বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৬০

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাভাষার পক্ষে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের ঘোষণা ইসলাম ভ্রাতৃসংঘ মে-১৯৫২

ইসলাম, ভাষা সমস্যা ও আমরা

ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ

ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের প্রচার দপ্তদপ্ত

৬নং নয়া পল্টন, ঢাকা হইতে প্রকাশিত

‘আমাদের প্রেস’

১৯নং আজিমপুর রোড হইতে মুদ্রিত।

 ২১শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানের গণজাগরণের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন। পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি অধিবাসী এইদিন দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছে: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।

 কিন্তু কেন এই দাবী? সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর প্রাণের পরতে পরতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল কোন যুক্তির ভিত্তিতে?

 সে যুক্তি একটি নয়, দু’টি নয়, অগণিত। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে, জনসাধারণের সেই সব যুক্ত ইসলামের আলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত।

 প্রতিটি নাগরিকের দেহ এবং মনের সর্বাংগীণ বিকাশ ইসলামী রাষ্ট্রে সর্বপ্রধান লক্ষ্য। ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, মাতৃভাষার সাহায্য ছাড়া এ বিকাশ সাধন করা একেবারেই অসম্ভব। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে জাতীয় উন্নয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে মাতৃভাষার উন্নতিসাধনের মধ্যদিয়ে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) আবির্ভাবের সময় হিব্রু ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী ভাষা হিসেবে পরিগণিত হতো; কিন্তু সাধারণ মানুষের বোধগম্য হওয়ার জন্যই অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষা আরবীতে পবিত্র কোরান শরীফ নাজেল হয়। আরবীর পরিবর্তে সেদিন যদি অন্য কোন ভাষায় কোরান শরীফ নাজেল হতো তবে আরববাসীদের পক্ষে ইসলামের বাণী অতি অল্প সময়ে গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিকার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ঠিক তেমনি করে মাতৃভাষার মাধ্যমে আজ ইসলামী সমাজবাদের বাণী পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার মাধ্যমে এ চেষ্টা করার অর্থ হবে আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত করা।

 ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন হিন্দুদের তুলনায় ঘোর পশ্চাৎপদ ছিল। এর একমাত্র কারণ, ইংরেজ বাংলায় শাসন-বিস্তারের সাথে সাথেই মুসলমানদের মধ্যে ভাষা-সংকট সৃষ্টি করে। রাজভাষা ফারাসীকে বিতাড়িত করে ইংরেজরা সেখানে নিয়ে এল ইংরেজী। সদ্য আজাদীহারা মুসলমানদের ইংরেজী ভাষার প্রতি অবহেলা এবং সর্বব্যাপী অসহযোগিতা ও অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ স্বাভাবিকভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা-সংস্কৃতিতে মুসলমান সম্প্রদায়কে অতিক্রম করে গেলেন।

 এদিকে মুসলমানদের অবস্থা কি? তাঁরা হয়ে রইলেন ‘না ঘরকা না ঘাটকা।’ বাংলাভাষাও ভাল করে চর্চা করলেন না, ইংরেজীকেও বয়কট করলেন। ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বিরাট মুসলিম জাতি অশিক্ষিত মৎসজীবীর পর্যায়ে নেমে আসতে বাধ্য হলেন।

 অন্যদিকে একদল “শেরিফ” সম্পূর্ণভাবে বাংলাভাষাকে বর্জন করবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। একদিকে ইংরেজী বর্জন, অন্যদিকে “শেরিফ” দের বাংলা বর্জন করে উর্দু প্রচলিত করার প্রচেষ্টায় যে বিপর্যয় দেখা দেয় তাতে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

 কিন্তু আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হলো। বিশেষ করে গত ত্রিশ বছর ধরে এই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষিত মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে মাতৃভাষার কদর বুঝতে শিখেছেন এবং ক্রমে ক্রমে বাংলা সাহিত্যের সাধনায় মুসলমানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ নিশ্চিত পথে অগ্রসর হচ্ছিল। বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজও বাংলাদেশে গড়ে উঠল। সরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাংগালী মুসলমানের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা গেল এবং বলাই বাহুল্য, এই নবগঠিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-সভ্যতার বাহন হল বাংলা-উর্দু বা ইংরাজী নয়।

 এরপর এল দেশ বিভাগ। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ আশা করে যে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সাথে সাথে বাংলা ভাষার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের উন্নয়ন আরও ব্যাপক ও সর্বাত্মক হয়ে উঠবে। যে ভাষার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে, সেই ভাষাকে কেন্দ্র করেই পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চলবে, এটা অত্যন্ত ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক কথা; কিন্তু এখানেও একটা সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। ইংরেজ সরকার বাংলাদেশের শাসন হাতে নেবার সাথে সাথেই যেভাবে ভাষাসংকটের সৃষ্টি করে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইংরেজ ফারসী তাড়িয়ে আমদানী করেছিল ইংরেজী, এবার বাংলাকে হটিয়ে দিয়ে আমদানী করার কথা চলছে উর্দু।

 পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে বহিরাগত রাষ্ট্রভাষার স্থায়িত্বের নজীর নেই। ইরান ও তুরস্কের ইতিহাসে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এই ভারত ও পাকিস্তানেও ইংরেজী শিখে বহু ভারতীয় যশের শিখরে আরোহণ করেছেন সত্যি কথা, কিন্তু ইংরেজ চলে যাবার সাথে সাথে ইংরেজী ভাষাকেও এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে হচ্ছে। তার স্থান দখল করতে যাচ্ছে ভারতে হিন্দী এবং পাকিস্তানে বাংলা ও উর্দু।

 বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর লোকের কাছে একটা সস্তা যুক্তি প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে এই যে, বাংলা সংস্কৃতি ভাষা থেকে উৎপন্ন ও হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা পরিপুষ্ট বলে এই ভাষা ইসলামী ভাবধারা প্রচারের উপযোগী নয়। যাঁরা এই যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তাঁদের জানা আছে (এবং না জানলে জানা উচিত) যে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান ভাষা অল্পবিস্তর সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন। উর্দু ভাষায় অজস্র সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কারুর কোন সন্দেহ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে কি উর্দু ভাষার জাত খোয়া গেছে বলতে হবে? আমাদের প্রশ্ন, পবিত্র কোরান শরীফ যে সময় অবতীর্ণ হয়, সে সময় আরবী ভাষা কাদের ভাষা ছিল? পুতুল-পূজারী পৌত্তলিক নাসারাদের নয় কি? যদি তাই হয়, তাহলে আরবী ভাষাকে পবিত্র ভাষায় মর্যাদা দেওয়া হয় কেন? আসলে, ভাষা ভাবপ্রকাশের বাহন মাত্র। ভাব যদি সমৃদ্ধ হয় এবং ভাষা যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে যে কোন সমৃদ্ধ ভাবধারা যে কোন শক্তিশালী ভাষায় প্রকাশ করা চলবে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ভাষা- এই ভাষায় যদি ইসলামী ভাবধারার প্রচার ও প্রসার ঘটা অসম্ভব হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হয় বাংলা ভাষা দুর্বল, নয় ইসলামী ভাবধারারই দুর্বলতা রয়েছে; কিন্তু এ দুয়ের যে কোন একটি স্বীকার করে নেবার প্রগলভতা কারুর আছে কি?

 উর্দু ভাষাকে ইসলামী ভাবধারার অন্যতম বাহন বলা হয়ে থাকে; কিন্তু প্রশ্ন করতে পারি কি, এই উর্দু ভাষাতেই নিরীশ্বরবাদী কম্যুনিষ্ট কাব্য সাহিত্যের প্রচার সম্ভব হচ্ছে কি করে? উর্দু ভাষা যদি এতই সাফ-সুতরা ও পাক-পবিত্র হবে, তাহলে সে ভাষায় কম্যুনিষ্ট সাহিত্য রচনা করা হচ্ছে কেন? বস্তুতঃ বাংলা ইসলামী ভাবধারা প্রচারের অনুকূল ভাষা নয় বলে যাঁরা মতামত দেন, তাঁদের দৃষ্টিশক্তি নিতান্তই একপেশে। ইসলামী ভাবধারা তার নিজস্ব আদর্শের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। পৃথিবীর যে কোন ভাষায় যে কোন যুগে সার্থক রূপায়ণ চলতে পারে।

 বাংলাভাষার ইতিহাস আলোচনা করলে এ সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। বাংলাভাষার প্রাথমিক বিস্তারের মূলে ছিলেন মুসলমান, হিন্দুরা নয়। তৎকালীন বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দের অস্তিত্ব ছিল। নবাব হোসেন শাহের আমলে প্রধানতঃ মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সংস্কৃত-ঘেঁষা রূপ অতি অল্পদিনের ঘটনা। বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা ভাষা থেকে আরবী ফারসী শব্দের প্রায় বিলোপ সাধন করেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপ দেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত সাধন-ঘেঁষা বাংলা আজ হিন্দুসমাজও ব্যবহার করেন না। ভাব ও সংস্কৃতির বিবর্তনের সাথে সাথে বাংলা ভাষায়ও বিবর্তন এসেছে- এই বিবর্তনের মুখে কাজী নজরুল ইসলামের আরবী-ফারসী মধুর আমেজ দেওয়া কাব্য ও ছন্দের রাজা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আরবী-ফারসী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগবিশিষ্ট কবিতা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা পূর্ববাংলার মুসলমানদের মনোজগতে এক বিরাট ভাববিপ্লবের সৃষ্টি করেছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি যদি না করা হয় এবং উপর থেকে কোন কিছু চাপিয়ে দেবার কোন চেষ্টা যদি না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা উর্দু ভাষা থেকেও তার আহরণী-প্রতিভার পরিচয় দেবে, নিঃসেন্দেহে এ আশা আমরা করতে পারি।

 আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবী করতে গিয়ে আমরা হীন প্রাদেশিকতার মনোভাবকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। আমরা বিশ্বাস করি, গোষ্ঠীগত ও দেশগত রূপ ছাড়াও প্রত্যেক মুসলমানের একটি বিশ্বজনীন রূপ আছে- প্রাদেশিকতার পঙ্কিলতায় নিমগ্ন হয়ে আমরা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ দৃষ্টভংগীর পরিপোষকতা করার বিরোধী। সাথে সাথে একথাও বলে রাখা দরকার যে উর্দুকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে আমাদের কোন বক্তব্য নেই। বরং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভাববিনিময়ের প্রয়োজনে আমাদের উর্দু শিখতে হবে। তাই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবীও আমরা সমর্থন করি।

 ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে একের বেশী দুইটি রাষ্ট্রভাষার অস্তিত্ব থাকলে জাতির ঐক্যে ফাটল ধরবে, কেউ কেউ এই অভিমতও পোষণ করে থাকেন। বলা বাহুল্য, এ যুক্তিও ইসলামের আলোকে মেনে নেওয়া চলে না। ঐক্য ঁ(হরুঃ) ও সমতা ঁ(হরভড়ৎসরুঃ) এক হবে, একই ভাষায় কাজ-কারবার করতে হবে, একই ধারায় চিন্তা করতে হবেথ-এ যুক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অচল। বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলন- ইংরেজীতে যাকে বলা হয়, ঁহরুঃ রহ ফরাবৎংরুঃ-সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোই ইসলামের আদর্শ। একমাত্র সাধারণ আদর্শ ও জীবন-নীতির মাধ্যমেই একটি জাতিকে একতাসূত্রে আবদ্ধ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সংগ্রামে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু ভাষা-ভাষী মুসলমানের এগিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশে লীগ ও পাকিস্তানের প্রচার চলেছিল বাংলা ভাষাতেই, মাদ্রাজে মাদ্রাজীতে, উড়িষ্যায় উড়িয়াতে। এতে পাকিস্তানের দাবী দূর্বল না হয়ে বরং জোরালোই হয়েছিল। পাকিস্তান সংগ্রামের অভাবিতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল এই যে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলমানেরা আকৃতিগত, প্রকৃতিগত এবং ভাষাগত বিভেদ সত্ত্বেও একই আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হতে পেরেছিলেন। আজ পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর বাংলা-পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানেরা যদি সমান প্রেরণা নিয়ে হুকুমাতে রববানিয়াৎ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এগিয়ে আসেন, তাহলে ভাষার বিভিন্নতা, প্রাকৃতিক দূরত্ব এবং অন্যান্য অসুবিধা কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারবে না। তা ছাড়া আমরা বিশ্বাস করি আজকের যুগের ভাষার মাধ্যমে নয় বরং একমাত্র আদেশের মাধ্যমেই পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা যদি বাংলা শেখেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ উর্দু শেখেন তাহলে উভয় অংশের জনগণ একে অপরের ভাবধারা, সুখ-দুঃখ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংগে পরিচিত হতে পারবেন এবং উভয় অংশের জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হবে।

 তাই উপসংহারে এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমরা ঘোষণা করতে চাই যে, বাংলাভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরায়নি বরং এক ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে এ আন্দোলন আমাদের এগিয়ে দিয়েছে।

ইসলামী ভ্রতৃসংঘ ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন

 বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে উপরে যেসব যুক্তি দেওয়া গেল, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের কর্মীবৃন্দ মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করে বলেই সাংগঠনিক সমস্ত অসুবিধা অপেক্ষা করেও কর্মীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো।

 এই আন্দোলনে কারাবরণ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হতে তারা মোটেই দ্বিধাবোধ করেনি।

 আমরা বিশ্বাস করি, প্রাদেশিকতার সংকীর্ণ মনোবৃত্তি বা উর্দু ভাষাভাষীদের প্রতি কোনরকম বিদ্বেষের মনোভাব ভাষা আন্দোলনের জন্মদান করেনি। গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পূর্ব-পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি জনসাধারণ বাংলাকে আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন।

 মহান উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে তাকে পার্টিগত বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ রুখে দাঁড়াবে।

 ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে যারা রাষ্ট্রভাসানো আন্দোলনে পরিণত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত প্রহরীরূপে কাজ করে যাবেন পূর্ব-বাঙ্গলার প্রতিটি সন্তান।

 তাই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কাজে সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানের প্রতিটি কল্যাণকামী সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীকে আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাই।