বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১০১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
আওয়ামী লীগ সরকার মুখ্যমন্ত্রীর নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬।
আমাদের নীতি ও কার্যক্রম পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের বেতার ভাষণ
(৭ই সেপ্টেম্বর-১৯৫৬)

 গত ৭ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র হইতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান এক বেতার বক্তৃতায় নূতন মন্ত্রী-সভার নীতি ও কর্মপরিকল্পনা বিশ্লেষণ করেন। তিনি সকল রাজবন্দীর মুক্তির ঘোষণা প্রচার করেন এবং বলেন যে, খাদ্য সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁহারা সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করিবেন। তাঁহার এই বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ নিন্মে বিবরণ দেওয়া গেল:—

 ইতিমধ্যেই আপনার সম্ভবতঃ জানতে পেরেছেন যে কেবলমাত্র সাড়ে ছাবিবশ ঘণ্টা আগে আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেছি। সরকার গঠনের কাজ এখন পর্যন্ত সম্পূর্ন হয়নি। শীঘ্রই এ কাজ সম্পূর্ণ হবে। ইত্যবসরে আমি ও আমার অপর চারজন সহকমী যে সব সমস্যা শাসন-ব্যবস্থা ও জন-কল্যাণ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে রেখেছে, সাহস ও সংকল্পের সাথে সেগুলির সমাধানের জন্য এগিয়ে যাব বলে সঙ্কলপবদ্ধ হয়েছি।

 আর অধিক কিছু বলার পূর্বে আমার এবং আমার সহকর্মীদের প্রতি আন্তরিক সহানুভুতি প্রকাশের জন্য আমি দেশবাসী জনগনের উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জাপন করছি।

 ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ! আমরা এ প্রদেশের ইতিহাসের একটি সঙ্কট মুহুর্তেই কার্যভার গ্রহণ করেছি। আমরা বেশ ভালরূপেই অবগত আছি যে, আমাদিগকে কতকগুলো ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা করতে হবে। আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতা ও গদি দখলের লোভে দায়িত্ব গ্রহণ করি নাই। উপরন্ত কর্তব্যের চরম আহবানেই তা করেছি। আমাদের কার্যতার গ্রহণ করার মাত্র একদিন আগে পুলিশের গুলী চালনার ফলে ঢাকা শহর এক ভীষণ গোলযোগের সম্মুখীন হয়েছিল। আমরা এই দুর্ঘটনার জন্য একটি বিচারবিভাগীয় তদন্তের প্রস্তাব করেছি এবং সরকার নিহত ও আহতগণের উত্তরাধিকারীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও দেবেন।

খাদ্য সমস্যা

 খাদ্য ব্যবস্থা ও শাসন-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ক্রমাবনতি গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গেই আমরা লক্ষ্য করছি। গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণ বহু বৎসর যাবৎ যে অবহেলা সহ্য করে আসছে, তা প্রকৃতই অবর্ণীয়। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সোজা ভাষায় বলতে গেলে হয় যে, প্রদেশ দুর্দ্দশার শেষ সীমার গিয়ে পৌছেচে। যা হোক খাদ্য সংকট সব সমস্যাকে ছাড়িয়ে উঠেছে। আমি আপনাদিগকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, অগ্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহের মধ্যে খাদ্যই সর্বোচ্ছ স্থান অধিকার করে আছে। কাজেই আমাদের প্রথম কাজই হচ্ছে সমগ্র খাদ্য সমস্যার পর্যালোচনা করা। এ সম্পর্কে আজ লাট-ভবনে প্রেসিডেণ্ট মেজর-জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠক হয়ে গেছে। এই সম্মেলনে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অংশ গ্রহণ করায় আমরা সৌভাগ্য বলেই মনে করি; কারণ, খাদ্য ব্যবস্থায় তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আপনারা সবিশেষ ওয়াকেবহাল আছেন। তীব্র খাদ্য সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানকল্পে খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং খাদ্য ব্যবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য যে কয়েকটি ব্যবস্থা অবনম্বন করেছি, তা এই:—

 ১. ইতিপূর্বে যে ১ কোটি ১০ লাখ মণ খাদ্য-শস্য আমদানীর আদেশ দেয়া হয়েছে, তা ছাড়াও প্রেসিডেণ্টের মহানুভবতায় আরো ২৭ লাখ মন চাউল আমদানীর আদেশ দেওয়া হয়েছে।

 ২. পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরগুলো ও রেল প্রান্তে যাতে খাদ্য বোঝাই জাহাজগুলো তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারে, তার জন্যে নতুন উপায় উদ্ভাবনকল্পে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ বছর অক্টোবর মাস শেষ হওয়ার পূর্বেই ১ কোটি ৩৭ লাখ মণ চাউল আমদানী করতেই হবে।

 ৩. আগামী ১৪ই সেপ্টেম্বর জেলা ম্যাজিষ্ট্যাট ও জেলার কণ্ট্রোলারদের এক সম্মেলন বসছে। এ সম্মেলনে খাদ্যবস্থা পর্যালোচনা করে তাদের স্বস্ব এলাকার প্রয়োজন নির্ণয় করা হবে। এতে করে খাদ্যশস্যের দ্রুত বিলি ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা যাবে। এসব অফিসারদের বলা হয়েছে যেন তাঁরা তাঁদের মজুদ শস্যের পরিমাণ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে কি পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন এবং গ্রামাঞ্চলে কিভাবে খাদ্য-শস্য তাড়াতাড়ি বিলি করা যায় তার প্রস্তাবসহ ঢাকায় আসেন।

 ৪. আমরা সিদ্ধান্ত করেছি যে, খাদ্য সমস্যার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্যে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটদের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হবে। তাঁদের কাজ অধিকতর সহজ ও কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে এই সব অফিসারদের ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হবে, যাতে করে ঢাকার সদর দফতরের সঙ্গে পত্রালাপে বৃথা সময় নষ্ট না করে তারা সরাসরি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন। খাদ্য সংক্রান্ত অপরাধে বিশেষ করে মওজুদকারী, চোরাচালানকারী, কালোবাজারী এবং মুনাফাখোরদের কঠোর শাস্তি বিধানের জন্য জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটদের অধিকতর ক্ষমতা দেওয়া হবে।

 ৫. এখনও ফুড কমিটি গঠিত হয়ে না থাকলে উহাদের আশু গঠনের আদেশ দেওয়া হবে। যেসব ফুড কমিটি ইতিমধ্যেই গঠন করা হয়েছে, অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য সুেগলোকে পুনর্গঠন করা হবে।

 ৬. যেখানে লঙ্গরখানার প্রয়োজন হবে, সেখানে লঙ্গরখানী খোলার ব্যবস্থা হচ্ছে।

 দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদী এর যে-কোন নীতিরই সাফল্য নির্ভর করে কর্মচারীদের দক্ষতা, কার্যক্ষমতা এবং উদ্ভাবনী শক্তির উপর। এজন্য আমরা শাসন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে সর্বপ্রকার দুর্নীতিমুক্ত করতে চাই। স্থায়ী কর্মচারীদের সততা এবং সাধুতা ফিরিয়ে আনতেই হবে। অসং এবং অকর্মণ্য কর্মচারীদের আমরা সরিয়ে দিতে চাই। সং কর্মক্ষম এবং মনোযোগী কর্মচারীদের জন্য অমনোযোগী এবং বেয়াড়া কর্মচারীদের জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। কর্মচারীরা হয় কাজ করবেন, না হয় কাজ ছেড়ে চলে যাবেন; কালগুণে জনসাধারণের অর্থ অপচয় করা চলবে না। আমাদের কর্মসূচী এবং পরিকল্পনা কার্যকরী করতে সরকারী কর্মচারীরা আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন পাবেন।

 আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যা কিছু আমরা করব, জনসাধারণের সেবাই হবে তার ভিত্তি, রাজনৈতিক সুবিধাবাদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না। দৈনন্দিন শাসনকার্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করব না। সাধু এবং দক্ষ কর্মচারীদের মনোবল রাখতে ও অটুট রাখতে ও যথাসম্ভব তাদের পুরস্কৃত করতে এবং অসাধু ও অক্ষম কর্মচারীদের শাস্তি বিধান করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কর্ম দ্বারাই আমরা কর্মচারীদের যোগ্যতার বিচার করব।

রাজবন্দীদের মুক্তি

 রাজনৈতিক বন্দীদের দুঃখ-কষ্টে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন নাগরিকের হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত তাদের মুক্তির জন্য বরাবর দাবী করা হচ্ছে। তাদেরে মুক্তি আমাদের বিশ্বাসের অঙ্গ হিসেবে ২১-দফা কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। জনসাধারণের ন্যস্ত বিশ্বাসের মর্যাদা ও আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা রক্ষার জন্য বাধা-নিষেধও আমরা তুলে দিয়েছি। রাজনৈতিক কর্মীদের উপর আরোপিত সমূদয় বাধা-নিষেধও আমরা তুলে নিয়েছি। নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য যথাযথ আইন রচনা ব্যবস্থাও করা হবে।

দুনীতি দমন

 আমাদের ওয়াদা অনুযায়ী দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের যাবতীয় অনাচার ও দুনীতি দূরীকরণের জন্য আমরা বাস্তব কর্মপন্থা অবলম্বন করব। সন্দেহজনক উপায় এবং জনগণের রক্তের কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এসব বিবেকহীন ভাগ্যন্বেষীদের অচিরে দমন করা প্রয়োজন এবং ওদের দমন করা হবে।

শিক্ষা সংস্কার

 জনগণের প্রতি আমাদের ওয়াদা অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের ব্যবস্থাও আমরা করব। আজাদী লাভের পর দেশের সর্বস্তরেই অধোগতি দেখা গিয়েছে; কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রের মান হাসের কোন তুলনাই হয় না। শিক্ষার মান ছাড়াও, শিক্ষার ব্যয় যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে সাধারণ সঙ্গতির লোকদের পক্ষে দুঃসহ হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি, নাগরিকদের যে শিক্ষা দেয়া হবে, তার উপরেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। সুতরাং আমরা প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রতি মনোনিবেশ করতে চাই। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো শিক্ষাকেও আমরা জীবনের অন্যতম প্রধান প্রয়োজন বলে মনে করি। এই অনুভূতিতে অনুপ্রানিত হয়েই আমরা জনসাধারণের জন্য কম ব্যয়সাপেক্ষ ও উন্নত ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা করার কাজে ব্রতী হব।

সংখ্যালঘুদের প্রতি আশ্বাস

 আমি এখন দেশবাসীর এক অংশ সস্বন্ধে বলছি- যারা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু নামে পরিচিত কিন্তু তাঁদের আমরা দেশ ও জাতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মনে করি। তাঁদের সেবায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা তাঁদের এই আশ্বাস দিচ্ছি যে, সরকারী কাজে ও দেশের সেবায় তাঁরা কেবল সমান সুযোগ সুবিধাই পাবেন না; অধিকন্ত এমন এক পরিবেশ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যাতে তাঁরা মুসলমান ভাইদের মতই পূর্ণ নিরাপত্তার সংগে তাঁদের ধর্ম-বিশ্বাস পোষণ ও পালন করতে পারেন।

মোহাজের সমস্যা

 এখন আমি আমার সেই সব দেশবাসী সম্বন্ধে দু-এক কথা বলছি যারা দুর্ভোগ্যবশতঃ আমাদের আজাদীর দশম বর্ষে ও‘মোহাজের’ নামে পরিচিত হচ্ছেন। তাঁরাই হচ্ছেন সেই সব নরনারী যাঁরা পাকিস্তান হাসেলের জন্য সব কিছু কোরবান করেছেন। এটা আশা করা যাচ্ছিল তাঁরা বহু আগেই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত ও পুনর্বাসিত হবেন। তার পরিবর্তে তাঁদের বহু লোক ক্যাম্পে, মালগাড়ীতে, নোংরা ও জীর্ণ কুটিরে মানুষের অনুপযুক্ত অবস্থায় বাস করছেন। তাঁদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনই আমাদের সংকল্প। এতে করে তাঁরা জনসাধারণের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবেন। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সম্মানজনকভাবে সুষ্ঠু এবং সাধারণ জীবনযাত্রার উদ্দেশ্যে তাঁদের জন্য সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করতেই হবে।

 পর্যাপ্ত খাদ্য-শস্যের সরবরাহের বন্দোবস্ত সুসম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এবং আমার সহকর্মীগণ খাদ্য সরবরাহ ও বণ্টন ব্যবস্থার কার্যাবলী স্বচক্ষে দেখার জন্য মপম্বলে যাব। আমাদের বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাংখীগণকে অনুরোধ করছি-যখন আমরা সফরে বের হই, তখন যেন তাঁরা আমাদের জন্য পার্টি, অভ্যর্থনা ও খানাপিনার বন্ধোবস্ত না করেন। আমরা বিশেষভাবে বুঝতে পারছি যে, যখন আমাদের জনসাধারণের এক বিরাট অংশ অর্ধনশন অবস্থায় রয়েছেন, তখন আমাদের জাঁকজমকপূর্ণ আতিথেয়তা গ্রহণ করবার অধিকার নেই।

 আজকে আপনাদের নিকট থেকে বিদায় নেবার আগে আমি এটাই বলতে চাই যে, আমরা জনসাধারণের ইচ্ছার উপরেই সরকারী কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছি এবং আমরা যতদিন পর্যন্ত জনসাধারণের আস্থাভাজন থাকবো, ততদিন পর্যন্ত আমরা সরকারী কার্য পরিচালনা করব। আমি আশ্বাস দিচ্ছি যে, যে মুহুর্তে আমরা বুঝব যে, আমরা জনসাধারণের খেদমত করবার মত অবস্থায় নেই, তারপরে আর এক মূহুর্তে আমরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকব না।