বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৪০

শিরোনাম সূত্র তারিখ
উর্দ্দুর পক্ষে লেখা বাঙালীদের তাত্ত্বিক বক্তব্য মাহে নও (আজাদী সংখ্যা) ১৪ আগষ্ট, ১৯৪৯

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার নাম
মীজানুর রহমান

 দুনিয়ার প্রত্যেক আজাদ রাষ্ট্রের নিজস্ব রাষ্ট্রভাষা রয়েছে এবং থাকা দরকার। এই বিষয়ে তর্ক-তকরারের গোনজায়েশ নাই।

 তিকসিমের পর ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হয়েছে নাগরী হরফে লেখা হিন্দী বা হিন্দুস্থানীকে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সওয়াল স্বাভাবিকভাবে উঠেছিল। কায়েদে আজম নির্দেশ দিয়ে গেছেনউর্দ্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

 কায়েদে আজমের নির্দেশ যুক্তিসংগত। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার কবেলিয়াত উর্দুর রয়েছে। এই সমস্যার সমাধানের বুনিয়াদ তৈরী হয়েছে গেছে। আনজামের এনতেজাম শুধু বাকী।

 সমাধানের বিষয়গত আলোচনার দরকার নেই। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার নাম নিয়ে আমরা কিছু সোপারেশ রয়েছে। এই সোপারেশটুকু পেশ করার জন্যই আজকের আলোচনা।

 রাষ্ট্র বা জাতির নামানুসারেই হয়ে থাকে রাষ্ট্রভাষার নাম। হওয়াও সংগত এবং সুবিধাজনক। এই হিসাবে আমার মতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার নাম হওয়া উচিৎ পাকিস্তানী উর্দু ভাষাকে “পাকিস্তানী” বলে অভিহিত করাই আমার প্রস্তাব।

 “উর্দু মানে সামরিক ছাউনি (মিলিটারী ক্যাম্প) উর্দু কেবল মুসলমানের ভাষা নহে। মুসলমান ও খাছ কোন তায়ালুক নেই। মরহুম মওলানা মোহাম্মদ আলীর কথায়- “উর্দু ইসলামের তোহফা নহে। আরবীফারসী-তুকী জবান হতেও উর্দুর উৎপত্তি নহে... আরবী-ফারসী জবানের কতকগুলি আলফাজই উর্দু ভাষায় মুসলমানদের নিজস্ব।... আরবী কোন দিনই ভারতের মুসলমানদের কথ্য ভাষা ছিলনা। ফারসী এবং তুর্কী এককালে ভারতের মুসলমানদের কথ্য ভাষা ছিল।

 “Although the Court Language of the Muslims remained Persian. Hindustani had to come the vernacular of daily use long before the Mughals lost the rule of Delhi. It is this language which is called Urdu and in the advocacy of which Muslims are sometimes so vehement. To use the sneer or Mr. Lioyd George, it is not only Mr. Balfour who is hatching the Cuckoo's egg for even though the Muslims of India know that it is not their own they are now as much attached to Urdu as they were attached to Persian before, and far more than they were ever attracted to Arabic”.

 উর্দু দৈনিক ‘হামদর্দের সম্পাদক এবং মশহুর উর্দু কবি মরহুম মওলানা মোহাম্মদ আলীর পক্ষে উর্দু হামদর্দই স্বাভাবিক। তথাপি সত্যের খাতিরেই মওলানা উপরের মন্তব্য করেছেন। উর্দুর বিকাশে মুসলমানের দান অবশ্য প্রচুর। নিজস্ব শক্তি সৌন্দয্য এবং সাবলীলতার কল্যাণেই উর্দু ভারতবর্ষের নানা প্রদেশে এতটা প্রসার লাভ করেছিল।

 মুসলিম হুকুমাতের মারকাজ দিল্লীর সামরিক ছাউনীতেই উর্দুর পয়দায়েশ। রাজনীতিক কারণে বেচারা উর্দুকে আজ জন্মভূমি হতে হিজরত করে আসতে হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানের নানা প্রদেশে উর্দু অবশ্য অপরিচিত নহে। বর্ণমালা ও ইসলামী অবধারার কল্যাণে এবং নিজস্ব শক্তি ও সৌন্দর্য্যের দওলতে উর্দু মুসলমানদের নিকট খুবই আদরণীয়।

 মাগরেবী পাকিস্তানের বাসিন্দাগণের নিকট উর্দুর মকবুলিয়াৎ সম্বন্ধে সন্দেহের অবসর নাই। মাশরেকী পাকিস্তানেরও উর্দুর কদরদামী ব্যাপক। মুসলমানী বাংলা এবং মুসলমানী উর্দু শব্দ সম্পাদকে বলতে গেলে খালাতো ভাই। মাশরেকী পাকিস্তানের মুসলমান সমাজে নিত্য প্রচলিত শব্দসমূহের শতকরা ৬০-৭০টি শব্দ উর্দু ভাষাতেও প্রচলিত বলে আমার বিশ্বাস। সাহিত্যিক বাংলার কথা অবশ্য আলাহিদা। তথাকথিত সাহিত্যিক বাংলা মাশরেকী পাকিস্তানের সাধারণ মাতৃভাষা নহে তাহা অবশ্যই স্বীকার্য। মোকামী জবান এবং আদাবী জবানের পার্থক্য সকল দেশেই বর্তমান। মোকামী জবানই আসলের মাদেরী জবান।

 মুসলমানী বাংলা এবং মুসলমানী উর্দুর আসল পার্থক্য লিখন প্রণালীতে। মাশরেকী পাকিস্তানের বাংলা জবানের লিখনরীতি পরিবর্তনের কথা উঠছে। আরবী হরফে লিখিত হলে মুসলমানী বাংলা এবং মুসলমানী উর্দুর বর্তমান পাথক্য কালক্রমে বিলোপ পাওয়া বিচিত্র নহে। পাকিস্তানের কল্যাণে আমাদের জীবন অনেক কিছু পরিবর্তন এসেছে এবং আরও আসবে। রাজনৈতিক আবর্তন বিবর্তনের সহিত ভাষার আবর্তন বিবর্তন বিশেষভাবে বিজড়িত। ভাব প্রকাশের জন্যই ভাষা। ভাবধারার পরিবর্তনের সংগে সংগে ভাষার পরিবর্তনও অবশ্যাম্ভাবী। মুসলিম জাতীয়তা ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নহে। ভৌগোলিক জাতীয়তার সহিত ইসলামী জাতীয়তার মৌলিক মোখলেকাৎ ভৌগোলিক ব্যবধান যাহাই হোক না কেন, সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের এক খোদা, এক নবী, এক মযহাব, এক মিল্লাত, একই তাহজীব-তমাদ্দুন। সুতরাং ভৌগোলিক ব্যবধানে মুসলিম মিল্লাতের সত্যিকার ভাবধারা বিভিন্নমুখী হতে পারে না। যেহেতু ভাবধারার উৎস এক, ভাবের বাহন ভাষাও মোটামুটি এক-কেন্দ্রিক হওয়াই স্বাভাবিক।

 আগেই বলেছি রাষ্ট্র-ভাষার নাম দেশ বা জাতির নামানুসারেই হয়ে থাকে। এবং হওয়াও সংগত। পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষার স্বাভাবিক নাম “পাকিস্তানী”। উর্দু নাম বদল করে পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষাকে “পাকিস্তানী” বলাই আমার মতে সঙ্গত। পাকিস্তানী গৃহীত হলে আমার বিশ্বাস মুসলমানী বাংলা এবং মুসলমানী উর্দু Ultimate fusion-এর পথ অধিতর প্রশস্ত হবে। মুসলমানী বাংলা এবং মুসলমানী উর্দু সমবায়ে গঠিত হবে Common Script-এ লেখা পাকিস্তানী। মাশরেকী ও মাগরেবী পাকিস্তানের জবানী সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এই পথে।

 স্বাভাবিকভাবেই সওয়াল হতে পারে উর্দু যখন হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা তখন উহার নাম বদলের দরকার কি? দরকার রয়েছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে সমুন্নত ভাষা উর্দু এবং বাংলা অন্য কোন প্রাদেশিক ভাষা বাংলার ন্যায় একটা বিকশিত নহে। মাশরেকী পাকিস্তানের মুসলমানী বাংলার সহিত উর্দুর সামঞ্জস্যের কথা বলেছি। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার নাম পাকিস্তানী রাখা হলে মাশরেকী ও মাগরেবী পাকিস্তানের ভাষাগত সমন্বয়ের পথ সহজ ও কোশাদা হবে। পাকিস্তানী কথাটায় পাকিস্তানের বাশিন্দাগণের প্রাণে যতটা অনুপ্রেরণার সঞ্চার করবে অন্য কোন নামে তাহা সম্ভবপর নহে। অনুপ্রেরণার কথাটা বিশেষভাবে কারেলে কদর।

 নাম পরিবর্তনের উর্দুর অন্তর্নিহিত ও সাবলীলতা ব্যাহত হবে না। আবশ্যক সংস্কার এবং পরিবর্তনের পর মাশরেকী পাকিস্তানের বাংলা ভাষার নাম পরিবর্তনেরও কথা উঠেছে। মুসলমানী বাংলার নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তানী হতে পারে। পাকিস্তানী বাংলা ও পাকিস্তানী উর্দ্দু স্বাভাবিকভাবেই চলবে ইসলামী তাহজীব-তমদ্দুনের পথে। ভারতীয় উর্দ্দু এবং পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষা চলবে অন্য পথে। দুই বিভিন্নমুখী ভাষার এক নাম অসংগত নহে কি? এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলেও পাকিস্তানী বাংলা ও পাকিস্তানী উর্দ্দুর নাম পরিবর্তনের আবশ্যকতা অনুভূত হবে।

 Common Script এবং Common ideology সোনার কাঠির পরশে Common Language evaluation খুবই সম্ভব এবং স্বাভাবিক। পাকিস্তানী হওয়া উচিৎ উক্ত Common Language-এর নাম। পাকিস্তানের সামগ্রিক কল্যাণ কামনায় Common Language তৈরী করার প্রচেষ্টা শুধু সংগত নহে, জরুরী। ইনশাআল্লাহ পাকিস্তান স্থায়ী হবার জন্যই এসেছে Common Language হবে পাকিস্তানের স্থায়ীতের অন্যতম সোনালী বন্ধন। নাম পরিবর্তনের উর্দ্দু ভাষার আসল হাস্তি বজায় থাকবে। অথচ নতুন নামের দওলতে পাকিস্তানের সকল প্রদেশের কাছে খাছ করে মাশরেকী পাকিস্তানের বাশিন্দাগণের নিকট রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা এবং আকর্ষণীয়তা বৃদ্ধি পাবে। কারণ আগেই বয়ান করেছি।

 একথা সত্য যে, উর্দ্দু সাধারণভাবে পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই মাদেরী জবান নহে যদিও উর্দ্দু পাকিস্তানের প্রচলিত জবানসমূহের মধ্যে পাকিস্তানের হুকুমতী জবান হবার পক্ষে অধিকতর মোমতাহেক। রাজনৈতিক আবর্তনে উর্দ্দু নিজ বাসভূমে পরাবাসী হতে বসেছে। হিন্দুস্থানের ইউ,পি, দিল্লী প্রভৃতি প্রদেশেই ছিল উর্দ্দুর শক্তিশালী আস্তানা। নাগরী হরফে লেখা হিন্দীর হামলায় উর্দ্দু সাবেক আবাস হতে বহিষ্কৃত হচ্ছে। পাকিস্তানী নামের বরকতে উর্দ্দু ভাষা পাবে পাকাপোক্ত আস্তানা এবং উচ্চতর আসন পাকিস্তানের পাক মাটিতে।

 নাম বদলের প্রস্তাব পেশ করেছি বলে কেউ যেন মনে না করেন যে আমি উর্দ্দুর মোখালেফ। বাংলা আমার মাদেরী জবান হলেও আমি বরাবর উর্দ্দু ভাষার অধিকতর চর্চার পক্ষপাতী। পাকিস্তানের সামগ্রিক কল্যাণ কামনায়ই আমি নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব পেশ করেছি। আমার প্রস্তাবে কায়া বজায় থাকবে, বদল হবে কেবল ছায়া। ছায়ার চেয়ে কায়াই আসলে কাম্য।

 Common Script-এ লেখা Common Language রাষ্ট্রের পক্ষে নেহায়েত জরুরী ব্যাপার। ভাবালুতা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ও মংগলের জন্য আমাদিগকে সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। পাকিস্তানের স্বচ্ছ দৃষ্টি আকৃষ্ট হোক এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি, পাক গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব গ্রহণ করবার কালে প্রস্তাবিত “পাকিস্তানী” নাম অনায়াসে গৃহীত হতে পারে। পাক-বাংলা, এবং পাক-উর্দ্দুর সমন্বয় সাধনের প্রকৃষ্ট পন্থা সেরাতুল মোস্তাকীম, পাকিস্তানী।