বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড)/৬

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬। ৩ নং সেক্টরেরর যুদ্ধ সংক্রান্ত অন্যান্যের বিবিনণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ...১৯৭১

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার এম, এ, মতিন[১]

 আমাদের হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া থেকে তুলে ভারতীয় সীমান্ত সীমানাতে স্থানান্তরিত করা হয়। মে মাসের প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে তেলিয়াপাড়াতে ঘাঁটি, সংখ্যায় ছিলাম ৮০/৮৫ জন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া চট্টগ্রাম থেকে এসে আমার সাথে যোগ দেন। এরপর আমরা দুজন পরামর্শ করে ডিফেন্স নেই।

 মে মাসের প্রথম থেকে পাকবাহিনী ৮/১০ বার হামলা চালিয়েও আমাদের সরাতে পারেনি। ওখানে মাঝে মাঝে যুদ্ধে আমরা পাকবাহিনীর গাড়ী ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছি। প্রত্যহ হামলা করতো পাকবাহিনী। বেসামরিক লোক, ইপিআর, মুজাহিদ এরা এতো সাহসিকতার সাথে পাকবাহিনীর সাথে মোকাবিলা করে যে আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। ইপিআরদের কথা ভোলা যায় না। এত সাহস আমি জীবনে দেখিনি। হেডকোয়ার্টার থেকে খাবার আসতো। এমনও দিন গেছে যে, ২/৩ দিন খাবার পায়নি। বৃষ্টিতে ভিজে অনাহরে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মুজাহিদ দুলামিয়ার একটি ঘটনা বলা দরকার। মুকুন্দপুর হরশপুর (সিলেট) ওখানে পাকবাহিনীর সাথে এক যুদ্ধে দুলামিয়ার বেশ কিছু পাক বাহিনীকে খতম করে। পাক বাহিনীর চাপে অন্যান্যরা চলে যায়, দুলামিয়ার পেটে গুলি লেগে মারা যাবার মত তবুও গামছা দিয়ে পেট বেঁধে এলএমজি ফায়ার করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে প্রায় জ্ঞান হারায় এমন অবস্থা। কর্ণেল শফিউল্লাহ পিছন থেকে দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে দুলামিয়াকে উদ্ধার করে। দুলামিয়া প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেও তার ট্রিগারে হাত ছিল। শফিউল্লাহ তাকে উদ্ধার করে উঠে আসার সাথে সাথে বলে আমার এলএমজি কোথায়। আর বলতো, স্যার আমি মরে গেলে ‘জয় বাংলা’ বলবেন।

 ইপিআর নায়েক সুবেদার মালেক, নায়েক আবদুল ওহিদ, ল্যান্স নায়েক মফিজ, নায়েক সালাম, সেপাই হায়দার আলী, গোলাম মওলা, মুজাহিদ তাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক নূরুল ইসলাম এবং সিপাই কবীর- এদের নাম ভোলা যায় না। ছাত্রদের মধ্যে সেলিম এবং আনিসের দুই ভাই এবং শাহজামান মজুমদারের কথা অতুলনীয়। সেলিম মীরপুর অপারেশনে শহীদ হয় বিহারী কলোনীতে। মরার সময় সে বলেছিল যে, ‘স্যার পাকবাহিনীর হাতে মারা গেলাম না, কুত্তা বিহারীদের হাতে মারা গেলাম।’

 যাহোক, ১৯শে মে পাকবাহিনীর আর্টিলারী এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রের সাহায্য ব্যাপক আকক্রমণ চালালে আমরা তেলিয়াপাড়া ছাড়তে বাধ্য হই। যুদ্ধে আমাদের ৮/৯ জন মারা যায়। পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধ চলে সারা দিন ধরে।

 ২০শে মে ভোরে আমি পাল্টা আক্রমণ করি তেলিয়াপাড়াতে। সকালে আমরা ৪/৫ টা আস্কার দখল করে নেই কিন্তু পাকবাহিনীর আরও সৈন্য আসায় আমরা প্রায় ১১টার দিকে পিছু হটে আসি। আমাদের ১০ জন মারা যায়। পাকবাহিনীর ২০/২৫ জন মারা যায়। ইতিমধ্যে যুদ্ধনীতি পরিবর্তন হয়। আমার বাহিনীকে গেরিলা শিক্ষা দিই।

 ১৭ই মে ক্যাপ্টন মুর্শেদ কিছুদিনের জন্য তেলিয়াপাড়াতে আসে। ক্যাপ্টেন মুর্শেদ তার দল নিয়ে তেলিয়াপাড়া সিলেট রাস্তায় মাইন বসিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে। পাক বাহিনীর ১২টা গাড়ী ওখান দিয়ে যাচ্ছিল।

পাকবাহিনীর গাড়ী ধ্বংস হয় এবং ৭০ জন মারা যায়। ২টি ট্রাক এবং একটি বাস, চিঠিপত্র এবং অনেক গোপন তথ্য আমাদের হস্তগত হয়।

 সম্মুখযুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে আমরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। এতে করে আমরা কৃতকার্য হতে লাগলাম। দুইবার একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি। বুলেট লুঙ্গি ও হাফহাতা জামার হাতা ভেদ করে গেছে কিন্তু আমার শরীর স্পর্শ করেনি।

 ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী পুনর্গঠিত করতে থাকি। বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে এসে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু নিতে থাকি এবং সার্বিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে সম্মুখ সমরে আসতে হয়। আমাদের উপর নির্দেশ আসে শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করে, ধ্বংস কর, অস্ত্র কাড়ো, এগিয়ে যাও। আমরা তখন দলে বেশ ভারী হয়ে চলেছি, অস্ত্রশস্ত্রও বেশ আছে। আমরা কাজ আরম্ভ করে দেই। সেপ্টেম্বর মাসেই একাদশ বেঙ্গল তৈরী হয়। পুরাতন আর্মি, মুজাহিদ, আনসার এবং ছাত্র মিলে ব্যাটালিয়ন পুরা করা হয়। কোন সময়ে আমি একা, কোন সময়ে দুই কোম্পানী মিলে, কোন সময়ে তিন কোম্পানী মিলে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাঝামাঝি পর্যন্ত। হরশপুর, মুকুন্দপুর, তেলিয়াপাড়া, মনতলা, সিলেট, সাজিবাজার, শাহপুর ইত্যাদি স্থানে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে আমরা জয়লাভ করি। শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারী আমাদের মাঝে মাঝে সাহায্য করতো।

 ৩০শে নভেম্বর আমার উপর নির্দেশ আসে আখাউড়া দখলের জন্য। ১লা ডিসেম্বর আমি, মিত্রবাহিনী, ২য় বেঙ্গলের বাহিনী সম্মিলিতভাবে আমরা আখাউড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ঘিরে ফেলি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আক্রমণ চালাই। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়- ১লা ডিসেম্বর তারিখে শুরু হয়, ৬ই ডিসেম্বর সকালে আখাউড়া আমাদের দখলে আসে। কর্নেল শফিউল্লাহ আমাকে মাধবপুরে রওনা হয়ে যেতে বলেন। কর্নেল নিজে ১১ বেঙ্গল এবং ২য় বেঙ্গল নিয়ে ব্রহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হলেন বললেন রাস্তায় দেখা হবে। ঐ দিন ২টার দিকে আখাউড়া থেকে রওনা দেই, পুরাতন ক্যাম্প মনতলাতে রাত ১০/১১ টার দিকে পৌঁছাই। সকালে মাধবপুরের দিকে অগ্রসর হবার মনস্থ করি। ৭ই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় মেজর নূরুজ্জামান আমার ক্যাম্পে এসে একটি দুর্ঘটনার খবর দেন এবং আমার কোম্পানীকে রেখে আমাকে একাদশ বেঙ্গলের দায়িত্ব নিতে বলেন। মেজর বলছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন হঠাৎ করে সিলেটের রামপুরে পাকবাহিনীর ৪০/৫০ জনের একটি দল আক্রমণ চালায়। ওখানে পাঞ্জাবী সুবেদারের সাথে কর্ণেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি হয় কিন্তু শফিউল্লাহ বুদ্ধি বলে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সুবেদারকে আঘাত করে ধরাশায়ী করেন। ২ জন মুক্তিবাহানী মারা যায়। ১০/১২ জন আহত হয়। মেজর নাসিম গুরুতর রুপে আহত হয়। কর্নেলের পিস্তল যেখানে গুলি লেগে পিস্তলটি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু কর্নেল বেচেঁ যান। ১৫/১৬ জন পাঞ্জাবী মারা যায়, বাকি সব আত্মসমর্পণ করে একাদশ বেঙ্গলের কাছে।

 কর্নেল সাহেবের সাথে দেখা করে একাদশে বেঙ্গলের দায়িত্ব নেই এবং তিনি ঐ রাতেই মাধবপুর, শাজবাজপুর সরাইল হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। ৭ই ডিসেম্বর রাতে পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হই। ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হস্তগত করি। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলেও আমাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় আশুগঞ্জ দখলের জন্য নির্দেশ দেন কর্নেল শফিউল্লাহ ১১ই ডিসেম্বর। ১১ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ দখল করি। ভৈরব সেতু ধ্বংস করে ভৈরব শহরে পাকবাহিনী আস্তানা গাড়ে। মিত্রবাহিনী এবং কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় বেঙ্গল নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার পথে রওনা হন আমাকে আশুগঞ্জে রেখে। আমাকে নির্দেশ দিয়ে যান আমি আমার বাহিনী নিয়ে পাক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখি, যাতে তারা ঢাকার পথে পিছন দিক থেকে গিয়ে কর্নেল শফিউল্লাহ বা মিত্রবাহিনীর কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমরা দুই দিক থেকে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখলাম। মাঝে মধ্যে আক্রমণ করে আমরা পাকবাহিনীর বিপুল ক্ষতি করি। ভৈরবের অপর পাড়ে যে পাক ঘাঁটি ছিল ১৭ই ডিসেম্বর তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

 বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং ২৫তারিখে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে অস্ত্র ধরি। অসহযোগ আন্দোলণে পুরো সমর্থন আমাকে এগিয়ে দেয়।

স্বাক্ষরঃ মেজর, এম, এ মতিন
২৮-৩-৭৩

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল হেলাল মুর্শেদ[২]

 ৪ঠা মে আমি আমার প্লাটুনসহ শাহবাজপুর পৌঁছি। ৫ই মে সকালে আমি রেকি করি এবং রাত্রে রেইড করি। ৬ই মে সকালে জনসাধারণের মুখে শুনতে পাই ৯জন পাকিস্তনী সৈন্য মারা যায়। তার ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা জনসাধারণের বাড়ীঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার প্লাটুনের মাত্র ১জন আহত হয়। রেকি করে ৭ই মে আমি আহত সৈন্যসহ প্লাটুন নিয়ে বিকেলে মাধবপুর পৌঁছি। মাধবপুরে তখনো আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা মাধবপুর পৌঁছার পর এবং মেজর শফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যরা শাহবাজপুর থেকে মাধবপুর পৌঁছে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং গোলাগুলি করে। ঐ মূহূর্তে আমরা যদিও অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম তথাপি মেজর শফিউল্লাহ আমাকে শত্রুর বাদিক দিয়ে আক্রমণ করার আদেশ করেন। আমি প্লাটুন নিয়ে শত্রুর বাদিকে অগ্রসর হই। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করা। ঐ সময় আমি শত্রুর উপর আক্রমণ করতে পারলাম না এ জন্য যে আমাদের চতুর্দিক দিয়ে শরণার্থী যাচ্ছিল। বিকেলে ছয়টা পর্যন্ত পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানীদের চরম আক্রমণে আমাদের আলফা কোম্পানী সৈন্য তুলে নিয়ে মনতলায় নতুন করে ডিফেন্স তৈরী করে।

 মনতলায় আমি তাদের সঙ্গে যোগদান করি। মনতলায় আমাদের প্রধান ঘাঁটি তৈরী করি এবং সেখান থেকে ছোট ছোট রেইড এবং এ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেই।

 এসময় পাকিস্তানী সৈন্য মাধবপুর দখল করে ভেলিয়াপাড়া পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। ভেলিয়াপাড়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তারা রাস্তা তৈরী করে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। মাধবপুর এবং তেলিয়াপাড়া হয়ে যে রড় রাস্তা সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত সেই রাস্তায় পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড এবং এ্যামবুশ করাই শ্রেয় মনে করি এবং সেভাবে রেইড ও এ্যামবুশ করতে থাকি। কেননা ঐ রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানী গাড়ী যাতায়াত করতো।

 মনতলা থেকে আমি কয়েকবার এ্যামবুশ করি। আমি প্রথম এ্যামবুশ করি ইসলামপুর গ্রামের রাস্তায়। ঐ রাস্তায় মাইন বসিয়ে গাড়ি উড়ানোর চেষ্টা করি এবং তাদের যোগাযোগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। মাইন বসানোর ফলে আমার প্রথম এ্যামবুশে একটা জীপ, একটা ট্রাকসহ মোট ৩০জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। আমাদের গুলিতেও প্রায় ২০ জন নিহত হয়। সর্বমোট প্রায় ৫০ জন পাকিস্তনী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। মনতলায় এটাই আমার সাফল্যজনক এ্যামবুশ। পরেও কয়েকবার এ্যামবুশ করি কিন্তু তত সুবিধা করতে পারিনি।

 এরপর মনতলা থেকে তেলিয়াপাড়া যাবার নির্দেশ পাই। আমি মেজর নাসিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তেলিয়াপাড়া চলে যাই। তেলিয়াপাড়া যে কোম্পানীটি ডিফেন্সে ছিল। তার ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) মতিনের পরিবর্তে আমাকে দেওয়া হয়। আমাকে আমার প্লাটুনসহ উক্ত কোম্পানীর কমাণ্ডার নিযুক্ত করে। তেলিয়াপাড়া অবস্থানকালে আমার কোম্পানী নিয়ে আরও একটি এ্যামবুশ করি।  ১৬ই মে তেলিয়াপাড়া রাস্তার ৮১ মাইল পোস্টের নিকট উক্ত এ্যামবুশ করি। ঐ এ্যামবুশ দুটি পাকিস্তানী ট্রাক ধ্বংস করতে সক্ষম হই। একটা ট্রাক দখল করি এবং প্রায় ৫০ জন সৈন্য হতাহত হয়।

 মে মাসের ১৫ তারিখে পাকিস্তানী সৈন্য তেলিয়াপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রায় ৪০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। আমাদের শহীদের সংখ্যা ছিল ৫জন। পাকিস্তানী সৈন্যদের আর্টিলারী ও মর্টার আক্রমণ আমরা তেলিয়াপাড়া থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে সিমনা চলে যাই এবং সেখানে হেডকোয়ার্টারে স্থাপন করি। তেলিয়াপাড়া থেকে সৈন্য তুলে নেওয়া সত্বেও তেলিয়াপাড়া সিলেট বড় রাস্তায় আকস্মিক আক্রমণ আমরা অব্যাহত রাখি।

 সিমনা থেকে ডেলটা কোম্পানী আমার অধীনে দেয়া হয় এবং এই ডেলটা কোম্পানী নিয়ে আমি শাহবাজপুর মাধপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করি এবং জুলাই মাস নাগাদ আমি ঐ সমস্ত জায়গায় যুদ্ধ করি।

 ১৮ই জুলাই পাকিস্তানী সৈন্যরা আমার কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানীর উপর আক্রমণ করে রাত প্রায় ৪টার সময়। এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের দুটি কোম্পানীর উপর আক্রমণ করে। ১৯শে জুলাই বিকাল ৩টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। এখানে আমরা একটা পাকিস্তানী লঞ্চ ডুবিয়ে দিকে সক্ষম হই। আমার কোম্পানীর ১ জন শহীদ ও একজন আহত হয়। পাকিস্তানী সৈন্যও কয়েকজন নিহত হয়।

 ২৯শে জুলাই মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশনে আমি আমার কোম্পানী নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করি। তখন আমার ঘাঁটি ছিল লক্ষীপুর গ্রামসহ আর ৪টি গ্রাম নিয়ে। মাঝে মাঝেই আমরা মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশনের চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করি। কেননা তখন পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান ছিল মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশনের মাঝে।

 লক্ষীপুর ছিল আমার কোম্পনীর মূল ঘাঁটি। এখান থেকে আমার এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে আমিরগঞ্জ ব্রিজ ভেঙ্গে দেই। আমিরগঞ্জ ব্রিজে পাকিস্তানী মুজহিদ বাহিনীর মুজহিদকে আক্রমণ করলে তারা পালিয়ে যায়। এবং আমার প্লাটুন, উক্ত ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।

 ১৩ই সেপ্টেম্বর সিঙ্গারবিল এবং মুকুন্দপুর-এর মাঝখানে এক খানা ট্রেন নষ্ট করে দেই। ট্রেনে ৪টা বগী ছিল। ইঞ্জিনটা মাটিতে পড়ে যায়। ৪টা বর্গীর প্রায় ৭০জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং আহত হয়। উক্ত ট্রেন ধ্বংস করে দেওয়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুকুন্দপুর থেকে তাদের ঘাঁটি তুলে নেয়।

 সেপ্টম্বর পর্যন্ত উক্ত এলাকা আমাদের দখলে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানী সৈন্য পুনরায় মুকুন্দপুর দখলের চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তারা মুকুন্দপুর রেললাইন মেরামত করে পুনরায় দখল করে নেয়।

 ২৪শে সেপ্টম্বর ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) ভূঁইয়া তাঁর কোম্পানী নিয়ে ধর্মঘর নামক জায়গায় পাকিস্তানীদের উপর চরম আক্রমণ করেন। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে সাহায্য করার জন্য আমার কোম্পানী ছিল বাঁ দিকে ফ্ল্যাস্ক প্রোটেকশনে। ক্যাপ্টন নাসিমের কোম্পানী ছিল ডান দিকের ফ্ল্যাস্ক প্রোটেকশনে। উক্ত যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের একজন জুনিয়র কমিশশু অফিসারসহ দশজন নিহত হয়। আমদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

 ২রা নভেম্বর ১০ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইণ্ডিয়ান আর্মির সহায়তায় বেলুনিয়াতে একটি বড় যুদ্ধের পরিকল্পনা করে এবং ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে অনুরোধ করে ১টি কোম্পনী সেখানে পাঠানোর জন্য। অনুরোধ অনুযায়ী আমাকে বেলুনিয়া পাঠান হয়। আমি আমার ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ায় রওনা হই এবং বিকেলে পৌঁছি। বেলুনিয়ায় আমি দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সঙ্গে যোগদান করি।  ১০নভেম্বর বেলুনিয়া বালুজ-এ অবস্থানরত পাকসেনাদের ছত্রভঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে আমি শত্রুপক্ষের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে দুই ভাগ করে দেই যে তাদের যোগাযোগ বা একত্রিত হওয়া সম্ভব না হয়। আমার কোম্পানীসহ দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৪ কোম্পানী এখানে চারদিন অবস্থান করি এবং যুদ্ধ করি। তারা ১ জন নায়েক শহীদ হন এবং ১জন নায়েক সুবেদার আহত হয়। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে এবং তৃতীয় দিনে আমাদের উপর পাক বিমান বাহিনী আক্রমণ করে। এতে দুজন মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং ১ জন মুক্তিসেনা গুরুতরভাবে আহত হন।

 ১৫ই নভেম্বর এভাবে অনবরত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১ ব্যাটালিয়ন ইণ্ডিয়ান আর্মি ঢুকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে এবং তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ফলে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৫০জন ইণ্ডিয়ান আর্মির হাতে বন্দী হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হবার পর দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৪ কোম্পানীসহ আমার কোম্পানীকে ফেনী পৌঁছে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিতে আদেশ করা হয়।

 প্রথমে আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই এবং পরপর দশম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৪ কোম্পানীও পৌঁছে। ২৩শে নভেম্বর এ দিন ফেনী এয়ারপোর্টের প্রায় কছাকাছি পৌঁছে আমরা ডিফেন্স বসাই। ফলে এয়ারপোর্ট থেকে পাক বাহিনী সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

 ২৬শে নভেম্বর আমার কোম্পনী তুলে নিয়ে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের যোগদান করার নির্দেশ পাই। ২৮শে নভেম্বর আমি আমার কোম্পানী তুলে নিয়ে আখাউড়া রওনা হই। এবং ২৯শে নভেম্বর আখাউড়া পৌঁছি। আখাউড়া পৌঁছে দেখতে পাই আমার ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আখাউড়া অপারেশন করার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছে।

 ১লা ডিসেম্বর পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে রাজাপুর এবং আজমপুর গ্রামে অবস্থানকারী পাকসেনাদের উপর চরম আঘাত হানি। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচণ্ড মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানে শত্রু পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ২৫ জন খানসেনা আমাদের হাতে বন্দী হয়। এখানে আমদের লেঃ বদিউজ্জামান ও একজন নায়েক সুবেদারসহ কয়েকজন শহীদ হন। রাজাপুর এবং আজমপুর আমরা দখল করতে সক্ষম হই।

 ৬ই ডিসেম্বর আমরা ডেমরার অভিমুখে রওনা হই এবং ১২ই ডিসেম্বর ডেমরা পৌঁছি। ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করি।

 ১৬ই ডিসেম্বর ডেমরা থেকে রওনা হয়ে যখন বালুনদী অতিক্রম করি তখন বিকেল সাড়ে চারটা। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম পশু শক্তি বর্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা। আত্মসমর্পণের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। হাজার হাজার জনতা জয়োল্লাসে ফেটে পড়ে রাস্তায় রাস্তায় “জয় বাংলা” আর “জয় মুজিব” স্লোগান আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলে। আমরা সোজা ঢাকার অভিমুখে রওনা দেই। রাস্তায় একইভাবে জনসাধরণ আমাদের স্বাগত জানাতে থাকে এবং বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। রাত ১২টা সময় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি এবং সেখানে অবস্থান করি।

 ঐতিজহাসিক ঢাকা নগরীও তখন লোকে লোকারণ্যে। সারা রাত ধরে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আনন্দে আকাশে অসংখ্য ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যে সমস্ত বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপি আর, পুলিশ, মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও জনসাধারণ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন তাদের নাম বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে স্বর্ণক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে, এই কামনাই করি। নয় মাসের যুদ্ধে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাকিস্তান পদাতিক বাহিনীর চরম পরাজয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বাঙ্গালী সৈনিক, যুবক, তথা জনসাধারণ প্রকৃতপক্ষেই সৎ সাহসী, বীর সৈনিক ও রণকৌশল। এ দেশের আপামর জনসাধারণ একযোগে একবাক্যে সম্মিলিত হয়ে শত বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও মাতৃভূমিকে হানাদার বর্বর পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এ স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতাকে রক্ষা করাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

স্বাক্ষরঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মুর্শেদ খান

সাক্ষাৎকারঃ সিপাই আফতাব হোসেন[৩]

 ১৯৭১ সালের মে মাসেই আমরা ময়মনসিংহের বাজিতপুর থানা আক্রমণ করি। পাক দালালদের অনেক ঘরবাড়ি ও দালান খতম করি। বাঙ্গালী পুলিশরা পাকসেনাদের সহযোগিতা করতো। মুসা নামে এক কুখ্যাত দালাল পাকসোনাদের মেয়ে সরবরাহ করত এবং কারফিউ দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সবার বাড়িতে থানার বাঙ্গালী পুলিশদের নিয়ে লুটতরাজ চালাত। রাত ১১টায় আমরা থানাতে হামলা চালাই। পুলিশরা পালিয়ে যায়। মুসাসহ অনেক দালালকে হত্যা করা হয়। এখান থেকে ১৯টা রাইফেল উদ্ধার করি। ৭টি সিভিল গানসহ প্রচুর এম্যুনিশন উদ্ধার করি। আমাদের গেরিলা দলে লোক বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছত্রভঙ্গ অনেক ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র আমাদের সাথে যোগ দিতে থাকে।

 ১৯৭১ সালের মে মাসে ভৈরব থানা এলাকা থেকে আমরা একটা ৩ ইঞ্জি মর্টার, ২টা চীনা হালকা মেশিনগান এম্যুনিশনসহ হালকা মেশিনগানের এম্যুনিশন ভরা ৪৮টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করি। এক ডাকাত সর্দারের বাড়ি থেকে ঢাকার বেলাবো (রায়পুরা থানার) আবদুল হাজি সাহেব আমাকে খবর দেন যে, ঐ ডাকাতের বাড়িতে উপরোল্লিখ অস্ত্রশস্ত্র আছে।

 জুন মাসে আমরা কুমিল্লা জেলার নবীনগর থানার এক দালালের বাড়িতে হামলা চালাই। উক্ত কুখ্যাত দালাল (চেয়ারম্যন পেরা মিয়া) পাকসেনাদের মেয়ে সরবরাহ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের কাছে ধরিয়ে দিত। সে ঢাকার চরসিন্দুরের এক মুক্তিযোদ্ধাকে (ছাত্র) পাকসেনাদের কাছে ধরিয়ে দেয়। এবং পাকসেনারা ঐ ছাত্রকে হত্যা করে। কুখ্যাত দালাল পালিয়ে যায়। তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে বাড়িতে পাহারারত সবাইকে হত্যা করা হয়। (পেরা মিয়া বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় মুক্তি পায়)।

 জুলাই মাসে আমরা ঢাকা জেলার মনোহরদী থানা এলাকার রামপুর গ্রামে পাক বাহিনীর লঞ্চ ও গানবোটের উপর হামলা চালাই। এই আক্রমণে খান সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানীরা এখানে হেলিকপ্টারের সাহায্যে লাশ নিয়ে যায়। এরপর থেকে পাকসেনারা আর কোনো দিন লঞ্চ গানবোট নিয়ে আসে নাই।

 উক্ত জুলাই মাসে আমার ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার নদীর মধ্যে পাক দালালদের লঞ্চ ও বালির নৌকার উপর আক্রমণ চালাই। দালালরা হাজার হাজার মণ বালি নিয়ে পাক সেনাদের দোতলা তিনতলা বাঙ্কার পাকা করে দিত বালি সিমেণ্টের সাহায্যে। আক্রমণে নৌকা লঞ্চগুলো নদীতে ডুবে যায়। দালালদের খতম করা হয়।

 এদিকে মেজর শফিউল্লাহ (৩ নং সেক্টর কমাণ্ডার) ও ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান শত শত ছাত্রকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের অধীনে পাঠাতে থাকেন। তখন আমরা ময়মনসিংহের দক্ষিণাঞ্চলে। ঢাকা- ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকা মিলিয়ে গঠিত ৩ নং সেক্টরের অধীনে একটি সাবসেক্টর গঠন করি এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই।

সাক্ষাৎকারঃ মেজর দোস্ত মোহাম্মদ সিকদার[৪]

 আমাকে আলফা কোম্পানীতে পোস্টিং করা হলো। কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন মেজর নাসিম, যিনি এখন ব্রিগেড কমাণ্ডার। এখনো তিনিই আমার ব্রিগেড কমাণ্ডার তাঁর সাথে আমি গেলাম। আমি তাঁর কোম্পানীতে কোম্পনী অফিসার হিসাবে কাজ করতাম। একটা বড় রকমের অপারেশনের জন্য কোম্পানীগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আমি গিয়ে উপস্থিত হই। ব্রিগেডিয়ার নাসিম আমাকে নিয়ে কয়েক জায়গায় ঘরোঘুরি করেছেন। আমার সাথে তেমন কোন আলোচনা করেন নাই। তবে কয়েকটা মহড়া দেখেছি তার মধ্যে একটা আমার মনে পড়ে খুব ইনটেলিজেন্স মহড়া, যেটা ইণ্ডিয়ায় হয়েছিল। মানুষ কিভাবে চট করে ফক্স হোল তৈরী করে নিজেকে লুকিয়ে রেখে শত্রুপক্ষের সাথে লড়তে, এটা তারই মহড়া। তিনি বললেন, এটা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি তাড়াতাড়ি নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কেননা মাটিতে ট্রেঞ্চ করতে সাধারণত বেশ সময় লাগে কিন্তু ফক্স হোল পদ্ধিতি চট করে করা যায়। তাঁরা কয়েকটা সেকশন মিলে একটা প্লাটুন তৈরী করেছিলেন আমি সেটা বুঝতেই পারিনী। এটাতে নিজেকে আত্মরক্ষা করা যায়। আবার শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এসব দেখে আমি এতে যোগদান করি। আমাদের একটা টার্গেট ছিল, ঠিক সেই টার্গেটই আমরা আক্রমণ চালাই। টার্গেট ছিল আগরতলা উত্তর দিকে ধর্মঘর বলে একটা জায়গা ছিল, তারপর বামুটিয়া। এরপর ঠিক জায়গাগুলোর নাম মনে নেই, তবে বামুটিয়া ঐ সব এলাকার কাছাকাছি।

 প্রশ্নঃ ওখানে পাকিস্তানী স্ট্রেনথ কত ছিল?

 উত্তরঃ ওখানে শুধু নিয়মিত আর্মি ছিল না, মিক্সড ছিল- রাজাকার মিলে ছিল। সংখ্যা এক কোম্পানী। মাসটা ছিল অক্টোবরের দিকে। আমাদের প্ল্যানে ছিল যে সেখানে কিছু আর্টিলারী বোমবার্ডমেণ্ট পাব। সেকেণ্ড বেঙ্গলের আলফা কোম্পানী এবং ডেলটা কোম্পানী এই আপারেশনে অংশ নেয়। আলফা কোম্পানী কমাার ছিলেন মেজর নাসিম এবং ডেলটা কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল মুর্শেদ।

 আমরা এদিক থেকে এক কোম্পানী যাই এবং আরেক দিক থেকে ক্যাপ্টেন কোম্পানী নিয়ে এলে এক সাথে মিলিত হই। মাঝখানে থেকে ইনডিয়ান আর্মি ঢুকে এডভান্স করে। ইতিপূর্বে আর্টিলারী ফায়ার হয়। আমরা পিছছে থাকি। আমরা টার্গেট থেকে ১৫০০ গজ দূরে ছিলাম। মেজর নাসিমের পরামর্শে সেখানে যে টেলিফোন লাইন ছিল সেটা কেটে দেওয়া হয়। নিশ্চয় সেটা ঠিক করবার জন্য পাকিস্তানীরা আসবে। ঠিক তাই কয়েকজন পাকসেনা (এক সেকশন মত) রাইফেল নিয়ে এদিকে আসছিল কিন্তু হঠাৎ করেই আমাদের থেকে একজন আনকণ্ট্রোল হয়ে ফায়ার করে ফেলে। এটা প্রিম্যাচিউর টার্গেট হয়ে গিয়েছিল। আমরা ৬/৭ জন মারতে পেরেছিলাম আর কিছু আহত হয়েছিল, কেউ কেউ সরে পড়েছিল। সাথে সাথে বোমবার্ডমেণ্ট শুরু হয়ে গেছে। আমরা মারতে চাইনি জীবিত ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা বোমবার্ডমেণ্ট লিফট আপ হবার পরে আস্তে আস্তে ফর্সা হতে লাগলো। ফর্সা হবার পরে আমরা অর্ডার পেলাম আমাদের পুল আউট করতে হবে।

 প্রশ্নঃ আপনারা আর চার্জ করেননি?

 উত্তরঃ আমরা আর চার্জ করিনি। এ্যাটাক করিনি। আমার মনে হয় এ্যাটাকিংটা এবানডেণ্ট করে ফেললো। কেনা সাধারণ কেউ তো বলে না কোন কিছুতে হেরে গেলে। যেহেতু আমরা ছিলাম বাঙ্গালী ফোর্স আর তারা ছিলেন ইনডিয়ান ফোর্স, এটা একটা লজ্জার ব্যাপার। আমরা দেখেছি আমাদের পাশ দিয়ে তারা চলে এসেছে। তাতে বোঝা যায় তারা অবজকেটিভ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। আমরা বুঝতে পারলাম, এই অপারেশনে তারা কৃতকার্য হয়নি। তারা যখন চলে যাচ্ছিল আমাদের পাশ দিয়ে তখন বলছিল ভাই এটা তোমাদেরই দেশ। যত রকম ঝুঁকি নেয়ার তোমরা নাও, আমরা পারবো না- এই বলে চলে যাচ্ছিল। তারা যাবার পর আমরা পুল আউটের অর্ডার পেয়ে আমাদের পুরনো ছাউনি, যেখানে আমরা থাকতাম সেই পঞ্চবটিতে চলে গেলাম। এরপর আর কোন অপারেশনে আমি যাইনি। ব্যাটালিয়ন রেইজ করলো। আমি রিক্রুটমেণ্টে ব্রিগেডিয়ার নাসিমকে সাহায্য করতাম। ১১ বেঙ্গল রেইজ করলো অর্থাৎ এস ফোর্সকে কমপ্লিট করার জন্য। রেগুলার ব্রিগেড তৈরী হলো।

 প্রশ্নঃ আপনি কতোদিন রিক্রুটিং- এ কাজ করেছেন সেখানে?

 উত্তরঃ ঠিক দিন মনে পড়বে না, তাবে মূর্তিতে যোগদান করার আগ পর্যন্ত কাজ করেছি। সেখানে সেকেণ্ড ব্যাচ ট্রেনিং শুরু হয়।

সাক্ষাকারঃ মেজর শামসুল হুদা বাচ্চু[৫]

 ১৫ই-১৬ই অক্টোবর আমাকে আগরতলা নিয়ে আসা হয় 'সি' সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে। সে সময় সেখানে দুজন অফিসারকে পাই। তার মধ্যে একজন হচ্ছেন বজলুল রশীদ। তিনি পিএমএ-তে ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি পাকিস্তান থেকে এসেছেন। আগরতলা আসার পর আমাকে সি সেক্টরের কাছেই একটা কোম্পানী ছিল সেখানে পাঠানো হলো। সেখান থেকে বর্ডার মাইল দু'য়েক দূরে ছিল। এই কোম্পানীতে পুলিশ, বিডিআর সবাই ছিল। তাদের নিয়ে মাঝে মধ্যে বর্ডারে যেতাম। সামনেই এটকা ডিফেন্স ছিল। সেখানে থাকা অবস্থায়ই একবার মার্চ করে মাইল পাঁচেক ভিতরে ঢুকেছিলাম কিন্তু বেশী সুবিধা করতে পারিনী। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রেইড করা কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি। কারণ প্রস্তুতি তেমন ছিল এবং ট্রেনিং পাকা হয়নি। তখন সেই সময় ব্রিগেডিয়ার নাসিম ১১তম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট গড়ে তোলেন এবং আমাকে তাঁর রেজিমেণ্ট নিয়ে আসেন। এই বেঙ্গলে ট্রেগু লোক অনেক ছিল। মেজর নুরুদ্দিন, মেজর আবুল হোসেন এই বেঙ্গলে ছিলেন। নভেম্বরের শেষের দিকে ১১তম বেঙ্গল যখন পুরোপুরি গড়ে ওঠে তখন আমরা সেখান থেকে মার্চ করে বাংলাদেশের ভিতর প্রবেশ করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা। পুরো এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যসহ হেঁটে যখন আমরা ভৈরব পার হই তখন পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। সেখানে আহত হন মেজর নাসিম, চারজন ভারতীয় লোক মেজর শাফায়েত জামিল ও ভারতীয় একজন ক্যাপ্টেন। শত্রুদের সাথে জেনারেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি যুদ্ধ হয়েছিল। এ সময়টা হচ্ছে ডিসেম্বরের ৬ কি ৭ তারিখে। সেখানে যে মেজর নাসিম আহত হয়েছিলেন তার মূলে ছিল আমাদের একজন অফিসারের ভূল পরিকল্পনা। এরপর আমদের ব্যাটালিয়নকে টেক ওভার করেন মেজর মতিন। টেক-ওভার করার পর যখন আমরা আশুগঞ্জ যাই তখন পাকিস্তানীদের সাথে সংঘর্ষ হয়।

 পাকিস্তান আর্মিরা সকালবেলা আশুগঞ্জে যে ব্রীজটা ছিল সেটা উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ইণ্ডিয়ান আর্মি মনে করেছিল যে পাকিস্তানী আর আশুগঞ্জে নেই, নদীর ওপারে ভৈরবে চলে গেছে। তখন সেখানে ১০ম বিহার ব্যাটালিয়ন ছিল। তারা দেখতে একদম কালো ছিল। তাদের সাথে ছিল ২০তম রাজপুত। আশুগঞ্জে জায়গাটা এমন যে সেখানে ৩টা কি ৪টা তিনতলা দালান ছিল এবং সামনে এক মাইলের মত জায়গা ছিল একদম ফাঁকা। ভারতীয় আর্মির ধারণা ছিল যে, সেখানে পাকিস্তনী আর্মি নেই কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল হয়তো পাকিস্তানী আর্মি আছে। কথা ছিল ভারতীয়দের সাথে ১১তম বেঙ্গলের একটা কোম্পানী থাকবে কিন্তু পরে এসে বললো থাক তোমাদের যেতে হবে না। তবুও আমাকে আমার কোম্পানী নিয়ে শহর থেকে আধ মাইল পরে দূরে একটু উঁচু গ্রাম ছিল, সেখানে বসে থাকার জন্য আমার এডজুটেণ্ট লেঃ নাসির বললেন। তখন সেখানে আমার সাথে ছিল ১০ম বিহারের মেজর গাঙ্গুলী (কোম্পানী কমাণ্ডার)। আমার কোম্পানী নিয়ে আমি সেখানে বসে আছি, তখন দেখি ভারতীয় সৈন্যের দুটি ব্যাটালিয়ন মার্চ করে মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে ছিল ছোট চারটা ট্যাংক। ভারতীয়রা যখন সেই দালানগুলির মাঝমাঝি চলে এসেছিল তখন আমরা ৪/৫ মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না যে এই গোলাগুলির আওয়াজ কোথা থেকে হচ্ছে। তারপর দেখলাম যে ভারতীয় সৈন্যরা কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, কাউকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে, কারো শরীর দিয়ে রক্ত রেয়ে পড়ছে। ৫/১০ জন করে পিছনের দিকে আমরা যেখানে আছি সেই লাইনের দিকে সরে আসছে। সেখানে চারটা ছোট ট্যাংকের মধ্যে দুটো জ্বলে গিয়েছিল এবং দুটো ট্যাংক নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল ভারতীয়রা। তখন আমাকে ওয়ারলেসে বলা হলো যে তোমার কোম্পানী নিয়ে তুমি তাড়াতাড়ি পিছনে চলে এসো। আমরা যেখানে ছিলাম তার থেকে ২০০গজ পিছনে আরেকটা উঁচু জায়গা ছিল এবং তারপর আধ মাইলের মতো পরিস্কার জায়গা এবং তারপরই গ্রাম শুরু হয়ে গেছে। এই সময় দেখি যে পাকিস্তানী আর্মি সামনের ঐ জায়গা দিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তখন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের রেঞ্জের ভিতরে। তখন আমরা উইড্রো করে সামনের আসলাম। এর মধ্যে দৌড়াদৌড়া শুরু হয়ে গেছে। পিছনে ভারতীয় আর্মির যারা বেঁচে ছিল বা যারা চলতে পারে তারা সামনে চলে এসেছে। তখন এসে আমি জেনারেল শফিউল্লাহকে পেলাম। তিনি একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ভারতীয় আর্মি এতো বড় একটা ভুল করে ফেললো যা কল্পনা করা যায় না। আমরা দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যরাও আছে। এর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে এবং আশপাশ অনেক লোক পড়েও গেছে। তখন আমি শফিউল্লাহকে বললাম যে স্যার দৌড় দেন। আমি আর শফিউল্লাহ দৌড়ে ঐ দূরুত্বটা পার হই এবং যখন দেখলাম যে গোলাগুলি খুব বেশী শুরু হয়ে গেছে তখন আমরা শুয়ে পড়লাম। ২/১ মিনিট শুয়ে থাকার পর আবার উঠে দৌড়ে যেখানে থেকে গ্রাম শুরু হয়েছে সেখানে একটা পুল ছিল সেটা পার হয়ে গ্রামের সীমানার মধ্যে ঢুকে গেলাম। পরে আমরা শুনলাম আমরা প্রথমে যে জায়গায় ছিলাম পাকিস্তান আর্মিরা সেই পর্যন্ত এসছিল আর এগিয়ে যায়নি। তার পরদিন সকাল বেলা অর্ডার এলো তোমরা যাও। কারণ আশুগঞ্জে থেকে পাকিস্তানী আর্মিরা চলে গেছে। তারপর আমরা আশুগঞ্জ গেলাম। গিয়ে দেখি ওরা চলে গেছে এবং জিনিসপত্র সব বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানী আর্মিরা সন্ধ্যার পরপরই নদী পার হয়ে ওপারে চলে গিয়েছিল। যে সব ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল তাদের লাশ পাকিস্তানীরা আগেই সরিয়ে ফেলেছিল। তবে সেখানে গিয়ে আমি মেজর মুখার্জীর লাশটা দেখেছিলাম। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এর মধ্যে ভৈরবের দিক থেকে শেলিং শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও কিছু আর্টলারী চলে এসেছে। ইতিমধ্যে মুজিব ব্যাটারীও এসেছে, তারাও অপারেশন করছে। ভারতীয় বাহিনীও এসে গেছে। লেঃ কর্ণেল আজিজও তখন এখানে আমাদের সাথে ছিলেন, আরও অনেক অফিসার ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তানী আর্মি সারেণ্ডার করে সেদিন সরাদিন প্রচুর ফাঁকা গুলি ও ফুর্তি হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির যারা ভৈরবে, ছিল তারা ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সারেণ্ডার করেনি। ১৯শে কি ২০ শে ডিসেম্বর ভারতীয় জেনারেল গেলেন ভৈরব, তারপর তারা সারেপ্তার করে। তারপর দুই দিন সময় লাগে পাকিস্তানীদের সরিয়ে জায়গা খালি করতে।

মেজর এস, এ ভূঁইয়া প্রতিবেদন[৬]

॥ একটি এ্যামবুশ ও সুবেদার চান মিয়ার বীরত্ব ॥

 প্রায় সাড় তিন মাসের মত আমি বি-কোম্পানীর সাথে মনতলায় ছিলাম। ঐ সময়ের মধ্যে আমরা অনেক ছোট বড় অপারেশন করছি। সবগুলোর বিবরণ লেখা সম্ভব নয় বলে আমি মাত্র কয়েকটির কথা নীচে লিখলাম।

 ২৭শে জুন রাত্রে আমি বি-কোম্পানীকে নিয়ে বাংলাদেশের ভিতর যাই। দিনের বেলায় গিয়ে শত্রু সৈন্যরা কোথায় আছে, কিভাবে আছে, কেমন ভাবে অবস্থান করছে তাই দেখবার জন্য ভিতরে যাই। দেখতে পাই সিপাই থানার সামনে শত্রুর দুটো ছোট ঘাঁটি আছে এবং তারা সেখানে বিনা দ্বিধায় চলাফেরা করছে। তাদের সংখ্যা ৬০/৭০জন। সিদাই থানার পুলিশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে আমরা তাদের অবাধ চলেফেরা সম্বন্ধে নিশ্চিত হলাম। সেদিন রাত্রে সেনাদলকে দুটি ভাগে ভাগ করলাম। সুবেদার চান মিয়াকে আমি আমার একটি গ্রুপের ভার দিলাম এবং তার সহকারী হিসেবে দিলাম সুবেদার তৈয়বকে। আমি নিজে অন্য দলটা সঙ্গে নিলাম। আমার সাথে ছিলেন সুবেদার সফিউল্লাহ। রাত ৩টায় আমরা বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকলাম। দুশমনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দূরে ছিল না। সুবেদার চান মিঞা গেলেন বাম দিকের অবস্থানে, আমি গেলাম ডান দিকের অবস্থানে। ভোর ৪টার দিকে শত্রুর খুব কাছে গিয়ে আমরা লুকিয়ে ওঁৎ পেতে রইলাম। যে রাস্তা দিয়ে শত্রুসৈন্য দল বেঁধে টহল দিচ্ছিল সেই রাস্তার পাশেই আমরা ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চান মিয়ার দল বাড়ির আনাচে কানাচে এবং পাট ক্ষেতের ভিতরে পজিশন নিলেন। এলাকাটা ছিল সমতল এবং তার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে ছিল ধান ক্ষেত। আর সে ধান ক্ষেতের উচ্চতা ছিল এক ফুটের মতো। অতএব লক্ষ্যবস্তু একেবারে সুপষ্টভাবে আমদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল।

 আমরা যার যার স্থানে তো অস্ত্রশস্ত্রসহ পজিশন নিয়ে ছিলামই, উপরন্তু সিদাই থানার বাম দিক থেকে শত্রুর প্রতি তাক করে রেখেছিলাম একটি রিকয়েললেস রাইফেল। রাতের অন্ধকারেই আমরা এই কাজ শেষ করি।

 সকাল ৭টার দিকে শত্রুর প্রায় ৩০/৪০ জন সৈন্য নিয়ে আগের মতো সুবেদার চান মিয়ার অবস্থানের দিকে টহল দিতে বেরুল। আমরা আরও দেখতে পেলাম শত্রুবাহিনীর আর একটি দল শান্তি বাহিনীর কিছুসংখ্যক লোক নিয়ে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা কাছাকাছি পৌঁছামাত্র চান মিয়ার পুরো দলটাই তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করলো। তাঁর দলের হাতে ছিল ২ ইঞ্চি মর্টার আর ১৮টি বোমা। সবগুলোই তারা কাজে লাগাল। প্রায় ৩০মিনিট ধরে সংঘর্ষ হলো এবং চান মিয়াদের তীব্র গুলিবর্ষণে ভয়ার্ত হয়ে অনেকগুলো মৃত সৈনিককে পিছনে ফেলে পাক সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। শত্রু পক্ষের অন্য দলটি প্রতিশোধের স্পৃহায় সুবেদার চান মিয়ার দলকে আক্রমণ করতে চাইলো। তারা কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। শত্রুর ইচ্ছা ছিল উত্তর দিক থেকে এসে লেফট (বাম) ফ্ল্যাস্ক করে চান মিয়ার দলকে পিছন থেকে আক্রমণ করা। শত্রুর অগ্রগমনের পথে আমি আমার দল নিয়ে বিপুল আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। যেই মাত্র তারা আমাদের কাছে এলো অমনি আমরা হালাকা মেশিন গান ও রাইফেলের সাহায্য তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গেও একটা ২ ইঞ্চি মর্টার ছিল। সেটারও আমরা পুরোদস্তুর সদ্ব্যবহার করলাম। ঐ দিক রিকয়েললেস রাইফেলের অবস্থান থেকে ৪টি রিকয়েললেস রাইফেলের গোলা বর্ষিত হলো শত্রুর বাঙ্কারের উপর। শত্রুর দুটি বাঙ্কার সেই গোলার আঘাতে চুরমার হয়ে গেল। এবারও শত্রুরা আমাদের ওঁৎ পেতে আক্রমণ করার ফাঁদে পড়ল। দিশেহারা হয়ে তারা আমাদের অবস্থানের উপর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করল। এখানেও তাদেরকে নিহত সঙ্গীদের লাশ ফেলে পিছনে হটতে বাধ্য করা হলো। আমরা শত্রু সৈন্যের কামানের গোলাবর্ষণকে অত্যন্ত ভয় করতাম। করণ তাদের নিশানা ছিল অদ্ভুত রকমের নির্ভুল। এখানেও সেই নির্ভুল নিশানার পরিচয় পেয়ে আমাদের ঐ অবস্থানে থাকা নিরাপদ মনে করলাম না। সুতরাং মর্টার থেকে শত্রুদের দিকে গোলাবর্ষণ করতে করতে তারই আড়ালে আমরা পিছনে সরে এলাম। কামানের গোলা তখন এমন অবিশ্যাম ধারায় এসে পড়ছিল যে, পিছনে হটে আসা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর ছিল না। ঐ সময় আমাদের কোন পরিখা ছিল না। আমার কোম্পানীতে এই প্রথমবারের মতো সেদিন রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহার করি। তাতে চমৎকার ফল হয়। আমরা দুটো বাঙ্কার সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই।

 ঐ দিন আমার দলের একটি মাত্র ছেলের শরীরে গোলার টুকরো এসে আঘাত করে। অন্যান্যরা খোদার একান্ত রহমতে সক্ষম অবস্থায় ফিরে আসে। আমার রানার ও আমি এক স্থানেই ছিলাম। কামানের গোলাগুলো যখন ভীষণ শব্দ করে আমাদের আশপাশে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল মৃত্য বুঝি আমাদের ঘাড়ের উপর খঞ্জর ধরে বসে আছে। আমার কাছ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে একটি কামানের গোলা সশব্দে ফেটে পড়লো। লক্ষ্য করে দেখলাম আমাদের করো মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। আমরা তখন মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আর মুখে উচ্চারণ করতে থাকলামঃ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানারা ইন্নি কুনতু মিনাজজোয়লেমিন।  পাকিস্তানী রেডিও সেদিন প্রচার করা হয়েছিল যে, আমাদের মৃত্যের সংখ্যা ২০ জন। কিন্তু প্রকৃত খবর পাই ঘটনার ৫দিন পরে। শত্রুপক্ষে নিহত হয় ১৭ জন আর আহত হয় ১৯ জন। গোপন অবস্থান থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করলে দিশেহারা শত্রু সৈন্যদের আত্মরক্ষার প্রায় উপায় থাকে না এবং তখন তাদের এমনি সীমাহীন ক্ষতি মেনে নিতে হয়। এর সাধারণ কারণ এক পক্ষের সতর্কতামূলক পূর্বপ্রস্তুতি, অন্য পক্ষের অজানা বিপদ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং অপ্রস্তুতি। আর শত্রুপক্ষ সমরশক্তিতে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেন আকস্মিকভাবে এমনি ওঁৎ পাতা ফাঁদে পড়লে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় এবং সাধারণ মনোবল হারিয়ে ফেলে। সে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় সেই মুহূর্তে অংশ নিতে আর সাহস পায় না। ফলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোটাই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে।

 যাহোক, অপূর্ব সাহস দেখিয়েছিলেন সেদিন সুবেদার চান মিয়া। ঐ দিনের যুদ্ধের পর চান মিয়ার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছিল। পরে কর্তৃপক্ষ কোন এক কারণে আমার দল থেকে তাকে বদলী করতে চাইলেও আমি তাতে রাজি হইনি।

॥ আর একটি রেইড ॥

 আর একটি ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করছি। দিনটি ছিল ৮ই জুলাই। ২৭শে জুন যে স্থানটিতে আমরা এ্যামবুশ করেছিলাম, পাক সৈন্যরা সেখানে নতুন করে কতকগুলো বাঙ্কার করেছিল। নতুন করে তারা আরও অনেক সৈন্য এনে তাদের অবস্থানকে মজুবত করে তুলেছিল। আমরা প্ল্যান করলাম রেইড করে শত্রুর নবনির্মিত বাঙ্কারগুলি উড়িয়ে দেবো। ২৭ শে জুন তারিখে আমাদের হাতে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা সীমান্ত এলাকার দিকে আর আসতো না অথবা অবস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও নড়াচড়া করা তারা অর্থহীন বলে মনে করতে। ২৭শে জুন এবং ৮ জুলাই তারিখে মধ্যে আমরা বার কয়েক শত্রুঘাঁটির কাছে ওঁৎ পেতে ছিলাম কিন্তু পাকসেনারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে না বেরুনোর জন্য আমরা বিশেষ সুবিধা করতে পারিনী। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থানের উপর আমরা কয়েকবার ৩ইঞ্চি মর্টার দিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিলাম।

 ৮ই জুলাই তারিখে আমরা সমস্ত কোম্পানী নিয়ে দুই দিক থেকে শত্রুর এলাকায় ঢুকলাম। ভোর চারটার দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। শত্রুর অবস্থান ভারত সীমান্ত থেকে বেশি দূর ছিল না। সিদাই থানা থেকে তাদের অবস্থানগুলো আমাদের নজরে পড়তো। আমরা শত্রুকে মাঝখানে রেখে দুই পাশ থেকে ঢুকলাম। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা রিকয়েললেস রাইফেল ও মর্টার শত্রুর দিকে তাক করে রেখেছিলাম। আগে থেকেই সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম যাতে একই সময়ে রিকয়েললেস রাইফেল, মর্টার রাইফেল সব কিছুর সাহায্যে আমাদের সৈন্যরা একযোগে শত্রুদের উপর আঘাত হানতে পারে। ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় শত্রুর অবস্থানের উপর আমরা আতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলাম। রিকয়েললেস রাইফেলের গোলার আঘাতে শত্রুদের দুটো বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়া হলো। সবচেয়ে ভালো কাজ করলো মর্টারগুলো। আমরা পনেরো মিনিট গোলাগুলি বর্ষণ করার পর পাক সেনারা আমাদের উপর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে দিল। ঐ এলাকার শত্রুর প্রতি সম্ভাব্য আক্রমণের স্থানগুলো তাদের কামানের লক্ষ্য কেন্দ্র হিসেবে পূর্বনির্দিষ্ট ছিল। জ্যামিতিক নিয়মমাফিক তাদের কয়েকটা গোলা আমাদের অবস্থানের উপর এসে পড়ে। বিপদ বুঝে ঐখান থেকে আমরা আমাদের বাহিনী সরিয়ে নিয়ে আসি। ঐ আক্রমণে পাকবাহিনীর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় এক সপ্তাহ পরে বেসামরিক লোক মরফত আমরা সে খরব পাই। পাক সেনাদের ৬ জন সৈন্য মৃত্যের তালিকা পূর্ণ করেছিল।

॥ ধর্মঘরে সুবেদার তৈয়বের কৃতিত্ব ॥

 আমার সাবসেক্টরের মধ্যে ধর্মঘরে এসে অধিক পরিমাণ পাকিস্তানী সৈন্য জমায়েত হয়। ধর্মঘর ছিল সাবেক ইস্ট পাকিস্তানী রাইফেল বাহিনীর বিওপি অর্থাৎ বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে আসার পর থেকে আমি সেখানে কোন দিন অপারেশন করিনি। তারপর ঐ শত্রুঘাঁটির উপর মনোযোগ দিলাম। আমি নিজে প্রায় ৫০জন সৈন্য নিয়ে দু' দু' বার ঐ এলাকায় গোপনে আতর্কিত আক্রমণ করার জন্য ফাঁদ পেতেছিলাম, কিন্তু শত্রুরা একবারও তার কাছে ভেড়েনি। তাই দূর থেকে কিছু করা যায় কিনা তারই ফন্দীফিকির আঁটলাম।

 ঐ এলাকায় কয়েকবার মর্টারের সাহায্য আমরা গোলাবর্ষণ করি। আমাদের সঙ্গে ছিল সুবেদার তৈয়ব। মর্টারের গোলাবর্ষণে সুবেদার তৈয়ব একজন দক্ষ ওস্তাদ। যতবারই তিনি শত্রু ঘাঁটিতে মর্টারের সাহায্য গোলাবর্ষণ করেছেন ততবারই শত্রুর কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে। একবার আমাদের কয়েকটি মর্টারের গোলা ধর্মঘর দীঘিতে পড়ায় দীঘির বহু মাছ মরে গিয়েছিল। সারা ধর্মঘরের লোক কয়েকদিন ধরে সেই মাছ খেয়েছিলেন।

 অন্য আর একদিন আমরা দুই দিক থেকে ৪টি মর্টার দিয়ে শত্রু সৈন্যের ধর্মঘর পজিশনের উপর গোলাবর্ষণ করি। সেদিন মেজর মতিনের কোম্পানী থেকে ২টি মর্টার ধার করে এনেছিলাম। আমরা প্রায় ৬০টি মর্টারের গোলা ব্যবহার করেছিলাম। আমাদের গোলাবর্ষণ ছিল অত্যন্ত নির্ভুল। কয়েকদিন পরে আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের গোলা সঠিক জায়গায় পড়ায় পাঞ্জাবীরা ঐ জায়গা ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

 মতিন সাহেবের কোম্পানীতে নায়েক আজিজ নামে একজন যুবক ছিল। মর্টারের গোলাবর্ষণে যে বেশ সাফল্য অর্জন করেছিল। তার মর্টার ফায়ার সম্বন্ধে কোম্পানীতে বেশ সুনাম ছিল।

 এই এলাকাতেও রাজাকারের সংখ্যা ছিল খুব বেশী। ঐ রাজাকারদের চোখে ধুলো দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তারা কেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করতো না তা বুঝতে পারিনী। সম্ভবত ঐ এলাকার মত রাজাকার বাংলাদেশের কোথাও ছিল না। তারা পাঞ্জাবী সৈন্যদের পথ দেখিয়ে ভারতের সীমানার কাছে এসে আমাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাঞ্জবীদের সহযোগিতা করতে শুরু করলো। তাদের এই ক্রিয়াকলাপে আমরা গভীর ভাবে ব্যথিত হতাম।

 যাহোক, বিজয়নগর এলাকাতেও আমরা কয়েকটি গোপন আতর্কিত হামলা চালাই। কিন্তু তাতেও আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারিনী। মাত্র একদিন এ্যামবুশ করে কয়েকজন পাঞ্জাবীকে যমদ্বারে পাঠিয়ে দিই।

॥ বীর মুজাহিদ দুলা ॥

 এ প্রসঙ্গে কয়েকজন মুজহিদের নাম করা যায় যাদের আমি তেলিয়াপাড়াতে দেখেছি। এদের মধ্যে মনে রাখার মতো দুটি নাম দুলা এবং আহাদ। দুলার বয়স ছিল ২৬ বছর। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার শালদা নদীর কছে। সে মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের কোম্পানীতে মেজর মতিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সমগ্র মুক্তিবাহিনীতে দুলার মতো সাহসী যুবক আর কজন ছিল আমার জানা নেই। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে সে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার তুলনা হয় না। বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণের মধ্যেও এই অকুতোভয় যুবক লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেনি কিংবা রণক্ষেত্র ছেড়ে দূরে সরে যায়নি, আপন লোকদেরকেও সে গোলাবারুদ বিতরণ করেছিল।

 ২১শে জুন আমি যখন শত্রুর ত্রিমুখী প্রচণ্ড আক্রমণের দারুন মনতলা থেকে সরে আসতে বাধ্য হই সেদিন দুলা কলকলিয়ার লড়াইয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তার কিছুটা পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

 কলকলিয়া ছিল ক্যাপ্টেন মোর্শেদের অধীনে এবং দুলা সেই ফ্রণ্টেই লড়ছিল। ২১শে জুন রাতে শত্রু বাহিনী যখন আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় সেই একই সময়ে কলকলিয়াতেও তারা আক্রমণ চালায়। মোর্শেদের সৈন্যরা শত্রুদের সাথে সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা বহুগুণ বেশী থাকায় মোর্শেদের দল সেখান থেকে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে সময় দুলা মিয়ার হাতে ছিল একটা হালকা মেশিন গান সে তার হালকা মেশিন গান অনবরত গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল এবং শত্রুর অগ্রগতিকে সারারাত ব্যাহত করে রেখেছিল। নিঃশঙ্কচিত্তে অপারবিক্রমে সে এক ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। অবস্থা প্রতিকূল দেখে যখন তার সংগীরা আত্মরক্ষা করতে পিছু হটছিল তখন দুলা সেই পশ্চাদপসরণে অংশগ্রহণ না করে নির্ভয়ে তার হালকা মেশিন গান থেকে অবিরাম গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। তারই অসীম সাহসিকতা ও গুলি ছোড়ার ফলে দলের অন্যান্যরা পিছু হটার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু দুলার বড়ই দুর্ভাগ্য, সে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে এক মহা বিপদে আটকে পড়ে। শত্রুপক্ষের মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি এসে দুলাকে বিদ্ধ করে। দুলার পক্ষে একমাত্র দুলার মেশিনগানই সক্রিয় ছিল এবং শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতাকে তারই মেশিনগানটি কিছুটা বাধা দিচ্ছিল। ফলে শত্রুর একমাত্র লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিল দুলা। অবশেষে শত্রুরা দুলাকে আহত করতে সক্ষম হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু নিদারুণ আহত অবস্থায় দুলা সংজ্ঞা হারায়নি এবং শেষ কর্তব্য স্থির করে সে তার হালকা মেশিনগান থেকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুকে বাধা দিয়ে যাবে বলে স্থির করল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে জান দেবে কিন্তু জীবিত অবস্থায় তার শরীরকে শত্রুহস্তে কলুষিত হতে দেবে না।

 আমি যখন মনতলা থেকে সরে এসে ভারতের সিদাই থানায় (আগরতলার উত্তরে) তখন লে. কর্নেল শফিউল্লাহ আমার এখানে উস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর তিনি আমাকে মোর্শেদের অবস্থানের কথা জানালেন এবং তারাতাড়ি কলকলিয়া চলে যেতে আমাকে নির্দেশ দিলেন। তিনি আরো বললেন, “মোর্শেদের সৈন্যরা দারুণ বিপদে আছে। তারা সবাই শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের বিপদমুক্ত করতে সাহায্য কর।”

 এই কথা বলে তিনি কলকলিয়া চলে গেলেন এবং তাঁর পিছু পিছু আমিও কলকলিয়া পৌঁছুলাম। আমরা যাওয়ার পর দেখতে পেলাম আল্লাহর মেহেরবানীতে ক্যাপ্টেন মোর্শেদসহ তার কোম্পানীর সবাই নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে। তাদের সবাইকে দেখে আমরা আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করলাম।

 সবাই এল কিন্তু তখনো পর্যন্ত দুলা এলো না। তখন বেলা ১১টা খবর এলো দুলার পেটে এবং ডান পায়ে কয়েকটি গুলি লেগেছে। সে কাদা পানির মধ্যে অসহায় পড়ে আছে। ছোট্ট একটা সৈন্যবাহিনী গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে না পেরে ফিরে এসেছে। শত্রু তখন মেশিনগান বসিয়ে পজিশন নিয়ে আছে এবং কাউকে নড়তে দেখলেই গুলি ছুড়ছে। শত্রুমেশিনগান বাসিয়েছিল ছোট্ট একটি টিলার উপর।

 আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাছ থেকে দূরবীন নিয়ে দেখলাম শত্রুর কিছু সৈন্য পজিশন নিয়ে আছে এবং অন্যান্যরা পরিখা খনন করছে। আমরা সবাই চিন্তা করছি দুলাকে কিভাবে শত্রুদের ঐ বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করব। কোন একটা ফন্দি উদ্ভাবনে আমরা যখন চিন্তিত তখনই একটি ছেলে দৌড়ে এসে খবর দিল যে দুলাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। আহত দুলা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সম্পূর্ণ নিস্তেজ এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলে শত্রুরা তাকে মৃত মনে করেছিল এবং তার দিকে আর গুলি ছোঁড়া প্রয়োজন নেই মনে করে তারাও গুলি ছোড়া বন্ধ করেছিল। এই রকম একটা সুযোগ পেয়ে আমাদের দুই সাহসী ছেলে সন্তর্পণে নালার ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে দুলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।

 দুলাকে যখন আমাদের সামনে আনা হলো তখনকার দৃশ্য এত করুণ এবং বেদনাদায়ক যে তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মুহূর্ষ দুলা বাম হাত দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ পেট চেপে ধরে আছে। কেননা ক্ষতস্থান থেকে তার নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম করছিল। ডান পায়ে গুলি লেগে ছিন্নভিন্ন মাংসগুলি কোনক্রমে পায়ের হাড়ের সংগে লেগেছিল। আর তার সমস্ত শরীর রক্তরঞ্জিত।

 একটা গুলিবিদ্ধ বাঘের মত ছটফট করছিল। তখনও সে বাকশক্তি হারায়নি। আমাদের চোখের দিকে চোখ রেখে সে বলল, স্যার, আমি আর বাঁচব না, এক্ষুনি মারা যাব। আমার আফসোস রয়ে গেল স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমি মরতে পারলাম না। স্বাধীন বাংলা দেখা আমার ভাগ্যে হয়ে উঠল না। স্যার আমাকে কথা দিন যেভাবেই হোক স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমাকে করব দেবেন। আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তাই আমার লাশ বাংলাদেশের মাটিতে করব দেবেন।

 সে আরো বললো, স্যার গুলির আঘাতে আমার পেটের নাড়িভূড়ি বের হয়ে গেছে। আমার বাঁচার কোনই সুযোগ নেই।

 মুমুর্ষ দুলার করুণ কণ্ঠ শুনে সেদিন আমরা সাবই গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। সমস্ত হৃদয় আমাদের বিষাদে ভরে গিয়েছিল। আমরা আবেগ সংযত কণ্ঠে তাকে যতই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্ঠা করি সে তাতে শান্ত হয় না, সে তার অন্তিম মুহূর্তের আভাস পেয়ে শেষ মনের কথাটি আমাদের জানিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে বলতে থাকে, স্যার পাঞ্জাবী দস্যুরা যখন আমাদের বাঙ্গালীদের নির্মমভাবে, নির্বিচারে হত্যা শুরু করে তখন আমার ৮ বছরের মেয়েটি আমাকে কি বলেছিল জানেন? বলেছিল, আব্বা তুমিও মুক্তি ফৌজে যোগ দাও, পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, দেশকে স্বাধীন কর। আব্বা তুমি বাড়ি থেকে কি করবে? যদি দেশ স্বাধীন না হয় আমাদের অবস্থা কি হবে? তারা ত যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে।

 আমার হাত ধরে দুলা বলল, “স্যার আপনার বাড়ি কুমিল্লা, আপনি নিশ্চয় শালদা নদী চেনেন। সেখানে আমার বাড়ি। আমার এলাকার সবাই আমাকে চেনে। দয়া করে আমার মেয়েকে এবং সেই এলাকার কাউকে আমার মৃত্যুর খবরটা দেবেন না। আমার মৃত্যুর খবর পেলে আমার মেয়েটি বাঁচবে না। সে আমার জান। দয়া করে তার কাছে, স্যার আমার মৃত্যুর খবরটা গোপন রাখবেন। তবে আমার একটা দাবী, আমার হতভাগী মেয়েটিকে আপনি দেখবেন। স্যার আমার এই একটি কথা ভুলে যাবেন না।” কথা বলার মাঝে মাঝে একটা কথা সে ঘুরেফিরে বারবার বলছিল, “জয় বাংলা দেখে যেতে পারলাম না।”

 দুলার এই মুমূর্ষ অবস্থায় এ্যাম্বুলেন্স আসতে কিছুটা দেরী হবে মনে করে লে. কর্নেল শফিউল্লাহ তাকে নিজের জীপে করে আগরতলা পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমাদের মুক্তিফৌজের ডাক্তার আবুল হোসেনও দুলার সাথে হাসপাতালে গেলেন যাতে দুলা তার মনের ভরসা না হারায়। হাসপাতালে যাওয়ার পর দুলার অপারেশন করা হয় এবং যখন ডাক্তার জানালেন যে দুলার সঙ্কটাবস্থা কেটে গেছে তখন লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ হাসপাতাল ত্যাগ করেন।

 সেদিন দুলার সাথে আরো কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদেরকেও পাঠানো হলো।

 দুলার অবস্থা দেখে সেদিন আমার মত অনেকেই ধারণা করেছিল দুলা আর বাঁচবে না। কিন্তু আল্লার অসীম ক্ষমতা আমাদের মত ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে নিরুপণ করা অত্যন্ত কঠিন। তাঁরই অশেষ কৃপায় এবং অত্যন্ত করুণায় দুলা দেড় মাস পর আরোগ্য লাভ করল এবং পুনরায় ক্যাপ্টেন মোর্শেদের কোম্পানীতে যোগদান করল। পরবর্তীকালে অসীম বীরত্বের সংগে দুলা অনেক রণক্ষেত্রে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বাঙালীর বীর্যবত্তার ইতিহাস সমুজ্জ্বল করে তুলেছে।

 এবার বলছি আহাদের কথা। আহাদের বয়স মাত্র ১৫বছর। অতুলনীয় সাহসী ছিল এই বীর মুজাহিদ কিশোর। মুজাহিদ হিসেবে তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে তার বীরত্ব প্রদর্শণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল ঘটনা। দুলা ও আহাদের বীরত্বের সম্মানস্বরুপ লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল শফিউল্লাহ তাদেরকে ২৫০০ টাকা করে পুরস্কার প্রদান করেন।

 এর পড়ে আসে পুলিশ প্রসঙ্গ। আমার সঙ্গে যে ৫জন পুলিশ ছিলেন তারা হলেন মিজান, সুরুয মিয়া, খোরশেদ মিয়া, তাহের এবং কানু মিয়া। আমার কোম্পানীকে এরা মর্টার ছুড়তেন। মাত্র সামান্য কয়েকদিনের শিক্ষায় এরা মর্টার চালনায় প্রায় পেশাদার সৈনিকের মত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ৫জন পুলিশ সৈনিকের দান সামান্য নয়। অসীম বীরত্বের সঙ্গে এঁরা শত্রুসৈনিকের সাথে বারবার লড়াই করেছেন।  মেজর মতিনের কোম্পানীটি ছিল পুরোপুরি প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের বাহিনী দ্বারা সংগঠিত। আমি এবং মেজর মতিন যখন তেলিয়াড়ায় লড়াই করেছি তখন কি রকম নিস্কম্প হৃদয়ে ঐ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের জোয়ানরা লড়াই করেছে। মেজর মতিনের ই-পি-আর কোম্পানী পরবর্তীকালেও বিভিন্ন ফ্রণ্টে খুব সাহসের সঙ্গে লড়েছিল। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের প্রশংসা না করে আমি পারি না।

॥ চুড়ান্ত লড়াই ও আখাউড়ার যুদ্ধ ॥

 নভেম্বরের ২০ তারিখের পরে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল। যশোরের কাছে পাকিস্তানের স্যাবর জেটগুলো ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করায় আকাশযুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান আক্রমণে ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। এতে যুদ্ধের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে এ সময় যশোরের চৌগাছা পতন হয়। এবং তারা যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যের সঙ্গে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।

 নভেম্বরের এই সময়টাতে আমরা আখাউড়ার শত্রুসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। শত্রুর বিরুদ্ধে এবার আমরা পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করি। আমাদের আক্রমণও একই রকম তীব্র এবং প্রচণ্ড। এ সময় ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহর অধীনে ছিল পুরো দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য। এই দুই ব্যাটালিয়নই ছিল যাবতীয় সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত। এ-ছাড়াও ছিল কয়েকটা কোম্পানী যাকে আমরা সেক্টর ট্রুপস বলতাম।

 কর্নেল শফিউল্লাহ ‘এস’ ফোর্সের ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার মেজর মঈন এবং ১১নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডিং অফিসার মেজর নাসিমকে এই মর্মে নির্দেশ দিলেন যে মেজর মঈনের ব্যাটালিয়ন আখাউড়ার দিকে আক্রমণাত্মক অভিযান চালাবে এবং তাদের সাথে থাকবে সেক্টর ট্রপস, আর মেজর নাসিমের ব্যাটালিয়ন (১১ নং বেঙ্গল রেজিমেণ্ট) আগরতলা উত্তর দিকে ধর্মঘরের ওখানে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেবে যাতে করে সিলেট থেকে মনতলা হয়ে পাকবাহিনী পেছন থেকে আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করতে না পারে। লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ধর্মঘরের সামনে রেখে মোহনপুর-আগরতলা রোডে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ সময় আমি একটি কোম্পানীর নেতৃত্বের ভার নেই। শত্রু যাতে মোহনপুর-আগরতলা রোড ধরে অগ্রসর হতে না পারে সে উদ্দেশ্যই আমরা আখাউড়া যুদ্ধের আগেই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সে সময় আমি যে কাম্পানীর পরিচালনার নেতৃত্ব নিয়েছিলাম সেটি বি-কোম্পানী।

 ওদিক তখন আখাউড়ায় কি ঘটেছিল তার কিছুটা বিবরণ, আমি যা সংগ্রহ করতে পেরেছি, দেওয়া যাক। ২৭শে নভেম্বর কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর মঈনকে মেরাসানী, নিরানসানী, সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশনে, সিঙ্গারবিল ঘাঁটি, রাজাপুর, আজমপুর ইত্যাদি এলাকা দখল করার নির্দেশ দেন। উল্লেখযোগ্য যে, এই সব এলাকা আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের কাছাকাছি। কর্ণেল শফিউল্লাহ মেজর মঈনকে ৩০শে নভেম্বর এবং ১লা ডিসেম্বর তারিখ রাতে এই সব এলাকায় আক্রমণ চালাবার আদেশ দিয়েছিলেন।

 মেজর মঈন দ্বি-ধারা আক্রমণ চালালেন। প্রথম আঘাত হানলেন নভেম্বর-ডিসেম্বর ৩০/১ তারিখ রাত ১টার সময়। প্রথম পর্যায়েই দখল করলেন সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশন ও সিঙ্গারবিল ঘাঁটি। শুনেছি, সে রাতে লড়াই চলেছিল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত।

 এই অভিযান আমাদের পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রায় এক ব্যাটালিয়ন। শত্রুপক্ষের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী। এই যুদ্ধে শত্রুসেনারা আর্টিলারী, মর্টার, মেশিনগান ইত্যাদি ছোটবড় সব অস্ত্রশস্ত্রই ব্যবহার করে। আমাদের পক্ষেও সেদিনকার লড়াইয়ে আর্টিলারী এবং মর্টারের সাপোর্ট ছিল। সেক্টর ট্রুপসের কাছেও ছিল মেশিনগান।  এখানে উল্লেখযোগ্য যে, লড়াইয়ের সে রাতগুলো ছিল খুবই অন্ধকার এবং ডিসেম্বর শীত-রাত্রির কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কিন্তু এই অন্ধকার ও কুয়াশার বাধা আমাদের জওয়ানদের পারেনি বিন্দুমাত্র হতোদ্যম করতে। একটার পর একটা স্থান দখলে আসাতে তারা ক্রমেই মানসিক দিক থেকে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং নব উন্মাদনায় দ্বিগুন শক্তিতে শত্রুদের আগাত হেনে পর্যুদস্ত করছিল। আখাউড়ার এক যুদ্ধে হতোদ্যম পাকিস্তানী সেনারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় এবং তাদের প্রচুর লোকসান স্বীকার করতে হয়। একজন শত্রুসেনা জীবিত অবস্থায় বন্দী হয় এবং ২০ জন হয় নিহত। এছাড়া মুক্তিফৌজের হস্তগত হয় হানাদার প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, রেশন, পোশাক-পরিচ্ছদ, ডিফেন্স স্টোর (প্রতিরক্ষা সামান্য)। আমাদের পক্ষ থেকে পাকবাহিনীর হাতে এই যুদ্ধে ইয়াসিন খাঁ নামে মুক্তিফৌজের একজন সিপাহী শহীদ হয়। তাকে সমাহিত করা হয় সিঙ্গারবিলে। তাছাড়া এই লড়াইয়ে মুক্তিফৌজের সিপাহী আবু জাফর, সিপাহী হুমায়ন, সিপাহী আবদুল লতিফ, হাবিলদার আকতার হোসেন, হাবিলদার মুফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, হাবিলদার নবীউল্লা এবং অপর একজন আহত হয়। পর্যুদস্ত শত্রুবাহিনী সাময়িকভাবে পিছু হটলেও ২রা ডিসেম্বরের সকালে আমাদের বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং সারাদিন ধরে খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে আমাদের বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আর্টিলারীর সহায়তায় মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে এই এলাকা শত্রুবাহিনী পুনর্দখল করে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর আমাদের বাহিনী সিঙ্গারবিলে গিয়ে জমায়েত হয়। এই যুদ্ধে শত্রবাহিনীরও অসম্ভব ক্ষতি সাধিত হয়। মুক্তিফৌজের নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী শত্রুর হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। অন্যান্য যারা আহত হন তারা হলেন সিপাহী 'আবদুল আউয়াল, হাবিলদার মাজু মিয়া, নায়েক নাসিরুজ্জামান, নায়েক আবদুস সালাম, সিপাহী মিজানুর রহমান।

 ৩রা ডিসেম্বর আমাদের বাহিনী নিজেদেরকে পুনর্গঠিত করে পাক বাহিনীর উপর পুনরায় আক্রমন চালায় এবং আজমপুর স্টেশন ও তার এক হাজার গজ অগ্রবর্তী স্থান দখল করে। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষের এগারজন সৈন্য নিহত হয়। আমদের পক্ষে দু'জন সিপাহী ও একজন নায়েক সুবেদার শহীদ হন। আমাদের বাহিনীর যখন যুদ্ধে লিপ্ত এমনি সময়ে আমরা খবর পেলাম পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে। এবার আর যুদ্ধ কেবল বাংলাদেশ বাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত ভারত-বাংলাদেশ বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ডিসেম্বরের ৩/৪ তারিখ রাতে আমাদের বাহিনী পুনর্দখলকৃত এলাকাকে সুরক্ষিত করল। বলা বহুল্য, মুক্তিফৌজের অবিরাম আঘাতের পর আঘাত, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা মুক্তিবাহিনীর চাতুর্যপূর্ণ আতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন বেসামাল হয়ে পড়েছিল। এবার তারা সমস্ত দোষ ভারতের উপর চাপিয়ে ভরত আক্রমণ করে বসল।

 ৩রা ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে সেদিন অপরাহ্নে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ঐ দিন রাত্রি দ্বিপ্রহরে তিনিও ভারতের জওয়ানদের পাকিস্তানী হামলা প্রতিহত করার জন্য হুকুম দেন।

 অতএব মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হল ভারতীয় সোনাবাহিনীর হাত। সম্মিলিত বাহিনী ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, প্রচণ্ড গতিতে আক্রমণ করল অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে। বাংলাদেশের সীমানার চতুর্দিক দিয়ে যৌথ কমাণ্ডের অধীনস্থ সৈন্যদল ঢুকে পড়ল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

 এদিকে সামরিক সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সৈন্য মিত্রবাহিনীর নাম নিয়ে আখাউড়া যুদ্ধে নেমে পড়ে। আক্রমণ চালানো হয়েছিল অতি প্রত্যূষে। উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় আমাদের বাহিনীর পক্ষে খুব বেশি আর্টিলারী সাপোর্ট (কমানের সহায়তা) দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল মর্টারের প্রচুর সহায়তা। এই আক্রমণ শুরু করার আগে মেজর মতিনের নেতৃত্বে সেক্টর ট্রুপসের দুই কোম্পানী দিয়ে পাশ থেকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মেজর মতিনের ই-পি-আর কোম্পানী মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও নিজের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র নড়েনি। আমাদের সেক্টরে ৪ঠা ডিসেম্বর যুদ্ধে মুক্তিফৌজের যে বীর সৈন্যরা শাহাদত বরণ করেন তাঁরা হচ্ছেন- লেঃ বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমিন, সিপাহী সিদ্দিকুর রহমান। যাঁরা আহত হন তাঁরা হচ্ছেন-সুবেদার চান মিয়া, হাবিলদার কামরুজ্জামান, কোম্পানী হাবিলদার মেজর নূরুজ্জামান এবং আরো ১৫ জন। এই লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিফৌজ ১৩ জন শত্রুসেনাকে হত্যা করে এবং ৪ জন শত্রুসেনা তাদের হাতে বন্দী হয়। মুক্তিফৌজ ছোটবড় হাতিয়ারসহ শত্রুবাহিনীর ৩২ টি রাইফেল কবজা করে।

 ডিসেম্বরের ৫ তারিখে পাকিস্তান বাহিনী আমাদের বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্তু আমাদের তীব্র-প্রতি-আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়ায় তুমুল লড়াই। এই লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী ও সংযুক্ত মিত্রবাহিনী অপরিসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী আখাউড়া দখল করে। ৪/৫ ডিসেম্বরের যুদ্ধে এই এলাকায় শত্রুবাহিনীর প্রায় ১৬০ জন সৈন্য মারা যায়।

 আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন শত্রুর অবস্থান ছিল খুবই সুদৃঢ়। ফলে এখানকার যুদ্ধ হয় ব্যাপক এবং মারাত্মক। বাংলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আখাউড়ার লড়াইয়ের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখানকার যুদ্ধে উভয় পক্ষই সর্বাধিকসংখ্যক আর্টিলারী ব্যবহার করে। কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্লাটা অক্রমণের মুখে পাঞ্জাবী সৈন্যরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় মিত্রবাহিনী আমাদের বাহিনীর সাথে যোগ দেবার পর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে তারা আর দাঁড়াতে পারেনি। বলাবহুল্য, আখাউড়ার পতনের পর শত্রুবাহিনী আর কোথাও ভালোভাবে অবস্থান নিতে পারেনি।

 আখাউড়ার যুদ্ধে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যেসব অফিসার অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেনঃ মেজর মতিউর রহমান, ক্যাপ্টেন মোরশেদ, লেফটেন্যাণ্ট ইব্রাহিম, লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ও লেফটেন্যাণ্ট সলিম (কোম্পানী অফিসার)।

 এখানে আমি ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোকপাত করতে চাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ছিল বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অন্যতম পুরনো ব্যাটালিয়ন। হানাদার পাক বাহিনী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর এই ব্যাটালিয়ন তখনকার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর শফিউল্লাহর (বর্তমানে কর্নেল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান) অধীনে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মুক্তি সংগ্রামে এই ব্যাটালিয়নের অবদান অতুলনীয়।

 এখানে আখাউড়ার যুদ্ধে শাহাদাৎপ্রাপ্ত বীর সৈনিক লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করে তাঁর শহীদী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই।

 লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান রংপুর মিলিটারী কাস্টোডি থেকে পালিয়ে এসে ১৬ ই আগস্ট মনতলায় আমার সাথে যোগ দেন। আমি ১১ নং বেঙ্গল রেজিমেণ্টএ যোগদানের আগ পর্যন্ত তিনি আমার অন্যতম প্লাটুন কমাণ্ডার হিসাবে আমার সাথেই ছিলেন। তিনি আমার সাথে বহু অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন।

 লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহসী সৈনিক। সদা হাসিমুখে এই অসম সাহসী যোদ্ধা যদিও মূলত ছিলেন একজন ক্যাভালরী অফিসার, তবু একজন ইনফ্যানট্রি অফিসারের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলেন না। যুদ্ধ চলাকালে শত্রুবাহিনীর একটি শেল তাঁকে আঘাত করে এবং সেই আঘাতে তিনি শহীদ হন। তাঁর মরদেহ আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে একটি মাজারের কাছে সমাহিত করা হয়। সিপাহী রুহুল আমিনের মরদেহও এরই কাছে সমাহিত করা হয়।  ২১ বছরের যুবক লেফটেন্যাণ্ট বদিউজ্জামান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। সদা প্রফুল্লচিত্ত নিরহংকারী বীর সৈনিক মাতৃভূমির স্বধীনতা সংগ্রামে হাসিমুখে আত্মোৎসর্গ করেন। তাই দেশবাসী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে চিরদিন তাঁর কথা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন।

॥ আশুগঞ্জের লড়াই এবং ঢাকার পথে 'এস' ফোর্স ॥

 এদিকে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ তাঁর 'এস' ফোর্স নিয়ে কোন পথে অগ্রসর হচ্ছেন তার বিবরণ সংক্ষেপে দিচ্ছি। ৬ই ডিসেম্বর বিকালে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ ইসলামপুর ব্রীজের কাছে এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন এবং নিশ্চত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। তারপর এখান থেকে 'এস' ফোর্স ৭ই ডিসেম্বর ঢাকার পথে রওনা হয়। এবং এইদিন শাহবাজপুরে তাদের সাথে আর একটি খণ্ডযুদ্ধ হয় ও পরে শত্রুরা ভেগে যায়। তারপর ‘এস’ ফোর্স ও মিত্রবাহিনী সরাইল পৌঁছে। আশুগঞ্জে আমরা আবার শত্রুসৈন্যের সম্মুখীন হলাম ৮ই ডিসেম্বর। আশুগঞ্জে শত্রুবাহিনী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়েছিল। সেটা ছিল যুদ্ধকৌশল সমৃদ্ধ এবং তার ঘাঁটিগুলি ছিল অত্যন্ত মজবুত। আমাদের ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনী প্রথম আক্রমণ চালায় ৯ই ডিসেম্বর বেলা ৩টার সময়। এই আক্রমণে আমাদের পক্ষে ছিল, তবুও তার সেই ভয়াবহ রুপ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিন। সম্মিলিতভবে ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে শত্রুবাহিনীও ভীষণভাবে মারমুখী হয়ে ওঠে। একদিকে যখন আমাদের পদাতিক বাহিনী বিনা বাধায় শত্রুর উপর বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় শত্রুপক্ষ তাদের ভারী মেশিনগান ও বিমানবিধ্বংসী কামান দিয়ে অবিরামভাবে গুলি ছুড়ে যাচ্ছে। তাদের আর- আর (রিকয়েললেস রাইফেল) গুলোও তখন নিরস্ত ছিল না। তারাও তখন আমাদের পক্ষের ট্যাঙ্কগুলোকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। আমাদের পক্ষের গোলন্দাজ বাহিনীর মিডিয়াম গানগুলো শত্রুপক্ষের উপর অবিশ্রান্তভাবে গোলা নিক্ষেপ করছিল, ঠিক তার পাল্টা জবাবে শত্রুপক্ষও তখন সমভাবে আমাদের উপর গোলা নিক্ষেপ করছিল। তুমুল লড়াইয়ের পর শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনীকে সাময়িকভাবে সেদিন পিছু হটতে হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাদের ক্ষয়ক্ষতি আমাদের থেকে অনেক বেশী ছিল। ঐ দিনকার যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর চারখানা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৪০/৫০ জন বীর যোদ্ধা মারা যান। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের প্রায় দেড় শতাধিক লোক নিহত হয়।

 দ্বিতীয়বার আক্রমণের পর অবশেষে শত্রুসৈন্য ১০ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ভৈরববাজারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শত্রুপক্ষ আশুগঞ্জ থেকে ভৈরববাজারে যাবার পূর্বে ভৈরব ব্রীজের তিনটি স্প্যান ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যুদ্ধের গতিবেগ রক্ষা করার জন্য কোন সময় নষ্ট না করে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ একাদশ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে ভৈরববাজার ঘিরে থাকার জন্য নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল সেক্টর ট্রুপস নিয়ে পদব্রজ নরসিংদীর দিকে রওনা হন।

 তিনি নরসিংদী পৌঁছানোর পূর্বেই মিত্রবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টারযোগে সেখানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। ১২ই ডিসেম্বর তিনি শীতলক্ষ্যা পার হন। ইতিমধ্যে তিনি দুটি ছোটখাটো সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এছাড়া তিনি দুটি দলকে ঢাকার দিকে পাঠিয়ে দেন। তার একটি ছিল বাসাবো এলাকার জন্য ও অপরটি ছিল ঢাকা সেনানিবাসের জন্য। ১৬ই ডিসেম্বর শত্রুপক্ষের ৩০০ জনের একটি দল ডেমরাতে তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

 ১৩ই হইতে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা পর্যন্ত ‘এস’- ফোর্স ডেমরা ও শহরের বিভিন্ন উপকণ্ঠে লড়াই করে। এরপর তারা ডেমরার পরবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে একবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। পরে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ জোনারেল অরোরার সাথে ডিসেম্বর বেলা ৪টা ৩১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও সেক্টর ট্রুপস ঢাকা স্টেডিয়াম পৌঁছে যায়।

  1. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন। ছুটিতে থাকাকালীন অবস্থায় মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন।
  2. ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টে লেফটেন্যাণ্ট পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি : ১৯৭৩ গৃহিত
  3. ২৪-৭-১৯৭৪ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  4. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে। সাক্ষাৎকারটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প ৮-১০-১৯৭৯ তারিখে গৃহীত।
  5. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক ১০-১০-১৯৭৯ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকার।
  6. ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। প্রতিবেদনগুলি তাঁর রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।