বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/১০৮
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
---|---|---|
সাহায্যের আহবান জানিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির বিবৃতি | দৈনিক যুগান্তর | ৮ এপ্রিল, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের সাহায্যে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির আবেদন
বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি নামে একটি সংস্থা সম্প্রতি গঠিত হয়েছে। ঐ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন শ্রী তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, এবং সম্পাদক হিসেবে আছেন, শ্রী মণিন্দ্র রায়, শ্রী নররেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও শ্রী দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। সমিতির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন ডাঃ মণীন্দ্রলাল বিশ্বাস এবং সহ-সভাপতিমণ্ডলীতে আছেন-সর্বশ্রী অজিত দত্ত, অন্নদা শংকর রায়, অমলাশংকর, উদয়শংকর, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, গোপাল হালদার, জ্যোতি দাশগুপ্ত, দক্ষিণারঞ্জন বসু, ডাঃ নীহার কুমার মুন্সী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, মন্মথ রায়, শম্ভু মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ, সরযুবালা দেবী, সুচিত্রা মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত আবেদন প্রচার করা হয়েছেঃ
ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকারবোধ ও মানবিক মর্যাদার পবিত্র অনুভবকে ট্যাংকের চাকায় পিষে ফেলতে চাইছে। প্রকৃতির আশীর্বাদ, কবির স্বপ্ন নদী-মেঘলা-শোভিতা এই শ্যামল ভূখণ্ড ও তার সাড়ে সাত কোটি মানব সন্তানকে আধুনিকতম মারণাস্ত্রের সাহায্যে একদল নরপিশাচ ঝলসে মারতে চায়।
নাপাম বোমার আগুনে তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শনগুলি, বহু স্মৃতি ঘেরা জনবসতি অঞ্চল, এমনকি গায়ের সবুজ মাটিকে পর্যন্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে। গোটা জাতির স্বপ্ন, শ্রম আর সম্পদে নির্মিত সেতু, বাঁধ ও প্রকল্পগুলিকে তারা বেছে বেছে ধ্বংস করছে। শাশ্বত-সাধনার পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এই জংগী চক্র কামান দেগে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মূল্যবান গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার ঘাতকরা ধ্বংস করেছে। সংবাদপত্রের কার্যালয়কে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বোমা ফেলে মর্টার ছুড়ে হাসপাতাল ভবনে জ্বেলেছে নরকের ভয়াবহ আগুন। মন্দির-মসজিদচার্চের পবিত্রতাটুকুও ঐ যুদ্ধোন্মাদ রাক্ষসদের নখ এবং দাঁতের কামড় থেকে রক্ষা পায়নি।
হত্যা ও রক্তের নেশায় জঙ্গী ইয়াহিয়া চক্র উন্মাদ হয়ে গেছে। খবর এসেছে কয়েক লক্ষ লোক মারা গিয়েছে-নিজেদের দেশে মানুষের অধিকারে মায়ের ভাষায় কথা বলে যারা শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের শিকার, কামানোর খোরাক, কয়েক লক্ষ অমৃতের সন্তান পচা গলা শবদেহ হয়ে শহরে বন্দরে গ্রামে শুকুনির খাদ্য হচ্ছে। তাদের কবর দেবার, দাহ করবার কোন ব্যবস্থা হয়নি। ইয়াহিয়ার উদ্যত সংগীন কয়েক লক্ষ শবেদেহকে নিয়ত পাহারা দিচ্ছে, দেশবাসী যাতে শহীদদের প্রাপ্ত মর্যাদাটুকু দিতে না পারে।
নর-নারী শিশু-বৃদ্ধ কে মরেনি? শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবী চাকুরে ব্যবসায়ী-কে মরেনি? শিল্পী, সাহিত্যিক সংবাদিক অধ্যাপক, কে মরেনি?
দানবরা মায়ের দুই স্তন কর্তন করে রক্তের উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার মধ্যে অবোধ শিশুর মুখ চেপে ধরেছে। আড়াই বৎসরের বাচ্চাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে গোলা ছুড়েছে। ইজ্জত লুট করে তারপর বাংলাদেশের মা ও বোনদের সংগীন দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান আচার্যদের সারিবন্দি দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়েছে। হাসপাতালের প্রত্যেকটি রোগীকে গুনে গুনে খুন করেছে।
কিন্তু নতুন মর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ সত্য ও সুন্দরের উপাসক বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃত্যুঞ্জয় প্রতিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বীর রোশেনারা বেগম বুকে মাইন বেঁধে জল্লাদের ট্যাংকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের কিশোরী দেহের সংগে একটা আস্ত প্যাটন ট্যাংকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ফৌজীদের হাত থেকে একের পর এক ঘাঁটি কেড়ে নিচ্ছে। গোটা বাংলাদেশ আজ একটিই অস্তিত্ব হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করছে। বাংলাদেশ জিতছে।
পশ্চিম বংগের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী আমরা, রবীন্দ্রনাথের উত্তর পুরুষ আমরা, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে নীরব বা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা ভুলিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এবং ভারতবর্ষের ভূমিকা। আমরা আমাদের মহান ঐতিহ্যকে কিছুতেই ভুলতে পারি না।
তাই আমরা ‘বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’ গঠন করছি।
আমাদের নিজ নিজ ক্ষেত্র ও নিজ নিজ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা এক ভাবগত আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। আমরা চাই শুধু পশ্চিম বংগ নয়, শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবিক শুভবুদ্ধি বাংলাদেশের নবজাত সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং সর্ববিধ সাহায্য নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য এক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু করুক।
সেই সঙ্গে আমরা বিপন্ন মানবতার পক্ষে বাস্তব ও প্রত্যক্ষ সাহায্যও সংগ্রহ করতে চাই। সীমন্তের ওপারে এই মুহূর্তে দরকার ঔষধ, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, গুঁড়ো দুধ ও বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাদ্য। আর তা কেনার জন্য দরকার টাকা পয়সা।
পশ্চিম বংগের মানুষ। রাজপথ, বস্তি, কুটির অথবা অট্টালিকা-যেখানেই আপনি বাস করুন, অবিলম্বে আপনার যতখানি সামর্থ্য তার থেকেও বেশি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসুন। ১৪৪ লেলিন সরণি, কলকাতা-১৩ (টেলিফোন: ২৪-৩৯৩০)- এই ঠিকানায় সমিতির কার্যালয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উপযুক্ত রসিদের বিনিময়ে আপনার সাহায্য ধন্যবাদের সংগে গৃহীত হবে।
সীমান্তের ওপারে এই মুহূর্তে দরকার রক্ত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজপথ, বৃতি, কুটির অথবা অট্টালিকা-যেখানেই আপনি বাস করুন অবিলম্বে ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের কার্যালয়ে (৬৪ লেনিন সরণি, কলকাতা-১৩। সময়: বেলা ২টা থেকে ৬টা) গিয়ে রক্ত দান করুন। আপনার এই ভালবাসা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গৃহীত হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ-বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিন। সেই শিশুটিকে স্মরণ করুন-মায়ের বুকের রক্তের ফোয়ারায় যার মুখ গুঁজে ধরা হয়েছিল। ওর খাদ্য দরকার। সেই জননীকে স্মরণ করুন-পশুরা যার অংগচ্ছেদ ঘটিয়েছে। মা’র চিকিৎসার দরকার। সেই কিশোরটির কথা স্মরণ করুন-ফ্রণ্টে আহত যে বীর ক্যাম্পে শুড়ে আছে, দুই চোখে অধীর প্রত্যাশা নিয়ে যে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, পশ্চিমবেঙ্গর দিকে। ওর রক্ত দরকার। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আপনি যেই হোন, যেখানেই থাকুন, একবার বিপন্ন বাংলাদেশের কথা ভাবুন। তার দরকার টাকা। কারণ ঔষুধ আর খাদ্য কিনতে হবে।
আমাদের মনুষ্যত্ব জাগ্রত হোক। আমাদের বিবেক শুভবুদ্ধির আহ্বানে সাড়া দিক। যেন ভুলে না যাই ইতিহাসের অগ্নি পরীক্ষায় আমাদেরও উত্তীর্ণ হতে হবে।