বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৩৫

শিরোনাম সূত্র তারিখ
শামসুল হক কর্তৃক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম প্রস্তাবিত ম্যানিফেষ্টো পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি: বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা-২৪১ ২৪শে জুন, ১৯৪৯

শামসুল হকের প্রস্তাব ও আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম ম্যানিফেষ্টো[১]

 পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্যে শামসুল হক ‘মূলদাবী' নামে একটি ছাপা পুস্তিকাতে লিপিবদ্ধ তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন। পুস্তিকাটির মুখবন্ধের প্রারম্ভে তিনি বলেনঃ

 ইং ১৯৮৯ সনের ২৩শে ও ২৪শে জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন” মনে করে যে, সর্বকালের সর্বযুগের সর্বদেশের যুগ প্রবর্তক ঘটনাবলীর ন্যায় লাহোর প্রস্তাবও একটি নূতন ইতিহাসের সৃষ্টি করিয়াছে। বিরুদ্ধ পরিবেশে মানবের দেহ, মন ও মস্তিস্কের উন্নতি ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। মানুষ পরিবেশের দাস এ কথা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করেন। বিরুদ্ধ পরিবেশে পূর্ণ ইসলামিক মনোভাব এবং সমাজ বিধান গড়িয়া তোলা সম্ভব নয়। ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হইতে এই মহা সত্য উপলব্ধি করিয়াই বিরুদ্ধ পরিবেশে বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হইলেও শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র বা শুধু মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করিবার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রভাবান্বিত ইসলামবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী, ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়িয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহাদের ছিল না।

 রব বা স্রষ্টা হিসেবেই সৃষ্টির বিশেষ করিয়া সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সাথে আল্লাহ সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বস্তুতঃ রব বা স্রষ্টা, পালন বা পোষণকর্তা হিসাবে, বিশ্ব ও সৃষ্টিকে ধাপের পর ধাপ, স্তরের পর স্তর, পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের ভিতর দিয়া কতকগুলি স্থায়ী ও সাধারণ ক্রমবিকাশ ক্রমোন্নতির নিয়মানুসারে এক অবস্থা হইতে অপর অবস্থার ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতরূপে চরম সুখ, শান্তি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে আগাইয়া নিবেন। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে আল্লাহ শুধু মুসলমানের নয়- জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের। রবই আল্লাহ সত্যিকার পরিচয়। রব হিসাবে রবুবিয়াৎ বা বিশ্ব-পালনই তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ। সুতরাং দুনিয়ার উপর আল্লাহর খলিফা বা প্রতিভূ হিসাবে মানব এবং খেলাফৎ হিসাবে রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান কাজ ও কর্তব্য হইল আল্লাহর উপায় ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্বের পালন করা এবং জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামগ্রিক সুখ, শান্তি, উন্নতি, কল্যাণ ও পূর্ণ বিকাশের জন্য চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রাম করা।

মুসলিম লীগ সম্পর্কে শামসুল হক পুস্তিকাটিতে বলেনঃ

 নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনও দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান ছিল না; ইহা ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ। ইহার উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, পাকিস্তানের মূল নীতিগুলিকে কার্যকরী করিয়া তুলিতে হইলে প্রয়োজন নতুন চিন্তাধারা, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচী এবং মুসলিম লীগকে মুসলিম জনগণের সত্যিকার জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ হিসাবে গড়িয়া তোলার।...

 কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ উপরোক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করিয়া তাঁদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য লীগের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা ভাঙ্গাইয়া চলিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যেই তাহারা মুসলিম লীগকে দলবিশেষের প্রতিষ্ঠান করিয়া ফেলিয়াছেন। শুধু তাহাই নয়, মানবের প্রতি আশীর্বাদস্বরূপ ইসলামকেও ব্যক্তি, দল ও শ্রেণীবিশেষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যায় এবং অসাধুভাবে কাজে লাগান হইতেছে। কোনও পাকিস্তান প্রেমিক এমন কি মুসলিম লীগের ঝানু কর্মিগণ পর্যন্ত নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে কোনরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করিতে অথবা প্রস্তাব করিতে পারে না। কেহ যদি এইরূপ করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহাদিগকে পাকিস্তানের শত্রু বলিয়া আখ্যায়িত করা হয়।

 পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে, মুসলিম লীগকে এইসব স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকার জনগণের মুসলিম লীগ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে, মুসলিম লীগকে সত্যিকার শক্তিশালী মুসলিম লীগ বা মুসলিম জামাত বা মুসলিম জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে পরিণত করিতে হইলে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে ইহার সদস্য শ্রেণীভুক্ত করিতে হইবে, অন্যথায় মুসলিম লীগকে পাশ্চাত্য সভ্যতা, গণতন্ত্র ও সাংগঠনিক নীতি প্রভাবান্বিত দলবিশেষের পার্টি বলিয়া ঘোষণা করিয়া অপরাপর সবাইকে সাধ্যমত দল গঠন করিবার সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার দিতে হইবে। মুসলিম লীগের ভিতর প্রত্যেক ব্যক্তি, দল ও উপদলের স্বাধীন মতামত, আদেশ, নীতি ও কর্মসূচী ব্যক্ত এবং তার পিছনে সংঘবদ্ধ হইবার অধিকার দিতে হইবে। তদুপরি ছাত্র, যুবক, মহিলা, চাষী, ক্ষেতমজুর, মজদুর প্রভৃতি শ্রেণীসংঘ গড়িয়া তুলিবার স্বাধীনতা থাকিবে।

 ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তাতে বলা হয়ঃ

১। পাকিস্তান খেলাফৎ অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক্স বৃটিশ কমনওয়েলথের বাহিরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে।

২। পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে।

৩। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর প্রতিভূ হিসাবে জনগণের উপর ন্যস্ত থাকিবে।

৪। গঠনতন্ত্র হইবে নীতিতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।

 কৃষি পুনর্গঠন প্রস্তাবে বলা হয়ঃ

১। জমিদারী প্রথা ও জমির উপর অন্যান্য কায়েমী স্বার্থ বিনা খেসারতে উচ্ছেদ করিতে হইবে।

২। সমস্ত কর্ষিত ও কৃষি উপযোগী অকর্ষিত জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে।

৩। তাড়াতাড়ি অর্ডিন্যান্স জারী করিয়া তেভাগা দাবী মানিয়া লইতে হইবে।

৪। রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে সমবায় ও যৌথ কৃষি প্রথা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।...

৫। নিম্নলিখিত বিষয়ে কৃষকদের অবিলম্বে সাহায্য করিতে হইবেঃ

(ক) সেচ ব্যবস্থা সুবিধা ও সার প্রস্তুতের পরিকল্পনা।

(খ) উন্নত ধরনের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।

(গ) সহজ ঋণদান ও কৃষিঋণ হইতে মুক্তি।

(ঘ) ভূমি-করের উচ্ছেদ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভূমিকর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমানো।

(ঙ) ভূমি-করের পরিবর্তে কৃষি আয়কর বসানো।

(চ) খাদ্যশস্য প্রভৃতি জাতীয় ফসলের সর্বনিম্ন ও সর্ব-উ দর নির্ধারণ করিয়া দিতে হইবে এবং পাটের সর্বনিম্ন দর বাঁধিয়া দিতে হইবে।

(ছ) খাদ্যশস্যের ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকা উচিত। পাট ব্যবসা ও বুনানীর লাইসেন্স রহিত করিতে হইবে।

(জ) সকল রকমের সমবায় সমিতিগুলিকে সাহায্য ও উৎসাহ দিতে হইবে।

 ৬। কালে সমস্ত ভূমিকে রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং সরকারের অধিনায়কত্ব ও তত্ত্বাবধানে যৌথ ও সমবায় কৃষিপ্রথা খুলিতে হইবে।

 দেশীয় শিল্পকে নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মূল দাবীতে নিম্নলিখিত কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়ঃ

 ১। প্রাথমিক শিল্পগুলিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে যেমনঃ যুদ্ধ শিল্প, ব্যাঙ্ক, বীমা, যানবাহন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, খনি, বন-জঙ্গল ইত্যাদি; এবং অন্যান্য ছোটখাটো শিল্পগুলিকে পরিকল্পনার ভিতর দিয়া সরাসরি রাষ্ট্রের তত্ত্ববধানে আনিতে হইবে।

 ২। পাট ও চা শিল্পকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত হইবে এবং পাট ও চা ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকিবে।

 ৩। কুটির শিল্পগুলিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিতর দিয়া বিশেষভাবে সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে।

 ৪। বিল, হাওর ও নদীর উপর হইতে কায়েমী স্বার্থ তুলিয়া দিয়া সরকারের কর্তৃত্বাধীনে মৎস্যজীবীদের মাঝে যৌথ উপায়ে বণ্টন করিয়া দিতে হবে এবং সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৎস্যের চাষ ও মৎস্য ব্যবসার পত্তন করিতে হইবে। ফিশারী বিভাগের দ্রুত উন্নয়ন করিয়া এই সমস্ত বিষয়ে শিক্ষা প্রসার করিতে হইবে ও উন্নত ধরনের গবেষণাগার খুলিতে হইবে।

 ৫। শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যক্তিগত একচেটিয়া অধিকার থাকিবে না।

 ৬। বৃটিশের নিকট হইতে স্টার্লিং পাওনা অবিলম্বে আদায় করিতে হইবে এবং তাহা দ্বারা যন্ত্রপাতি ক্রয় করিতে হইবে ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে হইবে।

 ৭। দেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিবার ভার রাষ্ট্রকে গ্রহণ করিতে হইবে।

 ৮। সমস্ত বৃটিশ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে।

 ৯। শিল্পে বৈদেশিক মূলধন খাটানো বন্ধ করিতে হইবে।

 ১০। শিল্পে মুনাফা হার আইন করিয়া বাঁধিয়া দিতে হইবে।

 মানবতার চূড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়া এক কাতারে সমবেত হইতে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আবেদন জানাইতেছে। সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দ আজ সমাজের আনাচে-কানাচে সর্বত্র শোনা যাইতেছে- সেই ফোঁসফোঁস শব্দই যেন এই যুগের সঙ্গীত। আমাদের কওমী প্রতিষ্ঠান এই সরীসৃপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া তাহাদের বিষদাঁত উৎপাটন করিতে বদ্ধপরিকর। হজরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) বলিয়াছিলেন: “যদি আমি ঠিক থাকি, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আর যদি আমি ভ্রান্ত হই, আমাকে সংশোধন কর।’ সেই অমর আদর্শকেই সামনে ধরিয়াই কওমী প্রতিষ্ঠান সমস্ত দেশবাসীকে সমতালে আগাইয়া আসিতে আহবান জানাইতেছে; আসুন আমরা কোটি কোটি নর-নারীর সমবেত চেষ্টায় গণ-আজাদ হাসিল করিয়া সোনার পূর্ব পাকিস্তানকে সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়িয়া তুলি।


  1. ১৯৪৮ সালের ২৩শে জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী, সম্পাদক শামসুল হক এবং মুখ্য সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ।