বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৫৩

শিরোনাম সূত্র তারিখ
একুশে ফেব্রুয়ারী: আন্দোলনের ঘটনাপঞ্জী একুশে ফেব্রুয়ারী (সংকলন) ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২

একুশের ইতিহাস

কবির উদ্দিন আহমদ

 বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে ১৯৪৮ সনে ঢাকার অগ্রণী ছাত্রসমাজ ও সংস্কৃতিবান বুদ্ধিজীবীরা প্রথম আওয়াজ তুলেছিল। তখন থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সেদিনও ছাত্র সমাজ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, সরকারের চূড়ান্ত দমননীতি নেমে এসেছিল তাদের উপর। ছাত্র জনতার দুর্বার শক্তির সন্মুখে বিশ্বাসঘাতক নাজিমুদ্দিন সরকার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীকে স্বীকার করে প্রস্তাব পাশ করেছিলেন ও গণপরিষদের কাছে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে ধৃত সকল বন্দীদের মুক্তি দিয়ে এবং অন্যতম কর্মী ও নেতৃবৃন্দের উপর থেকে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করে ঢাকার অবাঞ্চিত পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়েছিলেন।

 ১৯৪৮ সনের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পর প্রায় চার-চার বছর (১৯৫২) কেটে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার দাবীকে সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, নাজিমুউদ্দিন সরকার তার নিজের প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করেছে। লীগ সরকারের এমনি বিশ্বাসঘাতকতাই জনসাধারণের মনে পুঞ্জীভূত অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল।

২৬শে জানুয়ারী

 পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবর্তের প্রবাহচক্রে নাজিমুউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। ১৯৫২ সনে পূর্ববঙ্গ সফরকালে ২৬শে জানুয়ারী পল্টন, ময়দানে এক জনসভায় তিনি পুনরায় নির্লজ্জের মত “উর্দূই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে” বলে ঘোষণা করলেন। এই বক্তৃতা প্রদেশের অসন্তোষ-ভরা জনমনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ঢাকায় এবং প্রদেশের সর্বত্র তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে সংঘটিত প্রতিবাদ উঠতে লাগলো দিকে দিকে।

৩০শে জানুয়ারী

 নাজিমুদ্দিনের স্বৈরাচারী ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্র-সমাজ সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলবার সংকল্প গ্রহণ করলো। ৩০শে জানুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র সভা করে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবীকে সামগ্রিক কণ্ঠে পুনরুত্থান করল। এই পুনরুত্থাপনের নেতৃত্ব গ্রহণ করল “বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র-ভাষা কমিটি”। ১৯৪৮ সনের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের নির্যাতিত ছাত্র-কর্মীরা নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে ভাষা আন্দোলনকে জীইয়ে রাখার জন্যে জনাব আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে “বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি” গঠন করে। এই রাষ্ট্রভাষা কমিটিই প্রতি বৎসর ১১ই মার্চ “রাষ্ট্রভাষা দিবস” উদযাপন করতে এবং এই কমিটিই ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনকে প্রথম সংগঠিত রূপ দেয়।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ

 সেই ৩০শে জানুয়ারী বৈকালে বার লাইব্রেরী হলে ঢাকার ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিবিদ ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়।

৪ঠা ফেব্রুয়ারী

 এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। বৈকালে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জননেতা মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা লীগ সরকারের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবী সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেই দিনই ২১শে ফেব্রুয়ারী অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবীতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেওয়া হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রস্তুতি

 ৪ঠা ফেব্রুয়ারী থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচার প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঢাকার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে সমগ্র প্রদেশের জনমনে তখন বিক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। স্বরাজোত্তর কালে সরকার বিভিন্ন উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে যে প্রাণধ্বংসী ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল, তারই প্রত্যক্ষ আঘাতের ফলে জনসাধারণে সৃষ্টি খুলে গেছে, অন্ধ মোহ কেটে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে ভাষার কণ্ঠরোধ করার নতুন ষড়যন্ত্র তাদের অসন্তোষকে দ্বিগুণতর করে দিয়েছে। সমগ্র প্রদেশ তখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। দিন দিন অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 একদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারীর জন্য জনসাধারণের ধর্মঘটের প্রস্তুতি অন্যদিকে ঐদিনই পূর্ববঙ্গ সরকারের বাজেট অধিবেশন উপলক্ষে গণ-শক্তির ভয়ে ভীত সরকার নিজেদের অসহায় মনে করে ২০শে ফেব্রুয়ারী রাত্রি থেকে ক্রমাগত এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারী করল।

 সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের আবহাওয়ার অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দিল। রিক্সাওয়ালা, গাড়ীওয়ালা, দোকানদার থেকে শুরু করে ছাত্র, কেরাণী, অফিসার ও রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত সর্বত্র প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হলো। সকল মহলেই ১৪৪ ধারার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, সারা শহরময় একটা থমথমে ভাব বিদ্যমান থাকে।

 একদিকে চূড়ান্ত সরকারী দমননীতি অন্যদিকে জনসাধারণের তীব্র অসন্তোষ-এমতাবস্থায় কর্তব্য নির্ধারণের জন্য “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের” এর জরুরী সভা আহ্বান করা হল। সঙ্গে সঙ্গে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররাও এক জরুরী বৈঠক সমবেত হয়ে পরিস্থিতির ব্যাপক পর্যালোচনা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

 সংগ্রামের কৌশল নির্দ্ধারণ করতে গিয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে তুমুল বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। জনাব ওলী আহাদ পরিস্থিতির সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনে অগ্রসর না হলে ভাষা আন্দোলনের এখানেই অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে, আর সরকারী দমননীতির নিকটও বশ্যতা স্বীকার করা হবে, সর্বোপরি জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। ইতিমধ্যেই সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদের সভা থেকে দুইজন প্রতিনিধি সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সভায় এসে উক্ত হলের ছাত্রসাধারণের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সর্বসম্মত অভিমত জানিয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও উক্ত সভার অধিকাংশ সদস্যই সরকারী দমননীতিকে মেনে নেওয়ার পক্ষে মন্তব্য করেন এবং অবশেষে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সঙ্গে সঙ্গে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যদি ছাত্র ও জনসাধারণের কোন অংশ সর্বদলীয় কর্মপরিষদের এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যায় তবে স্বাভাবিকভাবেই এই সর্বদলীয় কর্মপরিষদ বাতিল হয়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া হবে।

২১শে ফেব্রুয়ারী

 এই দিন সকাল থেকেই শহরের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটা চরম ঘৃণা ও ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে। কর্মীদের প্রবল প্রচারকার্যের ফলে জনসাধারণের মধ্যে আগে থেকেই ধর্মঘটের অনুকূলে মনোভাব সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। কর্মীদের প্রচেষ্টায় শহরের সকল অঞ্চলের দোকান-পাট, গাড়ী-ঘোড়া, যানবাহন ও স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। বেলা ১২টার মধ্যে সকল স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এসে হাজির হলো। প্রায় সাড়ে ১২টার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জনাব গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠীত হল। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক জনাব আবদুল মতিন আন্দোলনের পূর্বাপর পর্যায়ও ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ সঙ্কটজনক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেন এবং সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতামতের উপরই ১৪৪ ধারা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন।

 তখনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে জনাব শাসমসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তি পূর্ণভাবে আন্দোলন চালাবার জন্য বৃক্ততা দিলেন। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি তাঁর সহকর্মীগণসহ সভা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। অতঃপর ব্যাপকতম পর্যালোচনার পর ভাষার দাবীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিস্থিতির মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ছাত্ররা সুদৃঢ় আত্মচেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সংহত অভিমত ঘোষণা করল।

 সঙ্গে সঙ্গে সভা ভঙ্গ করে “দশজনী মিছিল” বের করার জন্য ছাত্ররা শ্লোগন দিতে দিতে গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। গেটের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল আইবি ও পুলিশ বাহিনী। ছাত্রদের প্রথম ‘দশজনী মিশিল’ শ্লোগান দিয়ে বের হতেই পুলিশ এসে গ্রেফতার করে তাদের ট্রাকে ভর্তি করে। দেখতে দেখতেই অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে অনেকগুলি ট্রাকে ভরে তাদের লালবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এত গ্রেফতারের পরও ছাত্রদের দমন করতে না পেরে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ তখন কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ল রাস্তার পাশে আর বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাঙ্গণে। উপর্যুপরি কয়েকবার কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ার পর ছাত্ররা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে ঝাঁপ দিতে থাকে। অনেকেই আবার কাঁদুনে গ্যাসে আহত হয়ে পড়ে রইল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ছাত্ররা তখন উত্তেজনা আর যন্ত্রণায় অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

 প্রায় বেলা ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতারী বরণ করতে থাকে, আর ধীরে ধীরে তারা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে গিয়ে জমায়েত হতে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিয়ে বের হতেই উদ্ধত পুলিশ বাহিনী এসে তাড়া করে। বেলা প্রায় সোয়া তিনটি সময় এম,এল,এ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকে। ছাত্ররা যতই শ্লোগান দেয় আর মিছিলে একত্রিত হয় ততই পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়া হানা দিতে থাকে। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে তাড়া করতে করতে মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের ভেতর ঢুকে পড়ে। হোষ্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করায় এরপর ছাত্ররা বাধ্য হয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। একদিকে ইট-পাটকেল আর অন্যদিক থেকে তার পরিবর্তে কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসে। পুলিশ তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছাত্রদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবদুল জববার ও রফিকউদ্দিন আহম্মদ শহীদ হন, আর ১৭ জনের মত গুরুততভাবে আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে সরানো হয়। তাঁদের মধ্যে রাত আটটায় সময় আবুল বরকত শহীদ হন।

 গুলীচালনার সাথে সাথেই পরিস্থিতির অচিন্ত্যনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে-মুখে যেন ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুন ঝরতে থাকে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের মাইক দিয়ে তখন পুলিশী হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। আইন পরিষদের সদস্যের প্রতি ছাত্রদের উপর গুলী চালাবার প্রতিবাদে অধিবেশন বর্জন করার দাবীও জানান হয়। ১৪৪ ধারার নাম-নিশানাও তখন আর পরিলক্ষিত হয় না। গুলীচালনার সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রান্তে প্রান্তে। তখনই অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েট ও বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে বেরিয়ে আসে। শহরে সমস্ত লোক তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে মেডিক্যাল হোষ্টেল প্রাঙ্গণে এসে হাজির হতে থাকে। রাস্তায় আর অলিতে-গলিতে যেন ঢাকার বিক্ষুব্ধ মানুষের ঝড় বয়ে চলে প্রবল বেগে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের ব্যারাকে ব্যারাকে শহীদদের রক্তরঞ্জিত বস্ত্রের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। মাইক দিয়ে যখন শহীদানের নাম-ঠিকানা ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন সমস্ত মানুষের মন থেকে যেন সমস্ত ভয়-ত্রাস মুছে গেছে, চোখে- মুখে সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধের দুর্জয় শপথ প্রকাশিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি মুখের রেখায় রেখায়।

 বাইরের এমনি তুমুল পরিস্থিতির ঢেউ এসে লেগেছে পরিষদ কক্ষে। পরিষদের বিরোধী দলের সদস্যরা নূরুল আমিনের কাছে ছাত্রদের উপর গুলীচালনার কৈফিয়ৎ দাবী করেন এবং পরিষদ মুলতুবি রাখার দাবী জানান। নূরুল আমিন সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, “কয়েকজন ছাত্র গুরুতররূপে আহত হয়েছে শুনে আমি ব্যথিত হয়েছি, তাই বলে আমাদেরকে ভাবাবেগে চালিত হলে চলবে না।” পরিষদ কক্ষেই এমনি জঘন্য মনোবৃত্তির তীব্র প্রতিবাদ উঠলো। লীগ পরিষদ দলের জনাব তর্কবাগীশ বলে উঠলেন, “আমাদের ছাত্রগণ যখন শাহাদাত বরণ করেছেন তখন আমরা আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকব তা আমি বরদাশত করব না।” -এই বলেই তিনি পরিষদ কক্ষ বর্জন করে এসে ছাত্রদের মাইকে পুলিশী বর্বরতার প্রতিবাদে ও আন্দোলনের সপক্ষে বক্তৃতা করলেন।

 রাত্রে পূর্ব হতে জারীকৃত সান্ধ্য আইন আর ১৪৪ ধারার বিন্দুমাত্র চিহ্নও কোথাও রইল না। শহর আর শহরতলীর হাজার হাজার মেয়ে-পুরুষ সেই রাত্রে মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গণ দেখতে আসে। দেখে মনে হল যারা শহীদ হলো তারা যেন মৃত্যুহীন, তারা যেন বাংলার সকল ধর্মের সকল মতের মানুষের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছে এই বধ্যভূমিকে।

২২শে ফেব্রুয়ারী

 এই দিন ভোর থেকেই সলিমুল্লাহ হল, মেডিক্যাল কলেজ, ফজলুল হক হল, মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল, জগন্নাথ কলেজের মাইকগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সকল কর্মী আর ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ সাধনের জন্য আহ্বান জানান হয়।

 সকাল বেলা সংবাদপত্রে দেখা গেল মাত্র ৩ জন নিহত, ৩০০ জন আহত ও ১৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

 ছাত্রদের উপর গুলীচালনার সংবাদ শুধু শহরেই নয়, দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের সমস্ত দোকান-পাট, গাড়ী-ঘোড়া, অফিস-আদালত, যান-বাহন বন্ধ করে শ্রমিক-মজুর-কেরানী ও কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘটে এগিয়ে এসেছে। শহীদদের লাশগুলিকে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেডিক্যাল হোষ্টেলের ভেতর ‘গায়েবী জানাজা’ পড়া হলো। এদিন সমস্ত শহর মিলিটারীর হাতে দেয়া হয়েছে। তবুও দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ জানাজায় এসে শরিক হলেন। ইমাম সাহেব মোনাজাত করলেন, “হে আল্লাহ, আমাদের অতি প্রিয় শহীদানের আত্মা যেন চিরশান্তি পায়। আর যে জালিমরা আমাদের প্রাণের প্রিয় ছেলেদের খুন করেছে তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায় তোমার দেওয়া এই দুনিয়ার বুক থেকে।”

 জানাজা শেষে জনসাধারণকে নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জনাব ওলী আহাদ পরিস্থিতির সামগ্রিক গুরুত্ব বিচার ও কর্মপন্থা ঘোষণা করে বক্তৃতা করলেন। তাঁর মুখ থেকে এক-একটি কথা যেন আগুনের ফুলকির মত বেরুল। সভা শেষ করেই লক্ষাধিক জনতার বিশাল মিছিল বেরোয়। এই শোভাযাত্রার মধ্যখানে হঠাৎ লাঠিচার্জ করার পরও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে গুলী চালায়। এখানে হাইকোর্টের কেরানী সফিউর রহমান শহীদ হন। ছত্রভঙ্গ জনতা তখন হাইকোর্ট আর কার্জন হলের চত্বরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শোভাযাত্রার প্রথম অংশ তবুও ষ্টেশন ও নবাবপুর হয়ে এগুতে থাকে। শোভাযাত্রার এই অংশ সদরঘাট এলে পুনরায় তাদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়। অনেকেই আহত হয়ে পড়ে রইলো রাস্তায় দু’পাশে। মিছিলটি মিটফোর্ড হয়ে চকবাজার দিকে মেডিক্যাল হোষ্টেলে গিয়ে শেষ হয়।

 অন্যদিকে সকাল ৯টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ ‘মর্নিং নিউজ’ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং ‘সংবাদ’ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের উপর মিলিটারী বেপরোয়া গুলী চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে।

 এইদিন জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলেও দলবদ্ধ হয়ে শোভাযাত্রা বের করে, আর ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। গ্রাম থেকে গাড়ীওয়ালা, মাঝি-মাল্লা, আর কৃষক-মজুর ছাত্র-শিক্ষকের এসে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এইদিন সমস্ত অফিস-আদালত, কারখানা, স্কুল-কলেজ, দোকান-পাট, যানবাহন বন্ধ করে তারা মিছিলে যোগ দিয়েছে। শহরের সকল প্রান্ত থেকে জনসাধারণ নিজেরাই মিছিল সংগঠিত করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেলওয়ে কারখানায় ধর্মঘট ঘোষিত হয়েছে। কারখানার শ্রমিকরাই রেলের চাকা বন্ধ করতে এগিয়ে এসেছে। প্রায় ১১টা পর্যন্ত রেল চলাচল একদম বন্ধ থাকে। সবদিক থেকে ব্যাপকতম ধর্মঘটের চাপে সরকার সেদিন বিকল হয়ে পড়েছিল। তারই চাপে পড়ে সেদিন পরিষদে লীগ সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং তার জন্য গণপরিষদের কাছে সুপারিশ করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন গুলীচালনার প্রতিবাদে লীগ পার্লামেণ্টারী দল বর্জন করেন।

২৩শে ফেব্রুয়ারী

 গত দুই দিন ধরে পুলিশ-মিলিটারী নিরস্ত্র জনতার উপর বেপরোয়া গুলী চালিয়েছে। শহীদদের লাশগুলি নিয়ে পর্যন্ত সরকার ছিনিমিনি খেলেছে। লাশগুলি কোথায় নিয়ে গেছে তার কোন হদিসই মেলেনি। জনসাধারণের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে- তাদের মনের ক্ষত আরো দ্বিগুণতর হয়ে গেল। শহীদদের লাশ নিয়ে এ দুর্ব্যবস্থা দেখে ‘দৈনিক মিল্লাত’ সেদিন সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলল, “ইসলামী বিধান অনুসারে মুসলমানের লাশ অতি পবিত্র এবং অত্যন্ত তাজিমের সহিত দাফন কার্য সম্পন্ন করা বিধেয়। কিন্তু দুই দিনের পুলিশ জুলুমের ফলে শাহাদাতপ্রাপ্ত লাশগুলি ইহাদের অভিভাবকদের ফেরত দেওয়া হয় নাই। শরিয়ত মোতাবেক তাহাদের শেষকৃত্য যদি সমাপন না করা হইয়া থাকে তাহা হইলে সরকারকে গোনাহের ভাগী হইতে হইবে। ইসলামী রাষ্ট্র বলিয়া জাহির করার পরও পাকিস্তানে এইরূপ ঘটিতে দেওয়া অত্যন্ত আপত্তিকর। মুসলমান জনসাধারণের মনের ক্ষতে ইহার দ্বারা লবণের ছিটা দেওয়া হইয়াছে বলা যাইতে পারে।”

 সকাল বেলা সংবাদপত্রে দেখা গেল ৫ জন নিহত, ১৫০ জন আহত ও ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রদেশের সর্বত্র ঢাকার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সংগঠিত বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছে। ধর্মঘট-শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে সর্বত্র গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে জেলায় জেলায়। ঢাকায় পূর্ণ ধর্মঘট প্রতিপালিত হয়েছে এদিনও। নিরস্ত্র জনতার উপর নাজিরাবাজার ও রেল ষ্টেশনে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের মাইকটি মিলিটারী এসে জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে যায়। মেডিক্যাল হোষ্টেলের গেটের পাশেই ছাত্ররা নিজেরাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলে। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন। এইদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদকে আন্দোলন চালানোর জন্য আবার পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। সভায় ৯ দফা দাবী স্থিরীকৃত হয় এবং নূরুল আমীনের জঘন্য মিথ্যা বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয় আর প্রদেশের ও কেন্দ্রের আন্দোলনে যোগসাধনের জন্য সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়।

 ঢাকার শত সহস্র মানুষকে এক একটি মাইকের সম্মুখে বসে বসে সারা দিন বক্তৃতা শুনতে দেখা যায়। রাত্রে আজিমপুর কলোনীর মেয়েরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় যোগদানের জন্য সেই আমলের সুদূর কমলাপুর থেকেও মেয়েরা আসেন। কয়েক হাজার মহিলা এই প্রতিবাদ সভায় একত্রিত হয়ে সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান।

২৪শে ফেব্রুয়ারী

 যতই সরকার দমননীতি চালাচ্ছিল ততই জনসাধারণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল। একটানা ৪ দিন তুমুল আন্দোলন চলেছে ঢাকা শহরে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের সকল শ্রেণীর মানুষ এসে যোগ দিয়েছে সেই প্রতিরোধ আন্দোলনে। সমস্ত অফিস-আদালত, কল-কারখানা, যানবাহন, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এক মিলিটারী ছাড়া আর কোন শক্তিই তখন সরকারের হাতে ছিল না। প্রত্যেকটি মুহূর্তেই সরকারের পতনের আশঙ্কা ছিলো। এমনি পরিস্থিতি দেখে গভর্নর অনন্যোপায় হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য আইন পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন।

 বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের উপর গুলী চালানোর জন্য তীব্র নিন্দা করেন এবং তারই প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন।

 মিলিটারী বাহিনী ফজলুল হক হল, জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও সলিমুল্লাহ হলের মাইকগুলি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সলিমুল্লাহ হলের পশ্চিম দিকস্থ দরজা ভেঙ্গে মিলিটারী বাহিনী প্রায় ৮০ জনের মত কর্মীকে গ্রেপ্তার করে এবং সলিমুল্লাহ হলের ভিতরে আন্দোলনকারীদের যে সেক্রটারিয়েট বসেছিল তার সমস্ত কাগজপত্র হস্তগত করে নেয়। সন্ধ্যাবেলা মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের স্মৃতিস্তম্ভটি মিলিটারী এসে ভেঙ্গে ফেলে।

 জটিলতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ আবার সভা আহ্বান করে। সরকারকে ৭৫ ঘণ্টার চরমপত্র দেয়া হয় এবং ৫ই মার্চ প্রদেশব্যপী “শহীদ দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়; আর আন্দোলনে সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবী করা হয়। ৯ দফা দাবীর ভিত্তিতে সরকারের নিকট নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন দাবী করা হয়।

২৫ শে ফেব্রুয়ারী

 আন্দোলনের চাপে পড়ে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন এবং ছাত্রছাত্রীদের হল পরিত্যাগ করে চলে যাবার জন্য নির্দেশ দেন। তখন আন্দোলনের সমস্ত প্রচারযন্ত্র সরকার কেড়ে নিয়েছে। আন্দোলনকারীদের উপর একপক্ষীয় আক্রমণের ফলে চরম সন্ত্রাসের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল সারা শহরময়। দেখতে দেখতেই আন্দোলনের মূল ৯ জন কর্মকর্তার উপর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়ে গেল। সরকার যথেচ্ছ গ্রেফতার শুরু করল ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের। সংবাদপত্রগুলিও সম্পূর্ণ{রুপে সুর বদলিয়ে আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যা দিতে লাগল। শহরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ফলে আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই আপাতত স্তব্ধ হয়ে গেল।

২৭শে ফেব্রুয়ারী

 রাত্রে পুলিশ এক বাড়ীতে হানা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৯ জন আত্মগোপনকারী নেতার মধ্যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে নেয়।

 ৫ই মার্চ ঢাকা শহরে শহীদ দিবস সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। অসংখ্য মিলিটারী সারা শহরের অলি-গলি বেষ্টন করে রেখেছিল। তবে মফস্বলে ৫ মার্চ শহীদ দিবস পূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল।

 সরকার সারা প্রদেশের দাবীকে অস্বীকার করতে না পেরে এক ভূয়া তদন্ত কমিশন বসান। কিন্তু যেহেতু আন্দোলনের নেতাদের বন্দী করে রেখে সরকারী লোক দিয়েই সে কমিশন গঠিত হয়েছিল, সে জন্য সর্বদলীয় কর্মপরিষদ তা বর্জন করে। ভাষা আন্দোলন এমনি চূড়ান্ত সরকারী দমননীতি চাপে আপাততঃ স্তব্ধ হয়ে গেলেও প্রদেশের জনসাধারণ তাকে ভোলেনি। তার প্রমাণ ১৯৫৩ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক সাফল্য। সারা প্রদেশের মানুষ এই দিন শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসছে। ১৯৬৩ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী এবং তৎপরবর্তী গণ-আন্দোলনের ধারা তারই সাক্ষ্য বহন করে আসছে।

 ভাষা আন্দোলনের ধৃত সকল রাজবন্দীকে অবিলম্বে ছেড়ে দেবেন বলে সরকার কর্তৃক বার বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, জনাব ওলী আহাদ, জনাব তোয়াহা, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক অজিত গুহকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ তাদের শত্রু-গোষ্ঠীর চেহারা চিনে নিয়েছে। আর অমর বীর শহীদরা প্রত্যেকটি মানুষের মনে এক একটি স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে রয়েছে চিরকালের জন্য। এই স্মৃতিস্তম্ভই সকল প্রতিবন্ধকতার প্রচীর ধ্বংস করে নতুন জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এদেশের মানুষের মনে দুর্জয় প্রেরণার সঞ্চার করে চলেছে।[১]

  1. মার্চ ১৯৫৩