বাংলাভাষা-পরিচয়/২২
২২
চলতি বাংলার আর-একটি বিশেষত্ব জানিয়ে দিয়ে এ বই শেষ করি। যাঁরা সাধু ভাষায় গদ্যসাহিত্যকে রূপ দিয়েছিলেন স্বভাবতই তাঁদের হাতে বাক্যবিন্যাসের একটা ধারা বাঁধা হয়েছিল।
তার প্রয়োজন নিয়ে তর্ক নেই। আমার বক্তব্য এই যে, এ বাঁধাবাঁধি বাংলা চলতি ভাষার নয়।
কোথায় গেলেন তোমার দাদা, তোমার দাদা কোথায় গেলেন, গেলেন কোথায় তোমার দাদা, দাদা তোমার গেলেন কোথায়, কোথায় গেলেন দাদা তোমার: প্রথম পাঁচটি বাক্যে ‘গেলেন’ ক্রিয়াপদের উপর, এবং শেষের বাক্যটিতে ‘কোথায়’ শব্দের উপর ঝোঁক দিয়ে এই সবকটা প্রয়োগই চলে। আশ্চর্য তোমার সাহস, কিংবা, রেখে দাও তোমার চালাকি, একেবারে ভাসিয়ে দিলে কেঁদে: সাধু ভাষার ছাঁদের চেয়ে এতে আরও বেশি জোর পৌঁছয়। যা থাকে অদৃষ্টে, যা করেন ভগবান, সে প’ড়ে আছে পিছনে: এ আমরা কেবল-যে বলি তা নয়, এইটেই বলি সহজে।
বাংলা ভাষার একটা বিপদ তার ক্রিয়াপদ নিয়ে; ‘ইল’ ‘তেছে’ ‘ছিল’ -যোগে বিশেষ বিশেষ কালবাচক ক্রিয়ার সমাপ্তি। ক্রিয়াপদের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি এড়াবার জন্যে লেখকদের সতর্ক থাকতে হয়। বাংলা বাক্যবিন্যাসে যদি স্বাধীনতা না থাকত তা হলে উপায় থাকত না। এই স্বাধীনতা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বৈরাচার নেই। ‘ভাসিয়ে একেবারে দিলে কেঁদে’ কিংবা ‘ভাসিয়ে দিলে একেবারে কেঁদে’ বলি নে। ‘সে প’ড়ে সবার আছে পিছনে’ কিংবা ‘রেখে চালাকি দাও তোমার’ হবার জো নেই। তার কারণ জ়োড়া ক্রিয়ার জোড় ভাঙা অবৈধ।
চলতি গদ্যের একটা নমুনা দেওয়া যাক। এতে সাধু, গদ্যভাষার বাক্যপদ্ধতি অনেকটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে—
কুঞ্জবাবু চললেন মথুরায়। তাঁর ভাই মুকুন্দ যাবে স্টেশন পর্যন্ত। বৈজু দারোয়ান চলেছে মাঠাকরুনের পাল্কির পাশে পাশে, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, ছিটের মেরজাই গায়ে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ঘর সামলাবার জন্যে রয়ে গেছে ভরু সর্দার। টেমি কুকুরটা ঘুমোচ্ছিল সিমেণ্টের বস্তার উপর ল্যাজে মাথা গুঁজে, গোলমাল শনে ছুটে এল এক লাফে। যত ওরা বারণ করে ততই কেঁইকেঁই ঘেউ-ঘেউ রবে মিনতি জানায়, ঘন ঘন নাড়ে বোঁচা ল্যাজটা। রেল লাইন থেকে শোনা যাচ্ছে মালগাড়ি আসার শব্দ। ডাকগাড়ি আসতে বাকি আছে বিশ মিনিট মাত্র। বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুকুন্দ; সে যাবে কলকাতার দিকে, আজ সেখানে মোহনবাগানের ম্যাচ। ঐ বুঝি দেখা গেল সিগ্ন্যাল-ডাউন। এ দিকে নামল ঝমাঝম্ বৃষ্টি, তার সঙ্গে জোর হাওয়া। বেহারাগুলো পাল্কি নামালো অশথতলায়। হঠাৎ একটি ভিখিরি মেয়ে ছুটে এসে বললে, ‘দরজা খোলো মা, একবার মুখখানি দেখে নিই।’ দরজা খুলে চমকে উঠলেন গিন্নিঠাকরুন, ‘ওমা, ও কে গো! আমাদের বিনোদিনী যে! কে করলে ওর এ দশা!’ কুকুরটা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল, ওর বু’কে দুই পা তুলে কাঁই-কাঁই করতে লাগল আনন্দে। বিনোদিনী একবার তার গলা জড়িয়ে ধরল দুই হাতে, তার পরেই ওকে সরিয়ে দিল, জোরে ঠেলা দিয়ে। গোলেমালে কোথায় মেয়েটি পালালো ঝড়ের আড়ালে, দেখা গেল না। চারি দিকে সন্ধানে ছটল লোকজন। বড়োবাবু স্বয়ং হাঁকতে থাকলেন ‘বিন্দু বিনু’, মিলল না কোনো সাড়া। মকুন্দ রইল তার সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়িতে, রুমালে মুখ লুকিয়ে একেবারে চুপ। মেলগাড়ি কখন্ গেল বেরিয়ে। বৃষ্টির বিরাম নেই।