বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/কাঠঠোক্‌রা

৮৬ পৃঃ
কাঠঠোক্‌রা
কাঠঠোক্‌রা

আমাদের দেশে বর্ণসুষমায় সমৃদ্ধ যে কয়টি পাখী আছে, তন্মধ্যে কাঠঠোকরা একটি। তবে অনেকের ইহার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় নাই, কেন না এই পাখী বৃক্ষবিহারী হওয়ায় বেশীর ভাগ সময় ইহারা বনমধ্যে বা ছায়াঘন কাননমধ্যেই থাকে। আমরা কয়জন কষ্ট স্বীকার করিয়া বিহঙ্গদের আচরণ লক্ষ্য করি?

 ইহাদের আহার অন্বেষণপ্রণালী কৌতুহলোদ্দীপক। যে গাছটাকে সাময়িকভাবে শিকারক্ষেত্র করে, তাহাতে প্রথমে প্রায় মূলদেশে যাইয়া বসে এবং গাছের কাণ্ডে চঞ্চুদ্বারা হাতুড়ীর মত ঘা দিতে দিতে ক্রমশঃ উর্দ্ধদিকে অগ্রসর হয়। কখনও কখনও সড়াৎ করিয়া খানিকটা নামিয়া আবার উঠিতে থাকে। এইরূপে যখন একটা গাছের শীর্ষে আসিয়া পৌছে তখন উড়িয়া আর একটি গাছের নিম্নদেশে যাইয়া তাহারও অগ্রভাগের দিকে ক্রমশঃ অগ্রসর হয়।

 প্রাণীজগতে কীটপতঙ্গ ও জীবাণুর সংখ্যা করা যায় না। অন্য যে কোনও জীবের তুলনায় এরা লক্ষগুণ বেশী। যদি এই সব কীটপতঙ্গের বিনাশের ব্যবস্থা বিধাতা না করিতেন, তবে এ পৃথিবীতে মানুষ টিঁকিয়া থাকিতে পারিত না। খেচর জগতের প্রাণীরা, অর্থাৎ পাখীরা, বহু লক্ষ কীট প্রতিদিন উদরসাৎ করিয়া, এই পৃথিবীকে মামুষের বাসোপযোগী করিয়া দেয়।

 পাখী যে তার বিচিত্র বর্ণ বা সুমধুর সঙ্গীতে শুধু আমাদের চিত্তবিনোদনের জন্য সৃষ্ট হইয়াছে তাহা নহে। আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবং আমাদের বাণিজ্যসম্পদ সংরক্ষণে সাহায্য করে বলিয়াই ইহাদের নিকট সকল মনুষ্যসমাজ কৃতজ্ঞ।

 এক এক জাতীয় পাখী এক এক প্রকার কীট ধ্বংস করে। আবাবিল, বাঁশপাতি প্রভৃতি উড্ডীয়মান কীট পতঙ্গ শিকার করে। ফিঙ্গেও বেশীর ভাগ তাই করে, তবে সে ভূচর কীটও ছাড়িয়া দেয় না। শালিক, হুপো, নীলকণ্ঠ, দোয়েল—এরা ভূপৃষ্ঠে-বিচরণ-কারী ষট্‌পদী কীটাদি দ্বারা জীবনধারণ করে। কাঠ্‌ঠোকরা কেবল বৃক্ষাদিতে, গাছের ত্বকের অভ্যন্তরে যে সব কীট থাকে তাহাই খায়। এই সব কীট টানিয়া বাহির করিয়া ধ্বংস করিবার জন্যই যেন বিশ্বকর্ম্মার কারখানায় ফরমাইস দিয়া বিধাতা এর অবয়ব গঠিত করিয়াছেন।

 ইহাদের জিহ্বাটি দীর্ঘ, লিক্‌লিকে এবং আঠাযুক্ত। উহার অগ্রভাগ আবার করাতের মত কণ্টকিত। গাছের বাকলের ভিতরে বা কোনও সরু গর্ত্তমধ্যে কীট আসিলে এর জিহ্বাটি তন্মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেয় এবং জিহ্বার আঠায় কীটটি জড়াইয়া গিয়া একটানে পাখীর মুখগহ্বরে আসিয়া উপস্থিত হয়। যখন কোনও কীট তাহার জিহ্বার নাগালেরও বাহিরে থাকে, তখন বৃক্ষকাণ্ডের উপরিভাগে চঞ্চুটির দ্বারা সবলে আঘাত করে। গর্ত্তমধ্যস্থ কীট ভয় পাইয়া বাহিরে আসিতে চেষ্টা করা মাত্র কাঠঠোক্‌রার “জিহ্বায়ত্ত” হয়। পিঁপড়ে, উই ও ঘুন জাতীয় যে সমস্ত কীট কাঠ নষ্ট করে তাহদের বিলোপ সাধন করিয়া কাঠঠোক্‌রা মানুষের উদ্ভীদসম্পদ রক্ষা করিতে সাহায্য করে। সুতরাং মানুষের কাছে ইহাদের একটা বিরাট অর্থনৈতিক মূল্য আছে।

 খাদ্য অন্বেষণ করিবার সময় পদদ্বয় যথাসম্ভব ফাঁক করিয়া তীক্ষ্ণ নখদ্বারা বৃক্ষগাত্র আঁকড়াইয়া ধরে এবং সুদৃঢ় হ্রস্ব লেজটি গাছের গায়ে লাঠিতে ভর দিবার মত চাপিয়া ধরে। তাহার পর দীর্ঘ গ্রীবাটি পশ্চাৎদিকে যথাসম্ভব লইয়া গিয়া সম্মুখভাগে সজোরে হাতুড়ীর মত চালিত করে। সুদৃঢ় চঞ্চুর আঘাতে যে শব্দটি উত্থিত হয় তাহা বেশ উচ্চ। এই উচ্চ ঠক্ ঠক্ ধ্বনি বাংলার পল্লীকাননে দিনের বেলা প্রায়ই শ্রুত হয়।

 যখন নীড়রচনার সময় আসে, তখন বৃক্ষকাণ্ডের নানাস্থানে ঘা মারিয়া ফাঁপা জায়গা খুঁজিয়া বেড়ায়। ফাঁপা স্থান পাইলে চঞ্চুটিকে কুড়ালীর মত ব্যবহার করিয়া পুনঃ পুনঃ আঘাত পূর্ব্বক অতি পরিপাটি সুগোল প্রায় তিন ইঞ্চি ব্যাসের একটি গর্ত্ত খনন করে। কোনও নিপুণ ছুতারও বোধহয় ওরূপ নিখুঁত গোলাকার গর্ত্ত কাঠে খুদিয়া উঠিতে পারে না। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসেই শাবক-উৎপাদনে তৎপর হয়। এই সময়ে ইহার চঞ্চুর আঘাতজনিত উচ্চ ঠকঠক্‌ ধ্বনিতে বাগান মুখরিত হইয়া উঠে।

 গাছের বিবর খননেই ইহারা যত নিপুণতা প্রকাশ করে। কিন্তু কোটরটির মধ্যভাগে কোনও প্রকার শয্যারচনা করে না। পাখীরা প্রায়শঃই নানারূপ দ্রব্য দিয়া নীড় আস্তৃত করিয়া একটি গদির মত ডিম্বাধার রচনা করে। কিন্তু ইহারা বৃক্ষকোটরের শক্ত মেজেই ডিম্ব ও শাবকের জন্য পর্য্যাপ্ত মনে করে। ইহাদের ডিম শ্বেতবর্ণের এবং সংখ্যায় এক একবারে তিনটি করিয়া হয়।

 সচরাচর যে কাঠঠোক্‌রা আমরা দেখিতে পাই তাহার পুরুষপাখীটির মস্তক ও ঝুঁটি উজ্জ্বল লাল। পৃষ্ঠের সম্মুখভাগ উজ্জ্বল পীতবর্ণ পশ্চাতের অংশ ও পুচ্ছ কৃষ্ণবর্ণ। ডানার পালক শ্বেত ও পীতবর্ণ এবং তদুপরি শ্বেত ফুটকিও থাকে। ঘাড়ের দুইপাশ শ্বেত হইলেও বহু কালো রেখায় বিচিত্রিত। স্ত্রীপাখীর দেহের বর্ণ পুরুষের মত, শুধু মস্তকটি কালো এবং তদুপরি শুভ্র রেখার ত্রিকোণ আঁকা। ইহাদের গ্রীবা দীর্ঘ হয়। প্রকৃতির খেয়ালে এই ব্যবস্থা কেন, তাহার কারণ বোধহয় আর ব্যাখ্যা করিয়া বলিতে হইবে না। ইহারা আদৌ সামাজিক পাখী নহে। একই বাগানে একটা বা একজোড়া পাখী ছাড়া অন্য কাঠঠোক্‌রাকে দেখা যায় না।

 ইহারা ঘনসন্নিবিষ্ট কাননমধ্যে নিকটবর্ত্তী গাছ হইতে গাছে উড়িয়া বেড়ায় বলিয়া, খুব বেশীদূর একটানা উড়িয়া যাইবার ক্ষমতা বিধাতা ইহাদিগকে দেন নাই। উড়িবার সময় ডানা দুইটি এত দ্রুত সঞ্চালিত হয় যে তাহার ফরফর ধ্বনি বেশ স্পষ্ট শুনা যায়। খানিকটা উড়িয়াই ইহাদিগকে নিম্নাভিমুখে যাইতে হয়, কেন না গাছের মূলদেশের দিকই ইহাদের গন্তব্য স্থান। সুতরাং পক্ষদ্বয় খুব দ্রুত কয়েকবার বিধূনিত করিয়া গুটাইয়া লইয়া শূন্যপথে যেন সে ডুব দেয়। একটু অপেক্ষাকৃত দূরে যাইতে হইলেও সে সোজা উড়িয়া যায় না, খানিকটা সোজা উড়িয়া পাখা গুটাইয়া একবার “ডাইভ” করিয়া আবার ডানা মেলিয়া ঊর্দ্ধদিকে নিজেকে উৎক্ষিপ্ত করে। এইরূপে উঠিয়া পড়িয়া অগ্রসর হওয়া ইহার স্বভাব। ডানার উপরে ইহাদের গতি খুব স্বচ্ছন্দ বলিয়া বোধ হয় না, মনে হয় যেন উড়িতে ইহাদের কষ্ট বোধ হইতেছে।

 পাখীরা সচরাচর যেভাবে শাখার উপর উপবেশন করে ইহারা সেরূপ করেনা। অন্যান্য পাখী শাখার উপর আড়াআড়ি ভাবে বসে। ইহার লম্বালম্বী ভাবে শাখাটিকে আঁকড়াইয়া ধরে, উপবেশন করে বলিলে ভুল হইবে। কোনও ডালের নিম্নভাগে ঐরূপে আঁকড়াইয়া বেশ অবলীলাক্রমে ডাল বাহিয়া মাথার দিকে বা লেজের দিকে দুইদিকেই বেশ দ্রুতগতিতে চলিতে পারে।

 ইহারা আত্মগোপনপ্রয়াসী পাখী নহে। ইহাদের খাদ্য অন্বেষণের ধারা ও উজ্জ্বল বর্ণ সে পথে মস্ত বাধা। সেইজন্য ইহাদের কণ্ঠে বিধাতা তীব্র ধ্বনি দান করিয়াছেন। ইহাদের কণ্ঠধ্বনিতে উদারা হইতে তারা পর্য্যন্ত সব পর্দ্দাই ধ্বনিত হয়। মাছরাঙার ধ্বনির সঙ্গে ইহাদের কণ্ঠধ্বনির সাদৃশ্য আছে। তবে ইহাদের স্বর আরও উচ্চ, তীব্র ও কর্কশ, কাণে আসিয়া যেন বিঁধে। উড়িতে উড়িতে চিৎকার করাই ইহাদের অভ্যাস। ইহাদের ডাককে হ্রেষা রব বলিলেই সঙ্গত হয়। গাছে উপবেশন করিয়া ইহারা ডাকে না।

 ইহার পৃষ্ঠদেশের উজ্জ্বল পীতবর্ণের জন্য ইংরেজ লেখকগণ ইহাকে “গোল্ডেন ব্যাকড উড পেকার” বলিয়া বর্ণনা করেন। ভারতবর্ষের সমতলভূমিতে এই একটীমাত্র কাঠঠোক্‌রা একমেবাদ্বিতীয়ম্ হইয়া আছে। পার্ব্বত্য অঞ্চলে অবশ্য কয়েকটী বিভিন্ন প্রকারের অদ্যবিধ গাত্রবর্ণের কাঠঠোক্‌রা আছে।