বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/৪

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ঢাকা-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল

শিরোনাম সূত্র তারিখ
8। জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়াব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরোধে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও অন্যান্য বাহিনী সাক্ষাতকারঃ মেজর জেনারেল (অব) কে. এম সফিউল্লাহ[] ………………১৯৭১

 ১৪/১৫ই মার্চ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হবে। এ গুজবের মধ্যে কিছু সত্যতাও ছিল। আমাদের কাছে কিছু প্রয়োজনের অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল। সেগুলো জমা দেওয়ার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়। আমরাও সেই নির্দেশ মানার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। এই গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ই মার্চ জনসাধারণ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৫০ জায়গায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এতে আমাদের খাদ্য সরবরাহে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় আমি প্রথম ব্যারিকেডে গিয়ে জনসাধারণকে বলি যে, আপনারা আমাদের উপর আস্তা রাখুন। আমি ১৭ বৎসর সামরিক বাহিনীতে চাকুরী করেছি অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য, ফিরিয়ে দেবার জন্য নয়। এই জন্যে আমাদের উপর আপনাদের আস্থা রাখতেই হবে। আপনারা যদি না রাখেন তবে আমাদের উপর আস্থা রাখার মত লোক আর কেউ নেই। এই কথা শুনে তারা বলল যে আমরা আপনার ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের সাথে দেখা করতে চাই। জনতার মধ্য থেকে চার-পাঁচজন গণ্যমান্য নেতা আমার সঙ্গে আসলেন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার-এর সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার এই আশ্বাস দিলেন যে আমাদের উপর আস্থা রাখুন। আমাদেরকে বিশ্বাস রাখুন এবং এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলুন। এতে আপনাদের সুবিধে হবে এবং আমরা কোন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ব না। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলবো বলে আশ্বাস দিয়ে তারা চলে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন প্রতিবন্ধকতা উঠানো হয় নাই। শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই গিয়ে প্রতিবন্ধকতা উঠাচ্ছিলাম। কিন্তু একদিকে যেই আমরা ব্যারিকেড সরাচ্ছিলাম অপরদিকে জনসাধারণ আবার ব্যারিকেড সৃষ্টি করছিল। এর বিরুদ্ধে কোন কড়া ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাক সেনাবাহিনীর চোখে আমরা সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছিলাম।

 ১৯শে মার্চ সকাল দশটার দিকে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের কাছে অয়ারলেসে এই মর্মে এক মেসেজ পাঠানো হয় যে “The Commander with his escort is coming to have lunch with you. He would visit Gazipur Ordnance Factory. এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতেও এরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এবং সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়ন-এর লোকজন গিয়ে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীর রেসিডেণ্ট ডিরেক্টর ব্রিগ্রেডিয়ার করিমউল্লাহ্ (পশ্চিম পাকিস্তানী)-কে অস্বস্তিকর পরস্থিতি থেকে উদ্ধার করা হয়। (তাঁকে ফ্যাক্টরীর লেবাররা ঘেরাও কের রেখেছিল)। এ ঘেরাও থেকে উদ্ধার করতে আমাদের কোন বেগ পেতে হয়নি। ১২টার দিকে একটা মেসেজ আসে যে “I had cleard some barriacade. Now I am at ‘Chowrasta’. I am using the civilians to open the barricade. You also clear the barricade from your side and meet me enroute. If there is any opposition use maximum force.” এ খবর পাবার পর আমরা আমাদের লোকজনকে নিয়ে জয়দেবপুর থেকে প্রতিবন্ধকতা সরাতে সরাতে অগ্রসর হই এবং ব্রিগেড কমাণ্ডার-এর সাথে রাস্তায় মিলিত হই।

 এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, আমরা প্রতিবন্ধকতা নিজেরাই পরিষ্কার করি। কিন্তু বিগ্রেড কমাণ্ডার বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবাব এবং তার সঙ্গীরা জনগণকে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা পরিষ্কার করে। প্রতিবন্ধকতা সরাবার সময় বেশ কিছুসংখ্যক লোককে মারধর করা হয়। বেলা প্রায় দেড়টায় বিগ্রেড কমাণ্ডার তার লোকজনকে নিয়ে জয়দেবপুর পৌঁছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে বিগ্রেড কমাণ্ডারের সাথে যে সমস্ত লোক ছিল তাদের মধ্যে একজন লেঃ কর্নেল (আর্টিলারী), একজন ক্যাপ্টেন (আর্টিলারী), একজন মেজর (আর্মার), একজন ক্যাপ্টেন (ইনফ্যানট্রি), একজন ক্যাপ্টেন (কমাণ্ডো) এবং ৭০ জন জোয়ান চাইনীজ এলএমজিতে সজ্জিত ছিল। তিনি জয়দেবপুরে প্রবেশ করে গর্বিতভাবে বললেন, “Nobody can stop us. We can move to any direction wherever and whenever we want to move. তার উক্তি এবং ভাবভঙ্গীতে আমার মনে হলো যেন আলেকজাণ্ডার ভারত জয় করল। জয়দেবপুরে এসে শুধুমাত্র অফিসাররা জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে ঢুকল। কিন্তু ৭০ জন জোয়ান প্রাসাদের বাইরে রয়ে গেল।

 বিগ্রেড কমাণ্ডার যখন ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে আসছিলেন, তখন যাতে আমাদের উপর কোন অঘটন না ঘটে, সেজন্য আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলাম। কেননা, আমাদেরকে নিরস্ত্র করা হবে বলে একটা আশংকা আমাদের মনের মধ্যেও ছিল। বিগ্রেড কমাণ্ডার প্রাসাদে ঢুকে সমস্ত জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলেন এবং মন্তব্য করছিলেন যে এ রকমের প্রস্তুতি কেন? তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম যে, এখানকার পরিস্থিতি এমন যে, যেকোন মুহূর্তে উত্তেজিত জনতা দ্বারা আমরা আক্রান্ত হতে পারি। এবং সীমান্তের পরিস্থিতি যা, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদেরকে সীমান্ত অভিমুখে রওনা দিতে হতে পারে। উত্তর যদিও মনঃপূত ছিল তবুও আমরা একে অপরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছিলাম।

 বিগ্রেড কমাণ্ডার প্রাসাদে ঢোকার সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসেছে। ফলে উত্তেজিত ও বিক্ষুদ্ধ জনতা আবার অল্প সময়ের মধ্যে জয়দেবপুর রেলক্রসিং-এ এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একটা ভর্তি মালবাহী গাড়ী, যেটা তখন ময়মনসিংহ থেকে জয়দেবপুরে এসেছিল, তা দিয়ে রেলওয়ে ক্রসিং-এর উপরে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একথা শোনার সাথে বিগ্রেড কমাণ্ডার কর্নেল মাসুদকে নির্দেশ দেন যে ২০ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হোক। যদি কোন বাধার সৃষ্টি হয়, তবে যেন ম্যাক্সিমাম শক্তি প্রয়োগ করা হয়। কর্নেল মাসুদুল হাসান এই নির্দেশ পাবার সাথে সাথে মেজর মইনুল হোসেনকে (বর্তমান লেঃ কর্নেল) নির্দেশ দিলেন যে তাঁর কোম্পানী নিয়ে যেন এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হয়। কোন সময় নষ্ট না করে মেজর মইন এই প্রতিবন্ধকতার সামনে পৌঁছান।

 তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাছে আবেদন করেন যে, আপনাদের ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। কারণ আমাদের সাথে এখনও অস্ত্র আছে। আমাদের কাছ থেকে এখনও অস্ত্র নেয়া হয় নাই। জনতা যখন শুনছিল না তখন তিনি ভীড় ঠেলে জনতার মধ্যে যারা নেতা তাঁদের সাথে আলাপ করেন। নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব হাবীবুল্লাহ এবং আর একজন ছিলেন শ্রমিক নেতা আবদুল মোতালেব। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং জয়দেবপুরে হাটবার। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের সমাবেশ ছিল সেখানে। কিন্তু জনতা প্রতিবন্ধকতার এ পাশে ছিল আর কিছু জনতা প্রতিবন্ধকতার অপর পাশে ছিল। নেতারা ছিলেন বাজারের দিকে। মেজর মইন ইতিমধ্যে নেতাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হন যে আমাদেরকে এখনও নিরস্ত্র করা হয়নি। তারা আমাদের কথায় বিশ্বাস করেন। নেতারা জনসাধারণকে বুঝাবার চেষ্টা করছিলেন যে তারা যেন আর কোন গণ্ডগোল না করে। জনতার মাঝে তখনও হৈ চৈ এবং গণ্ডগোল চলছিল। ইতিমধ্যে লেঃ কর্নেল মাসুদ, বিগ্রেড কমাণ্ডার জাহানজেব ও তার ট্রুপস সেখানে গিয়ে পৌঁছান।

 ব্যারিকেড-এর বাজারের পাশের দিকে অধিকাংশ জনতার সমাবেশ ছিল এবং অপর পাশের দিকও বেশ জনসমাবেশ ছিল। কিন্তু এ পাশের লোক বেশ উত্তেজিত ছিল। কারণ তারা জানত না যে মেজর মইনের সাথে  ব্যারিকেড-এর অপর পাশের জনতার সাথে কি কথাবার্তা হয়েছিল। জয়দেবপুর পর্যন্ত যে রাস্তা স্টেশনের দিকে চলে যায় সে রাস্তার শেষপ্রান্তে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর ট্রুপস মোতায়েন ছিল। তার পিছনে হুকুম দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে বিগ্রেড কমাণ্ডার জাহানজেব আরবাব তার বাহিনী নিয়ে এসে যায়। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর বাকী সৈন্য প্যালেসে থেকে যায়। বিগ্রেড কমাণ্ডার আসার সাথে সাথে মেজর মইনকে আদেশ দেয় সে যেন তার সেনাবাহিনীকে পেছনে সরিয়ে নিয়ে এসে রেলস্টেশনে যাবার পথের উপর জনতাকে সামনে রেখে মোতায়েন করে। মেজর মইন তখন বিগ্রেড কমাণ্ডারকে বললেন যে নেতারা আপনার সাথে দেখা করতে চান এবং এই উদ্দেশ্যে তারা এদিকে আসছেন। বিগ্রেড কমাণ্ডার উত্তেজিত হয়ে বললেন, “I do not want to see them. Tell them to get away and deploy troops."

 মেজর মইন নির্দেশ মোতাবেক সৈন্যদের মোতায়েন করার জন্য আদেশ দিচ্ছিলেন। এ আদেশ শুনে এবং সৈন্যদের গতিবিধিও বিগ্রেড কমাণ্ডার জাহানজেব আরবাবের ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে নেতারা পেছনে সরে যান। নেতাদের পেছনে সরে যেতে দেখে এপাশের জনতা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তখন বিগ্রেড কমাণ্ডার মেজর মইনকে নির্দেশ দেন জনতার উপর গুলি ছোঁড়ার জন্য। একদিকে তিনি নিজে মেজর মইনকে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন কিন্তু অপর দিকে তিনি মেজর মইনকে কর্নেল মাসুদের নির্দেশ নিতে বলছিলেন। কর্নেল মাসুদ ঐখানে ছিলেন।

 এখানে বলে রাখা দরকার যে, টাঙ্গাইলে আমাদের যে কণ্টিনজেণ্ট ছিল তাদের খাদ্য নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক (বেডফোর্ড) টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুর আসছিল। ঐ গাড়ী বাজারের নিকট এসে এক বিরাট জনতার ভিড় দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল যে আজ হাটবার তাই এত লোক। তারা এখানকার ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। হঠাৎ জনতার মধ্যে থেকে কিছু লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং বলে যে সামনে পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের গুলি ছোঁড়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তোমাদেরকে আমাদের সাথে যোগ দিয়ে পাঞ্জাবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ট্রাকের মধ্যে ড্রাইভারসহ ৭ জন বাঙ্গালী সৈন্য ছিল। তারা হতবুদ্ধি হযে কি করতে হবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। জনতা পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে তাদেরকে বন্ধ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়। অস্ত্রের মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল এবং চাইনীজ এসএমজি ছিল। ড্রাইভার এবং কো- ড্রাইভার কোন রকমে পালিয়ে এসে বলে যে আমাদের পাঁচজন সৈন্যকে জনতা বোধ হয় মেরে ফেলেছে এবং আমরা মারধর খেয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। তখন বিগ্রেড কমাণ্ডার হুকুম দেয়, “Fire and Clear the barricade” মেজর মইন এই হুকুম পাবার পর প্রথম বিউগল বাজালেন এবং পতাকা উঠিয়ে গুলি ছোঁড়া হবে বলে মাইকে ঘোষণা করলেন। এ ঘোষণায় জনতার মাঝে কোন ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়নি। তারপর তিনি জনতার মাঝে একজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেন। এ আদেশ শোনার পর জনতার মাঝে একটু ভয় ও ভীতির সঞ্চার হয়। মেজর মইন যাকে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে বাংলায় বললেন যে নিচের দিকে গুলি ছুঁড়ে দাও। যেহেতু গুলিটা গিয়ে একটা গাছের মধ্যে লেগেছে সেহেতু বিগ্রেড কমাণ্ডার এটা দেখে খুব রাগান্বিত হলেন। এবং নির্দেশ দিলেন, “Fire for effect” এবারও জনতার মধ্যে একটু নড়চড় হচ্ছিল। এবারও তিনি বাংলায় বললেন উপর দিকে মেরে দাও। এবার যে গুলি করছিল, সে রাইফেলটাকে এমনভাবে উঠিয়ে ধরছিলো যে মনে হচ্ছিল সে আকাশের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তা দেখে বিগ্রেড কমাার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “I want one dead body per bullet. If you cannot handle the situation 1 will employ my troops.” এই সময় জনতার মধ্য থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে দেখে মেজর মইন এবার ঠিকভাবে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। গুলি একজন লোকের গায়ে লাগে এবং সে মাটিতে পড়ে যায়। এর ফলে জনতা ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। এ সময় জনতার মধ্য থেকেও ভীষণভাবে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। জনতার গুলিতে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর কিছুসংখ্যক সৈন্যও আহত হয়। এ সময় জয়দেবপুর বাজারে অবস্থিত মসজিদের উপর থেকে বিগ্রেড় কমাণ্ডার জাহানজেব আরবাবকে লক্ষ্য করে এস-এমজি ফায়ার শুরু হয়। আমাদের সৌভাগ্যবশতঃ বিগ্রেডিয়ারের গায়ে তা লাগেনি। এখন জনতা এবং সৈন্যদের মধ্যে বেশ  কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর বাকী সৈন্যসহ আমি তখন প্যালেসে ছিলাম এবং গুলির আওয়াজ শুনে কিছুসংখ্যক সৈনিককে জাহানজেব আরবাবের ট্রুপস-এর পিছনে মোতায়েন করি। এর দুটো উদ্দেশ্য ছিল জনতার হাত থেকে সৈনিকদের বাঁচানো এবং যদি বিগ্রেড কমাণ্ডারের অশুভ উদ্দেশ্য থাকে তা প্রতিহত করা।

 এ খণ্ডযুদ্ধ প্রায় পনর বিশ মিনিটের মত চলে এবং এরপর সম্পূর্ণ এলাকা জনতামুক্ত। জনতা চলে যাবার পর আমরা ব্যারিকেড খুলে ফেলি। এরপর বিগ্রেড কমাণ্ডার ঢাকার দিকে চলে গেলেন এবং যাবার আগে নির্দেশ দিয়ে গেলেন জয়দেবপুর ও গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকার মধ্যে সান্ধ্য আইন জারী করার জন্য এবং আরো বলে গেলেন অয়ারলেসে তাকে জানাবার জন্য কি রকম এ্যামুনিশন খরচ হয়েছে এবং কতজন হতাহত হয়েছে। আমরা তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, দুইজন লোক নিহত হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক আহত হয়েছে। বিগ্রেড কমাণ্ডার যাবার সময় চৌরাস্তায় কিছু লোক দেখতে পায়। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য দূর থেকে গুলি ছোঁড়ে এবং এতে দুজন লোক মারা যায়। আহতদের সংখ্যা জানা যায়নি।

 আমরা নির্দেশ অনুযায়ী সান্ধ্য আইন জারী করি। সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে পাঁচজন নিখোঁজ লোককে আমরা মসজিদের পাশের এক কক্ষ থেকে উদ্ধার করি। স্থানীয় নেতাদের সাহায্যে এবং আমাদের লোকদের সাহায্যে তল্লাশী চালিয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ৪টি রাইফেল উদ্ধার করতে সক্ষম হই। তিন-চারদিন পর গফরগাঁও থেকে এসমএমজিটি উদ্ধার করি। অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে বের করা পর্যন্ত ঐ বেলায় সান্ধ্য আইন বলবৎ ছিল। যদি বিগ্রেড কমাণ্ডার সেখানে না থাকত তাহলে আমরা ব্যারিকেড খুলে ফেলতে পারতাম। কোন হতাহত হতো না। যেভাবে এ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা হয়েছে তাতে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্যরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ঐদিনই রাতে ৫ জন বাঙ্গালী সৈন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ৪টি চাইনিজ রাইফেল এবং একটি এস-এমজি এ্যামুনিশনসহ ছিল। সন্ধ্যার সময় অয়ারলেসে আমরা বিগ্রেড কমাণ্ডারকে জানালাম যে, আমাদের ৬৩ রাউণ্ড গুলি খরচ হয়েছে এবং আমাদের কিছুসংখ্যক সৈন্য আহত হয়েছে। দুজন বেসামরিক লোক নিহত এবং বেশ কিছুসংখ্যক আহত হয়েছে। যদিও তিনি বললেন যে ভাল করেছ, কিন্তু তিনি মনে মনে খুশী হতে পারেননি। কেননা তিনি বলেছিলেন, why 63 round spent and only two dead?

 ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার-এর কর্তব্য এবং দায়িত্ব তার ব্যাটালিয়নের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি সুস্থ মস্তিষ্ক কিছুই করতে পারেননি। বিগ্রেড কমাণ্ডার-এর কাছ থেকে তাঁর উপর কারণ দর্শাও নোটিশ এলো কিভাবে ট্রাকের পাঁচজন সৈন্য থেকে অস্ত্র নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো? এবং পাঁচজন কেন অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেল? ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার এক্সপ্লানেশন-এর জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জবাবে বিগ্রেড কমাণ্ডার সন্তুষ্ট হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে নিজে গিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। যাবার পূর্বে আমার সাথে পরামর্শ করেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনাকে ডাকছে ততক্ষণ আপনি ঢাকাতে যাবেন না। যেহেতু তিনি মানসিক অস্থিরতাতে ছিলেন সেহেতু তিনি সেই অস্থিরতা দূর করার জন্য ২৩শে মার্চ ঢাকা বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে আসলেন। সেখানে যাবার সাথে তাঁকে বিগ্রেড কমাণ্ডার জাহানজেব আরবাব বললেন, তোমাকে ব্যাটালিয়নে ফিরে যেতে হবে না। তুমি স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এটাচড্; ব্যাটালিয়নের ঘটনাবলী নিয়ে তদন্ত হবে। তার পর থেকে ঢাকাতে থেকে যেতে বলা হয়। সেহেতু তিনি আর ব্যাটালিয়নে ফিরে যেতে পারেন নি। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে কর্নেল মাসুদ স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এটাচড়; এবং তার অনুপস্থিতিতে আমি যেন ব্যাটালিয়ন-এর কার্যভার গ্রহণ করি।

 ২৫শে মার্চ বেলা ১১টার সময় আমাকে বিগ্রেড থেকে জানানো হয় যে, বিগ্রেডিয়ার মজুমদার, সেণ্টার কমাণ্ড্যাণ্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, চট্টগ্রাম ব্যাটালিয়নে আসছেন এবং সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। আরো জানানো হয় নতুন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল কাজী রকিব উদ্দিন নতুন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার হিসেবে আসছেন এবং তিনিও আজ পৌঁছে যাবেন। কর্নেল মাসুদ আমাকে ১১টার দিকে টেলিফোনে বলেন যে, লেঃ  কর্নেল রকিব নতুন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার হিসেবে আসছেন। তিনিও ভালো লোক। আমার যা হয়েছে তার জন্য কোন আফসোস নাই। খোদা যা করেন, ভালোর জন্য করেন।

 বেলা প্রায় ১টায় বিগ্রেডিয়ার মজুমদার ব্যাটালিয়নে পৌঁছান এবং আমার সাথে এক ঘণ্টা পর্যন্ত আলাপ আলোচনা করেন। তাঁর কাছে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি তার পুরোপুরি জবাব দিতে পারননি। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু ঘোলাটে পরিস্থিতিতে মুখ খুলে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে লেঃ কর্নেল কাজী রকিব ব্যাটালিয়নে পৌঁছে যান। বেলা প্রায় তিনটায় বিগ্রেডিয়ার মজুমদার সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। ভাষণের মর্ম এই ছিল যে, আমরা সৈনিক, আমরা সরকারের নির্দেশ মোতাবেক চলি। এবং সরকার যা হুকুম দেন তা আমরা পালন করতে বাধ্য হই। ব্যাটেলিয়নে ঘণ্টাখানেক এ পরিপ্রেক্ষিতে ভাষণ দেন। তারপর লেঃ কর্নেল রকিবকে ব্যাটালিয়ন-এর ভার বুঝিয়ে দেন। এবং সৈনিকদের বলেন, আজ থেকে লেঃ কর্নেল রকিব তোমাদের নতুন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার। বেলা প্রায় পাঁচটার দিকে তিনি ঢাকা রওনা হয়ে যান। কিন্তু যাবার আগে আমি তাঁকে বলেছিলাম, স্যার আপনি আমাদের ব্যাটালিয়নে নতুন এসেছেন। তাই আজ রাতটা এখানে থেকে যান। কিন্তু তিনি বলেন যে ঢাকাতে তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে থাকবেন। এখন আমি উপলব্দি করতে পারছি যে যদি তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে থাকতেন, তাহলে হয়ত আজ আমাদের সাথেই থাকতেন।

 বিগ্রেডিয়ার মজুমদার চলে যাবার পর আমি ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার রকিবকে দেশের তদানীন্তন গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মনোভাব জ্ঞাত করাই। কিন্তু তাঁর মনোভাব সম্পূর্ণরূপে না জানাতে তাঁর সাথে খোলাখুলি আলাপ করতে পারছিলাম না- যদিও আমার পক্ষ থেকে যতদূও সম্ভব ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মনোভাব তাঁকে জ্ঞাত করাই। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন কিভাবে মোতায়েন ছিল তাও তাঁকে বলি। ডেপ্লয়মেণ্টটা এই- এক কোম্পানী ময়মনসিংহ, এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে- এই দুই কোম্পানীর ভার ছিল আমার উপর। এক প্লাটুন ছিল রাজেন্দ্রপুর এ্যামুনিশন ডিপোতে। সেখানে আরো তিনটি পাঞ্জাবী প্লাটুন ছিল-এক প্লাটুন পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট, এক প্লাটুন বেলুচ রেজিমেণ্ট, এবং এক প্লাটুন ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট। ব্যাটালিয়নের বাকি লোক সব জয়দেবপুর প্যালেসে ছিল।

 ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টার দিকে কর্নেল রকিবের ছেলে ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানায় যে তাদের বাসায় কয়েকটা বেনামী টেলিফোন কল এসেছে এবং ধমক দিয়ে বলা হয়েছে যে তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ঐ দিন বিগ্রেড কণ্ট্রোল রুমে আমাদের ব্যাটালিয়নের একজন পাঞ্জাবী অফিসার কর্তব্যরত ছিল। কর্নেল রকিব তাকে নির্দেশ দেন সে যেন ইপিআর হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন করে সেখান থেকে কিছু আমর্ড গার্ড তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি ইপিআর থেকে মনে হয় এই ভরসায় সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন যে তিনি মাত্র কিছুদিন আগে ইপিআর থেকে এসেছেন। আমর্ড গার্ড তাঁর বাসায় পাঠানো হয়েছিল কিনা, তা পরে আর জানতে পারিনি।

 ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১২টায় জেনারেল টিক্কা খান ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কর্নেল রকিবের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং বলেন যে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে গোলযোগ চলছে। একজন দায়িত্বশীল অফিসারের নেতৃত্বে যেন সেখানে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হয়। গাজীপুর জয়দেবপুর থেকে নিকটবর্তী। সেখানে কোন গোলযোগ হলে নিশ্চয়ই আমরা খবর পেতাম। কিন্তু যেহেতু টিক্কা খান নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন সেহেতু ঐ রাতেই প্রায় তিনটায় এক কোম্পানী সৈন্য একজন অফিসারের নেতৃত্বে সেখানে পাঠানো হয়। সৈন্য পাঠাবার পর সেখানে দেখা গেল কোন গণ্ডগোল ছিল না। আমার মনে হয়, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাটালিয়নের সমস্ত সৈনিককে দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখা যাতে আমরা একত্রিত হয়ে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের ২৫শে মার্চের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন বাধা সৃষ্টি না করতে পারি।  ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১ টায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের অবস্থা কি? ঢাকাতে তো বেশ গুলিগোলার আওয়াজ শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পরপরই ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সমস্ত যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কি হচ্ছিল তার কোন খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না। ২৬শে মার্চ সকাল বেলায় ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার রকিবকে বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং চারিদিকে যে সমস্ত গুজব রটছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করেছে। এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। যেহেতু ঢাকার সাথে অন্য সব রকম যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায় সেহেতু আমি অয়ারলেস সেটে গিয়ে ঢাকার কি হচ্ছে তা শোনার চেষ্টা করি। ২৫শে মার্চ রাতে টেলিফোন যোগাযোগ বিছিন্ন হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ইউনিটে অয়ারলেস সেটে যেভাবে কাজ চলছিল তার একটি বিস্তৃত বর্ণনা নিচে দেওয়া গেলঃ-

 বিগ্রেড হেডকেয়ার্টারে - ৫৭ বিগ্রেডে ছিল কণ্ট্রোল স্টেশন আর সাব-স্টেশন ছিল নিন্মলিখিত ইউনিটগুলোঃ ১। ১৮ পাঞ্জাব, ২। ৩২ পাঞ্জাব, ৩। ২২ বেলুচ রেজিমেণ্ট, ৪। ১৩ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট, ৫। ৩১ ফিল্ড রেজিমেণ্ট, ৬। ৪৩ লাইট এণ্টিএয়ারক্র্যফট রেজিমেণ্ট, ৭। ট্যাংকস স্কোয়াড্রন- এগুলো সব ঢাকায় ছিল, ৮। ২ ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুর, ৯। ২ ইস্ট বেঙ্গল, টাঙ্গাইল (এ সেটগুলো ঢাকা থেকে এসেছিল)। এর অপারেটর সব পাঞ্জাবী ছিল। অয়ালেস সেট এবং অয়ারলেস নেট কিভাবে কাজ করে সে সম্বন্ধে যারা পুরোপুরি অবগত নন তাদের অবগতির জন্য বলছি যে, অয়ারলেস নেট-এ একই ফ্রিকোয়েন্সিতে যখন এক স্টেশনে কথা বলা হয়, তখন অন্য স্টেশনের লোকজন একই সময়ে ঐ সমস্ত কথাবার্তা শুনতে পায়।

 ২৬ শে মার্চ সকাল ৭/৮ ঘটিকার সময় আমি এবং কর্নেল রকিব অয়ারলেস সেটে যাই। সেটটা জয়দেবপুর রাজবাড়ির অফিসার্স মেস-এর পূর্বদিকে বসানো ছিল। আমরা যখন সেটে যাই তখন সেটে কথা হচ্ছিল। আমরা সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে অপারেটর ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে অন্য চ্যানেলে চলে আসে। ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবর্তন করাতে অন্যান্য স্টেশনের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। আমি অপারেটরকে (পাঞ্জাবী ছিল) জিজ্ঞেস করি যে তুমি ফ্রিকোয়েন্সি কেন চেঞ্জ করছ? আর বাকী স্টেশন কোথায়? সে উত্তর দিল যে ঢাকা থেকে নির্দেশ দিয়েছে গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এবং এই নেটে অনেক স্টেশন হয়ে যাবার জন্য। জয়দেবপুর-ঢাকা-টাঙ্গাইল এক নেটে থাকবে বলে নির্দেশ পাওয়া গেছে। আমি তাকে বললাম কিছুক্ষণ আগে অয়ারলেস সেট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল সে ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিরে যাও। সে উত্তর দিল যে, স্যার আমার সেট আর কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল না। আমি তখন তাকে বললাম যে অন্যান্য ইউনিট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে সে ফ্রিকোয়েন্সিতে মিলাও বা সেট কর। সে উত্তর দিল “আমার সে ফ্রিকোয়েন্সি জানা নেই।” আমি তাকে আর কিছু না বলে কর্নেল রকিবের সাথে অফিসে ফিরে আসি। আসার সময় রাস্তায় কর্নেল রকিবকে বলি, “There must have something serious happened in Dacca. That is why Dacca station does not want us to hear the conversation” তারপর আমি একজন বাঙ্গালী অপারেটরকে গোপনে নির্দেশ দিই ঐ সেট এর উপর লক্ষ্য রাখার জন্য যে কি কথাবার্তা হয়। আমি অফিস যাবার সাথে সাথে আমাদের ব্যাটালিয়নের নিজস্ব অপারেটর আমাকে বলে যে ময়মনসিংহের কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নুরুল ইসলাম আপনার সাথে জরুরী কথা বলতে চান। টেলিফোন যোগাযোগ ছিল না বলে তিনি অয়ারলেসে কথা বলতে চান। ময়মনসিংহে আমাদের নিজস্ব অয়ারলেস সেট ছিল। আমি সেটে যাবার পর মেজর নুরুল ইসলাম বলে যে, সে কয়েক হাজার লোক দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। তারা বলছে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট তাদের সাথে যোগ দিক।

 এখানে বলে রাখা দরকার ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টারে মেজর নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল। ইপিআর-এর উইং কমাণ্ডার একজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিল। ইপিআর উইংয়ে তাদের যে রিজার্ভ কোম্পানী ছিল তার প্রায় অধিকাংশই বাঙ্গালী ছিল। উইং কমাণ্ডার ঢাকার নির্দেশমত সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিকদের (ইপিআর) বর্ডার থেকে উইথড্র করে উইং হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। তাদের সংখ্যা উইং হেডকোয়ার্টারে ছিল প্রায় ৫০/৬০ জন। জনতা যখন উইং হেডকোয়ার্টার ঘিরে ফেলল তখন  হেডকোয়ার্টার-এর আউটার পেরিমিটারে বাঙ্গালী সৈনিকরা পাহারারত অবস্থায় ছিল। মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল) মাইক্রোফোনে উচ্চস্বরে জনসাধারণকে এ এলাকা থেকে চলে যাবার নির্দেশ দিচ্ছিলেন এবং এও আশ্বাস দেন যে, সময় আসলে আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। সারাদিন তারা এ অবস্থায় ঘেরাও ছিল। মেজর নুরুল ইসলামের আশ্বাস পেয়ে জনতা আস্তে আস্তে সরে যায়। আমাকে যখন সে এ সমস্ত ঘটনা জানায় তখন আমি তাকে বললাম ধীরেসুস্থে কাজ কর। সময় আসলে সব কিছু বলব। সে আমাকে সেখানে আরো কিছু সৈনিক পাঠাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিল। আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে আমি পাঠাতে চেষ্টা করব।

 আমি অয়ারলেস থেকে অফিসে ফিরে আসার সাথে সাথে আমি যে একজন অপারেটরকে ঠিক করেছিলাম ঐ অয়ারলেস সেটে লক্ষ্য রাখার জন্য সে এসে আমাকে খবর দিল যে, স্যার, আপনারা চলে আসার কিছুক্ষণ পর সে আবার ফিকোয়েন্সি চেঞ্জ করে অন্যান্য স্টেশনের কথা শুনছিল। আমি দূর থেকে শুধু এতটুকুই শুনতে পেরেছি কে যেন কতগুলো লোক মেরেছে। পাঞ্জাবী অপারেটর তার সম্বন্ধে নির্দেশ চাইলে ঢাকার অপারেটর ভীষণভাবে রাগান্বিত হয়, এবং বলে সে যেন আর কখনো এই ফ্রিকোয়েন্সিতে না আসে। তাকে গতকাল যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন সেভাবে চলে।

 এ খবর পেয়ে আমি ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডার কর্নেল রকিবের অফিসে যাই এবং তাকে এ সমস্ত ব্যাপার (ময়মনসিংহের ব্যাপার এবং অয়ারলেস-এর ব্যাপার) সব খুলে বলি। এবং তাকে আমি বলি যে, স্যার, আমাদের এখন কিছু একটা করা দরকার। তা না হলে পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। যদি চলে যায় আপনিও কিছু করতে পারবেন না, আমিও কিছু করতে পারবো না। তিনি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করা দরকার? আমি এ পরামর্শ দিলাম যে ময়মনসিংহের পরিস্থিতি খারাপ। ঢাকার সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহের সাহায্যের জন্য আমাদের সমস্ত সৈনিকদের নিয়ে সেখানে চলে যাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের সৈনিকদের ময়মনসিংহ গিয়ে কনসেনট্রেট করা। আর পরিস্থিতি লক্ষ্য করে যদি কিছু করতে হয়, তাহলে আমরা যেন এক সাথে হয়ে করতে পারি। তিনি তখন বললেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ ছাড়া কি ভাবে এ পদক্ষেপ নিই। আমি তখন বললাম যে, আপনি ঢাকা থেকে নির্দেশ নেন যে ময়মনসিংহের পরিস্থিতি খুবই খারাপ, আমাদের সেখানে ইনফোর্সমেণ্ট পাঠানো দরকার। তিনি আমার কথামত ঢাকাতে অয়ারলেস সেটে কথা বললেন। কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না। আমি তাকে বললাম যে এখন আমরা যদি কিছু না করি তাহলে আমাদের সৈনিকদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা হয়ত আমরা পালন করতে পারব না। এতে তিনি একটু ঘাবড়িয়ে পড়লেন। ২৬ শে মার্চ প্রায় দশটার দিকে জেনারেল টিক্কা খান তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী করেন এবং ঐ আইনের নির্দেশাবলী রেডিওতে প্রচার করতে থাকেন। সামরিক আইন জারীর কথা শুনে সৈনিকদের মধ্যে এক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঢাকায় যে বেশকিছু একটা ঘটেছে তার একটা আভাস পাওয়া যায়।

 ২৬ শে মার্চ সকাল ১০/১১ টার দিকে দেখলাম একটা আর্মি হেলিকপ্টার রাজেন্দ্রপুরের দিকে একবার যাচ্ছে এবং আবার আসছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম তারা রাজেন্দ্রপুর থেকে এ্যামুনিশন নিচ্ছে। তাতে বুঝা যাচ্ছে ঢাকাতে যে এ্যামুনিশন ছিল তা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে তারা খরচ করল। এ খবর পাবার পর ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারকে আবার বললাম যে, স্যার, “There must have something serious happened in Dacca and that is why they are running short of ammunition is being lifted by helicopter."

 ২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকাতে কি ঘটেছিল তার কোন খবর পাইনি। বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে খবর দিল যে ঢাকাতে বেশ গোলাগুলি হয়েছে এবং বেশকিছু লোক মারা গিয়েছে। সে আরো বললো যে, বাঙালী সৈনিকদের বেঁধে নিয়ে কোথাও নিয়ে মেরে ফেলা  হচ্ছে। সে ব্যাটালিয়নে পৌঁছার সাথে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টির হয়। তখন আমি ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারকে বলি যে, ঢাকা থেকে আপনি কোন নির্দেশ পাচ্ছেন না। ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতিও খারাপ। আমরা যদি কোথাও কনসেনট্রেট না হই তাহলে পরিস্থিতি হয়ত আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। আমি তাকে আবার বললাম যে, আমরা আমাদের সৈনিকদের নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ চলে যাই। তিনি উত্তরে বললেন যে আমার ছেলে পিলে আছে। বেলা প্রায় দু'টোর দিকে ঢাকা থেকে বিগ্রেড কমাণ্ডার বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার-এর সাথে অয়ারলেসে কথা বললেন এবং বললেন, “our troops are facing some difficulties at Tongi, Send a company to do some shooting.” আমাকে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার জিজ্ঞেস করলেন, কি করা যায়? জয়দেবপুরে তখন শুধু একটা রাইফেল কোম্পানী ছিল, যার কমাণ্ডার মইনুল হোসেন চৌধুরী। ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার রকীব বললেন এই কোম্পানীকে পাঠাবার জন্য। আমি তখন বললাম যে এখন এই কোম্পানীকে না পাঠিয়ে টংগীর খবর নিন। একজন পাঞ্জাবী অফিসার পাঠাতে বললাম। গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে আমাদের যে কোম্পানী ছিল তার কমাণ্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। আমি তাকে পাঠাতে বললাম। ড্রাইভার এবং বাকী লোক ছিল বাঙালী। ঐদিনই আমরা টঙ্গীতে বেশ কিছু বড় বড় গোলার আওয়াজ শুনি। অফিসারকে আর অন্যান্যদেরকে পৃথক পৃথক ব্রিফ করে টঙ্গী থেকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। বিকেলে টঙ্গী থেকে ফিরে আসার পর ঐ অফিসার কমাণ্ডিং অফিসারকে খবর দেয় যে সেখানে তেমন কিছু হয়নি। কিছুসংখ্যক জনতা টঙ্গী পুলের কাছে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে কিছু গোলাগুলি হয়েছে। সে এও বলল যে, “Since there was a barricade near Tongi Bridge the troops from Dacca did some sporadic Firing. Incidentally I was also challenged by the Dacca troops.” ড্রাইভার বলল যে আমরা টঙ্গীতে যাবার সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের সবাইকে (আমাদের অফিসারসহ) দুই হাত উপরে উঁচু করে বেয়নেটের ডগায় অফিসারের কাছে নিয়ে যায়। আমাদের সৈনিকদের সবাই ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। অফিসারকে যখন তারা উঁচু করায় (হ্যাণ্ডস-আপ) তখন অফিসার পাঞ্জাবী ভাষায় তাদের তিরস্কার করছিল। তার কথা শুনে পাঞ্জাবী সিপাইগুলো বলছিল, “দেখ, শালা পাঞ্জাবী ভি সিখ লিয়া।” এখন মনে হয় তাকে বাঙ্গালী অফিসার মনে করে হাত উঁচু করিয়েছিল। এইভাবে হাত উঁচু অবস্থায় তাদের অফিসারদের সামনে যাবার সাথে সাথে তারা (তাদের অফিসাররা) দুঃখ প্রকাশ করে। আমাদের অফিসার তাদের সাথে ঘণ্টাখানেক আলাপ-আলোচনার পর ফিরে আসে।

 আমি এই ঘটনা ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারকে বলি এবং এও বলি যে, “Sir, it is about time that we take some actions, otherwise it will be too late, “তিনি তখন বললেন আমি কি করতে পারি? আমি তাকে বললাম, “If you are so afraid of taking any action then I am going to take some actions. As far as your safety is concerened you can go to cantonment and tell them that thay (2 E Bengal pers) have all gone and no one listens to you. You will not be blamed for it as you have come only two days before. Neither you know the troops, nor they know you. If you want we will tic you and leave in one of the rooms and the Dacca authorities will not doubt you.” এ কথা বলার পর আমি উনাকে একটু চিন্তা করে দেখতে বললাম এবং বললাম আমি সমস্ত অফিসার জেসিও'দের এ ব্যাপারে ব্রিফ করছি। যে পাঞ্জাবী অফিসার টঙ্গীতে খবর নিতে গিয়েছিল সে গাজীপুর ফিরে না গিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসে। জয়দেবপুরে আরো দুইজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এবং কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য ছিল। তাদের মধ্যে গোপনে শলাপরামর্শ চলছিল। আমি এটা লক্ষ্য করেছিলাম। তাই এ অফিসারকে রীতিমত অর্ডার করে গাজীপুর পাঠিয়ে দিই।

 ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে কিছু লোক ঢাকা থেকে আসে। তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঢাকাতে বেশকিছু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর আগে ড্রাইভার ছাড়া আর কারো কাছে শুনতে পাইনি। ২৭শে মার্চ সকালে একজন লোক ধীরাশ্রম থেকে জয়দেবপুরে আসে। সে খবর নিয়ে আসে যে কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা ধীরাশ্রম রেলওয়ে  স্টেশনে ঢাকা থেকে এসেছেন এবং সেখানে বসে আছেন। তিনি আমার সাথে বা লেঃ কর্নেল মাসুদের সাথে দেখা করতে চান। আমি ঐ লোকটার সঙ্গে গোপনে দেখা করি এবং লেঃ কর্নেল মাসুদ ব্যাটালিয়নে নেই, উনি ঢাকায়। বর্তমান ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল রকিব। আপনি চলে আসুন, কোন অসুবিধা হবে না। বোধ হয় লেঃ কর্নেল রকিব ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার শুনে জয়দেবপুর আসতে সাহস পাননি। তাই তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

 ২৮ শে মার্চ সকালে ময়মনসিংহ থেকে মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে খবর পাঠায় যে ২৭/২৮ শে মার্চ রাতে তার সেনাবাহিনীর উপর পাকিস্তানী ইপিআররা হামলা চালিয়েছে। লড়াই এখনো চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারকে বললাম যে, আমাদের শিগগিরই ময়মনসিংহ রিইনফোর্সমেণ্ট পাঠানো দরকার। আমরা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেই যে, যেহেতু ঢাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিছিন্ন এবং ময়মনসিংহে আমাদের সৈন্যরা আক্রান্ত হয়েছে, সেহেতু আমাদের এখন তাদের সাহায্যে যাওয়া উচিত। ময়মনসিংহে যে আমাদের সৈন্যরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে একথা আমরা কাউকে বলিনি। আমাদের একথা গোপন রাখার একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল যে জয়দেবপুর থেকে সবাইকে এক সাথে নিয়ে যাওয়া এবং পথিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করা। এ ব্যাপারে আমরা এক পরিকল্পনা তৈরী করি। রাতে যাবার পরিকল্পনা এ জন্য করা হয়েছিল যে গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে আমাদের যে সব সৈনিকরা আছে তাদেরকেও যদি সাথে নিয়ে না যাই তাহলে তারা হয়ত আটকা পড়বে। যেহেতু দিনের বেলায় তাদের সরাতে গেলে অসুবিধা হতে পারে সেহেতু রাতে তাদেরকে সরানোর সময় বেছে নেয়া হয়। কেননা, গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে যে সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্য আছে তাদেরকে গোপনে সংবাদ দিতে হবে। আমরা যে জয়দেবপুর থেকে যাচ্ছি এটা সবাই জানত। কিন্তু গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সৈন্য সরাতে গেলে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে এ জন্য রাতে যেন বাঙ্গালী সৈন্যরা গোপনে বের হয়ে আসতে পারে তার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। আরো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল যে, আমি সারপ্লাস অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কিছুসংখ্যক সৈনিক নিয়ে সকাল দশটার দিকে ময়মনসিংহে যাত্রা করব। এবং লেঃ কর্নেল রকিব বাকী লোকদের নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রওনা হবেন। এই সময়টা যেন গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা যেন ঠিক ঐ সময় বেরিয়ে আসতে পারে। ওয়াপদার সাথে এটাও ঠিক হযেছিল যে, ঐ সময় গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর ও জয়দেবপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে- যাতে এ সমস্ত জায়গা থেকে আমাদের বের হতে কোন অসুবিধা না হয়। গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে লোক পাঠিয়ে ওদেরকে ঐ সময়ের মধ্যে বের হবার খবর দেওয়া হয়েছিল।

 ২৮ শে মার্চ সকাল দশটায় সমস্ত উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং যানবাহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। যাবার সময় লেঃ কর্নেল রকিব এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের নিয়ে তিনি সন্ধ্যার সময় রওনা হবেন। আমি জয়দেবপুর থেকে বের হবার পর চৌরাস্তা থেকে সমস্ত বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানদের মাঝে এক অভূতপূর্ব আনন্দের হিল্লোল সৃষ্টি হয় এবং সবাই উল্লাসে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে থাকে। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং আমাদেরকে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে অনুপ্রাণিত করে। তাদের মধ্যে কিছু লোক জানত আমরা কি করছি। যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় লোক আমাদের পরিকল্পনার কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জনাব আবদুল মোতালেব। তিনি একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের যাবার জন্য বেসামরিক ট্রাক, বাস, গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন।

 টাঙ্গাইলের কাছাকাছি যাবার পর দেখতে পেলাম অপরদিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটা জীপ গাড়ী আসছে। ঐ গাড়ীটা আমাদের কনভয়-এর কাছে এসে দাঁড়ায় এবং আমাদের গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে খুশী হয়। তারা বলে যে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমাদের লোকজন পজিশন নিয়ে আছে। আমরা তাদেরকে খবর দিয়ে আসি, যেন কোন অঘটন না ঘটে। কিছুক্ষণ পর আমরা টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করি। সেখানে ব্যাণ্ডপার্টিসহ এক উৎফুল্ল জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করে। জনতার এই উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু মনে মনে শুধু একটা চিন্তা করছিলাম যে, আমি যা করতে চলেছি এ কাজে আমি কি শুধু একা? না আরো কেউ আছে? যদিও একদিকে খুশী ছিলাম, অপরদিকে ভাবনাও কম ছিল না। কারণ আমি জানি আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই সাজা। কিন্তু তবু জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সঞ্চার হতো। টাঙ্গাইলে যাবার পর কে একজন আমাকে বললেন যে মেজর জিয়া নামে একজন চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ কথা শুনে আমার সাহস দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বেড়ে যায়। কারণ, তখন আমার মনে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এ কাজে আমি একা নই।

 টাঙ্গাইলের জনগণ আমাদেরকে যেভাবে সাহায্য করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ্যামুনিশেন বোঝাই একটা গাড়ীর অ্যাক্সেল ভেঙ্গে যাবার সাথে সাথেই সে অ্যাক্সেল তারা বদলিয়ে দেয়। আমি আমার সমস্ত সৈন্য এবং যানবাহন নিয়ে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে পৌঁছে যাই।

 টাঙ্গাইলে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল, তার কমাণ্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। টাঙ্গাইল কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে পৌঁছার সাথে সাথেই কোম্পানীর জেসিও আমাকে বলে যে, সে গত রাতে কোম্পানী কমাণ্ডারকে নিরস্ত্র করে রেখেছে। আমি তখন সমস্ত কোম্পানীকে একত্রিত করে লেঃ মোরশেদকে তাদের কোম্পানী কমাণ্ডার নিয়োগ করি। আর সমস্ত কোম্পানীকে এই বলি যে তোমরা সবাই ময়মনসিংহে চলে আস এবং ময়মনসিংহ পৌঁছার পর তোমাদের বাকী নির্দেশ দেব। এখন থেকে লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) তোমাদের কোম্পানী কমাণ্ডার আর তোমাদের কাছ থেকে এ ওয়াদা চাই যে তোমাদের কাছে আমি তোমাদের পুরাতন কোম্পানী কমাণ্ডারকে আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি! তোমরা তাকে তোমাদের সাথে নিয়ে আসবে। এবং আমার কাছে ময়মনসিংহ পৌঁছাবে। যেহেতু আমি ময়মনসিংহ যাবার জন্য তাড়াহুড়াতে ছিলাম সেহেতু বেলা দুটোর দিকে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে রওনা হই। তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়ে আসি যে, জয়দেবপুর থেকে লোক না আসার আগে তারা যেন টাঙ্গাইল ত্যাগ না করে।

 টাঙ্গাইল থেকে কয়েক মাইল যাবার পর প্রথম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই। এখানে বলে রাখা দরকার, ঢাকার খবর পাবার পরপরই জনসাধারণ টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তার মাঝে মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে। প্রথম যে প্রতিবন্ধকতা আমি দেখতে পাই সেটা ছিল একটা কাঠের পুল। জনসাধারণ সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এবং আগুন তখনও জ্বলছিল। পুলটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমার কনভয়কে অনেক দূর ঘুরে কোন কোন জায়গাতে নতুন রাস্তা করে যেতে হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা খুলে অগ্রসর হতে আমার বেশ সময় লেগে যায় এবং রাত প্রায় তিনটায় আমি মুক্তাগাছা পৌঁছি। মুক্তাগাছায়ও টাঙ্গাইলের মত কিছু লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। তারা আমাদের উপর গুলি করার আগেই আমরা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হই আমরা তাদের শত্রুনই। আমরা বাংলাদেশের সৈনিক। তখন বহু লোক বেরিয়ে আসে এবং রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ঐ রাত আমরা মুক্তাগাছা কলেজে কাটাই। আমাদের সাথে খাবার ছিল না। জনসাধারণ আমাদের খাবার ব্যবস্থা করে।

 ভোর হবার আগেই জয়দেবপুর এবং টাঙ্গাইলের লোকজন মুক্তাগাছায় পৌঁছে। মেজর মইন (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) আমাকে বলে যে সবাই এসে গেছে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কোথায়। উত্তরে বলল সে আসে নাই। আমি জয়দেবপুর থেকে আসার পূর্বোল্লিখিত পরিকল্পনার কিছুটা রদবদল হয়েছিল। তা নিম্নরূপ আমাদের লোকদের জয়দেবপুর থেকে সরিয়ে আনার কথা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার পরে মেজর মইনকে বলেছিলেন এ সময় বদলী করে ৮ টা করার জন্য। সময় ছিল বলে ঐ পরিবর্তিত সময় সবাইকে জানানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার মত ঠিক করতে পারছিলেন না। সন্ধ্যে সাতটায় মেজর মইনকে আবার বললেন যে সময়টা পরিবর্তন করে সাড়ে সাতটা করে দাও। মেজর মইন তাকে বলেছিলেন যে, এখন আর সবাইকে এই সময় সম্বন্ধে বলার সুযোগ হলো না, তাই এই সময়টা অপরিবর্তিত থেকে যায়। রাত ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। রাত ঠিক ৮টায় অয়ারলেস, যেটা অফিসার্স মেস-এর পূর্বাংশে ছিল, সেখান থেকে একজন পাঞ্জাবী সৈনিক আমাদের একজন সিপাইকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এই গুলির আওয়াজের সাথে সাথে চারিদিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের লোক একজন অপরজনের উপর মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তারা সজাগ ছিল সেহেতু আমাদের লোকের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই গোলাগুলিতে কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিক মারা যায়। কথামত পৌনে ৮টায় প্যালেসের বাইরে যে জীপ গাড়ী দাঁড়ানো ছিল সে জীপে করে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তিনি গাড়ীর কাছে না গিয়ে একজন পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে অফিসার্স মেস-এর দ্বিতলে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তাই হয়ত তিনি ঐ অফিসারের হাত থেকে সরে আসতে পারেননি। অথবা নিজে ইচ্ছে করে আসেন নি। কারণ ঐ সময় তাঁর ঐ জায়গাতে থাকার কথা ছিল না।

 গোলাগুলির পর ব্যাটালিয়ন-এর লোকজন সময়মত বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। গাজীপুর থেকে যখন লোক বেরিয়ে আসে তখন পাঞ্জাবী অফিসার বাধা দেওয়াতে তারা তাঁকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। জয়দেবপুরের লোক টাঙ্গাইল পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে এক গোলযোগের সৃষ্টি হয়। গোলযোগের সূত্রপাত এভাবে হয়েছিল যে, জয়দেবপুর থেকে যখন বাঙ্গালী সৈন্যরা বেরিয়ে আসছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ কথা বলার সাথে সাথে আমি যে অফিসারকে আমানত রেখে গিয়েছিলাম তার উপরে আক্রোশে গুলি চালানো হয় এবং সে মারা যায়।

 এ সমস্ত ঘটনার পর আমি দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করলাম যে আমাদেরকে এখন মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

 ২৯ শে মার্চ সকালে মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহ যাত্রা করি। যদিও দূরত্ব ছিল মাত্র ১০ মাইল তবুও এই পথ অতিক্রম করতে আমাদের প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছিল। ময়মনসিংহ পৌঁছার সাথে সাথে মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্নেল) বলল যে, গতকাল আড়াইটা পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে সবাই মারা গেছে, শুধু ছয়জন ছাড়া। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

 মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে ময়মনসিংহের ঘটনার যে বর্ণনা দেন তা উল্লেখ করছি। ২৬ শে মার্চ ময়মনসিংহে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর কোম্পানী ও ইপিআর-এর লোক জনসাধারণ কর্তৃক ঘেরাও হয়েছিল। তখন ইপিআর হেডকোয়ার্টার পেরিমিটারের বাইরে বাঙ্গালী সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল। তারা জনসাধারণকে সরে যেতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে উইং কমাণ্ডার (পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার) চালাকি করে বাঙ্গালী ইপিআর লোকদের বলে যে গতকাল তোমরা অনেক কষ্ট করেছ। আজ তোমরা রেস্ট কর। আজকের ডিউটি দেবে অন্য কোম্পানী (সে কোম্পানীটা ছিল সমস্ত পাঞ্জাবীদের)। আজ রাতে তোমাদের আর কোন ডিউটি হবে না। তোমরা হাতিয়ার জমা দিয়ে রেস্ট কর। যেহেতু চারিদিকে একটা থমথমে পরিবেশ ছিল সে কারণে কেউ হাতিয়ার জমা দেয়নি। সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ে। রাত প্রায় ১২টার মধ্যেই পাকিস্তানী ইপিআর-এর সৈনিকরা ইপিআর-এর যত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল তা তারা ছাদের উপর নিয়ে যায় এবং সমস্ত যানবাহন সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় যাতে যখন সমস্ত গাড়ী স্টার্ট করতে হেড লাইট অন করে তখন যেন সমস্ত আলো ইপিআর-এর বাঙ্গালীর যে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছে সে ব্যারাকের উপর পড়ে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানীর তাঁবুতে পড়ে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় তারা টেলিফোন যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়। মেজর নুরুল ইসলাম ও লেঃ মান্নান ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে সি-এণ্ড-বি রেস্ট হাউসে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে বারটায় রেস্ট হাউস-এর উপর তাদের কামরা লক্ষ্য করে অটোমেটিক গুলি ছোড়া হয়। প্রথমে তিনি টেলিফোনে কোম্পানীর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি এবং লেঃ মান্নান পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নদীর দিকে চলে যান। এবং সেখান থেকে ময়মনসিংহ শহরে যান। সকাল না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোম্পানীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারেননি। ভোরে যখন যোগাযোগ হয় তখন ভীষণভাবে দুই দলের মধ্যে গোলাগুলি চলছিল। এই গোলাগুলি বেলা দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই গোলাগুলিতে ৬ জন পাকিস্তানী ছাড়া আর সবাই মারা যায়। অবশিষ্ট ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে ময়মনসিংহ জেলে রাখা হয়। আমি ময়মনসিংহ পৌঁছার সাথে সাথে এ সমস্ত ঘটনা শুনতে পাই।

 ২৯ শে মার্চ বিকেল চারটা পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন-এর সমস্ত লোক কনসেনট্রেট হয়। রাজেন্দ্রপুর কণ্টিনজেণ্ট রাত্রে পৌঁছে। আমি ময়মনসিংহে পৌঁছে আমার পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য সীমান্ত থেকে সমস্ত ইপিআরকে ময়মনসিংহে এসে কনসেনট্রেট হতে অর্ডার দিলাম। তারপর আমি ময়মনসিংহ পুলিশ অয়ারলেসে গিয়ে বাংলাদেশের যত জায়গাতে পুলিশ অয়ারলেস কমিউনিকেশন আছে সবাইকে লক্ষ্য করে এই নির্দেশ দিলাম যে, আমি মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছি। বর্তমানে ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা আমার নিয়ন্ত্রণাধীন আছে। আপনারা যে যেখানে আছেন, যদি বাঙ্গালী হন, যার কাছে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং দেশকে পাকিস্তানীদের কবল থেকে স্বাধীন করতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করুন। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে আমি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেলাম। যে সমস্ত জায়গা থেকে আমি কনফারমেশন পেয়েছি যে তারা অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেসব জায়গা হল- দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, ফেনী এবং চট্টগ্রাম।

 ২৯ শে মার্চ বিকেলে জেলা এডমিনিস্ট্রেশন-এর সমস্ত অফিসারবৃন্দ, জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এম-এন এ এবং এম-পি এদেরকে নিয়ে এক বৈঠক করি। সেই বৈঠকে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে তার পরিকল্পনা নিই। জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সামরিক বাহিনীকে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করার ভার বেসামরিক প্রশাসন এবং এম-এন ও এম-পি দের উপর ন্যস্ত করা হল। তাঁরা বেশ আগ্রহের সাথে এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার হাতে রাখি। এই বৈঠকে এও সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন। এবং সেটা পাবার জন্য আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের প্রস্তাব পেশ করা দরকার। তাই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, আমাদের একজন এম-এন-একে দিল্লী পাঠানো হবে আমাদের প্রস্তাব দিয়ে। আমরা এম-এন এ জনাব সৈয়দ আবদুস সুলতানকে বাংলাদেশের দূত হিসেবে দিল্লীতে আমাদের এ প্রস্তাব কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করার জন্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিই। এ সিদ্ধান্তও নেয়া হল যে তাকে সীমান্তের বাইরে পাঠাবার পূর্বে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা দরকার যে তারা আমাদের গ্রহণ করবে কিনা। এই মর্মে আমি একজন অফিসারকে (ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, বর্তমানে মেজর) হালুয়াঘটে বিএসএফ-এর সাথে যোগাযোগ করতে পাঠাই। সে ওখানে পৌঁছার পর বি-এস-এফ-এর একজন অফিসার ক্যাপ্টেন বালজিতের সাথে দেখা করে। সেখানে ক্যাপ্টেন ছাড়াও আরো দু'জন অফিসার ছিলেন। একজন লেঃ কর্নেল সিনহা। তিনি ছিলেন ইণ্টেলিজেন্স-এর লোক এবং আর একজন ছিলেন সেখানকার বিএসএফ কমাণ্ড্যাণ্ট। তাদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলে। তাঁরা আমাদের সব কিছু দিয়ে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমি সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করি।

 ৩০ শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ইপিআর, পুলিশ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং কিছু আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলি। যার লোকসংখ্যা ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ময়মনসিংহে যখন পৌঁছি তখন আমার সাথে অনেক জেসিও এবং নিন্মলিখিত অফিসার ছিলেন: ১। মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্নেল)। ২। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরি (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)। ৩। মেজর নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)। ৪। ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর)। ৫। ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরী। ৬। লেঃ গোলাম হেলাল মুরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)। ৭। লেঃ ইবরাহীম। এছাড়া ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বর্তমানে মেজর) যিনি ময়মনসিংহে ছুটিতে ছিলেন তাকে আমি সাথে নিয়ে নিই। তাকে বলার সাথে সাথে সে আমার ব্যাটালিয়নে যোগ দেয়। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কাজী নুরুজ্জামান ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যোগ  দেন। ময়মনসিংহ থেকে যাবার পথে দুইজন মেডিকেল কলেজের ডাক্তার নিয়ে নিই। তারা হচ্ছে ডাঃ আবদুর রহমান এবং ডাঃ আহমদ আলী।

 ময়মনসিংহ পৌঁছে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোথায় কি করছ সে খবর নেওয়ার জন্য আমার অয়ারলেস দিয়ে মনিটরিং করি। এবং যে সমস্ত খবর পাই তন্মধ্যে ২৯শে মার্চের বিকেলের খবর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঐ দিন ১৪ ডিভেশন-এর হেডকোয়ার্টারের কর্নেল সাদুল্লাহ এবং যশোর বিগ্রেডের বিগ্রেড মেজরের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তার মধ্যে নিম্নলিখিত উক্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কর্নেল স্টাফ রীতিমত বিগ্রেড মেজরকে গালিগালাজ করে বলছিলেন, “You have been routed by rag-tags. You people have no shame, How could you be routed by unarmed people? You need kick. However, tell your commander, if he needs any help, we will send air sorties. We are in any way sending two air-sorties to Kushtia circuit house. We have been able to tackle Dacca which did not bother us much. We are really concerned about Kushtia now. We have captured 8.L.B.Hq. We are now proceeding towards Radio Station.In the process we have suffered a lot of casualties. Send a c - 130 (Transport Aircraft) tomorrow to Chittagong, so that the dead and the wounded can be sent Dacca. If it cannot come then send an “Allwate" (IIcliopter) to naval basc at 10-30. If c-130 can come then. “Allwater” is not required.” এবং তারা এখন হয়ত ঢাকা থেকে এসব জায়গায় রি- ইনফোর্সমেণ্ট পাঠাবে। আমার আরো চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে যখন জিওসিএর মেসেজ শুনলাম যে ৮ ইস্ট বেঙ্গল হেডকোয়ার্টার দখল করা হয়েছে তখন সাথে সাথে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি যে মেজর জিয়া (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) তার দলবল নিয়ে হয়ত ধরা পড়ে গেছে। এমতাবস্থায় সেখানে এমন কোন অফিসার জানামত ছিল না যে নেতৃত্ব দিতে পারবে। আমি তখন এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে অতিশীঘ্র ঢাকা আক্রমণ করা উচিৎ যেন ঢাকা থেকে কোন রি-ইনফোর্সমেণ্ট বাইরে না যেতে পারে।

 এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য নিন্মলিখিত পরিকল্পনা নিলাম- নর্থ বেঙ্গল থেকে যাতে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের দিকে না আসতে পারে সেই জন্য পুলিশ এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক সৈনিকদের নিয়ে গঠিত এক কোম্পানী সৈন্য বাহাদুরবাদ ঘাটে পাঠাই। আর কোম্পানী ইপিআর সিরাজগঞ্জ ঘাটে পাঠাই। এক কোম্পানী ইপিআর এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক কোম্পানী গফরগাঁওয়ে পাঠাই। এক কোম্পানী ইপিআর পাঠাই টাঙ্গাইলে। ৩১ শে মার্চের মধ্যেই এরা এ সমস্ত জায়গায় পৌঁছে যায়। এ ছাড়া আরো দুই কোম্পানী লোক (ইপিআর) ঢাকার পশ্চিমাংশ মীরপুর, মোম্মদপুর এবং ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ১লা এপ্রিলের মধ্যে আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠাই। আমি আমার ব্যাটালিয়ান এবং ইপিআর-এর একটি কোম্পানী নিয়ে ঢাকার পূর্বদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নিই। এ পরিকল্পনা আমি এ জন্য নিই যে, পাকবাহিনী প্রত্যাশা করছিল যে আমরা যদি তাদেরকে আক্রমণ করি তাহলে পশ্চিমাংশ দিয়ে করব। তাই তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য পূর্বাংশ দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এদিক দিয়ে আসার জন্য আমি যে রাস্তা ব্যবহার করেছিলাম তা ছিলো ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব- নরসিংদী ট্রেনে। তারপর নরসিংদী থেকে পায়ে হেঁটে ভাংগা দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ঢাকায় পূর্বাংশ দিয়ে আক্রমণ করব। এই পরিকল্পনাও যেন ১লা এপ্রিলে বাস্তবায়িত হয় তারও ব্যবস্থা করি।

 ৩০ শে মার্চ আমি যখন জায়গায় জায়গায় নির্দেশ দিয়ে লোকজন পাঠাচ্ছিলাম তখন গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার সকাল সাড়ে এগারোটায় টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন এবং বলেন যে দু'খানা জেট জঙ্গী বিমান জয়দেবপুরের প্যালেস ভীষণভাবে আক্রমণ করেছে এবং স্ট্রাফিং করছে। তার প্রায় ১৫ মিনিট পর আবার টেলিফোনে বললেন যে আর একখানা জঙ্গী বিমান জয়দেবপুর প্যালেসে বড় বড় বোমা ফেলছে। তাতে বিকট আওয়াজ হচ্ছে এবং প্রাসাদে আগুন লেগে গেছে। এ সংবাদ শুনে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে আমরা ঠিক সময় বেরিয়ে পড়তে পেরেছি। আমাদের মনে কোন দ্বিধা রইল না যে আমরা কোন ভুল করিনি। বরং ঠিকই করেছি।

 আমরা পূর্বপরিকল্পনা মত লোকজন জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিই। আমি আমার বাহিনী নিয়ে ৩০ শে মার্চ ট্রেনযোগে নরসিংদীর দিকে রওয়ানা হই। অল্পসংখ্যক কম্পার্টমেণ্টে আমরা এক সাথে সবাই যেতে পারছিলাম না। তাই অল্প অল্প করে গন্তব্যস্থানে পাঠাচ্ছিলাম।

 ময়মনসিংহ থেকে চলে আসার পূর্বে আমি জনগণকে আশ্বাস দিলাম যে আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছি। ৩০ শে মার্চ আমি আমার হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ স্থানান্তরিত করি। কিশোরগঞ্জে ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমান মেজর) নামে আর একজন অফিসারের সাথে দেখা হয়। সে তখন বাড়িতে ছিল। তাকে বলার সাথে সাথে সেও আমাদের সাথে যোগ দেয়।

 ৩১ শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের লোক গন্তব্য স্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যারা সর্বপ্রথম রওয়ানা হয়েছিলো ১লা এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত ঢাকার পূর্বাঞ্চল বাসাবো, ডেমরা এ সমস্ত স্থানে গিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। সেদিন আমি কিশোরগঞ্জে অবস্থান করছিলাম। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একটি খবর আসলো যে মেজর খালেদ মোশাররফ (বর্তমান কর্নেল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাবডিভিশন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন রেখেছেন এবং তিনি আমার সাথে কথা বলতে চান। আমি যখন তাঁকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম তখন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যে আমি যেন ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর না হয়ে তার সাথে যোগাযোগ করি। ঐ দিনই আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে যাই। আমার সৈনিকরা যারা ঢাকার অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল আমি তাঁদের আর বাধা দিইনি। মেজর খালেদ মোশাররফ কি বলতে চান তা জানার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর সাথে দেখা করতে চাই। আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছি তখন খালেদ সেখানে ছিলেন না। তিনি তার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর শাফায়াত জামিল (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)-কে মেসেজ দিয়ে পাঠান। এরপর আমি ফিরে আসি। আমি যেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেরার পথে দু'খানা জঙ্গী বিমান আমাদের তাড়া করে। বেশ কিছুক্ষণ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে স্ট্রাফিং-এর পরে তিতাস গ্যাস ওয়েল ট্যাঙ্কার-এর উপর বোমাবর্ষণ করে এবং এতে আগুন ধরে যায়। আমাদের সৈনিকরা যারা ভৈরবে ছিল তাদেরকেও জঙ্গী বিমান দুটো খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু না পেয়ে তারা নরসিংদীতেও খোঁজাখুঁজি করে। আমাদের সন্ধান কোথাও পায়নি। দিনটি ছিল ১লা এপ্রিল।

 মেজর খালেদ মোশাররফ মেজর শাফায়াত জামিল মারফত আমার নিকট যে মেসেজ পাঠান তা ছিল নিন্মরূপঃ “Do not go towards Dacca. You will be banging your head against wall. We have liberated an arca whole of Brahmanbaria Subdivision and a part of Sylhet. Before taking any further action on Dacca, we should jointly liberate this whole area and then go for Dacca. I had already contacted Indian BSF officers and they have agreed to help us. I could not come and meet you today because I am going to meet Brigadier B. C. Panda of BSF who promised me to help us.”

 তার পরিকল্পনা আমার মোটামুটি পছন্দ হলো। কারণ, আমি জানি যে তখন ঢাকাতে পাকিস্তানের যে সমস্ত সৈনিক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে আমাদের তার ১০ ভাগের এক ভাগও নেই। তাই যাতে আমরা যুক্তভাবে একটা পরিকল্পনা নিতে পারি সেই চিন্তা আমি করছিলাম। এবং আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে, আমাদের এভাবে তাড়াহুড়া করে ঢাকা আক্রমণ করা ঠিক হবে না। আমি তখন আমার অফিসারদের নির্দেশ দেই যে যারা ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হয়েছে তারা যেন নিম্নরূপ মোতায়েন হয়ঃ এক কোম্পানী যেন ঢাকা- নরসিংদী রাস্তা পাহারা দেয়। এক কোম্পানী আশুগঞ্জ আর বাকী লোক যেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসে। ঢাকার পূর্বাংশ ও পশ্চিমাঞ্চলে যে সমস্ত সৈনিক গিয়েছিল তাদের সাথে পাকবাহিনীর ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়। আমার সাথে পর্যাপ্ত অয়ারলেস সেট না থাকায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে যারা ছিল তাদের সাথে একমাত্র দূত (রানার) ছাড়া আর কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না।

 খালেদ মোশাররফের সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন পরিকল্পনা নেয়া হয় যে আমরা যুক্তভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেট এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করব। এই পরিকল্পনাকে আমি বাস্তবায়িত করার জন্য আমার হেডকোয়ার্টার কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া টি, গার্ডেনে ৩রা এপ্রিল স্থানান্তরিত করি। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ বা ভৈরববাজার যাবার সময় আমাদের যানবাহনগুলি নেবার জন্য মালগাড়ীর ওয়াগনকে ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে কেটে জায়গা করা হয় এবং গাড়ি পার করার ব্যবস্থা করা হয়। ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন থেকে সবাইকে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার পর ১৫০০ রাইফেল, প্রায় ২০টা এল-এমজি, কিছুসংখ্যক স্টেনগান আর ৩ লক্ষ এ্যামুনিশন আমি আমার সাথে নিয়ে আসি। আমাদের ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এই আমস এ্যামুনিশন ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।

 ১লা এপ্রিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে যে এলাকা ছিল তা এরূপঃ মেঘনার পশ্চিম পাড়ে নরসিংদী- তারাবো-ঢাকা রাস্তা আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। ব্রাহ্মবাড়িয়া সাবডিভিশন মেঘনার পূর্বপারে যেখানে আমি আমার সৈনিকদের মোতায়েন করেছিলাম সে জায়গাগুলো হল উত্তরে আজবপুর, তারপর আগঞ্জ এবং সবচেয়ে দক্ষিণে লালপুর, উত্তরে সিলেটের শেরপুর, শাদীপুর এবং শেওলা করিমগঞ্জও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পূর্ব এবং দক্ষিণাংশে মেজর (বর্তমান কর্নেল) খালেদ মোশাররফের সৈন্যরা ছিল। যে সব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল তা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর, গোকর্ণঘাট, উজানিসার পুল এবং গঙ্গাসাগর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিওর ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকার রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বেসামরিক যানবাহন, ট্রাক, বাস একত্রিত হয়। এই ট্রাক বাস দ্বারা দুই কলাম ফোর্স তৈরী করা হয় যার এক কলাম ২রা এপ্রিল টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হয় এবং আর এক কলাম নরসিংদীর দিকে রওয়ানা হয়। যে কলামে টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা হয়েছিল আমার টাঙ্গাইলে প্রেরিত কোম্পানী তাদেরকে রাস্তায় এ্যামবুশ করে। এই কলামে প্রায় ১০০টির বেশী গাড়ী ছিল। এ এ্যামবুশ এত সুন্দর হয়েছিল যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেশকিছু লোক হতাহত হয়। হতাহতের সংখ্যা বলা যাবে না। তবে লোকমুখে শোনা যায় যে আহতদের নিয়ে যাবার জন্য ছয়খানা গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অপারেশনে আমাদেরও কিছু লোক মারা যায়। এই খবর পাই মেসেজের মাধ্যমে। এই পশ্চিমাংশের লোকদের খবরাখবর ততদিন পর্যন্ত পাই, যতদিন তারা মধুপুর জঙ্গল থেকে যুদ্ধ চালাচ্ছিল।

 যে কলাম সৈন্য ঢাকা থেকে নরসিংদী রওয়ানা হয়েছিল তারা আমাদের কোম্পানীর দ্বারা নরসিংদী এবং পাঁচদোনার মাঝামাঝি জায়গায় আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণে পাকিস্তানের সৈন্যদের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা পিছে হটে যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনা ঘটে ২রা এপ্রিল। তারা ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর সাহায্য চায়। যেহেতু বিমান বাহিনী অন্যান্য জায়গায় ব্যস্ত ছিল সেহেতু বিমান বাহিনী সেদিন তাদের সাহায্যে আসতে পারেনি। কিন্তু পরদিন তাদের আর্টিলারি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের সৈনিকরা যে জায়গাতে ছিল সেই জায়গাতে পাঁচদোনা-নরসিংদীতে ভীষণভাবে আর্টিলারী গোলাবর্ষণ শুরু হয়। আমাদের নিকট দূরপাল্লার কোন অস্ত্রই ছিল না, রাইফেল এবং লাইট মেশিনগান ব্যতীত। তাই আমরা তাদের পাল্টা জবাব দিতে পারিনি। এভাবে তারা ৪৮ ঘণ্টা যাবৎ আমাদের উপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। ৩রা এপ্রিল আর্টিলারী গোলাবর্ষণ ছাড়াও জঙ্গী বিমান ও আমাদের উপর ব্যাপকভাবে স্ট্রাফিং করে। শত্রুর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ এই ছিল আমাদের প্রথম। সৈনিকরা এ রকম গোলাবর্ষণের সম্মুখীন আর কখনো হয়নি। তাই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পেছনে সরে আসে। আমরা বেশকিছু সংখ্যক সৈনিককে ভৈরবে একত্রিত করতে সক্ষম হই এবং পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভৈরবের পূর্বাংশে রামপুরা ব্রীজের কাছে মোতায়েন করি-যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় ভৈরব পৌঁছতে না পারে। ৩রা এপ্রিল এই পরিকল্পনা নিই যে, যেহেতু আমাদের সৈন্যদের কম সেহেতু পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য ডিনায়াল প্লান গ্রহণ করি। এর উদ্দেশ্য, রাস্তাঘাট, রেলওয়ে ব্রীজ, রোড ব্রীজ ভেঙ্গে দেয়া যাতে শত্রুরা অতি সহজে সম্মুখে আসতে না পারে। ডিনায়াল প্লান-এর প্রথম আমরা ভৈরবের কাছে রামপুরের ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলি। আর কিশোরগঞ্জের কাছে রোড এবং রেলব্রীজ দুটোই ভেঙ্গে দিই। ভৈরবের ব্রীজ ভাঙ্গারও পরিকল্পনা নিই।

 ৪ঠা এপ্রিল দেখা হয়ে গেল কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল)-এর সাথে আমারই হেডকোয়ার্টারে তেলিয়াপাড়াতে। তিনি আগরতলা থেকে তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনিই সেই ওসমানী যাকে আমি ভালোভাবে চিনতাম। আমি তাকে চিনতে পারিনি এই জন্যে যে আত্মগোপন করার জন্য গোঁফ কেটে রেখেছিলেন। ঐ দিনই আমি খবর পেলাম যে জিয়াউর রহমান (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) চট্টগ্রাম থেকে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আমার কাছে আসছেন।

 একটা কথা বলা দরকার, ৪ঠা এপ্রিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মস্ত বড় দিন। সেদিন আমার হেডকোয়ার্টারে অনেক সিনিয়র অফিসার একত্রিত হয়েছিলেন। যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেনঃ ১। কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল, বিমান ও নৌযান মন্ত্রী), ২। মেজর জিয়াউর রহমান (বিগ্রেডিয়ার), ৩। মেজর খালেদ মোশাররফ (কর্নেল), ৪। লেঃ কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা (রিটায়ার্ড কর্নেল), ৫। মেজর কাজী নুরুজ্জমান (রিটায়ার্ড লেঃ কর্নেল), ৬। মেজর নুরুল ইসলাম (লেঃ কর্নেল), ৭। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (লেও কর্নেল), ৮। লেঃ কর্নেল আবদুর রব (রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল, বর্তমানে এম-পি) এবং অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। তিনি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। It was decided that day, that the operation for liberation war to be conducted under one command and the commander being colonel M.A.G. Osmany (now rtd. General osmany).

 ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে এই অনুরোধ করি যে যত শীঘ্র হোক রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা যেন সরকার গঠন করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার গঠিত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোন বৈদেশিক সাহায্য পাব না। ঐ দিন অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে এটাও সাব্যস্ত হল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার উপর ন্যস্ত থাকবে। কুমিল্লা-নোয়াখালী এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার যুদ্ধ পরিচালনার ভার মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফের উপর ন্যস্ত করা হয়। চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধ পরিচালনার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের উপর। এই সিদ্ধান্তের পর আমরা যার যার এলাকার সৈন্য মোতায়েন করি।

 ৪ঠা এপ্রিল আমার বাহিনী নিন্মলিখিত এলাকায় নিযুক্ত থাকেঃ প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য নরসিংদীতে, এক কোম্পানী আজবপুরে, এক কোম্পানী আশুগঞ্জে, এক কোম্পানী লালপুরে, এক কোম্পানী সিলেটের শেরপুরে ও শাদিপুরে, এক কোম্পানী সরাইলে (এই কোম্পানী আমার রিজার্ভ কোম্পানী ছিল)। তাদের উপর দুটো টাস্ক দেয়া হয়েছিল। প্রথম টাস্ক হল, যদি দরকার হয় ঢাকার দিক থেকে পাকসৈন্যরা আক্রমণ বৃদ্ধি পেলে লালপুর এবং আশুগঞ্জে যেসব সৈনিক আছে তাদের সাহায্যার্থে তালশহর এবং গোকনঘাট এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করবে। দ্বিতীয় টাস্ক হল, যদি সিলেটের দিকে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ বৃদ্ধি পায় তাহলে শেরপুরে সৈন্যদের সাহায্যার্থে যেন মৌলভীবাজারে সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়। এসব কোম্পানী ছাড়াও মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের অনুরোধে চট্টগ্রামের সৈনিকদের রি- ইনফোর্সমেণ্ট-এর জন্য আমাকে এক কোম্পানী সৈন্য তাকে দিতে হয়। ৫ই এপ্রিল তারা আমার কাছ থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। এবং সে কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যে রাস্তা কুমিল্লার দিকে চলে গেছে সে রাস্তার উপর নজর রাখার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশারফের উপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করার জন্য উজানিসা পুলের নিকট এক কোম্পানী, গংগা সাগরে এক কোম্পানী এবং গোকনঘাটে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন করেন।

 যেহেতু আমার সুদক্ষ সৈনিকের অভাব ছিল সেহেতু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, প্রাক্তন ইপিআর, পুলিশ এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোক নিয়ে এই সমস্ত কোম্পানী পুনর্গঠন করা হয়।

 সৈন্যসংখ্যা আমাদের কম থাকায় ৪ঠা এপ্রিল থেকেই আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ যুবক ট্রেনিং নিচ্ছিল। অল্প সংখ্যক অফিসার এবং ইনস্ট্রাকটর নিয়ে আমি এই ট্রেনিং শুরু করি। আমার যে সমস্ত অফিসার ছিল তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কোম্পানী নিয়ে ৪ঠা এপ্রিল নিম্নলিখিত জায়গাতে মোতায়েন ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নরসিংদীতে, ক্যাপ্টেন নাসিম আশুগঞ্জে, লেঃ মুরশেদ লালপুরে, ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলে, ক্যাপ্টেন আজিজ শেরপুর কাদিপুরে, ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী চট্টগ্রাম অভিমুখে, মেজর মইন তেলিয়াপাড়াতে তার কোম্পানীর সাথে, মেজর নুরুল ইসলাম ট্রেনিং দেওয়ার জন্য এবং লেঃ ইব্রাহীম আমার হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে। ৫ ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান আমার সাথে যোগ দেয়। (নুরুজ্জামান যোগ দিয়ে তার পরিবারকে আনার জন্য রায়পুরাতে চলে যায় এবং ২৬শে জুন পুনরায় যোগদান করে।)

 আমাকে সিলেট থেকে ভৈরব এবং নরসিংদী পর্যন্ত সৈনিকদের তত্ত্বাবধান করতে হত। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, জয়দেবপুর থেকে যেদিন আমরা বেরিয়ে এসেছি ঐদিন থেকে আমাদের খাওয়া- দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, আমরা যখন যেখানেই ছিলাম ঐ জায়গার জনসাধারণ আমাদের খাবার ব্যবস্থা করত। তাই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। যাঁরা আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ নরসিংদীতে মিজানুর রহমান (একজন স'মিল ম্যানেজার), আশুগঞ্জে মোঃ শফিউদ্দীন, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রাক্তন এমপিএ সাচ্চু মিঞা, এবং সিলেটের সাবু চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলকাস মিঞা।

 ৪ঠা এপ্রিল আমি সিলেট অভিমুখে যাত্রা করি আমার যে কোম্পানী সৈন্য শেরপুর, শাদিপুরে পাঠিয়েছি তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনা দেবার জন্য। মৌলভীবাজার গিয়ে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) চিত্তরঞ্জন দত্তের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেখানে মেজর দত্ত এমএনএ মানিক চৌধুরী, কিছুসংখ্যক প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকজনকে নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেন। আমি মৌলভীবাজারে গিয়ে তাদের কাছে আমার মনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করি। আমার সৈনিক এবং তাদের গঠিত বাহিনী নিয়ে সিলেট জেলাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সিলেটে তখন এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী সৈন্য ছিল। আমার কাছে তখন আমার নিজস্ব এক কোম্পানী সৈনিক এবং কর্নেল দত্তের দ্বারা গঠিত আরো প্রায় দুই কোম্পানী সৈনিক ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের নিকট যে সৈন্য রয়েছে তাদের দ্বারা সিলেট শত্রুমুক্ত করতে হলে আমাদের দুই পর্যায়ে এই আক্রমণ চালাতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলকে মুক্ত করা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সুরমা নদীর উত্তরাঞ্চল যুক্ত করা।

 এই প্রথম পর্যায় সম্পন্ন করার জন্য পাকিস্তানী যত সৈনিক সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে ছিল তাদের পরাজিত করতে তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করি। এক কোম্পানী শেরপুর থেকে সিলেটের দিকে প্রধান সড়ক দিয়ে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হয়। এক কোম্পানী ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে রেললাইন ধরে অগ্রসর হয়, আর এক কোম্পানী শেওলা করিমগঞ্জের দিক থেকে সুরমা নদীর দক্ষিণ পার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়।

 এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে এক খণ্ডযুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং তারা পলায়ন করে শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত হয়। ৫ই এপ্রিল সুরমা নদীর সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং সুরমা নদীর উত্তরে সিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়ে আমাদের হস্তগত হয়। প্রাক্তন ইপিআর-এর কিছুসংখ্যক লোক যারা সুনামগঞ্জে ছিলেন তারাও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। ঐ দিন পর্যন্ত আমাদের আয়ত্তাধীনে যে সমস্ত এলাকা ছিল তা হল: সমস্ত সুরমা নদীর দক্ষিণে এবং পশ্চিমে সমস্ত অঞ্চল, সিলেট শহর এবং খাদিমনগর। আমাদের কাছে সৈন্য ছিল মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী এবং প্রাক্তন ইপিআর-এর তিন কোম্পানী, যারা সমস্ত এলাকাকে ঘিরে রাখে। পাকিস্তানের যে সৈনিক ছিল তারা এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী। তারা শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত হয়েছিল। পাকিস্তানীদের কাছে আধুনিক, মারাত্মক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। যে ব্যাটালিয়ন সেখানে ছিল সেটা হল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট।

 প্রথম পর্যায় শেষ করার পর আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দিই, যে-এলাকা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানে যেন শত্রুরা ব্যুহ ভেদ না করতে পারে। সে জন্য সজাগ দৃষ্টি রেখে সে এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে বলি। দ্বিতীয় পর্যায় অপারেশন আমি সাথে সাথে শুরু করতে পারছিলাম না, এজন্য যে, শত্রুসন্যের সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাই সবাইকে পরিখা খনন করে বৃহ প্রস্তুত করতে বলি।

 পাক সৈনিকরাও তখন বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিল। তাদের মনোবলও লোপ পেয়েছিল। আত্মসমর্পণের ইচ্ছা থাকলেও তাদের মনে আশংকা ছিল যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। তাই আত্মরক্ষার জন্য তারাও চারিপার্শ্বে পরিখা খনন করে ব্যুহ তৈরী করল। আমি তখন চিন্তা করছিলাম যে অন্য কোথাও থেকে এখানে সৈন্য আনা যায় কিনা। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে কোন সৈন্য সরাতে পারছিলাম না এইজন্য যে তখন নরসিংদীতে লড়াই চলছিল। পাকিস্তানীরাও তখন নীরব থাকেনি। তারা পিআইএ ফোকার ফ্রেণ্ডশীপ এবং সি-১৩০ বিমানের সাহায্যে সিলেটে রি-ইনপোর্সমেণ্ট শুরু করে। আমাদের শুধু সৈন্যই কম ছিল না, অস্ত্রশস্ত্রেরও অভাব ছিল যথেষ্ট। আরো অধিক সৈন্য কিভাবে যোগাড় করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য মৌলভীবাজারে মেজর দত্ত (বর্তমানে কর্নেল দত্ত) এবং এমএনএ মানিক চৌধুরীর সংগে মিলিত হই। এই সাক্ষাৎকার ঘটে ৮ই এপ্রিল। ঐ দিন শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য বেশকিছুসংখ্যক বেসামরিক লোককে একত্রিত করে পাকিস্তানীদের ব্যূহের পশ্চিমাংশ দিয়ে মহড়া দেখানো বা শো করানো যেন এই সুযোগে খাদিমনগরের দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শালুটিকার বিমান ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাতে পারি। এ সমস্ত লোক একত্রিত করার দায়িত্ব নেন এমএনএ মানিক চৌধুরী। ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত লোক যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তানী রি-ইনফোর্সমেণ্ট বেশ হয়ে যায় এবং ৯ই এপ্রিল দিবাগত রাত্রে পাকিস্তনীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে সারারাত লড়াই চলে এবং অবশেষে আমরা পিছনে হটতে বাধ্য হই। এ লড়াইয়ে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হন এবং পাঁচজন আহত হন। যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন হাওলাদার কাজী মোসলেহউদ্দীন ও ল্যান্সনায়েক আবদুর রহমান। শত্রুপক্ষেরও বেশ হতাহত হয়। তাদের দূরপাল্লার কামানের গোলার মুখে আমরা টিকতে পারছিলাম না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানও আমাদের উপর আক্রমণ চালায়।

 সেখান থেকে আমরা পিছু হটে আবার শেরপুরে ব্যূহ নির্মান করি এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনার জন্য আবার মৌলভীবাজারে মিলিত হই। ঐদিন কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল), মেজর কাজী নূরুজ্জামানও (অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) মৌলভীবাজারে উপস্থিত হন। যেহেতু আমাকে সিলেট ও নরসিংদীতে যুদ্ধের পরিকল্পনা তত্ত্বাবধান করতে হয়েছিল এবং নরসিংদীতে যুদ্ধ চলছিল। সেহেতু মেজন কাজী নূরুজ্জামান এবং মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তকে সিলেটের যুদ্ধের পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। মেজর নূরুজ্জামান সিনিয়র হওয়াতে তাকে অধিনায়ক করা হয়। যে সমস্ত সৈন্য যুদ্ধের জন্য আমি সিলেট নিয়েছিলাম তাদেরকে রেখে আসি। ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট থেকে এক কোম্পানী সৈন্য সিলেট এবং এক কোম্পানী সৈন্য চিটাগাং পাঠাবার পর আমার নিকট মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দুই কোম্পানী সৈন্য থেকে যায়। তাদের দ্বারা আমাদের ঢাকা থেকে অগ্রসরমান এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্যের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল।  আমি এই দুই কোম্পানী সৈন্য প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক জনগণ দ্বারা এক ব্যাটালিয়নের মত সৈন্য আবার তৈরি করি। তাদের দ্বারাই আমি পাকিস্তানী সৈনিকদের মোকাবেলা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। এবং আজবপুর, ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর এবং গোকনঘাটে এক ব্যূহ তৈরি এবং শত্রুদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকি।

 ১১ই এপ্রিল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভৈরব এলাকায় পাকবাহিনী হেলিকপ্টার এবং জঙ্গী বিমানের সাহায্যে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাপকভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। আমাদের নিকট কোন বিমানবিধ্বংসী কামান ছিল না বলে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারিনি। পাকসেনাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে ১৩ই এপ্রিল আমি কিছুসংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভৈরব, আশুগঞ্জের দিকে পাঠাই যেন মেঘনা নদীর পূর্বপারের এলাকাগুলোতে আমরা বেশ শক্তিশালী থাকতে পারি। ঐ সমস্ত ছেলেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পাক বাহিনীর জংগী বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দুজন তরুণ শহীদ হয়। এর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন সৈনিক ছিলেন। তার নাম সিপাই মোহাম্মদ মোহসীন। ট্রেনিং প্রাপ্ত যে ছেলেটি শহীদ হয় তার নাম জানা নেই। ঐ দিন আমাদের অপারেশনাল কো-অর্ডিনেশনের জন্য মৌলভীবাজার যেতে হয়। আক্রমণের কথা শুনে আমি মৌলভীবাজার থেকে ১৩/১৪ই এপ্রিল রাত দুটার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে ভোরে প্রায় ৫টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সেদিন কর্নেল রেজা ছিলেন। পাকবাহিনীর আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়াতে আমি সরাইলে যে রিজার্ভ কোম্পানীকে রেখেছিলাম তিনি সেই কোম্পানীকে লালপুরে আমাদের লোকদের সাহায্যার্থে পাঠান। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছে এ খবর পাই যে সরাইলে আমার যে রিজার্ভ কোম্পানী ছিল, তারা লালপুর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে। অয়ারলেস সেট না থাকাতে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হচ্ছিল। কারণ, করো সাথে কিছু বলতে হলে আমাকে রানার দ্বারা অথবা নিজে গিয়ে যোগাযোগ করতে হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই রিজার্ভ কোম্পানীকে ইচ্ছা থাকলেও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। সরাইলে তাদের রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, যুদ্ধ যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে তাহলে তারা যেন তালশহর ও গোকনঘাট এলাকায় ব্যূহ রচনা করতে পারে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শত্রুযদি মেঘনা নদীর পূর্বপারে আমরা যে ব্যূহ তৈরী করেছি সেটা ভেদ করে তা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছার পূর্বে তাদের যেন বাধা দিতে পারি। তাছাড়া মেঘনা নদীর পুর্বপারে আমার যেসব সৈন্য মোতায়েন আছে তাদের সাহায্যে যেন তারা আসতে পারে। এই রিজার্ভ কোম্পানী লালপুরে চলে যাওয়াতে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

 ১৪ই এপ্রিল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলষ্টেশনে গিয়ে কিভাবে তাঁদের ফিরিয়ে আনা যায় সেই পরিকল্পনা করছিলাম। এমন সময় প্রায় সকাল সাড়ে পাঁচটায় পাক সেনাবাহিনী আমার বাহিনীর উপর ভীষণভাবে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈনিক রেল লাইন ঘেঁষে ভৈরবের দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটালিয়ন সৈনিক আইডব্লিটিএ’এলসিটি এবং মোটর লঞ্চের সাহায্যে মেঘনা নদী দিয়ে লালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক এই সময় নরসিংদীর নিকটবর্তী কোন এক জায়গা থেকে দূরপাল্লার কামান দ্বারা লালপুর, আশুগঞ্জ এবং ভৈরবে ভীষণভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, ছয়খানা এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, ভৈরব এবং লালপুর প্রভৃতি জায়গাগুলোতে ভীষণভাবে আক্রমণ করে এবং সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ক্রমাগত ছয় ঘণ্টা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। যখন জংগী বিমানের আক্রমণ চলছিল তখন ছয়খানা হেলিকপ্টার দ্বারা কয়েকবার তারা নরসিংদী থেকে প্রায় দুই কোম্পানী কমাণ্ডার আমাদের পিছনে মেঘনার পূর্ব পারে অবতরণ করায়। যুদ্ধ তখন তুমুলভাবে বেধে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের নিকট কোন দূরপাল্লার কামান বা ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বিমানবিধ্বংসী কামান না থাকায় আমাদের সৈনিকদের মনোবল বেশ ভেংগে যায়। কারণ আমরা চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত হই। এভাবে বেলা প্রায় ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবং আমার সৈনিকগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের একত্রিত করতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যেহেতু আমার নিকট কোন রিজার্ভ ফোর্স ছিল না, তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকটবর্তী শাহবাজপুরে একত্রিত করি। শাহবাজপুর এলাকাটা প্রতিরক্ষার জন্য উপযোগী না হওয়ায় আমি সিলেটের মাধবপুরে আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ নির্মাণ করতে শুরু করি। আশুগঞ্জের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন। তাঁরা হলেনঃ সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহী কফিলউদ্দীন, সিপাহী আব্দুর রহমান সরকার।

 ১৪/১৫ই এপ্রিল রাত প্রায় দুটায় শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে যে পুল ছিল তা ভেংগে দিই এবং তিতাস নদীর পূর্ব পারে শাহবাজপুরের কাছে একটা ব্যূহ নির্মাণ করি। যদিও ১৪ই এপ্রিল আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল কিন্তু তবুও পাকিস্তানী সৈনিকরা দুই দিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ঢোকেনি। এ দুদিন তারা অনবরত ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গোলাবর্ষণ করেছে। তারপর তারা আস্তে আস্তে শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। শাহবাজপুর দখল করার জন্য তারা স্থল এবং জল উভয় পথে আসে। ২১শে এপ্রিল তারা শাহবাজপুর দখল করে। যেদিন তারা শাহবাজপুর দখল করে সেদিন তারা আমাদের অবস্থানের উপর বেপরোয়াভাবে দূরপাল্লার কামার দিয়ে এবং জঙ্গী বিমান দিয়ে গোলাগুলি করে। আমাদের কাছে বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার কোন অস্ত্র না থাকায় এবং পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানের আক্রমণে আমাদের সৈনিকরা এতই আতংকিত হয়েছিল যে তারা বিমান দেখলেই ভয় পেয়ে যেত।

 পাক সৈন্যের শাহবাজপুর দখল করার সাথে সাথে আমি শাহবাজপুর থেকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য বেশ কিছুসংখ্যক পুল ভেংগে ফেলি। আমরা মাধবপুর বেশ বড় রকমের ব্যূহ তৈরী করি। মাধবপুর দখল করার জন্য পাকবাহিনী আমাদের উপর কয়েকবার আক্রমণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ২৮শে এপ্রিল বেলা পাঁচটায় মাধবপুর দখল করে নেয়। এই আক্রমণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে। লড়াই সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়। পাক সেনাবাহিনী মাধবপুর আক্রমণের জন্য দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে এবং যে গোলাবারুদ তারা ব্যবহার করে, তা ছিল হাই এক্সপ্লোসিভ এবং আগ্নেয় ধরনের। কাজেই সেখানে তাদের গোলা এসে পড়ত সেখানেই আগুন লেগে যেত। পরিখা এবং বাংকার তৈরী করে আমরা যে ব্যূহ তৈরী করেছিলাম সেটাও ছিল বেশ মজবুত। কিন্তু আমাদের সাথে রাইফেল, এলএমজি এবং মেশিনগান ছাড়া আর কোন ভারী অস্ত্র ছিল না। বেলা প্রায় ১২টার মধ্যে আমাদের অবস্থানের চার দিকে শুধু আগুন জ্বলছিল। তবুও আমাদের জোয়ানরা কেউই তাদের ট্রেঞ্চ এবং বাংকার ছেড়ে যায়নি। বাংকার এবং ট্রেঞ্চে বসে শত্রু নিপাত করছিল। বেলা প্রায় সাড়ে বারটায় পাকিস্তানী সৈনিকরা মাধবপুর দখল করার জন্য আমাদের অবস্থানের দিকে দলে দলে অগ্রসর হয় এবং ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। আমাদের মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেল তাদের অগ্রসর হতে দিচ্ছিল না। তাদের যে দলই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল সে দলটিকেই গুলি করে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছিল। মাধবপুরে যখন এভাবে মুখোমুখি যুদ্ধ চলছিল তখন আমি মাধবপুরে পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে অপর একটি ছোট সৈনিক দলকে লেং মুরশেদের নেতৃত্বে পাঠাই যাতে সে তাদের পিছন দিয়ে আক্রমণ করতে পারে। তার আক্রমণও বেশ ফলপ্রসূ হয়। সারাদিন যুদ্ধ করার পর আমাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে যায়। এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের এক অংশের সৈনিকদের গোলাবারুদ এবেবারেই ফুরিয়ে যায়। অয়ারলেস যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে গোলাবারুদ পাঠানো সম্ভব হয় নাই, এমনকি তারাও কোন খবর দিতে পারেনি। এখানে একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল। যখন আমাদের সৈনিকদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়, ঐ মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যারা ঐদিকে অগ্রসর হচ্ছিল তাদেরও গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়। কারণ আমাদের সৈনিকদের যখন গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায় তখন তারা অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে আসে। অনুরূপ পাকবাহিনীও যারা আমাদের বাহিনীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তারাও গোলাগুলি না করে পিছনের দিকে চলে যায়।

 এই অবস্থান সুরক্ষিত না থাকায় পরমুহূর্তে পাকবাহিনীর কিছু সৈনিক আমাদের ব্যূহের ভিতর ঢুকে পড়ে। এতে আমাদের অবস্থান রক্ষা করা আমাদের জন্যে বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এখানে রীতিমতো হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। অবশেষে আমি তাদের হুকুম দিতে বাধ্য হই কারা যেন পেছনে চলে আসে। এই যুদ্ধে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ ১। ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল), ২। ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) ৩। সুবেদার করিম (বর্তমানে সুবেদার মেজর), ৪। হাবিলদার এরশাদ, ৫। সিপাহী সোলেমান, ৬। সিপাহী মান্নান, ৭। সিপাহী খায়ের (শহীদ)।

 এই যুদ্ধে আমার অনুমান পাকিস্তানী সৈনিক খুব কম হলেও ২৭০ থেকে ৩০০ জন হতাহত হয়েছিল। মাধবপুরের যুদ্ধে সিপাহী খারে এবং সিপাহী শাহজাহান শাহাদত বরণ করেন। তাছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক আহত হয়। মাধবপুর থেকে সরিয়ে আমি তাদের সিলেটের মনতলাতে নিয়ে আসি এবং নতুন করে আবার ব্যূহ তৈরী করার নির্দেশ দিই।

 মাধবপুরের যুদ্ধের পর যেসব এলাকা আমার নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল সেগুলো হল, উত্তরে শ্রীমঙ্গল, শায়েস্তাগঞ্জ এবং দক্ষিণে তেলিয়াপাড়া, মুকুন্দপুর, সিঙ্গারবিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার দিক থেকে শাহবাজপুর এবং মাধবপুরের দিকে আসছিল। তাদের লক্ষ্য চিল যত শীঘ্র হোক সিলেটের সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করা। তাই তারা মরিয়া হয়ে সিলেট হাইওয়ে ও ব্রাহ্মবাড়িয়া-সিলেট হাইওয়ে তাদের নিয়ান্ত্রণে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

 আমাদেরও চেষ্টা ছিল যাতে করে তারা এ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। তাই সিঙ্গারবিল থেকে শাহজিবাজার পর্যন্ত এক প্রতিরক্ষাব্যূহ নির্মাণ করি। পাকিস্তানীরা কেবলমাত্র ঢাকা থেকে সৈন্য এনে সিলেটের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল না, তারা কুমিল্লার দিক থেকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কুমিল্লার দিক থেকে যে সমস্ত সৈন্য অগ্রসর হচ্ছিল তাদের বাধা দেওয়ার জন্য মেজর খালেদ মোশাররফ কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে লাইনের উপর নিম্মলিখিত জায়গায় পুল ভেঙ্গে দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে, যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় অগ্রসর হতে না পারে। যে সব পুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হলঃ উজানিসার হাইওয়ে ব্রীজ, গঙ্গাসাগর এবং আখাউড়া রেলওয়ে ব্রীজ।

 আমরা নিম্নলিখিত কারণে পাকিস্তানী সৈনিকদের অগ্রগতি রোধ করতে পারছিলাম না: আমাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল কম। তাছাড়া আমাদেরকে এই স্বল্পসংখ্যাক সৈন্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবক্ষাব্যূহ তৈরী করে পাকিস্তানী সৈনিকদের বাধা দিতে হচ্ছিল। অপরদিকে পাকিস্তানী সৈনিকরা এক জায়গায় কনসেনট্রেট্‌ ছিল এবং তাদের সৈন্যসংখ্যাও বেশী ছিল। ফলে আমাদের পক্ষেও অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। শুধু তাদের সৈন্যসংখ্যাই বেশী ছিল না, তাদের বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। যেহেতু আমরা সিলেট হাইওয়ের উপর তেলিয়াপাড়াতে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করে রেখেছিলাম সেহেতু পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ ব্যূহ ভেদ করে অগ্রসর হবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল। কারণ সিলেটে অগ্রসর হতে হলে ঐ প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করা একন্ত প্রয়োজন ছিল।

 শেরপুর এবং শাদিপুর আমাদের যে ব্যূহ ছিল সেগুলোর পতন হয় ২৪শে এপ্রিল তারিখে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীরা প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্যসিলেটের রি দিক থেকে মোতায়েন করে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য ছাড়াও তাদের জঙ্গী বিমানও বেপরোয়াভাবে আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের বেশসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল ক্যাপ্টেন আজিজ (বর্তমানে মেজর)। যুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন আজিজ জেট জঙ্গী বিমানের গুলিতে আহত হয়। আমাদের যারা শহীদ হয়েছিলেন, তারা ল্যান্স নায়েক আবদুল হাই, সিপাহী মোহসীন, সিপাহী শাহাদত হোসেন, নায়েক সুরত আলী, সিপাহী রহিসউদ্দিন মোল্লা, মোজাহিদ সুরদন নমসুদ্র।

 শেরপুর-শাদিপুর পতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সিলেটে আমাদের সৈন্যসংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না। তাই তারা অতি সহজে এবং শীঘ্রই সিলেটের দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তেলিয়াপাড়া তখনও আমাদের অধীন ছিল। পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়াকে বাইপাস করে শাহজিবাজারের শায়েস্তাগঞ্জের দিকে চলে যায় এবং সিলেট থেকে আরো অগ্রসরমান পাকসেনাদের শ্রীমংগলে এসে যোগাযোগ করে। তখন থেকে ঢাকা-সিলেট থেকে আরো অগ্রসরমান পাকসেনাদের শ্রীমংগলে এসে যোগাযোগ হয়। তখন থেকে ঢাকা-সিলেট রাস্তা তাদের নিয়ন্ত্রণধীনে চলে যায়। কিন্তু তেলিয়াপাড়া আমাদের নিয়ন্ত্রণধীনে থাকায় পাকবাহিনী সহজে চলাফেরা করতে পারত না। কেননা তেলিয়াপাড়া থেকে চুনারুঘাট পর্যন্ত চা বাগানের ভিতর দিয়ে যে হাইওয়েটা চলে গিয়েছিল সেটা তাদের মরণ ফাঁদ ছিল। প্রায় প্রত্যেক দিনই পাকিস্তানী সেনারা এ্যামবুশের সম্মুখীন হতো এবং তারা বেশ হতাহত হতো।

 সিলেট হাইওয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণধীনে থাকা পর্যন্ত আমরা যেভাবে যুদ্ধ করেছিলাম সেটা ছিল প্রথাগত যুদ্ধ। কিন্তু সিলেট হাইওয়ে পতনের পর আমাদের যুদ্ধের পদ্ধতি বদলিয়ে ফেলে গেরিলা ওয়ারফেয়ার শুরু করি। কিন্তু কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার একবারে বাদ দিয়ে দিইনি। তবে এখন থেকে আমাদের যুদ্ধের প্রধান পদ্ধতি ছিল গেরিলা ওয়ারফেয়ার। আমরা যে সমস্ত ক্যাম্প খুলেছিলাম তা ছিল প্রধানত গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য। তাছাড়া কিছুসংখ্যক ট্রেনিং ক্যাম্প কনভেনশনাল পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য যে সমস্ত ক্যাম্প খোলা হয়েছিল সেগুলোতে আমাদের ইন্সট্রাক্টর ছাড়াও বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আমরা বেশকিছুসংখ্যক ইন্সট্রাক্টর পেয়েছিলাম। কিন্তু যে সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্পে কনভেনশনাল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সে ক্যাম্পগুলোর ইন্সট্রাক্টর সমস্ত আমাদেরই ছিল।

 গেরিলা বাহিনী সমন্ধে এখানে দু-চারটা কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বা মুক্তির জন্য সমস্ত জনগণ (নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনী) মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এই মুক্তি বাহিনীর দুটি অংশ ছিল। একটিকে নিয়মিত বাহিনী বলা হত। অপরটি গেরিলা-তাকে গণবাহিনী বলা হত। এ নামগুলো বাংলাদেশ সরকার দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের নিয়মিত বাহিনী” “মুক্তি ফৌজ” নামে পরিচিত ছিল। এবং গণবাহিনী ফ্রিডম ফাইটার (এফ, এফ) হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

 এটা আমাদের জানা ছিল যে, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা সম্ভব নয়। দেশ জয় করতে হলে আমাদোর নিয়মিত বাহিনীর দরকার। আমদের বন্ধুরাষ্ট্র কিন্তু এ ব্যাপারে একমত ছিল না। যদিও এটা তাদের অজানা নয় যে দেশ জয় করতে হলে রেগুলার ফোর্স-এর দরকার, শুধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা যায় না। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত রেগুলার ফোর্স বা নিয়মিত বাহিনী গঠন করার বিরুদ্ধে এই জন্য ছিল যে তারা হয়ত মনে করত যদি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান দখল করার সম্পূর্ণ সুনাম যেন তারা নিতে পারে। কিন্তু আমরাও পেশাদার সৈনিক ছিলাম। তাই তাদের এসব পরামর্শে আমরা কখনও কর্ণপাত করিনি এবং আমরা গেরিলা বাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও গড়ে তুলি।

 তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাটের মরণফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি তখন তেলিয়াপাড়ার ব্যূহকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনার ব্যস্ত থাকি। কারণ এটা শুধু আমার ডিফেন্সই ছিল না এটা ছিল আমার হেডকোয়ার্টার।

 পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়া তাদের আয়ত্তে আনার জন্য ক্রমাগত ২১ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আর একজন অফিসার আমার সাথে যোগ দেয়। তার নাম ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া (বর্তমানে মেজর)। যেসব অফিসারের উপর তেলিয়াপাড়া রক্ষা করার ভার দিই তারা ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া, (বর্তমানে মেজর), লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)। এ ছাড়াও আরো কিছুসংখ্যক কলেজের ছাত্রও ছিলেন। তাঁরা হলেন শহীদ সেলিম আহসান, আনিসুল হাসান, ফজল হোসেন, আনিসুর রহমান (পরবর্তীকালে এঁরা সবাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন পান এবং অফিসার হন)। এদের মধ্যে সেলিম মিরপুর অপারেশনে শহীদ হন এবং আনিস তাঁর কলেজ জীবনে ফিরে যান।  তেলিয়াপাড়া ব্যূহ রক্ষা করার জন্য যে ২১ দিন হয়েছিল সেই যুদ্ধে এই সমস্ত অফিসার এবং সৈনিকরা মনোবল ও সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ২১ দিন লড়াইয়ে মধ্যে পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়ার উপর প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে পাঁচবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাঁরা তিনবার আমাদের কাছ থেকে তেলিয়াপাড়া দখন করে। আমরা দুবার তাদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই। কিন্তু তৃতীয় বারে তাদের সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র এত বেশি ছিল যে তেলিয়াপাড়া ঐবার আর দখল করা যায়নি। ১৯ শে মে শেষ পর্যন্ত তেলিয়াপাড়ার পতন হয়। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে যারা শাহাদত বরণ করেন তারা হলেনঃ সিপাই মোবারক আলী, সিপাই রংগু মিয়া, নায়েক নিজাম উদ্দীন, ল্যান্স নায়েক আসলাম মিয়া, সিপাই আব্দুল গফুর মিয়া, সিপাই আলী আজম ভূঁইয়া, সিপাই জামাল উদ্দীন, সিপাই আবু মিয়া, মোজাহিদ গিয়াস উদ্দীন, মোজাহিদ আলকাস মিয়া।

 এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত গেরিলা অপারেশনগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ

 মাধবপুর এ্যামবুশ, ১৪মেও মাধবপুরের পতনের পর পাক সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়ক ব্যবহার করতে শুরু করে। যদিও ঐ সড়কের স্থানে স্থানে আমরা পুল ভেঙ্গে দিয়েছিলাম তবুও তারা বিকল্প পথ তৈরী করে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তাদের যাতায়াতে বাধা দেবার জন্য মাধবপুরের কাছে ঐ এক বিকল্প সড়কের উপর পাকবাহিনীকে এ্যামবুশ করার জন্য ১৪ই মে তারিখে লেঃ মোরশেদের নেতৃত্বে ১২ জন সৈনিকসহ একটি দল পাঠাই। এ দল ঐ জায়গাতে রাত প্রায় দুটায় পৌঁছে এবং বিকল্প সড়কের উপর দু'খানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পেতে তারই পাশে ওত পেতে বসে তাকে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল এবং সকাল প্রায় ৮টা পর্যন্ত এ সড়কে পাক সেনাবাহিনীর কোন গাড়ী না চলাতে তাদের এমনিই বসে থাকতে হয়। বৃষ্টিতে তারা সবাই ভিজে যাওয়াতে নিকটবর্তী এক গ্রামে আশ্রয় নেয়। গ্রামে এক নির্জন বাড়ীতে যখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন সিলেটের দিক থেকে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন পাকবাহিনী ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এই কনভয়ের সবচেয়ে প্রথম গাড়ীটি ছিল একটি জীপ গাড়ী। ঐ জীপ গাড়ীটি বিকল্প পথের দিয়ে যাবার সময় ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং সাথে সাথে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এই গাড়ীটি ধ্বংস হবার পর আমাদের সৈনিকরা সেখানে (ঐ বাড়ীতে) নীরবে বসে থাকে এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। প্রথম গাড়ীটি বিধ্বস্ত হবার পর তার পেছনের গাড়ীটি দ্রুত এগুবার চেষ্টা করে। ফলে সেটিও মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হবার সাথে সাথে পাক সৈনিকরা বিপদ দেখে গাড়ী থেকে দ্রুত নেমে পড়ে এবং ঔ পুরো গ্রামখানি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের এ্যামবুশ দলটিতে মোট ১২ জন লোক ছিল। আর শত্রুপক্ষের খুব কম হলেও প্রায় ৪০০ লোক ছিল। আমাদের লোকজন যখন দেখল যে তারা প্রায় ঘেরাও হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা শত্রুদের উপর গুলি ছুড়ে ট্যাকটিক্যাল উইথড্র করে আসতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পেছনে প্রায় তিন মাইল পর্যন্ত ধাওয়া করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এখানেই সর্বপ্রথম ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে দু'খানা যানবাহন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং ঐসব গাড়ীতে যারা ছিল তাদের অধিকাংশ হতাহত হয়। এই এ্যামবুশে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ ১। লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ২। সেলিম (ছাত্র) পরবর্তীকালে লেঃ (শহীদ) ৩। আনিস (বর্তমানে লেফটেনেণ্ট)।

 নালুয়া চা বাগানের এ্যামবুশঃ ১৫/১৬ই মে, ১৯৭১ সন-১৫/১৬ই ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ১২/১৩ জন সৈনিক নিয়ে নালুয়া চা বাগানে সিলেট সড়কের উপর এক এ্যামবুশ তৈরী করে। ঐ দিন প্রায় এক কোম্পানী পাকসেনা সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাচ্ছিল। বিকেল প্রায় দুটায় দিকে তারা ঐ এ্যামবুশের ভেতরে চলে আসে এবং চারিদিক থেকে আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে শুরু করে। ঐ এ্যামবুশে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। এ এ্যামবুশ এত কার্যকরী ছিল যে পাকসেনা বাহিনীর এক কোম্পানী সৈনিকের মধ্যে অধিকাংশই নিহত হয়। তিনখানা গাড়ী সম্পূর্নরূপে ধ্বংস হয় এবং দু'খানা গাড়ী বিকল হয়ে যায়। আমাদের সৈন্য সংখ্যা বেশী না থাকাতে সে স্থান ত্যাগ করে পিছে চলে আসতে বাধ্য হয়। পরে চা বাগানের শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পারা যায় প্রায় ৬৫ জনের মত পাকসেনা নিহত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে যাঁরা বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ ১। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বর্তমানে মেজর) ২। হাওয়ালদার আবুল কালাম (বর্তমানে সুবেদার)।

 তেলিয়াপাড়া এ্যামবুশ ১৬ই মে, ১৯৭১ সন- মতিন তখন তেলিয়াপাড়ায় নিযুক্ত ছিলেন। নালুয়া চা বাগানে এক কোম্পানী পাকসেনা এ্যামবুশ হবার পর তাদের বেশকিছুসংখ্যক হতাহত হয়। তাদের সাহয্যার্থে চুনারুঘাট থেকে আরো কিছুসংখ্যক সৈন্য একত্রিত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তেলিয়াপাড়ার নিকট তারা পুনরায় এ্যামবুশ হয়। এই এ্যামবুশ-এর নেতৃত্ব দিচ্ছিল ক্যাপ্টেন মতিন। এ এ্যামবুশে ও ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। পাকসেনাদের একখানি গাড়ী ধ্বংস হয় এবং বেশকিছুসংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়।

 যেহেতু আমাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ছিল “হি এণ্ড রান”-শত্রু নিপাত এবং নিজের কম ক্ষতি। তাই আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে শত্রুর উপর আঘাত হেনে পিছনে চলে আসত। কিছুদিন পর জানা গিয়েছে যে ঐ এ্যামবুশে প্রায় ৪০/৫০ জন পাকসেনা হতাহত হয়েছিল। তেলিয়াপাড়া এ্যামবুশঃ ১৯শে যে ১৯৭১ সন-তেলিয়াপাড়ার এই দিন পতন ঘটে। মুর্শেদ ছিলেন এর প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত। পাকসেনারা যখন সিলেট সড়কের উপর বার বার এ্যামবুশ হচ্ছিল এবং ১৬ তারিখের এ্যামবুশে যখন তাদের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন বোধহয় তাদের সাহায্যার্থে পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য ব্যাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট অভিমুখে আসে। সেদিন রাতেই তেলিয়াপাড়ার চা বাগানের নিকটবর্তী এলাকার চারখানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে আমাদের সৈনিকেরা সিলেট সড়কের উপর ওত পেতে বসে থাকে। এই এ্যামবুশের নেতৃত্ব দিচ্ছিল লেঃ মোর্শেদ। দলে তার লোক ছিল ১৫ জন। কনভয়-এর প্রথম গাড়িটি মাইনের উপর দিয়ে চলে যায় কিন্তু মাইন ফাটেনি। যখন দ্বিতীয়, তৃতীয় গাড়ী মাইন অতিক্রম করছিল সাথে সাথে দুখানি গাড়ীই একত্রে বিধ্বস্ত হয়। পেছনের গাড়ীতে যে সমস্ত পাকসেনা ছিল তারা গাড়ী থেকে পিছনে বেশ কিছু দূরে এক খোলা ময়দানে একত্রিত হয়। পাকসেনাদের দুর্ভাগ্যবমতঃ ঐ খোলা মাঠের নিকটবর্তী এলাকায় আমাদের একদল লোক মেশিনগান নিয়ে ওত পেতে বসেছিল। এবং পাকসেনাদের যারা এখানে একত্রিত হয়েছিল তাদের প্রায় সবাই মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সৈন্য এসে সে সব মৃতদেহ ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মোজাহেদ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। পরে সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ এ্যামবুশে পাকসেনাদের বিপুল পরিমান অস্ত্রমন্ত্র এবং একখানা গাড়ী আমাদের হস্তগত হয়। এছাড়া তাদের তিনখানা গাড়ী বিধ্বস্ত হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা ১৩০ থেকে ১৫০ জনের মত ছিল।

লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আবদুর রকীবের প্রতিবেদন

'বিচিত্রা'

১৩ মে ১৯৮৩

 ২৫শে মার্চ ১৯৭১। সকাল ৯টা কি ১০টার দিকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার আমাকে আমার অফিস থেকে (আমি তখন ঢাকাতে ৩২ নং ব্যাটালিয়ন পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের সি-ও ছিলাম) ডেকে হুকুম করলেন যে তোমাকে সেকেণ্ড ইস্ট বেঙ্গলের সি-ও নিযুক্ত করা হল, কর্নেল মাসুদকে অপসারণ করা হয়েছে। ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার (তদানীন্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টার কমাণ্ডার, যাকে আগের দিন অর্থ্যাৎ ২৪ শে মার্চ চিটাগাং থেকে আনা হয়েছিল) তোমাকে ব্যাটালিয়নের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। কর্নেল মাসুদ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে যাবেন না। ঐ হুকুম অনুযায়ী আনুমানিক বিকাল ৩টা থেকে ৪টার কোন সময় ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সংগে জয়দেবপুরে যাই এবং ব্যাটালিয়নের সংগে পরিচিত হই এবং দায়িত্বভার গ্রহণ করি। ঐসময় ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন কোম্পানী এবং প্লাটুনের অবস্থান নিম্নরূপ ছিলঃ


(১) এক কোম্পানী ময়মনসিংহে-কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নুরুল ইসলাম (পরে মেজর জেনারেল এবং অবসরপ্রাপ্ত)।

(২) এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর কাজেম কামাল, অবাঙ্গালী।

(৩) এক প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এমুনিশন ডিপোতে-গার্ড হিসাবে।

(৪) এক প্লাটুন গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে-গার্ড বা প্রহরী হিসাবে।

(৫) ব্যাটালিয়নের অবশিষ্টাংশ জয়দেবপুরে। ঐ সময় জয়দেবপুরে নিম্নোক্ত অফিসারদেরকে পাইঃ


 (ক) মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) শফিউল্লাহ, সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড।

 (খ) মেজর (বর্তমানে মৃত) আসজাদ লতিফ, কোম্পানী কমাার-অবাঙ্গালী।

 (গ) মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল হাসান, কোম্পানী কমাণ্ডার।

 (ঘ) ক্যাপ্টেন (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) আজিজুল রহমান, এ্যাডজুট্যাণ্ট।

 (ঙ) ক্যাপ্টেন (বর্তমানে কর্নেল) এজাজ আহমদ, কিউ, এম

 (চ) ক্যাপ্টেন (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) মোহাম্মদ নাসিম, কোম্পানী অফিসার।

 (ছ) ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মৃত) মোহাম্মদ রিয়াজ, কোম্পানী অফিসার-অবাঙ্গালী।

 (জ) ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বোধ হয় পাকিস্তানে) নকভী, কোম্পানী অফিসার-অবাঙ্গালী।

 (ঝ) সেঃ লেঃ (বর্তমানে কর্নেল) মোরশেদ, কোম্পানী অফিসার।

 (ঞ) সেঃ লেঃ (বর্তমানে কর্নেল) ইব্রাহিম, কোম্পানী অফিসার, সিগন্যাল অফিসার।

 (ট) একজন ডাক্তার-বাঙ্গালী।

(৬) এই ব্যাটালিয়ানের সাথে জড়িত ২০/২৫ জন অবাঙ্গালী ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি একটু বলতে চাই, ১৯৫১সালে কমিশন পাওয়ার পরে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টে পোস্টিং পাই, এবং তার পর থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে কয়েক বৎসর তদানীন্তন ইপিআর-এ এবং অন্যান্য স্টপ জবে চাকুরী করি। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সঙ্গে চাকুরীর অভিজ্ঞতা বা সম্যক পরিচয় ছিল না। ব্যাটালিয়নের লোকজনদের ভিতর আমার কিছুমাত্র পূর্ব পরিচয় ছিল মেজর শফিউল্লাহ এবং মেজর কাজেম কামালের (অবাঙালী অফিসার) সঙ্গে। আর আমি যখন ব্যাটালিয়ানের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাই তখন আমার পাক সামরিক বাহিনীর প্ল্যান সম্বন্ধে কোন ধারনা ছিল না। ঐ দিন গভীর রাত্রে তদানীন্তন ইস্টার্ন কমাণ্ডের কমাণ্ডার জেঃ টিক্কা খান আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ঐ অঞ্চলের বিশেষ করে গাজীপুরের খবরাখবর কি। আমি উত্তরে জানাই যে অস্বাভাবিক কিছু পরিলক্ষিত হয় নাই। তিনি হুকুম করলেন গাজীপুরে ফ্যাক্টরীতে আমাদের সৈন্যসংখ্যা পুরো কোম্পানীতে উন্নীত করতে এবং অন্য কোম্পানীতে তৈরী অবস্থায় থাকতে। তদনুযায়ী, যেহেতু মেজর আসজাদ লতিফের কোম্পানীর এক প্লাটুন গাজীপুরে ছিল, তাকে তার কোম্পানীর অবশিষ্টংশ অর্থাৎ, দুই প্লাটুন গাজীপুরে পাঠিয়ে দিই এবং মেজর মইনের কোম্পানীকে জন্য কোন হুকুমের জন্য তৈরী থাকতে বলে দিই। অবশ্য পরে তাদের সম্বন্ধে আর কোন হুকুম আসে নাই। এ সময় আমার বা আমাদের কোন ধারণা ছিল না ঢাকা শহরে কি হচ্ছে। অবশ্য সন্ধ্যার দিকে  আমার বাসা থেকে (আমার ফ্যামিলির সবই তখন ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে ২৬/২ নং তোফায়েল কলোনী, বর্তমানে আজিজ পল্লীতে) কয়েকবার টেলিফোনে কোন অজানা লোক তাদেরকে বিরক্তিপূর্ণ টেলিফোন করে উত্ত্যক্ত করছে বলে খবর আসে।

 ২৬শে মার্চ ১৯৭১ঃ ঐ দিন সকালে রেডিও'র খবর জানতে পারি যে, ঢাকা শহরে “অনির্ধারিত সময়ের জন্যে” কারফিউ দেওয়া হয়েছে, এবং বিভিন্ন মার্শাল ল' নির্দেশবলী রেডিও মারফত শুনলাম। ঐ সব খবরে আমদের নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া হলেও সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব ছিল না, কেননা তখনও আমরা নিয়মতান্ত্রিক সৈনিক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমি অয়ারলেস সেট-এর কাছে গিয়ে দেখি যে, আমাদের সেটের ফ্রিকুয়েন্সীতে শুধুমাত্র ঢাকা কণ্ট্রোল জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ আছে। আমাদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর অবাঙ্গালী অপারেটর দেয় না। ঐ সময় আমি ব্রিগেড কমাণ্ডারের সঙ্গে অয়ারলেস-এ কথা বলে অবস্থা আঁচ করতে চাই, কিন্তু তিনি কোন মন্তব্য না করে এড়িয়ে গেলেন এবং বললেন যে, যখন দরকার হবে তখন তোমাদেরকে কাজের জন্যে ডাকা হবে। ঐ দিন ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ সবার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সমষ্টিগতভাবে কিছু প্রকাশ পায় না। যাহোক, ঐ দিন সকালে এবং বিকালে জয়দেবপুস্থ সমস্ত অফিসার, জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকদেরকে একত্রীভূত করে তাদেরকে সামরিক শৃঙ্খলা রাখার উপর গুরুত্ব দিই এবং বলি যে, অনেক সময় নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠে সামরিক ডিউটি পালন করতে হয়। ঐ দিন দুপুরের পর থেকে লোক মারফত ঢাকার ঘটনার কিছু কিছু আমাদের কানে এসে পৌঁছায়। তাছাড়া, বিবিসি এবং আকাশবাণীর খবরে আমাদের ভিতরে কিছু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং সেই সময় আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। এক কথায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঐ দিন বিকালে কিছু অফিসার জেসিওদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিশেষ করে সুবেদার নূরুল হক (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর- পরে অনারারী ক্যাপ্টেন হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন-স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বীরপ্রতীক পদক পান) সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐ দিনই সন্ধ্যায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলা করার মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিকসংখ্যক প্রহরী নিয়োগ ইত্যাদি বন্দোবস্ত করি। সন্ধ্যার দিকে আমরা অয়ারলেসে খবর পাই যে, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে এবং আরও সৈন্য পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের দিন কাটে।

 ২৭শে মার্চ ১৯৭১ঃ ঐ দিন শেষ রাত্রে আনুমানিক ভোর তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ আমার কামরায় একজন এনসিও এবং একজন সিপাহীকে নিয়ে আসে, বলে যে, তারা আমাদের যে প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে ডিউটিতে আছে সেই প্লাটুনের লোক। তাদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানীরা অতর্কিতভাবে আমাদের প্লাটুনের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে, এবং শুধুমাত্র তার দুজনই জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাদেরকে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও তাদের বক্তব্য সম্বন্ধে আমি সন্দিহান হয়ে উঠেলাম। আমি স্থির করলাম যে, ঐ ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করা প্রয়োজন। আমি সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ডকে বললাম ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন পাঠিয়ে ঐ ঘটনার তদন্ত করতে এবং সঙ্গে ঐ লোক দুটোকে পাঠাতে। তখন উপস্থিত সকলের একটু ইতস্ততঃ ভাব দেখলাম। এবং মেজর শফিউল্লাহ আমাকে বললেন যে, আমরা হয়ত পর্যবেক্ষণের ভিতরে আছি, রাত্রে বেশ প্লেন চলাচল করেছে। দিনের আলো না বেরোন পর্যন্ত কিছু 'মুভ' করলে দুর্ঘটনা হতে পারে। তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বের প্লাটুন একটু পরে রওনা হয়ে টঙ্গী-জয়দেবপুর রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি নিজে ফজরের নামাজের পর ঐ জায়গায় গিয়ে প্লাটুনের সঙ্গে মিলিত হবো এবং ঘটনার তদন্তে উপস্থিত থাকব। ঐ মত আমি প্লাটুন নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে সকাল ৭.৮টার দিকে পৌঁছাই। রীতি পালন করে ভিতরে গিয়ে দেখি আমাদের প্লাটুন বহাল তবিয়তে আছে এবং শুধু ঐ দুজনই কোন ভয়ে পালিয়ে গেছে। ঐখানে পাক বাহিনীর আরও দুটি প্লাটুন ডিউতে আছে। যাহোক, ওখানে যাওয়ার পরেই ঢাকার আর্মি এ্যাকশনের হিংস্রতা এবং নগ্নতা কিছু আন্দাজ করতে পারলাম। প্লাটুন কমাণ্ডার আমাকে জানালেন, গত দুই রাত এবং দিনে সমানভাবে হেলিকপ্টারযোগে গোলাবারুদ, এমনকি ১০৬ মিঃ মিঃ এণ্টিট্যাঙ্ক গান এবং আর্টিলারীর গোলাবারুদ গেছে। আমরা ঐ অঞ্চলে উপস্থিত থাকতেই দেখলাম যে, একটি হেলিকপ্টার এতে নামল এবং তাতে গোলাবারুদ উঠানো হচ্ছে। ঐ ঘটনা আমার মনে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমার মনে হল, পাকিস্তানীরা মিলিটারী এ্যাকশনে অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনছে না বরং মারণযজ্ঞে নেমেছে, কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অতিরিক্ত গোলাবারুদ সৈন্যদের প্রয়োজনে আসে না বা আসার কথা না। ১৯৫৩ সালে লাহোরের মার্শাল ল'এ আমাদের “ফার্স্ট লাইন” বা “পাউচ এম্যুনিশনই” খরচ হয়েছিল না। মনের ভাব মনে চেপে রেখেই সঙ্গে নেওয়া প্লাটুন সমেত ওখান থেকে চলে আসলাম। ফেরার পথে ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে প্লাটুনকে জয়দেবপুর চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম এবং আমি গাজীপুর অর্ডন্যান্স ডিপোতে আমার কোম্পানীকে দেখতে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম যে ঐ কোম্পানীও বেশ কিছু শংকাজনিত চিত্তে আছে। ওখানে আরও দেখলাম যে, আমার কোম্পানী ছাড়াও দুই কোম্পানী মত এমওডিসি'র লোক রয়েছে। এদের কাছে অস্ত্র আছে এবং দুই-তিন সপ্তাহের স্বল্প সামরিক শিক্ষা এরা পেয়েছে। এরা সবাই বাঙালী। ওখানে সবাইকে দেখে, কিছু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, কিছু গতানুগতিক ভাষণ দিয়ে বেলা এগার সাড়ে এগারটার দিকে জয়দেবপুরে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে আসলাম। রাস্তাঘাট, বাজার প্রায় জনশূন্য ছিল এবং সকলের ভিতরে একটা ভীতিজনক ভাব ছিল।

 হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের অবস্থার আরও অবনতির কথা জানতে পারলাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের কথাবার্তাও কানে আসতে থাকল। যেহেতু তখন পর্যন্ত ঐ এলাকার কোন 'অঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে নাই, আমি অফিসে এসে বসলাম। অফিসে বসার পর সুবেদার নূরুল হক প্রথামত ওখানকার সৈন্যদের সম্বন্ধে সমস্ত খবর দিলেন এবং অন্য দুই জায়গায় খবর আমাকে দিলেন। সকলের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবও আমাকে জানালেন। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার অফিসে এসে বললেন, “আমাদের নিরস্ত্র ভাইয়েরা গুলি খেয়ে শেয়াল-কুকুরের মত মরবে আর আমরা হাতিয়ার হাতে থাকা সত্ত্বেও নীরব দর্শক হয়ে থাকবো?” আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্ট করলাম এই যে, ধৈর্যহীন হয়ো না, সময়মত সব কিছুই করা হবে। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে মেজর মইন আমার অফিস কামরায় ঢুকে একই ধরনের অভিব্যক্তি করলে আমি তাকে একই ধরনের কথা বলি। এর কিছুক্ষণ পরে মেজর শফিউল্লাহকে আমার অফিস কামরায় ডাকি এবং একথা সেকথার পরে তাকে বলি যে আমদের ‘ইয়ং ব্লাড’ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে এবং এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে। তিনি আমাকে বললেন যে আমাদের উত্তেজিত হওয়া শোভা পায় না; সবকিছু একটু ভেবেচিন্তে করতে হবে। (প্রসঙ্গত এটুকু বলছি যে, আমাদের উপরোক্ত কথোপকথন প্রচলিত ইংরাজী এবং বাংলা দুই ভাষাতে হয়েছে। কথোপকথনের বাংলা অনুবাদ যা দাঁড়ায় তা লিখেছি)। ঐ অবস্থায় দুপুর গড়িয়ে গেল। ঢাকার সঙ্গে কোন সংযোগ নাই বললেই চলে। আনুমানিক তিনটা সাড়ে-তিনটার সময় অয়ারলেসে ব্রিগেড কমাণ্ডার আমার সাথে কথা বললেন। প্রথমে জানতে চাইলেন যে আমদের এদিকের অবস্থা কি। আমি উত্তরে জানালাম যে আমার নিকটবর্তী এলাকায় কোন অঘটন ঘটে নাই। তবে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে অবস্থার যথেষ্ট অবনতির খবর পাচ্ছি এবং সেখানকার কোম্পানী কমাণ্ডাররা আরও সৈন্য চাচ্ছেন তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে। তিনি বললেন ওখানে সৈন্য পাঠানোর দরকার নাই, তারা ঐদিকটা দেখবেন। তিনি আরও বললেন যে, “দুষ্কৃতকারীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে”-টঙ্গী ব্রিজ বিনষ্ট করে ফেলেছে। ঐ দিন সন্ধ্যায় টঙ্গী এলাকা আর্মি অপারেশন করবে; এক কোম্পানী প্রস্তুত থাকবে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে উত্তর দিক থেকে এসে অপারেশনে সহায়তা করবে। এই খবর দেওয়ার পর যথেষ্ট সংশয় এবং শঙ্কার সৃষ্টি হয়। উদ্বেগাকুল চিত্তে আমরা সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকি।

 ঐ দিন সন্ধ্যায় দূর থেকে অর্থাৎ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গীতে আর্মি এ্যাকশনের প্রচণ্ডতায় আমি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। গুলি এবং তোপের আওয়াজ এবং গোলাগুলির শলাকা দেখে আমার মনে হয় পাক আর্মি আইন- শৃঙ্খলা উন্নতির জন্য সরকারকে সাহায্য করছে না, বরং পুরোপুরি বাঙালী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। সারাদিনে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর মিলিয়ে দেখলাম একই দিক নির্ণয় করছে। মনে হল আমরা বোধ হয় হব পরবর্তী টার্গেট, এবং এ অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক আনুগত্য নিরর্থক। টঙ্গীর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সবেদার নূরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। (এই সঙ্গে জয়দেবপুরের অবস্থান সম্বন্ধে একটু বলা দরকার যাতে সবাই জিনিসটা ভালভাবে বুঝতে পারেন। পুরো ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরের জমিদার বা রাজবাড়ীতে। প্রকাণ্ড চত্বরের ভিতরে অনেকগুলো বড় বড় দোতলা বিল্ডিং-এর সমষ্টি। বর্তমানে এগুলো মহকুমা প্রশাসক এবং মহকুমা পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দক্ষিণে স্বল্প উঁচু পাঁচিল ও গেট। এই গেট দিয়ে ঢুকলে গোটা দুয়েক বাস্কেট বল/ভলিবল গ্রাউণ্ড সাইজের মাঠ। মাঠের পরেই বড় উঁচু দোতলা পুরানো কালের বিল্ডিং, নীচে অফিসার মেস এবং জুনিয়র অফিসারদের থাকার জায়গা। দোতলা মেসের ড্রয়িংরুম। পুবের দিকে টু-আই-সি এবং অন্য একজন মেজর থাকতেন। পশ্চিমের দিকে কামরা ছিল সিও'র জন্য। এ বিল্ডিং সংলগ্ন পশ্চিম এবং উত্তর কোনা থেকে শুরু করে উত্তর দিকে বিস্তৃত আর একটি বড় দোতলা বিল্ডিং ‘এল’- এর মত দেখতে। ব্যাটালিয়নের সমস্ত অফিস এই বিল্ডিং-এ ছিল। প্রথম বিল্ডিং-এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিল্ডিং এর সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। নীচে নেমে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে হত। ঐ দ্বিতীয় বিল্ডিং-এর উত্তরে আরও একটি বড় দোতলা বিল্ডিং পুবের দিকে বিস্তৃত ছিল। সেটা চিল ট্রপস-এর বসবাসস্থান। পুবের দিকেও দেওয়াল এবং কিছু বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা ছিল।) তারা এসে পৌঁছতেই আমি বললাম যে, পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ কোন উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। আমার মনে চিন্তা খেলে গেল যে আমাদের ক্ষুদ্র এবং বিভক্ত শক্তি নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া আত্নহত্যার শামিল, এবং আমাদের প্রয়োজন সমস্ত ব্যাটালিয়নকে এক জায়গায় একত্রীভূত করা এবং সেটা ময়মনসিংহেই সম্ভব। এ ছাড়া জয়দেবপুর রাজবাড়ীর পিছনে কিছু সরকারী কোয়ার্টারে আমাদের কিছুসংখ্যক জেসিও এবং এনসিও এবং সেপাইদের ফ্যামিলি আছে এবং আমার মনে হল যে, আমরা চলে যাওয়ার পর পাক বাহিনীর প্রথম আক্রোশ ঐসব পরিবারবর্গের উপর পরবে। সেইজন্যে আমি সুবেদার নূরুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইসব ফ্যামিলির কি হবে?” তিনি তার উত্তরে বললেন যে, তাদের জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা তাদেরকে আশেপাশের গ্রামে পাঠিয়ে দেব, এবং সেখানকার পাবলিক তাদের দেখাশুনা করবে। তখন আমি তাকে বললাম যে, পরের দিনের ভিতরেই যেন এ বন্দোস্ত হয়ে যায়। তারপর আমি ক্যাপ্টেন আজিজকে (এ্যাডজুটেণ্ট) গাড়ীর এভাইলিবিলিটি' অর্থাৎ কয়টা জীপ, ডজ, লরী চালু অবস্থায় আছে জানতে চাইলাম। তিনি যে পরিসংখ্যান দিলেন, তাতে আমি আন্দাজ করতে পারলাম মর্টার প্লাটুন এবং কিছু সৈন্য-আন্দাজ এক রাইফেল প্লাটুন (২৫/৩০)নিজেদের হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদসহ উঠানো সম্ভব হবে। তখন একটা প্রশ্ন থেকে গেল যে, অবশিষ্ট লোকজন এবং গাজীপুরে যারা আছেন তাদেরকে কি করে নেওয়া যাবে। তখন মেজর মইন স্বেচ্ছাকৃতভাবে বললেন যে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে ‘ক্রস-কাণ্ট্রি' পায়ে হেঁটে গফরগাঁও হয়ে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দেবেন। তখন আমি প্লান করে ফেললাম, আগামীকাল সকালে এক পার্টি গাড়ীতে টাঙ্গাইলে হয়ে ময়মনসিংহ যাবে এবং বাকীরা আগামীকাল সন্ধ্যায় রওনা হবে। গাড়ীর জন্য চেষ্টা করা হবে এবং যদি সম্ভব না হয় তাহলে পায়ে হেঁটে রওনা হবে। এটা স্থির করার পর, আমি তদানীন্তন মেজর শফিউল্লাহকে এই নির্দেশ দিই, যেহেতু তোমার ফ্যামিলি এখন ঢাকাতে নাই (তারা তখন কুমিল্লাতে তার শ্বশুরালয়ে ছিল), তোমার সমস্যা একটু কম। আগামীকাল সকালে অর্থাৎ ২৮শে মার্চে মর্টার প্লাটুন এবং এক রাইফেল প্লাটুন নিয়ে টাঙ্গাইল রওনা হয়ে যাবে। রাস্তায় যদি কোন রোড ব্লক পাও সেগুলো সাফ করবে। সেখানকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ‘কনট্যাক্ট’ করে বলে যাবে ঐগুলো খোলা রাখতে এবং রাত্রে আমাদের অবশিষ্ট লোক চলে যাওয়ার পর ঐগুলো বন্ধ করে দিতে। টাঙ্গাইল পৌছে সেখানকার কোম্পানীর দায়িত্বভার বা অধিনায়কত্ব নিয়ে নিবে এবং ঐ কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহে একত্রীভূত হবে। আমরা সবাই আগামীকাল, অর্থাৎ ২৮শে মার্চ ৭১, সন্ধ্যার পর এখান থেকে রওনা হব।”  মেজর মঈন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হককে স্ব স্ব দায়িত্বের কাজের নির্দেশ দিয়ে দিলাম। তাদের সবাইকে বলা হল যে আমাদের এই প্লানের গোপনীয়তা যেন বজায় থাকে, নেহাৎ প্রয়োজনীয় এবং নূন্যতম লোককে বলবে। কোনক্রমেই যেন অবাঙালীরা (২০/২৫ জন, যারা তখনও আমাদের সঙ্গে ছিল) যেন জানতে না পারে, কারণ যোগপনীয়তাই হবে আমাদের আপাতত কার্যসিদ্ধির একমাত্র পথ। এবং তাদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে আগামীকাল ২৮শে মার্চ সকালে সব ট্রুপসকে একত্রীভূত করবে যেকানে আমি সমস্ত্র পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্যে আমি আমার ‘টু-আই-সি' মেজর শফিউল্লাহকে মর্টার প্লাটুন এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে সেখানে পাঠাচ্ছি।

 এইসব করার পরে আমার নিজের ফ্যামিলির সম্বন্ধ্যে একটু চিন্তা হল। তারা ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট। তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না। চিন্তা করলাম যে কোনরকমভাবে ঢাকাতে গিয়ে তাদেরকে এদিকে নিয়ে আসা বা ছাউনী থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় কিনা। সেইজন্যে পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে মার্চ স্বল্পক্ষণের জন্যে ঢাকাতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে এবং টঙ্গী ব্রিজে একটা জীপ রাখতে অণুরোধ করে অয়ারলেস সেটে একটা মেসেজ পাঠালাম। শেষক্ষণ পর্যন্ত আর কোন উত্তর আসে নাই।

 ঐ রাত্রে নতুন আর কোন ঘটনা ঐ অঞ্চলে গটে নাই। অবশ্য দেশের বিশেষ করে ঢাকার ঘটনাবলীর বিভিন্ন বিবরণ বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌছাতে থাকায় সৈনিকদের মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে ঐ দিন আমাদের ব্যাটালিয়নের একটা গাড়ীর ড্রাইভারের (গাড়ীটা কছুিদিন আগে মেরামতের জন্যে ঢাকা ওয়ার্কশপে ছিল, এবং সে ঢাকাতে আটকা পড়েছিল। ২৭ মে মার্চে স্বল্পকালীন কারফিউ বিরতির সময় তাকে ওয়ার্কশপের কেউ হুকুম দেয় গাড়ীটা নিয়ে ইউনিটে চলে যেতে। গাড়ী নিয়ে আসার সময় টঙ্গী ব্রিজের ব্লকের জন্যে আটকে যায় এবং সেখানে আর্মি এ্যাকশন শুরু হয়ে যাওয়াতে গাড়ী ফেলে পায়ে হেঁটে জয়দেবপুরে এসে পৌঁছাই।) আর্মি এ্যাকশনের প্রাথমিক বিবরণে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে থাকে।

 ২৮ শে মার্চ ১৯৭১ঃ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আনুমানিক সকাল সাড়ে আট বা নয়টার সময় জয়দেবপুরের সমস্ত র‍্যাংকের ট্রুপসকে (বাঙালী, অবাঙালী সব) এক জায়গায় করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি, এবং জানাই যে মেজর শফিউল্লাহ সাহেবকে মর্টার এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে টাঙ্গাইলে অবস্থার উন্নতির জন্যে পাঠাচ্ছি।

 আনুমানিক সকাল ১০ টার দিকে যখন মেজর শফিউল্লাহ প্রায় তৈরী হয়ে গিয়েছেন রওনা হবার জন্যে, আমার মনে হল যে গাড়ীর বনোেদবস্ত্র না হলে রাত্রে সি-ও হিসাবে ট্রুপসের সঙ্গে পায়ে হেঁটে রওনা হতে হবে, এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অতিরিক্ত ইউনিফর্ম নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই মেজর শফিউল্লাহকে ডেকে তার স্যুটকেসে আমার দুই সেট ইউনিফর্ম দিয়ে দিই। ঐ সময় সেঃ লেঃ মোর্শেদ উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় অন্যান্য কাজের ভিতরেও টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের খবরের জন্যে যথেষ্ট উৎকণ্ঠিত ছিলাম। সকাল থেকেই ময়মনসিংহের সঙ্গে অয়ারলেস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।

 প্রায় সাড়ে দশটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ তার পার্টি নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। ওদের যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন 'জয় বাংলা' ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে তাদের উৎসাহিত করছিল। আমার ধারণ হল যে, আমাদের প্ল্যান স্থানীয় লোকেরা জেনেছে এবং এই অবস্থায় আমাদের ট্রুপস গেলে অবাঙালীরা যারা তখনও আমাদের সঙ্গে আছে, মনে করবে যে, আমাদের টাঙ্গাইল রি-ইনফোর্সমেণ্ট পাঠানো একটা ভাঁওতামাত্র। সেইজন্য সাধারণ পাবলিককে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেওয়া এবং ভয় দেখানো একটা নাটকের অভিনয় মত করতে হল। ওদের রওনা হয়ে যাওয়ার কিছু পরে সরকারীভাবে আমি ব্রিগেডে লিখিত মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম এই বলে যে, টাঙ্গাইলের অবস্থার উন্নতি সাধনকল্পে আমি মেজর শফিউল্লাহকে উপরোল্লিখিত সৈন্যসহ পাঠিয়েছি। এইজন্য করলাম যে, কোন সন্দেহ যাতে আমাদের উপর না আসে।  এরপর আমার চিন্তা হল গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে কিভাবে “কো-অর্ডিনেণ্ট” করা যায়। আনুমানিক সাড়ে এগারটা বারটার দিকে ঐ কোম্পানী সুবেদার চাঁদ মিয়া একটা গাড়ী নিয়ে আসলেন দুই রাত্রি আগে যে দুই পলাটুন জয়দেবপুর থেকে ওখানে যায় তাদের বিচানা নিয়ে যেতে। ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হত তাকে আমার কাছে নিয়ে আসলেন। আমি তাদেরকে বললাম যে, ওকে (চাঁদ মিয়াকে) প্লান বলে দিন। তাদের কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি সুবেদার চাঁদ মিয়াকে নির্দেশের সারাংশ এইভাবে বলিঃ

(1) সন্ধ্যার সময় থেকে তার কাছে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যে অয়ারলেস সেটের সংযোগ আসে সেটা খুলে রাখতে। যখন সংকেত যাবে “এখন সাড়ে সাতটা বাজে” তখন থেকে তোমরা রওনা হবার এ্যাকশন শুরু করবে।

(2) এ্যাকশন শুরুর প্রথম কাজ হবে অর্ডন্যান্স ডিপোতে যে অয়ারলেস সেটের ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে তাকে নষ্ট করে দেওয়া যাতে আমাদের খবর ঢাকা অথরিটি সঙ্গে সঙ্গে না পায়।

(3) অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে যত গাড়ী আছে এবং আশেপাশে যতটা সম্ভব গাড়ী দখল করে নিতে এবং ঐ গাড়ীসমূহ নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে ‘মুভ’ করতে।

(4) ‘মুভের’ সময় অর্ডন্যান্স ডিপোতে রক্ষিত ব্যাটালিয়নের পুরানো হাতিয়ারসমূহ এবং গোলাবারুদ যতটা সম্ভব নিয়ে যেতে।

(5) এম, ও, ডি, সি’র লোক যতটা সম্ভব সংগে নিয়ে যেতে এবং যারা যেতে পারবে না তাদেরকে নির্দেশ দিতে যে ঐ ডিপো থেকে দূরে সরে যেতে, কারণ পরে তারা আর্মি এ্যাকশেনের শিকার হবে।

 সুবেদার চাঁদ মিয়া চলে যাওয়ার পর আমার খেয়াল হল যে মেজর আসজাদ লতিফ তার অবাঙালী কোম্পানী কামাণ্ডরকে ওখানে থেকে সরিয়ে আনার দরকার যাতে চাঁদ মিয়া নিরূপদ্রবে তৈরী হতে পারেন। তাই আমি তাকে আমার সঙ্গে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে লাঞ্চ করার জন্যে ডেকে পাঠালাম। জয়দেবপুরস্থ সমস্থ বাঙালী অফিসার এবং জেসিওরা যে যার দায়িত্বমত প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছিল, এবং আইরের ভাবখানা ছিল যে সবকিছুই নর্মাল বা সাধারণভাবে চলছে। আমি মোটামুটিভাবে অবাঙালী অফিসারদেরকে গল্পচ্ছালে আমার আশেপাশে রাখছিলাম, যাতে তারা এ ব্যাপারে আঁচ করতে না পারে। আমি অবশ্য মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে যেয়ে ছোটখাট নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাকে বলে সামরিক ভাষায় “টাইং আপ”। আমার নিজস্ব যথেষ্ট চিন্তা ছিল অন্য জায়গায় কি হচ্ছে বা না হচ্ছে তা সঠিক জানা ছিল না- এই বিদ্রোহের পরিণতি কি হবে কে জানে, যদি সফল না হয় তাহলে নিজের ক্যামিলি এবং ছেলেরা ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টে, তাদের পরিণতি কি হবে, ইত্যাদি।

 (আজ ১২/১৩ বৎসর পরে ঐ দিনের কথা চিন্তা করলেও যথেষ্ট আতংকিত হয়ে পড়ি। ঐ দিনে ভবিষ্যৎ ছিল অজনা-দেশাত্মবোধই ছিল একমাত্র প্রেরণা।)

 এসব ছাড়াও আমার জানা প্রয়োজন ছিল যে, গতকাল রাত্রে টঙ্গীতে ‘আর্মি এ্যাকশনের’ পর কত সৈন্য আছে, কারা আছে, পজিশন তারা কতদূর পর্যন্ত নিয়েছে এবং আমাদে ‘মুভ’-এর সময় তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কতদূর আছে। দুপুরে খাওয়ার পরে আমি নিজেই যাবার মনস্থ করছিলাম, কিন্তু ক্যাপ্টেন আজিজের ইশারায় এবং পরামর্শে মেজর আসজাদ লতিফকে কিছু সৈন্য ‘এসকর্ট’ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাকে বলে দেওয়া হল যে, টঙ্গীতে যেসব সৈন্য পৌছে গিয়েছে তারে সঙ্গে ‘মিলাপ’ করে এসো এবং বিশেষ আগের রাতে আমাদের ব্যাটালিয়নের একখানা ডজ গাড়ী যেটা টঙ্গী ব্রিজের কাছে ড্রাইভার ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল, সেটা কি অবস্থায় আছে দেখবার জন্যে এবং সম্ভব হলে ‘রিকভার’ করার ব্যবস্থা করে আসতে। এই ব্যবস্থায় আমাদের দুইটা সুবিধা হল। প্রতমত, এই অবাঙালী অফিসারকে তার কোম্পানী থেকে অধিক সময় সরিয়ে রাখা এবং টঙ্গীতে যদি কোন অঘটন ঘটে তা হলে প্রথম চোটটা অবাঙ্গী অফিসাররের উপর দিয়ে যাবে। এ অফিসার বেলা দুটো-আড়াইটার দিকে এবং সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। সে জানায় যে, টঙ্গীতে পাক আর্মি তাকে বিশ্বাসই করতে চায় না, তাকে এবং তার সঙ্গের সবাইকে ‘ডিস আর্ম' করে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এমনকি তার পাঞ্জাবীতে কথা বলার উপরে সন্দেহ প্রকাশ করে।

 যাই হোক, ঐ অফিসার জায়দেবপুর থেকে টঙ্গী রওনা হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে উপরে নিজের কামরায় গেলাম। কিছু সময় পরে মেজর মইন আমার কামরায় এসে বেলন যে, আমাদের প্ল্যান নাকি পাঞ্জাবী এবং অবাঙালীদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছে, অথবা তারা আঁচ পেয়ে গিয়েছে। কারণ হিসেবে বলল যে, আমাদের কোন সেপাই ক্যাণ্টিনের কিছু পাঠান সিভিলিয়ানকে প্রকারান্তরে বলে ফেলেছে ঐ রাত্রে সাবধান থাকতে, এবং সে কথা তাদের ভিতরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম আরও সাবধান হয়ে যেতে এবং আমি ভাবছি এ ব্যপারে কি করা যায়। এর কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন আজিজ আমাকে এসে বললেন যে, একজন স্থানীয় ছাত্রনেতা আমার সঙ্গে টেলিফেনে কথা বলতে চায় এবং দেখা করতে চায়। আমি অল্পক্ষণ পরেই আসছি বলে দিতে বললাম (প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, যদিও ঢাকার সঙ্গে আমাদের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তবুও জয়দেবপুরে স্থানীয় এক্সচেঞ্জ কাজ করছিল এবং গাজীপুর ফ্যাক্টরী পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিল) এই মনে করে যে ছাত্রনেতার সঙ্গে ‘ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা করা হয়ত ঠিক হবে না এবং আমাদের ভিতরকার অবাঙালীদেরকে প্রকারন্তরে ভাব দেখানো যে কোন কিছু অঘটন ঘটতে যাচ্ছে না, আমি ‘ইউনিফর্ম' না পরে একটা প্রাইভেট শার্ট এবং প্যাণ্ট পরে নীচে নেমে আসলাম। ঐ ছাত্রনেতার (তার নাম আমার এখন মনে নাই) সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে সন্ধ্যার সময় গেটের সামনে দেখা করার সময় দিলাম। নীচে নেমে আসার পর থেকে প্রাইভেট পোশাকেই সুবেদার নূরুল হক এবং অন্যান্য সকলের সঙ্গে ‘ডিটেলস টাই আপ' অর্থাৎ খুঁটনাটি বিষয়ে নির্দেশাদি দিতে ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তকুল এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণসমূহ ছিল (১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছেছেন কিনা এবং আগে কি করেছেন তার তখন পর্যন্ত পাই নাই, (২) ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে সকাল থেকে যোগাযোগ বিছিন্ন, (৩ আমাদের প্ল্যান যদি খোদা-না-খাস্তা সফল না হয়ে তাহলে পরিণতি কি, (৪) বিদ্রোহহের ভবিষ্যৎ কি, এবং (৫) আমার ফ্যামিলি এবং ছেলেরা যারা ক্যাণ্টনমেণ্ট আছে তাদের ভাগ্যে আগামীকাল থেকে কি পরিণতি ইত্যাদি। আমার এই চিন্তাযুক্ত ভাব দেখে হয়ত কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেন আমি তাদের সঙ্গে যাব কিনা। আমি তাদেরকে উত্তরে বললাম যে, সব কিছু প্ল্যান করে তো পিছনে থাকা যায় না, কারণ পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। যাক, বেলা প্রায় ৪টার দিকে খবর পাওয়া গেল যে, মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল অতিক্রম করে ওখানকার কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহের পথে রয়েছেন। কিছু আশ্বস্ত হওয়া গেল।

 এখন আমাদের খেয়াল ‘লাষ্ট মিনিট কো-অর্ডিনেশন', বিশেষ করে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুন এবং গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন আজিজ যথেষ্ট জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুনকে বলে আসলেন সন্ধ্যার সময় তোকে তাদের অয়ারলেস খুলে রাখতে এবং ‘সাংকেতিক বাক্য' পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা সেখানকার তার ডিঙ্গিয়ে নিজের বন্দোবস্তে বেরিয়ে পড়েন। এম্যুনিশন ডিপোতে ঢোকার উপর সব সময় কড়াকড়ি, এবং ঐ সময়ে খুব বেশী ছিল। ঐ জায়গার ও-সি বা অধিনায়ক ছিলেন এক অবাঙালী। ক্যাপ্টেন আজিজ তাকে যেয়ে বললেন যে, তিনি এসেছেন 'সামারী অব এভিডেন্স' রেকর্ড করতে। দুই রাত আগে যে দুইজন লোক আমাদের প্লাটুন থেকে পালিয়ে ছিল, তাদেরকে এ্যারেস্ট করে রাখা হয়েছে এবং সি- ও সাহেব আগামীকাল তাদের ‘সামারী কোর্ট মার্শাল' করবেন। ভিতরে ঢুকবার অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আজিজের উপর স্টেনগান তাক কার ছিল। এইসব ঘটনাপ্রবাহে ঐ দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অফিসাররা উতলা হয়ে ওঠেন যাওয়ার সময় সংকেত দেওয়ার জন্যে। সন্ধ্যার সময় বা কিছু আগে খবর পেলাম আমাদের ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে অয়ারলেসে সংযোগ স্থাপন হয়েছে। ঐ কোম্পানী কমাণ্ডারকে নিজে সাংকেতিকভাবে জানিয়ে দিলাম যে মেজর শফিউল্লাহ তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে টাঙ্গাইল ছেড়ে আরও এগিয়ে গেছেন, এবং আমরাও রওনা হচ্ছি। আমি সন্ধ্যাটা একটু গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে ঐ অঞ্চলে কারেণ্ট ছিল না, অতএব ছিল গাঢ় অন্ধকার। (পরে জেনেছিলাম যে, টঙ্গী থেকে আর্মি ইলেকট্রিক কানেকশন অফ করে দিয়েছিল বোধ হয় পরের দিন আমাদের উপর অপারেশন চালানেরা জন্যে, এবং অবশ্য আমরাও লাইন কেটে দিয়েছিলাম।) দিনের ভিতর মেজর মইন, অন্যান্য অফিসার এবং জেসিওরা মিলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমাদের সকলের উঠানোর জন্যে গাড়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন। যাই হোক, রাত্রি আটটার সময় প্রয়োজনীয় লোকদেরকে আমার অফিসে একত্রিভূত করি-মিলিটারী ভাষায় যাকে বলে “ও’ গ্রুপ। আমি রাত ৮-৩০ মিঃ সময় নির্দেশ করি অর্থাৎ ঐ সময় থেকে আমাদের ‘মুভ’-এর কার্যাবলী শুরু হবে। কিন্তু ঐ সময় আমাদের কোন একজন বলে উঠলেন সময়টা একটু পিছিয়ে দিতে, কেননা তার উপর যে একটা দায়িত্ব অর্পিত ছিল তার প্রস্তুতির জন্যে আর একটু সময়ের প্রয়োজন। আমি তখন রাত ৮টা ৪৫ মিঃ সময় নির্ধারণ করে দিলাম।

 এর আগে ক্যাপ্টেন আজিজকে একটা নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, আমি আমাদের ‘মুভ’-এর অর্থাৎ যাত্রা শুরুর সময় দেওয়ার পর পরই তিনি এক সেকশন (দুটি) মেশিনগান এবং এক সেকশন (দুটি) রিকয়েললেস এ্যাণ্টি- ট্যাংক গান নিয়ে জয়দেবপুরের চৌরাস্তায় গিয়ে টঙ্গীর দিকে তাক রেখে রোড ব্লক সৃষ্টি করেন, যাতে আমাদের মুভের সময় টঙ্গীর দিক থেকে পাক আর্মি কোন গণ্ডগোল করতে না পারে এবং বাধা পায়। আমার ‘অর্ডার' শেষ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার নিজের কাজে চলে গেলেন।

 বলাবাহুল্য যে, ঐ সময় পর্যন্ত দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়কার প্রাইভেট জামাকাপড় পরিহিত অবস্থায় ছিলাম। অর্ডার শেষ কারার পর নীচের মেসে এসে দেখি যে, অবাঙালী দু'জন অফিসার- ক্যাপ্টেন রিয়াজ এবং নকভী খাওয়ার টেবিলে বসে রাত্রের খাবার খাচ্ছেন। আমিও তাদের সঙ্গে বসে রাত্রের খাবার খেলাম এবং তাদেরকে কিছু কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখলাম। বুঝলাম যে, আমাদের প্ল্যান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং আমাকে সিভিল কাপড়ে দেখে উৎকণ্ঠ। যদিও কিছু হয়েও থাকে-সরে গেল।

 ৮টা ৪০ মিঃ কি ৮টা ৪২ মিঃ-এর দিকে আমি উপরে নিজের কামরায় উঠে গেলাম পেশাক পরে তৈরি হবার জন্যে। উপরে অন্ধকার ছিল। নীচে মেসের গ্যাসের আলো থেকে উপরে উঠে অন্ধকারটা আরও বেশী লাগছিল। আমি মনে করলাম যে, একটু অপেক্ষা করি। কেননা একটু পরেই ‘এ্যাকশন' শুরু হবে এবং অবাঙালীদের নিরস্ত্র বা কিছু করার পর আমার কাছে কেউ নিশ্চয় আসবে। তখন আমি তৈরী হয়ে নেব। আমাদের প্লান ছিল যে সঙ্গেকার পাকিস্তানীদেরকে নিরস্ত্র কবর, এবং যদি তারা বাধা দেয় তখন গুলি চালাতে হবে, তবে গুলি চালানো হবে যথাসম্ভব স্বল্প এবং ক্ষিপ্ত-ভবিষ্যতের জন্য গোলাগুলি বাঁচাতে হবে।

 নির্দিষ্ট সময়ে বা ঐ সময়ের ৫-১০ সেকেণ্ড আগে নীচে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে এবং প্রচণ্ডতা বেশ বেড়ে গেল। আমি তখন উপরের তলায় একটু একটু সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার কাছে তখন কোন হাতিয়ার ছিল না। অল্প কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম যে কোন লোক সন্ত্রস্ত্রভাবে অথচ তাড়াতাড়ি পা টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠে আসল। আমি একটু আশান্বিত হলাম আমাদের কেউ হবে। কিন্তু সিঁড়ি শেষ হওয়ায় তার পায়ের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। সংশয় বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আওয়ার পেলাম আর একজন লোকের জোর কদমে উপরে উঠে আসার। শেষোক্ত লোকটা যখন মাঝসিঁড়িতে তখন প্রথমোক্ত লোকটা তার উপর টর্চলাইটের আলো ফেলে। নীচের লোকটি তখন জিজ্ঞোস করে ওঠে “কৌন হ্যায়”। উপরের লোকটি বলে, “আমি ক্যাপ্টেন নকভী, কেন?” নীচের লোকটি বলে ওঠে, ঞা, নকভী বেঁচে, তারপরই সে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে গেল। আমি অনুভব করলাম যে, আগের লোকটা, অর্থাৎ যে উপরের তলাল রয়ে গিয়েছে, সে হল ক্যাপ্টেন নকভী-অবাঙালী এবং সশস্ত্র। এত কিছু করার পরেও নিজের জন্যে ভরাডুবি। পরিণতি কি আল্লাহ জানে। হঠাৎ খেয়াল হল, এমনিও শেষ, ওমনিও শেষ, ঘটনা অজানার একটু ভান করে দেখা যাক না। একটু সতর্ক থেকে, পিলারের আড়াল থেকে নকভীর সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞাসা করলাম “ব্যাপার কি, নীচে গোলাগুলি চলছে কেন?” সে বলল, “জানি না স্যার, ওরা আমাদের উপর গুলি করছে, দেখেন আপনি টেলিফোনে এ্যাডজুটেণ্টকে পান কিনা।” বুঝলাম যে, তার বিশ্বাস যে সমস্ত ঘটনা আমার অজ্ঞাতে। তার বিশ্বাসটা আর একটু পাকা করার জন্যে আমার নিজের কামরায় রাখা পল্টনের এক্সচেঞ্জের টেলিফোন ঘোরালাম। জানতাম কেউ জবাব দেবে না। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম যে, নীচের থেকে সবাই চলে যাচ্ছে কিন্তু আমি যেতে পারছি না, আটকা পড়ে গেছি ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে। ঐ অবস্থায় রাত কাটল।

 ২৯শে মার্চ ১৯৭১ঃ সকালে দেখলাম বহু লোকজন বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার নিয়ে রাজবাড়ী ঘিরে রেখেছে। আমাদের উপর কড়া প্রহরা। লোকজনও বদলী হতে থাকল, আমিও চিন্তা করতে থাকলাম কিভাবে ফন্দি বের করা যায় এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দিন বেড়ে চলছিল। প্রায় সাড়ে এগারটার দিকে প্লেনের আওয়াজ পেলাম। কিছুক্ষণ পড়ে দেখলাম যে, দু'টো এফ-৮৬ প্লেন রাজবাড়ীর যে অংশে সৈন্যরা থাকত এবং আমাদের গাড়ীসমূহ থাকত, সেই অঞ্চলে স্ট্রাফিং করছে। বুঝলাম ঢাকায় সব খবর হয়ে গিয়েছে এবং আর্মি শিগগিরই আসছে। বেলা দুটা- আড়াইটার দিকে দেখলাম রাজবাড়ীর সম্মুখ অংশ সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে এবং পোর্টেবল মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, “সেকেণ্ড বেঙ্গলের যারা যারা আছো, সারোর কর।” আমার নাম ধরেও একই ঘোষণা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের মুখ দিয়ে শুনলাম। তখন ক্যাপ্টেন নকভী আগে এবং আমি পিছনে সারোর করতে বাধ্য হলাম। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব, ব্রিগেডিয়ার হাসানের সঙ্গে ৮-বেলুচ রেজিমেণ্ট ছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম।

 আমি কোন বিদ্বেষ নিয়ে লিখি নাই। আমার বর্ণিত কোন ঘটনা কেও যদি অসত্য বলে প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমি মিথ্যাচারীর কালিমা নেব।

আবদুর রকীব
লেঃ কর্ণেল(অবঃ)

মেজর জেনারেল (অবঃ কে, এম, শাফিউল্লাহর প্রতিবাদ

‘বিচিত্রা” ১৯৮৩

 ১৩ মে ১৯৮৩ সংখ্যা বিচিত্রায় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্ব' এই শিরোনামে লেঃ কর্ণেল (অবঃ) কাজী আবদুল রকীবের লেখা একটি নিবন্ধ আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তিনি তার নিবন্ধের মধ্যেমে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় তাঁর নিজস্ব ভূমিকার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে সব অবান্তর বক্তব্যের অবতারণা করেছেন। এই নিবন্ধে বর্ণিত অনেককেই আমার মত আশ্চার্যান্বিত না করে পারে না। সম্পূর্ণ নিবন্ধটিতেই তিনি তার মনগড়া কাহিনী ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরে রেখেছেন। তারা পুরা নিবন্ধটির ওপর আলোচনা করার আমার কোন ইচ্ছা নেই। শুধু দু-একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি।

 স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিছু কিছু পত্র-পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সাক্ষাৎকার কখনও কাউকে হীন করে তোলার বা নিজের কৃতিত্বকে প্রকাশ কারার অভিপ্রায় ছিল না। সাধারণভাবে যা ঘটেছে তাই তুলে ধরতে চেষ্ট করেছি মাত্র।

 লেঃ কঃ রকীব দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার তিনদিন পর এই ব্যাটালিয়ন জয়দেবপুর ছেড়ে ময়মনসিংহ চলে যায়। তার বক্তব্যানুযায়ী এই ব্যাটালিয়ন জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তিনি একাই করেছেন এবং আমরা শুধু তার নির্দেশ অনুসারেই কাজ করে গিয়েছি। এর পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত এই ব্যাপারে নিজস্ব কোন উদ্যোগ বা পরিকল্পনাই ছিল না। তিনি ২৬শে মার্চের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ ঐদিন বিকালে কিছু অফিসার, জেসিওদেও সঙ্গে কথা বলার সময়- বিশেষ করে সুবেদার নূরুল হক সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে পারে। আমি এ ব্যাপরে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐদিনই সন্ধায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলার মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিকসংখ্যক প্রহরী নিযোগ ইত্যাদি বন্দোবস্ত করি।

 রকীব সাহেবের এই বক্তব্যে অবাক না হয়ে পারছি না, কারণ তার এই মন্তব্য আমাদেও অদূরদর্শিতা ও সমরপ্রস্তুতির শৈথিল্যেরও ইঙ্গিত বহন করে বলে আমার মনে হয়। এই ব্যাটালিয়নকে যে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে তা জয়দেবপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসীদেও আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয় ছিল।তাই ১৭ মার্চ এলাকাবাসীরা জয়দেবপুর থেকে টঙ্গির রাস্তার উপর ৩০ থেকে ৪০টিরও বেশী ব্যরিকেড তৈরি করে রেখেছিল।যেখানে ঐ এলাকার জনসাধারণ আমাদের নিরস্ত্র করা হবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল সেখানে আমরা কোন বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়া ২৬ মার্চ বিকাল পর্যন্ত নীরব, নিশ্চেষ্ট ছিলাম এটা তিনি কিভাবে চিন্তা করতে পারলেন।

 জয়দেবপুরের জনগন এর ব্যাটালিয়ন সমরপ্রস্তুতির কথা কখনও ভুলবে না। এমন কি রকীব সাহেবের ও ভোলার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে তিনি ২৬ মার্চ বিকেলেই প্রথম শুনতে পান যে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে আর তাই তিনি ঐদিনই তা প্রতিহত করার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহন করেন।

 রকীব সাহেবের অবগতির জন্য লিখছি যে, ১৯ মার্চ ১৯৭১ শুক্রবার বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সজ্জিত ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার অভিপ্রায় ঢাকা থেকে জয়দেবপুর এসেছেলিন। সেদিন যদি এই ব্যটালিয়ন সমরপ্রস্তুতিতে কোন ত্রুটি বা শৈথিল্য থাকত তা হলে ঐদিনই এই ব্যাটালিয়ন নিরস্ত্র করা হত। সেদিন বিগ্রেডিয়ার জাহানবেজ আরবাব রাজবাড়ীতে ঢুকেই ব্যাটালিনের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি দেখে আমাদেরও নিরস্ত্র করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। লেঃ কর্নেল মাসুদুল হাসান (তৎকালীন ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার) বস্তুতঃ সেদিনই তার ব্যাটালিয়নের কমাও হারিয়েছিলেন।

 ২৭ মার্চ উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লেখক এক জায়গায় লিখেছেন, টঙ্গীর গোলাগুলি আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ ও সুবেদার নূরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। তারা এসে পৌঁছাতেই আমি বললাম যে পরিস্থিত এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।'

 রকীব সাহেবের নিবন্ধের এইটুকুই সবছেয়ে বড় অসত্য উদ্ধৃতি। সঠিক কথা হল সন্ধ্যায় আমি তাকে প্রথমবার সরাসরি বলি যে আমাদের আর জয়দেবপুর থাকা উচিত নয়। তাকে আরও বলি যে ব্যাটালিয়কে ময়মনসিংহে একত্রিত করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছি। আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। আমার কথায় তাকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হতে দেখি। যদিও এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কথাই ছিল, কারণ আমরা যা করতে যাচ্ছি তা সহজ ভাষায় হচ্ছে বিদ্রোহ এবং তার পরিণতি কি হতে পারে তাও কোন সৈনিকের অজানা থাকার কথা নয়।

 ২৫শে মার্চ বিকালে যখন তিনি এই ব্যাটালিয়নের কর্তৃত্বভার গ্রহন করেন তখন থেকেই আমি তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম এবং ব্যাটালিয়নের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থাৎ ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা যে পাকিস্থানী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াঁবার জন্য সম্পূর্নভাবে মানসিক ও সামরিকভাবে তৈরি আছে তা তাকে আভাসে ও ইঙ্গিতে বোঝোতে চেষ্টা করেছি।  ২৭শে মার্চেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই যে জয়দেবপুরে বসে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেদিনই রকীব সাহেবকেও আমাদের পরিবল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলি। এ পরিকল্পনা আমাদের অনেক আগেই করা ছিল এবং তা বাস্তবে পরিণত করার সিদ্ধান্ত সেদিনই নিই। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তাকে খোলাখুলিভাবে কিছু বলেত পারিনি, কারন রকীব সাহেব এমন এক সময় এবং এমন এক পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাটালিয়নে এসেছিলেন যে তখন তাকে সম্পূর্ন বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবং তার পক্ষেও হয়ত এত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মনোভাব বোঝা সম্ভব ছিল না। তাই ২৭শে মার্চ যখন আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই তখনই আমি তাকে খোলাখুলিভাবে বলতে সাহস পেয়েছি। তার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে এই ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতি ও আমাদের পরিকল্পনা সম্পের্ক আলোচনা না করার কতকগুলি কারনও ছিল।

 (ক) লেঃ কর্নেল মাসুদ অপসারণ করে, ২৫শে মার্চ বেলা ৪টায় লেঃ কর্নেল রকীবকে এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহনের জন্য পাঠান হয়। লেঃ কর্নেল মাসুদকে আমরা যেভাবেই বিশ্বাস করতে পারতাম সেভাবে লেঃ কর্নেল রকীবকে বিশ্বাস করতে পারি নাই,কারন লেঃ কর্নেল মাসুদ এই ব্যাটালিয়নে প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার মনোভাবও আমাদের সবার জানা ছিল। কিন্তু লেঃ কর্নেল রকীব কমিশন পাওয়ার পর থেকেই পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট চাকুরিরত ছিলেন এবং ব্যাটালিয়নের প্রত্যেকের নিকট তিনি ছিলেন সম্পূর্ন অপরিচিত। এই অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ন তার মনোভাব বুঝবার অবকাশ বা সুযোগ আমার হয়নি এবং তিনিও তার মনোভাব আমার নিকট প্রকাশ করেননি।

 (খ) ১ মার্চ কারফিউ জারি করে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ ঢাকার নিরীহ জনগনের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তাতে পাকিস্তানী যেসব ব্যাটালিয়ন অংশগ্রহন করে তার মধ্যে লেঃ কর্নেল রকীব সাহেবের ব্যাটালিয়ন ৩২ পাঞ্জাবও ছিল। ২৫ মার্চ যখন তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে আসেন আমি তাকে ১ মার্চের ঐ হত্যাযজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন এমন কিছু হয়নি; ব্যাটালিয়নের লোকজন দু'একটি ফাঁকা আওয়াজ করেছে মাত্র। এতে তার প্রতি আমার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই তার সঙ্গে মন খুলে কখা বলতে পারছিলাম না। ঐদিন ঢাকা শহরে যে কি ঘটেছিল তা নিশ্চয়ই আজও কেউ ভোলেনি।

 রকীর সাহেব লিখেছেন ২৭ মার্চে সন্ধ্যায় তিনি উপলিব্ধ করেন যে আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহন করেন। তার বর্ণনা অনুসারে তার পরিকল্পার কার্যকারিতা শুরু হয় পরদিন সকাল ১০টা থেকে অথাৎ ২৮ মার্চ সকাল ১০টা থেকে।

 তিনি নিজেই লিখছেন এই ব্যাটালিয়নের একজন অবাঙ্গালী অফিসার কাজেম কামাল ও আমি ছাড়া বাকি সবাই ছিল তার কাছে অপরিচিতি। আশ্চার্যের বিষয় এই যে এমন একটি সম্পূর্ন অজানা ও অচেনা পরিবেশে কি করে তিনি এত বড় পরিকল্পনা একাই করে ফেললেন! আর ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ডেকে বললেন-'পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।' আর আমরাও তার কথা মেনে নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা দিলাম।

 ২৮ মার্চের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তার উপর মন্তব্য করা আমার পক্ষে ঠিক হবে না, কারণ ঐদিন সকাল ১০টায় আমি জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। সেদিনের ঘটনাবলীর সঠিক বিবরণ তারাই দিতে পারবে যারা ঐদিন তার সঙ্গে ছিল। যেমন মেজর মইন, ক্যাপ্টেন নাসিম,ক্যাপ্টেন আজিজ,ক্যাপ্টেন এজাজ এবং সেকেণ্ড লেফটেন্যাণ্ট ইব্রাহিম প্রমুখ।

 তিনি তার নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন-' এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারনসমূহ ছিল (১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছালেন কিনা এবং আগে কি করছেন তার খবর তখন পর্যন্ত পাই নাই।...।'এ অংশের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখতে হয় যে, ঐ সময় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট জয়দেবপুর,গাজীপুর,রাজেন্দ্রপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিল। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমরা চাচ্ছিলাম ছড়িয়ে থাকা অংশগুলিকে সরিয়ে নিয়ে জায়গায় সংঘবদ্ধ হতে। ময়মনসিংহকেই সবাই একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম এবং সেখানে ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অংশ কখন কিভাবে পৌঁছাবে তার একটা পরিকল্পনা গ্রহন করি এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাটালিয়নের কিছু অংশ নিয়ে আমি জয়দেবপুর থেকে সকাল ১০টায় ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। আর বাকী অংশ ঐদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর থেকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল। আমি বুঝতে পারছি না, চলে আসার পর রকীব সাহেব আমার জন্য কেন এত উদ্বিগ্ন ছিলেন। ময়মনসিংহে আমি তো শত্রুও মোকাবেলা করতে যাইনি যে আমার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন থাকবেন। উদ্বিগ্ন আমি ছিলাম যে ব্যাটালিয়নের অন্যান্যরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারল কিনা। তার উদ্বেগের প্রধান কারণ হওয়া উচিত ছিল কিভাবে ব্যাটালিয়নের বাকী সবাইকে নিয়ে নিরাপদে ময়মনসিংহে পৌছানো যায়।

 ২৯ মার্চ ভোরে যখন ব্যাটালিয়নের সবাই আমার সঙ্গে মুক্তাগাছায় মিলিত হয়, তখন আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি কমাণ্ডিং অফিসার সাহেব কোথায়? তখন অনেকে আমাকে এই কথাই বলেছে যে তারা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় অফিসার্স মেসের ব্যালকনিতে সি-ও সাহেব ও ক্যাপ্টেন নকভীকে (একজন অবাঙ্গালী অফিসার) দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। কি পরিস্থিতিতে রকীব সাহেব ঐ জায়গায় রয়ে গেলেন সে ব্যাপারে তিনি যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন সেটা কি সত্যের অপলাপ নয়? আমাদের পূর্ব পরিকল্পনামত ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রেপুর থেকে একই সময় সবাইকে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল। রকীব সাহেব এই সময়সূচী পরিবর্তন করে সাড়ে আটটা কেন করেছিলেন তা তিনি লেখেননি।

 তার নিজের কথা অনুযায়ী সাড়ে আটটায় রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা তখন পর্যন্তও তিনি যেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এবং ৮ টা ৪২ মিনিটে তিনি তার কামরায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, যে কেউ এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যেখানে তার ৮টা ৩০ মিনিটে জয়দেবপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা সেখানে তিনি ৮টা ৪২ মিনিটে তার কামরায় ফিরে গেলেন কেন? এটাই কি তার ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যাওয়ার লক্ষণ ছিল?

 ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে সারা রাত আটকে থাকার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটাও কি গ্রহণযোগ্য? তার নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে সেই অনিশ্চিত দিনগুলিতে আমরা সর্বক্ষণই সশস্ত্র থেকেছি, কখনও নিরস্ত্র অবস্থায় থাকিনি। সেদিনের সে অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটময় সময়ে তার সঙ্গে অস্ত্র না থাকাই কি অস্বাভাবিক ছিল না?

 তার নিকট আমার আরও জিজ্ঞাস্য যে, গোলাগুলির মুখে যখন এই ব্যাটালিয়নের সবাই চলে আসতে পারল তখন কেন চলে আসতে পারলেন না ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার? পাকিস্তানীরা তো জয়দেবপুর রাজবাড়ি ঘেরাও করেছিল ২৯ মার্চ দুপুরের পর। আমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঐকান্তিকতা যদি সেদিন সত্যি তার থাকত তাহলে ২৮ মার্চের সারারাত ও ২৯ মার্চের দুপুর পর্যন্ত সময়টুকু কি যথেষ্ট ছিল না? ২৯ মার্চের ভোরে যখন রাজবাড়ীতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী স্ট্রাফিং ও বোমাবর্ষণ করছিল তখনও কি তিনি পারলেন না এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে?

 ২৯ মার্চ দুপুরের পর ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসে জয়দেবপুর রাজবাড়ী ঘেরাও করে ও রকীব সাহেবকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের ন্যায় তাকেও সেলে রাখা হয়। ঐ সময় সেলে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের ভাগ্যে যখন নানা প্রকার লাঞ্ছনার শেষ ছিল না তখন তার প্রতি কর্তৃপক্ষের সদয় ব্যবহারের কারণ কি ছিল? অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের যখন পশুর মত ছোট একটি সেলে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল তখন তার থাকার জন্য কেন বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল? এসবের জবাব কি তিনি দিতে পারবেন?  রকীব সাহেব তো তার দীর্ঘ নিবন্ধে কোথাও এ কথা লেখেননি যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানীরা কি ব্যবস্থা নিয়েছিল? তিনি তো একথা লেখেননি যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে আবার পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের কমাণ্ড দেয়া হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, লেঃ কর্নেল মাসুদ,লেঃ কর্নেল জলিল, লেঃ কর্নেল ইয়াসিন আরও অনেককেই তো কমাণ্ড থেকে অপসারিত করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা তো কেউ তাদের কমাণ্ড আর ফিরে পাননি। উপরন্তু যাদের উপর যে অমানুষিক ও পৈশাচিক অত্যাচার চালান হয়েছিল তার চিহ্ন তো আজও তাদের অনেকের শরীরে রয়ে গেছে।

 লেঃ কর্নেল রকীবের উপর আমার ব্যক্তিগত কোন ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই। কিন্তু তার নিবন্ধের উপর কিছু আলোকপাত করতে গিয়ে আমাকে যেসব কথা লিখতে হল সেজন্য আমি দুঃখিত। একবার ভেবেছিলাম যে এ নিবন্ধের উপর কোন মন্তব্য করব না, করা উচিত নয় কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে প্রতিবাদ না করলে অসত্য সত্য হয়ে থাকবে। তাই আমাকে লিখতে হল।

জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খান[]

 ২৫ শে মার্চ সকালে ঢাকা ক্যাণ্টমেণ্ট এবং টঙ্গী টেলিফোনে এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং খবরাখবর নিই। জয়দেবপুরের জনসাধারন তখন দারুণভাবে উত্তেজিত। তারা টেলিফোনে আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য দারুণভাবে চাপ দিতে থাকে। দুপুর বারটার সময় টঙ্গী টেলিফোনে এক্সচেজ্ঞের মাধ্যমে জানতে পারি যে, পাঞ্জাবী কমাণ্ডো ব্যাটালিয়নের কিছু সাধারণ পোশাকধারী সৈন্য টঙ্গী ব্রীজ দখল করে জনসাধারণের উপর গোলাগুলি চালাচ্ছে। তখন আমরা বুঝতে পারি এবং দখল করে জনসাধারণের উপর গোলাগুলি চালাচ্ছে। তখন আমরা বুঝতে পারি এবং ধারণা করি যে পরবর্তী আক্রমণ হয়তবা আমাদের উপর করবে।

 রাত্রে আমরা পাজ্ঞাবীদের দ্বারা আক্রান্ত হবো মনে করে জয়দেবপুর প্যালেসের চতুর্দিক পরিখা খনন করে পাহারা দিই। আমি কর্তব্যরত থাকাবস্থায় রাত প্রায় সাড়ে বারোটার সময় ঢাকা থেকে টেলিফোন গেল এবং সে টেলিফোন করেছিলেন লেফটেন্যাণ্ট জেনারেল টিক্কা খান স্বয়ং। তিনি আমার অফিসার কমাণ্ডিং লেঃ কঃ রকীবকে ডাকতে বলেন। আমি লেঃ কঃ রকীবের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করি এবং লেঃ জেঃ টিক্কা খানের টেলিফোনের কথা জানাই। লেঃ কর্নেল রকীব অফিসে আসবার পূর্বেই পুনরায় টিক্কা খানের এডিসি টেলিফোনে করেন। তিনি আমার কাছে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর জানতে চান। অর্থাৎ জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী জনসাধারণ আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিতে পারে। কাজেই তাকে রক্ষা করার জন্য আমরা কিরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি সে কথা জানতে চান। তার জবাবে আমি বললাম যে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর পুরাপুরি জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে দু'টি অয়ারলেস সেট আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতির কথা জানাব। এমন সময় লেঃ কর্নেল রকীব আমার অফিসে চলে আসেন এবং আমি তাঁকে টিক্কা খান ও তার এডিসির টেলিফোনের কথা জানালাম। তিনি তখন আমাকে একজন অফিসারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে পাঠাতে বলেন এবং অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে খবর দিতে বলেন। আমি তার নির্দেশমত কাজ করলাম। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন অফিসার আমার ডিউটি কক্ষে আসলেন। তাঁদের সঙ্গে সারারাত পরিস্থিতির উপর আলোচনা হয়।

 ২৫শে মার্চ সকাল আটটায় রেডিওতে সামরিক আইনের ঘোষণা শুনি। এর পর থেকে আমরা সবাই অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং কি করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করি। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে আমরা জয়দেবপুর থেকে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আমরা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে দুই প্লাটুন সৈন্য এবং রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে এক প্লাটুন সৈন্যের কথা চিন্তা করি এবং তাদেরকে কিভাবে আমাদের মাঝে আনতে পারি সে বিষয়ে চিন্তা করি। এভাবে ২৬শে মার্চ জয়দেবপুর কাটাই।

 ২৭শে মার্চ সকালে আমরা সবাই মিলে লেঃ কর্নেল রকীবকে কিছুটা জোর করে অয়ারলেসে ময়মনসিংহে অবস্থিত কোম্পানীকে জানাতে বললাম যে, তারা জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করে। লেঃ কর্নেল রকীব তখন অয়ারলেসে ময়মনসিংহে মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) নূরুল ইসলামকে আমাদের কথা জানাতে বাধ্য হলেন এবং তাদেরকে জনসাধারণের সঙ্গে মিশতে বলেন।

 ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) আজিজকে সকালে পাঠানো হল রাজেন্দ্রপুর”এম্যুনিশন ডিপোতে" এবং সেখানে তিনি গিয়ে আমাদের বাঙ্গালী কোম্পানীকে খবর দেবেন কিভাবে তারা বের হয় এবং আমাদের পাওয়া মাত্র যেন বের হয়। এ খবর নিয়ে ক্যাপ্টেন আজিজ চলে গেলেন।

 সকাল দশটার সময় ৪টা ট্রাক ও ৩টা জীপ নিয়ে আমরা এক কোম্পানী অগ্রসর হলাম ময়মনসিংহের দিকে। আমি টাঙ্গাইল থেকে গেলাম। পুরা কোম্পানী নিয়ে মেজর শফিউল্লাহ্ ময়মনসিংহ চলে যান। যাবার পথে বহু লোক পথের মধ্যে হাত তুলে ও 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিয়ে আমাদেরকে স্বগত জানায়।

 আমি টাঙ্গাইল পৌঁছেই জানতে পারলাম যে টাঙ্গাইলে অবস্থিত বাঙ্গালী কোম্পানী পূর্বেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছে। তখন আমার সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আলাপ করতে আসেন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর কয়েকটি গাড়ী সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিল।

 আমি আমার কোম্পানীর সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে আমার আয়ত্তে নিলাম। উক্ত কোম্পানীর কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন মেজর কাজেম কামাল (পাঞ্জাবী)। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ভয় না করার জন্য। সন্ধ্যায় ডাকবাংলোতে কাজেম কামালের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করি। পরে আমি আমার ড্রাইভার ও গার্ডকে নিয়ে জীপে রাস্তায় বেরুলাম জয়দেবপুর থেকে আমাদের কোম্পানী আসছে কিনা দেখবার জন্য। কিছুদূর যাবার পর অনেক দূরে একটি গাড়ীর আলো দেখতে পাই। মনে হল আমাদের সৈন্যরা জয়দেবপুর থেকে আসছে। আমি ডাকবাংলোতে ফিরে আসছি এমন সময় ডাকবাংলোতে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। সোজা ডাকবাংলোতে না পৌঁছে আমি আমার সুবেদারকে ডেকে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলাম। সুবেদার বললো, স্যার কিছু না, সব ঠিক আছে। গোলাগুলি শেষ হবার পর ডাকবাংলোয় গিয়ে দেখি মেজর কাজেম কামাল ও তার সাথে আরও ৫/৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্য আহত ও নিহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মেজর কাজেম কামাল ও তার পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমার অনুপস্থিতিতে পালানোর চেষ্টা করে এবং গুলি শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা পাল্টা গুলি করলে তারা আহত ও নিহত হয়। এমন সময় আমাদের জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গইল পৌঁছে।

 জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌঁছলে তারা আমাকে আমার কোম্পানীসহ ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে বলে এবং তারাও মযমনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি তখন নিহত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সরিয়ে ফেলার জন্য জনসাধারণকে অনুরোধ করি। আমার গাড়ী তখনও সংগ্রহ না হওয়ায় আমি নিজেই কয়েকটি গাড়ী তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করি। তখন রাত প্রায় তিণ্টা। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হই। রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড থাকায় বেশী দূর অগ্রসর হতে পারলাম না।

 ২৯শে মার্চ ভোরে আমরা মুক্তাগাছার কাছাকাছি পৌঁছলাম। আমাদের পূর্বে জয়দেবপুর থেকে যে সেনাদলটি ময়মনসিংহ রওনা দিয়েছিল তারাও মুক্তাগাছায় পৌঁছেছিল। তারা ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি মুক্তাগাছাই রয়ে গেলাম। মধুপুরেও কিছু সৈন্য ছিল। সকাল দশটার দিকে মেজর নূরুল ইসলাম ময়মনসিংহ থেকে টেলিফোনে বললেন....আমাদের পিছনে ফেলে যাওয়া কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দিতে। আমি মেজর নূরুল ইসলামকে বললাম ব্রীজ উড়ানোর মত তেমন কোন এক্সপ্লোসিভ নেই। কেননা তখন আমার নিকট আশি পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ ছিল। তা দিয়ে সম্ভব হলে আমি চেষ্টা করবো। আমি কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিছনে ফিরলাম। কালিহাতী ব্রীজ উড়ানোর জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছিলাম। এমন সময় কাদের সিদ্দিকী সেখানে পৌঁছেন এবং তাঁকে আমরা টাঙ্গাইলে ফেলে আসাতে দুঃখ প্রকাশ করি। গ্রামের ও আশেপাশের লোকজন তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা আমার ব্রীজ উড়ানোর কথা শুনে আপত্তি করেন। কেননা চতুর্দিকে গ্রাম ছিল। পাঞ্জাবীরা তাদের অত্যাচার করবে, এ জন্য গ্রামবাসী ব্রীজ উড়ানোর পক্ষে মত দেন নাই। আমার নিকটও অল্প এক্সপ্লোসিভ থাকায় ব্রীজ উড়ানো সম্ভব হল না, কাদের সিদ্দিকী আমার কাছে একটা পিস্তল চাইলেন। কিন্তু পিস্তল না থাকায় তাকে দিতে পারলাম না। তারপর সেখান থেকে সোজা ময়মনসিংহ রওনা দিই। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে পৌঁছলাম। ময়মনসিংহে চতুর্দিকে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। আমরা পাঁচটা কোম্পানী তখন ময়মনসিংহে একত্রিত হয়েছি। সেখান থেকে আমাদের অপারেশন পরিকল্পনা শুরু করি। মেজর শফিউল্লাহ তখন আমাদের কমাণ্ডিং অফিসার। সেখানে জনসাধারণ ও নেতৃবৃন্দ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করি।

 ৩০শে মার্চ ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অফিসার ও সৈন্যরা ময়মনসিংহে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় খবর পাঠাই ও যোগাযোগ করি। সীমান্ত এলাকার সমস্ত ইপিআরদের খবর দিই সীমান্ত এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহে পৌঁছার জন্য। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এ খবর বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই। অয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের খবর পাই। চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ইপিআর-এর সঙ্গে পাকিস্তনী সৈন্যদের যুদ্ধ চলছে, সে সমস্ত খবর আমরা পাই। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। এবং জানতে পারি যে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ায় পাঞ্জাবী সৈন্যরা দারুণভাবে মার খেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বহু ইপিআর ও সাবেক সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। একজন সুবেদারের কমাণ্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হল মধুপুর গড়ে-পাকিস্তানী সৈন্যরা ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর নিতে এবং অবলম্বন করতে। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সমস্ত সৈন্য নিয়ে ট্রেনে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো। এমন সময় খবর পেলাম কুমিল্লার ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেছে। তখন আমরা দুটি বেঙ্গল রেজিমেণ্ট একত্র হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং ঢাকার দিকে অগ্রসর না হয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে ভৈরব রওনা হলাম ৩১শে মার্চ রাতে। পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ পৌঁছলাম ১লা এপ্রিল।

 ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) মতিয়ূর রহমানের কমাণ্ডে ইপিআর-এর একটা কোম্পানী পাঠান হলো নরসিংদীতে। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একজন অফিসার পাঠালেন ভৈরবে। ভৈরব থেকে তিনি কিশোরগঞ্জ চলে গেলেন মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালাম। চট্টগ্রাম থেকে মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) জিয়াউর রহমানকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া পৌঁছার কথা বলা হলো। এবং আমরা ২য় এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সমস্ত সৈন্য তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হবার কথা জানালাম।

 আমরা ২য় বেঙ্গল এবং ৪র্থ বেঙ্গল তেলিয়াপাড়া পৌঁছলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী আশুগঞ্জ পাঠান হয়। অন্য আর এক কোম্পানী সিলেট চলে যায়। আমি আলফা কোম্পানী অর্থাৎ আগঞ্জে পৌঁছি ৩রা এপ্রিল। আমার সঙ্গে অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসিম। ক্যাপ্টেন নাসিম ছিলেন কোম্পানী কমাণ্ডার,আর আমি ছিলাম সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড। এখানে আমরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। জনসাধারণ আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। কিছু আনসার ও মোজাহিদ রিক্রুট করি। কিছু নিয়মিত সৈন্যসহ এক প্লাটুন সৈন্য পাঠাই লালপুরে (আশুগঞ্জ থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ দিকে)।  আনুমানিক ৮ই অথবা ৯ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নরসিংদী দখল করে নেয়। ১৬ই এপ্রিল ভোরে ৫টার সময় পাকিস্তানী বিমান বাহিনী হঠাৎ আশুগঞ্জে আমাদের উপর বোমাবর্ষণ শুরু করে ৬টা স্যাবর জেট দ্বারা। সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে আমাদের তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সৈন্য ভৈরব ব্রীজের পশ্চিম দিকে ছিল এক ব্যাটালিয়ান। এক কোম্পানী প্যারাস্যুটে নামিয়ে দেয় আশুগঞ্জ শহরে। অন্য একটি ব্যাটালিয়ন পাঠায় লালপুর। সকাল আটটার সময় আমরা তিনদিক থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হই। তখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বেলা তিনটে পর্যন্ত যুদ্ধ অনবরত চলতে থাকে। আমাদের ১০/১২ জন সৈন্য ঐ যুদ্ধে শহীদ হন। ১৫/১৬ জন আহত হন। আমি এবং মেজর নাসিমও সামান্য আহত হই। অন্যপক্ষে পাকিস্তানী এক প্লাটুন সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয়।

 মেজর কে এম শফিউল্লাহকে জানালাম আমাদের পরিস্থিতি। তিনি আমাদেরকে সৈন্য তুলে নেওয়ার কথা বললেন। আমরা সৈন্য তুলে নিয়ে তালশহরে যাই। তালশহরে পৌঁছবার পর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এমন সময় একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলে একটা হোণ্ডা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। আমি উক্ত হোণ্ডায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য যাই। কেননা আমি তখন আহত। মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে তেলিয়াপাড়া যাবার পরামর্শ দেন। আমি ঐদিন সন্ধ্যায় তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি।

 তেলিয়াপাড়ায় আমাকে জানানো হলো মাধবপুরে ডিফেন্স দেওয়ার জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তেলিয়াপাড়ার মাঝখানে মাধবপুর। মাধবপুরে ২৫শে এপ্রিল আমরা আবার ডিফেন্স তৈরি করি। এবং শাহবাজপুর ব্রীজ ভেঙ্গে দিই। আমি অত্যন্ত অসুস্থ হওয়ায় আগরতলা হসপিটালে চলে যাই। হসপিটালে দু'সপ্তাহ থাকতে হয়। ১লা মে আমি আবার তেলিয়াপাড়া পৌঁছি। তখনও মাধবপুরে আমাদের ডিফেন্স ছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তখন শাহবাজপুর পর্যন্ত পৌঁছেছে। তেলিয়াপাড়ায় মেজর শফিউল্লাহ আমাকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শাহবাজপুর পাঠান পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড করার জন্য। তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর হয়ে শাহবাজপুর পৌঁছতে আমার এক রাত দুই দিন লেগে যায়।

ময়মনসিংহ-ঢাকা সিলেটের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এম, এ, মতিন[]

১২-৪-৭৩

 ২৯শে মার্চ ২য় বেঙ্গল জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে আসে। মেজর মইনুল হাসান, মেজর নূরুল ইসলামও ছিলেন। আমি তাদের সাথে দেখা করে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেবার জন্যে। তখনই বাড়ি গিয়ে মা-বাবা কে বলে চলে আসি। পাকবাহিনী কি করে আমাদের সবার খবর পেয়েছিল। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে পাক বিমান এসে ভৈরবের ওখানে বোমা ফেলে এবং কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে যায়।

 রাত ১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হই। আমরা সংখ্যায় ৮০০'র উপরে ছিলাম। সেকেণ্ডে বেঙ্গলের পুরা ব্যাটালিয়নসহ বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাত্রা করি।

 ৩০শে মার্চ ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাই। ওখান থেকে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে (সিলেট) যাই সকাল ৮টার দিকে। ওখানে মেজর খালেদ মোশাররফ আগে থেকেই ছিলেন। মেজর মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিয়ে ছিলেন। ৩১শে মার্চ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। দুটি বেঙ্গল রেজিমেণ্টের হেডকোয়ার্টার ওখানে করি। দুটি বাহিনী মিলে আলাপ আলোচনা করে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঐ তারিখে বিএসএফ-এর অফিসারবৃন্দ আমাদের হেডকোয়ার্টারে আসে এবং আশা-ভরসা দেয় সম্ভাব্য সব কিছু সাহায্য দেবার জন্য। কর্ণেল শফিউল্লাহ মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আলাপ করেন এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানীকে জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে পাঠানো হয় চট্টগ্রামের দিকে। অপরদিকে ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সেকেণ্ড বেঙ্গলের অপর একটি কোম্পানীকে সিলেট পাঠানো হয়।

 এপ্রিল মাসের ১/২তারিখে কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন ইপিআর বাহিনী নিয়ে নরসিংদী পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। ব্যাপক যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীর বহু লোক মারা যায়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীও কিছু লোক হারায়।

 ক্যাপ্টেন এ.এস.এম নাসিমের আর একটি দলকে কর্নেল শফিউল্লাহ আশুগঞ্জে (কুমিল্লা) পাঠান পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্যে ১লা এপ্রিলের দিকে। ইপিআর বাহিনী ১০০ মত এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ২৫/৩০ জন লোক নিয়ে একটি কোম্পানী গঠন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইলে পাঠানো হয় রিজার্ভ হিসাবে। সরাইলে গিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষা দেবার জন্যে একটি ট্রেনিং সেণ্টার খুলি।

 ১৩ই এপ্রিল আমার উপর হুকুম হলো আশুগঞ্জের সংলগ্ন লালপুরে যাবার জন্যে শত্রুর মোকাবিলা করতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে পৌঁছে আমার বাহিনী নিয়ে আমরা আলোচনা করছি এমন সময় পাক বাহিনীর ৪টি স্যাবর জেট দেড় ঘণ্টা যাবৎ আক্রমণ চালায়। আমার বাহিনীর অনেকে মেশিনগান নিয়ে বাড়ির ছাদে গিয়ে আক্রমণ চালায়। বিমান স্টেশন থেকে চলে যায়। ওখানে আমরা মহসিন নামে একজন সিপাইকে হারাই। রাতে আমরা রওনা হয়ে আশুগঞ্জ পৌঁছাই। মেজর নাসিমের সাথে আলাপ করে লালপুরে যাই। রাত ৪টার দিকে লালপুরে পৌঁছাই।

 ১৪ই এপ্রিল পাক বিমান আশুগঞ্জ ও লালপুরে গোলাবর্ষণ করে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাক বাহিনী জলযানে করে গুলি করতে করতে আসে।ভারী অস্ত্র ব্যবহারের দরুন আমাদের বেশ কিছু লোক হারাতে হলো।পাক বাহিনী তীরে উঠে পড়লে আমরা পিছু হটতে থাকি। ঐদিন আগঞ্জ ও লালপুরে পাক বিমান ব্যাপকভাবে বোমাবর্ষণ করে। আমরা পিছু হটি, সেখানেও টিকতে পারিনি। ইতিমধ্যে আমাদের পেছনে হেলিকপ্টারে করে পাক বাহিনী সৈন্য নামায়। সামনে পিছনে বিমান আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটি। ওখানে বেশ কিছু লোক হারাই। ১৫ই এপ্রিল কুমিল্লা জেলার শাহবাজপুরে পৌঁছাই। আমাদের দুটো বাহিনীর প্রায় ৪০ জনের মত মারা যায়। আশুগঞ্জ ও লালপুরে অধিকাংশ বাড়িঘর পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। লোকজনকে হত্যা করে মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে ব্রীজ ভেঙ্গে ওখানে আমি অবস্থান করতে থাকি কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশক্রমে। রাস্তাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের মধ্যে যোগ ছিল।

 ১৭ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৭/৮টার দিকে পাক বাহিনী এক ব্যাটালিয়ন আর্টিলারী ও অন্যান্য সব কিছু নিয়ে আক্রমণ চালায়, গানবোটও তাদের ছিল। সামনে আমাদের উপর তারা আক্রমণ চালায়। অপর পাক দল অন্য দিক থেকে নদীর পার হয়ে আক্রমণ করে। সারারাত যুদ্ধ হয়। আমার ৫ জন মারা যায়। পাক বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমরা পিছু হটে মাধবপুরে গিয়ে ঘাঁটি গড়ি। সেখানে ক্যাপ্টেন নাসিম তার দল নিয়ে ছিলেন। আমাদের ঘাঁটি দৃঢ় করি। কর্নেল শফিউল্লাহ দেখাশোনা করেন।

 ২১/২২ এপ্রিল পাক বাহিনী এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় বেলা ১২টার দিকে। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। আর্টিলারী মর্টার নিয়ে আক্রমণ চালায়। আমাদের ২৫০ মত ছিল। এক পর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীর ৪০০/৫০০ জন মারা যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রধানতঃ যোগাযোগের অভাবে আমরা পিছু হটি সন্ধ্যা ৭টার দিকে। আমাদের ২০/২৫ জন মারা যায় ঐ যুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত দুই কোম্পানীসহ তেলিয়াপাড়া পৌঁছাই। আমরা সিলেট হারালাম।

ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ []সিপাই আফতাব হোসেন

২৪-৭-১৯৭৪

 ময়মনসিংহে খাকডোরে ইপিআর-এর ২ নং শাখা ছিল। উইং কমাণ্ডার ছিল ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস (পঃ পাকিস্তানী), সুবেদার মেজর জিন্নত গুল (পাঠান), নায়েব সুবেদার খান বাহদুর, নায়েব সুবেদার হজরত খান, নায়েব সুবেদার রাজা বেলাল (পঃ পাকিস্তানী)।

 ২৬শে মার্চ ইপিআরকে আর্মস-এম্যুনিশন দেয়া হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। এবং উইং হেডকোয়ার্টারের চারিদিকে পরিখা-মরিচা খনন করার নির্দেশ দেয়া হয়। ঐদিনই দুপুরের পর হাজার হাজার স্থানীয় ছাত্র-জনতা দা, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি নিয়ে ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করার চেষ্টা করে। বাঙ্গালী সুবেদার সি-কোম্পানী কমাণ্ডার ফরিদ আহমদ ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে মেগাফোনে বলেন যে, আপনারা চলে যান। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নূরুল ইসলামের কোম্পানীও উইং হেডকোয়ার্টারের গ্রাউণ্ডে তাঁবুর মধ্যে ছিল। মেজর নুরুল ইসলামও মাইকে জনতাকে চলে যেতে বলেছিলেন। কিছুক্ষণ পর জনতা চলে যায়।

 ২৭শে মার্চ দুপুরের পর আমাদের উইং কমাণ্ডার কমর আব্বাস সমস্ত ইপিআরকে অফিসের সামনে মাঠের মধ্যে একত্রিত করেন। তারপর সমস্ত ইপিআর-এর উদ্দেশে ভাষণ দেন। সামরিক আইনের কয়েকটি বিধিনিষেধ তিনি আমাদেরকে পড়ে শোনালেন এবং বলেন, এখন থেকে দুইজনের মধ্যে কোন আলাপ- আলোচনা করা চলবে না, যদি কেউ করে আমি নিজে গুলি করে তাকে মেরে ফেলব। কোন বাঙ্গালী যদি কোন অপপ্রচারে লিপ্ত হয় তাহলে ' মেরা পহেলা গুলি উসকা সিনাকে সিনাছে নিকাল যায়েগি।'

 ২৭শে মার্চ বিকেল বেলায় আমি, সিপাই ইদ্রিস রেডিওতে খবর শুনলাম যে ঢাকাতে পিলখানা, রাজারবাগ পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে। তখন আমি সিপাই নান্নুকে (১৪৩৬৮) বললাম যে ঢাকাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙ্গালীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমাদের নিকট থেকে হয়ত অস্ত্রশস্ত্র জমা নিয়ে নিতে পারে। এক বিন্দু রক্ত থাকতে অস্ত্রসমর্পণ করব না বলে নান্নুকে বললাম। তার কিছুক্ষণ পর নায়েক সুবেদার খান বাহদুর (পাঠান) এবং পাকিস্তানী হাবিলদার আজিম আমাদের ৭নং প্লাটুনে আসলেন এবং স্বয়ংক্রিয় সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জমা দেবার নির্দেশ দেন এবং এরিয়ার বাইরে ডিউটিতে যেতে বলে। তখন আমি আর নান্নু বললাম, দস্তখত করে হাতিয়ার এবং এম্যুনিশন নিয়েছি। এক বিন্দু রক্ত থাকতে তা জমা দেব না। তারপর তারা চলে যায়। সন্ধ্যর সময় খানা খাবার জন্য সবাইকে ৫ মিনিট সময় দেয়া হয়। কিন্তু আমি হালকা মেশিনগান নিয়ে বসে রইলাম এবং নান্নু ও অন্যান্য সবাই খানা খেতে চলে যায়। হাবিলদার আজিমের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। আজিম আমাকে” তোম তো আজকাল সাচ্চা কমাণ্ডার বন গায়া।” বলে ঠাট্টা- পরিহাস করে। তখন আমি আজিমকে বলি যে, আমি বাঙ্গালী ছেলে। এটা বাংলাদেশ। আমার হাতে হালকা মেশিনগান আছে। এক্ষুনি এক ব্রাশ মেরে দেব। তখন খান বাহাদুর আমাকে অজুহাতে বন্দী করার চেষ্টা করে। তারপর সিপাহী নান্নু খানা খেয়ে চলে আসে। দুইজন একত্রে হবার দরুন আমাকে বন্দী করতে পারে নাই। তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত পাকিস্তানীরা আমাদেরকে উইং হেডকোয়ার্টারের পেট্রল ডিউটি করায়। ডিউটি শেষে সমস্ত ইপিআরকে এক জায়গায় জমা করে। উইং কমাণ্ডার কমর আব্বাস এবং সুবেদার মেজর জিন্নাত গুল আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'জোয়ান লোগ রাত কো ডিউটি কাজ জরুরত নেহি হায়। তুম লোগ নিন্দ যাও।' তারপর সবাই ব্যারাকে চলে যায়।  রাত প্রায় ১০ ঘটিকার সময় আমার ওস্তাদ লোকাস কুইয়া (খ্রীষ্টান) আমাদের ৭নং প্লাটুনকে উদ্দেশ্য করে যার যার সেণ্ট্রি ডিউটি আছে তাদেরকে দাঁড়াবার জন্য বলে। কিন্তু কেউ ডিউটিতে দাঁড়ালেন না। তখন আমি লোকাস কুইয়াকে বললাম আজ রাতে আমি ও নান্নু ডিউটি করব হালকা মেশিনগান নিয়ে। আমি আর নান্নু দুইজন দুই দরজায় ডিউটির জন্য দুইটা হলকা মেশিনগান নিয়ে দাঁড়ালাম। তর কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানী হাবিলদার সিকিউরিটি নজির বাদশাহ এবং এম,টি, প্লাটুনের হাবিলদার গোলাম হায়দার (পাকিস্তানী) দুইটা চীনা স্টেনগান নিয়ে আমার প্লাটুন হাবিলদার আজিমকে গোপনে কি যেন নির্দেশ দিয়ে যায়।

 আমাদের ব্যারাকের সামনে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের ১৪ নং ডিভিশনের (যারা ইলেকশন ডিউটিতে ময়মনসিংহ এসেছিল) এক প্লাটুন সৈন্য তাঁবুর মধ্যে ছিল। রাত প্রায় সাড়ে বারটার সময় হটাৎ একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। তখন লাইনের ভেতরে যে কয়েকজন অবাঙ্গালী ইপিআর ছিল তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। নান্নু তখন সাথে সাথে তার হালকা মেশিনগান দিয়ে বারান্দা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের প্লাটুনের উপর ফায়ার আরম্ভ করে দেয়। বিহারী সিপাহী মমতাজের নিকট থেকে আমি একটি হালকা মেশিনগান উদ্ধার করি। এই গান বাঙ্গালী সিপাহী (১৫২৭৯) হারুনকে দিই। হারুনকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের প্লাটুনের উপর ফায়ার করার জন্য নির্দেশ দিই। সিপাই মোস্তফা (১২৫২৭)-কে একটি হালকা মেশিনগান দিই দোতলা-তেতলা থেকে সিড়ির পথ বন্ধ করার জন্য। তখন আমি উপরতলায় যত বাঙ্গালী ইপিআর ছিল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, রাত্রি বেলায় বাঙ্গালী হোক বা অবাঙ্গালী হোক কেউ যেন নীচে নামার চেষ্টা না। করে। যদি কেউ চেষ্টা করে তাকে গুলি করা হবে। তারপর পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের প্লাটুনের সাথে আমাদের সারারাত গুলি বিনিময় হয়। ভোর পর্যন্ত (২৮ শে মার্চ) পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের সমস্ত প্লাটুনকে ধ্বংস করা হয়।

 ২৮ মার্চ সকালবেলা আমি হারুনকে নির্দেশ দিলাম মেগাফোন দিয়ে শ্লোগান দেয়ার জন্যঃ নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর, জয় বাঙ্গালীর জয়। আরো বললাম সবাই এখন উপরতলা থেকে নিচে নামতে পারে।

 তারপর আমি সিপাই নান্নু, সিপাই মোস্তফা, সিপাই হারুন এবং আরো কয়েকজন সিপাই নিয়ে সুবেদার মেজর জিন্নাত গুলের কোয়ার্টার আক্রমণ করি। সেই কোয়ার্টারে দু'জন হাবিলদারসহ চারজন পাকিস্তানী জেসিও ছিল। আমরা বাঙ্গালীরা সবাই মিলে তাদের উপর ফায়ার করছিলাম। এমন সময় উইং কমাণ্ডার তার পার্টি নিয়ে পেছন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা দেখে ফেলি। উইং কমাণ্ডার-এর পার্টির সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। তার পরই উইং কমাণ্ডার তার পার্টিসহ মুক্তাগাছার দিকে পালাতে চেষ্টা করে।

 ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের বাস রোড রেল লাইনের ক্রসিংয়ে উইং কমাণ্ডারের পার্টি পজিশন নেয়। তখন সিপাই নান্নু মিয়া ক্রলিং করে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের নিকট চলে যায়। কমর আব্বাস নান্নুকে দেখে ফেলে এবং চীনা স্টেনগান নিয়ে নান্নুর উপর ব্রাশ ফায়ার করে। নান্নু পজিশন নেয়াতে তার গায়ে গুলি লাগে নাই। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আবার অন্য ম্যাগাজিন গানের মধ্যে লাগাবার চেষ্টা করে। তার আগেই নান্নু ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে গুলি করে মেরে ফেলে। এইভাবে তার সাথের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। তার সাথে সাথেই চারদিক থেকে জনতা এসে তাদের মৃতদেহ নিয়ে যায় এবং মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়ায়। তারপর আমরা আবার সুবেদার মেজরের পার্টিকে আক্রমণ করি। ২৮শে মার্চ বিকেল পাঁচটার সময় তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর আমরা বাঙ্গালী ইপিআররা সুবেদার মেজরের পার্টিকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠাই।

 এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি-কোম্পানী (২য় বেঙ্গল) অধিনায়ক মেজর নূরুল ইসলাম ও লেফটেন্যাণ্ট মান্নান রাত্রিবেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারে সিএগুবি'র ডাকবাংলোতে ছিলেন। যখন গোলাগুলি আরম্ভ হয় তখন আমাদের উইং কমাণ্ডার কমর আব্বাসের পার্টি মেজর নূরুল ইসলামের উপর ফায়ার আরম্ভ করে দেয়। তখন তারা সেখান থেকে নদী সাঁতরিয়ে ওপারে চলে যান। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানী গোলাগুলির সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং অনেকে শহরে চলে যায়। সামান্য কয়েকজন লোক ময়মনসিংহে আমাদের এরিয়ার মধ্যে পজিশনে থাকে এবং সকাল বেলায় আমাদেরকে সাহায্য করে।

 সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, জিনিসপত্র ময়মনসিংহ শহরের রাবেয়া স্কুলে নিয়ে যায় এবং আমাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে। ২৯শে মার্চ আমরা ময়মনসিংহ ডিফেন্স নিয়ে থাকি। ইতিমধ্যে মেজর শফিউল্লাহ (সি-ইন- সি,বর্তমানে) জয়দেবপুর থেকে তাঁর লোকজন নিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ আসেন। ৩০শে মার্চ সমস্ত ইপিআর এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোকজন নিয়ে মেজর শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (ঢাকার রুপগঞ্জ থেকে এসে যোগ দিয়ে ইপিআর-এর চার্জ নেন) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মেজর শফিউল্লাহর নির্দেশে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ট্রেনযোগে আমরা ঢাকার দিকে রওনা হই।

 ৩১শে মার্চ আমাদের দল ঢাকার নরসিংদী পৌঁছায়। নরসিংদী থেকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান কয়েকশত ইপিআর নিয়ে ঢাকা জেলার ভাঙ্গা বাজারের নিকটে শতিলক্ষ্যা নদীর তীরে ডিফেন্স নেয় (১লা এপ্রিল); ২রা এপ্রিল আমাদের এক সেকশন (মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গেরিলা পার্টি, ইপিআর-এর) নং ৩১৫৭ হাবিলদার আবদুল হাকিম, ১৪৩৬৮ সিপাহী নান্নু মিয়া, ১৫২৬৯ মোহাম্মদ আফতাব হোসেন, ১৫২৭৯ হারুনুর রশীদ, ১২৫২৭ নওয়াজ, ১৫৪৯২ মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ১৭৩০৮ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ মফিজউদ্দিন, সাইদুর রহমান, আবদুল সাত্তার প্রমুখ ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমানের নির্দেশে ঢাকা পৌঁছে। শার্ট- লুঙ্গি পরে আমরা একটা চীনা স্টেনগান, হালকা মেশিনগান পাঁচটা, বাকি ৩০৩ রাইফেল, অনেক গ্রেনেড ও এম্যুনিশনের বাক্স নিয়ে ২রা এপ্রিল রাত্রের বেলা ঢাকা শহরের নিকটে আমুলিয়া গ্রামে আসি।

 যাত্রাবাড়ি প্রতিরোধঃ ৫ই এপ্রিল রাত আটটার সময় যাত্রাবাড়ি রোডে পাকসেনা বোঝাই একটা গাড়ীর উপর আক্রমণ চালাই। পুরো গাড়ী সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়। সাথে সাথে ঢাকা এবং ডেমরার দিক থেকে পাকসেনারা অনেকগুলি গাড়ী নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাথে প্লেন আসে এবং গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমরা আক্রমণ চালিয়েই সাথে সাথে আবার গ্রামে চলে যাই।

 পাঁচদোনাতে প্রতিরোধঃ এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ ঢাকার পাঁচদোনাতে আমাদের হেডকোয়ার্টার ডিফেন্স পাকিস্তানী সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। এখানে তুমুল লড়াই চলে। এই লড়াই দু'দিন চলে। ক্যাপ্টেন মতিয়ার রহমান ও সুবেদার ফরিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে ৪০০/৫০০ পাকসেনা হতাহত হয়। ২০/২৫টা গাড়ী সম্পূর্নরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। তার পরদিন ঢাকা সেনানিবাস থেকে বিপুল সৈন্য পাঁচদোনাতে আবার আমাদের উপর হামলা চালায় এবং তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। হেলিকপ্টার দিয়ে পেছনে ছত্রীসৈন্য নামাতে থাকে। পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা ভারতের আগরতলাতে চলে যায়। সেখানে তারা ৩নং সেক্টরে যোগদান করে।

 মনোহরদীতে গেরিলা অপারেশনঃ আমাদের উপরে উল্লিখিত গেরিলা পার্টি ঢাকার মনোহরদী থানা এলাকায় যায়। প্রায় এক মাস মনোহরদীতে গেরিলা অপারেশন চালাবার পর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা জেলার পাটুলী গ্রামে সিরাজ মিয়ার বাড়িতে হঠাৎ করে আমাদের পার্টির দু'জনের পায়ে গুলি লাগে (দুর্ঘটনায়)। এতে পুলিশের মোহাম্মদ আবদুল হক (গ্রাম-নিলক্ষ্মীয়া, ডাকয়র-দুলালকান্দী থানা-রায়পুর ঢাকা) ও মুজাহিদ আবদুল সালাম (গ্রাম-দুলালকান্দি থানা রায়পুর) মরে যান।

 কাটিয়াদী থানা অপরেশনঃ ১৯৭১ সনের মে মাসে আমার দল নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার কাটিয়াদী থানা অপারেশন করি। এর আগের দিন সেনারা কাটিয়াদী থানার আশেপাশে ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছিল এবং গ্রামের বেশ কয়েকজন নিরীহ লোককে হত্যা করেছিল। তারা গ্রামে ঢুকে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হয়েছিল। থানার বাঙ্গালী পুলিশদের কেউ কেউ খানসেনাদের সাথে সহযোগিতা করেছিল। তারও লুটতরাজে লিপ্ত ছিল। সিপাহী হারুনকে আমি রেকি করতে পাঠিয়েছিলাম। হারুন গিয়ে দেখে খানসেনারা লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ করে চলে গেছে। বাঙ্গালী পুলিশ ও অফিসাররা লুটতরাজ করে এক ধনী হিন্দুবাড়ি থেকে টাকা-স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছে। সিপাহী হারুন তাদেরকে বাধা দেয় এবং বলে যে আপনারা বাঙ্গালী হয়ে বাঙ্গালীর উপর অত্যাচার করছেন। তখন হারুনের উপর তারা ওসি'র নির্দেশে ৭ রাউণ্ড ফায়ার করে। সে কোনরকমে তার সাইকেল ফেলে চলে আসে। তখন ঐ দিন রাতেই আমরা কাটিয়াদী থানার উপর আক্রমণ করি। ভোরবেলায় বাঙ্গালী ও-সি' কে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘাতক পুলিশ পালিয়ে যায়। এখানে থেকে ১৭টি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করি।

সিপাই মোঃ আফতাব হোসেন, নং ১৫২৬৯
বাংলাদেশের রাইফেলস, সেক্টর হেডকোয়ার্টার
কুটিবাড়ি, দিনাজপুর।

শত্রুর প্রচণ্ড চাপে মনতলার পতন[]

মেজর এম, এস, এ ভূঁইয়া

 মে মাসের শেষের দিক। তেলিয়াপাড়া পতনের পর ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে মেজর) সিলেটের পাকিস্তানী এলাকা মনতলায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেন। মেজর মঈন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন হরশপুর এবং মুকুন্দপুরে। ঐ দিক থেকে শত্রুর প্রবল হামলার আশংকা থাকায় আমাদের দু'ধারের পজিশন মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিরক্ষ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য পাঠানো হলো। আমার সাথে দেয়া হলো ৫০ জন জোয়ান। সঙ্গে অস্ত্র দেওয়া হলো একটি ভারী মেশিনগান, ৭টি হালকা মেশিনগান এবং বাকীগুলি রাইফেল। জায়গার তুলনায় আমার সাথে লোকসংখ্যা এবং অস্ত্রের পরিমাণ ছিল নগণ্য। এত অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে আমাকে প্রায় আড়াই মাইল ফরোয়ার্ড লাইন কভার করতে হয়েছিল। আমাদের মিলিটারী ট্রেনিং অনুযায়ী এত বিরাট এলাকা কভার করা ছিল অকল্পনীয়।

 যা হোক, এই অল্পসংখ্যক লোক নিয়েই আমি মনতলা থেকে গিলাতলী এবং তারপর ইখতেয়ারপুর গ্রাম পর্যন্ত কভার করলাম। অবশ্য আমার অসুবিধা টের পেয়ে আমাকে আরও ২০ জন লোক দেওয়া হয়। এই ২০ জনের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিমান বাহিনীর লোক। সুতরাং পদাতিক বাহিনীর ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে তাদের ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল না। আমি যাওয়ার আগেই শত্রুরা সেখানে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের আক্রমণ কার্যকর হয়নি। প্রত্যেক বারই তাদের আক্রমণ ব্যাহত হতে লাগল। বাধ্য হয়ে শত্রুরা তাদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে ব্যাপৃত হল। শত্রুবাহিনী দিনের বেলা কয়েকবারই আমাদের উপর আক্রমণ চালালো। প্রথমে তারা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ডাক দিয়ে আক্রমণ চালায়। আমি এবং মেজর নাসিম প্রতিরক্ষা ব্যূহের ডান দিকে দুটি ভারী মেশিনগান রেখেছিলাম। ফলে শত্রুর পক্ষের আমাদের অবস্থান ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হল না। একদিন দিনের বেলায় আক্রমণের সময় শত্রুবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হলো। শত্রুঅনেক মৃতদেহ পিছনে ফেলে রেখে হটে যেতে বাধ্য হলো।

 আরেকদিন শত্রুবাহিনীর সাথে আমাদের লড়াই হলো মুখোমুখি। এ সময়ে শত্রুর সৈন্যসংখ্যা ছিল বিপুল। শত্রুবাহিনীর সংখ্যাধিক্যে আমাদের জোয়ানরা কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ আমাদের কোম্পানী তুলে নেওয়ার জন্যে পর্যন্ত পীড়াপীড়ি করেছিল। মনতলা পতনের শেষ দিন সন্ধ্যায় শত্রুবাহিনী এক ব্রিগেড এবং এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে মেজর নাসিম, লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদ এবং আমার পজিশনের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালাল। আমি সে সময়ে ছিলাম আমার কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে। আমি যাচ্ছিলাম মনতলা রেলওয়ে লাইনের ডান পার্শ্বে যে দুটো সেকশন ছিল সেগুলো চেক করার জন্যে। পথে জনৈক বে-সামরিক ব্যক্তির কাছে জানতে পারলাম মনতলা রেলওয়ে স্টেশনে আমাদের কোন লোক নেই। তার কথা আমার বিশ্বাস হল না, বরং পাল্টা তার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক হল। আমি ঐ লোকটির সঙ্গে আমার দু'জন দেহরক্ষীকে দিয়ে মনন্তলার পজিশন চেক করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ওদিকে শত্রুবাহিনী ছয়টি কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর অনবরত গোলাবর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। আমার পাঠানো দেহরক্ষী দু'জন ফিরে এসে জানালো, সত্যি সত্যিই ঐ পজিশনে আমাদের কোন লোক নেই। রাত তখন ৮টা বাজে।

 সেদিনকার ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিচ্ছিঃ মেজর নাসিমের অবস্থানের উপর শত্রবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য আক্রমণ চালায়। এক ব্যাটালিয়নের সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৮০০ শত। এই বিপুল সৈন্যের আক্রমণের মুখে মেজর নাসিম ও তাঁর সৈন্যদের অবস্থানে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তিনি তাঁর কোম্পানী নিয়ে অবস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। মেজর নাসিম মেজর মঈনের কোম্পানীকে (পরে লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদের দ্বারা পরিচালিত) ফরোয়ার্ড লাইনে টেলিফোনের মাধ্যমে এই সৈন্য উঠিয়ে নেওয়ার সংবাদ জানান। আমার সাথে মেজর নাসিম এবং লেফ্টেন্যাণ্ট মোর্শেদ উভয়ের সাথেই কোন টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল না। বাধ্য হয়ে মেজর নাসিম দুজন জওয়ান মারফত আমাকে এই সংবাদ পাঠান যে, শত্রুবাহিনীর আক্রমণ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খবরে আরো বললেন যে, শত্রুত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছে। মেজর নাসিম এবং লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদের সৈন্যদের পজিশন ছিল আমার উভয় পার্শ্বে। তাদের পজিশনে শত্রু প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। মেজর নাসিমের সৈন্যরা তুমূল লড়াই করে শত্রুর অগ্রগতিকে ব্যাহত কারার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। অবশেষে মেজর নাসিম নিজের ট্রপস এবং আমার কোম্পানীর ২১ জন লোক ও সুবেদার মান্নানকে নিয়ে পঞ্চবটিতে অর্থাৎ কয়েক মাইল পেছনে সরে গেলেন। ওদিকে লেফটেন্যাণ্ট মোর্শেদও প্রাণপণ লড়াই করার পর তাঁর সৈন্যদের নিয়ে সরে পড়তে শুরু করেছেন। আমি এসবের কোন খবরই পাইনি। তদুপরি আমার প্রতিরক্ষা লাইন ছিল কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে আড়াই মাইল আগে।

 আমার সে সময়কার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমি তখন বলতে গেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছি। রাত দশটার দিকে আমার হেডকোয়ার্টারের উপর প্রায় দশটা কামানের গোলা এসে পড়ল। আমাদের সংগ্রামী সৈনিকরা অনেকেই একেবারে নতুন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে তারা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই জীবনে এই প্রথম কামানের গোলার আওয়াজ শুনলো। শত্রুডান দিক দিয়ে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে যারা ছিল তাদের উপর প্রচণ্ড চাপ এল। আমি হেডকোয়ার্টারে থেকে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে অর্থাৎ ইখতেয়ারপুর ও গিলাতলীতে যারা ছিল তাদের খবরও জানা সম্ভব হল না। কাসিমপুর রেলওয়ে স্টেশনের ওখানে আমার একটি অবস্থান ছিল। সেখানকার জেয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ জন। আমি তাদের ওখানে দু'জন রানার পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু শত্রুদের কামান থেকে তখন এমন অবিরামভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল যে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর তারা থেমে যেতে বাধ্য হল।

 রাত তখন দশটা বাজে। আমিও অবস্থান ত্যাগ করাই মনস্থ করলাম। সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে তাদের জানিয়ে দিলাম, পরবর্তী অবস্থান এবং প্রতিরক্ষাব্যূহ রচিত হবে চৌমুহনীতে।

 শত্রু তখন তিন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি হেডকোয়ার্টার নিয়ে চৌমুহনীর দিকে রওনা হলাম। আমরা সবাই নিজ নজি অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সঙ্গে নিলাম। বাধ্য হয়ে আমরা সে সময়ে অনেক বেসামরিক লোককেও আমাদের অস্ত্রে বোঝা বহন কারার জন্যে সঙ্গে নিয়েছিলাম।  আমার বহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার সময় অন্যান্য কয়েকটি দলও এস আমার দলের সঙ্গে যোগ দিল। শত্রুর অগ্রগতিকে বিলম্বিত করার জন্য হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমরা গুলি করতে থাকলাম। রাত দুটোয় এসে আমরা পৌঁছলাম চৌমুহনীতে। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই সেখানে এসে একত্রিত হলাম। আমাদের কোম্পানীর সমস্ত সৈন্যই ছড়িয়ে পড়াতে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে কি- আমার অবস্থা ছিল ঝড়ের সমুদ্রের ছিন্নপাল নৌকার মাঝির মত। এখন সবাইকে এক স্থানে পেয়ে আমি খোদার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

 চৌমুহনীতে এসে আমি কোম্পানীর সবাইকে পেলাম সত্য, কিন্তু আবার নতুন বিপদের সম্মুখীন হলাম। হালকা মেশিনগান সজ্জিত আমার কয়েকটি সৈন্যদল গুলিবর্ষণ করে শত্রুসৈন্যদের অগ্রগতিকে বিলম্বিত করতে সক্ষম হলেও, শত্রুর পার্শ্ববর্তী অগ্রগতিকে বাধা দিতে সক্ষম হল না। আর শত্রুর সবদিকের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখাও ছিল অসম্ভব-কারণ আমাদের সংখ্যাল্পতা। সংখ্যায় শত্রুসৈন্য ছিল আমাদের তুলনায় দশগুণ। ভারতীয় সীমানা থেকে চৌমুহনীর দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। কিন্তু এই দুই মাইল রাস্তা সেদিন রাতে আমাদের কাছে অন্তহীন বলে মনে হয়েছিল।

 রাতের শেষের দিক তখন। তখন ভোর চারটা। শত্রুরা শুধু গুলি করতেই এগিয়ে আসছিল না, তারা এগিয়ে আসছিল ঘরবাড়ি, গাছপালা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে।

 ভোর সাড়ে চারটার দিকে তারা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। শত্রুবাহিনী তখন আমাদের পশ্চাদ্ভাগের ব্যূহ প্রায় ভেদ করে ফেলেছে। আমাদের বাহিনীর তিন দিক বেষ্টন করেছে তারা। সামনে, দক্ষিণে এবং বামে। তখন ঐ নিতান্ত ফাঁদে পড়া অবস্থার মধ্যেও আমরা মনোবল না হারিয়ে তিনদিকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে অবিরাম গুলি চালাতে লাগলাম। আমাদের প্রতিজ্ঞাঃ আমরা শত্রুদের কিছুতেই আমাদরকে ঘেরাও করতে দেব না। আমাদের হাতে তখন ছিল মর্টার আর ৫৬টা গোলা। নিরুপায় হয়ে শত্রুসৈন্যের উপর আমি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলাম। গোলার সংখ্যা কম হওয়াতে প্রতি দু-তিন মিনিট অন্তর শত্রুর অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করছিলাম। সেদিন মর্টারটি আমাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে বিধাতার আর্শীবাদের মত সাহায্য করছিল।

 সূর্য ওঠার পর দেখতে পেলাম শত্রুরা আমাদেরকে সম্পূর্নভাবে ঘিরে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে আমাদের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি বিনিময় চলল। অবশেষে সকাল ৯টার দিকে আমরা সিদাই থানায় পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।

নরসিংদী-আশুগঞ্জ সশস্ত্র প্রতিরোধ

ব্রিগেডিয়ার মোঃ মতিউর রহমান বীর প্রতীক[]

 সুবেদার মেজর সুলতানের আমলে আমার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল নরসিংদীতে। আমি ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে যশের সেনানিবাসের ২৫ বেলুচ রেজিমেণ্ট ছেড়ে ২৭শে মার্চ ময়মনসিংহ পৌঁছি। ময়মনসিংহে ইপিআর-এর এক কোম্পানী নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হই যুদ্ধ করার জন্য। ৩১শে মার্চ নরসিংদী পৌঁছি। সুবেদার মেজর সুলতান তখন ঢাকা থেকে সামান্য কয়েকজন লোকসহ নরসিংদী পৌঁছে এবং ১লা এপ্রিল আমার সাথে যোগ দেয়। ঢাকার লোকজন যখন মার খেয়ে দিশাহারা হয়ে শহর ছেড়ে পালাইতেছিল, তখন সুলতান সাহেব আমার সাথে কয়েকজন ইপিআর-এর লোকজন এবং ছাত্র ও জনতার সাথে যোগ দিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ সংঘর্ষে দুর্ধর্ষ সাহস এবং শক্তিতে যুদ্ধ করেন। এরপর থেকে পুরো নয়টি মাস তিনি আমার সাথে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে যান। নয় মাসের তার এবং বাকী সহকর্মীদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সব লিখতে গেলে অনেক দীর্ঘ এক ইতিহাস হবে। আজকের এই লেখায়, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখব না। শুধু বাংলাদেশ রাইফেলস-এর একটি বীরযোদ্ধার সামান্য একটু বলছি, তাতেই বুঝা যাবে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সংগঠন কত তীক্ষ্ণ এবং জাগ্রত।

 ঢাকা-নরসিংদী সড়কে করইতলী, বাবুরহাট, পাঁচদোনা এবং অন্যান্য স্থানে সম্মুখ যুদ্ধের পর আমাদের নরসিংদী ত্যাগ করতে হয়।

 ১৩ই এপ্রিল সকালে আমরা আশুগঞ্জে পৌঁছানোর পর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক কোম্পনীর ওখানে যাই। বিগ্রেডিয়ার নাসিম (তখন ক্যাপ্টেন) কোম্পানী কমাণ্ডার। তিনি আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেছেন। আমার সাথে তখন ৪০/৫০ জন লোকে এবং সাথে শুধু ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র আছে। তিনি আমাকে বললেন, আপনি ভৈরবের সামনে নরসিংদীর দিকে রামনগর রেলওয়ে ব্রীজের ওখানে যেয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করুন। পাকিস্তান আর্মির অগ্রগতিকে ওখানে রোধ করতে হবে। যতক্ষণ সম্ভব রুখতে হবে। অসম্ভব হয়ে পড়লে এখানে আসবেন, একসাথে মিলে যুদ্ধ করব।

 আমরা ১৩ই এপ্রিল বেলা ৯টার দিকে রামনগর পুলের নিকট পৌঁছি। এলাকায় পৌঁছে লোকজনকে স্থান নির্ধারিত করার পূর্বেই দেখতে পেলাম রেল লাইন দরে পাকিস্তান আর্মি অগ্রসর হচ্ছে। বেলা ১০/১১টার দিকে তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়। তারা সমস্ত দিন চেষ্টা করল, কিন্তু আর অগ্রসর হতে পারল না। পুরা রাত গোলাগুলি চলে। পরদিন সকাল ৬টা ৩০মিনিটের সময় ৬টা পাকিস্তানী স্যাবর জেট প্রথমে একবার উপর দিয়ে ঘরে গেল। ফেরত আসার পথে আমাদের এলাকাসহ আশুগঞ্জ ও ভৈরব বোমা ফেলে এবং স্ট্রাফিং শুরু করে। আমার সামনে তেকে যে পদাতিক বাহিনী এসেছিল তারা আরও একটু এগিয়ে এসে আমাদের উপর গুলিগোলা শুরু করে ব্যতিব্যস্ত রাখে। বাম দিকে মেঘনা নদীতে নৌবাহিনীর গানবোট থেকে নদীর পূর্বপার্শ্বে লালপুরে ব্রিগেডিয়ার আঃ মতিন (তখন ক্যাপ্টেন) ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ১ প্লাটুন নিয়ে অবস্থান করছিল। আমাদের ওখানে আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করা হয়। তার সাতে ৬/৭টা হেলিকপ্টার দিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন আমাদের পিছনে ভৈরব, আশুগঞ্জের পিছনে এবং আমাদের ডান পার্শ্বের বিভিন্ন এলাকায় নামানো আরম্ভ করে। আমরা সম্মুখসমরে ব্যস্ত। তার সাথে দেখছি কি সুন্দর শক্তির প্রদর্শন। জলে, হলে এবং আকাশ থেকে আমাদের উপর আক্রমণ। দেখছি লোকজন বিমান বাহিনীর এবং সেনাবাহিনীর আক্রমণে ঘর ছেড়ে জীবন নিয়ে দিকশূন্য হয়ে পালাচ্ছে আর দাউ দাউ করে জ্বলছে বাড়ীঘর। আমরা সামান্য কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী চারদিক থেকে শত্রুদ্বারা বেষ্টিত।

 পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আক্রমণ ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চলতে তকে। সাথে অন্যান্য বাহিনীর আক্রমণও চলতেই থাকে। আমাদের সাথে যা গোলাবারুদ ছিল তা দুই দিনের অনবরত যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে। ১৪ই এপ্রিল বিকেল ৩টার সময় ভাবছি কোন মতে ভৈরব পার হয়ে আশুগঞ্জে যেয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল- এর কোম্পানীর সাথে মিশতে পারব কিনা। নিজেদের অবস্থান ঘুরে দেখলাম। কারো নিকট ২/৪ রাউণ্ড গুলি আছে। কেউ বা খালি হাতে বসা। কারণ যা কাঁধে করে আগের দিন নিয়ে এসেছিলাম তাই তো সম্বল ছিল, আর তো কেউ কিছুই দিয়ে যায়নি। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটের সময় দেখতে পেলাম ইউনিফর্ম পরা একজন লোক পিছন থেকে আমার খুবই নিকট চলে এসেছে। তাকে মারতে মানা করলাম। উদ্দেশ্য, তাকে আত্মসমর্পণ করাবো। সে আত্মসমর্পণ করার পর দেখতে পেলাম সে আমাদের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন জওয়ান। আশুগঞ্জের পিছনে হেলিকপ্টারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোক নামার পর এবং বিমান বাহিনীর আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর কোম্পানী নিজেদের স্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। সে রাস্তা না পেয়ে এই দিকে এসেছে। মনে করেছে এই দিক দিয়ে বিপদের আশংকা কম। ভাবলাম ওদের সাথে মিলে যুদ্ধ করার কথা ছিল, তা আর হলো না। এখন আমরা শেষ মুহূর্ত গুনছি। চারদিক থেকে পাকিস্তানী বাহিনী জাল গুটিয়ে আনবে আর আমাদের জীবিত ধরবে।

 আরো যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত গুলিগোলা বলতে কিছুই নেই। লোক ক্ষুধায় কাতর। ১১ই এপ্রিল নরসিংদীর পতনের পূর্ব থেকে ১৪ই এপ্রিলের মধ্যে অনেকের বেলা সামান্য আহার জুটেছে। মানুষের জীবন তার অনুভূতির নিকট কত করুণ এবং কঠোর অনুভব হয় তখন হয়ত বুঝতে পেরেছি। আমি কমাণ্ডার হিসেবে তাদেরকে গুলিগোলা দিতে পারছি না যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। খানা দিতে পারছি না ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে। কেউ আমাদের সাহায্য করবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এ রকম আশ্বাসও দিতে পারছি না। কারণ, তখনও জানি না কোথাও থেকে কেউ সাহায্য করবে কিনা, কে কোথায় যুদ্ধ করছে বা লোকজন যুদ্ধ করছে কিনা তাও জানি না।

 বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে আমি মনস্থির করেছি এই স্থান আমাদের ছড়াতে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। সুবেদার মেজর সুলতান (তখন নায়েক সুবেদার) সহ দু'জন আমার প্লাটুন কমাণ্ডার ছিলেন। আমি ব্রহ্মপুত্র নদের রামনগর ব্রীজের পার্শ্বে যেখানে আমার অবস্থান ছিল আসতে বললাম। প্লাটুন কমাণ্ডার আসার পর জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা। তারা বলল, স্যার আপনি তো ঘুরে দেখে এলেন। জওয়ানরা প্রায় শূন্য হাতে বসা।

 আমি বললাম, সুলতান সাহেব, মালেক সাহেব আমাদের এলাকা ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। আমি কথাটা বলার সাথে সাথে দু'জনেই হাউমাউ করে শিশুর মত চীৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল, স্যার কাপুরুষের মত পালিয়ে কোথায় যাব, দেশ কি স্বাধীন হবে না? তাদের কান্নায় আমারও দুচোখে অশ্রু নেমে এলো। তাদের কান্নায় এবং আবেগে প্রায় ১৫/২০ সেকেণ্ডের মত মনে হল আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছি। মানুষের জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত থাকে। এই মুহূর্তটা আমার জীবনে কিভাবে মূল্যায়ন করব জানি না। অনেক সময় মৃত্যু বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তখন জীবন মনে হয় রাবার ইলাষ্টিকের মত দীর্ঘই হয়।

 একটু সুস্থির হয়ে বললাম, এখান থেকে চলে যাওয়ার অর্থ এই নয় আমরা আর যুদ্ধ করব না। আজকে যদি এই হত যে আমাদের ৪০/৫০ জনকে গুলি করে মারলে তারা আমাদের স্বাধীনতা দিবে তাহলে আমি আপনাদের কমাণ্ডার হিসেবে কথা দিচ্ছি আমিই প্রথম মরতাম। যুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে। এখান থেকে চলে যেয়ে আমরা গোলাগুলি সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব। এখন এখানে খালি হাতে বসে থাকলে আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে আনবে এবং আমাদের জীবিত ধরবে আর গুলি করে মেরে ফেলবে। বুঝিয়ে বলার পর মেনে নিল। বলল, স্যার আপনি আমাদের কমাণ্ডার, আপনি যা ভাল বোঝেন তা আমরা নিশ্চয় মেনে চলব। তবে স্যার, আপনি ছেলেদের বুঝায়ে বলেন কারণ তারা মানসিকভাবে অতি জেদি হয়ে আছে। প্রত্যেকটা অবস্থানে যেয়ে জওয়ানদের বুঝিয়ে বলে ছোট ছোট গ্রুপে বিভিন্নভাবে অবস্থান ত্যাগ করতে বললাম। বলে দিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যাও, শুনেছি ওখানে ২য় ইস্ট বেঙ্গল এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আছে। ওখানে যেয়ে যোগ দাও। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আবার দেখা হবে। সুলতান সাহেব এবং মালেক সাহেবকেও তাদের লোকজনের পিছনে যাওয়ার হুকুম দিলাম। দু'জন আমার দু’কাঁধে মাথা রেখে শিশুর মত হাউ মাউ করে কাঁদল। একটা সৈনিকের এমনি এক পরিস্থিতির কান্না অনুভব করা যে কত হৃদয় বিদীর্ণকারী সে আমি বুঝেছি। যদিও এটা অতি ক্ষুদ্র ঘটনা, তবু আমার জীবনের একটা বিশেষ ক্ষণ। দু'জন বলল, 'স্যার, আপনি যাবেন না? “আপনারা গেলে”।

 ওরা চলে গেলে সমস্ত এলাকাটা ঘুরে দেখলাম এখনও কেউ বাকী আছে কিনা। সুলতান সাহেব যাওয়ার সময় বলে গেল, 'স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”  সবাই চলে গেলে নিঃসঙ্গতা আর অবসাদ মনটাকে ছেয়ে ফেলল। জীবনটা মনে হচ্ছিল সত্যি খুব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এত গোলাগুলি হল, মরে গেলে তো রক্ষাই পেয়ে যেতাম। যাক আমি আমার কাহিনী লিখছি না, যাদের জন্য লিখছি ওখানেই ফিরে যাই। ১৪ই এপ্রিল রাতে যেয়ে কুলিয়ারচরে সুলতান সাহেব এবং তার সঙ্গী ১০/১৫ জন জওয়ানের সাথে দেখা। দেখে তাঁর কি আনন্দ। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হৈচৈ করে কিভাবে যে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছেন তা ঠিক বলতে পাবর না।

 তারপর থেকে কোনদিন সুলতান সাহেব আমার থেকে আর বিচ্ছিন্ন হননি। প্রতিটি অপারেশনে তিনি আমার সাথে ছিলেন। সিলেটের নলুয়া চা বাগানে দিনের বেলায় আমরা যে এ্যামবুশ করি তার উপর সুলতান বীরবিক্রমে পদক পান। আখাউড়া আক্রমণের সাথে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে আমার সাথে ছিলেন।

সাটিয়াচড়ার যুদ্ধ[]


 টাঙ্গাইল শহর তখনও মুক্ত অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায়, শহরে ও গ্রামাঞ্চলে প্রতিরোধের সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় বেতার মারফত রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যদের হিংস্র আক্রমণ আর বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের গৌরবময় প্রতিরোধের কাহিনী প্রচারিত চয়ে চলেছে।

 হামলাকারীদের দল তখনও টাঙ্গাইল জেলায় এসে পৌঁছাতে পারেনি। টাঙ্গাইল শহরে মুক্তির উৎসব চলেছে। রাজপথের দু'ধারে প্রতিটি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। 'জয় বাংলা' সংগীতে সারা শহর মুখরিত। কিন্তু সমস্ত আনন্দ - উৎসবের পেছনে আসন্ন বিপদের কালো ছায়া। শহরের মানুষ হাসতে গিয়েও প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে না। আকাশবাণী নিত্য নতুন দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে, মুক্ত শহরগুলি একের পর এক পাক-সৈন্যদের অধিকারে চলে যাচ্ছে। তারপর সেই হিংস্র জল্লাদের দল সেই সমস্ত শহরের অধিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে। এখনও ওরা ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা থেকে দূরে আছে কিন্তু কতদিন তারা এভাবে থাকতে পারবে। দু'দিন আগেই হোক আর পরেই হোক ওরা এখানে এসে হামলা করবেই। সেদিন? সেদিন টাঙ্গাইলের মানুষ কেমন করে ওদের প্রতিরোধ করবে? কেমন করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করবে?

 আজ সারা বাংলাদেশের মানুষের মন স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত। সারা প্রদেশের মানুষ কখনও এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। টাঙ্গাইলের মানুষ-অতি সাধারণ মানুষও তাদের বাইরে নয়, তারাও তাদের সঙ্গে একতালে পা মিলিয়ে চলবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি কোথায়? কোথায় অস্ত্র, কোথায় চালনার শিক্ষা ব্যবস্থা? কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে তো আর লাঠি-সোঁটা বা বর্ণা বল্লম নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। প্রতিরোধের দায়িত্ব সামনে আসতেই এই প্রশ্নটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

 তবু তাদের যেটুকু সম্বল তাই নিয়ে তারা প্রতিরোধের জন্য তৈরী হচ্ছে। তাদের সামনের সারিতে আছে কিছুসংখ্যক ইপিআর বাহিনীর যোদ্ধা। স্থানীয় ছাত্র ও যুবকের তাদের কাছ থেকে রাইফেল চালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র বলতে ই,পি,আর বাহিনীর সৈন্যদের হাতে কিছু রাইফেল আছে। আর আছে গুটিকয়েক পুরানো ধরনের মেশিনগান। এই নিয়েই তারা আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত পাক-সৈন্যদের সাথে লড়াই করবে। এই দুই অসব শক্তি-সংঘের পরিণতি কি হতে পারে, সেটা কি তারা অনুমান করতে পারে না? পারে বই কি। কিন্তু তার পরিণতি যাই হোক না কেন, প্রতিরোধে তারা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারবে না। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে প্রতিরোধের সংগ্রাম চলছে তারাও তার সঙ্গে সামিল থাকবে।

 অবশেষে সেই আশঙ্কা একদিন সত্যসত্যই প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দেখা দিল। নিছক জনরব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনা গেল পাক-সৈন্যদল ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই করে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের দু'ধারে গ্রামগুলি তাদের হামলার ফলে বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত। পাকসৈন্যরা এই সমস্ত গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দিচ্ছে, তাদের গরু-বাছুর কেড়ে নিয়ে এসে নিজেদের ভোজের উৎসব চালাচ্ছে। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে আসছে। ঘরের মেয়েরাও তাদের লুণ্ঠনরত হাত থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না।

 গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে আর মান-ইজ্জতের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে।

 এইভাবে মানুষ নামধারী, এই হিংস্র পশুগুলি বিভীষিকা ছড়াতে চলে আসছে। ওরা ওদের রক্তাক্ত থাবা উদ্যত করে ছুটে আসছে টাঙ্গাইলের দিকে। টাঙ্গাইলের মানুষ হুঁশিয়ার। দেশপ্রেমিক সন্তানগণ, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য তৈরী হও-সংগ্রাম পরিষদের প্রচার-ভ্যান ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে উদ্দীপনাময়ী বাণী ছড়াতে লাগল। আক্রমণকারী পাক-সৈন্যবাহিনী প্রথম বাধা পেল সাটিয়াচড়া গ্রামে।

 ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। পথের দু'ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকসৈন্যরা এর আভাসটুকুও পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোন ভয়ের কারণ আছে তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে কতকগুলি মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। বৃষ্টির মত ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির ঘায়ে অপ্রস্তুত পাক-সৈন্যরা ধরাশায়ী হয়ে পড়তে লাগল। নির্জন ও শান্ত পল্লীপথ এক মুহূর্তে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল।

 প্রতিরোধকারী দেশভক্তরা বিপুলসংখ্যক শত্রুঐসন্যের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই করে চলেছে। বেশ কিছুকাল এই লড়াই চলেছিল।

 হামলাকারী পাক-সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কঠিন প্রতিরোধ পেয়ে একটু পেছনে হটে গেল। ইতিমধ্যেই তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার পেছনে থেকে আরও অনেক সৈন্য পৌঁছে গেছে। এবার কামান-মর্টারের সজ্জিত ছাবিবশটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য সামনে এগিয়ে এল। মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে লক্ষ্য করে তারা অবিরল ধারায় গোলাবর্ষণ করে চলল। তারা ভাবতেও পারেনি যে, মাত্র তেইশ জন ইপিআর-এর যোদ্ধা ট্রেঞ্চের ভিতরে থেকে তাদেরকে প্রতিরোধ করে চলেছে। তাদের সম্বল ছিল মাত্র দুটি হালকা মেশিনগান, আর কিছু রাইফেল। তাই দিয়েই তারা কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।

 জীবন পণ করে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই প্রবল গোলাবর্ষণের মুখে এরা তাদের কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে। প্রতিরোধ যখন চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল, তখন ট্রেঞ্চের এই তেইশ জন যোদ্ধার মধ্যে একুশ জন নিহত হয়েছে। কোথায় ছিল এদের বাড়িঘর কে জানে। কোথায় ছিল এদের বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা! এরা কোথায় কিভাবে প্রাণ দিল, সেই বীরত্বপূর্ণ কাহিনী কোন দিন এদের কাছে পৌঁছাবে কিনা, তাই বা কে জানে!

 লড়াই থেমে গেছে। এদের কামানগুলি কিন্তু তখনও গোলাবর্ষণ করেই চলেছে। এবার এদের আক্রমণের লক্ষ্য সাটিয়াচড়, গোড়াই আর তার আশেপাশের গ্রামগুলি। তাদের রকেটের আগুনে সেইসব গ্রামের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হতে লাগল। এরপর গোলাবর্ষণ থামিয়ে ওরা ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে হত্যালীলা চালিয়ে যেতে লাগল। সামনে যাদের পেল তাদের কাউকে রেহাই দিল না। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামের লোকেরা যে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাল।

 সাটিয়াচড় গ্রামটি আমার কাছ অপরিচিত নয়। এই গ্রামেই আমার সহকর্মী ও বন্ধু বাকী সাহেবের (কৃষক নেতা খন্দকার আবদুল বাকী) বাড়ি। এই সাটিয়াচড়ে যাঁরা সেদিন পাকসৈন্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাকী সাহেব তাঁদের অন্যতম। হামলাকারীরা বাকী সাহেবের বাড়িতে ঢুকে তাঁর আশি বছর বয়সের বৃদ্ধ পিতাকে বন্দুকের কুঁদা দিয়ে এমন আঘাত করল যে, তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

 বাড়িতে আর যারা যারা ছিল, এরা তাদের সবাইকে হত্যা করল।


  1. ১৯৭১ সালের মার্চে জয়দেবপুরে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড হিসেবে মেজর পদে কমৃরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৫ সালে গৃহীত। উল্লেখ্য মেজর জেনারেল (অবঃ) কে, এম. সফিউল্লাহর পক্রিকান্তরে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বর্ণিত জয়দেবপুর সেনানিবাসের ঘটনাবলীর ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে ২য় বেঙ্গলের তৎকালীন অদিনায়ক লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আবদূর রকীব ১৩ মে ১৯৮৩ সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রার’র ‘ভিন্নমত’ শীর্ষক কলামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তদুত্তরে পরবর্তী সময়ে বিচিত্রারএকই কলামে মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহর একটি প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়। এগুলি এখানে একই সঙ্গে সংযোজিত হলো।
  2. ১৯৭১ সালের মার্চে ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্টে লেফটেন্যাণ্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বাংলা একাডেমী দলিলপত্র থেকে সংকলিত সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৩ সালে গৃহীত।
  3. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত।
  4. বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত।
  5. মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস ১৯৭৪ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
  6. * ১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি দৈনিক 'সংবাদ' ৩ মার্চ ১৯৮৩-এ প্রকাশিত সুবেদার মেজর সুলতান আহমদ বীরবিক্রম' শিরোনামে তাঁর রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।
  7. সত্যেন সেন রচিত 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ আগস্ট ১৯৭১, কলিকাতা থেকে সংকলিত। জায়গাটি আসলে নাটিয়াপাড়া। ভুলক্রমে সাটিয়াচড়া বলে উল্লেখিত হয়েছে।