বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/ছাতারে বা সাতভাই
“সাত ভাই” শুদ্ধ নাম, চলিত নাম “ছাতারে”। ইংরেজ নামকরণ করেছে সেভেন সিসটার্স। ভাইই হউক আর বোনই হউক, ইহা ঠিক যে ইহারা একা কখনও থাকে না। অনেকগুলি পাখী একত্র থাকাই ইহাদের প্রকৃতিগত। সংখ্যায় পাঁচটি হইতে সাতটি পর্য্যন্ত পাখী এক একটি দলে দেখা যায়। সুতরাং ইহারা খুব সামাজিক পাখী তাহা বলাই বাহুল্য। ইহাদের সামাজিকতা ও সঙ্ঘবদ্ধতার কারণটাও সহজেই অনুমেয়। পাখীটির দিকে চাহিলেই দেখা যাইবে যে ইহার শরীরের যেন বাঁধুনি নাই। চেহারা ঢ্যাপসা, নাদুসনুদুস, পালকগুলি যেন কোনও মতে শরীরে লাগিয়া আছে। বিশেষতঃ পুচ্ছটি নড়বড় করিতেছে, যেন আলগোছে শরীরের সঙ্গে লাগান রহিয়াছে, একটু নাড়া দিলেই খসিয়া পড়িবে। কোনও আমিষাশী শিকারী পাখীর কবলে পতিত হইলে এই অল্প-প্রাণ ক্ষীণজীবী পাখী প্রাণের জন্য মোটেই সংগ্রাম করিতে পরিবে না। সুতরাং দলবদ্ধ হইয়া থাকা ছাড়া ইহাদের উপায় নাই—তবু নিশ্চিন্ত, নিঃশঙ্কভাবে চরিয়া বেড়ান যায়। গুপ্ত আততায়ীর অকস্মাৎ আক্রমণের হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য অনবরত সতর্ক থাকিয়া একাকী আহার অন্বেষণ করা সহজ নহে। তাহাতে উদরপূর্ত্তি করিয়া খাওয়া হয় না, এবং যাহা খাওয়া যায় তাহাও বোধহয় হজম হয় না। কিন্তু দলবদ্ধ হইয়া থাকিলে, ছয় সাত জোড়া চোখ যেখানে অনবরত চারিদিকে লক্ষ্য রাখিতেছে, সেখানে কোনও আততায়ী সহসা আক্রমণ করিবার বড় একটা সুযোগ পায়না। ইহাদের চলাফেরার মধ্যে, বা কণ্ঠধ্বনির মধ্যে, এমনই একটা ইঙ্গিত আছে যাহা দ্বারা কোনও একটি পাখীর সাড়াতেই সব পাখী সচকিত হইয়া এক সঙ্গে সাবধানতা অবলম্বন করে। শালিকের মধ্যেও এই রূপ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কোনও স্থানে হয়তো অনেকগুলি শালিক ইতস্ততঃ খাদ্য অন্বেষণ করিতেছে। সহসা একটি শালিক হ্রস্ব শব্দ করিয়া উড্ডীন হইল। শালিক পাখা মেলিবামাত্র তাহার ডানার শ্বেতবর্ণ অত্যন্ত স্পষ্ট হইয়া উঠে। বোধহয় এই শ্বেতবর্ণ নিশানা দেখিয়াই—তৎক্ষণাৎ আশে পাশে অবস্থিত সবকয়টি শালিক সামরিক শৃঙ্খলার সহিত ভূমি হইতে উখিত হয়। ছাতারের এরূপ কোনও বর্ণনিশান নাই। হয়তো ভাষার সাহায্যেই তাহারা সম্মিলিত গতি ও চলাফেরা নির্দ্ধারণ করে। ইহাদের দেহের বর্ণ নিরবচ্ছিন্ন নিষ্প্রভ ধূসর। তার মধ্যে শ্বেতবর্ণের চক্ষু দুটি সুস্পষ্ট দেখা যায়। নিষ্প্রভ সাদা চঞ্চু ও পদদ্বয় দেখিলে মনে হয় রক্তহীনতায় ভূগিতেছে।
পাপিয়া দেখিলে ছাতারে পাখী খেপিয়া যায় এবং সকলে তারস্বরে চিৎকার করিতে করিতে তাহাকে তাড়া করে। কেন করে, সে কথা কোকিল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হইয়াছে। কাক যেমন কোকিলের চৌর্য্যবৃত্তি ধরিতে পারে না, অথচ কোকিল দেখিলেই তাড়া করে, ছাতারেও অনুরূপ কারণে পাপিয়া দেখিলে অকথ্য গালাগালি দিতে দিতে তার পশ্চাদ্ধাবন করে। পাপিয়া প্রহারের ভয়ে না হোক, বাক্যবাণের ধারাপাতে অতিষ্ঠ হইয়া পৃষ্ঠভঙ্গ দেয়।
অনেক সময় এই নিরীহ পাখীর বাসা হইতে ইহাদের ডিম্ব ও শাবককে বায়স, হাঁড়িচাচা প্রভৃতি দুরাত্মারা অপহরণ করে। ঐ সব বলিষ্ঠ গুণ্ডাদের সঙ্গে এক পারিয়া উঠা যায় না; দল বাঁধিয়া থাকিলে উক্ত প্রকার আপদের হাত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। একাকী যেখানে সাহস দেখান যায়না, দলে ভারী থাকিলে অনেক দুর্ব্বলও সেখানে বীর হইয়া উঠে। ছাতারে পাখীও দলবদ্ধভাবে মাঝে মাঝে বেশ দুঃসাহস দেখাইয়া থাকে। ফ্রাঙ্ক ফিন্ সাহেব বলেন যে তাঁহার জনৈক বন্ধুর একটি পোষা শিকারী বাজ একদিন এক ছাতারে পাখীকে গ্রেফ্তার করে। দলের অন্যান্য ছাতারে অমনিই অকুতোভয়ে সেই বাজের উপর আপতিত হইয়া সঙ্গীকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাইতে সক্ষম হয়।
ছাতারে দল বাঁধিয়া কেন থাকে, তাহা বুঝা গেল। কিন্তু এ সম্বন্ধে কতকগুলি প্রশ্ন উঠে। একটি দলের সবকয়টি ছাতারেই কি এক মায়ের সন্তান, এক পরিবারভুক্ত—এক বংশের? অথবা বিভিন্ন পিতামাতার সন্তান বড় হইয়া দল বাঁধিয়া দুই তিনটি দম্পতি একত্র বাস করিতেছে? ইহাও কি সম্ভব নয় যে ইহারা একটি কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবার, এক ভর্ত্তা আধ ডজন পত্নী লইয়া ঘর সংসার করিতেছে? কিংবা এক দ্রৌপদীর সহিত পাঁচ কি ছয় পাণ্ডব বাস করিতেছে? ইহার কোনও প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় না। সেরূপভাবে ইহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কেহ লিপিবদ্ধ করেন নাই।
যে সকল পাখী বৎসরের অধিককাল দল বাঁধিয়া বাস করে, তাহারাও প্রায়শঃ প্রজনন ঋতুতে জোড়া বাঁধিয়া পৃথক হইয়া যায়। নীড় নির্ম্মাণ, ডিম পাড়া, ডিমে তা দেওয়া এবং শাবককে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া বড় করিয়া তাহার পর আবার সকলে পুনর্ম্মিলিত হয়। কিন্তু ঐসকল কাজের সময় কেহ কাহারও সঙ্গে মিশে না, স্ত্রীপুরুষই উহা সম্পন্ন করে। ছাতারে কিন্তু প্রসবঋতুতেও একত্র থাকে। যদি ছয় সাতটি পাখীর দলে দুইটি কি তিনটি দম্পতি থাকে, তাহার কি ভিন্ন ভিন্ন বাসা নির্ম্মাণ করিয়া পৃথক পৃথক গৃহস্থালী পাতে, না সকলে মিলিয়া একই বাসায় ডিম্ব রক্ষা করে? ইহারা যে কমিউনিজমের পক্ষপাতী তাহা সম্ভব হইলেও হইতে পারে, কারণ কোনও কোনও ছাতারের বাসায় উর্দ্ধসংখ্যায় আটটি ডিমও পাওয়া গিয়াছে। একটি ছাতারে তিনটি কি চারটির বেশী ডিম পাড়িতে পারে না। ডেওয়ার সাহেব লিখিয়াছেন যে তিনি তিনটি ছাতারে পাখীকে আহার লইয়া একই নীড়ে গিয়া বাচ্চাদের খাওয়াইতে দেখিয়াছেন।
ছাতারে পাখী অতি সঙ্গোপনে ঝোপে ঝাপে, ঘন পত্রবীথি মধ্যে বা খুব পল্লব-বহুল বৃক্ষে লুকাইয়া বাসা নির্ম্মাণ করে। এই কারণে ইহার বাসা খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। ইহারা আবার নীড়ের ঠিকানা গোপন করিবার জন্য বেশ চাতুরী অবলম্বন করে। সাধারণতঃ প্রজননঋতুতে পাখীর বাসার সন্ধান পাওয়া সহজ। প্রায় সারা দিনই ইহারা আহার সংগ্রহ করিয়া মুহূর্ম্মুুহূ শাবকদের খাওয়ায়। সুতরাং একটু ধৈর্য্য সহকারে লক্ষ্য করিলেই তাহার বাসা সে নিজেই একরূপ দেখাইয়া দেয়। কিন্তু ছাতারে যদি দেখে যে কেহ তাহার গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে তাহা হইলে সে কিছুতেই বাসায় ফিরিবে না। জনপাঁচ ছয়ের কোন্টিকে আপনি অনুসরণ করিবেন? যেটিকে আপনি অনুসরণ করিলেন, সে এদিক ওদিক উড়িতে উড়িতে আপনাকে উল্টা দিকে অনেক দূর লইয়া যাইবে, তৎপর পলায়ন করিবে। আমি এভাবে অনেকবার অপদস্থ হইয়াছি। পাঠককে চেষ্টা করিতে অনুরোধ করিতেছি।
সারাদিন কলরব-পরায়ণ এই পাখীকে পূর্ব্ববঙ্গের কোনও কোনও অঞ্চলে “ফেচো” বলে,—বোধ হয় অনবরত ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করে বলিয়া। ইহার কোলাহলপ্রিয়তার জন্য ইংরাজিতেও ইহাদের আর একটি নাম আছে, ব্যাব্লার।