বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৪২

শিরোনাম সূত্র তারিখ
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যৌথ বিবৃতি পূর্ব বাংলার ভাষার আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতিঃ বদরুদ্দীন উমর ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০

পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকগণের নিকট আবেদন

ভ্রাতৃগণ,

 আল্লাহ তা'আলার অসীম অনুগ্রহে দুইশত বৎসরের গোলামীর পরে আমরা আজাদী লাভ করিয়াছি। এই আজাদী জিহাদের প্রধান সেনানী কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মরহুম আমাদিগকে বলিয়াছেন, “আমি পাকিস্তানের ভিত্তি পত্তন করিলাম, তোমরা পাকিস্তানের নাগরিকগণ ইহার উপর ইমারত গঠন করিবে”। এই গঠন কার্য্যের জন্য অত্যাবশ্যক দেশে শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষির সমুন্নতি সাধন। ইহার জন্য সর্বাগে প্রয়োজন দেশের শান্তির আবহাওয়া সৃষ্টি করা। কিন্তু গভীর দুঃখের বিষয় পশ্চিম বঙ্গে কতিপয় স্থানে বিশেষত কলিকাতায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার কারণে অথবা অন্য যে কনে কারণেই হউক আমাদের এই সুন্দর শান্তিপূর্ণ পূর্ব বাঙ্গালাতেও অশান্তি দেখা দিয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের সংখ্যালঘুদের প্রতি উৎপীড়ন যেমন আমরা ঘৃণা করি, পূর্ব্ববঙ্গের সংখ্যালঘুদের প্রতি উৎপীড়ন আমরা সেইরূপই ঘৃণা করি। আমাদের মহামান্য কায়েদে আজম মরহুম, পাকিস্তানের বড় লাট মাননীয় জনাব খাজা নাজিমুদ্দিন, প্রধান মন্ত্রী মাননীয় জনাব লিয়াকত আলী খান, পূর্ববঙ্গের প্রধান মন্ত্রী মাননীয় জনাব নূরুল আমীন, পূর্ব পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মৌলানা আতাহার আলী প্রভৃতি গণ্যমান্য মহোদয়গণ অন্য রাষ্ট্রের মুসলমানগণের প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিশোধ আমাদের রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু নিঃসহায় শান্ত জনগনের উপর লওয়ার প্রবৃত্তিকে একবাক্যে নিন্দা করিয়াছেন। আমরা আমাদের মুসলমান ভাইগণকে সবিনয়ে দৃঢ়ভাবে বলিব যে, এই প্রকার কার্য্যের দ্বারা পরোক্ষভাবে ও অজ্ঞাতসারে তাঁহারা ভারতের ৪ (চারি) কোটি মুসলমানের ধনপ্রান বিপন্ন করিয়া তুলিতেছেন এবং পাকিস্তানের অশেষ ক্ষতি সাধন করিতেছেন। এ প্রকার কার্য্যের ফলে আকস্মিক লোক বিনিময়ে রাষ্ট্রের উপর এমন চাপ পড়িবে যে, তার ফলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো ভাঙ্গি পড়িবে। উচ্ছৃংখল কার্যকলাপের ফলে, শিল্প-বাণিজ্য এবং স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হইয়া উভয় রাষ্ট্রই অচল হইয়া পড়িবে যার ফলে আমাদের এই সাধের আজাদী বিপন্ন হইবে।

 আল্লাহতা'আলা ধর্মবিশ্বাসী মুমনিগণকে বলিতেছেন, “ওহে ধর্ম্মবিশ্বাসী মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর কথা মান, রসুলের, এবং তোমাদের মধ্যে আজ্ঞাদাতা নেতাদের কথা মান”। (কুরআন, সুরা নিসা, রুকু ৮)। আল্লাহ তা'আলা বলিতেছেন, “যে ব্যক্তি হত্যাকারী কিংবা পৃথিবীতে উৎপাতকারী ভিন্ন অন্য কোনও প্রাণকে হত্যা করে, সে যেন সমস্ত মনুষ্য জাতিকে হত্যা করে”। (কুরআন মাইদাঃ রুকু ৫)। হজরত রসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “উৎপীড়িত (মজলুম) যদিও বিধর্মী হয়, তাহার আর্তনাদ হইতে সাবধান হও”। তিনি আরও বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি কোন জিম্মীকে (মুসলমান রাজ্যের অমুসলমানকে) কষ্ট দেয়, সে নিশ্চয়ই আমাকে কষ্ট দেয়”।

 পাকিস্তানের প্রত্যেক মুসলমানের মনে রাখা উচিৎ যে কলিকাতা বা হিন্দুস্তানের কোন অংশে হিন্দুদের দ্বারা অনুষ্ঠিত কোন অন্যায়ের জন্য এদেশের হিন্দুদের কিছুতেই দায়ী করা চলে না। মুসলমনাদের ন্যায় তাহারাও স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক এবং পাকিস্তান সরকার যখন তাহাদের নাগরিক বলিয়া স্বীকার করিয়াছে তখন জান-মালের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের ন্যায় তাহাদেরও রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ দাবী আছে। একথা প্রত্যেক মুসলমানের স্মরণ রাখা উচিৎ যে, পাকিস্তানের হিন্দুরা হিন্দুস্থানের মুসলমানদের বিনিময়ে জামানত হিসাবে বাস করিতেছে না। তাহারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারের বলেই বাস করিতেছে। অতএব একজন মুসলমানের যে তারই মত একজন পাকিস্তানের স্থানীয় নাগরিক এমন একজন হিন্দু উপর কোন অবস্থাতেই অন্যায় উৎপীড়ন করার অধিকার নাই। প্রত্যেক শিক্ষিত ও বিবেচক মুসলমানের স্মরণ রাখা উচিৎ যে, পশ্চিম বঙ্গের দাঙ্গার প্রতিবাদে এখানে নিরপরাধ হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার করিলে তাহাতে হিন্দুস্থানের মুসলমানদের কোনই উপকার হইবে না। বরং বিহার, উড়িষ্যা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, নাগপুর প্রভৃতি প্রদেশে এখনও যেসব কোটী কোটী মুসলমান হিন্দুদের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে বাস করিতেছে তাহাদের জীবন বিপন্ন হইয়া পড়িবে। দেশে শান্তি রক্ষার দ্বারা পাকিস্তানের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার দ্বারাই একমাত্র হিন্দুস্থানের মুসলমানদের আপনারা সত্যিকার উপকার করিতে পারেন।

 হিন্দু ভাইগণকে আমরা বলিব, আপনারা “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” সেই জন্মভূমিকে আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া সহসা পরিত্যাগ করিবেন না। আপনারা মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে হিন্দু-মুসলমানদের মিলনমন্ত্র গ্রহণ করিয়া ক্ষমতা দ্বারা ক্রোধকে জয় করুন এবং সাইজ সহকারে বিপদ দূর করিবার জন্য চেষ্টা করুন। আপনারা নিশ্চয় জানিবেন রাষ্ট্রের সর্বাধিক সাহায্য ও সহানুভূতি সুখে-দুঃখে সম্পদে-বিপদে সকল সময় আপনারা পাইবেন। পাকিস্তানের দৃঢ় অথচ সদয় বাহু সর্ব্বদা আপনাদিগকে সাহায্য ও রক্ষা করিতে প্রস্তুত আছে এবং রাষ্ট্রের সমস্ত হিতকামী নাগরিক ও ধর্মনিষ্ঠ মুমিন মুসলমান আপনাদের সহিত আছেন। ইহার প্রমাণ আপনারা বর্তমানে পাইয়াছেন এবং আশাকরি ভবিষ্যতেও পাইবেন। আপনারা লক্ষ্য রাখিবেন, আপনাদের মধ্য হইতে আত্মীয়স্বজন ফেলিয়া যাঁহারা পশ্চিম বঙ্গ ও আসাম প্রভৃতি ভারতীয় রাজ্যে চলিয়া যাইতেছেন, তাঁহারা যেন সেখানে যাইয়া অতিরঞ্জিত কোন কথা না বলেন বা উত্তেজনামূলক কোন গুজব না রটান, অথবা এখান হইতে কেহ কোন মিথ্যা সংবাদ সংবাদপত্রে কিংবা চিঠি-পত্রের মারফতে কাহারও নিকট না পাঠান। কারণ, তাহাতে সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হইলে এখানেও হইতে পারে এবং তার ফলে উভয় রাজ্যেই অশেষ অঘটন ঘটিতে পারে যদি কেহ তাহা করেন, তবে নিজের আত্মীয়-গোষ্ঠীরই অনিষ্ট করিবেন। সকলের মঙ্গলের জন্য শান্তির পথই একমাত্র পথ।

 আমরা আমাদের হিন্দু-মুসলমান ভাইগণকে এই বলিয়া সতর্ক করিয়া দিতে চাই যে, অতীতে পরস্পরের প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ প্রচার ও ঘৃণা প্রদর্শনের ফলে আমরা বহু কষ্ট পাইয়াছি, বর্তমানেও পাইতেছি, অনেক হইয়াছে, আর নয়। আমরা স্বাধীন হইয়াছি। স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিতে হইবে। সুতরাং এ বিষয়ে সকলকে সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। দেখিতে হইবে, কেন যেন দায়িত্বহীন সংবাদপত্রের প্রচারণায় কিংবা লোকের গুজব কথায় বিশ্বাস করিয়া আতঙ্কগ্রস্ত বা উত্তেজিত না হন। সকল সময়ে আপনারা আমাদের সরকারের অনুমোদিত সংবাদের উপর নির্ভর করিবেন এবং আমাদের নেতাদিগের নির্দেশের অনুসরণ করিবেন।

 আমরা পুনরায় আমাদের দেশবাসী ভাইগণের নিকট আমাদের সবিনয় আরজ জানাইতেছি যে, তাঁহারা যেন সকলেই এখন হইতে নিজদিগকে পাকিস্তানী বলিয়া বিবেচনা করেন এবং পরিচয় দেন এবং ইংরেজের বিভেদাত্মক ভাবের প্রভাব হইতে মুক্ত থাকেন। আমরা আরও জানাইতেছি যে, অন্য রাষ্ট্রে যাহাই ঘটুক না কেন আমরা পাকিস্তানে অখণ্ড শান্তি বিরাজমান দেখিতে চাই যাহাতে আমাদের প্রিয় পাকিস্তান সর্ব্বপ্রকারে পৃথিবীর একটি আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।


পাকিস্তান জিন্দাবাদ

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (প্রেসিডেণ্ট) সূর্য্যকুমার বসু (ঢাকেশ্বরী কটন মিল)
ডঃ এস, এন, রায়    মীর্জা আবদুল কাদের
হামিদুল হক চৌধুরী এম.এল.এ আলমাছ আলী
আলি আহমদ খান “(সম্পাদক) এম, এ, আউয়াল (প্রচার সম্পাদক)
বসন্ত কুমার দাস এম, এ, ওয়াদুদ (সহ-সম্পাদক)
ফরিদ আহমদ চৌধুরী কে, জি, মাহবুব (সহ-সম্পাদক)
আনোয়ারা খাতুন
আবদুল খালেক তফাজ্জল হোসেন (অফিস সম্পাদক)
খয়রাত হোসেন খালেক নেওয়াজ খান (ই,পি,এম,এস,এল)
আবদুল হাকিম এম,এ, আজিজ
(প্রিন্সিপাল) এব্রাহিম খান (সদস্য)    পাক গণপরিষদ উষা রায় (আনন্দবাজার)
ভবেশচন্দ্র নন্দী আবদুল ওহাব (ষ্টেটসম্যান)
আতাউর রহমান, এডভোকেট (প্রচার সম্পাদক)    এস, কে, চ্যাটাজিং (অমৃত বাজার)
এন, সি, সাহা
মুঃ নুরুল হুদা পি, কে, ব্যানার্জি
কফিল উদ্দিন চৌধুরী জাফর করিম
আলী আমজাদ খান ক্ষেত্র মোহন বনিক
রাধা বল্লভ সাহা
(খানবাহাদুর) আরফান খান
(রায়বাহাদুর) আর, পি, সাহা
কোষাধ্যক্ষ
কোষাধ্যক্ষ
সামছুল হক