রানার দল ও অন্যান্য দলের ৫০/৬০ জন গেরিলা যোদ্ধা টিউরপাড়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হইয়া পজিশন নেয়। হানাদারবাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনীর পাল্টা গোলাগুলি চলিতে থাকে। ঐ সময় হানাদারবাহিনীর টিউরপাড়া গ্রামের ১২ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। গেরিলাবাহিনীর গোলাগুলিতে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ জন নিহত হয়। তৎপর সারা রাত্রি পাকবাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনী বাঁশগাড়ি ও নারচীতে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলার পর ভোরবেলা পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করে। এই ঘটনার দুই দিন পরে তিন দিক হইতে পাকসেনা নারচী গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের বহু বাড়িঘর পুড়িয়া ভস্মীভূত করে।
১০ই নভেম্বর নারচীর আবদুল হাসিম বাবলুর দল বগুড়া সারিয়াকান্দি রোডের বাইগুনী গ্রামে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া কর্নেলসহ ৫ জন পাকসৈন্য নিহত করে। ঐ দিন গেরিলাবাহিনীর কমাণ্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সূফীর নেতৃত্বে বগুড়া শহরের নিশিন্দারায় ১১ হাজার কিলোওয়াট ভোল্টের ট্রান্সমিটার ধ্বংস করা হয়।
১২ই নভেম্বর ইণ্ডিয়ান মারহাট্টা রেজিমেণ্ট, আসাম রেজিমেণ্ট ও মুক্তিযোদ্ধারা হিলি সীমান্তে পাকবাহিনীর সহিত মোকাবিলা করার জন্য উপস্থিত হয়। হিলিতে পাকবাহিনী তখন ঘোড়াঘাট হইতে ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স আনিয়া। পাল্টা আক্রমণ করিবার প্রস্তুতি নেয়। তখন ৬নং আসাম রেজিমেণ্টের ক্যাপ্টেন রায়সিং ডোগরা ও মুক্তিযোদ্ধাদের এস, এম ফারুক (বগুড়া), আবুল কাশেম (জয়পুরহাট), মোজাহার (গাবতলী), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর) দলের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর সহিত প্রবল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য ও কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। পাকসৈন্যদের সঙ্গে মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্টেনগান টমিগান, রাইফেল প্রভৃতির দ্বারা যুদ্ধ চলে। ঐ দিন বিমান হইতে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ হয়।
১৩ই নভেম্বর মহিমাগঞ্জের দুলুর নেতৃত্বে ও সিহিপুরের বাবলু, খালেক, হামিদ, খলিল, নূরুল, শুকু ফিনু, জগলু, হাল্লু, লিণ্টু ও আরও অনেকের সহযোগিতায় সুখানপুকুর রেল স্টেশনের ধারে শিহিপুরের নিকট একটি পাকসৈন্যবাহী স্পেশাল ট্রেন ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করিয়া দেয়। ফলে প্রায় দেড়শত পাকসৈন্য মৃত্যুবরণ করে।
১৫ই নভেম্বর গেরিলা বাহিনী কমাণ্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে সুখানপুকুর রেলস্টেশনে শত্রুদের খাদ্যবাহী একটি ট্রেন মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ধ্বংস করে।
২৫শে নভেম্বর গাবতলীর নিকটস্থ জয়ভোগ গ্রামের রেলওয়ে ব্রীজ পাকবাহিনীর নিকট হইতে দখল করিবার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসৈন্যদিগকে আক্রমণ করিয়া গুলি বিনিময় করিতে থাকে। ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী থানাস্থ ক্যাম্পের দিকে পলায়ন করিতে বাধ্য হয়। দুই ঘণ্টা পর পাকসৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন গাবতলী স্টেশনে থামিলে পাকসৈন্যরা ট্রেন হইতে নামিয়া জয়ভোগা ও বইগুনী গ্রামের দিকে গুলীবর্ষণ করিতে করিতে অগ্রসর হয়। ফলে বাইগুনী গ্রামের আবুল হোসেনসহ কয়েকজন গ্রামবাসী গুলির আঘাতে নিহত হয়। পরে নেপালতলী গ্রামের দিক হইতে গেরিলাবাহিনীর একটি দল আসিয়া পাল্টা আক্রমণ করিবার ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী ক্যাম্পে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয়।
২৮শে নভেম্বর সারিকান্দি থানা আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় নারচীর আবদুল হাসিম বাবলু, আবদুর রশিদ, চরহরিণার তোফাজ্জেল হোসেন মকবুল, হুয়াকুয়ার আবদুর রাজ্জাক, রামচন্দ্রপুরের মহসিন। মৌরের চরের সরুজ্জামান। ৭নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা দল ও গেরিলাবাহিনী প্রবল গোলাবর্ষণ করে। পাকবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালাইবার ফলে দুইজন পাকসৈন্য নিহত হয়। গেরিলাবাহিনী অদম্য সাহসে মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে বর্বর পাকবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার দৃপ্ত পণ লইয়া যুদ্ধ করিতে থাকে। বেলা ১১টার সময় ব্রাশফায়ারে কয়েকজন পাকসৈন্য মাটিতে পড়িয়া যায়।
পরের দিন সকাল ৮টায় গেরিলা বাহিনী সারিয়াকান্দী থানা পুনঃ আক্রমণ করিয়া ৪৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। থানার অফিসার ইনচার্জসহ ১৮জন পাকসৈন্য নিহত হয়। এই প্রচণ্ড গোলাগুলির ফলে গেরিলা বাহিনীর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। সমস্ত দিবারাত্রি প্রচণ্ড গোলাগুলি চলিতে থাকে।
গেরিলা বাহিনীর খাদ্য ও পানীয় সরবরাহে কোন অসুবিধা হয় নাই। পার্শববর্তী গ্রামের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত হইয়া খাদ্যদি সরবরাহ করিতে থাকে। পরিশেষে রাজাকার ও পুলিশেরা আত্মসমর্পন করে। কিছুসংখ্যক পুলিশ অন্ধকারে গ্রামের দিকে পলাইয়া প্রাণ রক্ষা করে। গেরিলা বাহিনীর যে ৩ জন শহীদ হয় তাহারা হইতেছেন বালিয়ার তাইরের মমতাজ উদ্দীন, সাত বেকীর মোজাম্মেল হক ও আর একজন। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানা দখল হয়। গেরিলা বাহিনী কর্তৃক ৫৩ জন রাজাকার ও ১৯ জন পুলিশ বন্দী হয়। ১৯জন রাজাকারকে গুলী করিয়া হত্যা করে। গেরিলা বাহিনী ১১৮ টি রাইফেল, ৪২টি এলএমজি, ১টি রিভলবার, ১টি গ্রেডে ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে। ঐদিন বিমান আক্রমণ হয়, তাহার ফলে কয়েকজন জনসাধারণ নিহত হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীনের দল এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। নভেম্বর মাসের শেষভাগে পাকসৈন্যরা ভেরুরপাড়া রেলস্টেশনে যাইবার কালে পথিমধ্যে ট্রেন থামাইয়া জোড়গাছা গ্রামের কতকগুলি বাড়ীতে আগুন জ্বালাইয়া দেয়। সংবাদ পাইয়া পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে মুক্তিযোদ্ধা দল আসিয়া হানাদার বাহিনীকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গোলাগুলিবর্ষণ করিতে থাকে। পাক সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দৌড়াইয়া ভেলুরপাড়া স্টেশনে বাঙ্কার আশ্রয় লয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ সেখানেও তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে ৪ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।
পরের দিন মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মণ্টুর নেতৃত্বে আব্দুস সালাম, আতোয়ার হোসেন প্রভৃতি এবং স্থানীয় গেরিলা বাহিনী ও জনসাধারণ রেল স্টেশনটি পোড়াইয়া দেয়। পরে চকচকে ব্রীজে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়া ফেলে। তৎপর রেলওয়ে স্লিপার উঠাইয়া রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথমভাগে রংপুর পলাশ বাড়ী হইতে পলাতক একদল শত্রুসৈন্য গাবতলী থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার শুরু করে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম জাগুলির প্রাক্তন সৈনিক গোলাম ছারওয়ার খানের নেতৃত্বে তাহার দল প্রতিরোধ আক্রমণ চালায়। ইহাতে প্রচুর গোলাগুলির বিনিময় হয়। ফলে ২ জন শত্রুসৈন্য নিহত, ২ জন শত্রুসৈন্য আহত ও ১২ জন পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পূর্ব দিন সকাল বেলা পীরগাছা মিলিটারী ক্যাম্প হইতে একটি সৈনিক প্রাণের ভয়ে পালাইয়া আসিলে লস্করী পাড়ার নিকটস্থ জেলা বোর্ডের রাস্তার ব্রীজের নিকট শফিউল আলম স্টেনগানের গুলীতে তাহাকে নিহত করে। ঐদিন মহাস্থান হইতে ৫ জন হানাদার সৈন্য পালাইয়া আসিবার কালে গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে প্রবেশ করিবার সময় ৭ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। ঐ সময় চরহরিণার তোফাজ্জল হোসেন মকবুল ও তাহার দল ৫ জন পাক সৈন্যকে ধরিয়া ঘটনাস্থলেই গুলি করিয়া হত্যা করে।
৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার জাহেদুর রহমান (বাদল) ও আরও অনেকে রংপুর জেলার ভরতখালি বাঁধের পার্শ্বে পাকসৈন্যদের সহিত এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে রাজাকারসহ ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জাহেদুর রহমানসহ ৫ জন শহীদ হয়। এই ৫ জনের লাশ ভরতখালী স্কুল প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হয়।
৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কামার আবুল হোসেন (কলসা)-এর নেতৃত্বে তাহার দল পাকহানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। তুমুল লড়াইয়ের পর পাক সৈন্যরা নওগা অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করে। কিছুসংখ্যক পাকসৈন্য হতাহত হয়।
১০ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সম্মিলিত বিমান আক্রমণে সান্তাহার রেলওয়ে জংশন পাওয়ার হাউস মেকানিক্যাল ওয়ার্কস ও রেলওয়ে জংশন লোকোশেডের উপর বোমাবর্ষণ করে। ফলে কিছু পাকসৈন্য হতাহত হয়। যুক্তিবাহিনীর আনসার আলী নামে একজন বিমান কর্মচারী আহত হন।
১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী রংপুরের পলাশবাড়ী অতিক্রম করার পর পাকসৈন্য ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে। তাহারা বগুড়া শহরের এতিমখানা হইতে অনবরত শেলবর্ষণ করিতে থাকে। তাহার ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বহু লোক হতাহত হয়। উপর হইতে ভারতীয় বিমান বাহিনী ঘন ঘন বোমাবর্ষণ করিতে থাকে। তখন পাক সৈন্যরা বাঙ্কারে লুকাইয়া পড়ে। কিছু পাকসৈন্য পালাইয়া গ্রামের দিকে ধাবিত হয়। গ্রামবাসী তাহাদিগকে ধরিয়া যে যেখানে পারে হত্যা করে।
১৩ই ডিসেম্বর কিছুসংখ্যক সৈন্য জয়পুরহাট হইতে পালাইয়া আসিয়া সদর থানার সরলপুর গ্রামের পাঁচ পীরের দরগায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল ও তাহার দল জানিতে পারিয়া তাহাদিগকে ঘেরাও করিয়া ফেলে। মুক্তিফৌজের সহিত প্রচণ্ড গোলাগুলিতে দুইজন মুক্তিসেনা ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তন্মধ্যে ছিলেন মুক্তিফৌজের কমাণ্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল। পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন দা, কুড়াল খন্তা প্রভৃতি অস্ত্র লইয়া আসিয়া পাক বাহিনীর সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করে। ঐদিন গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে পীরগাছা মিলিটারী ক্যাম্প হইতে কয়েকজন পাকসৈন্য পালাইয়া আসিবার সময় কদমতলী গ্রামের রহিমউদ্দিন প্রামানিক নামে একজন লোক ভিটার মধ্যে মিলিটারীর ভয়ে হামাগুড়ি দিয়া লুকাইয়া থাকে। তখন একজন মিলিটারী তাহার পিঠে গুলি করে। তাহার পাশেই গোবর্ধন রবিদাস নামে একজন মুচিকে গুলি করিয়া হত্যা করে। নিকটস্থ গেরিলা বাহিনী আসিয়া তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলে।
প্রচণ্ড গোলাগুলি হওয়ার পর পাকসৈন্যদের একজন নিহত হয়। বাকী পাক সৈন্যরা একটি গর্তের মধ্যে লুকাইয়া পড়ে। পরে তাহারা সন্ধ্যার পর পালাইয়া যায়। ঘটনাস্থলে সারিয়াকান্দি থানার বোহালী গ্রামের রফিক নামে একজন মুক্তিসেনা শহীদ হন। এই প্রচণ্ড লড়াইয়ে হাট ফুলবাড়ী, জাতহলিদা, বাইগুলি ও নারচী গ্রামের গেরিলা বাহিনী অংশ নেয়। পাক সেনারা মৃতদেহটি পরে নারচীর গেরিলা দল মহিষের গাড়ী করিয়া লইয়া যাইয়া নারচীর সমুখস্থ বাঙ্গালী নদীতে ফেলিয়া দেয়। দীঘলকান্দির চান্দ কশাই ও চরকাধিকার একজন গ্রামবাসী পাক বাহিনীর গুলিতে মৃত্যবরণ করে।
১৩ই ডিসেম্বর বর্বর পাক বাহিনীর সহিত মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সহিত হিলি সীমান্তে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ছিল মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ও বোমা। আমাদের বাংলাদেশের কতকগুলি দামাল ছেলের সঙ্গে ছিল, সামান্য স্টেনগান এসএলআর রাইফেল, এলএমজি আর পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ছিল কতকগুলি মানব হত্যার মারণাস্ত্র।
এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হইয়াছিল আলম বাহিনী, সেলিম বাহিনী এবং এবাদ বাহিনী। প্রথম মিত্রবাহিনী পাকসৈন্যদের উপর বিমান থেকে গুলি বর্ষণ করিতে থাকে। তারপর শুরু হয় এক ঐতিহাসিক তুমুল যুদ্ধ। পৃথিবী থাকিবে, বাংলাদেশ থাকিবে, তাহার সহিত এই হিলির যুদ্ধ চিরদিন বাংলার ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকিবে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর সাতশত সৈন্য নিহত এবং কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্ক, মেশিনগানসহ আড়াইশত পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অল্পসংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হয়। হিলি দখল করার পর বিবরঘাঁটি থেকে তিনশত নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করা হয়।
ঐদিন বগুড়ার পুলিশ লাইন হইতে অহরহ শেলবর্ষণ হইতে থাকে। শহরের এবং কলোনীর বিহারীরা ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া যেখানে পারে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকসৈন্যরা পরাজিত মনে করিয়া তাহারা করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্য ডিনামাইট পুঁতিয়া রাখে। ঐদিন মিত্র বাহিনীর একশত সাতাশটি ভারতীয় ট্যাঙ্ক ত্রিমুখী সাঁড়াশী আক্রমণ করিবার জন্য গাবতলী হইয়া মাদলার পথে এবং মহাস্থান ও দুপচাচিয়া হইয়া বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে আসিয়া পৌঁছে। তুমুল ট্যাঙ্ক যুদ্ধ ও বোমা বিস্ফোরণে সমস্ত শহর প্রকম্পিত হয় এবং আগুনের লেলিহান শিখা দৃষ্ট হইতে থাকে। দুই একটি বোমার আঘাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছুসংখ্যক লোক হত ও বাড়ীঘর বিধ্বস্ত হয়।
১৪ই ডিসেম্বর বগুড়া শহর হইতে পলাতক দুইজন পাকসৈন্য সদর থানার সাবরুল ইস্কুলের মাঠ দিয়া পালাইয়া যাইতেছিল। ঐ সময় গেরিলা বাহিনীর আনোয়ার হোসেন, রফিক ও আরও অনেকে এবং গ্রামবাসী লাঠিসোটা এবং বর্শা প্রভৃতি লইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করে। তাহাদিগকে ধরিয়া মারপিট করিয়া হত্যা করে।
১৫ই ডিসেম্বর পলাতক পাকবাহিনী ও কিছু অবাঙ্গালী বগুড়া শহর হইতে পালাইয়া যাইবার সময় গোলাগুলি বর্ষণ করিতে থাকে। তাহারা শহর হইতে একটি লরী লইয়া যাইতেছিল। লরীটি বিকল হইয়া গেলে তাহারা মার্চ করিতে পদব্রজে অগ্রসর হইতে থাকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গ্রাম হইতে মুক্তিবাহিনীর দল আসিয়া পাল্টা গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ ও দুইজন আহত হয়। জানা যায়। ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে পাকসৈন্যরা ডেমাজানী আসিয়া আকস্মিক গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে কমলরাজভর নামে একজন নিহত হয়। পরে পাকসেনারা ফিরিয়া যাইবার পথে আড়িয়ার বাজারে ডঃ ফনিন্দ্রনাথ দেব, সুরেশচন্দ্র পাল, শিরিষচন্দ্র পাল, খোকা বৈরাগী, তপেন্দ্রনাথ পাল ও আরও কয়েকজনকে গুলি করে।
ঐদিন বৈকালে আনুমানিক ৪ ঘটিকার সময় ডিনামাইট বিস্ফোরণে করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস হইয়া যায়। ঐদিন মিত্রবাহিনীর সহিত পাকসৈন্যদের তুমুল যুদ্ধ চলিতে থাকে। ফলে বহুসংখ্যাক পাকসেনা হতাহত হয়। ঐ সময় ভারতীয় বিমান হইতে কয়েকটি ভারী বোমাবর্ষণ হলে এতিমখানার নিকটস্থ স্থানের ঘরবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং দুটি বৃহদাকার গর্তের সৃষ্টি হয়। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর আনুমানিক তিন হাজার পাকসেনাসহ উচ্চপদস্থ অফিসারেরা মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়।
OPERATION AVOYA BRIDGE: MR. BADIUZZAMAN[৬]
The successful operation at Rajshahi-Nawabgonj road in the night of 14/15 August has really put up the morale of freedom fighters so high that they have been too much excited to go for another operation around that area. Under the leadership of Maj. Gyas everyone at the camp was very keen to go for another operation. On the night of 14/15 August one of the most strategic bridge named as IHaripur Bridge of 120 ft. length over capturing 12 mixed guards of Rajakars and Pak army personnel. This had already snapped the communication link between Rajshahi- Nawabgonj highways. In the same night another group of crack morter detachment went within shell range of Nawabgonj town with 3” morter and for good one hour shelled the town thus disrupting and sheltering the celebration of Independence Day and that of morale of Pak army and local collaborators.
After returning from the above mentioned operation Maj. Gays took one day to overcome the fatigue of that operation and started preparing for another another operation. I was his Staff Officer working very closely with him. IIc only told me to prepare 6 persons out of informer group to go inside the enemy defence and bring back some information. We had some freedom fighters trained for this purpose. He briefed each and everyone separately and after their return by 20 August collected cnough information. What I found out from him on 20 August that he was preparing for an operation at 'Avoya bridge' one of the most strategic bridge on road leading from Sonamasjid-Nawabgonj-Rajshahi. The reason he told me that after demolition of Haripur Bridge they could not yet build that bridge. If we can demolish Avoya bridge the 2 battalion worth of regular and para-military forces who are located around Nawabgonj town will be isolated. An area of approx. 50 miles from Rajshahi town will remain under command of FF. Incidentally already an area of approx. 200 squirc miles around river Mahananda and Padilla was under command domuration of freedom fighters commanded by Maj. Gyas He selected 45 persons from amongst the freedom fighters and regular forces and in his own technique and style on 22 August made them sit around a big model of cloth, after making sketch of whole area. Amongst the group I was one of the fortunate one to be selected. Dr. Alam, a final year student of Rajshahi Medical College was also amongst those. We were given a thorough briefing by Maj. Gyas about his plan of operation. Those were the days of heavy flood around Rajshahi-Nawabgonj arca. The strategic bridge was located 19 miles away from Rajshahi Town. We set out in 3 large carrier boats (meant for carrying paddy) for out target by 11.00 a.m. in 3 groups. Major weapon we carried were one 2"x Vicar machine guns, 2x2" morters, 8 LMGs, 8 stens, 20 rifles, one grenade with each one of us also with us we also with us we had 450 kg of explosive. As we had paucity of explosives our leaders carried 250 kg of Gelatine explosives and 20 numbers of anti-tank mines of 10 lbs of explosives each one of them having Haripur bridge was demolished a week before with similar type of combination in explosives.
The R V from where we started was Faridpur BOP of Ex BDR which remained throughout in possession of regular forces of Bangladesh Niamita Bahini under Maj. Gyas. We also had 6 more BOPS under our command throughout the war of liberation all along river Padma and Mahananda. We expected to reach the destination although in rowing sail boats in 12 hours time. We carried with us haversack lunch. When we reached near our target we lost our direction as the area was totally submerged with flood water and dark. IIowever we managed to get the direction with the help of a local person and reached to our assembly area of the target at 0010 hrs approx 2 hours later than schedule time. We got ourselves unboarded approx. 1000 yards away from boat. We started making in diamond head information. When we moved about 200 yds we found that the road was submerged which was leading towards Avoya bridge. We continued to move very slowly in a keen -deep water. We came slowly upto 100 yds, and we could see the high bridge in the twilight of the sky, and it was already 0100 hrs almost 50 minutes after we got down from the boat. We kept on moving, and the morale of out boys were very high. When we came within 40-50 yds from the bridge suddenly 5/6 LMGs opened fire on us. A big shower of bullets flew over our head. We all were perplexed and never expected such a surprise. Suddenly I heard Maj. Gyas shouting at the top of his voice `get dispersed and take position.' Most of our people tried to get off the main road but they could not go much further from the knee-deep water. Most of the freedom fighters got into neck-deep water and around some submerged houses. For about 4/5 minutes there was complete confusion as the machine gun fire was showering over our head. I found Major Gyas standing in the middle of the road and I was next to him and during that period of first 2 minutes immediately after shouting for position, he opened up with his favorite Chinese sub- machine gun which he always carried during the operations. IIc exhausted 2 morc magazines. Meanwhile the Vicar machine guns which were mounted up at the enemy position.
Now the exchange of fire from both the sides continued. I saw our leader moving towards the ambush site and whole lot of freedom fighters started following him blindly shouting. In knee to neck-deep water we continued fighting and tried to capture the bridge. Enemy also continued with their resistance to retain the bridge and gave a stiff resistance. After about 3 hrs of fighting we saw enemy getting out of the bridge by 3 boats tied on the side of the bridge. Later we realised that the road on the other side of the bridge was submerged and no vehicle could come there and they had to resort to boat for their withdrawal.
Finding them escaping we continued to fire with automatic weapons at those people on the boats. The firing from the bridge site was almost diminishing except one LMG which kept on firing. When our LMGS and MGs were at the boat we could hear the shouting of some people saying 'Bachao' 'Bachao' with the reflection of starlight we could see one of the boats going down onto water due to impact of firing. When we captured the bridge it was 4-30 a.m. We ran short of ammunition and whole lot of freedom fighters were totally exhausted although their morale was sky high. Now the question of demolition of bridge camp up. But should we take a risk at this stage as in the morning we expected some re-inforcement from enemy. We decided to pull block to our camp. As the preparation of deep mine charges which could be used for placing there on the embankment after digging hole, at least would need 2 hours time. Morcover our chordite, tonators meant for making ring man circuit were spoiled during fighting. More, we lost one of our valiant fighter L/Nk Mohar Ali who had a bullet in his chest and 2 of the FFs got seriously injured, who needed immediate surgery to save their lives.
I must say the mission was partially successful. Although we could not demolish the bridge but we killed 2 Pak army soldier and 6 Rajakars. Their dead bodies were recovered from the river water 2 days later. We confirmed later that more than a dozen of Pak army and Rajakars were seriously injured in that operation. This action has really put the morale of Pak army down to their knee.
Two successful operation during the month of August did ensure the movement of troops confined only during the day time in minimum of 2 vehicles with adequate strength. More regular troops were deployed for guarding the bridges and culverts thus depleting the finishing strength. A large body of trained personal i.c. regular army was used for patrolling in the main line of communication i.e. road Rajshahi- Nawabgonj which could have been done entirely by paramilitia. This particular operation really opened my eyes about the need of leadership during any army operation as to how a body of armed personnel could be led successfully even against the odds.
- ↑ প্রকল্প সংগৃহীত দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
- ↑ বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
- ↑ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
- ↑ দৈনিক 'সংবাদ' ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮১ সংখ্যায় প্রকাশিত মুসা সাদিক রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।
- ↑ এ. জে এম শামসুদ্দিন তরফদার-রচিত ‘দুই শতাব্দির বুকে’ বগুড়া, ১৯৭৬ থেকে সংকলিত।
- ↑ বিবরণটি প্রকল্প সংগৃহীত দলিলপত্র থেকে সংকলিত। ১৯৭১ সালে মেজর গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার)-এর অধীনে স্টাফ অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন।