বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/২৫
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
---|---|---|
পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের প্রশ্নটি কয়েকটি দেশ বিবেচনা করছে বলে লণ্ডনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি | দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ | ২৩ জুন, ১৯৭১ |
পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ সম্পর্কে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলি বিবেচনা করছে শরণ সিং
লণ্ডন, ২২শে জুন—ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং গতকাল সন্ধ্যায় এখানে বলেন যে, গত এক পক্ষকাল ধরে যে কয়েকটি দেশ তিনি সফর করেছেন সেই কয়েকটি দেশের সরকার পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করার কথা বিবেচনা করেছেন।
শ্রী সিং বিশ্বের প্রধান যে ছয়টি রাষ্ট্র সফর করে এসেছেন সেই কয়টি রাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে কিনা, সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, ঘরোয়াভাবে তাঁকে যা বলা হয়েছে সে সব কথা তিনি প্রকাশ করতে পারেন না, তবে তিনি একথা বলতে পারেন যে, দুটি কারণে কয়েকটি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের কথা বিবেচনা করছে।
প্রথমতঃ পাকিস্তান নিজের দোষে অর্থনৈতিক সংকট করেছে—এই অবস্থায় সাহায্য দান সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়তঃ এই রাষ্ট্রগুলি মনে করে যে বর্তমানে সাহায্য করলে সংখ্যালঘু প্রশাসন সেই সাহায্য সংখ্যাগুরুকে দমনের কাজে লাগাবে।
এর আগে সফররের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে শ্রী শরণ সিং বলেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ এবং সমস্যাগুলি কি তা সংশ্লিষ্ট সরকার রাষ্ট্রসংঘ সংস্থা এবং বেসরকারী নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্রসহ এইসব রাষ্ট্রের জনগণকে অবহিত করার উদ্দেশ্যেই তিনি এই সফর করেছেন।
শ্রী শরণ সিং বলেন যে, এই সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ট্যারিফ পদ্ধতিতে এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা দমন নীতি চালিয়ে বাতিল করে দিতে চাওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলমান, হিন্দু খৃষ্টান ও বৌদ্ধ নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে ভারতীয় এলাকায় চলে এসেছে। শ্রী সিং বলেন যে, তাঁদের কাছে নিশ্চিত প্রমাণ আছে যে, কোন কোন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা চালিয়ে সেই এলাকায় অধিবাসীদের উৎখাত করা হয়েছে।
শ্রী সিং বলেন যে, প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বরাষ্ট্রগুলির কি মনোভাব হওয়া উচিত? ৬০ লক্ষ লোক শুনতে খুব বেশি নয়, কিন্তু যেখানে এই ৬০ লক্ষ লোক আসে সেখানকার অবস্থা সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশের জনসংখ্যা এমনিতেই বেশি এবং সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে সেখানে উদ্বাস্তুদের এই রকম ব্যাপক আগমন হলে যে সমস্যার উদ্ভব হয়, অর্থের ভিত্তিতে তার সমাধান সম্ভও নয়। শ্রী সিং বলেন যে, পরিস্থিতি ক্রমেই আরও সংকটজনক হয়ে উঠেছে উন্নিতির কোন আভাস নেই। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির প্রধান মনোভাব এই হওয়া উচিত যাতে পাকিস্তানে বর্তমান বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয়, উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ হয় এবং সেখানকার অবস্থার এমন পরিবর্তন হয় যাতে উদ্বাস্তুদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা সম্পর্কে আস্থা ফিরে আসে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির যাতে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, সেই উদ্দেশ্যেই তিনি এই সফরে বেরিয়েছেন।
শ্রী সিং বলেন যে, কেউ যদি এই সমস্যার প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দেন তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান পরিস্থিতির ওপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কোন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই। উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইয়াহিয়া খান ২২শে মে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তারপরও ২০ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে এসেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, যে পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুরা বাড়ীঘর ছেড়ে ভারতে এসেছে, সেই পরিস্থিতি এখনও বর্তমান—সেখানে এখনও আস্থার সঙ্কট রয়েছে।
সুতরাং বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশে যাঁদের হাতে আইন ও শৃঙ্খলার ভার রয়েছে তাঁরা যদি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারেন তাহলেই উদ্বাস্তুদের আবার স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শ্রী সিং বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর আওয়ামী লীগ দলের শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, সমগ্র পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সুতরাং তাঁদের সঙ্গেই একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে হবে, যাতে জনগণের প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করতে পারেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ অধিবাসীদের সঙ্গে একটা মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কথা বলতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলির কর্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের ওপর সম্ভাব্য সর্বপ্রকার চাপ সৃষ্টি করা এবং পাকিস্থান সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলা যে বাংলাদেশে অত্যাচার চালানোর অর্থই জনগণের অধিকারের ওপর অত্যাচার এবং এই অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।
শ্রী সিং বলেন যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সরকারী এবং বেসরকারী সাহায্যদান বন্ধ করতে হবে, কেননা এই সাহায্য পেলে পাকিস্তান অত্যাচার চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হবে এবং এই মর্মন্তুদ অবস্থা দীর্ঘায়িত হবে। পাকিস্তান যাতে রাজনৈতিক মীমাংসায় বাধ্য হয় সেজন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে।