বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৯৯
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচার | পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ | আগষ্ট, ১৯৫৬ |
যুক্ত নির্বাচন প্রথা কায়েম করুন
পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রতি আওয়ামী লীগের আবেদন
আমাদের দেশের নির্বাচন পদ্ধতি কিরূপ হওয়া উচিত যুক্ত নির্বাচন, না পৃথক নির্বাচন, সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে আমরা পূর্বে আপনাদের নিকট দ্বার্থহীন ভাষায় ও বিভিন্ন যুক্তি দিয়া বলিয়াছি যে, পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমরা যুক্ত নির্বাচন প্রথা চাই। এ সম্পর্কে এখন আরও দু একটি কথা আপনাদের খেদমতে হাজির করিতে চাই। কারণ, জনবিরোধী মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম প্রভৃতি নানা অপপ্রচার দ্বারা যুক্ত নির্বাচন প্রথার বিরুদ্ধে জনগণের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিতে চাহিতেছে।
মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম বলিতেছে যে, যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি চালু হইলে পাকিস্তান ধ্বংস হইবে।
ভাইসব, ইহাদের এই কথার জবাবে আমরা শুধু একটি বিষয় আপনাদের সামনে হাজির করিতেছি। কায়েদে আজম হইলেন আমাদের পাকিস্তানের জন্মদাতা। তিনি পাকিস্তানের অমঙ্গল চাহিবেন এমন কথা কোন পাকিস্তানীই মুখে আনিতে পারে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম দিবসেই ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগষ্ট তারিখে স্বাধীন পাকিস্তানের সার্বভৌম গণপরিষদের প্রথম দিনের অধিবেশনে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে সারা দুনিয়ার সামনে ঘোষনা করিয়াছিলেন “কালে হিন্দু আর হিন্দু থাকিবে না এবং মুসলমান থাকিবে না; অবশ্য ধর্মীয় অর্থে নহে; কারণ ধর্ম হইতেছে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কথাটা হইতেছে রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে।”
কায়েদে আজমের উপরোক্ত ঘোষণা হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের ঐ মহান নেতা সম্প্রদায় নির্বিশেষে পাকিস্তানের সমস্ত নাগরিককে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করিয়া একটি নূতন পাকিস্তানী জাতি গড়িয়া তুলিবার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। তাঁহার সে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্যই আমরা যুক্ত নির্বাচন চাই। যুক্ত নির্বাচন প্রথার মধ্য দিয়াই আমাদের রাষ্ট্রের মুসলমান, হিন্দু প্রভৃতি রাজনৈতিক ভেদাভেদ দুর হইবে এবং মুসলমান, হিন্দু প্রভৃতি সমস্ত নাগরিকদের নিয়া পাকিস্তানী জাতি গড়িয়া উঠিবে। ইহাতে পাকিস্তানের সংহতি আরও অটুট হইবে।
আজ যাহারা যুক্ত নির্বাচনের বিরোধিতা করিতেছেন তাহারা কায়েদে আজমের বাণীকে উপেক্ষা করিতেছেন। তাহারা কায়েদে আজমের স্মৃতিকে অবমাননা করিতেছেন এবং তাহারা পাকিস্তানের সংহতি আরও অটুট করিয়া তুলিবার পথে বাধা জন্মাইতেছেন।
মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম আর এক জিগীর তুলিয়াছে যে, যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু হইলে হিন্দুরা মুসলমানদের ভুলাইয়া আইন পরিষদের সমস্ত আসন দখল করিয়া নিবে।
অভিভক্ত ভারতে- যেখানে হিন্দুরা ছিল শতকরা ৭৫ জন এবং যেখানে হিন্দুরা প্রভূত ধন-সম্পদের অধিকারীও ছিল, সেক্ষেএেই যদি হিন্দুগণ মুসলমানদের পাকিস্তানের দাবী হইবে বিচ্যুত করিয়া থাকিতে না পারে, তবে আজ পাকিস্তানে- যেখানে হিন্দুগণ সংখ্যায় শতকরা ১০ জনের বেশী নয়, সেখানে তাহারা কি করিয়া কোটি কোটি মুসলমানকে ভুলাইয়া পরিষদের সব আসন দখল করিয়া নিবে? ইউনিয়ন বোর্ডে ও জেলা বোর্ডে যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রচলিত আছে। সেখানে কি হিন্দুরা সব আসন দখল নিয়াছে? শতকরা ১০ জন হিন্দু কোটি কোটি মুসলমানকে বোকা বানাইয়া দিবে- এরূপ আজগুবি কথা আজ যাহারা বলিতেছেন, মুসলমান সমাজের উপর তাহাদের কো আস্থা নাই। কাজেই মুসলমান সমাজও তাহাদের বিশ্বাস করিতে পারে না।
সরল, ধর্ম বিশ্বাসী মুসলমান ভাইদের মনে বিভ্রান্তি জন্মাইবার জন্য ঐ মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম গলাবাজি করিতেছে যে, যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু হইলে ইসলামের খেলাপ হইবে।
কিন্তু, ভাইসব! মিসর, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্রে যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু আছে। তাহাতে সে সব দেশে ইসলামের খেলাপ হয় নাই। আমরা যুগ যুগ ধরিয়া ইউনিয়ন বোর্ড ও জেলা বোর্ডের নির্বাচনে যুক্ত নির্বাচন প্রথায় ভোট দিতেছি। তাহাতেও আমাদের ধর্মের হানি হয় নাই। আজ আইন পরিষদের নির্বাচনে যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু হইলেই ইসলামের খেলাপ হইবে কেন?
পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের দিকটাও আজ আমাদের ভাবিয়া দেখা দরকার। গত ৯ বৎসর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এই অবিচার করিয়াছে। আজ কেন্দ্রীয় আইন সভার আসন বণ্টনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর সংখ্যাসাম্য নীতিও চালু রহিয়াছে। এই অবস্থায় যদি পৃথক নির্বাচন প্রথা চালু থাকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান ও সংখ্যালঘুদের ভিতর ভেদাভেদের সুযোগ নিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ প্রতিক্রিয়াশীলরা যদি কয়েকজন দালালকে হাত করিতে পারে, তবে তাহারা চিরদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের উপর অবিচার চালাইয়া যাইবে। বস্তুতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে দমিত করিয়া রাখার জন্যই প্রতিক্রিয়াশীলরা পৃথক নির্বাচন চাহিতেছেন ইহাদের এই চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্যও আজ যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করা প্রয়োজন।
যে মুসলিম লীগ গত ৯বৎসর যাবৎ সব দিক দিয়াই আমাদের সর্বনাশ করিয়াছে সেই মুসলিম লীগ ও তার দোসর নেজামে ইসলাম এখনও সাম্প্রদায়িকতার উপর নির্ভর করিয়াই বাঁচিয়া থাকিতে চাহিতেছে। সেজন্যই তাহারা পৃথক নির্বাচন চাহিতেছে।
কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা দেশের বহু ক্ষতি করিয়াছে। দেশের মঙ্গলের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে আজ দূর করা প্রয়োজন। সেজন্যই, আমরা চাই যুক্ত নির্বাচন। যতদিন দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকিবে, হিন্দু-মুসলমানে রাজনৈতিক ভেদাভেদ থাকিবে, ততদিন দেশে সুস্থ গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা দূর করিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও আজ যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু করা অপরিহার্য। সকলে ঐক্যবদ্ধ শক্তি দ্বারা যুক্ত নির্বাচনের দাবীকে অমোঘ করিয়া তুলুন। সকলে মিলিয়া আওয়াজ তুলুন—
- কায়েদে আজমের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য যুক্ত নির্বাচন চাই।
- পাকিস্তানের সংহতি অটুট করার জন্য যুক্ত নির্বাচন চাই।
- সাম্প্রদায়িকত ভেদাভেদ দুর করার জন্য যুক্ত নির্বাচন চাই।
- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্ত নির্বাচন চাই।
- পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য যুক্ত নির্বাচন চাই।
পূর্ব পাক আওয়ামী লীগের পক্ষে জনাব আনুল হাই কর্তৃক ৫৬ নং সিমসন রোড, ঢাকা হইতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পাইওনিয়ার প্রেস, ঢাল।