বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/১১৯

শিরোনাম সূত্র তারিখ
রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে একটি নিবন্ধ ‘ইত্তেহাদ’ ২০ জুলাই, ১৯৪৭

রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব
  মাহবুব জামাল জাহেলী

 পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে, ইহা লইয়া প্রচুর আলোচনা চলিতেছে। এই সমস্যাকে কেন্দ্র করিয়া যে সকল বিভিন্নমুখী চিমত্মধারার প্রকাশ হইতেছে, তাহা মুসলিম বাংলার জনগণের প্রাণ প্রাচুর্য্যেরই পরিচয় বহন করে। আলোচনার আলোকেই প্রকৃত পথের সন্ধান পাওয়া যায়, সুতরাং এই তর্ক-বিতর্কে আশংকিত হইবার কোন কারণ নাই।

 প্রধানতঃ বাংলা ও উর্দুকে লইয়াই এখন বিতর্কের উদ্ভব হইয়াছে। এবং প্রকৃতপক্ষে অন্য কোন ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গণ্য হইতে পারে না। প্রত্যেক ভাষার সমর্থনেই অনেকে অনেকে জোরালো যুক্তি-তর্ক উপস্থাপিত করিয়াছেন। এবং এই প্রসংগে যে বিতর্কের সৃষ্টি করা হইয়াছে তাহাকে উচ্ছাসও প্রচুর পরিমাণে আছে। কিন্তু প্রশ্নটি আদৌ উচ্ছাস-সাপেক্ষে নহে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে প্রত্যেকটি ভাষার দাবী বিচার করিতে হইবে। এ জন্যই প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ভাষার উপযোগী গুণাবলীর নির্ণয় প্রয়োজন। নিমণলিখিত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার আসন পাইবার উপযুক্ত বলিয়া মনে করা যইতে পারেঃ

(১)ভাষাভাষীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় হইলে চলিবে না।

(২)দুই ভাষাভাষীর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন হইবে।

(৩)এই ভাষার মাধ্যমে ইসলামের ভাবধারাকে ভাষাভাষীর মধ্যে পরিসস্ফুট করিয়া তুলিতে হইবে।

(৪)এই ভাষার ব্যাকরণ, বর্ণমালা ও লিপি জটিলতা বর্জিত হইবে।

 পাকিস্তানের জনসংখ্যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলিয়া থাকে, সুতরাং উপরোক্ত আদর্শে বাংলার দাবীই অগ্রগণ্য। গনতান্ত্রিক যুগে যদি গণভোট এই ভাষা সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব উঠিত, তবে নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় হইত সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হয়। রাষ্ট্রের একটি বিশিষ্ট অংশের সুবিধার্থে অন্য অংশে অসুবিধা সৃষ্টি করা কোন রাষ্ট্রেরই কাম্য নহে এবং হওয়া উচিত নহে। প্রাদেশিক প্রভৃতির রাষ্ট্রভাষারূপে পরিগনিত হইবার দাবিকে নিতান্তই জিদ বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। এবং উর্দু ভাষা-ভাষীর সংখ্যাও বাংলার তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। ইহা ব্যতিত উর্দু ভাষা বাংলার অধিকাংশ জনগণের নিকটই যে কোন বিদেশী ভাষার ন্যয়ই দুর্বোধ্য ঠেকিতে বাধ্য। সুতরাং এইদিক হইতে বিচার করিলে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হইবার কোন দাবিই যুক্তিযুক্ত হয় না। রাজনীতি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীর প্রতিপত্তি প্রচীনকাল হইতেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। এই সবজন-বিদিত প্রতিপত্তি দর্শনেই মহামতি গোখলে বলিয়াছিলেনঃ What Bengal things today, India things tomorrow.

 হৃত-গৌরব ফিরিয়া পাইবার জন্য বাংলার মুসলমান চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। ইহার প্রস্তুত প্রমান পাওয়া যাইতেছে। এইদিক হইতে বিচার করিলে কিছুকাল পূর্বে উর্দু ভাষার কোস দাবীই থাটিতে না। কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের অবস্থা-বিপর্যয়ের সুযোগ গ্রহণ করিয়া ঐ ভাষাভাষীরা তাহাদের দাবীকে শক্ত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে ইংরেজী ভাষার দাবী অবশ্যই অগ্রগন্য, কারণ এতদিন রাজনীতি ক্ষেত্রে ইংরেজীৱই প্রাধান্য ছিল। তবে বৈদেশিক কোন ভাষাই পাকিস্তানের কোনও রাষ্ট্রেরই রাষ্ট্রীয় ভাষা হইতে পারে না-এই জন্য ইংরাজীর দাবী মানিয়া লওয়া যায় না। সুতরাং উর্দু এবং বাংলার দাবীই মাত্র এখন আমাদের বিচার্য। কিন্তু উর্দুও যে প্রকৃতপক্ষে এই দেশীয় ভাষা এই কথাও বলা চলেনা। উর্দু হইল তুর্কী শব্দমানে ‘শিবির’। সৈন্যদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সুবিধার্থে সম্রাট আকবর এই ভাষার উদ্ভাবন করেনশিবিরজাত বলিয়াই এই ভাষার এই নাম। সুতরাং দেখা যাইতেছে, উর্দু ভাষা প্রকৃতপক্ষে দেশের ভাষা নয়।

 বিভিন্ন দেশীয় শব্দভাণ্ডার হইতে চয়ন করিয়া এই ভাষায় শব্দসম্ভার সমৃদ্ধিশালী করা হইয়াছে। স্বকীয়ত্ব বলিতে এই ভাষার কিছুই নাই। এই ভাষার দাবী অগ্রগণ্য হইতে পারেনা।

 আবার কেহ কেহ এই ভাষাকে মুসলমানী ভাষা হিসাবে দাঁড় করাইয়া ইহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালাইতে চেষ্টা করিতেছেন। এই প্রচেষ্টা যে নিতান্তই ভাবপ্রবণতা, এ কথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। কারণ, প্রথমতঃ মুসলমানী ভাষা বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ভাষার অস্তিত্ব নাই। তাহা হইলে মুসলমানগণ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাকেই মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে। ইহা হইতে পারে যে, ইসলামের শিক্ষা, সংস্কৃতি যে-ভাষার মাধ্যমে প্রকটিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকেই মুসলমানী ভাষা বলা চলে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মতে আরবী ভাষাকেই একমাত্র মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে। সুতরাং মসলমানী ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে এই যুক্তি বলে আরবী ভাষাকেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা করিতে হয়। কিন্তু তাহার ফল কি হইবে, উহা সহজেই অনুমান করা যায়। তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, ইসলামের ঐতিহ্যিক বহনের দাবীতে রাষ্ট্রভাষা হইবার যোগ্যতা বাংলারও নাই, উর্দুরও নাই। তবে পূর্ব প্রদর্শিত কারণে উর্দু হইতে বাংলার দাবীই বেশী যুক্তিসংগত।

 দেখা যাইতেছে যে, ইসলামের ভাবধারাকে বাংলার সাহায্য নিতেই হইবে। কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে ইসলামিক ভাবধারা ও কৃষ্টির প্রচার করিতে হইলে বাংলা ভাষাই কার্যকরী হইবে বেশী। কারণ মাতৃভাষার সাহায্যে কোন কিছু শিক্ষা না দিয়া একটা নূতন ভাষা শিখাইয়া ঐ ভাষার সাহায্যে এই শিক্ষা দিতে যাওয়া বোকামী হইবে মাত্র। নূতন কোন ভাষা শিক্ষা করিতেই এখন আমাদের অন্ততপক্ষে ৮/১০ বৎসর সময় অতিক্রান্ত হইয়া যাইবে এবং ইতিমধ্যে এতদ্দেশীয় মুসলমানগণ স্বীয় ঐতিহ্যিক চেতনোপলব্ধির ক্ষেত্র হইতে বহু পিছনে পড়িয়া থাকিবে। তাছাড়া বাংলাভাষায় বহু পূর্ব হইতে আরবী ও ফারসী ভাবধারার চর্চা হইতেছে। প্রাচীন যুগে রচিত পুঁথিগুলি ছিল এই বিষয়ের পুরোধা; বর্তমানেও বহু জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ নানা পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করিয়া এই প্রচারকার্য চালইতেছেন। অবশ্য এই কথা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই যে, এই প্রচারকার্য বাংলা ভাষায় যথেষ্ট কম হইয়াছে। কিন্তু এতদিন এইলপ না হইয়া উপায় ছিল না। একে তো আমাদের রাজভাষা ছিল বিজাতীয় ও বিধর্মীয়, তার উপর বাংলা ভাষার উপর কর্তৃত্ব করিত হিন্দুগণ; সুতরাং নিজ ইচ্ছামত প্রচারকার্য চালাইতে পারা যাইত না। এখন যদি আবার বাঙ্গালীর উপর উর্দু ভাষাভাষীদের কর্তৃত্বভার আনিয়া চালাইয়া দেওয়া হয়, তবে উহাকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বই আর কিছুই বলা চলিবে না।

 ইহা ব্যতীত ব্যাকরণের দিক দিয়াও উর্দু অপেক্ষা বাংলার দাবী যুক্তি সাপেক্ষে। প্রকৃত উর্দু অর্থাৎ সাহিত্যিক উর্দু অত্যন্ত জটিল। ক্রিয়াপদের লিঙ্গভেদ হইতে আরম্ভ করিয়া ব্যাকরণের অন্যান্য জটিলতা এত অধিক যে, স্বল্পায়াসে এই ভাষা শিক্ষা করা যায় না। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার জটিলতা উর্দু হইতে বহু অংশে কম। একথা অবশ্যই ঠিক যে, বাংলা শিক্ষার্থীর পক্ষে র, ড়, ষ, স, শ, ন, ণ প্রভৃতির পার্থক্য সঠিক অনুধাবন করা কষ্টকর। কিন্তু ইদানীং ভাষাবিদগণ প্রাচীন বর্ণমালা, ব্যাকরণ ও বানান প্রথার আমুল পরিবর্তনের প্রবৃত্ত হইয়াছেন,যাহার ফলে আশা করা যায়, সুসংস্কৃত হইয়া বাংলা ভাষা, বর্ণমালা, ব্যকরণ ও বানানের দিক হইতে ইংরাজীর ন্যায়ই সহজ এবং সকলের বোধগম্য হইবে। ইতিমধ্যেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা বানান পদ্ধতির সংস্কার সাধন করা হইয়াছে, ফলে ফলে বানান এখন যথেষ্টসহজ হইয়া গিয়াছে। অবশ্য এই প্রথা এখনও ব্যাপকভাবে সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তকে প্রচারিত হয় নাই। কিন্তু আবশ্যকবোধে প্রচলিত করিয়া লইতে বেশী দেরী হইবারও কোন কারণ নাই। অপরদিকে উর্দুর ব্যাকরণের জটিলতার কথা ছাড়িয়া দিলেও বর্ণমালাগত দুর্বোধ্যতাও উপেক্ষণীয় নয়। রে, ডে, দাল, যাশ প্রভৃতি শব্দের বাক ভুলতার দরুন প্রথম শিক্ষার্থীর পক্ষে উর্দু শিক্ষা দুরূহ হইয়া পড়ে। এবং এই সব দুর্বহ দুহতাকে সরল করিবার কোন প্রয়াসই অদ্যাবধি ঐ ভাষার পণ্ডিতগণ করেন নাই। উর্দু অর্থাৎ চলতি বাজারী উর্দুর ব্যাকরণগত জটিলতা অপেক্ষকৃত কম হইলেও উহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্থান দেওয়া যাইতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে উহা কোন ভাষাই নয়বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার শব্দাবলীর সমাহারে গঠিত এক আজব চিজ বলা যাইতে পারে। যে ভাষার কোস স্বকীয়ত্ব নাই, কোন সাহিত্য নাই, যে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা জাতির বা দেশের পক্ষে কলংকজনক বই কি। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষর দাবীর যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দিহান হইবার কেও কারণ নাই।

 এখন প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভা বাংলা হইলে পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত এই রাষ্ট্রের যোগসূত্র কি প্রকারে স্থাপিত হইবে। এই প্রশ্নের উত্তর প্রধানতঃ নির্ভর করে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর। কোন কোন বিষয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রসমূহের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব থাকিবে সেই বিষয়টি পরিষ্কার হইলেই এই প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাইবে। বর্তমান ব্যবস্থা মতে অর্থাৎ দেশরক্ষা, অর্থ বিভাগ এবং পররাষ্ট্র বিভাগের উপর যদি কেন্দ্রের কর্তৃত্ব থাকে, তবে অসুবিধা বিশেষ কিছু হইবে না। কেন্দ্রের সহিত দোভাষী অনবাদকের সাহায়্যে কাজ অনায়াসেই সমাধা করা যায়। বর্তমানে প্রাদেশিক সরকারের অনুবাদ বিভাগের মত একটি বিভাগ খুলিলেই সব গোলমাল চকিয়া যাইবে এবয় অন্যান্য প্রদেশের সহিতও এই উপায়েই যোগসূত্র অক্ষুন্ন রাখা যাইবে। শুধু যে বায়লা দেশের জন্যই কেন্দ্রীয় অফিসে অনুবাদকের দফতর খলিতে হইবে, এমন নয়। কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা যে উন্নত উর্দু কিংবা বাংলা হইবে একথা অবধারিত। সুতরাং বিদেশী রাষ্ট্রের সহিত যে সংবাদ আদান-প্রদান করিতে হইবে, তাহার জন্যও অনুরূপ দফতরের প্রয়োজন হইবে। এবং হিন্দুস্তান রাষ্ট্রের মধেও অনুরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে কারণ হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে হিন্দি বা হিন্দুস্তানী।

আপাতঃদৃষ্টিতে আরও একটি বিষয়েও আমাদের অসুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয়। সেটি হইল সৈন্য বিভাগে ভাবের আদা-প্রদান। পূর্ব পাকিস্তানের সেবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরা স্ব স্ব প্রদেশের স্বীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষায়ই কথাবার্তা বলিতে পারিবে। কিন্তু যখন এই দুই প্রদেশের সেনাবাহিনী প্রয়োজনানুসারে একত্রিত হইবে, তখনই অসুবিধা হইবে বেশী। পারস্পারিকভাবে আদান-প্রদান ছাড়াও আদেশ ওয়া (কমাণ্ড) লইয়াও অসুবিধা ভোগ করিতে হইবে মনে হয়। কারণ, বর্তমানে বিভিন্ন দেশীয় সেনানী লইয়া সেনাবাহিনী গঠিত হইলেও আদেশকার্য চালানো হয় ইংরাজীতে। কিন্তু তখন ইংরাজী বর্জন করা হইবে। এই সমস্যা গরম্নতর হইলেও অতি সহজেই ইহার সমাধান করা যায়। যদি আমরা আদেশবিধিগুলির (Commandments) আরবী ভাষা প্রচলন করি, তবেই অসুবিধার নিরসন হয়। আরবীতে আদেশ দিলে উহা ইংরাজী হইতেও শক্তিশালী হইবে। কারণ আরবী ভাষায় যে ঝংকার, যে দ্যোতনা আছে, সে দ্যোতনা ও ঝংকার ইংরাজী ভাষার নাই। দুই রাষ্ট্রের অবািসীগণ পরস্পরের সহযোগিতা করিলেই এই সমস্যা এবং অনুরূপ সকল মসস্যারই সমাধান সহজসাধ্য হইয়া যাইবে। নিজস্ব জিদ বজায়া রাখিবার জন্য গোঁড়ামীর আশ্রয় গ্রহণ করা কাপুরুষোচিত ব্যবহার বলিয়াই অবিহিত হইবে। পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য না থাকিলে কোন রাষ্ট্রেরই উন্নতি বিদান সম্ভবপর হইবে না, একথা সুনিশ্চিত।

প্রথম প্রথম অসুবিধা হইবেই, কিন্তু ধীরে ধীরে যখন জনসাধারণ এবং কর্মীগণ নুতন পরিবেশের সহিত নিজকে খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারিবেন, তখন কোন অসুবিধাই ভোগ করিতে হইবে না।

পশ্চিম বংগের হিন্দুগণ পূর্ব বংগ হইতে দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া গিয়া যেমন স্বয় সত্তা বিসর্জন দিল, পূর্ব বংপের মুসলমানগণও অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হইবে, যদি উর্দুকেই সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দুস্তানী হইবে, ইহা নিশ্চিত এবং তাহা হইলে বাংলা সাহিত্যে পশ্চিমবংগের যা দান তাহাও নিঃশেষে লোপ পাইবে। তাহাদের সংস্কৃতি, তাহাদের আভিজাত্য সকলই খর্ব হইয়া যাইবে। পূর্ব পাকিস্তানেরও অবস্থা ইহাই হইবে, যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হয়। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলার মুসলমানগণ কখনই ইহা ঘটিতে দিবে না...।

উর্দুও আমরা শিখিব আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের শিক্ষা-সংস্কৃতি জানিতে হইবে বলিয়া। কিন্তু তাহাদিগকেও বাংলা শিক্ষা করিতে হইবে, নতুবা তাঁহারা এক দেশদর্শিতার পরিচয় প্রদান করিবেন।


* পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুকাল আগে থেকে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। এই প্রবন্ধটি বাংলায় সপক্ষে একটি প্রস্তাব। প্রবন্ধটি কলকতা হতে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ' পত্রিকায় ২০শে জুলাই, ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়।