বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড)/৭৬

শিরোনাম সূত্র তারিখ
আটটি বিরোধী দলের উদ্যোগে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি
(ড্যাক) গঠিত আন্দোলনের আহবান
দৈনিক পাকিস্তান ৯, জানুয়ারী, ১৯৬৯

বিরোধী আর্ট দলের ঐক্যজোট ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’ গঠন

 পিডিএমভুক্ত পাঁচটি দল ও অপর তিনটি দল গতকাল বুধবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কথা ঘোষণা করে জনসাধারণকে নির্বাচন বর্জন করার আহবান জানিয়েছেন। এ ছাড়া তারা একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি (ডেমোক্র্যাটিক এ্যাকশন কমিটি) গঠনের কথা ঘোষণা করে জনসাধারণের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের মহান দায়িত্ব পালনের জন্য বর্তমান আন্দোলনকে ব্যাপকতর ও সমন্বিত করে একটি ‘অহিংস, সংঘবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তোলার সংকল্প ঘোষণা করেছেন। গত এক সপ্তাহকাল যাবত ঢাকাস্থ, পিডিএম ৬ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ওয়ালী খান গ্রুপ) ও জমিয়তে ওলেমায়ে ইসলামের ব্যাপক রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা শেষে গতকাল বিকেলে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন হতে উক্ত নেতৃবৃন্দ যুক্তভাবে এক ইস্তেহার প্রকাশ করেন।

 ঘোষণাপত্রে ন্যাপের (ওয়ালী খান গ্রুপে) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব আমীর হোসেন শাহ, জমিয়তে ওলেমায়ে ইসলামের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব মুফতি মাহমুদ, ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং পিডিএমভুক্ত নেজামে ইসলামের সভাপতি জনাব চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, পিডিএম আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব নসরুল্লাহ খান, কাউন্সিল লীগের সভাপতি জনাব দৌলতানা, এনডিএফ প্রেসিডেণ্ট জনাব নূরুল আমীন ও জামাতে ইসলামীর অস্থায়ী আমীর জনাব তোহায়েল মোহাম্মদ সাক্ষর করেন।

পূর্ণ বিবরণঃ

 ঘোষণায় তারা বলেছেন, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস বর্তমানের এক ব্যক্তির স্বৈরাচার ও জুলুমের শাসন জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবনতি ও ধ্বংস ডেকে এনেছে। বিশেষ করে এই সরকার সচেতনভাবে এবং অবাধ গতিতে ইসলামবিরোধী জীবন ব্যস্থার প্রবর্তন করেছেন এবং জনগণকে সমস্ত প্রাথমিক ও মৌলিক অধিকার এবং সার্বভৌম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে একটি পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেছেন।

 এই শাসন ব্যবস্থা সকল স্তরের মানুষের উপর বিশেষ করে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের উপরে নির্যাতন চালানোর অপরাধে অপরাধী।

 ঘোষণায় বলা হয়, এই অগণতান্ত্রিক সরকার দেশের গুটিকয়েক পরিবারের হাতে সকল সম্পদ জমা করার পরিকল্পিত নীতি অনুসরণ করেন। ক্ষমতাসীন চক্রের কারসাজীতে দুর্নীতি সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমলাতন্ত্র এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে দুর্নীতি এই সরকারের একটি স্থায়ী ব্যবস্থার রূপ নিয়েছে।

 এই স্বৈরাচারী সরকার রাসহীনভাবে তাদের নির্যাতনমূলক শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপকভাবে আটক রেখে, অন্যায়ভাবে জরুরী অব্যাহত রেখে এবং মৌলিক এবং নাগরিক অধিকার পরিপন্থী আইনের ব্যাপক প্রয়োজন দ্বারা এই সরকার টিকে আছে।

 এই সরকার এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যার ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে এবং তা বেড়ে যাচ্ছে। আর এই পরিবেশে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ ও  সম্পদের ব্যবধান প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। জনসাধারণ দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য এবং অসহনীয় মুদ্রাস্ফীতির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে।

 উপরক্ত সরকার দেশকে রক্ষার মত উপযুক্ত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

 সরকার এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যে, তার ফলে দেশের সর্বত্র মানুষ তাদের ভাগ্য ও ভবিষৎ সম্পর্কে চরম হতাশার কবলে নিমজ্জিত হয়েছেন। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে সব কিছুর প্রতি বিরাগ বিতৃষ্ণা, ঔদাসীন্য এবং অক্ষমতা বাসা বেঁধেছে।

 এই চরম জাতীয় বিপর্যয়ের পটভূমিতে উপরোক্ত গলদগুলো দূর করার এবং পাকিস্তানের আদর্শের বাস্ত বতায় এবং মূল্যবোধ উদ্ধোধনের জন্য এই আটটি দল পাকিস্তানে পূর্ণাংগ গণতন্ত্র ও জনগণের পূর্ণ রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দৃঢ় এবং দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা দেশে (ক) ফেডারেল প্রকৃতির পার্লামেণ্টারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম, (খ) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচন, (গ) অবিলম্বে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, (ঘ) পূর্ণ নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। সমস্ত কালাকানুন বিশেষ করে বিনা বিচারে আটক রাখার আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল, (ঙ) খান আব্দুল ওয়ালী খান, শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজনৈতিক বন্দী, রাজনৈতিক কারণে জারীকৃত সব গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার, (চ) ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারার আওতায় জারীকৃত সকল নির্দেশ প্রত্যাহার, (ছ) শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, (জ) নতুন ডিক্লারেশেন দানের উপর আরোপিত বিধিনিষেধসহ সংবাদপত্রের ওপর জারীকৃত সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইত্তেফাক, চাতন, প্রগ্রেসিভ পেপারস লিমিটেডসহ সকল বাজেয়াপ্তকৃত কিংবা ডিক্লারেশনে বাতিলকৃত প্রেস পত্রিকা এবং সাময়িকী তাদের আদি মালিকের কাছে প্রত্যাবর্তনের দাবী করছেন।

 এই দলিল স্বাক্ষরদানকারী দলগুলো আরো ঘোষণা করছে যে, একটি বাধাহীন এবং পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির উপরোক্ত শর্তসমূহ বাস্তবায়িত না হলে বর্তমান স্বেচ্ছাচারী এবং অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন হবে জনগণের সাথে জালিয়াতির সামিল। তার প্রেক্ষিতেই তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং জনসাধারণের প্রতি নির্বাচন বর্জন করার আহবান জানিয়েছেন।

 ঘোষণায় সর্বশেষে বলা হয়, বর্তমানে সারা দেশে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করে যে জনসাধারণ ঐ ডিক্টেটারী শাসন চায় না। তাদের নিশ্চিত ও দৃঢ়বিশ্বাস স্বৈরাচার ও জুলুমের শাসন খতম না হওয়া পর্যন্ত বর্তমানের অগণতান্ত্রিক আন্দোলন থামবে না। দলিল স্বাক্ষর দাতাগণ তাদের নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে বলেন, আমরা ও আমাদের পার্টি স্বদেশপ্রেমের এই ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনে কোন ত্যাগ স্বীকার পরাঙ‍খুখ হবে না এবং জনগণকে তাদের পূর্ণ সার্বভৌম ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এবং অবিলম্বে উপরোক্ত লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে সুশৃংখলা, সুসংগঠিত অহিংসা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।